ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ কিংবা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

দৃশ্যকলার ব্যবহারিক অবস্থান সম্পর্কে নানা প্রশ্ন ও চিন্তা স্বয়ং শিল্পী ও সমালোচকদের মধ্যে বিদ্যমান। এখনো শিল্পকলা নিয়ে নানা মুনির নানা মত ও পথ আছে। নিজেদের মতো করে নানাবিধ মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে শিল্পীরা কাজ করে যান। আলোড়িত দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে সূত্র হয়ে ওঠে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।  

উপরিউক্ত অনুচ্ছেদের চমকপ্রদ উপস্থাপন  আমরা দেখতে পাই বেঙ্গল আর্টস প্রোগ্রাম-আয়োজিত মাহবুবুর রহমানের বৃহদায়তন একক  প্রদর্শনী ‘কোয়ারেন্টাইন’-এ, যেখানে প্রদর্শনীর ধারণার রূপরেখা গবেষণাসমৃদ্ধ ও সুপরিকল্পিত। অত্যন্ত শ্রমসাধ্য, সূক্ষ্ম ভাস্কর্য ও স্থাপনার পাশাপাশি দেখি সিল্কের গায়ে একগুচ্ছ স্ক্রল পেইন্টিংয়ের আদলে ব্রিটেনের নারী ভোটাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসের পুনর্বয়ান; বিশালাকার ট্যাপেস্ট্রিতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন ও ভারতের কৃষকদের করোনাকালীন খাদ্য আন্দোলনের সুতীব্র প্রতিচ্ছবি। ‘ব্ল্যাক-৪৭’ শিরোনামে একটি চকচকে সিরামিকের আলুভর্তি থলের সূত্রে সমান্তরাল টানেন ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই কুখ্যাত আইরিশ পটেটো ফ্যামিনের। পাশেই দেয়ালে আইরিশ কবি ইভান বোলানদের কোয়ারেন্টাইন কবিতার কিছু পঙ্ক্তি :

In the morning they were both found dead.

Of cold. Of hunger. Of the toxins of a whole

                                                            history.

But her feet were held against his breastbone.

The last heat of his flesh was his last gift to her.

পৃথিবীর অগ্রগতির ইতিহাসের পরতে পরতে আছে যুদ্ধের নির্মমতা। শীতে, ক্ষুধার তীব্রতায় তো যুগে যুগে এভাবেই হারিয়ে যাওয়া মানুষের ইতিহাস। এই কবিতা শিল্পীকে আবেগতাড়িত করেছে, ১৮৪৫-৪৭ সালের সেই ঘটনা আর  সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আক্রমণের ফলে যে মানবিক বিপর্যয়ের খবর গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, তার সঙ্গে এই প্রদর্শনীর প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রদর্শনীর নাম এই কবিতার নাম থেকে অনুপ্রাণিত হলেও ২০১৯-২২-এর কোভিড-১৯ মহামারির সময় প্রদর্শিত শিল্পকর্ম নির্মাণের গর্ভকাল বলা যায়। 

করোনাকালীন গৃহবন্দিত্বদশায় তথা কোয়ারেন্টাইনপ্রসূত ভাবনাচিন্তা, পঠনপাঠন, গবেষণা এবং স্বতোৎসারিত শিল্পসৃষ্টির অভিজ্ঞতা ও অভিঘাতের নির্যাস দেখা যায় প্রদর্শনীতে। মাহবুবুর রহমান জীবন, সম্পর্ক, ইতিহাস ও ভূ-রাজনীতির বহুবিচিত্র বিষয় নিয়ে ভেবেছেন, প্রশ্ন করেছেন ও শিল্পী হিসেবে নিজের অবস্থান নিয়ে সতর্ক হয়েছেন। তাই বলা যায়, তিনি কাজ করেছেন ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর আবেগকে নিয়ে, যাতে আছে শিল্পীর মানবিক দায়বদ্ধতার একটি বয়ান। প্রদর্শনীতে অনেকগুলো সিরিজ বা কাজের ক্রমকে আলাদা করেছেন, আবার  একীভূত করেছেন। ‘মাদারহুড’-এ শিল্পী ও তাঁর পরিবারের গল্প উঠে এসেছে, যেখানে পোষা কুকুর গুড্ডু, গুন্ডার সঙ্গে শিল্পীদম্পতির সম্পর্ক, ছোট শিশু প্রস্তরের উপস্থিতি যে পারিবারিক আবহ দিয়েছে, তাকে শিল্পী মাতৃত্ব বলে আখ্যায়িত করেছেন। গ্যালারিতে ঢুকেই সাদা ঘরের দেয়ালে হাতের বাঁয়ে  ফটোএচিং মাধ্যমে করা সিরিজটিতে একটি নিবিড় অন্তরীণ অনুভূতি গচ্ছিত করেছেন শিল্পী।

