খুলির আকৃতি

চুল কাটা শেষ হলে নাপিত যখন মাথার পেছনে ও দুই পাশে আয়না ধরেছিল, তখন একত্রিশ বছর বয়সী নওশাদ হাফিজের চিন্তায় একটা খটকা ধাক্কা দেয়, ‘অন্যরকম লাগছে। খুলির শেইপ কি বদলে যাচ্ছে?’ 

পেছনের দেয়ালে ঝোলানো মেসির ড্রিবলিং, সামনের আয়নায় মাথার সঙ্গে ফুটবল এবং কয়েকটা লাল হলুদ বুট পরা পা মাথার পাশে, দেখা গেলেও নাপিতকে নওশাদ আরো দুবার আয়না ধরতে বলেছিল। দেখার পর নাপিতকে হাত তুলে ইশারা করে, অর্থ আয়না সরাও। টাকা দিয়ে বের হয়ে আসার সময় নওশাদ দুবার মাথায় এবং একবার পাতলা ঠোঁটের নিচে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে হাত বোলায়।   

সকাল সাড়ে নয়টা থেকে জট পাকানো চিন্তাটা সারাদিন তার মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। 

এক বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির হিউম্যান রিসোর্স সেকশনের অধূমপায়ী একজন টিম মেম্বার নওশাদ। অফিসের নেমকার্ডে – অ্যাসিট্যান্ট ম্যানেজার, এইচআর – নীল কালিতে বোল্ড টাইপে লেখা। কিছুদিন আগে অফিস থেকে লোন নিয়ে খয়েরি রঙের গাড়ি কিনেছে।  

যখন নতুন, পুরনো কারো সঙ্গে কথা বলার সময়, যদি ‘কী করেন?’, ‘কী করো?’, বা ‘এখন কী করছিস’, প্রশ্ন আসে, তখন ওষুধ কোম্পানির নামের সঙ্গে ‘অ্যাসিট্যান্ট ম্যানেজার এইচআর’ শব্দগুলি শুদ্ধ উচ্চারণে নওশাদ একটু জোর দিয়ে বলে।

কোনো কোনো, বিশেষ করে সরাসরি কথা বলা, এবং জীবনের চড়াই-উতরাইয়ের অভিজ্ঞতায় পোড় খেতে খেতে কাণ্ডজ্ঞানে শিক্ষিত হওয়া মানুষ ‘এইচআর’ শুনে বলেন, ‘হিউম্যান অ্যান্ড রিসোর্স এক এন্ডলেস কনফ্লিক্ট।’ নওশাদ জানে, এরকম বললে মৃদু হাসতে হয়, যা ট্যাবলেটের চকচকে ফয়েলের মতো বিশেষ করপোরেট-কালচার।

সকালে চুল কাটানোর পর বাজারে যাওয়ার কথা ছিল নওশাদের। অনলাইনে মাছ-মাংস-দুধ-ডিম-ঘি-বাটার-সবজি-হরলিক্স-মধু কেনা যাবে। এসি লাগানো এবং সব সময় সুগন্ধ ঘুরতে থাকা সেলুন থেকে বের হয়ে বাসায় দ্রুত ফিরে আসে। ‘মাথায় হাত যখন বুলালাম তখনো খুলির পেছন ও  চাঁদির দুই পাশের দুটো ডিপিও উঁচু উঁচু লাগল কেন?’

বাসায় ফিরেই নওশাদ লুঙ্গি ও টাচফোন নিয়ে বাথরুমে দ্রুত ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ডানে-বাঁয়ে মাথা ঘোরায়। নিচু করে। চোখ যতটা ওপরে তোলা যায়, তুলে চাঁদি ও মাথার ডানে-বাঁয়ে দেখে। ডান হাতে মাথার ওপরে, পেছনে ও

ডানে-বাঁয়ে ঘষে। ‘খুলির শেইপ কি বদলে যাচ্ছে?’

চুলে শ্যাম্পু দিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ায়। 

নওশাদের কয়েকটি ভালো লাগার মধ্যে একটা হলো, গোসলের সময় বাথরুমে মিউজিক শোনা।

শৈশবে জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরত। গোসলের সময় শাওয়ার মুখের ওপর ও হাতের তালুতে পড়তে দেয়। ডানে-বাঁয়ে নওশাদ দুলতে থাকে। কেউ দেখলে বলবে, নাচছে। বিয়ের পর তৃতীয় রাতে, ছিল গরমকাল, মিউজিক ছেড়ে, মোমবাতি জে¦লে বাথরুমে বউ রিহানার সঙ্গে ভিজে ভিজে নেচেছিল।

শ্যাম্পুর ফেনায় ডোবা চুল দুই হাতে ঘষার সময় হাত নিয়ে যায় পেছনে, ঘাড় পর্যন্ত। এবং ঘাড় থেকে হাত আস্তে আস্তে ঘষাতে ঘষাতে নিয়ে আসে কপালের ওপর। কয়েকবার একই কাজ করে। সন্দেহ নাছোড়।

আয়নার সামনে আসে। ফোনে বাজতে থাকা মিউজিক বন্ধ করে। চুল থেকে শ্যাম্পুর বুদ্বুদ মোছে। হাত দিয়েই মোছে। প্রতিবিম্বের দিকে চোখ স্থির। মনোযোগ অনড়। ‘খুলির শেইপ কি ঠিক আছে?’ ঠোঁটের প্রতিবিম্ব নড়ল।

নওশাদ কখনো গোসল করে তোয়ালে জড়িয়ে বের হয় না। সামনে পড়ল রিহানা। চোখ কুঁচকে তাকায়। ‘লুঙ্গি নিয়াই তো দৌড়ে বাথরুমে ঢুকলা।’

