সিনেমা-নাটক : নতুন কতটা নতুন

সিনেমা অথবা নাটকের বিষয় উপাদান, নির্মাণশৈলী এবং প্রাসঙ্গিকতার উৎকর্ষ বিচার কিংবা নতুন কতটা নতুন, এ-ধরনের তুল্যমূল্য নির্ধারণ বিষয়টি ভাবতে সহজ। কিন্তু বিচারিক মূল্য জুড়ে দেওয়া মোটেও সহজ নয়। কারণ প্রতিটি শিল্পই প্রকাশের উপমায় স্বতন্ত্র। যা কিছু স্বতন্ত্র, সেটাই নতুন। কতটা নতুন যোগমাত্রার লেভেল দেওয়া কঠিন। তবে সার্বিক বিচারে সিনেমা অথবা নাটকের সংস্কৃতিমূল্য আছে কি না, সেটা আর্থিক লাভের বিচারে নয়। মননশীলতার মাপে। অথবা বাঁকবদলের
ইশারা-ইঙ্গিতের সমাজতাত্ত্বিক মূল্যায়নে। কিংবা সময়ের প্রয়োজন পরিশোধ করতে পারছে কি না। সেসব বিচার্য বিষয় হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, নতুনের সংজ্ঞা কীভাবে নির্ধারণ হবে। নতুন বছর, নতুই বই, নতুন শহর অথবা নতুন বউ ইত্যাদি সবকিছুতেই নতুন শব্দের যোগ আছে। নতুন নাটক অথবা সিনেমার কাল নির্ধারণ আমরা কীভাবে করবো। কারণ যে-কোনো বর্তমান অথবা নতুন, অতীত উৎস থেকে নির্মিত। সময় অথবা কাল একটি বায়বীয় ধারণা। ঘটনা-দুর্ঘটনার গতিপ্রকৃতিই সময়কে চিহ্নিত করে। সেই সন্ধিক্ষণ সময়ের সৃষ্টি অনাসৃষ্টি সবই নতুন বলে মনে হয়। বিধায় নতুন সিনেমা নতুন নাটক মানে পুরনো সবকিছু বর্জন? মোটেও নয়।

প্রথমে আমরা আলোকপাত করছি সিনেমা প্রসঙ্গটি। যা ছিল পুরনো তা সিনেমার রীতি-পদ্ধতিতে কতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছিল। সিনেমার এই বিষয়ের অনুসন্ধান জরুরি। আমাদের পূর্বনির্মাতাদের সিনেমা নামের সংস্কৃতিচর্চার কারণে ৬০-এর বেশি বছর ধরে সিনেমা শব্দটি আজো উজ্জীবিত। এই মুহূর্তে প্রবন্ধালোচনার সূত্রে বন্দি। সিনেমা নতুন কতটা নতুন। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে মতদ্বৈততা অথবা মতৈক্যে তাঁরাও সিনেমা নিয়ে ভেবেছেন। গড়েছেন সিনেমা। সিনেমা সংস্কৃতি বিকাশে লড়াই করেছেন।

১. কতটা নতুন শর্ত পূরণে পুরনো

১৯৫৩ সাল। তৎকালীন ঢাকার সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা একত্র হলেন। চ্যালেঞ্জ নিলেন। নির্মিত হলো মুখ ও মুখোশ। ১৯৫৬ সালে এই দেশে সিনেমা নামের নতুন সংস্কৃতির যাত্রা শুরু হলো। ঘটলো সিনেমা শব্দটির সঙ্গে বাঙালি দর্শকদের পরমাত্মীয়তা। গ্রামবাংলার রূপ-অপরূপ এবং সরল মানুষের হাসি-কান্না দর্শক সিনেমার পর্দায় উপভোগ ও অনুভব করলো জাগো হুয়া সাভেরা (১৯৫৯) এবং আসিয়া (১৯৬০) সিনেমায়। অর্জন করলো নিজেদের জীবন দেখার নতুন অভিজ্ঞতা। রাতের উন্মুক্ত মাঠে বাঙালির যাত্রা দেখা চোখটা নতুন প্রশান্তির খোঁজ পেল। কিন্তু ১৯৬১ সালে সিনেমার রূপকলা নিয়ে পরীক্ষামূলক কখনো আসেনি (১৯৬১) দেখে দর্শক হোঁচট খেলো। থমকে দাঁড়ালো। বিস্মিত হলো সিনেমার পর্দায় নতুন ধরনের গল্প-বর্ণনা দেখে। আবার সূর্যস্নান (১৯৬২) সিনেমার ভাবগম্ভীর গীত, নায়িকা চরিত্রের সলিল সমাধি দর্শকদের সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে প্রশ্ন করতে শেখালো। এই ধারাবাহিকতায় কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩) সিনেমায় মানব সম্পর্কের অদ্ভুত ইমেজ দর্শক পর্দায় দেখে মানুষকে বুঝতে পারার ব্যাখ্যায় নিজেরাই জড়িয়ে গেল। সিনেমার শিল্প-উদ্দেশ্য দর্শক অনুভব করতে জানলো। সিনেমা শুধু বিনোদন হিসেবে থাকলো না। ভাবনার রসদ হয়ে দাঁড়ালো। নতুন কতটা নতুন এই শর্ত পূরণে বাংলাদেশের সিনেমা এগিয়ে গেল।

