নভেরা-প্রতিভা : আনা ইসলামের আয়ত অবলোকন

মইনুদ্দীন খালেদ

নভেরা : বিভুঁইয়ে স্বভূমে  l আনা ইসলাম l অন্যপ্রকাশ ও জার্নিম্যান l ঢাকা, ২০২০ l ১৫০০ টাকা

‘কেউ একজন ভবিষ্যতে আমাদের স্মরণ করবে।’ সাপ্পো দীর্ঘশ্বাস ফেলে এ-কথা বলেছিলেন। সেটা খ্রিষ্টপূর্ব ৬৪০ বছর আগের কথা। সাপ্পো ছিলেন গ্রিসের কবি। এই নারী আজ ইতিহাসে গণ্য হয়েছেন হোমারের প্রতিপক্ষ প্রতিভা হিসেবে। নারী-প্রতিভাকে বিবেচনা না-করা, বিস্মৃত-হওয়া এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে উপেক্ষা করার এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তাই উনিশ শতকের নারীবাদী জার্মান লেখক লুইস অট্টো-পিটারস নারীর বিরুদ্ধে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আধিপত্য সামাল দেওয়ার জন্য বলেছিলেন, ‘নারীরা বিস্মৃত হতেই থাকবে যদি না তারা নিজেরাই নিজেদের কথা না ভাবে।’ নারীর অবমূল্যায়নের ইতিহাস দীর্ঘ, বিচিত্র এবং সর্বক্ষেত্রেই বেদনাদায়ক। জার্মান এক্সপ্রেশনিজম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পুরুষশিল্পীদের সমতুল্য করে কি ইতিহাসে গ্রাহ্য হয়েছেন ক্যাথি কোলভিৎস? এখন ভাবা হয়, কিন্তু ফিদা কাহলো যে শিল্পাকাশে রিভেরার চোখে কম দ্যুতিময় স্বতন্ত্র নক্ষত্র নয়, তা কি শিল্পীর জীবদ্দশায় কেউ চিন্তা করেছে? রদ্যাঁর বান্ধবী বলে আজো তাঁর সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে পরিস্ফুট হতে পারেননি কামি ক্লদেল। পুরুষ-প্রতিভার রাহুগ্রাসে অন্ধকারে নিমজ্জিত নারীর কীর্তি-ঐশ্বর্য। এর অজস্র দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে। এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাবতেই পারেনি যে বেগম রোকেয়ার লেখা শিক্ষার্থীর আত্মজাগৃতির জন্য অবশ্যপাঠ্য বিষয় হওয়া উচিত। 

ইতিহাসে নারীর অবমূল্যায়ন স্বভাবতই চিন্তাশীল সংবেদী নারীর মননকেই গাঢ়তরভাবে ভাবায়। এ-ভাবনার চিন্তাগর্ভ এক সন্দর্ভ শিল্পসমালোচক আনা ইসলামের লেখা গ্রন্থ নভেরা : বিভুঁইয়ে স্বভূমে । কিন্তু নভেরা কে? একদিন নবীন প্রজন্ম এ-প্রশ্নও করতে পারে। বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক ভাস্কর নভেরা আহমেদ নিয়ে এ-আশঙ্কার কথাও বলেছেন এ-গ্রন্থের লেখক। এমন বিশদ বিশ্লেষণী বিবরণে দেশের আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের এ-পথিকৃৎ নারীকে নিয়ে এর আগে কোনো গ্রন্থ রচিত হয়নি। যেসব প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিভিন্নজন পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন তার বেশিরভাগই তথ্যের বিচারে নির্ভরযোগ্য নয় এবং নভেরা-প্রতিভার বিশ্লেষণেও সেগুলো চিন্তাপুষ্ট নয়।

