বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র

এক

চলচ্চিত্র এক বিস্ময়কর মাধ্যম, মানব সমাজে যার আছে ব্যাপক প্রভাব। চলচ্চিত্র বহন করে শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করার শক্তি। প্রভাব, প্রচার, ভূমিকা তৎপরতায় চলচ্চিত্র এখন পরাশক্তি, যদিও চলচ্চিত্র নিছক কারখানায় উৎপাদিত পণ্যমাত্র। চলচ্চিত্র কি কৌশল, নাকি চমক, নাকি শিল্প-এসব প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। চলচ্চিত্রের শৈশবকালের উদ্দেশ্য ছিল, বস্তু অথবা ব্যক্তির দৃশ্য পর্দায় প্রক্ষেপণের সময় তাতে গতি কীভাবে আনা যায়, যা কালিক পথপরিক্রমায় গণমানুষের চাহিদা মিটিয়ে আজ প্রভাব বিস্তারকারী শিল্পকলা। এই মাধ্যমের বিস্ময়বোধ বিস্তার করার ক্ষমতা প্রবল। এর একটাই কারণ, চলচ্চিত্রের প্রকাশভঙ্গির সর্বজনগ্রাহ্য ক্ষমতা। এর ভাষাভঙ্গি ব্যাকরণরহিত-যদিও চলনে-গঠনে চলচ্চিত্রকে ব্যাকরণঋদ্ধ ও সিদ্ধ হতে হয়; কিন্তু সাধারণ অর্থে এর পঠনে কোনো ব্যাকরণ প্রয়োজন হয় না। চলচ্চিত্র নামের ছায়াযুদ্ধের রংঢং বুঝে নেওয়ার ভাষা ভূগোল সীমার যে-কোনো প্রান্তের যে-কোনো ভাষার মানুষেরপক্ষেইসম্ভব। চলচ্চিত্র দেখেই এর ভাব-ভাষা বুঝে নেওয়া সহজ। চলচ্চিত্রকে দৃশ্য ধারণায় বুঝতে পারা সহজ হলেও এর সাংগঠনিক অথবা মাধ্যমগত ভাষা উদ্ধার করা ততটা সহজ নয়। এই বলবান গণমাধ্যমের ভাষা-সেই অর্থে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ভাষা-অপভাষা-বিচার করে তার পাঠ উদ্ধার করা বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য-অভিপ্রায় নয়।

বরং কিভাবে আমাদের চলচ্চিত্রের ভাষা কতটা গতিশীল, কতটা জীবনমুখী, তা নিয়ে এবং দর্শকদের ওপর এই ভাষার প্রভাব নিয়ে একটা আলোচনার সূত্রপাতই এর লক্ষ্য। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা যখন স্থিরচিত্রে গতিসঞ্চার করতে প্রাণাতিপাত করছিলেন, তখন এই প্রাচ্যদেশে এই শিল্পটি অন্ধকারেই ছিল। পশ্চিমে চলচ্চিত্রে দৃশ্য গতি পেল। চলচ্চিত্র আমাদের অক্ষিদুয়ারে এলো সাবালক হয়ে। অবাক-নির্বাক-সবাক চলচ্চিত্র এই যুক্ত বাংলায় উদ্দীপক বারোমশলা হিসেবেই আবির্ভূত হয়। সেই চলচ্চিত্র নিয়ে হইচই-কলরবকালে বাঙালিরা এর শিল্পীত নির্মাণের চ্যালেঞ্জ নিল। ১৯৫৬ সালে আবদুল জব্বার খান নামে একজন অতিউৎসাহী যুবকের প্রচেষ্টায় চলচ্চিত্র নামের শিল্পটির যাত্রা শুরু হলো। মুখ ও মুখোশ প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলাভাষার কাহিনিচিত্রের স্বীকৃতি পেল। এদেশের দর্শক দেখতে পেল, মঞ্চায়িত নাটক চলচ্চিত্রের পর্দায় সবাকরূপে।

