নানা-নানি : তৃতীয় পর্ব

নানারা তিন ভাই। আবার তাঁরা চার ভাইও। কারণ, নানার বাবা শেখ আবদুল জব্বার একজন বালককে পুত্র হিসেবে পালন করতেন। আর তা এতই নিবিড় ছিল যে, সবাই জানত তাঁরা চার ভাই। এমনকি আমার নানা বাড়ি বানানোর সময় বড় ভাইকে নিয়ে একসঙ্গে বাড়ি তৈরি করেন। অর্থাৎ বাড়ি একটাই। শুধু দুজনের অবস্থান দুদিকে। পুবে বড় ভাই, পশ্চিমে মেজো। কামরা আর নকশা প্রায় একই ধারার। শুধু যার যার দরকারে সামান্য হেরফের। সবচেয়ে মজার ছিল তিনতলার ছাদ। এটা এত বড় ছিল যে, বর্ষাকালে আমাদের ছোটাছুটি করার জায়গার কোনো অভাব ছিল না। ছাদের পাশে সব বড় বড় গাছপালা। পুবে বেশ কয়েকটা নারকেল ও তালগাছ। পশ্চিমে একটা লম্বা জাতের বাঁশঝাড়। এর নতুন চারাগুলি ছাদ ছাড়িয়ে কাঠির মতো উঠে যেত। এখনো কঞ্চি গজায়নি বলে একটা লাঠির মতো মনে হতো। হতো কিছুটা বাঁকা। কেননা, অন্যদের পাশ থেকে সরে থাকতে হবে। যাতে সব কঞ্চি সমান আলো-বাতাস পায়। অন্যের সঙ্গে সংঘর্ষ না ঘটে। গাছের ধর্ম বড় সুন্দর। প্রতিযোগিতা থাকলেও সবাই মিলেমিশে থাকে। মানুষের মতো বোমা মেরে ঘরবাড়ি ভেঙে প্রাণ হরণ করে না। গাছ আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু।

ছাদের দু-প্রান্তে জালি দেওয়া ছিল যা লোহার পাইপের মাঝ দিয়ে জল নিকাশ করত। অনেক সময় ময়লা বা পাতা পড়ে জালি বন্ধ হলে ছাদে জল জমে যেত। তাতে আমাদের আরো ফুর্তি। একজন আরেকজনের গায়ে জল ছিটিয়ে মজা করা। পরে নানি এসে আমাদের সংযত করে শেখাত কী করে নালির মুখ পরিষ্কার করতে হবে। পাতা আর ময়লা সরলে জল নিকাশের নানা রকম শব্দ হতো। এক রকম সংগীত বলা চলে। আমরা এটা উপভোগ করতাম। চোঁ-চাঁ … শোঁ-শাঁ নানান ধ্বনি। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বা বিঠোফেনের সংগত মনে হতো। তখন মনে হয়নি। আজ সেই স্মৃতি লিখতে গিয়ে এদের উপমা চলে আসছে। বিসমিল্লাহ খানের সানাই, আলি আকবর … রবিশঙ্কর এঁরা আমাদের ধ্রুপদী সংগীতের উদাহরণ। চাইকোভোস্কির কথাও মনে পড়ে। আর বিঠোফেন তো কিংবদন্তি। বাখ, মোজার্ট … কাকে বাদ দিই। প্রকৃতি এসব সুরের আধার। এইসব গুণী তাঁদের যন্ত্রে ওই সুর ফুটিয়ে তুলতেন। চন্দ্রালোকিত যামিনী … প্রান্তরে বয়ে যাওয়া বাতাসের শননধ্বনি … কে না শুনেছে। শুধু  ধরা পড়েছে এদের সেনসরিতে বা স্নায়ুতন্ত্রে।

ঝামটিয়ায় এগারোটা-বারোটা পরিবার, কিন্তু আমার নানা-নানি অগণন। কারণ পাড়ার বয়স্করা সবাই নানা-নানি। এদের ভাইবোনও তাই। এভাবে কত দিগন্ত জুড়ে নানা-নানির অবস্থান। নানার বোন নানি, তাঁর শালিগোষ্ঠীও নানি … নানির বোনেরা এর মধ্যে পড়ছে। নানা-নানি অগণন।

সবচেয়ে কাছের ছিল নিজ নানি গোলাপজান বেগম। যৌবনে মনে হয় গোলাপি ছিলেন। তাঁর একটা প্রতিনিধি পাই বড়মাসির বড় কন্যা মমতাজবুবুর মধ্যে। তিনি ছিলেন একেবারে গোলাপি-বিবি। যদিও কপাল মন্দ। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে যান। আর বিয়ে করেননি। বাবা-মায়ের সংসার আগলেছেন।