নভেরা-জীবনের ব্যক্তিক ও সামাজিক সম্পর্কের একনিষ্ঠ ও অনুপুঙ্খ পাঠ, তাঁর সৃষ্টিসম্ভারের অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণ এবং দেশীয়, এই উপমহাদেশীয় ও আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষাপটে সেসবের তুলনামূলক বিচার আর পুরুষতান্ত্রিক অপরাজনীতির নিগড় ছিন্ন করে পথিকৃৎ ভাস্করকে তাঁর স্বোপার্জিত মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকার, – সব মিলিয়ে আনা ইসলামের এ-গ্রন্থ নারীর প্রতি নারীর দায়বদ্ধতার এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। এটি পুরুষ সমাজের প্রতি নয় শুধু, নারীর প্রতি নারীরও যে আশানুরূপ শ্রদ্ধা, মমতা, দায়িত্ববোধের অভাব রয়েছে, তা-ও জানান দিয়ে যায়।

গ্রন্থের শুরু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের একটি লেখা দিয়ে। ‘ইনার গেজ’ শীর্ষক মহাকাব্যপ্রতিম যে-মুক্তাঙ্গন ভাস্বর্য প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে ১৯৬০ সালে এদেশে নভেরার আকাশপ্লাবী সূর্যের আলোর মতো আবির্ভাব তার ক্যাটালগে শিল্পাচার্য বলেন, কে-ই বা পারে তার সাফল্যকে অভিনন্দন না জানিয়ে, যখন এদেশের শিল্পভুবনে তার সৃষ্টিতে নতুন ঐতিহ্যের জাগরণ দেখা যাচ্ছে। এ-প্রদর্শনীর আগে ১৯৫৭-তে নভেরা তখনকার পাবলিক লাইব্রেরির দেয়ালে ফ্রিজ রীতিতে লোকশিল্পের শৈলীতে নতুন রূপ আরোপ করেন এবং ১৯৫৮-তে গড়েন একটি মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য এক শিল্পপতির বাড়ির আঙিনায়। ভাস্কর্যের বিষয় কৃষির বাংলাদেশ। একটি গরু ও তাকে ঘিরে দুটি দুই বয়সী মানুষী দেহ। গরু ও কৃষিলগ্ন মানুষের সহাবস্থানের এ-বিষয় নির্মাণে রেনেসাঁস-উত্তর ব্যাকরণ নয়, বরং তা হেনরি মুরের কাজের সঙ্গে সংগতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। লোককলা, বাংলার কৃষিজীবন এবং তা পুনর্বয়নে আধুনিকতার মাত্রা সংযোজন – এসব কারণেও নভেরার সৃজনের মর্ম জয়নুল আবেদিনকে উদ্দীপ্ত করে – এমন ভাবা বোধহয় অসংগত হবে না।

জয়নুল চিনলেন, বুঝলেন ঠিকই; কিন্তু আর কেউ-ই বুঝতে পারলেন না। তাঁর প্রজন্মের কেউ-ই তাঁর কাজের মূল্যায়ন করেননি। করেননি কেন? কেন তাঁরা বিমুখ ও নীরব রইলেন? এ-প্রশ্ন উত্থাপন করে আনা ইসলাম দেখিয়েছেন যে, নভেরা তাঁর কালে এদেশে যে আধুনিক ভাস্কর্যের সূচনা ও বিপুল বিকাশের নজির সৃষ্টি করেছেন তা অনুধাবনে প্রাজ্ঞ ছিল না তখনকার শিল্পী-সাহিত্যিকের সমাজ। তাছাড়া নারীর কাজের প্রতি অমনোযোগ ও ঈর্ষা দুটিই সচল ছিল আধিপত্যপ্রিয় পুরুষ-চৈতন্যে।

