না, শেষ ইন্টারভিউটাও বাঁধল না। যেন একটা চিল ভেসে উঠল আকাশে। মাথার উপর, অপেক্ষমাণ। ছেলেটা চুপ। একটা বিড়ি ধরাল। ফুটপাতটা ধরে একমুখ ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে হাঁটতে লাগল। পিছন পিছন সেই চিল।

শিয়ালদা স্টেশনে এলো, বাড়ি ফিরবে।

এভাবে ফিরিয়ে দেওয়াকে কী বলে? সে কিন্তু এবার সত্যিই খুব খেটেছিল। যোগাযোগ জুটেছিল একটা। দাদার বড় শ্যালক নাকি পার্টি করেন। লম্বা হাত। সেই হাতের মুঠোয় ঠেলে দেওয়া হয়েছিল তাকে। মানে ভাইভা দেওয়ার জন্য লোকটির সল্টলেকের বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল। অমনি কী সপাং সপাং কথার শব্দ! বলে ওঠেন, ‘ইংরাজি-টিংরাজি জানো কিছু?’

‘ইংরাজি? হ্যাঁ, মানে …’ 

সপাটে ধমক, ‘এত তোতলাও কেন বলো তো!’

দাঁতে দাঁত বসে ছেলেটির। মাঢ়ি শক্ত হয়। তারপর হাসে, আপ্রাণ হাসার চেষ্টা করে। তাকে যে এই শেষ ইন্টারভিউটা বাঁধাতেই হবে। স্থানীয় ভবঘুরে বিভাগের চাকরি। অনেকেই পাশ করেছিল রিটেনে। কিন্তু আসন সীমিত। দাদার শ্যালককে দিয়ে তাই লাইনঘাট করা। তাঁরই সঙ্গে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল। একজন এক্সপার্ট তাঁর চেনা। কিছু কথাও হয়ে আছে সেই সূত্রে। অতএব ইন্টারভিউ দিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে বাড়ির সবাই একপ্রকার নিশ্চিত, এবার সে চাকরিটা পাচ্ছেই। পাবেই। সেই মতো শ্যালকেরই এক বিশেষ যোগাযোগে আজ সে কলকাতার একটা অফিসে গিয়েছিল একজনের সঙ্গে দেখা করতে। ইন্টারভিউটার আগাম ফলাফল জানতে। কিন্তু না, হলো না।

পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন। মাইকে ঘোষণা করছে। উদ্বেগ নেই, ছেলেটি এরকম হাঁটছে। শিয়ালদা স্টেশন থেকে এ-সময় সিট পাওয়া যায়। আর যাবেও যখন একেবারে লাস্ট স্টেশন বনগাঁ, কিছুটা ফাঁকা একটা বগিতে উঠে জানালার ধারে চলে গেল। খানিক বাদেই ট্রেন ছাড়ল। জানালার কোণটায় মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকল সে। শরীরটা এ কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে …। এই অবস্থায় সে তার অতল মনটা ছাড়া আর কাকেই বা আঁকড়াতে পারত। বাড়ি-সমাজ-স্বজন, মনে মনে যাকেই ধরতে যায়, পিছলে যায়। যেতে যেতে পূর্বার মুখটা ভেসে উঠল। 

পূর্বা পাশের পাড়ায় থাকে। একটা লাইব্রেরিতে বই পাল্টাতে গিয়ে আলাপ। দুজনেই ঘনঘন বই পাল্টাত। দেখা হতো। একদিন দ্রুত পড়া একটা বই জমা দিচ্ছিল ছেলেটি, পূর্বা পাশে দাঁড়িয়ে হঠাৎই কথা বলে ওঠে, ‘বেশি পড়লে কিন্তু মানুষ একা হয়ে যায়।’ ছেলেটি তাকায়। তারপর উত্তর করে, ‘উল্টোও হতে পারে।’

‘মানে?’

‘বই যার সঙ্গী, তাকে একা করা যায় না।’

পূর্বা থমকায়। চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় থাকেন আপনি?’