দুঃখের বিষয়, কয়েক মাস আগে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। বছর চারেক আগে খাজুরদহে তাঁদের বাড়িতে প্রায় সপ্তাহখানেক কাটিয়েছিলাম। স্মৃতির ভাণ্ডারে শেষ ছবি। বড় মনের মানুষ ছিলেন। একজন হিন্দু ছেলেকে পালতেন। নাম পচা। মানে সংসারে মনে হয় কেউ ছিল না। পচা বড় হলে নিজে সব খরচ করে বিয়ে দেন। ওদের এক ছেলে, এক মেয়ে। স্কুলে পড়ে। ওরা বুবুর বাড়ির নিচতলায় পুরোটা জুড়ে থাকে। মেয়ে বড় – পায়েল। ঝামটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী। কিছুদিন পর বিয়ে হয়ে যায় খালনার এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ছেলের সঙ্গে। ডাকনাম ধনা। ভালো নাম মনে পড়ছে না। ধনারা সম্ভ্রান্ত পরিবার। সবাই লেখাপড়া জানা। দোতলা বাড়ি। আমাকে থাকতে অনুরোধ করেছিল; কিন্তু আমার সময়ের ছকে না মেলায় সফল হইনি।

মমতাজবুবুর দাদা-দাদির কথা খুব মনে পড়ে। দাদা

কৃষ্ণকায় এবং এক পা ছিল ভাঙা, ফলে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। বহরমপুরে চাকরি করতেন। কী চাকরি জানা হয়নি। বুবুর দাদি ছিলেন মধ্যম উচ্চতার হলুদ ধরনের ফর্সা মানুষ। খুব মিশুক ছিলেন। আমাদের খুব আদর করতেন।

বুবুদের বাড়ি-সংলগ্ন আরেকটি বাড়িতে সাদুল্লাহ বলে আমার বয়সী এক ছেলে ছিল। কিছুটা প্রতিবন্ধী। তাকে তার মা খাইয়ে দিত। আমাদের হাসি পেলেও হাসতে পারতাম না। ফর্সা সাদুল্লাহ মমতাজবুবুর খুব স্নেহ পেত। তিনি ওকে নিয়ে হাসিঠাট্টাও করতেন।

বড় খালুর বাড়িটি ছিল মাটির, কিন্তু দোতলা। বেশ বড়। দক্ষিণে বারান্দা। একটা ক্যারমবোর্ড ছিল। বোর্ডটা আমাদের খুব প্রিয় ছিল। আমরা ভাইবোনেরা সময় পেলেই খেলতে বসে যেতাম।

বড় খালু তাজম্মল হোসেন ছিলেন খুব শৌখিন মানুষ। বাড়িতে দামি একটা গ্রামোফোন ছিল। চারকোনা বেশ উঁচু। আওয়াজ ছিল জোরালো। এটা আমার খুব নজর কাড়ত। বুবুকে দিয়ে গান শোনার ব্যবস্থা করতাম।

এ-বাড়িতে মমতাজবুবুর ছোট চাচার ছোট ছেলে মুহতাজ ছিল আমার সহপাঠী। শ্যামবর্ণ, ভালো স্বাস্থ্য। বেশ স্মার্ট ছিল। ওর বড় ভাই মোয়াজ্জেম হোসেন কিছুটা লম্বা-পাতলা সরল মানুষ ছিলেন। মুহতাজের গাল ছিল গোল। মোয়াজ্জেম ভাই কিছুটা চাপা। অবশ্য রং দুজনেরই এক – শ্যামলা। চাচি ছিলেন শ্যামলা রঙের। চাচাকে দেখিনি। তিনি খুন হয়েছিলেন পুকুরের ওপারে এক আত্মীয়ের হাতে। সে-এক কাহিনি। পুরোটা জানিও না। তবে ধারণা করি, জমি-জায়গা নিয়ে কিছু একটা হবে। পুকুরপাড়ে তাঁকে বল্লম ছুড়ে খুন করা হয়। তিনি বল্লম বুকে নিয়েও উঠতে চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু মাথায় আঘাত করে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।