নভেরা : বিভুঁইয়ে স্বভূমে বইটি নভেরার জীবন জানার ও শিল্পকর্মের তাৎপর্যময় স্বাতন্ত্র্য অনুভবের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস। ইতোপূর্বে আমরা নভেরার জীবনেরও সঠিক রূপ বোঝার মতো কোনো বই রচিত হতে দেখিনি এবং তাঁর শিল্পকর্মেরও এত বিশদ বিশ্লেষণ নেই কোনো লেখায়। নভেরাকে নিয়ে কাল্পনিক ভাবনা প্রসারিত করে অনেক অগ্রহণযোগ্য সাহিত্য রচিত হয়েছে।

নভেরা ১৯৬০-এর ওই প্রদর্শনীর পর আর কী কী ধরনের কাজ করেছেন, তাঁর আর কটি প্রদর্শনী কোথায় কোথায় হয়েছিল এবং তিনি  নিজের ভাস্কর্য সৃষ্টিতে কীভাবে বিবর্তিত হয়েছেন এবং চিত্রশিল্পও রচনা করেছেন স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত – এসব এর আগে বিস্তারিতভাবে কোনো লেখক বিশ্লেষণ করেননি। আনা ইসলাম নভেরা-অনুসন্ধানে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে দেশের এই আধুনিক ভাস্করের সঙ্গে আনার পরিচয় ঘটে প্যারিসে। তারপর ২০১৫-এর ৫ মে-তে নভেরার লাশ যাঁরা কবরস্থ করেছেন তাঁদের সঙ্গে ছিলেন লেখক ও শিল্প-সমালোচক আনা ইসলাম। নভেরা প্যারিস ও প্যারিসের অদূরে জীবনের বেশিরভাগ সময় যাপন করেছেন। আনাও আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে আছেন প্যারিসে। এ-কথা সবার প্রায় জানা যে নভেরা ইংল্যান্ডের স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটে মডেলিং ও স্কাল্পচার বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেছেন এবং এর আগে ‘সিটি অ্যান্ড গিল্ড’ এবং পরে ফ্লোরেন্সে ভেন্ডেরিনো ভেনতুরির কাছেও শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করেছেন। পঞ্চাশের দশকে দেশে ফিরে ‘ফ্রিজ’ ম্যুরাল, শিল্পপতির বাড়ির সামনে প্রথম মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য, শহিদ মিনার নির্মাণ এবং ১৯৬০-এ শতাধিক ভাস্কর্য নির্মাণ করে তার থেকে ৭৫টি নির্বাচন করে প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এদেশের আধুনিক শিল্পের ইতিহাসে এই অভূতপূর্ব শিল্পায়োজন আশানুরূপ মূল্যায়ন পায়নি। সামরিক শাসনকেন্দ্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালি ভাস্করের এ-উত্থান সুনজরে দেখেনি।

কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার যে তাঁর সৃষ্টি তা-ও একসময় সমাজের কর্তাব্যক্তিদের কূটকচালে স্বীকৃতি পায় না। সেখানে চলে আসে হামিদুর রহমানের নাম। এদেশের শিল্পের ইতিহাসে শহিদ মিনার হামিদুর রহমানের সৃষ্টি বলেই লিখিত হয়েছে। আনা ইসলাম শহিদ মিনারের মূল নকশার প্রতিলিপি, অন্যান্য ডকুমেন্ট ও নভেরার সাক্ষাৎকার নিয়ে দালিলিকভাবে ইতিহাসকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে আনাকে নভেরা বলছেন, ‘হামিদ তো ফ্রেসকো পেইন্টিং শিখেছে। কোনোদিন স্থাপত্য বা ভাস্কর্য করেনি। সে কী করে শহিদ মিনারের নকশা করে। শ্রমিকরা জানত না কী করে এ ধরনের কাজ করতে হয়। হামিদ ছিল সাহায্যের জন্য।’ (পৃ ১০৮) লেখকের সঙ্গে আলাপচারিতায় নভেরা আবারো বলেন, ‘অনেক কাজ একা করতে হবে বলে হামিদকে বলি সাহায্যের জন্য।’ (পৃ ৯২) শহিদ মিনারের নকশা সরকারিভাবে অনুমোদন পায় ১৯৫৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। সরকারের নথিভুক্ত সেই অনুমোদনপত্রেও উল্লিখিত হয়েছে হামিদুর রহমানের নাম নভেরার সহযোগী হিসেবে। এসব তথ্যের মুদ্রণ শুধু নয়, অডিও-ভিজুয়াল সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ-গ্রন্থের লেখক। এসব তথ্য ও প্রমাণ বিবেচনায় আমরা এখন নিঃসন্দেহ হতে পারি যে, আমাদের শহিদ মিনারের স্থপতি এদেশের ভাস্কর্যশিল্পের পথিকৃৎজন নভেরা আহমেদ।

