জীবনানন্দের গান

বাসররাতে নবপরিণীতাকে গান গাইতে বলার ‘স্পর্ধা’ জীবনানন্দের মতো একজন আপাতনিরীহ স্বামীর পক্ষে কী করে সম্ভব হলো, সে এক বিস্ময়। কিন্তু তিনি সত্যিই বাসররাতে স্ত্রীকে দিয়ে গান গাইয়েছেন। তাও যেনতেন গান নয়, রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’।

স্ত্রী লাবণ্য দাশের বয়ানে জানা যাচ্ছে : ফুলশয্যার রাতে স্বামীর সঙ্গে তাঁর ‘আইসব্রেকিং’ হয়েছিল এভাবে :

–         আমি শুনেছি তুমি গাইতে পার। একটা গান শোনাবে?

–         কোনটা?

–         জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, গানটা যদি জান তবে সেটাই শোনাও।

লাবণ্য বলছেন, ‘আমার এখনও মনে পড়ে, প্রথমবার গাইবার পরে তিনি আরও একবার গাইতে বললেন।’ (লাবণ্য দাশ, মানুষ জীবনানন্দ, ভাষাচিত্র, ২০১৫, পৃ ২৭)

প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথের প্রতি জীবনানন্দের অনুরাগ বা প্রীতি সর্বজনবিদিত। তিনি ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে কবিতা লিখেছিলেন অন্তত পাঁচটি। তাঁকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন অন্তত চারটি। আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর যখনই কিছু লিখেছেন, সেখানে অনিবার্যভাবে রবীন্দ্রনাথের কথা এসেছে।

অনেকদিন পরে একদিন হাসতে হাসতে লাবণ্য তাঁর স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন : ‘আচ্ছা, তুমি প্রথম দিনেই জীবন মরণের সীমানা ছাড়াতে চেয়েছিলে কেন?’

জীবনানন্দ হেসে এই গানের দুটি লাইনের অর্থ জানতে চান :

আজি এ কোন্ গান নিখিল প্লাবিয়া

তোমার বীণা হতে আসিল নামিয়া।

লাবণ্য চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। জীবনানন্দ স্বভাবসুলভ ক্ষীণকণ্ঠে বললেন : ‘জীবনের শুভ আরম্ভেই তো এ গান গাওয়া উচিত এবং শোনাও উচিত।’

বস্তুত জীবনানন্দ সারাজীবনই মনের ভেতরে একটা সুর বয়ে বেড়িয়েছেন; যে-সুরের নাম সম্ভবত ‘বিপন্ন বিস্ময়’।

জীবনানন্দের অনেক কবিতার শব্দার্থ করা কঠিন। অনেক সময় দুর্বোধ্য। কিন্তু সুর দেওয়া যায়। কিছু কবিতার সুরারোপ করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিই যে লিরিক বা গান/ গীতিকবিতা তিনি লিখেছিলেন, সেগুলিতে সুর দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না।

জীবনানন্দ কেন গান লিখেছিলেন, সেই সংখ্যা কত এবং যে উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, তা কি সফল হয়েছিল? গান বা সংগীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ কেমন ছিল? জীবনানন্দের যে-কয়টি কবিতার সুরারোপ করা হয়েছে, সেগুলি কি ঠিক গান হয়ে উঠেছে?

জীবদ্দশায় মূলত কবি হিসেবে পরিচিত জীবনানন্দ দাশ যে অনেক উপন্যাস ও গল্প লিখেছিলেন, তা জানা যায় তাঁর মৃত্যুর পরে। জীবদ্দশায় কিছু প্রবন্ধ এবং বইয়ের আলোচনাও বেরিয়েছিল। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত জীবনানন্দের সৃষ্টিসম্ভারের মধ্যে রয়েছে তিন হাজার কবিতা, ১৯টি উপন্যাস, ১২৭টি গল্প, ৭৯টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ-আলোচনা-ব্যক্তিগত রচনা, ৫৬টি খাতা ভর্তি ৪০০২ পৃষ্ঠার ডায়েরি এবং দেড়শোর মতো চিঠিপত্র ও চিঠিপত্রের খসড়া। (গৌতম মিত্র, পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি, ঋত, ২০২১, পৃ ২০)। কিন্তু সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় আঁচড়কাটা জীবনানন্দ যে কিছু গানও লিখেছিলেন, তা জানা যায় আরো পরে।

দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে জীবনানন্দের যে ৪৮টি পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে, সেখানে ৪১ নম্বর খাতায় ১৫টি গান আছে। যদিও গানের আলগা খাতাগুলি পাওয়া যায়নি। তার মানে আরো কিছু গান হয়তো ছিল। (জীবনানন্দ দাশ বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত, দে’জ, ২০০৭, পৃ ৫৮৫)।

গানের রচনাকাল আগস্ট-সেপ্টেম্বর ১৯৪৬। অর্থাৎ জীবনানন্দ যে সময়টায় জন্মস্থান বরিশালে ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষক, কিন্তু সেখান থেকে কলকাতায় চলে আসার কথা ভাবছেন। কার্যত ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেই তিনি বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। তার মানে এই গানগুলির রচনাকাল একটি ক্রান্তিকালে। কেন তিনি গান লিখলেন, নিতান্তই খেয়ালবশত, নাকি প্রয়োজনে?

জীবনানন্দের কর্মজীবন এবং চাকরি হিসেবে শিক্ষকতা নিয়ে তাঁর খেদ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, তিনি আসলে নতুন কিছু চাইছিলেন। সেটি শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কিছু। যদিও আমৃত্যু শিক্ষকতা করেই তাঁকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে। মাঝখানে একটি পত্রিকায় (স্বরাজ) কিছুদিন চাকরি করলেও সেখানে থিতু হতে পারেননি। শিক্ষকতার প্রতি তাঁর খেদের প্রধান কারণ ছিল সামান্য মজুরি এবং শিক্ষার পদ্ধতি। তাঁর সময়ে কলেজের শিক্ষকরা খুব সম্মানজনক বেতন পেতেন না। এর মধ্যে দেশভাগের ডামাডোল শুরু হয়ে গেলে জীবিকা নিয়ে আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েন। একটি ‘বিশুদ্ধ চাকরি’র সন্ধানে ছুটে বেড়িয়েছেন এখানে-ওখানে।

শোনা যায়, ওই সময়ে তাঁর কোনো এক সুহৃদ বলেছিলেন সিনেমার গান লিখে ভালো পয়সা পাওয়া যায়। জীবনানন্দ ভেবেছিলেন তিনিও হয়তো গান লিখে পয়সা কামাতে পারবেন। বস্তুত সেই ধারণা থেকেই গান লেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু গানগুলি সিনেমায় ব্যবহারের জন্য কাউকে দিয়েছিলেন বা এ নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল কি না, তা জানা যায় না। 

কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে পাণ্ডুলিপির ৪১ নম্বর খাতায় সংরক্ষিত গানগুলো হচ্ছে :

১.

আজ বিকেলের ধূসর আলোয়

তোমার সাথে দেখা

এতটা দিন পথ চলেছি – শেষে

কালো মেঘের কেয়াবনের জলহিজলের দেশে

আমি তোমার পাতা শিশির

হাতের তুলির রেখা।

২.

রাতের আঁধারে নীল নীরব সাগরে

আমাদের এ জীবন জনহীন বলয়ে আকাশে

সাগরের দূরগামী জাহাজের মতো

কী ক’রে কখন

অতি দূর থেকে ভেসে আসে।

৩.

সারা দিন আমি কোথায় ছিলাম, আলো

এই জীবনের ইতিহাসে আমি আগে

তোমাকে কখনও দেখি নি, তবুও দেখেছি

সূর্যে যখন আকাশী গ্রহণ লাগে

পৃথিবী মলিন হয়।

৪.

অন্ধকারের ঘুমসাগরের রাতে

দূর আকাশের তারা,

নীল নিখিলের নীরবতা

নেই কিছু এ ছাড়া,

অকূল অলখ থেকে হাওয়া

কোন্ দিকে তার চলে যাওয়া।

৫.

