পাঠকদের রুচি-নির্মাণ ও মননচর্চায় কালি ও কলম পত্রিকার ভূমিকা

বাংলাদেশের সাহিত্য পত্রিকা নিয়ে, বিশেষ করে গত সত্তর বা পঁচাত্তর বছরে আমাদের দেশে যে উল্লেখযোগ্য পত্রিকাগুলি বেরিয়েছে, তা নিয়ে খুব ভালো গবেষণামূলক কাজ আমার চোখে পড়েনি। কিছু প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, কিন্তু আমাদের মননের জগৎ যেহেতু খুব দুর্বল তাই এসব বিষয় নিয়ে স্থায়ী মূল্য বহন করে এমন কাজ করার মানুষেরও খুব অভাব। আমাদের রাজনীতি, কৃষ্টি বা শিল্পের জগৎ সবকিছুই কেমন একটা নিয়ম-ছাড়া ধরনের, তাই সবকিছুতেই সত্যিকার যত্নের অভাব। তাছাড়া বিদ্যাজগৎ বা শিল্পের জগতে ফাঁকি দেওয়া যেহেতু ঝুঁকিপূর্ণ, তাই তাতে আরো বেশি মূল্য চুকাতে হয় আখেরে! ঝুঁকিপূর্ণ এই অর্থে যে, জগতের যে-কোনো বিষয় নিয়ে অযত্ন বা কমিটমেন্ট বা সততার অভাব থাকলে কোনোমতে দায়ছাড়া গোছের হয়, কাজ চালিয়ে নিতে পারে সমাজ, কিন্তু বিদ্যাপাড়া বা শিল্পপাড়ায় বেনোজল ঢুকলে একটি জাতির বা সমাজের ধ্বংস প্রায় অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সমাজে গত পঞ্চাশ বছরে জীবনের যে-কোনো শাখার চেয়ে সবচেয়ে বেশি পতনের সম্মুখীন হয়েছে বিদ্যাজগৎ। একেকটি বছর ধ্বংসের অজানা লক্ষ্যের দিকে একটু একটু করে সমাজটাকে এগিয়ে দিচ্ছে। যারা সেটাকে রুখতে পারেন তাঁরা লেখক, শিল্পী বা মননশীল মানুষ। কিন্তু এই মননচর্চার সঙ্গে যে শিক্ষা বা বিদ্যাজগৎ অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত তা আমরা সম্পূর্ণ বিস্মৃতপ্রায়।

যে-বিষয়টি মননচর্চার জন্য অত্যন্ত জরুরি সেটা হলো মূল্যবোধের উচ্চ মাত্রা। কিন্তু উনিশ শতকের শিল্প বা

সংস্কৃতিকর্মীর কাছে যে-মূল্যবোধ অনেকটা জরুরি ছিল, তা পুঁজির বাজারে শিল্পকে পণ্য করার পর অনেকটা কমতে শুরু করে। পণ্য বাজারজাত করার পর দেখা গেল, ভোক্তার চাহিদা বদলাতে শুরু করে যেখানে শিল্পের মাঝেও জালি দ্রব্য ঢুকতে শুরু করে। আর যে-সমাজে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি ও রাষ্ট্র, সেখানে রাজনীতি প্রয়োজনে শিল্পকে নিজেদের দর্জির মাপমতো ছেঁটে নেয়। এই ছেঁটে নেওয়ার কাজেও রাষ্ট্র নাক গলাতে থাকে। রাষ্ট্র যেখানে নাক গলায়, সেখানে ভুসি মালকেই উৎকৃষ্ট, আধুনিক ইত্যাদি তকমায় জড়িয়ে রাষ্ট্র চালাতে চায়। বাজার থেকে সত্যিকার সৃজনশীল পণ্য হারিয়ে যেতে বাধ্য হয়।  এভাবে দেখা যায় সমাজের মননের বা শিল্পের ক্ষেত্রকে একটি সজাগ ও সৃষ্টিশীল গোষ্ঠী বাঁচিয়ে দেয় নতুন সৃষ্টি বা ভাবনা দিয়ে; কিন্তু সেটা একইভাবে সব জায়গায় ঘটে না। আমাদের সমাজ সেই তমসাচ্ছন্ন সমাজগুলির একটি, যেখানে বলতে গেলে প্রায় কিছুই ঘটেনি। অনেক সময় উন্নততর শিক্ষা শিল্পের বা সৃজনের রুদ্ধপথকে অনেকটা বাঁচিয়ে দেয়। আমাদের সমাজে তা ঘটেনি। তবে দু-চারজন মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু কাজ করতে চেয়েছিলেন। দু-একটি পত্রিকাকেও সেই ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।

