নব্য উদারনীতিবাদ ও জিরো ক্যালোরি সংস্কৃতি

মাত্রা ডিঙিয়ে খাবার খেয়ে আমরা মুটিয়ে যাই। তবে এ আমাদের না চাইতেই পাওয়া দেহগড়ন। ইথিওপিয়ার বদি জনগোষ্ঠীর পুরুষরা যদিও তাদের সাধনা করে বানানো মোটা পেটকে দেহের সৌন্দর্য মনে করে, মুটিয়ে যাওয়া সমসাময়িক  নগর-সংস্কৃতিতে যেন তা একেবারেই বেমানান। নব্য উদারনীতিবাদের এই গ্লে­াবাল জমানায় ফিট শরীর ও খাদ্য গ্রহণের বেলায় পরিমিতি বোধকে প্রশংসা করা হলেও অন্যান্য ভোগ-বিলাসিতাতে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়; সেখানে যেন মাত্রাজ্ঞানের বালাই নেই। প্রাথমিকভাবে হাল-সংস্কৃতির এই বৈপরীত্যকে  উপজীব্য করে দাগী আর্ট গ্যারেজ ‘জিরো ক্যালোরি’ নামে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। দাগী আর্ট গ্যারেজ ঢাকাকেন্দ্রিক সাতজন শিল্পীর একটি সংগঠন, যেটি ২০১৪ থেকে সমসাময়িক শিল্পভাষা নিয়ে সংগঠিতভাবে চর্চা করে চলেছে। এই প্রদর্শনীতে দাগী-শিল্পীদের জিরো ক্যালোরি ভাবনার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় নানা মাত্রায়।

শিল্পী ধীমান সরকার তাঁর কাজে নব্য আসেরিও সাম্রাজ্যের (৬৬৯-৬৩১ খ্রিষ্টপূর্ব) রাজা আসুরবনিপালের খাট ভেঙে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তের দৃশ্য নির্মাণ করেছেন। ধীমান তাঁর কাজে চৌকি, গামছা, লুঙ্গি, আয়না, বিপ্লবী পোস্টারের ধাঁচে দেয়াললিখন এসব অনুষঙ্গ দিয়ে একটি পরাবাস্তব দৃশ্য-ধারণা তৈরি করেছেন। সৈয়দ তারেক রহমান একটি ভিডিও উপস্থাপন করেছেন। তাঁর উপস্থাপনার বিষয় হলো খাদ্য। বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণীর সঙ্গে এক ফ্রেমে কিন্তু আলাদা প্যানেলে তিনি খাবারের দৃশ্য ধারণ করেন। সাদাকালো ভিডিওটি তিনি একটি অন্ধকার ঘরে উপস্থাপন করেন। মানুষ পৃথিবীতে সমগ্র প্রাণিকুলের খাদ্যশৃঙ্খলের উঁচুতে থেকে পৃথিবী শাসন করছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনন্য হচ্ছে। তারপরও মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য গ্রহণের দৃশ্য কি অভিন্ন এক জৈবসত্তার দিকেই ইঙ্গিত দেয়? এমন প্রশ্ন তারেক তাঁর কাজে তুলে ধরেছেন।

রুপম রায় প্রদর্শনীতে দুটি কাজ দিয়েছেন। ‘আই লাভ অ্যানিম্যাল’ কাজটিতে তিনি গরুর আধা প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও বনেদি আমলের খাটের চারটি পায়ার ব্যবহারে স্যান্ডউইচের একটি আকৃতি দিয়েছেন। মনে হচ্ছে, একটা কিং সাইজের খাট চিড়েচ্যাপ্টা স্যান্ডউইচ হয়ে গেছে। ধারণাগতভাবে কাজটিতে স্বার্থ ও উদারতার সংঘর্ষ উপলব্ধি হয়। লেজসহ পশুর চামড়া যেমন জীবন্ত অনুভূতি দেয়, তেমনি চারটি পায়ার চাপে কাজটি একটা কিউবিক আকৃতি পায়। রুপম ‘ব্রিকবেড’ নামে আরেকটি কাজ করেছেন। এই কাজটিতে তিনি ইট ভেঙে শূল আকৃতি বানিয়ে সারিবদ্ধ একটি কম্পোজিশন করেছেন। তবে এই সুসংবদ্ধ উপস্থাপনটি দর্শকের মনে তীব্র অস্বস্তির জন্ম দিতে পারে।

