নগেনের অন্তর্ধান

নগেন নিঃশব্দ। স্থির ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই অবস্থায় যে কেউ ওকে দেখলে ধন্দে পড়ে যাবে। মনে হবে কে যেন ওকে এমন করেই স্ট্যাচু বানিয়ে দিয়েছে। নৌকাটি অনড়। কোনো জাদুমন্ত্রে স্থির হয়ে আছে। হাওয়া এসে থমকে গেছে যেন! শুক্লা তিথির চাঁদটা কেমন ম্যাড়মেড়ে আলো ছড়াচ্ছে। সমস্ত চরাচরে আর কেউ নেই। হাতে জাল নিয়ে নগেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নগেনকে দেখে একটা স্থির ছবির মতোই মনে হয়। ঝুপ করে একটা শব্দ হলো। জালটা উড়ে গিয়ে পড়ল। রাতের হালদাকে রুপালি ফিতার মতো মনে হচ্ছে। কিন্তু কর্ণফুলীর কাছে এসে এর মিলনস্থলটুকু কেমন প্রশস্ত হয়ে গেছে। সেই জায়গায় নগেনের হাতে আস্তে আস্তে জালটা উঠে আসছে।

জালে কোনো মাছ নেই। আবারো জাল ফেলল নগেন। এভাবে জাল ফেলতে থাকে নগেন। মাছের দেখা নেই। অনেক সময় পার হওয়ার পর একটি মাছ উঠে আসে। মাছটিকে তার কেমন কেমন মনে হয়।

কী মাছ?

কাছে এনে দেখল। বোয়াল মাছ। নগেন মাছটিকে উল্টেপাল্টে দেখে। খুব বড় নয় মাছটি, তবে মাছটির সারা গায়ে এক ধরনের জেল্লা আছে। বড় অদ্ভুতুড়ে মনে হয় মাছটিকে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মাছ ধরছে সে। আর এই মাছ ধরতে এসেই তার বাপ জগাই বুড়ো মরেছে। জগাই বুড়োর মৃত্যুর জন্য বজ্রপাত দায়ী। কারণ শরীরটা একেবারে পুড়ে গিয়েছিল। বাপটার শোকে মা’টা তার হেঁচকি উঠে মরে গেল। এই নগেনের কথা যেন মনেই পড়ল না। দিদিরা কেউ তার খবরও নিল না। আর খবরও কি নেবে! দিদিরাই আছে বহু কষ্টে। ছেলেপুলে নিয়ে দিন আনে দিন খায়। এই দুঃখী ভাইটার খবর নিতে গেলে যদি তাদের এক মুঠো খাবারও কমে যায়, তাহলে সে-ভারও তাদের সইবে না। তাই সম্পর্কের সুতোটা মনে হয় কেটেই গেল। দিদিদের খোঁজখবর সে জানে না। এভাবেই বাকি জীবনটা মনে হয় ফুট্টুস করে কেটে যাবে।

কাটছিল একা একাই। পাড়ার সবাই বলল, একটা বিয়ে-থা কর। ঘর-সংসার না করলে, কিসের আর পুরুষ মানুষ! তো মেয়ে দেবে কে?

সবাই খোঁজ করতে করতে কন্যাদায়গ্রস্ত এক পিতার সন্ধানও বের করল। রামাইয়ার কানা-কালা মেয়েটির কথা বলল। পড়শীদের কথা মেনে নিয়ে নগেন সুবাসিকে ঘরে তুলে আনল। একগাছি নৌকাটি নগেনের নিজের। বিয়ের সময় যৌতুক পেয়েছিল। তার শ্বশুর রামাইয়া কানা মেয়েকে গছাতে তাকে এই একগাছি নৌকাটি দিয়ে বলেছিল, ‘নগেন আঁর মাইয়্যাপুয়ারে চাই রাখিস। ইতিরে কষ্ট ন দিছ। আঁর উগ্গা মাইয়্যা। কোয়ালের ফেরে আন্দা হইয়ে, ক্যান গইত্তাম! এই নৌকা আন দি তুই খালত মাছ চাইছ, মাজে মিহালে বর্ষাকাইল্যা কামত দিব।’

‘অ একখান নৌকা থাইলে বঅর সুবিধা অবাজি। আঁই তোঁয়ার মাইয়ারে চাই রাইখ্যুম, কোনো অসুবিধা হইতো নো। আঁত্তে কোনো লোব-লালচ নাই। তুঁই একখান কামর কাম কইল্যা অবাজি, আঁরে একখান নৌকা দিয়।

