প্রাচ্যশিল্পে প্রাচ্যজীবন

প্রাচ্যের জীবনযাপন-ধারাকে দর্শকসমক্ষে শিল্পিতভাবে তুলে ধরা প্রাচ্যকলাশাস্ত্রের বিশেষ একটি ধরন। সামন্তশাসক এবং অভিজাত শ্রেণির গৌরব ও বৈভব তুলে ধরার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কৃষিনির্ভর সামাজিক জীবনের নানা কাজের ব্যস্ততা, গৃহকর্ম ও অবসরে নারীর সৌন্দর্যচর্চা প্রভৃতি প্রাচ্যকলাশিল্পীদের চিত্রপটে নন্দিতভাবে উঠে আসে। শিল্পের নানা ঘরানার মধ্যে প্রাচ্যকলার যত প্রয়োগ ও প্রসার, তেমনটি শিল্পের অন্য ক্ষেত্রে ঘটেনি। যেমন  উচ্চাঙ্গসংগীতের ক্ষেত্রে প্রাচ্যসংগীত না বলে বলা হয় ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত।

ভারতবর্ষে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে প্রাচ্যকলা নবজীবন পায় শতবর্ষেরও আগে, ইতিহাসে এটি নব্যবঙ্গীয় শিল্পধারা হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক প্রাচ্যকলাচর্চার সূত্রপাত হয় গত শতকের ষাটের দশকে এই বিভাগ প্রতিষ্ঠায়। শুরুতে একজন মাত্র ছাত্রী নিয়ে প্রাচ্যকলা বিভাগের শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়। গত পঞ্চাশ বছরে প্রাচ্যকলাচর্চা পুষ্ট হয়েছে এবং এটি ঐতিহ্য থেকে ক্রমাগত আধুনিকতার পথে পা বাড়িয়েছে।

গত সাত বছর ধরে ঢাকায় ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টাডি গ্রম্নপ প্রাচ্যকলা প্রসারে সক্রিয়। দুই বাংলার একান্নজন শিল্পীর আশিটি চিত্রকর্ম নিয়ে এদের সপ্তম প্রদর্শনী সম্প্রতি জয়নুল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের পঁচিশজন ও ওই বাংলার ছাবিবশজন শিল্পীর অংশগ্রহণ ছিল এ-প্রদর্শনীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের প্রধান শিল্পী মলয়বালা এই প্রদর্শনীর কিউরেটর।

এই আয়োজনের অন্যতম বিশেষত্ব হলো – গুরুশিল্পীদের সঙ্গে নবীন শিল্পীদের চিত্রকর্ম এক গ্যালারি চৌহদ্দিতে নিয়ে আসা। এতে নবীন শিল্পীরা সরাসরি গুরুদের কাজ দেখার এবং তাঁদের সম্পর্কে নিজের জ্ঞান বাড়ানোর সুযোগ পেলেন।

প্রদর্শনীর বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পীরা হলেন – ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার (১৮৯১-১৯৭৫), শিল্পী দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী (১৮৯৯-১৯৭৫), বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় (১৯০৪-৮০), সুধীর খাস্তগীর (১৯০৭-৭৪), গোপাল ঘোষ (১৯১৩-৮০), মানিকলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯১৬-২০০২), ইন্দ্র দুগার (১৯১৮-৮৯), বীরেন দে (১৯২৬-২০১১), মৃণালকান্তি দাস (১৯২৮-৯০), অকালপ্রয়াত নিখিল বিশ্বাস (১৯৩০-৬৬) ও রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩০)। তাঁরা সবাই অখ- ভারতে জন্ম নিয়ে শিল্পকলা ও শিল্পশিক্ষায় স্বনামধন্য হয়েছেন। এ-শিল্পী দলের অনেকেই অবনীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল বসুর সরাসরি ছাত্র ছিলেন।

প্রদর্শনীতে তাঁদের কাজগুলো প্রধানত ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়বস্তু সংবলিত। এমনকি রাজকীয় চরিত্র-চিত্রণের বদলে তাঁদের চিত্রপটে সেকালের প্রকৃতি ও জীবনধারার প্রতিফলন ঘটেছে।

বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় বিশ্বভারতীর কলাভবনে নন্দলাল বসুর সরাসরি ছাত্র, পরে একই বিভাগে তাঁর সহকর্মী ছিলেন। ১৯৪৩ সালে জলরঙে তাঁর আঁকা শিরোনামহীন ছবিতে তিনি এঁকেছেন – এক ফুলগাছের ছবি। এর ফুলের দুটি রং – সাদা ও লাল, পাতাও তদ্রূপ সবুজ ও লালবর্ণে রঞ্জিত। বীরেন দে এঁকেছেন – বরফাচ্ছাদিত দৃষ্টিনন্দন ভূ-দৃশ্য।

দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী স্বনামধন্য শিল্পী, শিল্পের শিক্ষক ও শিল্পতাত্ত্বিক। এ-প্রদর্শনীতে তাঁর কাজ একটি ভূ-দৃশ্য। শিল্পী দুটি গাছের ফাঁকে কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতির ছবি এঁকেছেন।

গোপাল ঘোষের ছবিও ভূ-দৃশ্য। জলরঙে তিনি এঁকেছেন নদীতীর। গ্রামীণ তিন নারীর জল তোলার ছবি এঁকেছেন ইন্দ্র দুগার। এটি তাঁর ১৯৫২ সালের কাজ। ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার এঁকেছেন নারী ও নিসর্গের ছবি। সিল্কের কাপড়ে জলরঙে দরজার সামনে দণ্ডায়মান এক ব্যক্তির ছবি এঁকেছেন মানিকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। মৃণালকান্তি দাস জলরঙে নৈবেদ্যর থালা হাতে এক নারী পূজারির চিত্র তুলে ধরেছেন। এটি ১৯৮৭ সালের কাজ।

প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী ওপার বাংলার এ-সময়ের শিল্পীরা হলেন – অনন্যা রায়চৌধুরী, অনুরাধা গায়েন, অপূর্ব সেনগুপ্ত, অর্ঘদীপ্ত কর, বিনয় ডালুই, এনাক্ষী দাস, মিন্টু নাইয়া, নন্দদুলাল মুখোপাধ্যায়, পরাগ হালদার, রিনা রায়, সোমা মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত সাহা, সুস্মিতা সাহা, স্বপন দাস ও তন্ময় দাসগুপ্ত।

জ্ঞানী শিরোনামে অনুরাধা গায়েনের ওয়াশ পেইন্টিংয়ে একটা গল্পের আভাস আছে। জানালার ধারে পড়ার টেবিলে পাঠরত মানুষটির চুল রশিতে বাঁধা, যেটির আরেক প্রান্ত পেছনে কিছুর সঙ্গে আটকানো। অর্থাৎ তন্দ্রায় মাথা নিচু হলে চুলে টান পড়বে, ছুটে যাবে ঘুম। জ্ঞানীজনের কঠোর পাঠসাধনা প্রতিফলিত হয়েছে এ-ছবিতে। ওয়াশ টেকনিক ভালো, তবে আলোছায়া প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিল্পীর আরো মনোযোগ দরকার ছিল।

স্বপন দাস কাজ করেন প্রাচ্যকলার ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে। সুরা হাতে তরুণী সাকির সঙ্গে পারস্যের কবি ওমর খৈয়ামের ছবি এঁকেছেন তিনি কুশলী বর্ণপ্রয়োগে। তাঁর টেকনিক ও অঙ্কনশুদ্ধতা দর্শকদের আকৃষ্ট করে।

একই রীতিতে মিন্টু নাইয়া এঁকেছেন – নারীর অপেক্ষা, রিনা রায় এঁকেছেন – সন্ধ্যাপ্রদীপ। আবার সুকান্ত সাহা গ্রামীণ পটভূমিকায় অন্নপ্রাশনের ছবি এঁকেছেন। পরাগ হালদার চিত্রপটের কেন্দ্রস্থলে এক চেয়ারে বসা এক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের ছবি এঁকেছেন। সুস্মিতা সাহা সরাইয়ের ওপর এক চড়ুইপাখি এঁকেছেন, জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে আটপৌরে শাড়ি পরা এক তরুণী এঁকেছেন অনন্যা রায়চৌধুরী।

