এক রাজকীয় ফকিরের গান

আওচার…

মকর সংক্রান্তির পরব চলছে। দিন পাঁচ অবিরাম মাইকে সাঁওতালি গান বাজছে।  কিছু কিছু গান তো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘ডিজে ডিজে’ হুংকারসহ, কিন্তু তারপরেও অদ্ভুত সহজ আর নিরাভরণ একঘেয়ে ছন্দের ধিতাং ধিতাং তাং ধিতাং মাথার ভেতর কেমন ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছে। খান বিশেক ঘরের ছোট সাঁওতাল বস্তি আমার ফার্ম হাউসের পুকুরের গা ধরে। ধামসা মাদল বাজিয়ে নাচ-গান করার অবস্থায় নেই এরা।  সারাদিন মাঠ চষছে, নিড়াচ্ছে, ধান কিংবা আলু লাগাচ্ছে, তুলছে, তারপর সন্ধের মুখে পুকুরে বাসন মাজা, কাপড় কাচা সেরে স্নান করে ফিরে, মাটির উনুনে কাঠকুটো জ্বাল দিয়ে রান্না সারছে। গান আর নাচের সাধ মেটাবে কখন? এই তো জীবন, নিত্যদিন, মাঝে কেবল এই এক-আধটা পরব, তাই তাতেই কিছু নেশাভাঙ করে তালে তালে পা মেলালে, তবেই তো জীবনের বাকি পাতাগুলি উলটে উলটে খানিক পড়া হবে!  সহজ জীবনকে আপন করে নেওয়া – এও এক চর্চা, সাধনা। যা সহজাত, সাবলীল, তা একপ্রকার আশীর্বাদ এবং যাদের ব্যক্তিত্বে এবং প্রকাশে তা নেই তাদের খোলস পালটে পালটে প্রতি মরশুমে সহজ হতে শিখতে হয়, এও একপ্রকার রেয়াজ। যে পারে না সে বড় অভাগা!

একই ভাবে  সুরও সহজ, ছন্দও।  তাকে জটিল অংকে কেটে-ছেঁটে বসিয়ে ক্যালকুলাসিত করা তো যায়; কিন্তু তাতে তার প্রাণ এবং মুক্তির ডানা ছাঁটা পড়ে। যে-মুক্ত ছন্দে আকাশময় চাঁদ তারা গ্রহ ধূমকেতু পাক খেয়ে চলেছে, কোথাও এতটুকু বিপর্যয় ঘটলেও মনে হচ্ছে তা সেই ভাঙা সুর ছন্দেরই অংশ, মানুষ বা তার সৃষ্টি তার বাইরে কীভাবে যাবে! জগৎ-সংসারের এই যে সারল্য তাকে অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে পারার নামই রেয়াজ, সাধনা।

বিধাতার স্বাভাবিক সারল্যের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন ওস্তাদ রাশিদ খান।  কুমারমামা, আমার গুরু কুমারপ্রসাদ, অপরিসীম স্নেহ করতেন তাঁকে। বলতেন, পাতিহাঁসের বাচ্চাকে সাঁতার শেখাতে হয় না, জলে পড়লেই সাঁতার কাটে। রাশিদ হলো পাতিহাঁসের বাচ্চা। নীল রক্ত বইছে ওর ধমনীতে তাই ও মুখ খুললেই গান!  যা গাইবে তাই সংগীত! রাশিদ খান ডাকতেন, কুমার কাকা।

রাগালাপ …

তখন আমার বছর চোদ্দ-পনেরো। আইটিসি সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে গুরুজি অরুণ ভাদুড়ির কাছে শিখতে যেতাম। বিশাল বিশাল গাছে ঘেরা অ্যাকাডেমি প্রাঙ্গণে সব থেকে প্রিয় ছিল প্রায় দোতলা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়া গুলঞ্চ গাছখানা। সুগন্ধ ম-ম করত সবসময়। ঢুকতে-বেরোতে হামেশাই দেখতাম বছর বাইশ-তেইশের রোগা, কালো, ছোটখাটো চেহারার একটি ছেলে সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যতবার দেখেছি মনে পড়ে তার পরনে অদ্ভুত নীল রঙের পাঞ্জাবি এবং একই রঙের
চুড়িদার-পায়জামা – প্রতিবার! তখনই কানাঘুষো শুনতাম তার নাম রাশিদ,  সে নাকি পাগলের মতো তান করে। একদিন ক্লাসে শিখছি, হঠাৎ সেই নীল পাঞ্জাবি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। দেশ থেকে আসা কোনো এক চিঠির ব্যাপারে কিছু খোঁজখবর দরকার ছিল তার। গুরুজি ব্যস্ত থাকায় তাকে সমরদা’র (পণ্ডিত সমর সাহা) কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বেশ মনে আছে সরল একগাল হাসি মাখামাখি হয়ে ছিল একমুখ পানজর্দার লাল রং আর মধুর গন্ধে। গান শিখে ফেরার পথে দেখতাম নীল পাঞ্জাবি গেটের বাইরের পার্কিং লটে হলুদ ট্যাক্সির ড্রাইভারদের সঙ্গে খোশগল্পে মত্ত।