আজ সকালের এই পৃথিবীর আলো

চকোর ঘুঘুর ঝলকানিতে অপার নীলিমা

আলোয় – গভীর আলোয় মিশে গিয়ে

উড়ো গাঁয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে

নগরীদের মিনার জ্বালাল।

৬.

আমরা যেন মেঘের আলোর ভিতর থেকে এসে

নগরী দিনের মতন কলরবে

এই জীবনের পথে চ’লে তবু

জানি শুধু এখনও যেতে হবে

তবুও দেখি সকলই ঘুমে ঘেরা।

৭.

ঘুমের হাওয়া, ঘুমের আলো

ঘুমের দেশের প্রেম (কী তোমার নাম?)

অইখানেতে শঙ্খনদীর তীরে তুমি দাঁড়িয়েছিলে নাকি

আমিও এলাম।

৮.

দেশ-সময়ের ক্রান্তি রাতে আজ এ পৃথিবীর

এই নগরীর হৃদয় দেখা যায়

পথে ঘাটে মেঘে মনের বর্তিকাতে

সেই কি মিলাল

সব পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া আলো?

৯.

কাউকে ভালোবেসেছিলাম জানি

তবুও ভালোবাসা,

দুপুরবেলার সূর্যে ভোরের

শিশির নেমে আসা।

১০.

(তোমার সাথে আমার ভালোবাসা

চল কেবল সুমুখপানে চল

সূর্যডানায়  – ঈগল পুরুষ জ্বলো

সময়সাগর শুকিয়ে গেলে সেই সোনালি বালির

সীমার মনে মরুভূমির সঙ্গে কথা বল।)

তোমার সাথে এই তো ভালোবাসা।

১১.

ভোরের বেলায় তুমি আমি –

নীল আকাশের ভরতপাখির গানে

কবে যে এই ধুলোমাটির পৃথিবীতে

প্রথম দেখেছিলাম।

১২.

ধ্বনি পাখির আলো নদীর স্মরণে এসেছি

আবার তুমি আমি

ভেবেছিলাম আমরা দুজন

মিশরীয় মমি।

১৩.

তুমি আমার মনে এলে।

বালুঘড়ি বিকল রাতের বেলা।

থেকে থেকে পড়ছে মনে

সে কোন ধূসর বেবিলনে

কবের গ্রীসের অলিভবনে

তোমার সাথে সূর্যতীরে

হয়েছিলো খেলা।

১৪.

কোথায় সবি ফুরিয়ে গেল অতল সনাতনে।

১৫.

মনে পড়ে আমি ছিলাম বেবিলনের রাজা

তুমি ছিলে আমার ক্রীতদাসী।

(গানের কথাগুলো এখানে সংক্ষেপিত)

পর্যবেক্ষণ

১. যে ১৫টি গানের সন্ধান পাওয়া যায়, সেগুলিকে তাঁর কবিতা থেকে আলাদা করা যায় না। তাঁর অনেক কবিতাকেও বিন্যাস ও শব্দচয়নের কারণে গান মনে হয়। আবার গান হিসেবে যা লিখেছেন তার সবগুলিকে সাদা চোখে দেখলে গান মনে হয় না। কবিতার চেয়ে গানের কথা সাধারণত সহজ ও সরল হয়। কিন্তু জীবনানন্দের গানগুলিও তাঁর কবিতার মতোই ধোঁয়াশা। অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বোধ্য – যার সুর করে গাওয়া খুব কঠিন। সম্ভবত এ-কারণেই কেউ গানগুলিতে সুর করে গাওয়ার চেষ্টা করেননি। বিশেষ করে যে উদ্দেশ্যে তিনি গানগুলি লিখেছিলেন বলে শোনা যায়, সেই সিনেমার প্লেব্যাক হিসেবে গানগুলি খুব জুতসই নয়। কেননা সিনেমার গানের সঙ্গে সাধারণত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কোরিওগ্রাফ বা শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বিশেষত নাচ থাকে। দুর্বোধ্য বা কঠিন লিরিকের সঙ্গে শারীরিক অ্যাক্টিভিটি, বিশেষ করে বাংলা সিনেমায় যেমন নায়ক-নায়িকাদের যে নাচের ব্যাপার থাকে, সেই ধরনের ক্রিয়াকলাপ কঠিন। তাছাড়া সিনেমার গল্পের সঙ্গে গানের লিরিকের মিল থাকতে হয়। একটা গল্প চলছে, খাপছাড়াভাবে সেখানে কোনো একটা গান ঢুকে গেলে সেটা সিনেমার ছন্দপতন ঘটায়। এসব বিবেচনায় জীবনানন্দের যে-লিরিকগুলি আমরা গান হিসেবে পাচ্ছি, সেগুলি আর যাই হোক, সিনেমার গান হিসেবে ব্যবহার করা বেশ কঠিন।