ভাস্কর নভেরা-প্রতিভা মূল্যায়নে পশ্চিমের শিল্পের সঙ্গে এই বাঙালি ভাস্করের সংযোগ, সংশ্লেষ এবং পরিণামে দেশজ ও লোকজ শিল্পাদর্শের সংবন্ধনে কী করে তা স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার তা আনা বিশেষ আয়োজনে বলেছেন। শুধু পাকিস্তান রাষ্ট্র সীমানার পরিধিতে নয়, এ উপমহাদেশের ভাস্কর্য-চর্চার নিরিখে নভেরা-প্রতিভার নিজস্বতা পরিমেয় করে তুলেছেন। বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করেছেন উপমহাদেশের নারীর ভাস্কর্য-চর্চার ইতিহাস। মীরা মুখোপাধ্যায় (১৯২৩-৯৮), শানু লাহিড়ী (১৯২৮-২০১৩), আমিনা আহমেদ কর (১৯৩০-৯৪), কমলা রায় চৌধুরী (১৯২২-৯৯), কমলা পদুভাল (?), পিলু পোচকানাওয়ালা (১৯২৩-৯৪) প্রমুখ ভাস্করের আগেই নভেরার উত্থান আধুনিক ভাস্কর হিসেবে। হেনরি মুর, বারবারা হেপওয়ার্থের শিল্প-ভাবনার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েও নভেরা যে নিজস্বতায় উজ্জ্বল তা প্রমাণ করায় প্রাজ্ঞ বিশ্লেষণের পরিচয় দিয়েছেন আনা। তবে এ-প্রসঙ্গে শুধু নারীর ভাস্কর্য-চর্চা নয়, চিত্রকলা-চর্চায় অগ্রগামী নারীর কৃতির কথা উল্লিখিত হয়েছে বইটিতে। অগ্রগামী শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে আনা যেহেতু অমৃতা শেরগিল বা শানু লাহিড়ীর প্রসঙ্গ টেনেছেন, তাহলে ঠাকুরবাড়ির নারীদের শিল্পচর্চার বিষয়টি কেন আলোচিত হবে না, সে-প্রশ্ন যৌক্তিকভাবেই উঠে আসে।

নভেরা-চৈতন্য বিশ্লেষণ আনা ইসলাম জরুরি মনে করেছেন। কেননা নভেরার শিল্প রিপ্রেজেন্টেশনাল শৈলীর চিহ্ন পাঠ করে উপলব্ধি করা যায় না। নভেরার অহিংস উদারনীতি একই সঙ্গে বাঙালি-সংস্কৃতিজাত এবং আরো অনেক ধর্ম-সংস্কৃতিপ্রসূত। বিশেষ করে উপনিষদ, বৌদ্ধধর্মের অহিংসা নীতি, আউল-বাউলের দর্শন নভেরাকে আমৃত্যু আবিষ্ট করে রেখেছিল। বিশেষ করে সর্বপ্রাণবাদে তাঁর আস্থা ছিল অনেক। তিনি পশুপাখি ও গাছপালার সঙ্গে সখ্য-সেতু রচনা করতে পেরেছিলেন।