আঁই বঅর খুশি হই।’

নগেনের সেদিন বেশ গদগদ ভাব ছিল গলায়। শ্বশুরকে পারলে সে মাথায় নিয়ে নাচে। এরপর নৌকাখানি নগেনের সঙ্গী হয়ে রইল। গত বর্ষায় রাঙা মাঝি মারা গেলে খেয়া পারাপারের দায়িত্বটা তারই কাঁধে এসে পড়ল। খেয়া পারাপারের জ্বালা অনেক। এ ডাকে তো, সে ডাকে। দু-দণ্ড জিরাতে পারে না। সারাক্ষণ একটা দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। তার ওপরে আশানুরূপ পয়সা জোটে না। সবাই শুধু বাইক্কা রাখে। ধান দেবে এই দেবে সেই দেবে বলে ঘাটের পয়সা মেরে খায়। তাই নগেন ছেড়ে দিলো ঘাটমাঝির কাজটা। এখন অনেক সুবিধা। ইচ্ছেমতো কাজ পাওয়া যায়। কোনো বাড়তি চিন্তা নেই। খেলে খেল, না খেলে নাই। বউটার তেমন খাওয়ার নেশা  নেই। তবে মুখের ধার তার অতি তীক্ষ্ণ!

বিয়েতে যৌতুক পাওয়া নৌকাটি অনেক কাজ দেয় নগেনের। ভাড়ায়ও যায় মাঝে-মধ্যে। এটা-সেটা তরিতরকারি নিয়ে যায়। আবার খালকূলে যাদের বাড়ি আছে, তারা অনেক কিছু শহরে নিতে-আনতে নগেনের নৌকা ব্যবহার করে। এই আনা-নেওয়া করে বেশ ভালোই ইনকাম আসে নগেনের। নগেনের শ্বশুর ভালোই ধারণা করেছিল, এই একগাছি নৌকা দিয়ে নগেনের উপকার হবে। আর নগনের উপকার হওয়া মানে তার কানি মেয়েটার উপকার হওয়া। কিন্তু বিয়ের পর থেকে পাড়া-প্রতিবেশীর কথার ঠেলায় নগেনের আর ভালো ঠেকছে না। এতদিন হয়ে গেল তার কানি বউটার কোনো ছেলেপুলে হলো না। এ-কথা ভেবে প্রায়ই নগেনের মন খারাপ হলেও সে বউকে উদ্দেশ করে কখনো গালমন্দ করেনি। একটা কানা মানুষকে মানসিক যাতনা দিতে তার কোথায় যেন বেধেছে। বিশেষ করে সে এই গুণটা রপ্ত করেছে কিছু পড়াশোনা করে। কারণ নগেনের গুণের মধ্যে একটা গুণ হলো, সে গান বাঁধতে পারে। সে প্রায়ই কাগজ পেলে একটা পেনসিল দিয়ে কিছু কথা লেখার চেষ্টা করে, আবার তাতে সুরও দেওয়ার চেষ্টা করে আর সুর দেওয়ার সময় তার কানি বউটা কেমন কান খাড়া করে রাখে। কিন্তু সে কখনো গানের মাঝখানে একটুও উচ্চবাচ্য করে না। এতে মনে হতে পারে, ঈশ্বর যেন কানিকে নগেনের জীবনে ইচ্ছে করেই জুটিয়ে দিয়েছেন। তবে নগেনের জীবনেও কানি বউটা বেমালুম গায়েব হয়ে যেত সেদিন, যেদিন দুপুরবেলা কানি একা একা দুটো চাল ফুটোতে গিয়ে নিজের কাপড়েই আগুন ধরিয়ে বসেছিল। ভাগ্যের কী লীলাখেলা, ঠিক ওই সময়ে নগেন এসে উপস্থিত হয়েছিল। কোনো রকমে হাঁড়ির জল ফেলে কাপড়ের আগুন নেভালো সে। কানির মনের আগুন নেভাতে পারেনি নগেন। সেই থেকে এখন একটা ভয় কানির ভেতরে জমাট বেঁধেছে – যে-কোনো সময় সে আগুনে পুড়ে মরে যাবে, সেদিন আর নগেন কাছে থাকবে না কানিকে বাঁচাতে। কথার কথা দিয়েও কানিকে সান্ত¦না দিতে পারেনি নগেন। কতভাবে আশ্বস্ত করতে চেয়েছে সে কানিকে যে, ও-রকম কিছুই ঘটবে না। তারপরেও কেন জানি কানির এই আশঙ্কা কিছুতেই কাটেনি। এখন রাতবিরাতে যখনই নগেন বাড়ি ফেরে তখন মনের ভেতর শঙ্কার কালোবিড়াল লাফিয়ে পড়ে, যেন   এই বুঝি বাড়িতে এসে কোনো অঘটনের খবর পেল!