২. জীবনানন্দের যে ১৫টি লিরিককে আমরা গান হিসেবে পাচ্ছি, তার সবগুলির বিষয় প্রেম। অর্থাৎ তিনি হয়তো সিনেমার

নায়ক-নায়িকারা ঠোঁট মেলাবেন – এমন ভাবনা থেকেই গানগুলি লিখেছিলেন। 

৩. গান হিসেবে লিখিত জীবনানন্দের লিরিকগুলির প্রতিটি ভালো কবিতা, তাতে সন্দেহ নেই। অর্থাৎ কাব্যগুণ আছে এবং কথাপ্রধান গান হিসেবে এগুলির গুরুত্ব আছে। কিন্তু তাতে গানের কাঠামো আছে কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন। কেননা ছন্দ ও অন্ত্যমিল নেই অনেক গানেই। অর্থাৎ এগুলি গানের সাধারণ কাঠামোর সঙ্গে মেলে না।

৪. গানের প্রতি দুই লাইনে অন্ত্যমিল থাকে। এই গানগুলিতে সেই সাধারণ রীতি মানা হয়নি। গদ্য-কবিতার মতো এগুলিকে গদ্য গান বলা হবে কি না?

৫. লিরিকগুলিকে কবিতার সঙ্গে পার্থক্য করা যায় না। যেমন ১ নম্বর গানের দুটি লাইন : ‘বেতের ফলের মতন আমার মøান চোখে তুমি হাজার বছর রয়ে গেছ।’ বেতের ফলের মতো ম্লান চোখের কথা আছে তাঁর ‘হায় চিল’ কবিতায় : ‘তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে।’ ‘সে’ শিরোনামের কবিতায়ও আছে – ‘বলেছিল এ নদীর জল তোমার চোখের মতোই ম্লান বেতফল।’

৬. গানের কথায় সাধারণত ব্র্যাকেট ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু জীবনানন্দের কোনো কোনো গানের বাক্যে ব্র্যাকেট আছে। ফলে ব্র্যাকেটবন্দি লাইনগুলি কীভাবে উচ্চারিত হবে, তা স্পষ্ট নয়।

৭. জীবনানন্দের কবিতায় যেমন প্রচুর ড্যাশের ব্যবহার লক্ষ করা যায়, গানেও তা-ই।

৮. আট নম্বর গানের শেষটা এরকম : ‘অপার ব্যথা, অসীম প্রয়াস ইত্যাদি …’। এভাবে কোনো গান শেষ হওয়ার কথা নয়। ইত্যাদি শব্দ দিয়ে কোনো গান শেষ হয় না। তার মানে এখানে গানটি বোধ হয় শেষ হয়নি অথবা তিনি শেষ করেননি।

৯. একাধিক লাইনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। গানের লিরিকে সাধারণত প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকে না।

গানের মতো যেসব কবিতা

জীবনানন্দের অনেক কবিতার শিরোনামে ‘গান’ শব্দটি আছে, যেমন : অবসরের গান, পিপাসার গান, অনুসূর্যের গান, তিমিরহননের গান, নব হরিতের গান, ঝরা ফসলের গান, আলোসাগরের গান।

 ‘সহজ’ কবিতার শুরুটা এরকম :

আমার এ গান

কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে, –

আজ রাত্রে আমার আহ্বান

ভেসে যাবে পথের বাতাসে, -।

অনেকটা একই সুরে লেখা ‘নির্জন স্বাক্ষর’ কবিতার শুরুটাও কাছাকাছি :

তুমি তা জান না কিছু,

না জানিলে –

আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!