 যে দর্শক সারাক্ষণ রুপালি পর্দায় সাদাকালো ছবি দেখতো, তারা সংগম (১৯৬৪) সিনেমায় দেখতে পেল রঙিন এক নতুন জগৎ। আবার একই দর্শক সিনেমা হলের প্রসারিত পর্দায় ১৯৬৫ সালে দেখলো সিনেমাস্কোপ বাহানা সিনেমা। চমৎকৃত হলো নতুন ধরনের সিনেমা প্রদর্শন অভিজ্ঞতায়। পাশাপাশি লোকজ বাংলার মিথকাহিনি নিয়ে নির্মিত রূপবান (১৯৬৫) শক্তিশালী বাণিজ্য মশলাযুক্ত উর্দু সিনেমাকে প্রতিহত করলো। সিনেমার দ্রুতিময় শক্তি নিয়ে নির্মাতারা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আরো সাহসী হলেন। বাঙালি দর্শকদের চিন্তাজগতে বিশ্ব চলচ্চিত্রের ভাষাবিজ্ঞান ধরিয়ে দিতে বহুমুখী ফ্লাশব্যাকে নদী ও নারী (১৯৬৫), সুতরাং (১৯৬৪) নির্মিত হলো। মঞ্চের নাটক, টিভি পর্দার নাটক সিনেমা পর্দায় চিত্রায়িত করলে কেমন হয়, এতসব বিচিত্র স্বাদ-আস্বাদে তের নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন (১৯৬৬), নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭) এবং ত্রি-রত্ন (১৯৭৪) সিনেমার ছায়া পর্দায় দেখতে পেল। নতুন কতটা নতুন এই দ্বন্দ্ব নিয়ে দর্শক সিনেমাকে সঙ্গী করে এগিয়ে চললো।

১৯৬৭ সালে পূর্ণদৈর্ঘ্যরে প্রথারীতি ভাঙার প্রয়াসে দুটি ভিন্ন মেজাজধর্মী ছোটগল্পে একটি সিনেমা আয়না ও অবশিষ্ট দর্শক দেখে স্পন্দিত হলো। আবার একই দর্শক দেখলো দীঘল দৈর্ঘ্যরে সিনেমা বিন্দু থেকে বৃত্ত (১৯৭০)। একই বছরে একটি বিপ্লব ঘটানো সিনেমার সঙ্গে দর্শক একাত্ম হলো। দেশব্যাপী প্রদর্শনের জন্য দর্শক আন্দোলন করলো। দিলো সামরিক সরকারের ভিত নাড়িয়ে। জীবন থেকে নেয়া যেন বাংলা ও বাঙালির প্রতিবাদ-স্পন্দনের সিনেমা হয়ে দাঁড়ালো। সবই সময়কে চিহ্নিত করার পরিণাম – ঘটনা-দুর্ঘটনা। নতুন কতটা নতুনের দাবিতে আগুয়ান।

১৯৭১। মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সিনেমায় যোগ হলো মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নামের নতুন এক শ্রেণির উদ্ভাবন। নতুন কতটা নতুন শর্ত পূরণ আবার ঘটলো। এছাড়াও আমাদের নির্মাতারা সিনেমা নির্মাণে লোকজ ও উপমহাদেশীয় ঐতিহ্যের প্রতিও বিশ্বাসী ছিলেন। নির্মাণরীতিতে আঙ্গিকগত কৌশল প্রয়োগে সহজাতরূপ থাকলেও বিষয় নির্বাচনে বাংলার সর্বকোণের জীবন, জীবন ধারণা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিস্তৃত চিত্রময়তা তাঁদের সিনেমায় ছিল দৃশ্যযোগ্য। তৎসহ প্রখরভাবে দেশজ দৃশ্যবোধের যুক্ততা। যেন এক আকাশে ওড়া বহু ঘুড়ির বর্ণময়তার মতো। তাঁরাও আধ্যাত্মিক রসের সন্ধানে বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২) সিনেমার গল্প খুঁজে ফিরেছেন। অথবা লালন ফকির (১৯৭২) নামের সিনেমার সংলাপ, ঘটনাক্রমে চিন্ময়ী জীবনজিজ্ঞাসার উত্তর তালাশ করেছেন। কখনো মানবিক রসের অনুসন্ধানে ডুমুরের ফুল (১৯৭৮), আনোয়ারা (১৯৬৭), নয়নতারা (১৯৬৭), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), সুতরাং (১৯৬৪), সূর্যস্নান (১৯৬২), হাঙ্গর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭) নির্মাণ করেছেন।

 যে-কোনো প্রথারীতির সিনেমায় শনাক্তকরণমূলক চিন্তা দাবি করে নতুনত্ব। এবং সিনেমার ভাষা প্রকাশ যেমন আলাদা এর প্রকৃত উদ্দেশ্যও বহুধাবিস্তৃত। নিজ ভাষাশক্তি আছে বলেই পুরনো ধ্যান-ধারণার মূলে আঘাত হানতে পারে। প্রত্যাখ্যান করতে পারে। মানুষের নান্দনিক মূল্যবোধসমূহ সমাজ জীবন প্রবাহের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারে। সিনেমা একধরনের ইচ্ছাশক্তি খোঁজার অথবা খুঁজে পাওয়ার উপলক্ষ। সিনেমা জনগণের বিশাল অংশের স্বার্থ, আশা-আকাক্সক্ষাসহ সম্ভাবনা ও সম্পর্কের কথা বলে। যেমন, ছুটির ঘণ্টা (১৯৮০), পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩), ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), চিত্রা নদীর পাড়ে (১৯৯৯), সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭) ও লোকায়ত চেতনার দৃশ্যপাঠ মাটির ময়না (২০০২) সিনেমাগুলো তার প্রমাণ, যা আজো দর্শকের কাছে নতুন সিনেমা স্বাদে সুখ্যাতি ছড়ায়।

দ্বিতীয়ত প্রযুক্তির কারুময়তা কখনো কখনো সিনেমার চিত্রময়তায় নতুন রূপ-ব্যঞ্জনায় ভূমিকা রাখে। সিনেমা সমন্বয়ী শিল্প বিধায় অন্যসব শিল্পকলা এবং সংস্কৃতির অর্থ ক্রিয়াশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। সিনেমা এককভাবে নতুন হতে পারে না। সহজে বদলাতেও পারে না। সিনেমা শুধু মেধা-মনন বিকাশের শিল্পকলা নয়, বিপুল অর্থ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত এবং সংগ্রাম ও উৎপাদন। সিনেমা স্বার্থ-সংযুক্তি প্রদর্শন এবং নির্মাণ ক্ষেত্রের সঙ্গে। ঠিক যেন নারীর জরায়ুর সংবেদনশীল সূক্ষ্ম শিরা-উপশিরার মতো জড়ানো। সিনেমার গঠনগত একটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এস্টাবলিশমেন্ট আছে। মাদার আইডেন্টিটি আছে। একধরনের চুম্বকীয় ডিমান্ড আছে। তবে সিনেমার পরিবর্তন যদি অর্থক্রিয়াশীল না হয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অর্থে আসে, তাহলে সিনেমা নতুন মনে হবে।