তারপর বহু বছর পরে কুমারমামার কাছে শেখা শুরু হলে প্রতি ক্লাসেই রাশিদের কথা উঠত। কুমারমামা সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির গোড়াপত্তনের কাণ্ডারিদের একজন এবং সেইসময় বিভিন্ন ঘরানার বন্দিশ রেকর্ড করার ক্ষেত্রে ফোর্ড ফাউন্ডেশন প্রজেক্টের দায়িত্বে ছিলেন, আর আমিও সেই সুবাদে সেই প্রজেক্টে কাজ করেছি। রাশিদের বেহাগ নিয়ে বিহ্বল ছিলেন কুমারমামা। ‘আলীরি আলবেলি’ বন্দিশখানা যে শৈল্পিক দক্ষতায় গাইতেন রাশিদ সেই সময়, তা একপ্রকার বিস্ময়!  বলতে বাধা নেই, আগে যে বেহাগ শিখেছিলাম তা গাইতে আমার খুব বিরক্তি বোধ হতো। এই বেহাগ শুনে তারপর কুমারমামার কাছে নতুন করে বেহাগ  ও ‘বরজো না মানে’ শেখার পরে মনে হলো বেহাগই বুঝি এই জীবনের একমাত্র প্রাপ্তি আমার!

তখন আমিও ঘড়ি ধরে রেয়াজ করি। চিল্লা করার চেষ্টা করি।  সাত ঘণ্টা রেয়াজের ঠিকুজি-কুলজি লিখে রাখি ডায়েরিতে।  এতটা এলোমেলো আর খারাপ হয়ে যাইনি তখনো। দীপক একদিন একটা ক্যাসেট নিয়ে এলো, সঙ্গে ছোট কাগজে কিছু লেখা – প্রতিটি তান কত মিনিট কত সেকেন্ড থেকে শুরু হচ্ছে এবং শেষ হচ্ছে তার ফর্দ। সেই তান শুনে মুখস্থ করে একই লয়ে এবং ওই পারফেকশনে ওকে শোনানো ছিল আমার আসছে-সপ্তাহের কাজ। সেটি একই সঙ্গে ওস্তাদ রাশিদ খানের বেহাগের রেকর্ড এবং আমার প্রেমপর্বের উপাখ্যান!

কয়েক বছর আগে সরোদিয়া অনিন্দ্য ব্যানার্জিদা’র ডাকে ওস্তাদ রাশিদ খানের গানের অ্যাকাডেমিতে গুরু হিসেবে শেখালাম কিছুদিন। আমার গানের দিন উপস্থিত ছিলেন তিনি, কানে গোলাপি হিরের দুল, মুখে পান, অদ্ভুত বিস্ফারিত বিহ্বল দুটি চোখের কোণ চিকচিক করছে, আনন্দে না বেদনায়, কেউ বোঝেনি।

বন্দিশ …

শিল্প শেখানো যায় না। দিক্নির্দেশ দিয়ে দেন গুরু, শিষ্যকে নিজের রাস্তা খুঁজে নিতে হয়। রাশিদ খান ছেলেবেলায় বারো ঘণ্টা করে রেয়াজ এবং একুশ দিনের চিল্লা করতেন – এইসব কথা হাওয়ায় ভাসে। গান গাইতে চাইলে পরিশ্রম কমবেশি করতেই হয়, কিন্তু শিখে শিল্পী হওয়া যায় না। সাধনমার্গে একটি কথা আছে, আধার।  সকলের ভেতরে আধার আছে আর আছে ভাব। মনকে তুমি কোথায় রাখবে তার ওপর সাধনার মার্গ নির্ভর করে। আমার এক ছাত্রী  সেদিন ফুল দিয়ে পাত্র সাজাচ্ছিল।  দেখলাম উজ্জ্বল হলুদ সর্ষে আর সাদা মটর ফুলের মাঝখানে বেগুনি রঙের বেগুন ফুল রেখেছে। আঁতকে উঠলাম বটে, হায় হায়, এইগুলিতে তো ফল ধরত; কিন্তু ওই যে রঙের খেলায় তার মন আটকে গেছে, এই ধরতে পারার মাঝখানেই শিল্পের বোধ লুকিয়ে থাকে। একে বলে কুদরত কি দেন। এক অপার্থিব শিল্পসত্তা নিয়ে এসেছিলেন রাশিদ। কেউ বলেন, তিনি ওস্তাদ আমির খানের গায়কি অনুসরণ করতেন; কেউ বলে পণ্ডিত ভীমসেন যোশির; কিন্তু সেসব কথার কথা। গাইবার সময় তাঁর গান হাত ফস্কে বেরিয়ে যাওয়া অবাধ্য ঘোড়ার মতো খোলা মাঠে, নরম রোদে, ঘাড়ের পশম দুলিয়ে কোন দিকে ছুটে বেড়াত, তিনি নিজেও জানতেন না। শ্রোতারা যেমন অপার বিস্ময়ে সে-গান শুনত তিনিও বোধ করি তাই। 