অর্থাৎ কাক্সিক্ষত নারীকে তিনি আসলে গান শোনাতে চান, কবিতা নয়। যেমন বাসররাতে নবপরিণীতার কাছে গান শুনতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুশয্যায়ও সেই গান। মেয়ে মঞ্জুশ্রী লিখেছেন, হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় তিনি রবীন্দ্রসংগীত শুনতে চেয়েছিলেন। আর মৃত্যুর পরে ছোট ভাই অশোকানন্দের বাসায় জীবনানন্দের মরদেহ ঘিরে ব্রাহ্মমতে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলেন নারীরা। অর্থাৎ গান বা সংগীত অথবা সুরের প্রতি একটা বিশেষ পক্ষপাত জীবনানন্দের ছিল। সম্ভবত সকল কবির ভেতরেই এই পক্ষপাতটা থাকে।

জীবনানন্দ গান হিসেবে যে-লিরিকগুলি লিখেছেন, তার সঙ্গে তাঁর অন্য অনেক কবিতার যথেষ্ট মিল রয়েছে। ফলে তাঁর গানকে কবিতা থেকে ঠিক আলাদা করা যায় না। আবার তাঁর অনেকগুলি কবিতার স্তবকবিন্যাস, ভাষা ও বলার ভঙ্গি গানের মতো।

বাংলার মুখ থেকে সুরঞ্জনা …

জীবনানন্দের কবিতায় দুর্বোধ্যতার অভিযোগ যেহেতু বেশ পুরনো, তাই তাঁর তুলনামূলকভাবে সহজ কিছু কবিতায় সুরারোপ করে গাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে যেসব কবিতার বিষয়বস্তু বাংলার প্রকৃতি, সৌন্দর্য ও দেশপ্রেম। যেমন :

১. বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর (রূপসী বাংলা) : সুর ও কণ্ঠ অজিত রায়।

২. আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায় (রূপসী বাংলা) : সুর ও কণ্ঠ অজিত রায়। (বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত অ্যালবাম ‘মহাজীবন’-এ এই গান দুটি রয়েছে।)

৩. আবার আসিব ফিরে : সুর অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়, কণ্ঠ লোপামুদ্রা মিত্র। অরিন্দম এই গানে দুটি সুর করেছেন। লোপামুদ্রার কণ্ঠে দুটি রূপই পাওয়া যায়।

৪. হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে (‘হায় চিল’, বনলতা সেন) : সুর দিলীপ  রায়, কণ্ঠ গোপা ত্রিবেদী।

৫. হায় চিল : সুর ও কণ্ঠ অনুপ ঘোষাল।

৬. পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি – রৌদ্রে যেন গন্ধ লেগে আছে (রূপসী বাংলা) : সুর বাসব চট্টোপাধ্যায়, কণ্ঠ – মানস কুমার দাস।

৭. সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকো তুমি; বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে (‘আকাশলীনা’, সাতটি তারার তিমির) : সুর ও কণ্ঠ : পুষ্কর বন্দোপাধ্যায়।