সময়োপযোগী হবে। হতে পারে যুগোপযোগী।

নতুন অথবা আধুনিকতার সংজ্ঞা বলে, প্রচলিত শৃঙ্খলাকে নাড়িয়ে দেওয়া। পরমোৎকৃষ্ট জ্ঞানচর্চায় শিল্পের নতুন পথের অনুসন্ধান করা। সিনেমা কতটা পারছে? যদি পারে তাহলে সিনেমা দাবি করবে নতুন কিছু। তবে এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সিনেমা নামের বৃহৎ পুঁজির শিল্পের রূপবদলে আধুনিক প্রযুক্তিও একটা বড় ভূমিকা রাখে।

২. হাওয়ায় ভাসে সিনেমা-নাটক

অতিমারির সময়কালে ঘরবন্দি মানুষের জীবনযাপনের পদ্ধতিগত আচরণে ঘটে রদবদল। সিনেমার প্রচলিত প্রদর্শন শৃঙ্খলার ভাংচুর হয়। বাংলাদেশের প্রায় ১০ কোটির অধিক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে নিয়ে গড়ে ওঠে বিনোদনকেন্দ্রিক হাওয়াই সিনেমা হল। পুঁজির শিল্পের রূপবদলে আধুনিক প্রযুক্তির একটা বড় ভূমিকা স্পষ্টতা লাভ করে। মুক্তবাজার তৈরির পথ হয় উন্মুক্ত। ওটিটি নামকরণে প্ল্যাটফর্ম নির্মাতাদের উৎসাহিত করে নিরীক্ষাধর্মী সিনেমা, নাটক এবং ওয়েব সিরিজ বলি, সদরঘাটের টাইগার নির্মাণে। এবং মনস্তাত্ত্বিক ভ্রম-ভ্রান্তি নিয়ে চরিত্রের পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতের গল্প মাই শেলফ অ্যালেন স্বপন, মুন্সিগীরি, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান। অপরাধ কাহিনির রোমাঞ্চকর ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়ে জানোয়ার। মহানগর, মোবারকনামা অথবা পরিত্যক্ত কারখানায় আটকে পড়া দুইজন নর-নারীর গল্পের গভীরতলে ১৫ই আগস্টের বোমা-সন্ত্রাসের গল্প। পথঘাটে আগুনসন্ত্রাসের গল্পে দহন। এসব গল্পের সিনেমা নতুন কতটা নতুন দাবি অর্থে বলা যায়, সময়ের দার্শনিক চিন্তার অন্তরঙ্গ সমবায়। দৃশ্যভাষিক ইমেজ তৈরির প্রচেষ্টায় নির্মাতাদের প্রবল আন্তরিকতা এবং নির্মাতাদের গল্প বলায় সাহসী হওয়ার চেতনা। তাঁরা সময়ের গল্প সময়েই বলতে চান। তাঁরা তৈরি হন সামাজিক অসংগতি প্রশাসনিক জটিলতায় বদ্ধ সিস্টেমের প্রতিবাদ করতে। তাঁরাই বানান ভার্চুয়াল জগতের উত্তেজনা উন্মাদনা নিয়ে ডার্ক কমেডি ঢংধর্মী রোমান্টিক থ্রিলার সিনেমা। নতুন কতটা নতুন? কতটা নতুন হতে যতটা আকার ইকার থাকা প্রয়োজন। বিশ্ববাজারে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণের তাগিদে নির্মাতারা সদাসতর্ক। অর্জন করছে কৌশলগত জ্ঞান। গ্রহণ করছে নতুন প্রযুক্তির সাপোর্ট। এবং লগ্নিকারকগণও সহযোগিতা করছেন। এ যেন নীরব নবতরঙ্গ।

এক সময় সামাজিক, অ্যাকশন ও রোমান্টিক – এই তিন ঘরানার সিনেমা নির্মাণ হতো। হাওয়াই সিনেমা হল সুবিধায় এখন গল্পে সাসপেন্স, ভায়োলেন্স, কমেডি অথবা ট্র্যাজেডি আনতে নানান জঁরা বা শ্রেণির সঙ্গে সেনসিটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ আসছে সংলাপে। প্রবাদে বলে, নারীর সঙ্গে নরের গোঁফবিহীন চুম্বন হলো লবণহীন ডিমের অমলেটের মতো। হয়তো দর্শকদের অতিরিক্ত তৃপ্তি দিতে সংলাপে অথবা নায়িকার দেহসংরাগে রসালো সংলাপ ভঙ্গি জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। টেস্টি সল্ট ইফেক্ট। স্বাদ বাড়লো। নতুন ধরনের সিনেমার তকমা লাগলো। প্রসঙ্গটি দর্শকরা গ্রহণ করছে। জীবনের ঘনত্ব বোঝার একধরনের পরীক্ষা। নতুন ততটাই নতুন। নতুন সিনেমা, নতুন নাটক। সমাজ কিছুটা সংক্রামিত হচ্ছে, যা দেশীয় সমাজ-সংস্কৃতির অঙ্গপরতে কিছুটা বিষপূর্ণ মনে হলেও নির্মাতারা বিষাক্ত মনে করছেন না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইংরেজ শাসনের প্রারম্ভকালে এ-সমাজে বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতার রাজ্য সৃষ্টি হয়। সমাজের রসপিপাসু দর্শকরা গীত, সাহিত্য ও যাত্রায় অশ্লীলতার  দারুণ ভক্ত হয়ে পড়েন। ধারণা করা যায়, এ যেন কলংকিত ইতিহাসের পুনর্পাঠ, এক অর্থে। তবে সংস্কৃতি ও সংগ্রামের প্রতি নৈতিক দায় সবারই থাকা প্রয়োজন।