সেই শুরু। এরপর মাঝেমধ্যে দেখা হলেই একটু কথা, বই নিয়ে আলোচনা, একে অন্যের বই নিয়ে একটু পাতা উল্টানো। এভাবে হঠাৎই একদিন পূর্বার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যায়। শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। ছেলেটির শুধু সেই জীবনসংগ্রাম, ফরম ফিলাপ, একের পর এক চাকরির পরীক্ষা। কিন্তু বছর দেড়েকও কাটল না, পূর্বা দাউদাউ করে ধরে গেল। একদিন পড়ন্ত বেলায় মুখে ভাত তুলতে যাবে, দেওরটা হঠাৎ পিছন থেকে জাপটে ধরে। স্বামীটা গায়ে কেরোসিন ঢালে। শাশুড়ি দেশলাই ঠুকে দেয়। জ্বলতে জ্বলতে ফিরে আসে পূর্বা।

খানিক হল্লা, একটা স্টেশন এলো। ছেলেটি চোখ খুলল। পাশে একটা মেয়ে বসেছিল, কখন উঠে গেছে। ফের চোখ বুজল সে। মায়ের দুই ছেলে, এক মেয়ে। সে-ই ছোট। নাম অভ্র, অভ্রজ্যোতি ব্যানার্জি। মা অবু বলে ডাকে। বছর পাঁচেক হলো, বাবা নেই। একমাত্র দিদি বিয়ে হয়ে বাইরে। উপস্থিত দাদার সংসারে থাকে। যেন নিচে এক গভীর খাদ। প্রতিদিন তার উপর একটা টাঙানো তারে দুহাত ছড়িয়ে হাঁটে। টলে। তবে পড়ে না।

বেলা পৌনে দুই। স্টেশন এসে গেল। ভালোই এলো ট্রেনটা। ঘণ্টাদুয়েক মতো লাগে। অভ্র ট্রেনটা থেকে নেমে একটা বিড়ি ধরাল। বাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে লাগল।

তার কিন্তু এবার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। একতলা বাড়ি। নিচু পাঁচিলে ঘেরা। সামনে লোহার গেট। অভ্র গেট খুলে ভিতরে ঢুকল। না, এখনো বাড়ির কেউ খবরটা জানে না। সেই শ্যালকও না। কাউকেই ফোন করে জানায়নি সে। ডানদিকের দরজা দিয়ে ঢুকলে ঘরটা মায়ের। খোলাই ছিল। অভ্র ভিতরে ঢুকে খাটে বসল। অমনি একটা ক্লান্তি … ক্লান্তি। পিঠটা টানটান করে বিছানায় ফেলে দিতেই দু-চোখ জুড়ে ঘুম। মাথার উপর দু-হাত, দুটো পা দুদিকে ছড়ানো। খাটটার উপর শুয়ে থাকল সে। অমনি খবর পেয়ে সারাবাড়ি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। মা, দাদা, দাদার বউ, শালি। ঢুকেই কিছু বলতে যাবে, অভ্র উঠে পড়ল। ‘হয়নি’ বলে ভিতরের বারান্দায় চলে গেল। বাথরুমে ঢুকল। ফিরে এসে হাতমুখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল, ‘কেউ খোঁজ করছিল?’

কোনো উত্তর নেই।

অভ্র তাকাল। গামছাটা রেখে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল। একটু ইতস্তত করল। তারপর বলল, ‘কিছু খাবার-টাবার আছে?’

চুপ থেকে মা মিনমিনিয়ে উঠল, ‘কী জানি।’

অভ্র বেরিয়ে এলো।

পাশ-সার্টিফিকেটগুলি রেখে আর লাভ আছে কি? না, মায়ের ব্যাপারটা আজ সে ভাববে না। জানে, আজ তাকে আরো লড়তে হবে। মা আজ কিছুতে মায়ের মতো থাকতে পারবে না। উপস্থিত ভাইপো-ভাগ্নিগুলির যেমন পড়ার সময় কোনো মা নেই, বাবা নেই।

রিকশা কালীবাড়িটার কাছে আসতেই একটা ডাক, ‘এই যে?’