শুনেছি ছোটখাটো বড় খালু নাকি মহিলাদের পোশাক পরে ছোট ভাইয়ের দেহ বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করেন। বিচারে আসামিদের বারো বা চৌদ্দো বছর জেল হয়। আসামিরা আবার দক্ষিণপাড়ার জামাই। মামাতো ভাইটির নাম ছিল কাঞ্চন। দক্ষিণপাড়ায় থাকত। বাপ-চাচাদের জেল হয়ে গেল। কাঞ্চনের বড় ভাই আখতার হোসেনকে আমরা মিয়াভাই বলে ডাকতাম। মিয়াভাই ফর্সা, সুন্দর, আমাদের চেয়ে বছর চারেকের বড় ছিলেন। বর্তমানে বাগনানে থাকেন। ব্যবসায় বেশ উন্নতি করেছেন।

নানাদের বাড়ির পর জয়নাল মামার বাড়ি। তারপর ছিল মিয়াভাইয়ের মামা খুদু মামাদের ঘর। খুদু মামার মা আমার নানি ছিলেন – ছোটখাটো ফর্সা মানুষ। খুবই সরল মানুষ। শেষ বয়সে বাতের ব্যথায় ভুগতেন। ব্যথা বিশেষ করে হাঁটুতে। শীতকালে প্রায়ই ঘরের সামনে বসে পায়ে রোদ পোহাতেন।

একবার একটা দৃশ্য এখনো পরিষ্কার মনে আছে।

তিন-চারজনের এক বেদেনির দল দক্ষিণ পাড়ায় ঢোকে। আর হাঁক পাড়ে … জড়ি-বুটি লাগবে … বাত সারাই … আরো অনেক কথা বলছিল। সব মনে করতে পারছি না।

এই দলকে নানি ডাক দেন। তিনি তার হাঁটুর বাতের ব্যথার কথা বয়ান করেন। বেদের দল তাঁকে ঘিরে বসে বলল, চিকিৎসা করবে। আমরা কয়েকজন উৎসুক বালক-বালিকা ঘিরে আছি চিকিৎসা দেখার জন্য।

বেদের দলে একজন পুরুষ ছিল। সে তার ঝুলি থেকে একটা গরুর শিং বের করল। এর দুদিকই কাটা। একদিক মোটা, অন্যদিক সরু। এরপর সে বের করল বাঁকানো ধারাল একটা ছুরি। বসন্তের চিরা-টিকার যেমন ছুরি হয় তেমন – তবে তা বাঁকানো। আর একটু লম্বা।

লোকটা নানিকে হাঁটুর কাপড় ওঠাতে বললে। প্রথমে এক পা। নানি হুকুম তামিল করে। পা দেখানো লজ্জা হলে কী হবে, চিকিৎসা। তিনি হাঁটুর কাপড় তুললেন। বেদে লোকটি ছুরির শেষ মাথা ধরে ধারালো আগাটা দিয়ে বেশ আট-দশটা আঘাত করল গোল করে। তারপর কি সব মন্ত্র পড়ে গরুর শিংটা বসিয়ে জোরে শ্বাস টানতে লাগল। কয়েকবার টেনে তুলতে দেখি নানির হাঁটুর ওপর কালো কালো রক্তের ফোঁটা।

সব বদ রক্ত বেরিয়ে গেল। বললে বেদে মধ্যবয়সী লোকটি।

আমাদেরও মনে হলো, সত্যি বদ রক্ত বেরিয়ে গেল। এবার নানি ভালো হয়ে উঠবে।

চিকিৎসার বিনিময়ে নানি কী দিয়েছিলেন তার খবর আর নেওয়া হয়নি। চিকিৎসা দেখে ঘরে ফিরি। আর ঘরে ফিরে সবাইকে বয়ান দিই। এটা আমার কাছে একটা মজার তথ্য। কিন্তু আমার কথায় কেউ তেমন আগ্রহ দেখাল না। মানে ব্যাপারটা সবাই জানে।

এই বাত-সারানোর ঘটনার সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার মনে পড়ছে। গ্রামে অনেক সময় দৈবজ্ঞ আসত। দৈবজ্ঞ মানে কোন পরিবারের সদস্যদের সামনে কী হবে বা হয়ে গেছে এইসব ঘটনার কথা জোরে জোরে আউড়াত। গ্রামের ভাষায় এদের বলত দৈবক। অর্থাৎ দৈবজ্ঞ। এরা যে সবসময় আসত তা নয়, দৈবাৎ বা হঠাৎ হঠাৎ হাজির হতো। আর এরা শুধু আসত দক্ষিণপাড়ায়। কারণ এদের হাতে পয়সা আছে। গরিবদের পাড়ায় এদের খুব একটা দেখা যেত না। কেউ হাত ধরে টেনে না নিয়ে গেলে যেতে চাইত না। বুঝতে পারি ব্যাপারটা অর্থনৈতিক। এই গরিব মানুষগুলি দিন আনে দিন খায় – হাতে কাঁচা পয়সা কোথায়? তাই এদের পাড়ায় দরিদ্র দৈবক পা মাড়াবে কেন?