৩. পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়

নতুন দৃষ্টিতে দেখা আবহমান বাংলার রূপ-স্বরূপ। আমরা এই দৃষ্টিকোণকে স্বদেশজাত নন্দনভাবনা বলতে পারি। দর্শক দেখছে অধিকাংশ নাটক আঞ্চলিক ভাষা সংলাপে। নতুন স্বাদে তৃপ্ত হচ্ছে বাগেরহাট অঞ্চলের ভাষায় সাহস। রাজশাহী শহর-গ্রামাঞ্চলের মাদক অপরাধ সংঘের ভাষা সংস্কৃতি অভ্যাস-অসভ্যতা নিয়ে তৈরি হচ্ছে সাটি কাপ। সিনেমার কলাকৌশলের জটিল মারপ্যাঁচ না থাকলেও আছে জলকাদায় মাখানো জীবন। তৎসহ ছিন্নভিন্ন কিছু মানুষ, কিছু যুবক-যুবতীর বহুগামী পথের কিছু লড়াই। দামাল গতিতে ছুটে চলা আছে। আছে ‘বেশ্যার ব্যাটা’র মতো জনপ্রিয় সংলাপ।

ঢাকাকেন্দ্রিক শিল্পচর্চা ফসল এখন জেলা অঞ্চলে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সিনেমা নাটকের চর্চার নতুন ক্ষেত্রের উন্মোচন ঘটছে। দর্শক মনে করছে বাংলার অঞ্চল ভেদে সংস্কৃতির চর্চা বিকাশ, প্রদর্শন এবং এর পার্থক্যের উপস্থাপন বিশ^ শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে বাঙালি জাতির একধরনের ব্র্যান্ডিং। এই প্রসঙ্গে ‘নালিউড’ সিনেমা রাজ্যের কথা বলা যায়, যা এখন দ্বিতীয় বৃহৎ সিনেমা উৎপাদনের দেশ। প্রতিবছর যেখানে নির্মাণ হচ্ছে ২৫০০ সিনেমা। নাইজেরিয়া শিক্ষা-সংস্কৃতিতে আজো পিছিয়ে পড়া দেশ। কোনো প্রযুক্তির সুবিধা নেই। সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যেই নির্মাতারা নির্মাণ করছে পুরনো যন্ত্র-অনুষঙ্গে সিনেমা। গল্পে বলছে নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতির কথা। জীবন যাপনের সংগতি-অসংগতি নিয়ে। সরল সাদামাটা আঙ্গিকে। পথঘাট, বাজার উঠান
ঘর-গেরস্থির গল্প। জীবন পতনের শ্লীল-অশ্লীল ভাষা শব্দের গল্প। হলিউডের পাশাপাশি দর্শক নালিউডের সিনেমা দেখছে। এ যেন সিনেমা নিয়ে নতুন কতটা নতুনের মহাযাত্রা। হয়তো এ-যাত্রার শরিক আমাদের গ্রামবাংলার ছেলেমেয়েরা। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে শহর-নগরের অলিগলিতে গ্রামবাংলার পথঘাট বাগানে এখন সিনেমা, নাটক নির্মাতা অভিনয়শিল্পীর সমাগম। নির্মাণ করছে শর্টফিল্ম ধারণায় হট ফিল্ম, আদর্শ প্রেমকাহিনি, বরবাদ, গোশত, প্রপোজ ইত্যাদি। দেখার দর্শক আছে। বিষয় নিয়ে লেখার লেখক আছে। যা বিদ্যমান কিশোর-কিশোরীদের মনোজগতের প্রতিচ্ছবি। নতুন বিষয়ের নতুন উদ্যোগ। কতটা নতুনের উদাহরণ। বিচারিক কোন মানদণ্ডে এ-ধরনের নাটক-সিনেমার শিল্পভাষা মূল্যায়িত হবে? ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ বলে লেবেল জুড়ে দিয়ে আলাদা করে রাখার সুযোগ নেই। তৈরি হতেই থাকবে বউচোর, পেজগি অথবা পল্টিবাজ কিংবা ক্রেজি হাসবেন্ড। এক ধরনের এক্সপেরিমেন্ট আছে। ফিলোসফি আছে। চিত্রনাট্যে সরলরীতি আছে। কৌতুকরস আছে। সংলাপ, শব্দ ও সংগীতের দেশীয় মনোহরপূর্ণ প্রয়োগ আছে। আঞ্চলিক সংস্কৃতি ধারণার চেতনাপ্রবাহ আছে। সবকিছুই যেন সিনেমাবংশীয় গড়নভঙ্গি। দর্শকদের কানেক্ট করতে পারছে। পপুলারিজম বলে কথা। ওটিটি, ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে। মন্তব্য আসছে – গল্পের মান নেই। অভিনয়ের শিল্পরূপ নেই। নির্মাণে পরিচর্যা নেই। আবার নির্মাতারা অলটার নোটিশে বলছেন, গড় মন্তব্যের মূল্য নেই। নির্দিষ্ট করে মন্তব্য করতে হবে। এই তর্ক-বিতর্কের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে বলা যায় এই বিষয়ের দর্শক কারা – শ্রমজীবী মানুষ। অঞ্চল ভেদের মানুষ। যারা আঞ্চলিক কিছু হলেই তৃপ্ত হন। এই সুযোগ নিতে নির্মাতারা আঞ্চলিক চেতনায় জড়িয়ে যাচ্ছে।

ইউটিউব ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের স্বাধীন চিন্তার বিষয় প্রকাশের একটা অতিরিক্ত সুবিধা আছে। নেই সামাজিক অথবা রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা। ফলরূপে দেখা যায়, গল্পে অশ্লীলতা অথবা নিছক ভাঁড়ামোর আধিক্য। অশ্লীলতার সংজ্ঞা নির্ধারণ নিয়ে তর্ক চলছে। তবুও দর্শকের ভিউ বাড়ছে। দর্শক মন্তব্য করে। অর্থ দাঁড়ায়, তারা দেখছে তার প্রমাণ। আবার দর্শক দ্বিমত প্রকাশে বলছে এসব সাংস্কৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু দেখা থেকে বিরত থাকছে না। নতুন কিছু স্বাদ না পেলে দর্শক কেন দেখছে। পরম উৎসাহে দেখছে বলেই ৬০০ (ছয়শো) পর্বেও অনেক সিরিয়াল নাটকের সমাপ্তি টানা যাচ্ছে না। কথায় যুক্তি আছে। এসব নাটক টিভি পর্দার চেয়ে দর্শকদের হাতে মুঠোফোনেই প্রদর্শন হয় বেশি। দর্শক উপভোগ করছে ইচ্ছা স্বাধীন। নাটকপ্রেমীদের বিনোদনে আপন মানুষ, না বলে কিছু নেই,