নগেনের এতসব বাছ-বিচার করা সম্ভব হয়নি। বউ আন্ধা, খোঁড়া যাই হোক না কেন, তার আফসোস নেই। জীবনে একটা নৌকার মালিক হতে পারবে – এটা কখনো কল্পনায় ছিল না। ছোটবেলা থেকেই একটা নৌকার স্বপ্ন তাকে বিভোর করে রেখেছিল। বাপ ছিল জনমের হাভাতে। সংসারে কোনো আয়-উন্নতি ছিল না। তার অল্প বয়সেই বাপটা মরে গেল। অবশ্য লোকে বলে চোলাই গিলে গিলে লিভার পচে গেছে। প্রায়ই পাহাড় থেকে আনা চোলাই গিলত। মাও কেমন জানি হয়ে গেল। দুই বোন ছিল, বিয়ে হয়ে গেছে। সবাই ভেবেছিল, আর বুঝি কোনো সন্তান হবে না। কিন্তু বহুদিন পর একজনই ছেলে সন্তান তার বাপের এ-পাড়ার বদনাম ঘুচিয়ে দিলো। কিন্তু বাপটা বেশিদিন বাঁচল না। নগেনের পিতা জগাই বুড়োর রাত-বিরেতে মাছ ধরার নেশা ছিল। আশ্বিনের শুরুতে সেবার খুব ঝড়-বাদল ছিল। রাতে জগাই বুড়ো গেল মাছ ধরতে। খুব বাজ পড়ছিল। আরো কয়েকজন ছিল জগাই বুড়োর সঙ্গে। সবাই দেখল আকাশে একটা বিদ্যুৎরেখা এ-মাথা থেকে ও-মাথা চিড়ে দিয়ে গেল। এত বড় পৃথিবীতে এক ঝলকানি দিয়ে আলোকিত করে নিষ্ঠুর হয়ে নেমে এলো জগাই বুড়োর ওপর। সবাই তাকিয়ে দেখল জগাই বুড়ো পুড়ে গেল। বিধাতার কী কঠিন বিচার! পুড়ে মরে গেল জগাই বুড়ো। তার শূন্যতায় পরিবার শূন্য হলেও একেবারে ফুরিয়ে গেল না নগেন আর তার মা। কিন্তু কে জানত নগেনের সঙ্গে নগেনের মারও বেশিদিন থাকা হবে না। তবে মায়ের পাট চুকেছে আরো কিছুদিন পর।