নওশাদ বাথরুমে ফিরে যায়।

রিহানা হাসছে। নওশাদ শুনল, রিহানা তার শাশুড়িকে হাসির কারণ বলছে।

‘রিহানাকে চিন্তাটা বলা কি ঠিক হবে? মাথায় হাত দিতে বলব? চাঁদির দুই দিক উঁচু লাগছে নাকি? শুনেই হাসবে। মা, শায়লা আর তানভীকে ডাকবে। শায়লা কোনো কথা না বলে ভাইয়ের মাথার দিকে তাকাবে। চার বছরের তানভী একটু চিন্তা করে তার বাপের মাথায় হাত দিয়ে দেখতে পারে শেইপ আসলেও ঠিক আছে কি না। বাসায় যখন কেউ আসবে তাকে তানভী হেসে হেসে বলবে বাবার মাথা মাঙ্কির মাথার মতো হয়ে যাচ্ছে। আর আমি তখন বানর উচ্চারণে ‘বা’ বলার পর দু-এক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে ‘নর’ বলতে পারব না।’

রিহানাকে বলেনি। বেডরুমের আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতে চিরুনি। নওশাদ সব সময় বাঁ পাশে সিঁথি করে। ডান পাশে সামান্য ব্যাকব্রাশ স্টাইলে চুল আঁচড়ায়। সিঁথি করল না। চাঁদি থেকে চুল আঁচড়ে কপাল পর্যন্ত আনল। ঘাড়ের ও দুই কানের দিকে আঁচড়ায়। একই রকমে আঁচড়াল কয়েকবার। প্রতিবারই চিরুনিটা খুব আলতোভাবে মাথার সবদিকে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, খুলিটা উঁচুনিচু হয়েছে কি না।

রিহানা ঘরে ঢোকে। হাতে মোবাইল। নওশাদ চুল আঁচড়ানোয় ব্যস্ত। ‘আমার বান্ধবী পলা তোমার সঙ্গে কথা বলবে। চুল কপাল পর্যন্ত কেন? আগে তো কখনো ওভাবে চুল আঁচড়াতে না।’ 

নওশাদ বাঁ হাতে মোবাইল নিল। পাশে দাঁড়ানো রিহানা। কথা শুনবে। পলার বাসায় কাল সন্ধ্যায় পার্টি।

‘অবশ্যই যাবো। এক বোতল ব্ল্যাক লেবেল আনব। শিহাব পছন্দ করে’, বলেই রিহানার হাতে মোবাইল দ্রুত দিয়ে নওশাদ বাঁ পাশে সিঁথি করে চুল আঁচড়ায়।

ফিরে যাওয়ার সময় রিহানা আড়চোখে নওশাদকে দেখে। 

‘মনে হচ্ছে খুলির আকার তো ঠিকই আছে।’ নিজেকে বলে নওশাদ মাথায় আবার হাত দিলো।

‘কী হলো তোমার? চুল আঁচড়ায়ে মাথায় হাত দিলা ক্যান?’

নওশাদ মিথ্যে বললো, ‘চুলকাচ্ছিল। মনে হয় খুশকি।’ 

‘তোমার তো খুশকি হয় না।’ 

‘হতে কতক্ষণ?’

দুই

ছুটির দিনে সকালে নাস্তা খাওয়ার পর খাটের মাথার দিকে পিঠে বালিশ দিয়ে নওশাদ, দুটো পা সামনে ছড়ানো, হাতের বাঁ পাশে ছোট টেবিলে কফি, বিলাসিতা, ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ে আর কফিতে চুমুক দেয়।

কাগজের কোনো কোনো খবরের শুধু হেডলাইন দেখে। ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ’, ‘আমেরিকার অস্ত্র সহযোগিতা’ – এইসব খবরের হেডিং বদলে যে-কোনো সময় হতে পারে ‘ভারতের সীমান্তে চীনের মহড়া’ বা ‘জার্মানির অস্ত্র উৎপাদনের ব্যয় এক ট্রিলিয়ন ইউরো’, ‘ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে দশ ফিলিস্তিনি নিহত।’ কিন্তু যখন ‘সোফিয়া, গ্রেস আর ডেসডিমোনা মানবিক রোবট’, ‘জেন্ডার বদলে মা হলেন একজন’, ‘তরুণ-তরুণীরা মোবাইল-হলিক হয়ে যাচ্ছে’, ‘তিন লক্ষ বছর আগের ফসিল’, ‘সমুদ্রে কয়েক লক্ষ টন মৃত মাছ ভাসছে, নিচে পলিথিনের বড় বড় মাঠ’  – এরকম খবর পড়ে, তখন নওশাদের মাথায় চিন্তাজট পাকাতে থাকে। খবরগুলি মাথা থেকে ফেলে দেওয়ার উপায় খোঁজে। স্বপ্নের মধ্যেও খবরের দৃশ্য তাকে তাড়ায়।

আজ কাগজ পড়ছে না। ডান পাশে না-খোলা কাগজ। জ্যামিতির কম্পাসের মতো দুই পা ভাঁজ করা। নাভির ওপর, বাঁ হাতে ধরা দশ বাই ছয় সাইজের ট্যাব। স্ক্রিনে চোখ স্থির। মনোযোগ অনড়।

রিহানা এসে পাশে দাঁড়ালো। হাতে কফির কাপ। বিছানায় বসেনি। শাশুড়ি ও ননদিনী শায়লার সঙ্গে বারান্দায় বসে খাবে। তানভীরের জন্যে দুধ ও মধু মেশানো হরলিক্স। সে এক জায়গায় বসে খায় না। এ-ঘরে ও-ঘরে খেয়ালমতো ঘোরে। হাতে থাকে স্মার্টফোন। অনেকরকম গেমে তার ব্যস্ততা শেষ হয় না। চশমা পরে। উচ্চতা বাড়ছে না।

‘কি, কাগজ পড়বা না?’ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল রিহানা।

নওশাদের চোখ ট্যাবে। ‘পরে পড়ব।’

‘কী দেখতিছ?’

‘মজার একটা জিনিস। বারান্দায় যাও। মা বসে আছে।’

‘কী?’

‘দেখো।’

‘স্কাল দেখার কী আছে?’