যেহেতু সংস্কৃতি বা শিল্প খুব জটিল পণ্য এক অর্থে, তাই একে হত্যার জন্য উদ্যত হস্ত সব সময় তরবারি নিয়ে প্রস্তুত। কিন্তু সেখানেও দূরতর আলোকশিখার আভা মাঝে মাঝে দেখা যায়। মানবিক বিদ্যা বা শিল্পকলা মানবসভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখায় জগতে যে-ভূমিকা রেখেছে তা খুব নগণ্য নয়। সভ্যতার বিবর্তনে এই ভূমিকা সব সময়ই শিল্পকলা পালন করে এসেছে, আজো করে যাচ্ছে; তা সব সমাজে সমানভাবে ঘটে না। কিন্তু সাহিত্য বা শিল্পকলাকে আমাদের সমাজ যে-রক্তচক্ষু দ্বারা শাসাচ্ছে, যদিও তা সর্বদা দৃশ্যমান নয়, কিন্তু সেটা আছে এবং ভয়ংকরভাবেই আছে। আমরা জানি সাহিত্যের বা শিল্পের ভূমিকা, বিশেষ করে রুচি ও ‘প্রগতির’ নির্মাণে, এমনকি  কোনো কোনো মনীষীর মতে মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা শিল্পকলার, তা যদি কিছুটা সত্যি হয়, তাহলে আমরা জানি সাহিত্য বা শিল্পকে ক্ষীয়মাণ করা বা marginalize করা সত্যিই ভয়ের। আর সেটাই আমাদের সমাজে হয়ে আসছে সেনাশাসকদের ক্ষমতা দখলের পর থেকে আজ প্রায় পাঁচ দশক ধরে। আমাদের পাঠক বা শিল্পভোক্তাদের কেউ কেউ ভেবেছিলেন, জনমানুষের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে শিল্প বা সাহিত্য তার মর্যাদার জায়গাটি খুঁজে পাবে সমাজে, বা রাষ্ট্রের আনুকূল্য লাভ করবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের সমাজে সুষ্ঠু আইনের শাসনের অভাবে জনমানুষের শাসন কোনোদিনই  প্রতিষ্ঠিত হয়নি, আর শিল্পকলা বা সাহিত্য সে-অর্থে কোনোদিন এর সত্যিকার ভূমিকা পালন করতে সুযোগ পায়নি জনচিত্তের রুচি গড়ে তুলতে।

আমরা জানি, সাহিত্য ও শিল্পকলার ইতিহাস, অন্তত গত দুই শতাব্দীর ইতিহাস, জানিয়ে দেয় যে, কলার সমালোচকরা অনেক ধরনের আপত্তি তুলেছেন শিল্প বা কলার কার্যকরী ভূমিকা সমাজে কী রয়েছে সে-বিষয়ে বিতর্ক তুলে, কিন্তু দীর্ঘ এই সময়ে প্রগতিবাদী বা কল্যাণবাদী সমালোচকরা এটাও জানিয়েছেন যে, সমাজে প্রাগমেটিক ও বিরামহীন হৃদয়বৃত্তির কর্ষণের ভূমিকাটা সাহিত্য ও শিল্পকলাই করে থাকে। এমনকি প্রাগৈতিহাসিক কালের গুহাচিত্রও আমাদের এই হদিস দেয় যে, মানুষের জীবন ও তার অর্থানুসন্ধানে সাহিত্য ও শিল্পকলাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। শিল্প শুধু মানুষের সংস্কৃতির মাঝে নিজের বিচিত্র বর্ণিল ফর্ম ও রস সৃষ্টি দ্বারা একে উজ্জ্বল করে তাই নয়, বরং তাবৎ এক ধরনের উন্নত রুচি অদৃশ্যভাবে গ্রন্থিত করে দেয় যা মানুষের জীবনকে বৃহত্তর উচ্চতায় অর্থময় করে তোলে। আর সেটাকেই বলা যায় সুশীল ও সংস্কৃত মানবের জীবনার্থ। লিখিত সাহিত্য মানবসভ্যতার দীর্ঘ পরিক্রমায় বলা যায় একেবারেই স্বল্পকাল আগে এসেছে, বলা যায় মাত্র অযুত-নিযুত বছরের মানবসভ্যতায় দু-তিন সহস্রাব্দকালের। কিন্তু এই লিখিত সাহিত্য বা শিল্পকলাই সেখানে ‘আধুনিক মন’ সৃষ্টিতে মনস্তাত্ত্বিক শক্তিকে শক্তি জুগিয়ে এসেছে। তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে, আর্ট বা শিল্পের অন্তর্গত শক্তিই মানবের সুকুমারবৃত্তির বেঁচে থাকার আকর।