নৌকায় নিজেকে মধ্যরাতের অসহায় মাঝি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না নগেন। ম্লান জোছনায় নদীর এ-পারে, ও-পারে ছায়া ছায়া অন্ধকার। তাকালে অস্পষ্ট ছবির মতো মনে হয়। চরাচরে মানুষ বলতে তাকেই একমাত্র হিসেবে ধরে নগেন কত কিছু যেন ভাবে। মনে হয়, তার এই চরাচরে আর কোনো জনমানব নেই। বাড়ির ঘাট সে চিনতে পারে না। এই নদীতে, মনে হয়, কোনো বাড়ির ঘাট নেই। এমন তো কোনো দিন হয় না। আজ তবে তার কি হলো! কোনো কিছু পেয়ে বসল না তো তাকে! নাকি মধ্যরাতের এই বোয়াল মাছটাই তার সঙ্গে এমন তামাশা শুরু করেছে! বোয়াল মাছটা মাছ তো! কেমন একটা সংশয় জাগে নগেনের। মাছ নিয়ে অনেক রটনা তার জানা আছে। মাছের জন্য কত জনের জীবন গেছে। আর রাতবিরেতে এখন মাছটা তো কিছুটা ভয়ের কারণ হতেই পারে! যাই হবে হোক, কপালে যাই থাকে থাকুক, বোয়াল সে খাবেই। একটা ক্ষিদে সারা শরীরে তার হা করে আছে। একটা থালায় গরম ভাতের ছবি তার চোখের তারায় ভাসতে থাকে। এই জন্যই কি সে বাড়ির ঘাট খুঁজে পাচ্ছে না? হাতের বৈঠা চরকির মতো ঘুরতে থাকে। নৌকার মাথা বিদ্যুতের মতো ঘুরতে থাকে। সবটাই যেন অচেনা। অচেনা পারের একটা নদীতে আজ যেন সে ভবঘুরে যাত্রী। এই পৃথিবীর কোথাও কোনো ঘাট নেই। আর কোনো জন নেই। একটা ভয় ঘিরে ধরে নগেনকে। আজ তার কি হলো? বাড়ির ঘাট কি ফিরে পাবে না? কত সময় হলো? রাত আর কতটুকু বাকি আছে? মাছটার অবস্থান দেখে নিল সে। বোয়াল মাছটা চকচক করছে। ক্ষিদেটা আরো দাউ দাউ করে পেটের নাড়িভুঁড়ি পেঁচিয়ে নিয়েছে। নৌকাটা থির ধরা পানিতে দাঁড় করিয়ে বৈঠাটা হাতে নিয়ে গলুইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে নগেন বিড়বিড় করে কিছু একটা আউড়াল। বারকয়েক হাতজোড় করে অদৃশ্য ঈশ্বরের কাছে নতজানু হয়ে কাকুতি-মিনতি জানাল। মনে মনে কিসব মন্ত্রতন্ত্র পড়তে শুরু করল। এবার কূলের আশায় সে একদিকে জোরে জোরে বৈঠা চালাতে লাগল। চাঁদের আলোর জাল পেরিয়ে নগেনের নৌকা বুঝি এবার পথ খুঁজে পেল। ওই তো দেখা যাচ্ছে বাঁশের ঝাড়। ওই বাঁশের ঝাড় দেখেই তো কত রাতে নৌকা ভিড়িয়েছে। আজো জোরে জোরে ওই লক্ষ্যে নৌকা চালাল। মনে হলো, সে পৌঁছে গেছে। নৌকা কূলে ভিড়িয়ে একটা শেওড়াগাছের গোড়ায় বেঁধে নেমে এলো নগেন।

বোয়াল মাছের কথা ভেবে আর একটু গরম ভাতের ছবি ভেবে নগেনের মনটা খুব উচাটন হয়ে ওঠে। এতক্ষণ সুবাসি যেন ঘুমের দেশে কাদা হয়ে গেছে। ওকে ডাকলে কি বিতিকিচ্ছিরি একটা কাণ্ডের সৃষ্টি হবে সেটা ভেবেই নগেনের অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। পরিবেশটা সে কল্পনা করতে চাইল। তার আগে নৌকাটা বেঁধে নিল। তারপর বোয়াল মাছটা হাতে নিতেই যে রণমূর্তিটা চোখের সামনে ভেসে উঠল, সে আর কেউ নয়, তার স্ত্রী সুবাসি। মাঝে মধ্যে নগেন সুবাসিকে যখন বাঁশি বলে ডাকে তখন, বউ খেঁকিয়ে উঠে বলে, ‘ননাইয়া ডাক ইন নঅ ডাকো! ইউনদি পেট ভইরতো নো! মাইনষুরে দেইক্যু না ক্যান গরি টিয়া পইসা গরের।’

সেই কথা ভেবে নগেনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। হাতের মাছটা যেন একটু নড়েচড়ে ওঠে। নগেন অবাক হয় নৌকায় থাকতেই তো এই মাছের দম চলে গিয়েছিল। তাহলে এখন এটার কি হলো? কিন্তু তারপরেও কেন হাতের মাছটি এমন ঝাঁকি দিয়ে উঠল! সে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। রাত অনেক হয়েছে। এত রাতে এমন উল্টাপাল্টা কিছু হলে মনে ভয় আসতে পারে। তারচেয়ে এখন মাছটাকে কুটে-ধুয়ে একটু লবণ-মরিচ দিয়ে রান্না করা যাক। নগেন তারপর খেয়ে শুয়ে পড়বে। সকালে উঠে সুবাসিকে সে বোয়াল মাছের কথা বলবে। তখন সুবাসি চোখ কপালে তুলবে। বলবে, তাকে কেন রাতের বেলা ডাকা হয়নি। তখন সুবাসিকে বলবে, ঘুম ভাঙালে তো সুবাসির মাথা ঠিক থাকে না। মেজাজ যায় চড়ে, তাই সে ঘুম থেকে জাগায়নি। সুবাসি নিশ্চয়ই তখন ব্যাপারটা বুঝবে। আর বুঝতে পেরে সে চুপচাপ মেনে নেবে, না হয় রেগে যাবে। সুবাসি রেগে গেলে কী করবে নগেন?