‘আছে। সকালে আমার মনে হলো অ্যানথ্রোপলজি সম্পর্কে একটু পড়াশোনা করা দরকার। বিশেষ করে জানতে ইচ্ছা হলো, মানুষের খুলির শেইপ এখনকার মতো হতে কত হাজার বছর গেছে।’ 

রিহানা বলল, ‘অন্য কোনো ব্যাপার আছে। আমাকে বলছ না।’

‘কোনো ব্যাপার নেই।’

রিহানা চলে যাওয়ার সময় বলল, ‘আমাকে তুমি না বলে থাকতে পারবা না। তুমি কেন গুগলে খুলি দেখতিছ? বিয়ের আগে আমরা তিন বছর প্রেম করছি, কোনোদিন তোমার মুখে

অ্যানথ্রোপলজির কথা শুনি নাই।’  

নওশাদ ব্যস্ত। রিহানা ঘর থেকে দরজার কাছে গিয়ে নওশাদের দিকে মাথা ঘোরায়। নওশাদ পরপর দু-তিনবার কফিতে চুমুক দিলো, যা আগে কোনোদিন করেনি। চোখ ট্যাবের স্ক্রিনে।  

তিন

কাঁটাবনের ঢালে আটতলার অ্যাপার্টমেন্ট। দোতলার বাসিন্দা নওশাদ। তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট। দক্ষিণমুখী বড় বারান্দার ডানে ও বাঁয়ে দুটি ঘর। পুবদিকের ঘর রিহানা ও নওশাদের। পশ্চিমে মা ও তানভীর থাকে। শায়লার ঘর উত্তরে। মায়ের ঘরের কোনায় নিমগাছ। বারান্দা থেকে নিমের পাতা ছেঁড়া যায়। বুড়ো মানুষটা সপ্তাহে তিনদিন নিমের পাতা দিয়ে দাঁত মাজেন। 

একদিন পরপর সকালে রিহানা বা শায়লা বারান্দার টবের গাছগুলিতে পানি দেয়।

শাশুড়ির ঘরের সামনে তুলসী, লেমনগ্রাস ও নয়নতারায় পানি দেওয়ার পর নিজেদের ঘরের সামনে গোলাপগাছে পানি দেওয়া শেষ হলে ঝুলন্ত টবের ক্যাকটাসে চোখ পড়ে রিহানার। কয়েকটা কালো ডাই পিঁপড়া ক্যাকটাসে ওঠানামা করছে। গ্রিলে বসে থাকা দুটি চড়ুই পিঁপড়াদের চলাফেরা মাপছিল। বিরক্তি নিয়ে উড়ে গেল।

রিহানার হাতে ছোট ঝাঁঝর। পানি নেই। বাথরুম থেকে পানি আনতে হবে। ঘরের পর্দা তুলে দেখে, ট্যাবের স্ক্রিনে নওশাদের তর্জনী দ্রুত ঘুরছে।

নওশাদ খেয়াল করেনি, রিহানা পেছনে দাঁড়িয়ে। কোনো কোনো উপস্থিতিতে নৈঃশব্দ্য থাকে।

স্ক্রিনে বিভিন্ন আকারের মাথার খুলির ছবি। নওশাদ একটা খুলির ওপর ডান হাতের তর্জনী ঘষছে। খুলি বড় হচ্ছে। খুলিটার কোন অংশের কী নাম বারবার পড়তে থাকে। স্বর ফিসফিস। রিহানা আগে কোনোদিন শব্দগুলি শোনেনি। 

‘এথমোইড বোন। খুলির মাঝখানের ছোট হাড়।’

নওশাদ নিজের খুলির ছোট হাড়ে তর্জনী ও মধ্যমা বুলায়।  

‘ফ্রন্টাল বোন। ঠিকই তো আছে।’

‘ল্যাক্রিমাল ও জাইগোম্যাটিক বোন।’ হাতের তালু দিয়ে হাড় দুটোতে আলতোভাবে নওশাদ চাপ দেয়। চোখ সরু করে। ‘একটু উঁচু লাগছে।’ আবার হাত বুলায়।

খুলির ডান ও বাঁয়ে প্যারিইটাল বোনে হাত বুলায়। চোখে সন্দেহ। দঁাঁত কামড়ানোর শব্দ আসে।   

‘খুলিটা কি একটু গরম গরম লাগছে? ব্রেইন কি গরম হচ্ছে?’ চাঁদির পেছনে, দুই পাশে, খুলিতে তালু দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে তাপ কতটুকু।

স্পষ্ট উচ্চারণে নওশাদ তিনটি শব্দ বললো থেমে থেমে : ‘নিয়ানডারথাল। অ্যানশিয়েন্ট। অ্যানসেসটরস।’

‘হা হা হা’, রিহানা হাসছে। নওশাদ চমকে ওঠে। ‘এখানে কখন আসছ?’

‘আমাকে বলবা তোমার কী হইছে? মাথার খুলি নিয়া পড়ছ ক্যান? মাথায় বারবার হাত দিচ্ছ ক্যান?’

প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে নওশাদ বলল, ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং। স্কালের ছবি দেখছি আর আমার স্কাল নেড়ে বোঝার চেষ্টা করছি।’

‘মনে হচ্ছে তুমি আসল কথাটা বলতিছ না। কিছু একটা লুকাইতেছ। অফিসের লায়লা তোমার মাথার সাইজ নিয়া কিছু বলছে?’

নওশাদ  হাসল।

‘আসল কথা এড়াবার জন্যি হাসি এরকমের উত্তর। কিন্তু ঠিক উত্তর না। খুলি দেখা আর মাথায় হাত বুলাবার আসল কারণ কী?’

‘আরে মেয়েদের চোখ আর মনকে কখনো ফাঁকি দেওয়া যায়?’

‘কথা ঘুরাবা না।’

‘বলেছি তো স্কালের হিস্ট্রি বুঝতে চাইছি।’

‘আমি লায়লাকে ফোন করব।’

‘আমাদের জীবনে লায়লাকে আনবে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমরা শান্তিতে আছি। লায়লা আমার কলিগ।

গায়ে-পড়া মেয়ে। ওকে নিয়ে আমরা সবাই হাসাহাসি করি।’

‘কথাগুলা যেন মনে থাকে।’ বলে রিহানা নওশাদের মাথায় হাত দিয়ে হেসে বলল, ‘মাথার খুলি ঠিক আছে। মনে হয় বুদ্ধির সাইজ বেঢপ হয়ে যাচ্ছে।’

ঘরে ঢুকল তানভী ও শায়লা। ভাবি ও ভাই কথা বলছে শুনে শায়লা চলে যাচ্ছিল। রিহানা ডাক দেয়। ‘কিছু বলবা?’ শায়লা মাথা ঝাঁকায়। অর্থ – না।

‘ভেতরে আসো।’

তানভী এসে বাবার পাশে বিছানায় বসেছে। ট্যাবের স্ক্রিনে চোখ। 

‘বাবা স্কাল একরম ছিল?’ বলেই নিজের মাথায় তানভী হাত দেয়। হাসে। ‘আমারটা তো ওরকম না।’

‘তোমারটা কেমন?’