ইতিহাসের এই প্রক্রিয়ায়, অর্থাৎ মানবরুচি বদলানোতে বা উন্নতকরণে সাহিত্যের বা শিল্পের সৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিক পারসপেকটিভ আনা কতটা জরুরি সে-বিতর্কও এসেছে। কিন্তু ইউটিলেটিরিয়ান দর্শন এবং এনলাইটেনমেন্ট বিজ্ঞান, বা র‌্যাশনালিস্টিক ভাবনাও সাহিত্যিকদের ভাবিয়েছে। তেমনি তাঁরা আরো ভেবেছেন যে, প্রতিদিনের জীবন আসলে কোনো ধ্রুব নিয়মে যেমন চলে না, তা আবার আরেক অর্থে ব্যাখ্যামূলক, যাকে আমরা ইন্টারপ্রেটিভ আর্ট বা ব্যাখ্যার শিল্প হিসেবে দেখতে পারি। আর এই ব্যাখ্যাটা ও রূপায়ণটা করে সাহিত্য বা শিল্পকলা। কিন্তু যেহেতু শিল্প বহুবর্ণিল, তাই এটা আবার দ্বিধাজর্জর দ্বন্দ্বদীর্ণও বটে। সাহিত্যিক জ্ঞান বা শিল্পের পাণ্ডিত্য পাঠকদের এটাও বোঝায় যে, শিল্পের অন্তর্গত সত্তা কিছুটা জটিল। জটিল এই অর্থে যে, অর্থময়তা বা অর্থসৃষ্টি কিছুটা আক্ষরিক, বা শিল্পে যে তুলির আঁচড় দেওয়া হয়, বইয়ের পাতায় যে-অক্ষরবিন্যাস ঘটানো হয়, সেটাকে নির্ভর করে সৃষ্ট, ইংরেজিতে যাকে বলে meaning-construction is textual, যে-জীবন আমরা যাপন করি তা ছবিভিত্তিক নয়, কিছুটা কল্পনাশ্রয়ী, কিছুটা রহস্যাবৃত! আর একজন প্রাজ্ঞ সম্পাদক বা তাঁর সম্পাদিত সাহিত্যপত্রিকা সময়ের দীর্ঘ পরিসরে যে-বিরামহীন শিল্পকলা উপস্থাপন করে চলেন তা পাঠকদের জীবন এবং সংস্কৃতিকে রূপান্তরিত করে ভিন্ন এক কেলাইডস্কোপিক সত্তায়। এখানেই সাহিত্য পত্রিকা বা সাহিত্য সম্পাদকের নিজের মনীষার ছাপ সময়ের ধারায় রেখে যাওয়া; কিন্তু এই কাজ একজন মানুষের পক্ষে ঘনবদ্ধ জঙ্গল বা পাহাড় কেটে আগামী জনগোষ্ঠীর জন্য প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ করার মতো দুঃসাধ্য কাজ। অথচ কাজটি সামান্য সহজ হয়, যদি সেই সমাজের শিক্ষা বা সংস্কৃতির রাষ্ট্রীয় নির্মাণকলা কিছুটা উন্নত হয়!