এর বাইরে সুমন ব্যানার্জি আটটি কবিতায় সুর দিয়েছেন, যেগুলি গেয়েছেন কুমার সানু। অ্যালবামের নাম ‘মেঠো চাঁদ’। এই অ্যালবামে যে কবিতাগুলি গান হিসেবে গাওয়া হয়েছে সেগুলি হচ্ছে – ১. আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে বসে থাকি (রূপসী বাংলা); ২. আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে, বলেছিল এ নদীর জল তোমার চোখের মতো মøান বেতফল (‘সে’, অন্যান্য কবিতা); ৩. মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে আমার মুখের দিকে, ডাইনে আর বাঁয়ে (‘মাঠের গল্প’, ধূসর পাণ্ডুলিপি); ৪. সময় মুছিয়া ফেলে সব এসে, সময়ের হাত সৌন্দর্যের করে না আঘাত (‘সময় মুছিয়া ফেলে সব এসে’, অন্যান্য কবিতা); ৫. একদিন এ পৃথিবী জ্ঞানে আকাঙ্ক্ষায় বুঝি স্পষ্ট ছিল আহা (‘রাত্রিদিন’, অন্যান্য কবিতা); ৬. বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি (রূপসী বাংলা); ৭. তোমায় আমি দেখেছিলাম ঢের, শাদা কালো রঙের সাগরের কিনারে এক দেশে (‘তোমায় আমি দেখেছিলাম’, অন্যান্য কবিতা); ৮. সুরঞ্জনা অইখানে যেয়োনাকো তুমি (‘আকাশলীনা’, সাতটি তারার তিমির)।

দেখা যাচ্ছে, এ পর্যন্ত তাঁর যতগুলি কবিতায় সুর দেওয়া হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে, তার অধিকাংশই রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের। এর বাইরে হয়তো আরো এক বা একাধিক কবিতায় সুরারোপ করে গাওয়া হয়েছে এবং এখনো হয়তো আরো অনেকেই জীবনানন্দের অন্য কোনো কবিতাকে সুর দিয়ে গান বানানোর চেষ্টা করছেন।

প্রথম সুরকার অজিত রায়

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রথম সুরারোপ করেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ অজিত রায়। সেটি ছিল ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে তিনি এই কবিতায় সুরারোপ করেছিলেন। তাঁর কণ্ঠে ওই গানটি মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। গানটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হলে সেটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।

জীবনানন্দের কবিতায় সুরারোপের ভাবনাটি অজিত রায়ের মাথায় কী করে এলো? একটি সাক্ষাৎকারে তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। ‘১৯৬২ সালের পর থেকে প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারিতে একটি করে নতুন গান করার প্রস্তুতি আমরা নিতাম। আবৃত্তিকার আশরাফুল আলম জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ থেকে কবিতায় সুরারোপ করার জন্য প্রায়ই তাগিদ দিতেন। আমিও ভাবছিলাম ‘রূপসী বাংলা’র কোনো কবিতাকে গানে রূপান্তরিত করতে পারলে একটা অসাধারণ ব্যাপার হবে। শুরু করলাম। এক লাইন দু লাইন করে করতে করতেই হয়ে গেলো। ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ কবিতাটির দুটি অংশের প্রথম অংশটিতে প্রথম সুরারোপ করি। এটি ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির ঘটনা।’ (উত্তরাধিকার জীবনানন্দ সংখ্যা, বাংলা একাডেমি, ২০০১, পৃ ৪৪৭)।

অবশেষে কবিতায় সুরারোপ করা হয় এবং অজিত রায় গানটি প্রথম শোনান জাতীয় প্রেসক্লাবে ১৯৭১ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে। অজিত রায় জানাচ্ছেন, শহিদ মিনারে যাওয়ার আগে প্রেসক্লাবে সংগীতের আসর বসতো। ‘এই অনুষ্ঠান শেষ করেই আমরা সাড়ে এগারটার দিকে শহীদ মিনারের দিকে যাত্রা করতাম। ১৯৭১ সালের ওইরকম অনুষ্ঠানেই প্রথম ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ গানটি করি।’