তানভী আবার মাথায় হাত দেয়। হাসে। ‘আমারটা তো গোল গোল।’

রিহানা বলে, ‘বাবার মাথায় হাত ঘোরাও। দেখো গোল না লম্বা?’ স্বর বিরক্তির।

শায়লার চোখও স্ক্রিনে। কথা বলছে না। ভাইকেও দেখছে। একবার মাথায় হাত দিলো। দৃশ্যে দৃশ্য আসে। ঠোঁট নড়ল। হেসেছে। 

সকালে সেলুন থেকে আসার পর নওশাদ কী কী করেছে না করেছে শায়লাকে বলল রিহানা, ‘তোমার ভাই মাথার খুলি নিয়া পড়ছে। হাত, মুখ, নাক, বডির ফর্ম এসব নিয়ে গুগলে কিছুই দেখতেছে না। শুধু দেখতেছে খুলির বিভিন্ন আকার। তোমার ভাই আমাকে কারণ কয় না।’ 

নওশাদ কিছু বলছে না। চোখ স্ক্রিনে। তানভী একটা খুলির ওপর আঙুল রাখে। ছবি বড় হচ্ছে। কপালের নিচে নাকের, মুখের গর্ত এবং ভাঙা তিন-চারটি হলদেটে দাঁত বড় হতে হতে সম্পূর্ণ স্ক্রিন ভরে যায়। যেন দুটো গর্ত দাঁতের সঙ্গে হা করে এগিয়ে আসছে। তানভী স্ক্রিন থেকে আঙুল তুলে নেয়। দুই হাতে চোখ ঢাকে। ‘বাবা স্কাল মুছে দাও।’

মা ঘরে ঢোকে। শায়লা ও রিহানার দিকে আসতে আসতে বলেন, ‘কী দেখতেছ?’  

রিহানা বললো, ‘আপনার ছেলে মাথার খুলি নিয়ে পড়ছে।’

বুড়ো মানুষটা অবাক হন। শায়লার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তানভী দাদিকে বলে, ‘দিদা তোমার স্কাল কি মাঙ্কির স্কালের মতো?’

দাদি হাসেন। স্ক্রিনে চোখ পড়ে। বসলেন খাটের বাঁ পাশে রাখা চেয়ারে।  ছেলেকে বললেন, ‘স্বপন, এত খুলি ক্যান?’

নওশাদ ওরফে স্বপন উত্তর দেওয়ার আগেই তানভী বলল, ‘দিদা স্কাল বড় করা যায়, ছোট করা যায়। একটা স্কালের কপালের নিচে দুটো বড় গর্ত। মুখটা হাঁ করে আমাকে খেতে আসছিল। আমার খুব ভয় করল!’ বলেই বাবাকে বলে, ‘দিদা দেখুক। বড় করো।’

রিহানা বলল, ‘তুমি না বড় স্কাল দেখে ভয় পাইলা।’ 

‘এবার ভয় পাবে না।’ বললেন দিদা।

নওশাদ একটা খুলি বড় করে। ‘এই স্কালটা স্টোন এইজের।’

নাক, মুখ, চোখ ও কানের গর্তে অন্ধকারের স্তূপ জমে আছে।

নওশাদের কথা শুনে রিহানা বলল, ‘খুলিটা এ-যুগেরও হতে পারে।’ কথায় ছিল টিটকারি।

তানভী নিজের কানের গর্তে আঙুল ঢোকায়। তার দিদা নিজের মাথায় হাত দিতেই শায়লা হেসে বলল, ‘মা, তুমি কী দেখতেছ তোমার মাথার সাইজ ঠিক আছে কি না?’

রিহানা হাসে। শব্দ হয় না।

‘তোমরা এখন যাও। আমি আরো কিছুক্ষণ দেখব।’

‘দেখ তোমার স্কালের ফিউচার কী।’

রিহানার কথার জবাব দিলো না নওশাদ। 

চার

নওশাদ ট্যাব খোলা রেখেই কিচেনে যায়। আরো এক কাপ কফি দরকার। ‘তোমরা খুলি দেখ আর মাথায় হাত দাও।’ রিহানাকে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল। বলেনি।

পানি ফুটছে। ফুঁসছে। টগবগের দিকে নওশাদের চোখ। ডান হাত এক স্বয়ংক্রিয় ক্রিয়ায় মাথায় উঠে গেল।  ‘সন্দেহটা ছাড়ছে না কেন?’

ট্যাবে পড়া কথাটা মনে পড়াতে খুশি হয় : ‘হোমো সেপিয়ান্স বেজ্ড অন দ্য ফিচার্স অব দেয়ার স্কালস অ্যালোন। বিকজ স্কালস ভ্যারি ইন দ্য অবভিয়াস ওয়েজ অ্যান্ড মে হ্যাভ সারভাইভড অ্যাজ …’ পরের শব্দগুলি মনে করতে পারল না।  

বাসার চার রকম বয়সের চারজন ট্যাবে অনেকরকম খুলি দেখছে। স্ক্রিনে রিহানার তর্জনী। কোনো কোনো খুলি দেখে তানভী বলছে, ‘মা একটু বড় করো। বেশি বড় করবে না।’

‘বড় করলে তুমি ভয় পাবা।’ রিহানার কথা শুনে প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়া শাশুড়ি বললেন, ‘বড় করো। শিশুদের কৌতূহলের উত্তর দিতে হয়। ওকে বোঝাও।’  