বউ-শাশুড়ি ইত্যাদি শিরোনামে নাটক তৈরি হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন উঠেছে কতটা এসব নতুন? নতুনের স্থায়ী সময় এক পল মুহূর্ত মাত্র। যখন দর্শক প্রথম দেখছে তখন সেটা তার কাছে নতুন। দ্বিতীয়বার দেখলে সেটা হয়ে যাচ্ছে পুরনো। তাহলে নতুন বিচার হবে কোন প্রেক্ষিত ধরে? এই ক্ষেত্রে সিনেমা অথবা নাটকের অবয়ব ঘটনা বিচার করা হলে পূর্ণ বিচার করা হবে না। এই দুই শিল্পকলার নির্মাণ ও প্রদর্শনের পূর্ণ ক্ষেত্রটি অনুসন্ধান করলে নতুন উদ্যোগ, উৎসাহ এবং নীরব জাগরণ লক্ষ করা যাবে। যেমন – সিনেমা-নাটক নির্মাণে পুঁজি বিনিয়োগ কর্তাদের উৎসাহ লক্ষণীয়। অনেক নাটক নির্মাতা সিনেমা নির্মাণে সুযোগ পাচ্ছেন। নতুন শিল্পীদের আগমনে নাটক-সিনেমার জগৎ সৃষ্টির আনন্দে কোলাহলমুখর। প্রতিষ্ঠিত প্রবীণ শিল্পীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুনরা অভিনয় করছেন। নির্মাতারা শুধু দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, বিদেশের নাটক-সিনেমা নির্মাণকৌশলের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করার উৎসাহ পাচ্ছেন। আমাদের তরুণ নির্মাতারা আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের প্রমাণ করতে সক্ষম হচ্ছেন। ছিনিয়ে আনছেন নানা পুরস্কার, স্বীকৃতি এমনকি তাঁরা বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি বোর্ডের সদস্য হয়ে বাংলাদেশকে সম্মানিত করছেন। এই সবই নাটক-সিনেমার নতুন ক্ষেত্রভূমি। কতটা নতুন এই শব্দের যুক্তিসমান উত্তর। সিঙ্গেল স্ক্রিন প্রেক্ষাগৃহ যাদের কাছে পরিবেশবান্ধব বলে মনে হয় না তাদের জন্য ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বিনোদন খুঁজে নেওয়ার উৎকৃষ্ট প্রেক্ষাপট। বিদেশি ওটিটি সংস্থার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে হচ্ছে বিধায় নির্মাতাদের কনটেন্টের শিল্পমানের দিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হচ্ছে। নতুন নির্মাতাদের দাবি, ওটিটি দর্শকরাই সিনেমা হলে পুনরায় আসছেন বড় পর্দায় তাঁদের পছন্দের সিনেমা দেখতে। শুভ লক্ষণ সিনেমা-নাটকের জন্য।

৪. নগদে গরম এবং বাকি ইতিহাস

নাটক এখন কবিতার মতো সহজেই রচিত হচ্ছে। এ যেন সময়ের দাবিতে এগিয়ে যাওয়া। ঘটনা ঘটছে। আমজনতার আলোচনায় উত্তেজনা তৈরি করছে। নাটক নির্মাতারা অ্যাকশন কাট শুরু করে দিচ্ছেন। এই ধরনের নাটকের পুঁজি লগ্নিতে প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠান আছে। বিনিয়োগ এবং দ্রুত রিটার্ন। তাদের ভাষ্যমতে, এসব নতুন নাটক। সময়ে বসবাস। সময়ের দায় মেটাতে সময়ের নাটক নির্মাণ। সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনায় একটি সিনেমা বা একটি মঞ্চনাটক তৈরি করতে প্রস্তুতি, বিস্তারিত পরিকল্পনা, আয়োজন, বিপুল অর্থায়ন এবং দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন।

সত্তর ও আশির দশকে মঞ্চনাটকে কত প্রস্তুতি, কত আয়োজনে মায়াবী প্রহর (১৯৭২), মুক্তিযুদ্ধকালীন সতেরো গ্রামের মোড়লের বেইমানি ও অন্তর্দহনের গল্পে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৫), নারীবাদী চেতনায় দ্রোহ-বিদ্রোহের দর্শন ভাবনায় কোকিলারা আমরা দেখেছি। আমরা উপভোগ করেছি মেরাজ ফকিরের মা, কি চাহ শঙ্খচিল, নূরল দিনের সারাজীবন (১৯৮২), ওরা কদম আলী, বাকি ইতিহাস, ইবলিশ, ভেঁপুতে বেহাগ, শিখণ্ডী কথা, নষ্টনীড়, নানকার পালা, কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, সাতঘাটের কানাকড়ি, এই দেশে এই বেশে, রাঢ়াঙ, নিমজ্জন, মহাজনের নাও, সং ভং চং, বেহুলার ভাসান, ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল, পুত্র, হাছনজানের রাজা, জ্যোতিসংহিতা, দমের মাদার, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল ইত্যাদি। যেসব ছিল বাংলা নাটকের নব কোলাহল কালের সরবচিহ্ন। সেইসব নাটক রচনায় নাট্যশিল্পী, কথাশিল্পীসহ নাট্যরচয়িতাগণ মঞ্চনাটকের বিষয়ভাবনা, মঞ্চরূপায়ণ এবং মঞ্চপরিকল্পনায় নানা নিরীক্ষার প্রয়োগ ঘটান। ফলে পরিবেশনার অনুষঙ্গ হিসেবে মঞ্চে আলোর ব্যাপ্তিময় প্রক্ষেপণ ঘটে। পোশাকে জুতসই সুচিন্তার লক্ষণ দেখা যায়। তৎসহ আবহ শব্দ-সংগীতের স্কোরিং যেন সিনেমা পর্দার মোহনীয় ইমেজ ধারণা দিতে সক্ষম হয়। ফলে নাটকগুলি প্রাসঙ্গিকতা দাবি করে। দর্শকদের তৃপ্ত করে। এ যেন সেই সময়ের বৈপ্লবিক চেতনা। প্রতিবাদের ভাষায় আন্দোলিত ছিল নাট্যমঞ্চ। নাটকগুলি দাবি করতো জীবনদর্শনের দ্বন্দ্বফল। দেশীয় প্রেক্ষাপট প্রাসঙ্গিকতা ছাপিয়ে বিশ^নাটকের রূপান্তর দর্শকরা উপভোগ করার সুযোগলাভ করেন। নির্মাতারাও নিজেদের অবস্থান মূল্যায়ন করার উৎস খুঁজে পান। মিথাশ্রয়ী গল্পের পর বিমূর্ত আয়োজন মঞ্চায়নে দর্শকদের সময়চক্রের চাকায় অতীত ভ্রমণের সুযোগলাভ ঘটে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেসব কতটুকু নতুন? সময়ের দাবিতে সবই নতুন ছিল। নাটক ও চলচ্চিত্রের কাজই হলো উদ্দীপনাময় ভাষার অনুসন্ধান। কালিক ঘটনায় সবকিছুই বর্তমান। পূর্বে না-দেখা কিছু দর্শকের কাছে বর্তমানে নতুনই।