সাহিত্য এবং শিল্পকলা একটি সমাজে কেমন হবে তা নির্ভর করে সে-সমাজের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর অনেকখানি। আজকের বাংলাদেশের শিক্ষার হালহকিকত নিয়ে অনেকেই জানেন, তবু যে প্রশ্নটি খুব জরুরি তা হলো শিক্ষাজগৎকে এ-অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য দায়ী কে বা কারা! আমাদের সাহিত্য বা শিল্পের জগৎ এই শিক্ষাজগতের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত! যাঁরা লেখক বা শিল্পী তাঁরা সমাজের কোন শ্রেণির মানুষ, বা তাঁদের সৃষ্টি বা কাজ দ্বারা তাঁরা সমাজের মানুষের মনকে কীভাবে একটা ভিন্ন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নিয়ে যান। এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজতর হয়, যদি আগে একটি বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়; সেটা হলো শিল্পের প্রায়োগিক মূল্য নির্ধারণ করা বা সমাজে সত্যিই এর মূল্য কী বা কতটা তা কিছুটা নির্ধারণ করা!

আজকের আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্র শিক্ষাজগতের কোন ধারাকে মূল্য দিচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে আমাদের শিল্প বা সৃষ্টিশীল জগৎ কতটা মূল্য পাবে। আমাদের সমাজ মানববিদ্যা শিক্ষাকে সম্ভবত সবচেয়ে কম মূল্য দিয়ে থাকে। আর সে-অবস্থায় রাষ্ট্রের বা সমাজের সবচেয়ে মেধাবী মানুষের এই জগতে আসার সম্ভাবনা একেবারেই কম। কারণ কেউ তো আর স্বেচ্ছায় অনাহারী বা অর্ধাহারী থেকে জীবন নির্বাহ করতে চান না। তাই যেসব শিক্ষায় সবচেয়ে অমেধাবী বা স্বল্প মেধার মানুষের বিচরণ বিদ্যাপাড়ায়, সেটিই মানবিক বা সৃষ্টিশীল শিক্ষা। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা শিক্ষার বা পেশার কোন চরিত্র বা ধরনকে বেশি মূল্য দেয়, সাধারণ মানুষের ঝোঁক সেদিকে ঝুঁঁকে থাকা। তাই দেখা যায়, সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা যে-শিক্ষাকে বেশি মর্যাদা দেয়, সেদিকেই মেধাবীরা যায়; কিন্তু সমাজ বা দেশের মানুষের সভ্যতা বিচার করা হয় তাদের রুচি বা বোধ দিয়ে। সেটা উন্নত করে শিল্প। যে সমাজ যত বেশি মানববিদ্যা থেকে  দূরে, সে-সমাজ রুচি বা মনন থেকে তত বেশি দূরে।

স্বাধীনতার পর আমাদের সমাজের অগ্রশীল মানুষ চাইলেন আমাদের শিক্ষা ও মূল্যবোধ বা রুচির জগৎটাকে পরিশীলিত করে গড়ে তুলতে। এই অগ্রশীল গুটিকয় মানুষের সামনে শিল্প বা সাহিত্য পত্রিকা তেমন ছিল না যা আমাদের মতো সদ্য স্বাধীন সাংস্কৃতিক দিক থেকে দীন সমাজকে উন্নত করার বাহন হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এঁদের সামনে কবিতা বা পরিচয় বা দেশ পত্রিকা ছিল। তাঁরা নিজেরা অনেকে তাঁদের সৃষ্টিশীল মন ও রুচি নির্মাণ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই তিন-চারটি পত্রিকা নিয়মিত পড়ে। এই অগ্রচিন্তার প্রগতিশীল তরুণদের একজন ছিলেন কবি মাহমুদ আল জামান বা আবুল হাসনাত। তিনি ব্যক্তিজীবনে ছিলেন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদের প্রথম সারির নেতা। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এই মানুষটি একসময় রাজনীতির বিকল্প হিসেবে মননচর্চা না শিল্পের রুচিকে উন্নততর করে গড়ে তুলতে সাহিত্য বা শিল্প পত্রিকা সম্পাদনার সিদ্ধান্ত নেন। জীবিকার জন্য তিনি যদিও দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাই এই পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীটিকেই তাঁর অন্বিষ্ট অর্থাৎ পাঠক বা লেখকদের রুচি নির্মাণের ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে বেছে নিলেন। যদিও এর বাইরে তিনি গণসাহিত্য নামে একটি অসাধারণ সাহিত্য পত্রিকা কবি ও প্রাবন্ধিক মফিদুল হকের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন।

সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা শুরু করে সাহিত্য ও সংগীতের সঙ্গে সঙ্গে চিত্রকলাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ লেখানো লেখক ও চিত্র-সমালোচকদের দিয়ে তিনি শুরু করেন। এই প্রথম আমাদের সমাজে লেখকরা চিত্রকলার শিল্পমূল্য বোঝার দিকে নজর দিলেন। সত্যিকার সাহিত্যের সঙ্গে শিল্পের বিভিন্ন শাখার সম্পর্ক কিছুটা বোঝার ক্ষেত্রেও পাঠকরা উৎসাহী হন এসব প্রবন্ধ পড়ে। সংবাদ সাময়িকী ছাড়া দেশে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পত্রিকা ছিল সিকান্দার আবু জাফর-সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা। কিন্তু একসময় এই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া বাংলা একাডেমির নিজস্ব সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকার বেশ কিছুদিন উন্নত মান বজায় রেখেছিল; কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের যেসব সীমাবদ্ধতা থাকে বাংলা একাডেমির সেই সীমাবদ্ধতা সব সময়ই রয়েছে। তাই তাদের পত্রিকাটিও দীর্ঘদিন সাহিত্য বা শিল্পের মান বজায় রাখতে পারেনি। তাছাড়া একটি সুসম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকাকে যে-আদলে গড়ে তুলতে হয় শিল্পের শিক্ষা ও কল্পনা দিয়ে, বাংলা একাডেমিতে কর্মরত লেখক-সম্পাদকদের কারো কারো তা থাকলেও একাডেমির নিজস্ব সীমাবদ্ধতা ডিঙিয়ে তেমন একটি স্থায়ী উন্নত সাহিত্য পত্রিকা বাংলা একাডেমির পক্ষে দীর্ঘদিন প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।

দীর্ঘদিন সংবাদে নিজের সকল কল্পনা ও সাহিত্যরুচি লগ্নি করেও আবুল হাসনাত একসময় বছর কুড়ি আগে সংবাদ ত্যাগ করে একটি ভিন্ন মানের সাহিত্য ও শিল্পবিষয়ক পত্রিকা শুরু করেন, তার নাম কালি ও কলম। শুরু থেকেই মুদ্রণ ও লেখা এবং অঙ্গসজ্জার জন্য পত্রিকাটি রুচিশীল সাহিত্য পাঠকদের প্রিয় পত্রিকা হয়ে দাঁড়ায়। জীবনের শেষ প্রায় দুই দশককাল আবুল হাসনাতের জীবন ও কল্পনায় জগতের কোনো বিষয়ই তেমন গুরুত্ব পেত না, যতটা পেত কালি ও কলম। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব শীর্ষ লেখকই আবুল হাসনাতের প্রিয়জন ছিলেন, তাঁরাও তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। তাই তিনি ভালো লেখা সংগ্রহ করতে সক্ষম হতেন অন্য সম্পাদকদের চেয়ে বেশি। বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য পত্রিকা বলতে কবিতা, পরিচয়, এক্ষণ, অনুস্টুপ বা আরো যেসব পত্রিকা বাংলা সাহিত্যকে পুষ্ট করেছে শতাব্দীকাল ধরে, তার অনেকটাই সম্পাদক আবুল হাসনাত জানতেন। তিনি ছিলেন সাহিত্য বিষয়ে সত্যিকার বোদ্ধা ও ঋদ্ধ মানুষ। স্বল্পভাষী, ভীষণ রুচিশীল মার্জিত স্বভাবের এই মানুষটির পক্ষেই সম্ভব হয়েছে কালি ও কলমের মতো একটি পত্রিকাকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।