শায়লা মাথার ডান ও বাঁ পাশে হাত দিলো। কয়েকটা ইংরেজি বাক্য পড়ে, নিজের মতো অনুবাদ করে : ‘এক লক্ষ বছর আগে থেকে মানুষের মুখ ও শরীরের গঠন বদলাতে থাকে।’ পড়ার পরেই ডান পাশে ঘুরে আয়নায় নিজেকে দেখে।

রিহানা খুলি দেখতে দেখতে বলল, ‘ইন্টারেস্টিং।’

শাশুড়ি জানতে চান, ‘কী ইন্টারেস্টিং।’

‘নৃতাত্ত্বিকরা বলেন খুলির বৃদ্ধি সমাজবিকাশের গল্প বলে।’

ধর্মপ্রাণ মানুষটার বিশ্বাস হয়নি। হাসেন।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শায়লা বলল, ‘ভাবি, তুমিও কিন্তু দু-একবার মাথায় হাত দিয়েছ। তোমার খুলির আকার ঠিক আছে?’   

খালার কথা শুনে তানভী তার মায়ের মাথায় হাত বুলায়। নিজেরও। রিহানা ট্যাব বন্ধ করে।

হাতে কফি নিয়ে ঘরে ঢুকল নওশাদ। ‘কী কী দেখলে আর পড়লে?’

রিহানা বলল, ‘তুমি যা যা দেখছ আর পড়ছ আমরা সব দেখিনি। পড়িনি। মা আপনার ছেলেকে বলেন, মাথার খুলিতে দেখার কিছু নেই।’

নওশাদ বিছানায় বসে খুলল ট্যাব। ‘খুলির মধ্যে ব্রেইন আছে। পড়ে দেখি আমাদের ব্রেইন কী অবস্থায় আছে।’

কথাটি বলল রিহানাকে রাগানোর জন্যে।

‘তোমার ঘিলু কি ঠিক আছে? দেখো।’ বলে রিহানা চলে গেল। স্যান্ডেলের ঠাস ঠাস শব্দের মধ্যে দরজার কাছে গিয়ে রিহানা শুনল : ‘সেরেব্রাম। সেরেবেলাম।’ সঙ্গে নওশাদের হাসি। 

তানভী বসেছিল বাবার পাশে। ‘কী বলছ বাবা?’

‘তুমি বড় হলে বুঝবে।’

রিহানা ঘরে ফিরে আসে। ‘তোমার বাজার তো আসলো না।’

‘ক-ল করো।’

মা ও শায়লার কৌতূহল হচ্ছে ব্রেইন দেখার। শায়লা দাঁড়িয়েছে মায়ের পেছনে।

তানভী মাকে ডাকে, ‘মম এসো। ব্রেইন দেখ।’

‘তোরা দ্যাখ।’ বলে রান্নাঘরে যায়। রিহানার ডান হাত স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাথায় চলে আসে। দ্রুত হাত নামায়।

চারজনের মধ্যে কেউই কথা বলছে না। নওশাদ স্ক্রিনে ব্রেইনটাকে একবার বড়, একবার ছোট করছে। তানভীরের চোখের দৃষ্টি স্থির। শায়লা আর মায়েরও।

তানভী বলল, ‘আমি খাসির ব্রেইন আর খাবো না।’

দাদি হেসে ওঠেন। সঙ্গে নওশাদও।

‘মা শোনো, ব্রেইনের ডান পাশ কন্ট্রোল করে আমাদের শরীরের বাঁ পাশ আর বাঁ পাশ কন্ট্রোল করে ডান পাশ। ব্যাপারটা বেশ পলিটিক্যাল। ডান ও বামপন্থীদের রাজনীতি।’ বলে হাসল নওশাদ।

‘আমি বুঝি না।’

‘হাইপোথ্যালামাস কী?’ প্রশ্ন করে শায়লা।

‘তুই পড়ে নিস।’

‘হাইপোথ্যালামাস আবেগ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা কন্ট্রোল করে।’ বলল না, সেক্সুয়াল রেসপন্সকেও। 

‘মা একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় জানলাম। তা হলো, গত আড়াইশো বছর থেকে মাথার খুলি বিপজ্জনক সমস্যার দিকে চলে যাচ্ছে।’

‘কে বলল?’

‘গবেষণা। আরো আছে। খুলির আকার সমাজবিকাশের কথাও বলে।’

মা হেসে বললেন, ‘আজগুবি কথা। রিহানাও বলছিল। এইসব দেখা বন্ধ কর। আমি যাই।’

তানভী বাবার পাশে বসে থাকে।

শায়লা মায়ের সঙ্গে চলে গেল।

মায়ের মনে পড়ে, অনেক বছর আগে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লেখা ‘ভবিষ্যতের মানুষ’ শিরোনামের একটা প্রবন্ধ তিনি পড়েছিলেন। প্রবন্ধের মূল কথা ছিল : একসময় মানুষের মাথা অনেক বড় হয়ে যাবে, হাত-পা হবে ছোট ছোট।

নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে তিনি মাথায় একবার হাত দিলেন। শায়লা দেখল। কিছু বলেনি। নিজের ঘরে গিয়ে শায়লা আয়নার সামনে দাঁড়ায়। খুলিতে হাত দেয়। সন্দেহ হয়, চাঁদির দুই পাশ কি উঁচু উঁচু লাগছে?  

‘সমাজবিকাশ তো হয় মানুষের কাজ ও চিন্তার বহুরকম ব্যবহারের কারণে।’ কথাটা ভাবতে ভাবতে নওশাদ ট্যাব বন্ধ করে।

‘বাবা আর দেখবে না?’

‘না।’

তানভী চলে গেল।  

‘সমাজের বিকাশ যেসব কারণে ঘটে তার মধ্যে অনেক বিষয় জটিলভাবে জড়াজড়ি করে থাকে। একটার সঙ্গে আর একটা মাকড়জালের মতো জড়ানো। মানুষের মাথার খুলি কি যুদ্ধ, নতুন নতুন প্রযুক্তি, একাকিত্ব, সভ্যতার নামে অ-মানবিক দৌড়ঝাঁপ আর সীমাহীন তথ্যের অতি চাপের কারণে শেইপলেস হয়ে যাচ্ছে?’ নওশাদের মাথায় প্রশ্নটি আসার পর নিজেই উত্তরহীন হয়ে যায়। ‘কার সঙ্গে এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলা যায়? সোফিয়া, গ্রেস আর ডেসডিমোনা মানবিক রোবট। রোবট কীভাবে মানবিক হয়?’