অভ্র ঘাড় ফেরাল। দেখল, মানতা। রাস্তার ও-ফুটে দাঁড়িয়ে আছে।

মানতা এ-শহরেরই। একটা বিয়েবাড়িতে বিজু পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বিজু অভ্রর ক্লোজ ফ্রেন্ড। সে-ই কথায় কথায় তার ইন্টারভিউটার কথা তোলে। হয়তো মেয়েটাকে খানিক ইমপ্রেস করার জন্য। তাতে চাকরিটা এবার অভ্র পাচ্ছেই শুনে মানতা খুব হাসে। খুশি হয়। তারপর দেখা হলেই সেই কথা তোলে। গল্প করে। এভাবে বছর দেড়েক হলো অভ্রর প্রেমিকা হয়ে গেছে। দেখতে খারাপ না। বেঁটে, ফর্সা, আঁটো – ব্যস। এই অব্দি। হাত বাড়ালে আছে। কিন্তু মানুষ কি শুধু হাত? তার চোখ নেই, কান নেই, মন নেই?

সেই মনটাই কখনো একা ঘরে টের পায়, ‘সকল পাওয়ার মাঝে আমার মনের বেদন বাজো নাই, নাই, নাই গো।’ মনে হয়, কে যেন আসে। দরজা বন্ধ দেখে ফিরে যায়। কে সে! অভ্র ভাবার চেষ্টা করে। কিন্তু পরক্ষণে চৌকাঠে অপেক্ষা করা একটা কূটকৌশল, আপোস, বেঁচে থাকার ধান্দাগিরি, সারা শরীরটায় ঢুকে পড়ে তার। যেন একটা কীট। কুরে কুরে খায়। পূর্বাও ততক্ষণে লুটের মাল, কোনো এক পয়সাওয়ালা ঘরের। অতএব মানতা অনিবার্য হয়ে ওঠে। জীবনটা ক্রমশ যেন এক ডোবা। সেই জলে কালো মাঢ়ি বের করে একগাল হাসা মানতা ছিপ ফেলে, গোটায়, ফের ফেলে। তো কতদিন? অভ্র গেঁথে যায়। কিন্তু ভালোবাসা ছিপে ওঠে কি?

দেখেছে, মানতাকে ঘিরে এইরকম আরোা অনেক পুরুষ-আত্মীয় ছুঁকছুঁক করে। তাকে ছুঁয়ে বসে। কথার ছলে তার গায়ে হাত দেয়। কিন্তু মানতা কিচ্ছু বুঝতে পারে না। তো এইরকমই একটা বাড়াবাড়ির দিন অভ্র বাড়ি ফিরে ডায়েরিতে লেখে, ‘আসলে তুমি কী/ মানুষ জানে না/ পোকামাকড়রা ঠিক চিনে ফেলে।’ তা সেই মানতাই গত সপ্তাহে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোমার ইন্টারভিউয়ের কী খবর?’

অভ্র উত্তর করে, ‘এখনো আসেনি।’

‘এর মধ্যেই চলে আসবে হয়তো।’

‘হয়তো।’

ব্যস, মানতার আর বলার মতো কিছু নেই। কিন্তু মানতা বলে। বলতে হয়। যেগুলি আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর এখানেই একটা জটিল বিরোধ। আসলে মানতার চোখেমুখে যারা যারা কথা বলে, হাসে, খুশি করে – তা অভ্ররই সেই ডোবা, খাঁচা, শ্বাসরোধ। অভ্র মনে মনে তাই ছটফটিয়ে ওঠে, ক্রুদ্ধ হয়। যা ঘটনাহীন। বিতৃষ্ণার কারণটা প্রমাণ করতে পারে না। ফলে মানতাও
দাঁত-নখ বের করে ফেলে। অভ্র অমনি গুম। ভাবে, গর্তই যদি, সেও তো এগিয়েছিল। তবে অন্তর বেঁকে বসে কেন! ক্রোধটা কার বিরুদ্ধে? চুপ করে ভাবে। মানতা স্তব্ধতাটা ভুল করে। ফের গদগদ হয়, ‘আচ্ছা, তোমার হঠাৎ হঠাৎ কী হয় বলো তো!’