ইমরান সোহেল পাঁচটি কাজ জমা দিয়েছেন। তিনি ÔIs this commute of the contemporary timeÕ এবং ÔResonanceÕ শিরোনামে কাজগুলি বিন্যস্ত করেছেন। সোহেল তাঁর একটি কাজে ঘোড়ার লোকজ মোটিফ ও হাতপাখার রঙিন ঝকঝকে ভাবটিকে সচেতনভাবে বিক্ষিপ্ত করেছেন। তার কাজে জনপ্রিয় লোকজ মোটিফকে বিবৃত করে দেখানো, রিভার্স  কম্পোজিশন, কোনো স্থিতিশীল ফর্মকে অনন্য করে তোলার প্রচেষ্টা, স্তূপ করে রাখা, আবৃত করে রাখা – এসব বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। সোহেলের কাজে সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ ধারণাটি প্রকট; একই সঙ্গে উন্নয়নকামী সভ্যতার সংকটের অন্তরালে চাপা-পড়া হাহাকারও প্রকাশ পেয়েছে।

‘জিরো ক্যালোরি’ প্রদর্শনীতে রাসেল চৌধুরীর দুটি কাজ প্রদর্শিত হয়েছে। রাসেল তাঁর ‘এগারলেস (EagerlessÕ কাজটিতে ফেলে দেওয়া নষ্ট ছবিকে ডকুমেন্ট পেশ করার মতো কম্পোজ করেছেন। রাসেলের আরেকটি কাজের নাম ‘মারজিনাল’। এই কাজটিতে তিনি একটি নষ্ট পরিত্যক্ত অ্যাকোয়ারিয়াম ব্যবহার করেছেন। অ্যাকোয়ারিয়াম যে-টেবিলের ওপর রাখা হয়েছে, তার ছয়টি পায়ে ছয়টি বুট জুতা পরিয়ে অচল কম্পোজিশনকে চলমান দেখানোর চেষ্টা করেছেন। রাসেলের এই কাজে অস্তিত্বমানতা, শূন্যতা, আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা এবং স্মৃতিকাতরতার অনুভূতি তৈরি হয়।

সানজিদ মাহমুদ ৪০ গুণন ১০ ফুট মাপের বিশাল আকৃতির একটি অ্যাক্রিলিক ছবি করেছেন। শক্তিশালী রেখা, নিরেট গড়নের বিমূর্ত জৈবিক চরিত্র, অনুরণন জাগানো রং এসবের সমন্বয়ে তিনি আকস্মিক ভয়ার্ত গুমোট নৃশংস অভিজ্ঞতার পুনঃরূপায়ণ করেছেন। সানজিদের আরেকটি ত্রিমাত্রিক ইনস্টলেশন ‘সিটি উইন্ডো’। কাজটিতে পিচ ও ফোমের চতুষ্কোণ আকৃতির টুকরো ইটের গাঁথুনির মতো সাজিয়ে একটি কাঠের জানালার মতো আকৃতি দেয়া হয়েছে। ইটের গাঁথুনিগুলিতে সিমেন্ট-বালির মিশ্রণের মতো কুচকুচে কালো পিচের চুয়ানো রেখা দর্শকের মনে অস্বস্তির জন্ম দেয়। আবার শিল্পী সানজিদের ‘তেলাপোকার গল্প’ শিরোনামে তৃতীয় আরেকটি কাজে দেখা যায়, লবণের দানার অনিয়ত জমিনে আধানিমজ্জিত কিছু বাজারি শিশুতোষ খেলনা,  বিক্ষিপ্ত অবিন্যস্ত অবহেলায় কোনো এক বিরানভূমিতে নিতান্ত তুচ্ছের অমর্যাদায় পড়ে আছে তারা। বাড়িতে অজস্র তেলাপোকার সঙ্গে সহাবস্থান করতে গিয়ে শিল্পী সানজিদের উপলব্ধিতে ধরা পড়ে এই মানবিক অস্তিত্বমানতা। বিমানবিক অবস্থান ও অনুভূতির সমন্বয় রয়েছে কাজটিতে।

