আধুনিকায়ন আর বিশ্বায়নের প্রাপ্তি, নাকি খেসারত : বাঙালির নদী আর গানের সহমরণ

আজন্ম ঢাকা শহরে বেড়ে ওঠা এই আমি শহুরে জনপদের বাইরে নদী-প্রকৃতিকে জানবার চেষ্টা করেছি বইয়ের পাতায়, গানের বাণী আর সুরে। কিন্তু মানসচক্ষুতে তার উপলব্ধি গড়ে ওঠার পাশাপাশি চর্মচক্ষুতে দেখবার সুযোগ না ঘটলে ‘দেখা’ দর্শন হয়ে ওঠে না। স্কুলে যাওয়ারও বহু আগে কবে যে প্রথম ‘পদ্মার ঢেউ রে’ গানটি কিংবদন্তি শিল্পী ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে শুনেছিলাম মনে নেই। ওই বয়সেই গানটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। মনে মনে পদ্মা নদীকে কল্পনা করতাম ছবি বা সিনেমায় দেখা কোনো নদীর সঙ্গে। কিন্তু সেই কল্পনার নদী ‘পদ্মার ঢেউ’কে মনে মনে আঁকতে পারতাম কি? খুব স্পষ্ট মনে আছে, আট-ন’বছর বয়সে রাজশাহী যাওয়ার পথে উত্তাল পদ্মা নদী দেখে প্রথম বুঝেছিলাম নদীও কেমন করে ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে তার বিশালতার জানান দেয়। সেবারই চাঁদের ভরা জ্যোৎস্নায় বাবার হাত ধরে পদ্মাপাড়ে হেঁটে বেড়ানোর সময় দেখা রাতের অন্ধকারে কৃষ্ণকায়া নদীর ঝলমলে রূপ সারাজীবনের জন্য মনের মাঝে আঁকা হয়ে গিয়েছিল।

ও পদ্মারে, ঢেউয়ে তোর ঢেউ ওঠায় যেমন চাঁদের আলো

মোর বঁধুয়ার রূপ তেমনই ঝিলমিল করে কৃষ্ণ কালো।

আর তাই এই পরিণত বয়সে এসেও যখন এই পঙ্ক্তিগুলি সুরে সুরে গেয়ে উঠি, যখন আমি বাবার হাত ধরে পৌঁছে যাই শৈশবের সেই সন্ধেবেলাতে জ্যোৎস্নাস্নাত কৃষ্ণকায়া পদ্মা নদীর কাছে। হাজার মাইল দূরে বসেও পদ্মা নদী আমার কাছে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। মনে মনে ভাবি, ভাগ্যিস দেখেছিলাম সেই রূপ! আরো ভাবি, কত গভীরভাবে, কত নিবিড়ভাবে নদীকে দর্শন করলে, তাকে চিনলে বা জানলে, তবেই না অমন গান লেখা যায়! এই গান লিখতে বা লেখনীতে এই গানের রূপকল্প ফুটিয়ে তুলতে পদ্মা নদী আর পদ্মফুল দুই-ই চিনতে হবে, জানতে হবে। আর রূপকল্পের জাদুকর নজরুল বাংলার চিরায়ত প্রকৃতির এই দুই উপচারকে কী অদ্ভুত নিপুণতায় মিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর গীতিকাব্যে।