১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন এবং ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্রনির্মাণ-দুটি পর্বই বাঙালির গণজাগরণের ঐতিহাসিক চেতনা এবং সংগ্রামের ফসল। বিশ্বচলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের পথরচনায় কিছুটা দেরি হলেও সাংগঠনিকভাবে তা ছিল যথেষ্ট উদ্দীপক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আবদুল জব্বার খানের নামটি স্মরণীয় হলো বটে, তবুও বাংলা ভাষায় এদেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেও তিনি বরণীয় হতে পারলেন না। কারণ বলা হলো, তিনি চলচ্চিত্রের বিনোদন ধারার জনক। হয়তো তাতে সত্যতা আছে, তবে তার চেয়ে বড় সত্য, এদেশে চলচ্চিত্র নামের গণশিল্পের পথরচনা তাঁর প্রচেষ্টাতেই হয়েছে। সেই দিন থেকে আজ ছয় দশক ধরে বাঙালির জীবনসংগ্রাম ও বিদ্রোহখণ্ড-অখণ্ড অথবা পূর্ণখণ্ডে বাংলা চলচ্চিত্রের উপাদান হিসেবে কদর লাভ করছে। নানা রূপ-জৌলুসে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দ্যুতি ছড়াচ্ছে। যখনই কোনো বিষয়বস্তু দ্যোতিত হয় তখনই ক্ষেত্রবিশেষে তার তাৎপর্য খুঁজে ফেরা শুরু হয়, চলমান থাকে নানা পরিকাঠামোগত সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক তথা সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে বিচারপর্ব। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আজ প্রশ্নবাণে বিদ্ধ। রংরূপের চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা কী? কোন ব্যাকরণিক উপস্থাপনা রীতিতে ঘটে বাংলা চলচ্চিত্রের অঙ্গভরণ? কেন সে পারে না বাঙালি জাতীয়তাবাদে অবদান রাখতে? রূপবান, বেহুলা, জরিনাসুন্দরী, জুলেখা, কাঞ্চনমালা থেকে বেদের মেয়ে জোসনা অথবা সাত ভাইয়ের এক বোন চম্পা নামের চলচ্চিত্র সম্পর্কে এসব প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

ফাগুনের আগুন লাগা ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। এই মাসেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে ‘বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ অথবা ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বাংলাভাষা’ প্রশ্ন শিরোনামে দাঁড়াতে হলো নতুন জিজ্ঞাসায়।

দুই

শিরোনাম কী নির্দেশ করে-সাফাই গাওয়া, নাকি তথ্য উদ্ধার করা, নাকি ব্যর্থতার দায়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, তবে এ-কাজগুলি শুধু চলচ্চিত্রের জন্য নয়, সকল শিল্পের বিচার-বিশ্লেষণে জরুরি। জবাবদিহিতা শিল্পের এক ধরনের দায়। সামাজিক দায়ও বটে। কারণ প্রতিটি শিল্পকে সামাজিক দায়িত্বপালন করতে হয়। স্বীকার করছি, প্রাথমিক শর্তে চলচ্চিত্র তথা সকল শিল্পকলার উদ্দেশ্যই রূপের জগতের প্রসার। বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-এই দুই শক্তির বিচার এক বৈঠকে সম্ভব নয়। কারণ মাধ্যমগতভাবে তারা আলাদা, তবে উদ্দেশ্যগতভাবে সহোদর। ভাষা কখনো অক্ষরনির্ভর, কখনো চিহ্ন বা শব্দনির্ভর। চলচ্চিত্রচিহ্ন, শব্দসহছবি (Culture) নির্ভর, যা স্পষ্টত চলচ্চিত্রের অক্ষর। অক্ষরই মেজশক্তির মাধ্যমেই চলচ্চিত্র মানবইন্দ্রিয়ের প্রকাশ, স্পর্ধা, বোধশক্তি ও চেতনাকে তরঙ্গায়িত করে। চলচ্চিত্র নামের সর্বভূক শিল্পকলার প্রতি সবারই প্রত্যাশা অনেক। সবারই শিখরস্পর্শী ভাবনা ছিল, ১৯৫২-র ভাষা-আন্দোলনের তেজ ও তাপে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সব গাছ ছাড়িয়ে এক পায়ে দাঁড়ানো তালগাছের মতো হবে। বাংলাভাষা-সংস্কৃতির পল্লবিত রূপসমৃদ্ধ সাহিত্য বাঙালির মস্তিষ্ক, চিন্তা ও চলনে থাকলেও চলচ্চিত্র নামের মানব সংস্কৃতি এত ফাঁপরে পড়ে সদা ক্লান্ত কেন? সরল অংকে এর উত্তর খোঁজা যায়। চলচ্চিত্র সংস্কৃতি কি চায়? আলাদা কিছু নয়, চলচ্চিত্র বাঙালি সংস্কৃতির পার্বণিক ক্রমধারার প্রতিনিধিত্ব করতে চায়। শাস্ত্রের তর্কে বাঙালি সংস্কৃতির সংজ্ঞায়ন দীর্ঘ হতে পারে;  কিন্তু চলচ্চিত্র সংস্কৃতির প্রধান অর্থ মানেই একটি ছায়া পর্দায় গল্পদেখা। মঞ্চধর্মী সংলাপ শোনা। ছন্দোবদ্ধ বাণী ও নৃত্যউপভোগ করা। প্রেম-বিরহ অথবা অন্যান্য বিষয় নিয়ে রচিত সংগীত শোনা।