একবার মাঝবয়সী এক লোক নানিদের ভিটের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আঙুল তুলে বলতে লাগল, এই বাড়ির সামনে ফাঁড়া আছে।

কথাটা নানির কানে যায়।

তিনি আমাকে দৈবককে ডাকতে বললেন।

আমি দৌড়ে যাওয়ার আগেই অন্য বাড়ির এক নানি তাকে আহ্বান জানিয়েছে। সুতরাং দৈবক সেখানে পৌঁছে গেলেন।

আমি নানিকে খবরটা দিলাম।

নানি বললেন, খেয়াল কোরো, যাওয়ার সময় ডাক দিয়ো।

দুপুর হয়ে গেছে। আমরা চার ভাই মিলে ছোট বাগানের পুকুরে স্নানের জন্য চলে যাওয়ায় দৈবককে আর পাকড়াও করা যায়নি। আমরা একটা অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হলাম।

পরে নানিও ভুলে যান।

আমার দৈবকের বাণীর সঙ্গে আর সাক্ষাৎ-পরিচয় হলো না। তবে শুনেছি, আগে কোনো এক দৈবক বলে গেছেন যে, এই বাড়ির বড় সন্তানের মানে বড় ছেলের দশ বছর বয়সে এক ফাঁড়া আছে। আমার বড় খালার বড় ছেলে জাহিদুল হোসেন ও মামার বড় ছেলে শেখ বজলুল করিম দুজনই দশ বছর বয়সে মারা যান। দৈবকের কথা ফলে গেছে। এবার আমার পালা। অবশ্য দশ বছর হতে এখনো কয়েক বছর দেরি। সুতরাং চিন্তাটা দূরবর্তী। কিন্তু একেবারে উড়ে যায়নি। সবার অবচেতন মনে বাসা বেঁধে আছে। আমি আমার মা-বাবার প্রথম সন্তান এবং দশ বছর হতে আর খুব বেশি দেরি নেই।

সেবার বাড়িতে নানি-মামি-মেজ খালা আর মায়ের মধ্যে শলাপরামর্শ হলো দৈবককে ডাকা হবে কি না। দু’দল হয়ে গেল। দুদিকে সমান ভোট। নানি না-ডাকার পক্ষে। শেষে নানির জয়। তিনি সবাইকে মানা করলেন দৈবককে ডাকতে। যা ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে আছে তা তেমনি থাক। শুধু শুধু উৎকণ্ঠা ডেকে এনে লাভ নেই। বরং মনে একটা পাষাণ চেপে থাকবে। তার চেয়ে না উসকানো ভালো। দৈবকের দিনটা খারাপ গেল। এ-পাড়ায় কোনো রোজগার হলো না। দৈবক চলে যেতে সবার স্বস্তির শ্বাস। আপদ গেছে। কী না কী বলে দিত, আর সবাই পড়ত দুশ্চিন্তায়। হাজার হলেও বাড়ির প্রথম সন্তানদের নিয়ে কথা। আর দুজন ইতোমধ্যে ধরাধাম ছেড়ে গেছে। তৃতীয়টি ঘটার কথা সবার মনে সহজভাবে জায়গা করে নেবে।

একবার ঘরে কলিচুন করা হবে। যাকে আজকাল বলে হোয়াইট ওয়াশ। ঘর তৈরির পর আর রং করা হয়নি। রং করার জন্যে মানিকমামা একজন মহিলাকে ডেকে আনলেন। বয়স প্রায় চল্লিশ। তিনি এই কলির কাজের কন্ট্রাক্ট নিলেন।

টাকা-পয়সার কথা মনে নেই। এই মহিলার নাম আমার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হয় : কাকতো। এ-কেমন নাম? যেন ভিনদেশি কোনো জাতি। চেহারায় কিছুটা অবাঙালি ছাপ ছিল। দীর্ঘদেহ। ছিপছিপে। রোদে পুড়ে তামাটে। রং-চটে-যাওয়া ধূসর শাড়ি। বাড়ি কোথায় তাও জানি না। তবে ঝামটিয়ার মানুষ নন। ঝামটিয়ার হলে চিনতাম।

নানাবাড়িতে চুন মাখার একটা বড় ড্রাম ছিল। সেটাকে পরিষ্কার করে বাকুলের এক কোনায় রাখা হলো।