‘বললে বুঝবে না।’ অভ্র গম্ভীর।

‘কেন, না বোঝার কী আছে?’

‘ভুল বুঝবে।’

এরকমই এক মাপা সম্পর্ক। দেখা-কথা-গল্প, দিন পনেরো বাদে বাদে। কখনো বা এক মাস। ক্রমশ এমন দাঁড়াল – দেখা হয়, পাশে হাঁটে, পরিচিত কেউ শ্মশানে যাচ্ছে – তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। রিঅ্যাক্ট করে না। যদি বা করে, মিনিট কয়েক। শুধু একটা ক্ষুধার্ত অন্ধকার! তার ভিতর থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে এসেই দুজন দুজনের উপর হঠাৎ খেপে যায়। কেমন বিরক্ত, হিংস্র। গত সপ্তাহেই যেমন যাওয়ার আগে মানতা শুধু বলে ওঠে, ‘সামনের দিন আসতে হবে?’

‘দ্যাখো।’ অভ্র চলে আসে।

পাড়ার ক্লাবে এসে ঢোকে।

চটি খুলে এককোণে দাঁড়ায়। পাশে বড় বড় দুটো ক্যারমবোর্ড। কোনো খেলোয়াড় নেই। একটা গ্রুপ আছে, সন্ধে ছ’টা বাজলেই জুয়ায় বসে যায়। চলবে রাত সাড়ে দশ, এগারো। তেরো তাস, চার কার্ডে লাইসেন্স, পার কার্ড দেড় টাকা। বাকিরা টিভির। সেটটপ-বক্স লাগানো, প্রচুর চ্যানেল। ঢুকলেই একটা কান ফাটানো আওয়াজ।

‘সাইন্ডটা একটু কমা না।’ অভ্র মুখ খোলে।

কোনো সমর্থন নেই।

অর্থাৎ ঠিকই আছে। কারো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। জোরসে একটা হিন্দি সিনেমা চলছে। অমনি একজন অন্য একটা জায়গায় ঘুরিয়ে দেয়। এইভাবে যতক্ষণ যন্ত্রটা চলবে, ঘুরবে। কোনো চ্যানেলই বেশিক্ষণ সময় পাবে না। কেউ একজন ঘুরিয়ে এক জায়গায় দিলো, মিনিট খানেক বাদেই ফের আওয়াজ, ‘ঘোরা ঘোরা।’ দুশো পঁয়ষট্টিটা চ্যানেল। শুধু ঘুরছে … ঘুরছে। কী যেন খোঁজে। পায় না। এইভাবে ধস্ত, ছারখার, দিনভর ঘুরপাক খাওয়া কতগুলি বেকার ছেলে রাত এগারোটা নাগাদ টলতে টলতে বাড়ি ফেরে।

পাশে এক বন্ধু দাঁড়িয়ে। অভ্র হঠাৎই একটু প্রশ্ন ছোড়ে, ‘কী রে, তোর ওই চাকরিটার কী খবর?’

হ্যাঁ, বন্ধুটিরও একটি চাকরি পাওয়ার কথা। দিনের পর দিন সরু লাইন করে একটা সরকারি চাকরির সম্ভাবনা বাঁধিয়েছে। বাঁধিয়ে গদগদ। যেন জীবন সার্থক। তারপর দিন যায়, মাস যায় – খবর নেই। উপস্থিত মাথা খাটিয়ে মাথাটা নিচু করে রাখে। চোখের সামনে কোনো অন্যায় হচ্ছে, চুপ। জীবন কড়া নাড়ে, খোলে না। চোখমুখ কুঁচকে শুধু হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে কানের রগ ডলে আর তর্জনী দিয়ে মাথার চুল পাকায়। তো উত্তর করে, ‘এখনো কোনো খবর আসেনি।’

‘আচ্ছা ধর, যদি না আসে?’