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে না এলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর কবিতাগুলি মুক্তিকামী বাঙালিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে দেশপ্রেমের কারণে। বাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং দেশপ্রেম যত বিস্তৃতভাবে তাঁর কবিতায় এসেছে, আর কোনো কবির সঙ্গে তার তুলনা হয় না। জীবনানন্দের কবিতা পড়লে যেভাবে চোখের সামনে সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ মূর্ত হয়ে ওঠে, আর কারো কবিতা এতটা প্রভাববিস্তারী নয়। নয় বলেই মুক্তিযোদ্ধারা ভাত-কাপড় কিংবা অস্ত্র নয়, চেয়েছিলেন রূপসী বাংলার একখানি কপি – যে-গল্পটি আমাদের জানাচ্ছেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান : ‘আমার এক ভারতীয় বন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে একবার জানতে চেয়েছিলেন, পরেরবার যখন আসবেন, তখন কী নিয়ে আসবেন তাদের জন্য? তারা বহু দ্বিধার পরে উত্তর দিয়েছিল। জামাকাপড় নয়, খাদ্যদ্রব্য নয়, ‘রূপসী বাংলা’র একটি কপি। হয়তো এ বিচার নন্দনতাত্ত্বিক নয়, তবে একজন কবির পক্ষে এর চেয়ে বড় পাওয়া কী হতে পারে, আমার তা জানা নেই।’ (জীবনানন্দ দাশ জন্মশতবার্ষিক স্মারকগ্রন্থ, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আবুল হাসনাত-সম্পাদিত, পৃ ২৭)।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ গানটি প্রচারিত হয়েছে। অজিত রায়ের সংশয় ছিল এই ধীর লয়ের গানটি সশস্ত্র সংগ্রামে উত্তাল দেশের মানুষের মনে কতটা অনুরণন তুলবে বা মুক্তিযুদ্ধে এ-গানের আবেদন কতটা সাড়া জাগাবে? কিন্তু দেখা গেল, গানটি দারুণ সাড়া ফেললো এবং গানের ভেতরে বীররস না থাকলেও মানুষকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করতে এই গানটি দারুণ ভূমিকা পালন করে।

রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি’ কবিতাটিতে প্রথম সুরারোপ করা হয় সত্তরের দশকে। ১৯৭৭ সালে কুমিল্লা বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তনে (টাউন হল) কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গানটি প্রথম গাওয়া হয় বলে ধারণা করা হয়।

গান নিয়ে জীবনানন্দের ভাবনা

জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসগুলিকে তাঁর আত্মজীবনীর খসড়া বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে তাঁর মাল্যবান উপন্যাসটি আরো বেশি আত্মজৈবনিক। এই উপন্যাসের নায়ক মাল্যবান গানের ব্যাপারে স্ত্রীকে কোনোদিন কিছু বলে না। ‘বড়ো একটা বেশি ঝালাপালা বোধ করলে অবিশ্যি ‘গান খুব ভালো করে শিখতে হয়’, ‘অনেকে খুব মন খুলে গায়, ভালো লাগে; মন খুলেছে বলে ভালো লাগে’ এরকম এক-আধটা ইশারায় অনুযোগ জানায় মাল্যবান। এ-ধরনের ইঙ্গিতের জন্যে স্ত্রীর কাছ থেকে সে সত্যিই শাস্তি পায়; কাজেই পারতপক্ষে স্ত্রীকে কিছুই বড় একটা বলতে যায় না। নিজে মাল্যবান গানমুজরো না ভালোবাসে তা নয়। যখন সে কলকাতার চাকরিতে বাঁধা পড়েনি, পাড়াগাঁয়ে ছিল, সেই ছোটবেলায় এক এক দিন শীতের শেষ রাতে বাউলের গান শুনতে তার খুব ভালো লাগত; কোনো দূর হিজল বনের ওপার থেকে অন্ধকারের মধ্যে সে-সুর ভেসে এসে তার কিশোর আঁতে ব্যথা দিয়ে যেত। কতদিন যখন দিন শেষ হয়-দাণ্ডাগুলি খেলে যখন সে কাঁচা কাঁচা কালিজিরা ধানশালি রূপশালির ক্ষেতের আলপথ দিয়ে বাড়ি ফিরছে, ভাটিয়াল গান শুনে মনটা তার কেমন করে উঠত যেন; সারা দিনের সমস্ত কথা কাজ অবসন্ন শোল-বোয়ালের মতো দিঘির অতলে তলিয়ে যেত যেন, ঝির ঝির ফটিক ফটিক ঝিক ঝিক ঝর ঝর করে উঠত ওপরের জল : যে জল গানের মতো, যে গান জলের মতো চারদিককার খেজুরছড়ি, নারকোলঝিরঝিরি ঝাউয়ের শনশনানি ছায়া অন্ধকার একটি তারার ভেতর এক কিনারে চুপ করে বসে থাকত সে।