শুরু হলো ঘরের দেয়াল ঘষা, ময়লা ওঠাতে হবে।

ঘরদোর বেশ নোংরা হতে লাগল। কিছুই করার নেই। রং করতে হলে এই দুর্ভোগ পোহাতে হবে, যা সব বাড়িতে হয়। চুন সবকিছুর ওপর আস্তর বিছায়। ভালো পরিষ্কার হয় না তৈজসপত্র। একটা ম্যাটম্যাটে রং হয়ে যায়।

দেয়াল ঘষা হয়ে গেলে একদিন কাকতো এলো। তার সঙ্গে আরো দুজন লোক। সবার মাথায় বস্তা। বস্তায় কী আছে আমাদের জানার খুব আগ্রহ।

বস্তা খুলতে দেখলাম সব ঝিনুক আর শামুক। তবে জ্যান্ত নয়। খোল মাত্র। আর এসব নাকি পোড়ানো। সব জিনিস এক জায়গায় একটা ছালার ওপর ঢালা হলো। তারপর ড্রামের অর্ধেক ভরা হলো জলে। আর আনা সব ঝিনুক আর শামুকের খোল ঢেলে দেওয়া হলো ড্রামে। ঢালার পর একটা বুদ্বুদ আওয়াজ হতে লাগল। আমরা ঝুঁকে পড়ে দেখছি। কাকতো হাঁক দিলো : বাচ্চারা, সরে দাঁড়াও। রীতিমতো কমান্ড।

আমরা সামান্য সরে দাঁড়াই। সে আমাদের ঠেলে ঠেলে প্রায় পাঁচ-ছ ফুট সরিয়ে দিয়ে বললে, সবাই দেখো, এখনি কী হয়।

আমরা অধীর আগ্রহে চেয়ে আছি। কী হয় কী হয়! একটা বুদ্বুদ-শব্দ শুনতে পাচ্ছি … তারপর ধোঁয়ার মতো কিছু একটা উঠতে লাগল। আরো কিছুক্ষণ পর হঠাৎ তুবড়ির মতো জল ছুটতে লাগল। আর সাদা চুন বাকুলের ওপর ছিটকে পড়তে লাগল। অবাক করা কাণ্ড। রীতিমতো ম্যাজিক। আমরা হাঁ করে চেয়ে আছি। আমাদের অবস্থা দেখে বড়দের মুখে হাসি।

তিন-চার মিনিট ফুটে জল ক্রমশ শান্ত হয়ে এলো। আমরা দেখতে থাকি। কাছে গিয়ে দেখি তখনো ভুটভুট করে চুন ফুটছে। গরম অনুভব করি। এই দৃশ্যটা মানসপটে শক্তভাবে সেঁটে আছে। মনে পড়ছে কাকতোমাসির মুখ। খেটে খাওয়া মানুষ।
শক্ত-সবল মেদহীন খাড়া চেহারা। আমার মা-মাসিদের মতো মেদযুক্ত চেহারা নয়। এখনো এসব যখন ভাবি খেটে-খাওয়া মানুষদের কথা মনে করে একটা অন্তর্লীন মায়াবোধ করি। বসে খাওয়া মানুষের বিপরীতে খেটে খাওয়া মানুষ। জগৎকে যারা বহন করে চলেছে। সভ্যতা তাদের হাতে নির্মিত। পিরামিড-তাজমহল গড়ে তুলেছে এইসব খেটে-খাওয়া মানুষ। অথচ এরাই জগৎ জুড়ে সবচেয়ে অবহেলিত মানুষ।

চুনকাম করার পর ঘরদোর ঝকঝকে হয়ে ওঠে। রোদ ঠিকরে পড়ে। আর আমার মনে পড়ে কাকতোমাসি ও তার দলবলের কথা।

সব মিলিয়ে কত খরচ হয়েছিল সে-তথ্যটা জানার মতো তখনো বয়স হয়নি। তাই জানাতে পারব না। জানা থাকলে বড় ভালো হতো। তখনকার সঙ্গে একটা তুলনা করতে পারতাম।

একবার মাঝারি ধরনের বান হয়েছে। যাওয়ার নাম নেই। তাই দেখে নানির মাথায় ‘ভাবের উদয় হইল’, তিনি বাবা-বাড়ি যাবেন।