বন্ধুটি সঙ্গে সঙ্গে অমনি চুল পাকায়। আরো জোরে জোরে রগ ডলে।

পিচের রাস্তা। তাত্ আছে। অভ্র সাইকেল থেকে নামল। মানতার সামনে এসে দাঁড়াল। মানতা কথা বলল, ‘বাজারে গিয়েছিলাম। উঃ, যা রোদ। ছাতা নিয়ে বেরোওনি কেন? যাক গে, তা -’

‘হয়নি।’

মানতা কথা বলতে সময় নিল।

না, মানতার কথা পূর্বা জানে না। কিংবা জানে। জেনে চুপ। বছর তিনেক হতে চলল, পূর্বা ফের এখানে। ডিভোর্স হয়ে গেছে। কপাল মোছা। শরীরে সামান্য যা পোড়া, সেরেছে। তবে আগুনটা যায়নি। কে ঢুকবে? সবসময় যেন দাউদাউ … দাউদাউ। ভিতরে এক আলো! দেখে অভ্র মোবাইলে তার নম্বর সেভ করার সময় পূর্বা না লিখে লেখে ‘আগুন’। মানে ‘আগুন’ নামে সেভ করে। নামটা লুকিয়ে রাখার জন্যও হতে পারে। তো উপস্থিত মা-বাবার সঙ্গে থাকে। একটা আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছে তাকে। পাশের পাড়াতেই দোতলা বাড়ি। অভ্র মাঝে মাঝে যায় সেখানে। কখনো সে বলে না, ‘বোসো।’

অভ্রই চেয়ার টেনে বসে।

আগুনটি রান্নাঘরে চলে যায়।

মিনিট কুড়ি বসে থাকতে পারলে, পূর্বা আসে। খাটটার একধারে এসে বসে। দাউদাউ, সতর্ক। দারুণ গায়। কিন্তু হারমোনিয়ামটা খাটের নিচে লুকানো। যেন অলটাইম বন্ধ একটা মানুষ। কচিৎ খুলতে দেখা যায়। এভাবেই হঠাৎ একদিন পূর্বা একটু খোলে, ‘হয়তো জানো না, আমি একটা এনজিওতে কাজ করি। সপ্তাহে চারদিন। ঘণ্টা তিনেক। করবে আমার সঙ্গে?’

‘কী কাজ?’

‘কিছু মানুষের মধ্যে যেতে হয়। মাইনে অল্প।’

‘কারা তারা?’

‘অনাথ। বুকের মধ্যে যাদের ধিকিধিকি আগুন জ্বলে।’

আবার সেই আগুন! অভ্র থমকায়। বলে, ‘কিন্তু আমার তো সামনে ইন্টারভিউ।’

‘ও।’ পূর্বা ফের বন্ধ হয়ে যায়।

ধিকিধিকি জীবনটার কাছে যাওয়া হয় না।

আর একটা দিন, আকাশে মেঘ। অভ্র হঠাৎই আস্তে কাঁধে হাত রাখার মতো একটা ইচ্ছের দিকে হাত বাড়ায়, ‘একটা গান শোনাবে?’

‘তারপর?’

‘জানি না।’

‘এভাবে একটা অজানা পথে হাঁটতে ভয় করে না?’ পূর্বা বড় দুটো চোখের পাতা উঠিয়ে তাকায়। মুখের কোথায় যেন একটা মিটিমিটি হাসি। হাসিটি মুছে নিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। চোখে সেই আগুন। অভ্র থেমে যায়। ‘উঠি’ বলে উঠে আসে।

পূর্বা ‘থাকো’ বলে না। ‘যাও’ বলে না।

একটা ধন্দ… ধন্দ। পূর্বাকে বোঝা যায় না। নিশ্চিত হওয়া যায় না। এভাবেই একদিন অভ্র বাড়ি ফিরে আসে। রাতে শুয়ে মানতাকে ভাবে। ভাবনাটার মধ্যে কখন অন্য একজন ঢুকে পড়ে। একটা নিশিডাকা গলায় ফিসফিসিয়ে ওঠে, ‘শুনতে পাচ্ছ অভ্র?’