মাহবুবুর রহমান সবসময় নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করেছেন, দক্ষতা অর্জন করেছেন, কিন্তু নিজেকে কোনো একক স্থানে আবদ্ধ রাখেননি। সবসময় নতুন নতুন মাধ্যমকে শিল্পকর্ম নির্মাণে নিরীক্ষা করেছেন। ফলে তাঁর অতীতের কাজে পারফরম্যান্স, ভিডিও আর্ট, ইনস্টলেশন, কাইনেটিক আর্ট, ফটোগ্রাফি, পেইন্টিং, প্রিন্টমেকিং প্রভৃতি মাধ্যমের দক্ষ ব্যবহার দেখা গেছে। কিন্তু বর্তমান প্রদর্শনী অনেক বেশি পরিশীলিত ও বিশাল। শুধু তাঁর চিন্তার ক্ষেত্র অনেক বেশি আন্তর্জাতিক। ‘টেম্পল অব ডেমোক্রেসি’ – বিশালায়তন গোলাকার ট্যাপেস্ট্রি, যেটি গ্যালারিতে চমকপ্রদভাবে ছাদ থেকে ঝুলছে। এটির নকশা নির্মাণে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করেছেন, সেটিকে বুনিয়েছেন প্রান্তিকের একদল নারীর হাতে। একধরনের মেলবন্ধন, যেখানে মানুষের কর্মদক্ষতা বনাম বিতর্কিত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উপস্থিতির যে-বাস্তবতা, সেটিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছেন। সিলিং ফ্রেস্কোর আদলে ট্যাপেস্ট্রিটিতে যুক্ত করেছেন নানা ছবি। যুক্তরাজ্যের ক্যাপিটাল হিল রাজনৈতিক ক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলেও এটি যেভাবে নানা সময়ে আক্রমণের শিকার হয়েছে, তা মাহবুবুর রহমানকে ভাবিয়েছে। ক্ষমতা ও ক্ষমতার লড়াইয়ের বিচিত্র রূপ রয়েছে সকল দেশে। ইতিহাস তো ক্ষমতাহীনের সঙ্গে ক্ষমতাধরের আপসহীনভাবে টিকে থাকার গল্প।

মধ্য উনিশ শতকে ব্রিটেনে নারীদের ভোটাধিকার নিয়ে আন্দোলনে যে-পরিবারের মেয়েরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ভারতীয় শিখ পরিবারের মেয়ে সোফিয়া দুলদীপ সিং ছিলেন। অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধের পর যাঁর পরিবার ভারত থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। নারীদের ভোটাধিকারের এই আন্দোলন পাশ্চাত্যের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। সিল্কের ওপর কাঁথা সেলাই করে করা ‘হিরোস’ সিরিজটিতে মাহবুব এই ইতিহাস তুলে ধরেছেন। ইতিহাস কীভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানের হয়ে ওঠে, কীভাবে মানুষের ও সময়ের মিথস্ক্রিয়া কাজ করে সূত্রবদ্ধ হয় তা দেখার বিষয়। কারণ, ইতিহাসে দাঁড়িয়ে থাকে  বর্তমান।

‘অপারেশন ম্যাজিক কার্পেট’ সিরিজটিতে আরবদের স্কার্ফ খাফিয়াহ ও ঘরের আদলকে একত্রিত করে যে-ভাস্কর্য স্থাপনা রয়েছে, তা যুদ্ধে গৃহহীন উদ্বাস্তু মানুষ, বিশেষ করে ফিলিস্তিন থেকে যেভাবে সেদেশের মানুষরা বিতাড়িত হয়েছিল সেই ইতিহাস তুলে ধরেছে। আরবদের খাফিয়াহ এখন বন্ধুত্ব, সহমর্মিতার প্রতীক। এভাবে নানা অবজেক্টের (বস্তু) প্রতীকী উপস্থাপনা ঘটেছে। 

‘হোমেজ ট্য দ্যুশাম্প’ ভাস্কর্য স্থাপনায় একটি সাইকেলের চাকাকে খাফিয়াহ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মার্শাল দ্যুশাম্প, যিনি একজন ফরাসি শিল্পী, আধুনিক ধারণাপ্রধান বা কনসেপচুয়াল শিল্প ও তত্ত্ব নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। দ্যুশাম্পের মতের শিল্পী নিজেই নির্ধারণ করেন শিল্পকে। আর মাহবুব সেটিকে দেখেন, দ্যুশাম্পের সাইকেলের সেই চাকাকে আদতে    শিল্পজগৎ দেখতে শিখিয়েছে সিগনিফিকেন্স হিসেবে। অর্থাৎ, শিল্প কী ও কেন? তা নিয়ে ভাবনাটা প্রদর্শনীতে সচেতনভাবেই রেখেছেন শিল্পী মাহবুব।