৫. বৃহত্তর মানবিক পটভূমি গঠনে পুনর্নির্মাণ

রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্ম জাগরণমূলক চেতনার ব্যাকুল প্রকাশ অচলায়তন (১৯১১), যা সমকালীন জীবনবোধের আলোকে ব্যঙ্গার্থ পরিবেশনা। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজো পাঠকের কাছে বহমান প্রতিক্রিয়া। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গড়ে তোলা মিথশক্তির বিপরীতে তারুণ্যনির্ভর নাট্যদল ‘প্রাচ্যনাট’ হয়ে উঠতে চেয়েছে বিনির্মাণবাদী। প্রচলিত এস্টাবলিশমেন্ট ভেঙে নতুন কিছুর অবগুণ্ঠন, যা নতুনের অ্যাটিচুড প্রকাশ করে। তাদের প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাটকের প্রকাশভঙ্গিকে নতুন কেন বলা হচ্ছে? ত্রিমুখী মঞ্চবিন্যাস, মঞ্চ-উপাদানের শৈল্পিক ও উপমাসূচক প্রয়োগ, আলোকবিন্যাসে স্থানিক বৈচিত্র্য আনার প্রচেষ্টা। নাট্যভাষায় শিল্পের বৈশিষ্ট্যগত দিক হলো, দর্শকের দৃষ্টিকোণে দেখাও, অনুধাবন করাও এবং অনুভব করাও। নিরীক্ষামূলক বর্তমান নাটকগুলি যেন তেমনি ইঙ্গিতপূর্ণ ধারণায় দর্শকদের বিমোহিত করছে। ধীরলয়ে ঘটছে জন-অভিজ্ঞতার পুনর্পাঠ। বলিষ্ঠ প্রামাণিকীকরণে প্রয়োগ হচ্ছে মাল্টিমিডিয়ার শৈল্পিক এবং কৌশলগত প্রক্ষেপণ। ফলে মঞ্চনাটকের অবয়ব জুড়ে কখনো লৌকিক কখনো অতিলৌকিক কথকতা প্রকাশ পাচ্ছে। এই নতুন প্রথারীতির অনুশীলন করে আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে ‘সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার’। ভিডিওগ্রাফি অ্যানিমেশন, থ্রি ডাইমেনশনাল প্রজেকশনের শৈল্পিক ব্যবহারে মঞ্চনাটকের দৃশ্যায়নে যোগ হয়েছে নতুন অর্থময়তা ও প্রকাশময়তা এবং দর্শকও নাটকের মঞ্চপাঠের সঙ্গে দ্বন্দ্বদ্বিধাসুলভ মুখোমুখিতায় দাঁড়িয়েছে। এই ধরনের নাট্যনির্মাতারা তাঁদের প্রচেষ্টাকে প্রথাবিরোধী নাট্যান্দোলন বলে প্রচার করছেন। পরিবেশনাগত যদিও রূপনীতির মাত্রা তথা মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার ২০০৮ সালে দর্শক উপভোগ করেছেন – ক্যাটাস্ট্রফি ও মেটামরফোসিস নাটকে। এসব নাটকের পোশাক-পরিচ্ছদে প্রামাণিকতা দাবি করা ছাড়াই অর্থবোধকতা এবং দৃশ্যবিন্যাসে বুদ্ধিগ্রাহ্য প্রকাশ থাকে। মঞ্চসজ্জা থাকে কনস্ট্রাক্টিভ। এপিকধর্মী পরিবেশকে চিহ্নিত করার প্রয়াস থাকে। মঞ্চ ঘিরে পরিবেশ দর্শককে আবিষ্ট করে রাখে। দর্শকের নিজস্ব চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। মন্তাজ আঙ্গিক ত্রিকোণ অথবা বক্রবিকাশ দ্বান্দ্বিক মুডে গল্প এগিয়ে যায়। এখানেই সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলা। নতুন ছন্দের সঙ্গে তাল মেলানো।