শুধু নজরুল কেন, কেবলমাত্র জননন্দিত এবং প্রতিষ্ঠিত কবি, ছড়াকার, গল্পকার, সাহিত্যিক, গীতিকবিরাই নন; আমাদের লোকায়ত জনপদের খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষ, আউল-বাউল, লোকজ কবি-গায়ক তাঁদের সৃষ্টির রসদ নিয়েছেন তাঁদের চারপাশের সহজ সাধারণ প্রকৃতি থেকে। খোলা আকাশ, দিগন্তবিস্তৃত সবুজ মাঠ, ছোট-বড় বহতা নদী, গ্রামভিত্তিক জীবনযাত্রা, ঋতুচক্র আর তাকে ঘিরে যাপিত জীবনের প্রাপ্তি-উদ্যাপন-শঙ্কা-প্রস্তুতি-আনন্দ-উৎসব, এই সবই এসেছে তাঁদের সহজিয়া কাব্যগাথায়, তাঁদের গানে। এই সব গান মুখে মুখে ফিরেছে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। এদেশের মাটি থেকে উৎসারিত এদের কথা আর সুর সহজ-সরল। যাঁদের বোধ থেকে, মনন থেকে এই সব গানের জন্ম হয়েছে, লালন-পালন হয়েছে, তাঁদের সকলের শেকড় এই মাটিতে। পূর্ব প্রজন্ম থেকে উত্তর প্রজন্মের মাঝে অপূর্ব এক মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে এই সকল চিরায়ত গানে। গ্রামীণ, প্রান্তিক, খেটে-খাওয়া মানুষের যাপিত জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে এই সব গানের সুরে, বাণীতে এবং চলনে।

আর তাই নদীবহুল পূর্বাঞ্চলের ভাটিয়ালি গানের চলন, বলন, গায়ন আর কাব্যধারার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া গানের পার্থক্য সুস্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয়। এমনকি সুরের প্রয়োগেও আছে নিজস্ব ধারা। ভাটিয়ালির সুরের প্রকাশে এক কূল থেকে নদীর স্রোতের শব্দ পেরিয়ে অন্য কূলে পৌঁছে যাওয়ার এক আকুল প্রয়াস আছে। তাই এতে তারসপ্তকের স্বর ব্যবহৃত হয় হামেশাই। কিন্তু উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়ার সুরের প্রয়োগে তারসপ্তকের চাইতে মুদারাসপ্তকের প্রয়োগ বেশি, কারণ এতে নদীর কূল ছাপিয়ে যাওয়ার তাড়না নেই।

তাল-লয়েও আছে বৈচিত্র্য। ভাটিয়ালির সুরে-তালে-লয়ে নিরন্তর বয়ে চলা নদীর অন্তহীনতা প্রকাশ পায়। আর তাই এর গায়নে লম্বা বিরতিহীনভাবে তারসপ্তকের স্বরে টান ধরার চল রয়েছে। আবার এর মাঝে নিস্তরঙ্গ নৌকার মাঝির বৈঠা বাইবার যে গতি, প্রকৃতি, বিরতি তারও প্রকাশ ঘটে স্পষ্টতই। অন্যদিকে উত্তরবঙ্গে নদী বা জলভূমি তুলনামূলকভাবে কম থাকায় গরুর গাড়ির বহুল প্রচলন ছিল। তাই সেখানকার রুক্ষশুষ্ক মাটির উঁচুনিচু মেঠোপথে গরুর গাড়ির চলনের ঝাঁকুনির সরব উপস্থিতি পাওয়া যায় ভাওয়াইয়া গানের সুরে, আধো-ভাঙা বা ভাঁজপড়া চলনে। নদীর এ-কূল পেরিয়ে ও-কূলে পৌঁছুবার আশা বা তাড়না নেই ভাওয়াইয়া গানের, তাই সুরের ভাঁজ বরং উঁচু স্বর হতে ক্রমশ নিচের দিকে নেমে আসে। ভাটিয়ালি গানে মাঝি, নৌকা, বৈঠা এসব শব্দ বারবার ফিরে আসে মূল উপজীব্য হয়ে। সেখানে কখনো মাঝি নিজেই গানের চরিত্র, আবার কখনো মাঝিকে উদ্দেশ করে গাওয়া হয় গান –

নাই বাইয়া যাও ভাটিয়ালি নাইয়া

ভাটিয়ালি নদী দিয়া

আমার বন্ধুর খবর কইয়ো

আমি যাইতেছি মরিয়া।

অন্যদিকে ভাওয়াইয়া গানে বারবার গরুর গাড়ি বা তার চালক ‘গাড়িয়ালে’র উল্লেখ পাওয়া যায়।