আনার নভেরা-সন্দর্শনে অনেক নতুন তথ্য ও ব্যাখ্যা আমরা এই প্রথম জানতে পারলাম। এতদিন শহিদ মিনারের আনত ভার্টিক্যাল কাঠামোর মধ্যে আমরা মা ও সন্তানের সম্পর্কের সূত্র খুঁজেছি। কিন্তু নভেরা বলছেন ভিন্নকথা। তাঁর ভাষ্যে, ওই কাঠামোতে আছে বৌদ্ধের প্রণত মুদ্রা।

আমরা নভেরার ’৬০-এর প্রদর্শনীর পর ১৯৭০ সালে ৩৩টি মনুমেন্টাল ভাস্কর্য নিয়ে ব্যাংককের প্রদর্শনীর কথাও জানতাম। কিন্তু আনা সচিত্র প্রমাণে ও তথ্যের উপস্থাপনে জানালেন, ১৯৭৩-এ প্যারিসের ‘গ্যালারি রিভ গোশ’-এও একটি একক প্রদর্শনী করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, নভেরা জ্যাকব অ্যাপসটাইনের শিক্ষার্থী ছিলেন। আনা তা তথ্য উপস্থাপন করে ও যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, নভেরা অ্যাপসটাইনের কাছে ১৯৫২-তে শিক্ষা লাভ করেননি। কারণ ’৫২ সালে ৭২ বছর বয়সী অ্যাপসটাইন পারিবারিক নানা দুর্ঘটনায় একটা অস্বাভাবিক মানসিক যন্ত্রণায় ছিলেন। তবে ভারতপ্রেমী অ্যাপসটাইনের সঙ্গে নভেরার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগে নভেরা প্রাণিত হয়েছেন এবং একজন বাঙালি ভাস্করের সৃজনোদ্যম দেখে আলোড়ন অনুভব করেছেন অ্যাপসটাইনও।

নভেরার সঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র স্ত্রী আনসারীর সম্পর্কটা কতটা নিবিড় ছিল তা-ও জানা গেল এ-বই পড়ে। ১৯৭১-এ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র মৃত্যুর খবর পেয়ে নভেরা গিয়েছিলেন আনসারীর বাড়িতে।

নভেরার সঙ্গে হামিদুর রহমানের সম্পর্ক ছিল প্রণয়ের। নভেরা হামিদের এ-প্রণয় সশ্রদ্ধায় আমৃত্যু ধারণ করেছেন। যদিও শহিদ মিনার প্রসঙ্গে তিনি তাঁর দাবি প্রতিষ্ঠায় অকুণ্ঠ থেকেছেন।

রুশ-জার্মান বংশোদ্ভূত গ্রেগোয়ার দ্য ব্রুনসের সঙ্গে ঘর করেছেন নভেরা। গ্রেগোয়ার নভেরার প্রতি আকর্ষণবোধ করেন ’৬০-এর দশকে ব্যাংককে। গ্রেগোয়ার পেশায় ফটোগ্রাফার। স্থাপত্যের ছবি তোলায় ছিল তাঁর খ্যাতি। ১৯৭০-এর প্রদর্শনী দেখে তিনি সাপ্তাহিক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকক ম্যাগাজিনে এক প্রবন্ধ লেখেন ‘স্কাল্পচার বাই নভেরা’ নামে। দূরদেশী এক গ্রেগোয়ার কী দার্শনিকতায় স্নাত হয়ে বাঙালি নভেরার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেন, ঘর বাঁধলেন, আমৃত্যু প্রেমজ সেবায় সযতনে মগ্ন রইলেন সহধর্মিণীর প্রতি, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়। দেশের পথিকৃৎ এই ভাস্কর কোন অভিমানে নিজেকে অবরুদ্ধ রাখলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা সত্ত্বেও উপেক্ষা করলেন রাষ্ট্রীয় পদক, যদিও অন্তিম বাসনা ছিল তাঁর দেশে গিয়ে তাঁর প্রিয় সৃষ্টি শহিদ মিনারের প্রশস্ত অঙ্গনে আঁকবেন ছবি, মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক। কিন্তু সে-আকাঙ্ক্ষা তাঁর পূর্ণ হয়নি। কিন্তু গ্রেগোয়ার আমাদের ভাবায়। মানবীকে শ্রদ্ধা করার কি বিশেষ কোনো নিপুণ আয়োজন আছে, যা আমরা আয়ত্ত করতে পারিনি কেউ, তা জেনেছিল নভেরাসঙ্গী গ্রেগোয়ার। আমরা কেবল বিস্মিত হই। আনা ইসলামের এ-বই পড়লে স্পষ্টত আমরা বুঝে যাই নভেরা গ্রেগোয়ার মানববন্ধন এক বিরল সন্দর্ভ।