পাঁচ

নওশাদ কাপড় পরছিল। রিহানা জিজ্ঞেস করে, ‘বাইরে যাবে নাকি?’ 

‘চিড়িয়াখানায় যাব।’

‘চিড়িয়াখানায় কেন?’ 

‘অনেকদিন যাইনি।’

‘তানভী আর শায়লাকে নিয়ে যাও। তানভী সেদিন বলছিল জু-তে যাবে।’ 

‘এই তোরা রেডি হ।’ বলে ড্রাইভারকে ফোনে বলল, ‘বাইরে যাবো। একটু পর নামছি।’

চিড়িয়াখানায় নওশাদ বানর, উল্লুক ও শিম্পাঞ্জির মাথার ছবি বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে তুলবে। করবে ভিডিও। এবং কখনো কখনো বানর, উল্লুক ও শিম্পাঞ্জির মাথার সঙ্গে ছোটবড় বয়সের দর্শনার্থীর মাথাকে পাশাপাশি রেখে তুলবে ছবি।

চিড়িয়াখানার সামনে থেকে নওশাদ এক হালি সাগরকলা ও আড়াইশো গ্রাম চিনেবাদাম কিনল। শায়লা বানরকে কলা দেবে ও খাওয়াবে। তানভীকে বলল, ‘তোর হাত থেকে বানর চিনেবাদাম নেবে। ভয় পাবি না।’  শায়লা  কলা ও তানভী  চিনেবাদাম খাওয়ানোর সময় নওশাদ ওদের মাথার সঙ্গে পশুর মাথার ছবি তুলবে।

চিড়িয়াখানায় বেড়াতে আসা মানুষদের পাশাপাশি রেখে নওশাদ পরিকল্পনামতো বানর, উল্লুক ও শিম্পাঞ্জির ছবি তুললো। ‘সব ছবি প্রিন্ট করবো।’

সন্ধ্যা পর্যন্ত ওরা ছিল চিড়িয়াখানায়। নওশাদ সেলফি তুলেছে উল্লুক ও বানরের সঙ্গে। করেছে ভিডিও।

ফেরার পথে নওশাদ বানরের কয়েকটা ছবি পাঠাল আর্টিস্ট বন্ধু ফয়সলকে। ছবির নিচে লিখল,  চিড়িয়াখানায় বনের আত্মীয়দের সঙ্গে। কাল সকালে তোর ওখানে আসব। জরুরি কথা আছে।

ফয়সল লিখলো, ‘সন্ধ্যায় ফ্রি আছি, চলে আয়। কাল সকালে থাকব না।’

ফার্মগেটে জঘন্য জ্যাম। গাড়ির জঙ্গলের মাথা কারওয়ান বাজারের মোড় পর্যন্ত। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নওশাদের গাড়ির ডানে-বাঁয়ে ও পেছনে দাঁড়ায় কয়েকটা গাড়ি ও বাস। একটা অ্যাম্বুলেন্স পেছন থেকে সাইরেন বাজাচ্ছে। কোনো কোনো গাড়ির চালকও দিচ্ছে হর্ন। ‘জ্যামে আটকে পড়ে হর্ন কেন দিচ্ছে?’ নওশাদকে বলল শায়লা। ‘আমরা এরকমই’, বলল নওশাদ।

ডান দিকে নওশাদ তাকাল। সাধারণ মানের গাড়িতে চারজন, বয়স হবে কুড়ি-পঁচিশের মধ্যে। সবার কানে হেডফোন। নিজের সঙ্গেই ব্যস্ত। নওশাদ তাকায় বাঁয়ে। দামি গাড়িতে ড্রাইভার বাদে তিনজন। সবার কানে হেডফোন। দুজনের মুখ হাসি হাসি। একজন গম্ভীর।

‘আচ্ছা, মাথার মধ্যে ক্রমাগত বিভিন্ন সামাজিক-অসামাজিক কথা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ, ঝগড়া, তর্ক আর প্রতিযোগিতার ম্যাট্রিক্স ঢোকার ফলে নিশ্চয়ই ব্রেনে অনেকরকম ঝড় হতে থাকে। ফলে, খুলির আকার বদলে যাচ্ছে না তো?’ চিন্তাটা আসতেই আবার নিজের মাথায় হাত দেয় নওশাদ। ‘ফয়সলের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হবে।’

বাসায় ফেরার পর তানভী তার মা ও দিদাকে চিড়িয়াখানায় কী কী করেছে বলে।

নওশাদ টাচফোনের সুইচটা অব করে। বিছানার ওপর রাখে। ক্যামেরাও। বাথরুমে গেল।

রিহানা নওশাদের টাচফোন অন করে। হলো না। ‘নওশাদের ফোন সবসময় তো খোলা থাকে। বন্ধ কেন?’

সন্দেহ তাড়ায়। সারাদিন নওশাদ যা যা করেছে তার হিসাব করে রিহানা। সিদ্ধান্তের কাছাকাছি যায়, নওশাদ কিছু একটা গোপন করছে।

নওশাদ বাথরুম থেকে আসতেই রিহানা নওশাদের মুখের সামনে ফোনটা তুলে ধরে, ‘আন লক করো।’

নওশাদ হাসল। আন লক করে।

চিড়িয়াখানায় তোলা সব ছবি রিহানা দেখল।

শিম্পাঞ্জির মাথার পাশে তানভীরের মাথা। বানরের মাথার পাশে শায়লার মাথা। চিড়িয়াখানায় আসা বিভিন্ন বয়সের মানুষের মাথার সঙ্গে শিম্পাঞ্জি, বানর, হরিণ, বাঘ, উল্লুক, গণ্ডার আর বুনো মোষের মাথা এমনভাবে তোলা, যে কেউ দেখলে বলবে, ‘পশু আর মানুষের মাথার আকারে খুব একটা পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না। মানুষগুলির চুল আঁচড়ানো। পশুরা চুল আঁচড়ায়নি, এই যা। মানুষের লেজ নেই। পশুদের আছে।’

বানরের মাথার সঙ্গে নওশাদের সেলফি দেখে রিহানা ফোন নিয়ে চলে যায় শাশুড়ির কাছে।

ছবিগুলি দেখে শাশুড়ি হাসলেন। রিহানার মুখ গম্ভীর। ‘মা আপনি হাসছেন?’