অভ্র চমকে ওঠে, ‘কে! কে!’

‘আমি।’

‘ওঃ, আবার তুমি! তুমি এখনো বেঁচে আছ!’

‘তুমি কি খেয়াল করেছ, তুমি ফের নিজেকে ভাবছ।’

‘বাজে কথা… বাজে কথা। আমি এখন পুরোপুরি যান্ত্রিক, মানানসই। কারোর সঙ্গে কোনো বিরোধ হয়? কিন্তু কেন একা হলেই এভাবে দংশাও? কী চাও তুমি?’

‘মুক্তি… মুক্তি। তোমার আসল চেহারা। দরজাটা আজ খুলে দাও।’

‘না, আবার ক্ষত-বিক্ষত হবে।’

‘কিন্তু আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে যে।’

‘হোক হোক। এভাবেই তো অধিকাংশ আছে।’

‘এইভাবে! নাঃ, আমি আর পারছি না। আমি এবার তোমার সমাজ, পূর্বা, সবার কাছে তোমাকে ফাঁস করে দেব। আমি এবার …’

‘খবরদার! তার আগে আমি তোর গ-লা টি-পে -’

‘আঃ, ছাড়ো।’ বলতে বলতে একটা ধস্তাধস্তি, শব্দ।

ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যায়। অভ্র হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। ঘামে। তারপর হাঁপায়। হাঁপাতে হাঁপাতে ফের বিছানায় এলিয়ে পড়ে।

মানতা কথা বলল, ‘সে কি, হলো না! এই যে বললে ইন্টারভিউ ভালো হয়েছে। কোন এক রিলেটিভ আছে। এবার হচ্ছেই, হবেই -’

‘না হলে কী করব।’

মানতা চুপ। হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখল। বিকেলে এমনিই আজ তাদের দেখা হওয়ার কথা। বলে উঠল, ‘এ ব্বাবা, এত বেলা হয়ে গেছে! বাড়িতে একজনের আসার কথা খেয়ালই নেই! আচ্ছা চলি।’

‘বিকেলে আসছ?’

‘ক-টার সময় যেন?’

‘পাঁচটা।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ বলে চলে গেল।

বেলা দুটো। অভ্র বাড়ি ফিরল। ক’টা জামা-প্যান্ট কাচল। স্নান করল। সেই সক্কালবেলায় চা-বিস্কুট খেয়ে ট্রেন ধরেছে। এবার খিদে পাচ্ছে। চুল আঁচড়ে খাবে। দুপুরে বারান্দার রংচটা একটা গোলটেবিলেই তাকে খেতে দেওয়া হয়। ভাতটা কিছু একটা দিয়ে আধঢাকা। তারই মধ্যে একটু ডাল, একটু সবজি। অভ্র চেয়ার টানল। ঢাকনি ওঠাল। তারপর ভাতে হাত দিতে  যাবে – থমকাল। পাশের ঘর থেকে বিষাক্ত ছোবলের মতো এক মহিলা-গলা, ‘হুঁ, অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকায়ে যায়। আর কী, এবার জেবনভর বোঝা বও। ঘাড়ে বসিয়ে গেলাও।’

ঘরটা দাদার। অভ্র গুম, স্থির। হয়তো ভেবে নিচ্ছিল, ধৈর্যটা হারালে কী কী বিপদ হতে পারে। হয়তো দেখছিল, সহ্য করা যায় কি না। শেষমেশ ছিটকাল। মা সঙ্গে সঙ্গে একেবারে দৌড়ে এলেন। তিনি এ-ছেলেকে চেনেন। বলে উঠলেন, ‘কী! কী হয়েছে! খাবি না!’