আদিম যুগে মানুষেরা সমাজে নানা প্রয়োজনে আচার-অনুষ্ঠানে নৃত্যভঙ্গির মাধ্যমে ভাব-অনুরাগ, ধর্মভাব প্রকাশ করতো। ফলে ভেবে নেওয়া হয়, নৃত্য মানবেতিহাসে প্রাচীনতম কলা। ভারতীয় নাটকের শুভসূচনা নৃত্য থেকে। যেহেতু নৃৎ ধাতু থেকে ‘নাটক’ শব্দটির উৎপত্তি। প্রাচীন ভারতে বাচিক অভিনয়ে গুরুত্ব প্রাধান্য পেত। নৃত্যের গতিভঙ্গি অঙ্গের সংগত সঞ্চালনযোগে বাচিক অভিনয়ক্ষেত্রটি সবল হয়। সেই প্রাচীন রীতি থেকে নতুন সংযোজন। সংস্কৃত নাটকের মুদ্রানির্ভর অভিনয় আধুনিককালে অবাঞ্ছিত হলেও ২০১৫ সালে মঞ্চস্থ ব্রাত্যজনের প্রতিবাদ মুখরতায় কথক মুদ্রায় মেইড ইন বাংলাদেশ দর্শকদের স্মৃতিতে রয়ে গেছে। নৃত্যের আঙ্গিক কৌশলে এখনো কোরিওগ্রাফিক পদ্ধতির প্রয়োগ দর্শকদের কাছে নতুন ব্যঞ্জনা মনে হয়েছে। মঞ্চনাটকের নতুনত্বের দাবিতে দেহ গরিমার চেয়ে চলন গরিমার প্রাসঙ্গিকতা আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ যেন প্রাচীন বৃক্ষতলে একই বীজের নতুন চারা রোপণ।

৬. নতুন কতটা নতুন

শিল্পের কাজই দর্শন, সমাজ-নৈতিকতা এবং সৌন্দর্য বিষয়ে প্রশ্ন উপস্থাপন করা। বস্তু অথবা বিষয়ের বাহ্যরূপের আড়ালে থাকা যথার্থ রূপভাব উন্মোচন করা। সিনেমা-নাটক কতটা নতুন হয়েছে? যথার্থতার রূপের ব্যাখ্যা প্রদানে নাটক কতটা স্বাধীন হতে পেরেছে? দৃশ্যমান বস্তু বা বিষয়কে কতটা ভিন্ন আঙ্গিক ব্যাখ্যায় জাহির করতে পেরেছে নাটক? সিনেমা কি পেরেছে জরাগ্রস্ত প্রাচীন ধারাকে পরিহার করতে? মর্মার্থে কি দর্শকের আবেগ জাগ্রত করছে? হয়তো পেরেছে। হাওয়া, সুড়ঙ্গ অথবা রেহানা মরিয়ম একধরনের শিল্পবোধ জাগিয়ে তোলে, যা কতকটা মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা দর্শক চোখে প্রত্যক্ষ করে, হৃদয়ে অনুভব করে। রং, দৃশ্য পরিকল্পনা, দৃশ্যের পটভূমি রচনা মনকে আন্দোলিত করে। ইমোশনকে জাগ্রত করে।

নাটক নতুন, কতটা নতুন? আমাদের নাট্যকারদের রচনায় মানুষের দিনরাতের কাব্যগাথা অসংখ্য চিত্রকল্পে সবিস্তার ঘটছে। ব্যাপ্তিতে সীমানা স্পর্শ করেছে মহাকাব্যিক ধারণার। যেমন রচিত হলো দ্বৈতাদ্বৈতবাদী নাটক প্রাচ্য। ২০০০ সালে নাটকটি মঞ্চস্থ হলো। এখানেই ঘটনাটি সমাপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু প্রাচ্য নাটকের নবপ্রাণ ঘটলো। মঞ্চরূপ থেকে মূকাভিনয় আঙ্গিকে দর্শক উপভোগ করলেন, অতঃপর চিত্রকলারূপে শিল্পতত্ত্বের সার্থকতায় অতিক্রম করলো। এর ফলে একটি নাটকের দ্বিবিধ মাধ্যমগত প্রকাশ বাক্সময়তা অভিনন্দিত বিষয় হলো। শুধু পরিমাপ করা গেল না নতুন কতটা নতুন।

বিষয়বৈচিত্র্যেই যার চমক, ছয়টি অণুনাটক কাহিনিগত ঐক্য না-ই বা থাকলো, ছিল তো সমসাময়িক প্রাত্যহিক গল্প। সমাজ, সময় নানা রূপভেদে জড়িয়ে মানুষেরই গল্প বলার প্রচেষ্টা একগুচ্ছ গল্প। অথবা প্রচলিত চর্চিত সংলাপে কাহিনি বর্ণনা যেন নাটকের আদি অবয়ব। সেখানে কবিতার উপমায়, চিত্রকল্পের অলংকারে এবং সংযমিত মেটাফোরিক এক্সপোজিশনে রিজওয়ান নাটকটিতে পৃথিবীর বিপর্যস্ত এবং সন্ত্রাসপীড়িত মানুষগুলি যেন দর্শকের সামনে প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়ে উত্তর আশা করছে।

আমাদের বিবেচনা ইত্যাদি অন্য ভিন্ন অভিজ্ঞতার প্রয়াসকে নতুন বলে বর্ণনা করা যায় কি না। কিংবা ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ী নাটকে দর্শক দেখলো তারাভানকে। দলিত নিম্নবর্গের নারীর প্রতিরূপায়ণ। ধসেপড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপে জীবননাশের গল্প। যে-গল্পের প্রত্যক্ষ সাক্ষী এদেশের মানুষ। প্রশাসন এবং শত শত শ্রমিক। যে-অপরাধ আজো অমীমাংসিত। এমন স্পর্শকাতর বিষয়ের নাট্যরচনা অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও বাতিঘর, কইন্যা নাটক রচয়িতার সাহস নতুন চেতনার দাবি করে কি না – পরিমাপ করার এখনই সময়।

আমাদের সিনেমা কতটা সমাজসচেতন? কত অংশে অগতানুগতিক? অথবা কতটুক সৃজনশীল? যদি হয় তাহলে সেটা নতুন। নির্মাতারা কর্মের প্রতি কতটা মনোযোগী, গল্পের বর্ণনকৌশলে কতটা চিন্তাঋদ্ধ। শৈল্পিক সুষমায় কতটা স্বতন্ত্র, অভিঘাতমূলক এবং উৎকর্ষমূলক। বক্তব্যধর্মী এবং বিশ্লেষণধর্মী।