‘স্বপন ছোটকাল থেকেই অন্যরকম। কী সব করত। একবার দুটো খরগোশ আনছিল ওর বাবা। খরগোশ দুটোকে ও কথা আর পড়া শেখাবেই। সাতদিন ধরে যখন একটা কথা আর অক্ষরও শেখাতে পারল না, এক সন্ধ্যায় বাড়ির পাশের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসলো। আমরা কেউ টের পাইনি। ওর বাবা ওকে কিছুই বলেনি। আমি রাগ করছিলাম।’

শাশুড়ির কথা শুনে রিহানা বলল, ‘মা আপনার ছেলে সারাদিন খুলি নিয়ে, মাথার সাইজ নিয়ে পড়ছে, ওর একটা কিছু হইছে মনে হয়। আমাকে বলতেছে না। মনে হচ্ছে, ওকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে হবে।’

‘না না ওর কিছু হয়নি’, মায়ের কথার মধ্যে নওশাদ ঘরে ঢুকে বলল, ‘আমি ফয়সলের ওখানে যাচ্ছি। ফিরতে একটু রাত হবে।’  

‘কখন প্ল্যান হলো? ঠিক আছে যাও। বেশি রাত করো না।’ রিহানার কথায় প্রশ্ন আছে এবং অনুমতিও। ‘বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিলে ওর মাথা থেকে খুলির ভূত নামতে পারে।’ 

ছয়

ফয়সল বাসায় একাই ছিল। ওর বউ শিফা, মেয়ে রিকি আজ রাতে ফয়সলের শ^শুরের বাসায় থাকবে। নওশাদ ঘরে ঢুকতেই বলল, ‘তোর কী হইছে? চোখ লাল কেন? জ¦রটর হয়নি তো? চুলও আঁচড়াসনি।’

নওশাদের জ¦র হয়নি। ‘চল তোর স্টুডিওতে বসি।’

ফয়সল বলতে যাচ্ছিল, বলেনি, ‘আগে কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে তুই তো কথা বলতি না। আগে যতদিন তুই আসছিস, কখনো স্টুডিওতে বসতে চাসনি।’

স্টুডিওর দরজা খুলতেই নওশাদের চোখ পড়ে মাঝখানে রাখা ইজেলে। ক্যানভাসে আঁকা হয়েছে সাতটা মুখাবয়ব। হেপ্টাগোনাল স্পেসে আঁকা। রেখাগুলি সরল। শিশু, তরুণ-তরুণী ও বুড়ো-বুড়ির মুখের পাশে, মাঝখানে বানর ও শিম্পাঞ্জির মুখ। মানুষ ও পশুর মাথার খুলি সাতটি তীক্ষ্ন কোণের মধ্যে আটকে গেছে। পশুর চোখে ও ঠোঁটে হাসির আভাস। মানুষদের মুখ ও চোখ মৃতপ্রায়।

নওশাদ এদিক-ওদিক না তাকিয়ে সোজা গিয়ে ছবিটার সামনে দাঁড়ায়।

ফয়সল কথা বলছে না। বন্ধুর মুখের দিকে চোখ। ‘তোর  কী হইছে?’ প্রশ্নটা করার আগেই নওশাদ বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে, ‘ছবিটা কবে থেকে আঁকছিস?’

‘এক মাস থেকে আঁকছি।’

‘এই থিম কেন?’

‘তুই তো জানিস প্রতি মাসে আমি একবার-দুবার চিড়িয়াখানায় যাই। তিন মাস আগে আমি দেখলাম দুজন তরুণ-তরুণী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছে, দুজনের মুখের মাঝখানে, একটু দূরে একটা বানর। মুখ গম্ভীর। চোখে কৌতুক। লেজ দোলাচ্ছে। তরুণ-তরুণীর মুখ আর বানরের মুখের সাদৃশ্য আমাকে চমকে দিলো। এই ছবি আঁকার থিম পেলাম।’

‘তোর মনে আছে তোর বাসায় তুই, শিফা, রিহানা আর আমি অ্যাভাটার দেখেছিলাম। মানুষের আদিম যুগের মুখ, লেজগুলি কি লম্বা, ঝুলন্ত মেরুদণ্ড, জঙ্গলে থাকে, কী মেসেজ দিচ্ছে? ছবিটার কালচার নির্মাণে একজন অ্যানথ্রোপলজিস্ট ছিলেন। খুলি আর মুখের শেইপ কি নিয়ানডারথাল যুগের হয়ে যাবে?’ ক্যানভাসের ওপর চোখ রেখেই নওশাদ বলল।

‘হতে পারে। চল বিয়ার খাই।’

কথার মধ্যে ফয়সলের ফোনে একটা টেক্সট এলো। আমেরিকা থেকে ওদের দুজনেরই বান্ধবী পাপিয়া পাঠিয়েছে। ফয়সল পড়ে। হাসে।

‘মেনি এক্সপার্টস বিলিভ দ্যাট বাই দ্য ইয়ার টু থাউজেন্ড ফরটিফাইভ, হিউম্যান্স উইল অ্যাচিভ ডিজিটাল ইম্মরটালিটি বাই আপলোডিং দেয়ার মাইন্ডস টু এ কম্পিউটার, অ্যান্ড দেন ব্যাক টু এ ডিফারেন্ট বায়োলজিক্যাল বডি।’