আমরা সবাই খুব খুশি। আমরা ভাইরা, তখন বোন আসেনি, আর মা সবাই আনন্দে ভাসছি।

ডাকো মানিকমামাকে।

তিনি একটা প্যাসেঞ্জার নৌকো জোগাড় করলেন। বেশ বড়। উপরে ছই দেওয়া।

মাঝি-মল্লা হলো যতে বাগ, পঞ্চাদা আর মানিকমামা তো আছেনই।

একদিন সকালে আমরা সকলে মিলে বদর বদর করে নৌকোয় উঠলাম। মাঠের মাঝ দিয়ে নৌকো লগির ঠেলায় এগোতে থাকে। ঝামটিয়া ছেড়ে আমরা রনজবাড় গ্রাম অভিমুখে যাত্রা শুরু করি। পনেরো-কুড়ি মাইল হবে।

আমরা ছোটরা সারা নৌকোয় দাপাদাপি করছি। কখনো ছাদে উঠে বকুনি খাওয়া।

ঘণ্টাখানেক পর একটা বাধা এলো। এলো না – আমরা গিয়ে পড়লাম। একটা বাঁধের ওপর দিয়ে জল তীব্রবেগে বয়ে চলেছে। তার মানে এটা অতিক্রম করা যাবে না। তখন নৌকো খুঁজতে শুরু করে বাঁধটা কোথায় ভাঙা। খানিক পর একটা ফাঁক পাওয়া গেল। এখানে স্রোত বেশি, কিন্তু বাঁধ নেই। নাবিকরা প্রশান্ত। আমরা ভীত। ক্রমশ ভয় কেটে গেল। কারণ সেই স্রোত আমরা কাটিয়ে এসেছি।

নানির বাবাবাড়ি পৌঁছতে বিকেল। ভিটের ওপর অভ্যর্থনার ভিড়।

আমরা নামলাম আগে। পরে মা-নানি। মাঝিরা নৌকো বেঁধে ভিটেয়, সবাই হাল্লাক। সারা শরীরে ঘাম। মাথার গামছা খুলে সবাই ঘাম মোছে।

তাদের জন্যে পাটি এনে নানির ভাই লুৎফর নানা সবাইকে জগ ভরে জল এনে দিলেন।

সবাই মুখ-হাতে জল দিয়ে জিরোতে থাকে। এসে গেল শরবত আর মুড়ি। সঙ্গে গুড়ও ছিল। সবই ঘরের জিনিস। স্বাদই আলাদা। লুৎফর নানারা বেশ সচ্ছল পরিবার।

নানি গোলাপজান তিন বোনের একজন। তিনি জ্যেষ্ঠ। মেজ ও ছোট নানি এই ভিটেতেই থাকেন। মেজ নানির কোনো সন্তান  নেই। বেশ লম্বাটে ফর্সা চেহারা। সুন্দরী। ছোট নানি চেহারায় ছোট। গোলগাল অবয়ব। শ্যামলা বরন।

পরদিন বিকেলে মেজ নানি বললেন, চলো, তোমাদের ঘুরতে নিয়ে যাই।

আমরা তো মহাখুশি।

বানবন্দি। মাঠ বলে কিছু নেই। শুধু লম্বাটে ভিটে কয়েকটা বাড়ি মিলে বেশ চলাচলের জায়গা আছে। সবার পা আড়ষ্ট হবে না।

আমাদের সঙ্গে মা-ও শামিল হলেন।

নানি আমাদের একটা বাড়ির চালাঘরের সামনে নিয়ে গিয়ে বললেন, দাঁড়াও, তালা দেওয়া তো, লোক ডাকতে হবে। তিনি ভেতরঘরে গিয়ে পনেরো-ষোলো বছরের এক যুবককে ডেকে আনলেন।

বললেন, তোমার এইসব মেহমান। চালকল খুলে দেখাও।

যুবক তালা খুলে ডায়নামো চালিয়ে দিলেন। ভটভট বিকট আওয়াজ।

তারপর সে চালকল চালু করল। বেল্ট ঘুরছে। আমরা এই জীবনে প্রথম মেশিনে ভাঙা চালের কল দেখলাম। আমাদের বাড়িতে সব ঢেঁকির চল। মেয়েরা পাড় দেয়। এমন মেশিনচালিত কল দেখে আমরা অবাক।

চালাঘরে শেষ মাথায় একটা তক্তপোষ রাখা। তার ওপর দেখি একটা বাক্সের মতো জিনিস রাখা।

মেজ নানি যুবক ছেলেটিকে বললেন, হারমোনি বাজাতে পারিস?