এছাড়া, বিকিনি আইল্যান্ডকে ঘিরেছেন নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করা বুদ্ধের ক্ষুদ্র মূর্তি দিয়ে। বিকিনি আইল্যান্ড থেকে বিতাড়িত হয়েছিল স্থানীয় অধিবাসীরা। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরীক্ষা করা হয়েছে।

মাহবুবুর রহমানের প্রদর্শনীর একটি লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, তিনি যেসব ইতিহাসকে ‘কোয়ারেন্টাইন’ প্রদর্শনীতে নিয়ে এসেছেন, তা ভিনদেশের ইতিহাস, বেশিরভাগ সাম্রাজ্যবাদী দেশের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। তাহলে আঞ্চলিকতার প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? আদৌ কি আন্তর্জাতিকটা বা কোনো আঞ্চলিকতার প্রেক্ষাপটে শিল্পকে দেখার কোনো প্রয়োজন আছে? বিদেশি ইতিহাস ভিত্তি করে
শিল্প-নির্মাণের প্রক্রিয়ায় তাহলে এদেশের দর্শকের কী ভূমিকা? এখানে দেখা যায়, মাহবুব শিল্প-নির্মাণের মাধ্যম, বিশেষত হাতে বুনন সেলাই-এ  দেশজ কাঁথা সেলাইয়ের পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। গবেষণার একপর্যায়ে মিশ্রণ করেছেন দেশজ সংস্কৃতিকে। নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সমষ্টি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে; সহযোগী ও সহশিল্পী, কারিগর ও কারুশিল্পী সবাইকে নিয়ে হাত লাগিয়েছেন বড় আকারের ও বৃহৎ ভাবনার যৌথশিল্পের উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। প্রদর্শনীর দেয়ালে তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে পুরো প্রদর্শনীকে নানা পরিপ্রেক্ষিতে দেখার সুযোগ রয়েছে বলে প্রদর্শনীটি গুরুত্বপূর্ণ, একঘেয়ে নয়।

‘রিডার’, ‘ড্রপস অব টিয়ারস’, ‘টোপিয়ন’ নামের তিনটি হাতে তৈরি বইয়ের প্রদর্শন রয়েছে। পুরনো ছাপাই বইয়ে হাতে আঁকা তাৎক্ষণিক ড্রইং, রয়েছে এম্ব্রয়ডারি করা বই। গোল্ডলিফ, সিভারলিফের ব্যবহার। বই জনগণের হাতের স্পর্শ পাচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে।

নিজেকে আদ্যোপান্তে দেখেছেন ‘টাইমলাইন’ শীর্ষক শিল্পকর্মে। এর অভ্যন্তরে তাকালে দেখা যায় মাহবুবকে আলোড়িত করে থাকা চারপাশের সবকিছুই তিনি প্রায় তুলে এনেছেন। মাহবুবের শিল্পকর্ম কোনো অর্থেই বিমূর্ত নয়, বরং অনেক বেশি বর্ণনামূলক, স্পষ্ট সংকরায়ণ প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত। বস্তুত, বিশ্বায়নের প্রভাবযুক্ত মিশ্রায়ন।

পুঁজিবাদ ও ভোগবাদকে নানা আঙ্গিকে দেখিয়েছিলেন শিল্পী  ওয়ারহোল। ‘হোমেজ টু ওয়ারহোল’-এ মাহবুব সচেতন হয়েছেন খাদ্য-রাজনীতির বিষয়ে। ওয়ারহোল যেভাবে Campbell’s Soup Can-এ বিজ্ঞাপনের দৌরাত্ম্যে খাদ্য বেচার সুচতুর রাজনীতিকে কটাক্ষ করেছেন, মাহবুব নিজেও সিরামিকে নির্মিত ডাবের ওপর কোকাকোলা লিখে একটি স্টেটমেন্ট দেন, চায়নিজ ভাষার ব্যবহার করেন – এরকম সূক্ষ্মতর ব্যঙ্গবিদ্রূপের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ জানান ক্ষমতার ও লোভের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে। মাহবুবুর রহমানের প্রদর্শনীর গভীরে ঢুকলে দেখা যায়, এখানে একটি বাঁচার সংগ্রাম চলছে। সংস্কৃতি সম্পর্কে পঠন-পাঠন ও গবেষণায় তাই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্যকে পর্যালোচনা করার তাড়না এই প্রদর্শনী দেখলে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বেঙ্গল শিল্পালয়ে কামরুল হাসান প্রদর্শনশালায় ‘কোয়ারেন্টাইন’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩ পর্যন্ত চলেছে।