দুই মলাটের মধ্যে যেন একাধিক বই পাঠের সম্ভাবনা যুক্ত হয়েছে নভেরা-বিষয়ক এ-গ্রন্থে। নভেরার জীবন ও শিল্প পাঠ নয় শুধু, এতে সংযোজিত হয়েছে ভাস্করের আত্মীয়-পরিজনসহ আরো অনেক মানুষ ও ঘটনার ছবি। তাছাড়া নভেরার সকল প্রদর্শনীর সিংহভাগ ভাস্কর্য ও ছবির ইমেজ সযতনে মুদ্রিত হয়েছে। লেখক যে শুধু ক্যাটালগ থেকেই ছবি ছেপেছেন তা নয়, অনেক ব্যক্তি-সংগ্রহ থেকেও একনিষ্ঠ যোগাযোগে উদ্ধার করেছেন শিল্পকর্ম ও নভেরা-জীবনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ব্যক্তির আলোকচিত্র।

নভেরা আহমেদের সঙ্গে দুই দশকের যোগাযোগে আনা ইসলাম অসাধ্য সাধন করেছেন; এ-উচ্চারণ অযৌক্তিক বা আতিশয্য দোষে দুষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই বলেই আমাদের মনে হয়। যে-নারীর ধমনীতে প্রবহমান স্বদেশ বাংলাদেশ, যে-নারী অন্য দেশে কোনো অনম্য আজ্ঞায় নিজেকে দুর্ভেদ্য বলয়ে মগ্ন রেখেছিলেন, সেই অতিসংবেদী স্পর্শকাতরতাময় নভেরার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের দায় ও দায়িত্ব অনুভব নিখাদ ছিল বলেই এ-বই লেখক রচনা করতে পেরেছেন। এ-বই নভেরার জীবনী নয়। আনা তা স্বীকারও করেছেন। তবে যে-পরিমাণ তথ্য লেখক সংগ্রহ করেছেন তাতে নভেরার জীবন ও শিল্প বিশ্লেষণে ভবিষ্যতের গবেষকদের পথ সুগম হয়েছে।

এ-বইতে বেশ কটি ছাপার ভুল আছে। তবে ছাপার ভুল, সত্যিই ছাপার ভুল কি না তা নিয়ে পাঠক দ্বিধান্বিত হবেন। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট, যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, তাতে সহশিক্ষার প্রবর্তন হয় ১৯৫৪-৫৫ সেশনে। আনার বইতে তা উল্লিখিত হয়েছে ১৯৬৪-তে। নভেরা-প্রতিভার এই অপূর্ব প্রামাণিক গ্রন্থ চার রঙে শোভিত করে প্রকাশ করতে অর্থ ও হৃদয়ের কার্পণ্য করেননি ‘জার্নিম্যান বুকস’ ও ‘অন্যপ্রকাশে’র স্বত্বাধিকারীদ্বয়। তাঁরাও এ-গ্রন্থ প্রকাশের জন্য পাঠকের শুভেচ্ছা পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।