বাপ-মাকে ফাঁকি দিয়ে কত রাত সে যাত্রা শুনতে গেছে – তারপর সেসব গানের সুর এমন পেয়ে বসেছে তাকে যে পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করতে করতে এক একবার টেবিলের ওপর মাথা রেখে অনেকক্ষণ নিঝ্ঝুম হয়ে পড়ে থাকত; কোথাও মেঘ নেই, বৈশাখ আকাশের বিদ্যুৎচমকানির মতো ভরে যেত মন এ-কানা থেকে সে-কানায়; বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠবার পূর্বাভাসের মতো; কিন্তু তার আগেই সে মাথা খাড়া করে অন্য পৃথিবীতে চলে যেতে চেষ্টা করত, ফোঁপাতে যেত না। মণিভূপকণ্ঠ চক্রবর্তী বলে একজন ভদ্রলোক ছিলেন – সত্যিই কি তাঁর নাম মণিভূপকণ্ঠ? কী মানে এই নামের? কিন্তু তবুও সকলেই তো তাঁকে এই নামে ডাকত; মণিভূপের গানের কথা মনে পড়ে; শমনহরা বোস-ঝুনু ঝুনু বোস-চৌধুরাণী নামেই বেশি খ্যাত – তার গান; সেসব দিন কোথায় গেছে যে আজ! পাড়ায় পাড়ায় গানের বৈঠকের লোভে পড়াশুনো ফেলে যেমনি সে আসরের এক কিনারে গিয়ে বসেছে, অমনি কাকা তাকে কান টেনেহিঁচড়ে বাসায় নিয়ে গেছেন; তবুও তার মায়ের সঙ্গে ষাট করে ফের আবার পালিয়ে যেতে ইতস্তত করেনি সে।’ (মাল্যবান, জীবনানন্দ-রচনাবলি-৪, ঐতিহ্য, ২০১৭, পৃ ১০৮)।

উপসংহার

জীবনানন্দের গানকে তাঁর কবিতা থেকে আলাদা করা যায় না। তাঁর উপন্যাস ও গল্পগুলি তাঁর ব্যক্তিজীবন থেকে আলাদা করা যায় না। কবিতার মতো তাঁর প্রবন্ধগুলিও দুর্বোধ্যতার অভিযোগে অভিযুক্ত। অতএব সমস্ত অস্পষ্টতা, ধোঁয়াশা আর দুর্বোধ্যতা নিয়েই জীবনানন্দ দাশ।

কবিতায় সুরারোপিত গানের ইউটিউব লিংক

১.   বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, অজিত রায় : https://www.youtube.com/watch?v = 04cYeSqmbb4&t = 40s

২.    আবার আসিব ফিরে, অজিত রায় : https://www.youtube.com/watch?v = UWby27608g8

৩.    আবার আসিব ফিরে, লোপামুদ্রা : https://www.youtube.com/watch?v = fSEsue8Hh1Y

৪.    আবার আসিব ফিরে, লোপামুদ্রা : https://www.youtube.com/watch?v = Mbzw09t7YiM&t = 3s

৫    হায় চিল, গোপা ত্রিবেদী : https://www.youtube.com/watch?v = DNAk4Qcu-Qc

৬.   হায় চিল, অনুপ ঘোষাল : https://www.youtube.com/watch?v = U-C0lnYpFQs

৭.   পাড়াগাঁর দুপ্রহর ভালোবাসি, মানস কুমার দাস: https://www.youtube.com/watch?v = gbUQU4XIZEI

৮.   আকাশলীনা, পুষ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় : https://www.youtube.com/watch?v = pkDiLdBXsxQ

৯.   মেঠো চাঁদ অ্যালবাম, কুমার সানু : https://www.youtube.com/watch?v = G9hfnZEjmnw&t = 289s