নওশাদ ‘ডিফারেন্ট বায়োলজিক্যাল বডি’ দুবার বললো। মাথায় ও মুখে হাত দিলো।

‘ভেরি ইন্টারেস্টিং। তখন কি বেঁচে থাক?’ ফয়সলের চোখেমুখে কৌতূহল। 

‘তাহলে পাপিয়াকে লিখে দে – পঁচিশ বছর পরে নারীর ব্রেস্ট থাকবে পিঠে, বাটোক্স সামনে, চোখ দুই কানের ওপর। পুরুষের লিঙ্গ হাঁটুতে। চোখ নাকের নিচে। কপালে নাভি। এবং বডির অন্য সব অঙ্গ প্রয়োজনমতো খুলে রাখা যাবে, লাগানও যাবে। কেমন হবে ডিজিটাল লাভ অ্যান্ড সেক্স জিজ্ঞেস কর।’

টেক্সট চলে গেল।

পাপিয়ার উত্তরও এলো, ‘কনফিউজ্ড।’

‘ফয়সল, তুই পাপিয়ার ওইরকম একটা ছবি এঁকে পাঠিয়ে দে।’

‘বিকৃত মানুষ হবে। এটা করা ঠিক হবে না।’

ইজেল থেকে সাত-আট ফুট দূরে ডিভান। দুই বন্ধু বসল। সামনে ছোট টেবিল। বিভিন্ন রঙে টেবিল লাঞ্ছিত। আসল রং কী ছিল বোঝার উপায় নেই। টেবিলের ওপর চারটে বিয়ার। ঘরে সাদা আলোর দুটি বাল্ব জ্বলছে।

‘নে বিয়ার খা।’ ফয়সল ছিপি খুলতেই সাদা ফেনা লাফিয়ে উঠে হাত ভিজিয়ে দিলো।

নওশাদ বিয়ার না নিয়ে নিজের ব্যাগ খোলে। বের করে ক্যামেরা ও ট্যাব। 

‘কিরে খাবি না?’

নওশাদ খাবে। পরে। ক্যামেরা নিয়ে ইজেলের সামনে যায়। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবিটার ছবি তোলে।

ফিরে আসে। বিয়ারের ছিপি খুলে চুমুক দেয়। হাতে ফেনা পড়েনি।

‘তোর কী হইছে?’

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নওশাদ ট্যাব খোলে। ফয়সলের সামনে ধরে। ‘ট্যাবে কী দেখব?’ ওর চোখেমুখে বিরক্তি।

‘তুই দ্যাখ আর শোন। তারপর বলছি।’

‘আড্ডা দিবি? নাকি এইসব দেখব? তুই কিন্তু তোর আসল প্রবলেমের কথা বলছিস না।’ 

‘বলব। দ্যাখ। শোন।’

 একটা ছবির নিচে লেখা : ‘আওয়ার ওল্ডেস্ট রিলেটিভস।’

মুখের গড়ন সিংহের কাছাকাছি। চোখ, মুখ, কপাল, নাক এবং চুলও।

পরের ছবিতে নিয়ানডারথাল যুগের একজন, তার কাঁধে একটা পশু। পশুটার ও মানুষটার মুখ প্রায় একরকম।

বর্ণনা চলছে। নওশাদ ফোনের ভলিউম বাড়িয়ে দিলো : ‘তাদের কালচার ছিল। সমাজের নিয়ম-আচারে জীবনযাপন করত। জলবায়ুর প্রভাব তাদের আকৃতি বদলে দেয়। বিশেষ করে বরফযুগ। ইউরেশিয়ান কন্টিনেন্টে যেসব ফসিল পাওয়া যায়, তা পূর্বপুরুষদের।’

‘তুই বন্ধ কর। কী সব আদিম মানুষ নিয়ে পড়ছিস। মুডটা খারাপ করে দিস না। আমরাই তো আদিম। আসল কথা বল, তোর কী হইছে? রিহানার সঙ্গে ঝামেলা?’

‘কিছুই হয়নি। তুই খেয়াল করছিস না মানুষ হয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল টাইপ। ক্লাইমেট বদলে যাচ্ছে। বিচিত্ররকম বিহেবিয়ার ও কালচারে মানুষ দিশেহারা। তথ্যসাম্রাজ্যের শিকারে আমরা প্রতিদিন নাস্তানাবুদ হচ্ছি। ন্যাচারকে ধ্বংস করছি। আমাদের আর কত সিভিলাইজেশন দরকার?’

‘বিয়ার খা। কী সব জটিলতা তোরে পেয়ে বসছে। মাথা থেকে দূর কর। অফিসে কিছু হয়েছে?’ কথায় বিরক্তি।

‘বললাম তো, কিছুই হয়নি।’ বলে ক্যামেরা খুলে চিড়িয়াখানায় তোলা ছবি দেখায়। ‘দেখ মানুষের মুখের সঙ্গে বানর, শিম্পাঞ্জির মুখ।’

‘তুই থামবি। তোর মাথায় এইসব কী ঢুকছে? মানুষ পশু ক্লাইমেট ডিজিটাল প্রবলেম আর খুলির শেইপ। তোকে সাইক্রিয়াট্রিস্টের কাছে নিতে হবে।’ বলে ফয়সল নিজের মাথায় হাত দিলো।

নওশাদ হাসে। বিয়ারে চুমুক দেয়।

‘হাসছিস কেন?’

‘মাথায় হাত দিয়ে তুই দেখলি খুলির শেইপ ঠিক আছে কি না।’

‘শোন, কোনো একটা বিষয়ে কথা বলতে থাকলে বিষয়টা শ্রোতার চিন্তায় প্রভাব ফেলে।’

‘গুড। শোন, আজ সকালে চুল কাটানোর পর নাপিত যখন মাথার পেছনে আর ডানে-বাঁয়ে আয়না ধরে দেখাচ্ছিল, তখন মাথার শেইপটা অন্যরকম মনে হলো।’

ফয়সল খুব জোরে হেসে ওঠে। লম্বা চুল দুলতে থাকে। চোখ পড়ে ক্যানভাসে। ছবিটার সামনে যায়। ডান দিকে সরে যায়। ছবির চোখগুলি ওকে অনুসরণ করছে। বাঁ দিকে আসে। চোখগুলি ওকে দেখছে। দৃষ্টি নাছোড়। হাসছে।

ফয়সল ভয় পায়। মাথায় হাত দিলো।