‘না।’ অভ্র জামা-প্যান্ট পরতে লাগল।

‘অবু, পাগলামি করিস না। শোন।’

‘আঃ, সরো।’

‘অবু, এভাবে খিদে-পেটে ভাতের থালা থেকে উঠিস না বলছি। অবু শোন, শুনে যা।’

‘না না, বললাম তো, সরে যাও।’ অভ্র সশব্দে ছিটকে বেরিয়ে গেল।

 বিকেল পাঁচটা। মানতা এলো না। পাঁচটা পঁচিশের ট্রেনটাও বেরিয়ে গেল। ফের ফাঁকা স্টেশন। না, নেই। অভ্র একটু হাসল। তারপর সাইকেলটা উঁচু করে রেললাইন টপকাল। ক’পা এগোলেই বড় রাস্তা। একটা বিড়ি ধরিয়ে ফের সাইকেল চালাতে লাগল। চারদিকে ভ্যান, রিকশা, অটো। স্টেশন থেকে সবাই যে যার বাড়ি ফিরছে। সে আজ কোথায় যাবে?

না, সে কারো কাছে হাত পাততে পারবে না। অন্যরাও জানবে না যে, সে খেয়ে আছে নাকি না-খেয়ে আছে। তাহলে? সে এ-শহরে একটা লোককে দেখেছে, খুব ভদ্র। সৌম্য চেহারা। চুপচাপ হাঁটে। কিন্তু উপার্জন জানে না। তো কিছু দিন বাদে দেখে, লোকটির জামা-প্যান্ট ক্রমশ নোংরা হয়ে যাচ্ছে। ছিঁড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুখটা কিছুতে পাল্টাচ্ছে না। শুধু হাত-পাগুলি ময়লা পড়ে কালো হতে হতে একদিন ভিখিরি হয়ে যায়। লোকে এখন তাকে পাগল বলে। তারও কি এই পরিণতি? মনে হতেই তার গা কেঁপে গেল। একজনের খাওয়া-পরার জন্য কত লাগে? আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল সে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎই তার ছোটবেলাকার একটা কথা মনে পড়ে গেল। মায়ের কথা। মা তখন দাঁতে ফিতে কামড়ে চুল বাঁধত। রাতে চাঁদ দেখাত। একদিন বলে ওঠে, ‘অবু, তুই যখন খুব বড় হবি, খুব বড় চাকরি করবি, তখন কী হবে বল তো?’

অবু তাকায়।

মা বলে, ‘তোর জন্য ওই চাঁদটার মতো একটা বউ এনে দেব, কেমন?’

অভ্র হেসে ফেলল। এক হাত দিয়ে দ্রুত চোখের কোণ মুছল। তারপর চাঁদটার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে ফের দৃষ্টি সরিয়ে সাইকেল চালাতে লাগল।

 তাহলে কিছু হলো না? মানতাও টা-টা? অথচ এরই জন্য সেই কবে থেকে সে শুধু ছুটছে … হাঁপাচ্ছে। নাহ্, আর কিছু না-হওয়ার ভয় নেই। কিছু একটা হতেই হবে, এভাবে আর কেউ ঠেসে ধরবে না তাকে। খালাস … খালাস, এত দিনে ছুটি। মনে হতেই তার খুব আনন্দ হলো। মাথাটা সোজা হয়ে গেল। কানে কীসের একটা ক্ষীণ শব্দ! যেন কোথাও বেঁচে

থাকাটার আরেকটা দরজা খুলছে। কোথায়?

মনে হতেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। না, আর বাড়ি ফিরবে না সে। চলে যাবে। চলে যাবে এখান থেকে। তবু যাওয়ার আগে একবার মা’কে খুব দেখতে ইচ্ছে করল তার। ভেবে সে সাইকেলটা চালাতে চালাতে শেষবারের মতো একবার বাড়ির সামনে দিয়ে গেল। তাকাতে তাকাতে গেল। না, নেই।

সাইকেলটা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে। আর ঠিক এমন সময় মোবাইলে একটা রিংটোন বেজে উঠল। অভ্র থমকাল। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম দেখল, ‘আগুন।’