না সে পরে ভেবে দেখা যাবে। এখন মৎস্যভক্ষণ ত্বরান্বিত হোক। ঘরের দিকে এগিয়ে গেল নগেন। ঘর বলতে দোচালার ওপর খড়। নড়বড়ে খুঁটির ওপর যেন কোন জাদুবলে দাঁড়িয়ে আছে ঘরটি। হাওয়া দিলে উড়ে যাবে। কিন্তু যাবে যাবে করে যায় না। এত জোর কোত্থেকে আসে, তা কারো জানা নেই। নগেনের ভাষ্য, ভগবান ইচ্ছা কইল্লে কত কিছু গড়িত পারে, নমুনা দেখারদ্দে নো না!

বাঁশের বেড়ার শক্তি ঘুণপোকা আর অবশিষ্ট রাখেনি। তাই অনায়াসে ফুটো হয়েছে সহস্রখানেক। সেই ফুটোতে হাওয়ার উদ্দাম চলাচল বেশ হয়। ছোট্ট যে উঠোনটা রয়েছে তার মাটিতেও নেই কোনো উজ্জ¦লতা। সেখানে একটা কালো আবরণ নগেনের গায়ের রঙের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। নগেন সেদিন গঙ্গারামকে এ-কথা বলছিল যে, এই উঠোনের মাটি দিয়েই মনে হয় তাকে তৈরি করা হয়েছে। তাই এর রং আর তার শরীরের রঙের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। সব শুনে গঙ্গারাম একটা কাষ্ঠহাসি হেসে বলেছিল, ও ডা তুই বেশি জানচ ফাল্লার! ভগবান আইয়েরে তরে কই গিয়ে না?