বিস্তার …

ঢাকায় বেঙ্গলের অনুষ্ঠানে আমি শেষবার রাশিদ খানকে শুনি।  প্রবল শীত। একেবারে সামনের দিকেই বসেছি। প্রসঙ্গত বলি, আমি এমন একজনের কাছে শিখেছি যিনি রাগসংগীতের ব্যাপারে একাধারে প্রবল শাস্ত্রজ্ঞ গোঁড়া মানুষ, অন্যদিকে চরম আধুনিকমনস্ক ও যুক্তিবাদী। তাই গান শোনার সময় রাগ, তার ভাব এবং শাস্ত্রমতে প্রয়োগরীতি – এই সবের দিকেই মন থাকে আমার। সেই রাতে রাশিদকে একটু অস্বাভাবিক লেগেছিল। খুব দ্রুত দুটি রাগ অল্প সময়ের মধ্যে মিটিয়ে মালকোষ ধরলেন। শুরুতে বেশ খানিকক্ষণ আমি সেই গায়কির সুরের লাগাও, ফ্রেজের কম্বিনেশন, বঢ়তের কায়দা শুনে ভাবছিলাম, খামখেয়ালি এই গান কি আসলেই খেয়াল? গজল? ঠুমরি? যে আন্দাজে গান এগোচ্ছিল তা পুরোপুরি শাস্ত্রসম্মত এমন বলতে পারি না – সুরের প্রয়োগ এমন ছিল। কিন্তু সেই গানের যে ক্ষমতা এবং ব্যাপ্তি, হাজার কাটাছেঁড়ার পরেও তা মালকোষ এবং খেয়াল ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারে না। আস্তে আস্তে মনে হচ্ছিল রাশিদের ভেতরের এক উন্মাদ রাশিদ বাইরে এসে ওই বিশাল মঞ্চের মাথায় ডানা মেলে পাক খাচ্ছে! তার ডানার হাওয়ায় দেশ-কাল পেরিয়ে, কোমল গান্ধার কোমল নিষাদ আছড়ে পড়ছে! সে-এক অশরীরী উপস্থাপনা, ভাষায় প্রকাশ করার নয়। যেন দেহে বাঁধা-পড়া এক ফকিরমন মুক্তির জন্য ছটফট করছে। কী অবিশ্বাস্য দুঃসাহসী সেই গায়কি! সুতোর ওপর কিংবা খোলা তলোয়ার বা ছুরির ফলার মুখে নাচছে যেন এক কথায় ইনসেন অ্যান্ড ইন্টক্সিকেটেড। ওই পুকার, তারসপ্তকেও গলা গনগনে আগুন! ক্লান্তিহীন, বিশ্রামহীন ওই আর্তি, গোল হয়ে ফেনিয়ে-ওঠা তান, হলক আর কণ স্বরের বিস্ময়কর অ্যাপ্লিকেশন! গোটা উপস্থাপনা যেন স্পিলবার্গের সিনেমার মতো উৎকণ্ঠা, আবেগ, রোমাঞ্চে ভরা। বাস্তবিক এই শিল্পী চলে যাওয়ায় আগামী শ্রোতা, অনুভবী আবেগতাড়িত রাগসংগীত শোনার অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হলেন। এই শূন্যস্থান একমাত্র বিধাতাই পারবেন পূরণ করতে। 