ওকি গাড়িয়াল ভাই

কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে।

আর কি কব দুস্কেরও জ্বালা, গাঁথিয়াছি কনমালা রে

ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত কাঁদি মুই নিদুয়া পাথারে রে…

ভাটিয়ালি বা ভাওয়াইয়া গানে নির্দিষ্ট জনপদের মানুষের আটপৌরে জীবনের দেখা মেলে, সেইসব মানুষের প্রতিদিনের জীবনের উপাদান এসব গানের রসদ জুগিয়েছে সেই কোন অনাদি অতীত থেকে। ঠিক তেমন করেই জারি, সারি, ধামাইল, গীতিকা, পালাগান, চটকা, ঝুমুর, ভাদু, টুসু বনবিবির গান, মনসার গান, মারফতি ও মুর্শিদী গানের উপাদান, উপচার, উপজীব্য সবকিছুরই জোগান দিয়েছে নির্দিষ্ট অঞ্চলের আবহাওয়া, ঋতু, প্রকৃতি, আকাশ, মাটি, নদী, সর্বোপরি নির্দিষ্ট গ্রামীণ জনপদের প্রান্তিক মানুষের দিনমান আর দিনান্তের জীবনলিপি, তাঁদের বিশ^াস, তাঁদের চিরায়ত সহজিয়া দর্শন। এসব গান, লোকজ সব উপাদান আমাদের বাঙালিয়ানার প্রাণভোমরা, আমাদের অনন্যমাত্রিক স্বকীয়তার জীয়নকাঠি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হয়েছে এই সম্পদ, চর্চিত আর চর্যিত হয়ে এসেছে কাল থেকে কালান্তরে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে অনেক কিছুই। বদলেছে জীবনযাত্রার গতি, প্রকৃতি। ফসলের আবাদি জমিতে ইটের দালান হয়েছে। উঁচুনিচু রাস্তা যেখানে গরুর গাড়ি চলতো, সেখানে পিচঢালা ঝকঝকে রাস্তা আর তা দিয়ে দূরপাল্লার বাস দ্রুতগতিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায় যাত্রী। নদীতে নৌকা চলে আর কই! আর চালাবার মাঝিরাই আর কোথায়! অকূল পাথার নদী কোথাও তার নাব্য হারিয়ে মরা নদী হয়ে বয়ে চলেছে, উত্তাল নদীকে কোথাও আবার শাসন করে ঝাঁ-চকচকে সেতু হয়েছে। ছোট্ট বাংলাদেশ আরো ছোট্ট হয়ে গেছে সংযোগ আর সম্পৃক্ততার সমন্বয়ে। বিশ্বায়ন, আধুনিকায়ন আর উন্নয়ন – এসবই তাৎপর্যপূর্ণ আর এর কোনোটাকেই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, সমীচীনও হয়তো নয়। এর জোয়ারে আমাদের প্রাপ্তি হয়তো অনেক আর তা নিয়ে আমাদের গর্ব করার জায়গাও নেহায়েত কম নয়। কিন্তু আমরা কি কি হারিয়েছি, তা হয়তো তেমন করে ভেবে দেখার অবকাশ আমাদের মেলে না।