দুই

কয়েক টুকরো মাছ। তাতে নুন মাখিয়ে নগেন তাকিয়ে থাকল। ছোট ডিব্বাগুলি খুঁজে হলুদ-মরিচ বের করল। হঠাৎ মনে হলো এতে দুয়েকটা খাট্টাবেগুন দিতে পারলে খুব জমতো! আশপাশে খুঁজলো। না, কোথাও খাট্টাবেগুন দেখতে পেল না। উপায়! উপায় তো একটা বের করতেই হবে। পাশের বাড়ির ক্ষেত থেকেই রাতে দুটো খাট্টাবেগুন ছিঁড়ে আনলে কেউ দেখবে না। ঝাপটা টেনে নগেন বেরিয়ে আসে। উপায় তো বের হলো। এখন ক্ষেতে বেগুন থাকলেই হয়। অন্ধকারেও চিনতে পারল নগেন। সবকিছু কেন জানি না চাইতেই পেয়ে যাচ্ছে। কোথাও যেন একটা গভীর যোগাযোগ রয়েছে। লাল লাল খাট্টাবেগুনগুলি কেটে টুকরো টুকরো করল। মাছের ওপর ছড়িয়ে দিতেই কেমন ভালো লাগল। মরিচের গুঁড়ো কম হয়েছে মনে করে আরেকটু দিলো। এবার মনে হলো যথাযথ হয়েছে। এবার উনুনে আগুন দেওয়ার পালা। কিন্তু মাছের মধ্যে কোনো তেল দেওয়া হয়নি। সে তেল খুঁজতে লাগল। পাওয়া গেল তেলের শিশি। উপুড় করে যা ছিল তা দিয়ে দিলো। তেল দিয়ে মাখিয়ে মাছটাকে উনুনে বসিয়ে এবার আগুন দেওয়ার পালা। উনুনে সহজে আগুন দিতে হলে চাল থেকে ছন টানতে হবে। কী হবে ভেবে পেছন দিকে গিয়ে এক মুঠো ছন টেনে আনল। এবার  ম্যাচের কাঠি ঘষে আগুন ধরিয়ে চুলোয় দিলো। একটু জোরে আগুনটা ধরে তারপর কমে গেল। কিন্তু কয়েকটা শুকনো বাঁশের ফালি ততক্ষণে নিজেদের গায়ে আগুন লাগিয়ে নিয়েছে। আগুন জ্বলছে। মাছের একটা গন্ধ বের হচ্ছে। পাশেই ভাতের হাঁড়ি। সন্ধ্যারাতে দুটো খেয়েছিল নগেন। এখন এ-হাঁড়িতে আর অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। তারপরেও আশা নিয়ে নগেন হাঁড়ির মুখটা উল্টে দেখল। মনটা খুশিতে নেচে উঠল। দু-মুঠো ভাত এখনো হাঁড়িতে অবশিষ্ট আছে। ইশ্ পেটটা মোচড় দিয়ে উঠছে। ইচ্ছে করছে এখনই কড়াইসুদ্ধ তরকারি হাঁড়িতে ঢেলে মাখিয়ে গপাগপ সাবাড় করে দেয়। কিন্তু আরেকটু ধৈর্য ধরতে হবে বলে নিজের কাছেই বিরক্ত লাগছে নগেনের। হাঁড়ি থেকে বাসি ভাতগুলি বাসনে নিল। হাঁড়িতে একটা ভাতও যেন পড়ে না থাকে সেটা নগেন বারবার করে নিশ্চিত হয়ে নিল। যেন তার এই অভাবের দিনে একটা ভাতও নষ্ট করা যাবে না। তরকারির ঝোলটা যখন কমে এলো তখন কড়াইটা নামিয়ে সরাসরি বাসনের ওপর উপুড় করে ঢেলে দিলো নগেন। কয়েক টুকরো মাছ আর ভাত আর ঝোল মিলিয়ে একটা তৃপ্তির খাবার সে চেটেপুটে খেল। এরপর চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম তার নামতে লাগল। সবকিছু ফেলে রেখে বিছনায় গড়াগড়ি খাওয়ার লোভ যখন অতিমাত্রায় তীব্র হয়ে উঠল তখন সে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আর কোনো কাজ করতে পারল না। হামাগুড়ি দিয়ে মেঝেতে শুয়ে থাকা সুবাসির শরীর ঘেঁষে শুশুক মাছের মতো পড়ে থাকল। মুহূর্তেই নেমে এলো রাজ্যের ঘুম। আর ঘুমের ঘোরের মধ্যে বোয়াল মাছের নির্যাতন শুরু হয়ে গেল। সে-নির্যাতন নগেনের মনের আবেগ কেড়ে নিলেও তার ঘুম ভাঙার নয়!

তিন

স্বপ্নের ঘোরে বোয়াল মাছের নির্যাতনের রেশ কাটতে না কাটতেই জাগরণের প্রথম ধাক্কাটা এসে লাগল। উঠানে কিছু লোকের হট্টগোল পাওয়া গেল। ঘুমের ঘোরে প্রথম নগেন বোঝেনি ব্যাপারটা। মনে করেছে হয়তো সুবাসির সঙ্গে পাশের বাড়ির কারো ঝগড়া লেগেছে। তারই শব্দ তার কানে আসছে। কিন্তু অবিরাম তার নাম ধরে যখন কেউ ডেকে যাচ্ছে, তখন সে চোখ খুলেও বুঝতে পারল না, সে কোথায় আছে। মনে হলো, অনেক দূর থেকে শব্দ ভেসে আসছে। আস্তে আস্তে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে এলো। বুঝতে পারল যে তার নিজের ঘরেই ঘুমাচ্ছিল সে। বোয়াল মাছের কথাটা মনে হতেই তৃপ্তির পরিবর্তে আতঙ্ক পেয়ে বসল তাকে। তার মানে সুবাসি সব জেনে গেছে এতক্ষণে। তাই বুঝি লোকজন নিয়ে হট্টগোল শুরু করে দিয়েছে! ঘরের ভেতর সব ফাঁকা। কী যেন নেই, কী যেন নেই নেই করছে ভেতরটা। ধরতে পারল না নগেন। সুবাসি নেই। তার মানে বাইরেই আছে সে। নগেন বের হয়ে এলো। ওমা একি দেখছে সে! খুঁড়ো গঙ্গারাম দলবল নিয়ে দোড়গোড়ায় কালনাগের মতো ফুঁসছে।

কিরে ওয়্যা, হেয়েন গরি ফুঁসর ক্যা? কিরিবা, মারিবা নাকি!