তান …

এই পর্বের নাম আর বিষয়কে কিছুতেই আলাদা করা গেল না। এমন একটা বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, তানই হলো শাস্ত্রীয় গানের মূল প্রতিপাদ্য – অথচ এই গানের বাকি অঙ্গগুলির মতো তানও একটি অঙ্গ, গায়কিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে তোলার বিশেষ গয়না; কিন্তু চমক আর ঠমক মানুষকে সহজেই কাবু করতে পারে বলে বিদ্যুৎগতির তান আসরের সমস্ত আলোটুকুই শুষে নিতে থাকে বহুকাল। অথচ এক কালে তানেরও বিস্তার ছিল। বরাবর লয়, মধ্যলয়, দ্রুত এবং অতিদ্রুত লয় – এইভাবে ধাপে ধাপে তান এগোনোর কথা। মধ্যলয়ে বহেলওয়া-অঙ্গর তান রাশিদ খানের গলায় আলাদা মাত্রা পেত, সঙ্গে খণ্ডমেরুর এক অদ্ভুত প্রয়োগ করতেন মূলত ঘড়ির কাঁটার উল্টোমুখে, অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ।

তাতে যে প্যাটার্ন নিতেন তানের, তা গতিময়তা, ছন্দ এবং মীড়ের এক অদ্ভুত মাখো-মাখো আন্দাজে এগোতে থাকত।  পুকারে তো তাঁকে একশতে দুশো দিতে হবে। লম্বা দমে ওই তান ফিরে ফিরে এসে উদারা মুদারা ঘুরে তারায় গিয়ে পতাকা উড়িয়ে একটি সাপাট নিয়ে ফিরে আসে। তাতে ওজন সুর বারিকি কোনোকিছুই এক আনা এদিক-ওদিক হতো না, কিন্তু আফসোস, বেশ  কিছুদিন ওঁর মধ্যলয়ের রাজকীয় তান থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলাম। বিলম্বিত থেকেই অতিদ্রুত তান তুলতেন এবং শেষ অবধি সেই স্পিডই থাকত।  এই সামান্য অনুযোগটুকু রাখলাম। 

তেহাই এবং …

গান হয় দুজনের, রাজার অথবা ফকিরের। বহিরঙ্গের ভাবখানা রাজার আর মনের আকুতি ফকিরের। ওঁর গলায় বেহাগ, দেশ, কিরবানি ভোলার নয়।  একজন মানুষ বিখ্যাত হয়ে গেলে তাঁকে নিয়ে গল্পকথা অনেক শোনা যায়, বলাও যায়, কিন্তু লাভ হয় না তাতে। তাঁর কাজ নিয়ে ভাবতে বসা দরকার। আমরা যারা চর্চা করে, পাঠ্যবই সাজেশন বই পড়ে, উত্তরের মকশ করে, তারপর বিহগড়া বা মারুবেহাগ নিয়ে বসছি – তারা বেশ বুঝতে পারি রাশিদ খানের মতো গানের পাতিহাঁস হওয়া কতবড় এক বিস্ময়! ওস্তাদ আমির খানের পর এত লম্বা সময় রাগ গাওয়ার মতো ক্ষমতা এবং পাগলামি এই শিল্পীর ছিল, নইলে গোরখ কল্যাণের মতো রাগ বাহাত্তর মিনিট ধরে গাওয়া কি চাট্টিখানি কথা?

কুমার গন্ধর্ব বা আমির খানের বা রাশিদ খানের মতো শিল্পীর গায়কি পরে আর কেউ সেভাবে হাসিল করতে পারেননি, পারা সম্ভব নয়। এঁদের গান এঁদের নিজেদের ভাবনা, ম্যানারিজম, শিল্পচেতনার, একান্ত ব্যক্তিগত প্রকাশ। তা শুনে অনুপ্রাণিত হওয়া যায়, কিন্তু অনুসরণ করলেই সে-গায়কি হয় নকল, না হয় ফ্যাকাশে শোনাবে। পাসওয়ার্ড হ্যাক করার মতো তীক্ষ্নধী এবং মেধা নিয়ে বারবার শুনতে হবে। ভাবতে হবে, সুরকে, সুরের পথকে ভালোবাসতে হবে। অসময়ে চলে গেলেন, কিন্তু যা রেখে গেলেন তা উপচেপড়া মণিমাণিক্য – এখন আমরা তার কতটুকু যত্ন ও কদর করতে পারি সেটাই দেখার। 

আমার অন্তরের প্রণাম এবং অপার বিস্ময় রাখলাম তাঁর কাছে।মঞ্চ, শ্রোতা, উদ্যোক্তা, মিডিয়া এইসব বাধ্যতার ঘেরাটোপ ছেড়ে কেবল আপন আনন্দে গান গাইবেন এবার ওস্তাদ রাশিদ খান, অনন্তকাল।