নতুন কতটা নতুন – এই বাক্যের দাবিতে মনপুরা, বাপজানের বায়োস্কোপ, অজ্ঞাতনামা, জালালের গল্প, অনিল বাগচীর একদিন, মেঘমল্লার, হাজার বছর ধরে, দেবী, ইতি তোমার ঢাকা, সাঁতাও, আদিম, লাল মোরগের ঝুঁটি, চন্দ্রাবতী কথা, ঊনলৌকিক ইত্যাদি সিনেমাকে আড়াল করে রাখার সুযোগ নেই। যে-কোনো পরিবর্তন আসে অর্থ ক্রিয়াশীল অর্থে। তেমনি অর্থানুসন্ধানে আমাদের সাহসী নির্মাতারা চিত্রকর্ম এবং কবিতার উপাখ্যান নিয়েও নির্মাণ করেছেন মায়া দ্য লাস্ট মাদার। তাঁদেরই গল্পের প্রেক্ষাপটে উঠে এসেছে ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলার ফুটবল দলের সংগ্রাম এবং বর্তমান নারী ফুটবলারদের গড়ে ওঠার লড়াই ও অনুশীলন নিয়ে দামাল সিনেমা। এ যেন অতীত-বর্তমানের মিলন-মিশ্রণে জাক্সটাপজিশন। বাংলার লুপ্ত প্রদর্শন সংস্কৃতি অথবা পারফর্মিং শিল্পকলা সার্কাস নিয়ে বিউটি সার্কাস। এই গল্পের অন্তঃসলিলে ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির খোলস বদলে দেশপ্রেমিকরূপে হাজির হওয়া, সার্কাসের নট-নটীদের মতো। বিউটি সার্কাস বিনোদনের ছলে সত্যের অন্বেষণ। দক্ষিণ বাংলার লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাঁতে বোনা কৌশলের মতো গল্পবর্ণনা পরান সিনেমা চিত্রনাট্যের গঠনকাঠামোর মীড়-মূর্ছনায় দর্শককে আবিষ্ট করে রাখে। কিছু অপ্রচলন দৃশ্যের চিত্রকলার মতো বর্ণনচ্ছটায় কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া সিনেমা। জলবতী নদী যেন যৌবনের ইশারা দেয়। মেঘ সমুদ্রে কুড়া পক্ষী যেন বীণার ঝংকার তুলে পৃথিবীজননীর  সন্তানদের স্বপ্ন দেখায়। হাওর অঞ্চলের মানুষের জিজ্ঞাসার দুরস্থ-বিষয়ক সিনেমা। কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া নতুনই বটে।

নদী যেন বাঁধা পড়ে নিজের টেনে আনা বালির বাঁধে। তেমনি গল্পের সুড়ঙ্গ ভিজুয়ালের মন্ত্রচুম্বকে টেনে রাখে। শিল্পীর কল্পনায় নাকি শিল্পের অবয়বে আগুন হয়ে জ্বলে। তেমনি আবেদনধর্মী আর এক রূপকধর্মী সিনেমা হাওয়া একটি আগুনজ¦লা গল্পের সিনেমা। সমুদ্র-জাহাজের গল্প দর্শক পূর্বেও দেখেছে গাংচিল, অভিযান নামের সিনেমায়। কিন্তু হাওয়া সিনেমা সমুদ্রযাত্রার গল্প হলেও নতুন কেন? বিশে^র কোনো এক দুস্থ গণতন্ত্রের দেশে জেলেদের মাছ শিকারে সমুদ্রযাত্রা। স্বৈরাচার চাঁনমাঝির একনায়কত্ব, সংকেতরূপে যেন স্বৈরাচারী রাজার মতো। প্রতিটি দৃশ্যকাব্য ইমেজ ধ্বনিতে মুখরিত। মানবিক জাগতিক সমস্যার মোকাবিলা, প্রতিহিংসা-সহিংসতার মধ্যে স্বৈরাচার নিধনের এক রূপকধর্মী সিনেমার গল্প হাওয়া। রাজনীতি, সমাজনীতি জুড়ে দিয়ে গল্প বলার চেষ্টায় দহন, খাঁচার ভিতর অচিন পাখির মতো হাওয়া এক ধরনের প্রতিবাদের উত্তাপ ছড়ানো সিনেমা। যেখানে বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের ৭০ বছরেও একটি পূর্ণ সিনেমা দর্শক উপহার পেল না, সেখানে ভাষার ওপর ধর্মের শামিয়ানা চাপিয়ে দেওয়া ফাগুন হাওয়া সিনেমা ভাষা-আন্দোলনের অর্থবোধকতা তুলে ধরে।

বিষমজাতীয় উপাদানের গল্পের দার্শনিক ধারণা হলো, রক্তপাত, সন্ত্রাসবাদ, স্বাধিকার ও গণতন্ত্র খর্বের ইতিহাস ভুলে যেতে নাই; যাওয়া মানে সমাজ-রাষ্ট্রজীবনে একই রকমের ঘটনা বারবার ঘটা। বর্বরতা সর্বস্বান্ত স্মৃতির এক ধরনের সারণি থাকে, যার ভিতমূলেই নতুন কিছু গড়ে ওঠে। নতুন কিছু গড়ে উঠতে সময় দিতে হয়। যে-সময় ধরে সিনেমা ও নাটকের জন্য সাহিত্য রচিত হবে। সমাজ থেকে  সিনেমা-নাটকের  স্বীকৃতি আসবে । সিনেমা-নাটক ক্যাজুয়াল আর্ট নামের অপবাদ থেকে মুক্তি পাবে। দর্শকও সিনেমা-নাটকের দর্শনগত অর্থানুসন্ধানে যুক্তিমুখিন হবে। সংস্কৃতিপাঠের অভিজ্ঞতায় দর্শকও তৈরি হবেন উচ্চমার্গীয় চেতনধারণায়। নির্মাতারাও দর্শকদের দমিত রাখার চেষ্টায় ব্যর্থ হবেন। পুনরাবৃত্তিমূলক ক্লিশে দশা  থেকে  মুক্তি পাবে নাটক ও সিনেমা। জনসংস্কৃতির লেভেল মার্কা সিনেমা-নাটকে তুরীয়ভাবে উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি ধারণার স্বীকৃতির সুযোগ ঘটবে। তখন দর্শকই বলবেন, আমাদের নাটক, আমাদের সিনেমা নতুন – ততটাই নতুন, যতটা প্রয়োজন।

[‘কালি ও কলম সাহিত্য সম্মেলন ২০২৪’-এ পঠিত। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।]