ছেলেটি মাথা নেড়ে জানাল, জানে।

নানি বললে, বাজা দেখি, নাতিরা শুনুক।

ছেলেটি হারমোনিয়াম বাজাতে শুরু করল। সুন্দর আওয়াজ বেরিয়ে এলো।

আমরা অবাক হয়ে শুনি।

জীবনে এই প্রথম হারমোনিয়াম দেখা।

দুদিন না যেতেই বানের জলে টান ধরল। আমাদের আর থাকা সম্ভব নয়।

আবার ফিরে এলাম ঝামটিয়ায়। তখন এখানে বান প্রায় শেষ অবস্থায়। আর দুদিন পর মাঠ থেকে জল নেমে গেল। তারপর পড়ে রইল পলিমাটি আর কাদা। সব থক থক করছে। বাইরে যাওয়ার জো নেই। আরো কয়েকদিন গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হলো। কিন্তু কানে বাজতে লাগল চালকলের ফট ফট ধ্বনি আর হারমোনিয়ামের মিষ্টি সুর। মনে পড়লে এখনো শুনতে পাই। দেখতে পাই নানির জন্মভূমি রনজবাড়। যেখানে আর কোনোদিন যাওয়া হয়নি। কিন্তু নৌকো-ভ্রমণটি আজো রোমাঞ্চ জাগায়।

আমরা ঝামটিয়ায় ফিরে আসার কিছুদিন পর নানির বোন মেজ নানি আমাদের এখানে বেড়াতে এলেন। আমরা সবাই খুব খুশি।

দুদিন পর আমরা জানতে পারলাম যে, আমাদের ঘরে রাতে বহুরূপী আসবে।

বহুরূপী সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছি। নানান রূপ ধরতে পারে এরা। শরৎচন্দ্রের ছিনাথ বহুরূপীর গল্প পড়েছি। তাই মনের মধ্যে একটা কৌতূহল জেগে রইল।

দেখতে দেখতে দুদিন কেটে গেল।

রাত আটটার দিকে আমরা সবাই একতলার তক্তপোষে বসে গল্প করছি। এমন সময় মা ঘোষণা দিলেন যে, আজ আমাদের ঘরে বহুরূপী আসবে।

আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

আমাদের মাঝ থেকে কখন মেজো নানি দোতলায় উঠে গেছেন আমরা খেয়াল করিনি।

কিছুক্ষণ পর দেখি দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে এক বুড়ো লোক নেমে আসছে। মুখভরা দাড়ি।

বুড়োলোকের মতো একটু জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছে। আমাদের কুশল জানতে চাইছে।

আমরা ভয়ে জড়সড়। হঠাৎ কোথা থেকে এই বৃদ্ধ নাজিল হলো! কিছুটা ভৌতিক বলে মনে হচ্ছিল।

আর দু-চারটে কথা বলেই বৃদ্ধ লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরা স্থাণুর মতো বসে। শুধু মা আর নানির মুখে কেমন একটা কৌতুক মেশানো হাসি। আমরা আরো রহস্যে তলিয়ে যেতে থাকি। কী ঘটল আমাদের সামনে?

প্রায় মিনিট পনেরো পরে মেজ নানিকে দোতলা থেকে নামতে দেখলাম।

হাসিখুশি মানুষ।

আমরা নানিকে বলি, নানি তুমি তো বহুরূপী দেখতে পেলে না।

তাই নাকি!

কখন এলো?

এই একটু আগে।

যাঃ আমি দেখতে পেলাম না।

কিন্তু নানিকে কোনো হা-হুতাশ করতে দেখলাম না।

আমরা ছোটরা অবাক হওয়া থেকে মুক্ত হতে পারলাম না।

পরদিন সকালে বন্ধু কাঞ্চনের সঙ্গে দেখা।

বলি, জানিস কাঞ্চন, কাল রাতে না, আমাদের ঘরে বহুরূপী এসেছিল।

কাঞ্চন বিশ^াস করল না। হেসে উড়িয়ে দিলো। ওর মুখভঙ্গি দেখার পর আর কাউকে বলার ইচ্ছা থাকল না।

দুদিন পর।

মেজ নানি চলে যাবেন। তিনি আমাদের কাছে বহুরূপীর রহস্য উদ্ঘাটন করলেন। মাথার পাকা চুল দুপাশ থেকে টেনে নিয়ে বানিয়েছেন দাড়ি। তারপর গলার স্বর বদলেছেন। এই ছিল বহুরূপীর রহস্য।