বাংলাদেশের গ্রামগুলি আর এখন সেই অর্থে গ্রাম নেই, বদলে  গেছে আবহমানকাল ধরে চলে আসা গ্রামীণ জনপদে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। আর তাই চিরকালীন গ্রামীণ উৎসব, পালা-পার্বণের রীতি-রেওয়াজও বদলে গেছে। অঞ্চলভেদে পরবের আচার-রীতি কিংবা সামাজিক ধ্যান-ধারণাতে সেই অর্থে অনেক ক্ষেত্রেই এখন আর একান্ত অনন্যমাত্রিকতা নেই। বাঙালির সবকিছুতেই গান আর তাই হয়তো বাংলাদেশকে গানের দেশ, প্রাণের দেশ বলা হয়। আমাদের লোকজ সংস্কৃতির ভাণ্ডারে যেমন মাঝি আর গাড়িয়ালের গান, তেমনি আছে ছাদ পেটানোর গান, ধান ভানার গান, বেদে-বেদেনীর গান। আমাদের সারি গান আসলে ‘শ্রম সংগীত’ বা ‘শ্রমজীবীর সংগীত’। সারি গানে মাঝিমাল্লার গানের প্রাধান্য থাকলেও ফসল কাটা, ফসল তোলা, হাল চাষ, ক্ষেত নিড়ানো বা ফসল তোলার সময়কালীন কৃষিজীবী মানুষের অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধিও স্থান পেয়েছে। খেটে-খাওয়া মানুষ এই গান একসঙ্গে সুর মিলিয়ে গেয়ে তাঁদের কর্মোদ্যম আর স্পৃহা, শক্তি আর বল নতুন করে ফিরে পেতেন নতুন করে। নৌকাবাইচ খুব জনপ্রিয় উৎসব ছিল একসময়। নৌকাবাইচের সময় সারি গান দলের ভেতর উদ্যম আনে। নৌকার গতির তীব্রতা, ক্ষিপ্রতা বাড়ে, আর সঙ্গে জোর কদমে বাড়ে সারি গানের লয়। নৌকার বৈঠা ওঠা-নামার তালে তালে ঢোল, মন্দিরা, করতালসহ নানা বাদ্যযন্ত্রের সহযোগে সারি গান চলতে থাকে। এর সবটাই ছিল গ্রামীণ জনপদে গভীর আনন্দ আর নির্মল বিনোদনের জোগানদার।

আল্লায় বলিয়া নাও খোল রে, ভাই সক্কলি।

আল্লাহ বলিয়া খোল ॥

ওরে আল্লা বল নাও খোল

শয়তান যাবে দূরে॥

কিংবা,

নাও ছাড়িয়া দে পাল উড়াইয়া দে

ছল ছলাইয়া চলুক রে নাও মাঝ দইরা দিয়া ॥

আরে উড়ালি বিড়ালি বাওয়ে নাওয়ের বাদাম নড়ে

আথালি পাতালি পানি ছলাৎ ছলাৎ করে রে

আরে খল্ খলাইয়া হাইসা ওঠে বৈঠার হাতল চাইয়া ॥

গ্রামেও এখন আর জীবন নিস্তরঙ্গ নয়, একঘেয়ে নয় কোনোক্রমেই। বিনোদনের খোঁজে গ্রামীণ মানুষকেও খুব তোড়জোড় করে আয়োজন করতে হয় না। হাতের তালুতে

থাকা মোবাইল ফোনে এখন এক লহমায় হলিউড, বলিউড থেকে শুরু করে যা মন চায়, তাকেই ডেকে আনা যায়। বিনোদনের আনন্দও তাই এখন সামষ্টিক নয়, একান্ত ব্যক্তিগত। তাই তেমন করে আর নৌকাবাইচ করার দরকারও পড়ে না, প্রেরণাও জাগে না। নতুন করে আর সারি গান লেখা হয় না, গাওয়া হয় না। ছাদ-পেটানোর জন্য মানুষ লাগে না এখন, চাষাবাদ আর ধান ভানা, গাছ কাটাসহ অনেক কাজেই মানুষের জায়গা নিয়েছে যন্ত্র। তাতে আরাম মিলেছে নিশ্চয়ই, সময়ের অপচয়ও কমেছে। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে এই পেশাজীবী মানুষগুলি, এঁদের জীবনের গল্পগাথা, এঁদের গান, এঁদের ঘিরে পালা-পর্ব।