সনদ বিশ^াস ‘ভিজ্যুয়াল ইকুয়েশন’ নামে দুই মিনিটের একটি অডিও ভিজ্যুয়াল উপস্থাপন করেছেন। তিনি কতগুলি অ্যানিমেটেড শটের মন্তাজের মাধ্যমে ও কয়েকটি দৃশ্যের সাহায্যে কাজটি নির্মাণ করেন। প্রথম দৃশ্যে প্লটের বর্ণনা, দ্বিতীয় দৃশ্যে প্লটের কার্যকরণ, তৃতীয় দৃশ্যে পরিণতি – এমন কাঠামোতে কাজটির বুনিয়াদ গড়েছেন তিনি। ‘ভিজ্যুয়াল ইকুয়েশন’ সমসাময়িক পৃথিবীর ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-সাংস্কৃতিক দৃশ্যপটের তুলনামূলক ধারণা এবং নিয়তিবাদের ধারণার মিশেল। এ যেন অনেকটাই পরিস্থিতির অমোঘ দ্বান্দ্বিক বাস্তবতাকে মনে করিয়ে দেয়। বিশেষত প্রথম দৃশ্যপটে সরোদের মৃদু ঝঙ্কারে প্লট নির্মাণের শাব্দিক শীতল আবহ আর প্লটের কার্যকরণে সৃষ্ট অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওয়েস্টার্ন অর্কেস্ট্রার মাইনর স্কেলের ক্রেসেন্ডো-পরিবর্তনশীলতার দার্শনিক এক সত্যকে সামনে নিয়ে আসে।

‘জিরো ক্যালোরি’ শিরোনামে একটি প্রতীকী অর্থ বহন করেই প্রদর্শনীটি বাস্তবায়িত হয়েছে। এর অবলম্বন এই সময়-পরিসরে বিদ্যমান নানা ঘটনা ও সত্তার দ্ব্যর্থক অবস্থা। অভিব্যক্তির মাত্রিক প্রকাশ এবং ব্যঞ্জনা নির্মাণের চিরাচরিত ভূমিকায় এসব শিল্পবস্তু বা আয়োজন কোনোটাই কোনো সরাসরি প্রতিক্রিয়া নয়, বরং সময়ের সঙ্গে একটি সংলাপের প্রয়াস।

এই প্রদর্শনী দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, ধীমানের কাজে ঐতিহাসিক কোনো চরিত্রের অদৃশ্য অবতারণায় কি সমসাময়িক পরিস্থিতিকে বিদ্রƒপ করা হয়েছে? সৈয়দ তারেক রহমানের কাজে কি উচ্চারিত হয়েছে খাদ্যের সুষম বণ্টনের কোনো আকাক্সক্ষা? রুপম রায়ের কাজে প্রাণী ও জীবের মৃত অবয়বদ্বয়ের সমন্বয়ে জীবন ও জড়তার যে-সম্পর্ক দেখানো হয়েছে তাতে কি সভ্যতার প্রসঙ্গ কেবলই বস্তুগত রূপ পরিগ্রহ করে? মানবিক মূল্যবোধ কি এখানে শুধুই ধোঁয়াশা? ইমরান সোহেল কি প্রতীকী উপস্থাপনায় ঐতিহ্যের অবক্ষয়ের আদলে সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয়কেই ইঙ্গিত করেছেন? রাসেল চৌধুরী কি অস্তিত্ববাদিতার ব্যক্তিক প্রশ্নে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন আত্মদর্শন? তেমনি সানজিদ মাহমুদের কাজের ভায়োলেন্স কি সনদ বিশ^াসের জিওপলিটিক্যাল রণভূমিতে রক্তাক্ত ইতিহাসের স্মৃতি বা অনুভবকে বয়ে নিয়ে আসে?

এমনই অনেক প্রশ্নের বা ভাবনার অবকাশ তৈরি করে এই প্রদর্শনীতে দাগী আর্ট গ্যারেজের শিল্পীরা সমসাময়িক পৃথিবীকে উপস্থাপন করেছেন নিজ নিজ দৃশ্য-নির্মাণে। ‘জিরো ক্যালোরি’ নামটিকে একটি আপেক্ষিক শব্দ-অবয়ব বলে বিবেচনা করা যায়, যাকে কেন্দ্র করে স্বাধীনভাবে শিল্পীরা তাঁদের চিন্তা ও চর্চার ফসলকে একটি ছায়াতলে আনতে সচেষ্ট হয়েছেন।