এসব কাজের বিশেষত্ব – এগুলো সাধারণ বিষয়কেন্দ্রিক ও বাস্তবানুগ বলে সাধারণ দর্শকদের দৃষ্টি কাড়ে।

প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে অগ্রজ তাজুল ইসলাম (১৯৪৬), জুটফেব্রিকে রং ও রেখায়  এঁকেছেন – গঠন।  প্রথিতযশা শিল্পী প্রাচ্যকলার অধ্যাপক আবদুস সাত্তার (১৯৪৮), কাগজে অ্যাক্রিলিক রঙে এঁকেছেন জলে ভাসা কোরিয়ান মাছ। সমসাময়িক শিল্পী রফিক আহমেদ মুক্তিযোদ্ধার ছবি এঁকেছেন, তিনি তাকে সজ্জিত করেছেন রঙিন পোশাকে। লক্ষ্মণচন্দ্র সূত্রধর পুরনো এক বাড়ির দরজার মুখে সবুজ আশ্বাসময় লতাগুল্মভরা দৃষ্টিনন্দন এক ছবি এঁকেছেন।

প্রয়াত শিল্পী শওকাতুজ্জামানের (১৯৫৩-২০০৫) কাগজে তুলি চালিয়ে ২০০১ সালে আঁকা তিনটি ফড়িং অকালপ্রয়াত প্রাণবান এই মানুষটির কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।

আমাদের সাহিত্যে সুন্দরী দুটি প্রধান নারীচরিত্র শকুন্তলা ও বনলতা সেন। সুশান্ত অধিকারী বনলতাকে তুলে এনেছেন তাঁর চিত্রপটে সমসাময়িক প্রসঙ্গে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিনি প্রদর্শনী দেখতে এসেছেন! আর ড. মলয়বালা গাছের শেকড়ে শকুন্তলার ছায়ামূর্তি দেখেন এবং নন্দিত উপস্থাপনায় তাকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরেন। এ-কালের সেলফিক্রেজ উঠে এসেছে কান্তিদেব অধিকারীর চিত্রে। অমিত নন্দী বিপরীত রাজনীতি অ্যানাটমি তুলে ধরেছেন ঐতিহ্য ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে।

বাংলাদেশের অংশগ্রহণকারী অন্য শিল্পীরা হলেন – বিকাশ আনন্দ সেতু, ইতি রাজবংশী, হরেন্দ্রনাথ রায়, কাজী নওরিন মিশা, নন্দিতা সূতার, সানজিদা আকতার, সামিনা জামান, জাঁনেসার ওসমান, জাহিদ মুস্তাফা ও জাহাঙ্গীর আলম। জাঁনেসার ওসমান তাঁর চিত্রপটে নানা রঙের ওয়াশ গড়িয়ে দিয়ে ছবি এঁকেছেন। জাহিদ মুস্তাফা আবহমান বাংলার এক গায়েনের ছবি এঁকেছেন অনেকটা মুঘল ঘরানার অঙ্কন-পদ্ধতিতে। জাহাঙ্গীর আলম লালচে ও হলুদাভ বর্ণের ভেতর রাধা-কৃষ্ণের ভঙ্গিমা তুলে ধরেছেন।

এ-আয়োজনে দুদেশের শিল্পীদের মেলবন্ধন সৃষ্টির সঙ্গে প্রাচ্যকলা প্রসারে ভূমিকা রাখবে। গত ৯ অক্টোবর শুরু হয়ে এ-প্রদর্শনী চলেছে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত।

শিল্পীদের চিত্রপটে আমরা পেলাম ঐতিহ্য আর আমাদের বাংলার অতীতকালের ভূ-দৃশ্য, পেলাম সাম্প্রতিক সময়ের ছবি ও এ নিয়ে শিল্পীদের নানা নিরীক্ষা। সব মিলিয়ে বৈচিত্র‍¨পূর্ণ হয়ে উঠেছিল এ-আয়োজন।