কালি ও কলমের ভূমিকা বিষয়ে ভাবতে গেলে আরো কিছু বিষয় আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন। সেটা হলো, একটা তমসাচ্ছন্ন সমাজে সাহিত্য বা শিল্পের চর্চা বা তাকে উচ্চ মাত্রায় নিয়ে যাওয়া এক কঠোর সংগ্রামের বিষয়, যা সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষের পক্ষে একটু কঠিন। স্রোতের বিপরীতে সারাক্ষণ সাঁতার কাটতে হয় সম্পাদককে। যেখানে নিয়তি এমন কিছু আচ্ছন্ন-করে-দেওয়া-বাজার আবহ সৃষ্টি করে হালকা রুচিহীন পাঠ্যবস্তু দ্বারা যে রুচি নির্মাণ, সেখানে প্রায়-অসম্ভব হয়ে ওঠে। কাতারে কাতারে পুঁজির বর্জ্য বাজারকে সয়লাব করে দিচ্ছে যাদের আমরা সাহিত্য বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। হৃদয়গহনের কোনো সূক্ষ্ম অনুধাবনহীন বা চিন্তার ব্যাপ্তিহীন কল্পকথাকে দিনের পর দিন পত্রিকায় ছেপে পাঠককে গিলতে বাধ্য করছে বাজার। কিন্তু এখানেও কিছু তরুণ-তরুণী স্বপ্ন দেখে, চিন্তা ও কল্পনার সৃজন-প্রতিভা নিয়ে জন্মেছে, তাদের চিন্তার উৎকর্ষ ও কল্পনার তেপান্তরবৃত্তি সৃষ্টিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কালি ও কলম। কিন্তু আমাদের লেখককুলের শিল্পী-স্বভাবে বড় কোনো অঙ্গীকার দেখা যায় না, তাঁদের গৃহস্থবধূ যেমন সারাক্ষণ সলতে জ্বালিয়ে গৃহের তমসা দূর করেন, তেমনি সম্পাদককেও এসব সম্ভাবনাময় লেখকের অন্বীক্ষার ঊর্ধ্বমানের কোনো অজানা সীমারেখার সন্ধান দিতে হয় উৎসাহ দিয়ে। কালি ও কলম এবং এর মনীষাসম্পন্ন সম্পাদক আবুল হাসনাত সেটাই করে যাচ্ছিলেন প্রায় দুই দশক। আজ তাঁর ‘অকাল প্রয়াণের’ পর তাঁর যোগ্য সহকর্মীরাও সেটাই করে যাচ্ছেন।

আমাদের সাহিত্যজগতের যা কিছু দীনতা তা নিয়ে আক্ষেপের সমারোহ ঘটিয়ে কী আর লাভ, কিন্তু যা আমাদের আছে তাই নিয়ে পত্রিকা ও লেখার মানকে এগিয়ে নেওয়ার লড়াইটা চালিয়ে যাওয়াই যৌক্তিক!

রুগ্ণ রাজনীতি ও রুগ্ণ সংস্কৃতির এক অজানা অয়নবৃত্তির মাঝে আমরা বাঁধা পড়ে আছি, তাই এই রুচিশীল পত্রিকাটিকে বাঁচিয়ে রাখাই হবে জরুরি কাজ। জাতি হিসেবে যেমন, পাঠক হিসেবেও তেমনি আমাদের আত্মসমর্পণকাতরতা তুলনাহীন, উজ্জ্বল ঝকঝকে রুচিহীন লেখায় ঠাসা পত্রিকা যেখানে আমাদের বাজার ও ঘরবাড়ি দখল করে নিয়েছে, সেখানে এই অপকৃষ্ট আসক্তির সমারোহকে উজিয়ে একটু পরিশ্রমী হয়ে ও অভিনিবেশ নিয়ে কালি ও কলমকে বাঁচিয়ে রাখাটা কর্তব্য, যা আমাদের পাঠকদের কিছুটা হলেও বিপরীত স্রোতের মাঝে মনীষা-ছোঁয়া রুচিতে ঋদ্ধ করবে, যেমনটা করেছে গত দুই দশক ধরে! আমাদের সামাজিক জীবনের এক ঘোর তমসাচ্ছন্ন সময় আমরা পার করছি, কালি ও কলম সেই বিরুদ্ধ সময়ে কিছুটা হলেও সলতে জ্বালিয়ে রাখবে, আশা করি!