ও-ডো বেতরবিয়াত্যাই নঅ গরিছ। চোয়ার মাইজ্জুমদে গাল ফাডাই ফেলাইয়্যুম। বউ উগ্গা ধাই গিয়েদে খবর রাখছ না?

কার বউ, কনে খবর রার!

ও-ডো বিড়বিড় গরি কী কার?

কি কয়্যুম, তোঁঞারা কার বউ ধাই গেইয়্যে কইতা লাইগ্যদে…।

ও-ডো জগাইয়ার পোয়া পঅলনি কোনো? তোর বউঅর কথা কইদ্দে অ্যারি!

এতক্ষণে নগেনের মাথা খুলল মনে হয়! সবাই মিলে তাকে তার বউয়ের কথা বলছে কি! সুবাসি কী করেছে? সে ভেবেছিল, সুবাসি কারো সঙ্গে ঝগড়াঝাটি লাগিয়েছে। কিন্তু সুবাসি কীভাবে পালিয়ে যাবে – এটা তো তার মাথায় আসছে না। কানাবউ পথ চিনে না, ঘাট চিনে না – এই মানুষটাই নাকি তার ঘর থেকে পালিয়েছে! ঘরের অপ্রশস্ত দাওয়ায় কোনোরকমে বসে নগেন নিজেকে সামলাল। এটা কী হলো? সবকিছুই কি ওই মাছের কারণে। আসলে রাতের মাছটাই অলক্ষুণে ছিল। তার মনে সারাক্ষণ একটা কু ডাকছিল। না জানি আরো কী আছে কোয়ালত। হা ঠাকুর, তুমি সব জানো, বলে নগেন একটা হাত আকাশের দিকে তুলে ধরল।

এবার পাড়া-প্রতিবেশী গঙ্গারাম খুড়োর নেতৃত্বে নগেনকে ইচ্ছেমতো বকাবকি করে বিদায় নিল। নগেন ঠাডা-পড়া লোকের মতো অনড় বসে রইল। নগেনের পেছনে বহুদিন এই গঙ্গারাম খুড়ো লেগে আছে। ভিটেটুকু না গিললে তার পিণ্ডি জুড়াচ্ছে না। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নগেনকে সে তাড়াতে চায়। এই ভিটেটুকু কী যে মূল্যবান ওই খুড়োর কাছে, তা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।

কিছুদিন পর একদিন সকালে নগেনের নৌকাটি হাওয়া হয়ে গেল। কি যে আজগুবি কাণ্ড ঘটতে শুরু করল, নগেন এর ব্যাখ্যা দিতে পারল না। কেউ কেউ নৌকা নিয়ে রূপকথার কাহিনি বানিয়ে ছাড়ল। জগাই বলল, তোর নৌকা ইবা মাঝি ছাড়া হাওয়ার টানে যারগই দেখিলাম। কডে গেইয়ে গই কইন্নো পাইল্লাম।

আড়ালে দাঁড়িয়ে গঙ্গারাম খুড়ো শয়তানি হাসি হাসল।

নৌকার শোকে নগেন নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেল। কাছে গেলে বোটকা গন্ধে টেকা দায়। এখানে-সেখানে নৌকা খুঁজে বেড়ায়। সকালে গেলে রাতে ফেরে। আবার কয়েকদিন পর দেখা গেল, নগেন আর ঘরেই ফিরছে না। এভাবে নগেন আসা-যাওয়া করছিল। তারপর অনেকদিন নগেন আর এলো না।

নগেনের ভিটার দখল নিয়েছে গঙ্গারাম খুড়ো। চালাটা মজবুত করে বেঁধে দিয়েছে। চারপাশের আগাছা পরিষ্কার করে দিয়েছে। একদিন সবাই নগেনের কথা ভুলে গেল। নগেন আর ফিরে এলো না। অবশ্য কেউ কেউ বলে, গভীর রাতে নগেনকে তারা নৌকা নিয়ে আসতে দেখেছে। নগেনের হাতে একটা মাছ। তবে সেটা কি মাছ কেউ ঠাহর করতে পারেনি। ঠাহর করলে তারা বুঝতে পারত। তবে সকলের ধারণা, সেটা বোয়াল মাছই হবে। গঙ্গারাম খুড়ো লোকের এসব কথা কানে তুলল না। তার ধারণা, নগেন মারা গেছে। সে আর ফিরে আসবে না।