মেজ নানি আমার মনে বহুরূপী হয়ে আজীবন জায়গা করে নিলেন।

আমার মেজ নানা শেখ আনোয়ার আলী বেশ ভারি চেহারার মানুষ। উচ্চতায় মধ্যম আকৃতির। এঁরা বংশগতভাবে গোলগাল। পাশে বেশি, ওপরে কম। কওসর আলী নানা ফর্সা, মেজ নানা কালো-সাদার মাঝামাঝি। তবে ছোট নানা শেখ গোলাম হোসেন কালোই বলা চলে। উচ্চতায় একটু বেশি। পাশে কম। তাঁর দুই সন্তান শেখ আলতাফ হোসেন ও আসগারি বেগম দুজনই কৃষ্ণকায় এবং পাশেও বর্ধিত। পয়সাওয়ালা ঘরের সন্তানরা সাধারণত যেরকম হয় – নাদুস-নুদুস।

মেজ নানি ছিলেন স্থূলকায়া। রং শ্যামলা। তবে মুখশ্রী ছিল সুন্দর। তাঁদের সন্তান না হওয়ায় দত্তক নেন মেজ নানির ভাইয়ের মেয়েকে। নাম ওলিমননেসা। আমার মায়ের বয়সী। দুজন ছিল সখীর মতো। ওলিখালা ছিলেন পাতলা, প্রচণ্ড ফর্সা – বাঙালি মনে হতো না। চোখে গোল্ডেন চশমা পরতেন – কণ্ঠটি ছিল সুরেলা। আমাদের খুব ভালোবাসতেন।

তিনিও ছিলেন নিঃসন্তান। মেজ নানি নানাকে আর একটা বিয়ে দেন। নিজের ফুপাতো বোনকে। খুবই পাতলা। নানির বিপরীত। ফর্সা তিনি। তিন মেয়ে ও এক ছেলের জন্ম দেন।

 ছোট নানা নিজের বাড়ি নির্মাণ করেন একেবারে পাড়ার পশ্চিমাংশে। তিনতলা বাড়ি। বলে রাখা দরকার, এঁরা যে-ই বাড়ি করেছে সবই তিনতলা। মনে হবে যেন পরিকল্পনা করে করা। ছোট নানা বাড়ির তিনতলার ছাদ করেন নৌকোর বাঁক তোলা ছাউনির মতো। অনেক লোকে বলাবলি করে কবরস্থান।

নানা-নানি নতুন ধারা উপস্থাপন করতে গিয়ে খারাপ সমালোচনার মুখে পড়েন। পরিচিত হয়ে যায় গোরস্তান বাড়ি বলে। বেচারাদের মন খারাপ হওয়ারই কথা।

ছোট নানার বাড়ির সামনে দক্ষিণ দিকে ছোট একটা পুকুর। চারদিক পাড় বাঁধানো। আর নারকেল ও কলাগাছের সার। সবুজের বেষ্টনী। সান-বাঁধানো পুকুরঘাট – সব মিলিয়ে একটা মনোরম দৃশ্য।

ছোট নানি আম্পা বেগম। ফর্সা। চেহারায়ও ছোট। গলাটা তীক্ষ্ন। তবে আমাদের সঙ্গে খুব ভাব ছিল।

একবার ছোট নানিদের কিছু হাঁস বড় নানিদের পুকুরে ঝাঁক বেঁধে খেলছে। আমার ইচ্ছা ওদের শান্তি ভঙ্গ করা। ছুড়লাম একটা ইটের টুকরো। আর লাগবি তো লাগ একেবারে একটা হাঁসের মাথায়। বেচারা ছটফট করে মরে গেল।

আমি তো ভীত। এবার মায়ের হাতে পড়তে হবে।

ভিটের ওপর থেকে ঘটনাটা মনে হয় নানির নজরে পড়ে। তারপর কাকে যেন ডেকে হাঁসটা উদ্ধার করে ছোট নানিকে দিয়ে আসে।

নানির জন্যে আমাকে আর আদালতে দাঁড়াতে হয়নি।

নানি ছোট নানিকে বুঝিয়ে বলে, এমনি খেলার ছলে ঢিল ছুড়েছে, লেগে গেছে।

বিরাট এক ফাঁড়া কাটল সেদিন।

পরে ঈশপের গল্প পড়ি : একটা বড় গাছের গুঁড়ির ওপর বেশ কিছু ব্যাঙ বসে ছিল। ছেলেরা তাদের ঢিল মারতে থাকে।

ব্যাঙেরা জিজ্ঞেস করে : ঢিল মারছ কেন?

ছেলেদের উত্তর : এটা তারা খেলছে।

ব্যাঙ জবাব দেয় : তোমাদের জন্যে যা খেলা, আমাদের জন্যে তা মৃত্যু ডেকে আনে।

আজ আমি গল্পের মর্মার্থ বুঝতে পারি। খেলার ছলে আমি একটা হাঁসের প্রাণ নিয়েছি। ভাবলে খুব কষ্ট হয় হাঁসটার জন্যে।