বিয়ের গানেও নদী ঘুরেফিরে এসেছে বারবার। ‘কে যাস রে ভাটিগাঙ বাইয়া, আমার ভাই ধনরে কইয়ো নাইওর নিতো বইলা’ বলে নাইওর যাওয়ার ইচ্ছের আকুলতায় মাঝিকে ডেকে গান করেছে ভিনদেশে বিয়ে হয়ে যাওয়া কনেবধূ। বিরহী প্রেমীর গানে নদী এসেছে সহস্রবার। নদীর জল আর চোখের জল একাকার হয়েছে গানের কথায়।

আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে

পুবালী বাতাসে –

বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি

আমার নি কেউ আসে রে ॥

যেদিন হতে নতুন পানি

আসল বাড়ির ঘাটে

অভাগিনীর মনে কত শত কথা উঠে রে ॥

আজকালের এই আধুনিক যুগে এরকম করে বলার আর দরকারই পড়ে না। আমাদের বিরহের ধরন বদলে গেছে, বদলে গেছে দুঃখ প্রকাশের ভঙ্গিমাও। তাই এসব গান লেখার আর সুযোগ নেই এই অতি দ্রুত চলমান সমাজে।

গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের সহজ, সরল, আড়ম্বরহীন আর বাহুল্যবর্জিত ইহজাগতিক চিন্তা আর পার্থিব জ্ঞানের সঙ্গে নিজেদের খোঁজার আর জানার পরম স্পৃহার সম্মিলনেই চিরকালীন লোকায়ত দর্শনের উদ্ভব ঘটেছে। আর সেখানে খুব স্বাভাবিকভাবেই বারবার এসেছে নদীর প্রসঙ্গ। অকূল পাথার নদী যেন বারংবার মানবজীবনের প্রতিরূপ হয়ে ধরা দিয়েছে।

আমি অপার হয়ে বসে আছি, ওহে দয়াময়

পারে লয়ে যাও আমায়।

আমি একা রইলাম ঘাটে, ভানু সে বসিলো পাটে,

আমি তোমা বিনে ঘোর সংকটে, না দেখি উপায়।

পরমাত্মার খোঁজ আর নিজেকে জানার বাসনা যখন একাকার হয়ে যায় এই লোকায়ত দর্শনে, তখনো কী সাবলীলভাবে চলে আসে নদীর প্রসঙ্গ।

মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে,

আমি আর বাইতে পারলাম না।

সারা জনম উজান বাইলাম

ভাটির নাগাল পাইলাম না।

এইসব গান হয়তো আজো আমরা শুনি রেডিও, টেলিভিশনে, দেশে-বিদেশে বাঙালির নানান ঝাঁ-চকচকে আয়োজনে; কিন্তু সেই গ্রাম, সেই নদী আমরা হারিয়ে ফেলেছি, হারিয়ে ফেলছি ক্রমাগত আমাদের বোধ থেকে। নদী মরে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন থেকে। মুখে যতই বলি না কেন নদীমাতৃক দেশ আমাদের, মায়ের মতো ভেবে তার যত্ন হয়তো আমরা নিইনি। তার থেকে কেবল নিয়েই গেছি, তাকে আগলে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি। তাই নদীকে ঘিরে, নদীর মানুষকে ঘিরে লেখা লোকজ গান, লোকজ সংস্কৃতি আমাদের উত্তর প্রজন্মের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রাসঙ্গিক। আমাদের চিরায়ত সুখ, দুঃখ, আনন্দ-অনুভূতির বোধে আর প্রকাশে বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে। তাই আমাদের আর মন মাঝির দেখাও মেলে না আর হয়তো কোনো প্রেমিক মাঝি আর ‘সব সখীরে পার করিতে নেবো আনা আনা’ও গেয়ে ওঠে না, বরং যুগ এসেছে গাইবার ‘বন্ধু তুই লোকাল বাস/ আদর কইরা ঘরে তুলস, হাত ধইরা নামাস’।