চলচ্চিত্রের আধেয় সমাজের অভ্যন্তরের নানাবিধ বিষয়-আশয় হলেও এর গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয় গণমানুষের সাংস্কৃতিক চাহিদা, যদিও চলচ্চিত্রের গল্পের কেন্দ্রে থাকে মানুষ এবং মানুষের জীবন। ভাষা-শব্দ-সংলাপ নির্ভর মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে বহিঃস্থ কিছু মাত্রাগত দাবি, তা হলো, গল্পের পরিবেশ, প্রতিবেশ, চলচ্চিত্রের শ্রেণিধারা, চরিত্রের ধরন-করণ। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায়। বাংলাদেশে দলিত বর্গীয়জন পদ অথবা কমনজেন্ডার হিসেবে পরিচিত জনের জন্মস্বত্ব এবং জীবনের যোগ-বিয়োগ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তাতে দর্শক শুনতে পায় ভাববাচক, ইঙ্গিত বাচক অথবা সম্বোধনবাচক নানা শব্দ-সংলাপ। ‘চুপি চুপি আয় আজ, ভুলে যাবো লাজ’, ‘রূপসাগরে ডুব মারিয়া করিস কত রঙ্গ’, ‘গপাৎ করে’, ‘টপাৎ করে’, ‘কপাৎ করে’, ‘মাগি’, ‘কামসারছে’, ‘তুইতো ঢাকা ওয়াসা হইয়া গেছোস’, ‘আর তুইতো সাহারা মরুভূমি’ ইত্যাদি একটি নির্দিষ্ট লৈঙ্গিক প্রভাববলয়ের ভাষা। এখানে ভাষা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সামাজিক গঠনে। সবই কার্যকরণগত অথবা বিধিগত (Formal)। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, চলচ্চিত্রের গল্প বলার জন্য এসব আবশ্যিক শব্দভাষা নয়। এক অর্থে অশ্লীল, দ্বিতীয় অর্থে শুধুই চলচ্চিত্রের জন্য বা জারি সংলাপভাষা-উচ্চারণ। একটি চলচ্চিত্রের ইমেজ প্রায়শ ন্যাচারালিজম অথবা রিয়েলিজম দাবি করে। তেমনি চলচ্চিত্রের শব্দ-ভাষা-সংলাপও স্বাভাবিক প্রচলনসই হতে চায়। কমনজেন্ডার ধারার চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত শব্দ-ভাষা স্বাভাবিক চেনাবস্তুজগতের সম্পর্ক উন্মোচন করে, তবে বাস্তবকে অতিক্রম করে নয়। ভাষার বাক্সময়তা চরিত্রের সামাজিক ভূমিকা ও অবস্থানকে নির্দিষ্ট করছে। আপাতত তাই এই সংলাপ-ভাষাকে অশ্লীল উদ্দীপক বলা যায় না।

তিন

চলচ্চিত্রের আবশ্যিক আধেয় হলো সময় ও স্থান। এ-দুটি বিষয়-অধ্যায় চলচ্চিত্রের শব্দ-ভাষা নিয়ন্ত্রণ করে। কখনো সংকেত প্রদানে সমর্থ হয়। যেমন, ‘আরে ও অলক্ষুইনা মাইয়া, আরে ও অপয়ামাইয়া, আরে ও বাসন্তী [….] তুই আমারে জ্বালাইয়া খাইলি। এই আনমনে বন বাদাড়ে ঘুরোস কা?’ মা ও বাসন্তী নামের মেয়েটির তিতাসপাড়ের দৃশ্যপট এটি, যেখানে আখক্ষেতের ভেতর দিয়ে পুরুষালি ভঙ্গিতে বাসন্তীর হেঁটেআসা এবং মায়ের সামনে পড়ায় তৎপর মায়ের খিস্তি। এই সংলাপ ভাষায় নিজ কন্যার প্রতি মায়ের অশ্লীল ইঙ্গিত ভাব অনুসন্ধানের সুযোগ নেই। তিতাস একটি নদীর নাম চলচ্চিত্রের নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটক সংলাপ দ্বারা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, বাসন্তী নামের নারী মালোপাড়ার নিকৃষ্ট কোনো চরিত্র নয়, মালো জনগোষ্ঠীর ভাগ্যাহত নারীর একক সত্তা। নিত্যদিনের গালমন্দের শব্দ-ভাষায় তিতাস একটি নদীর নাম-এ নিম্নবর্গের মানুষের চরিত্র অঙ্কন করেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। চলচ্চিত্রে মানুষের কথা, মানুষের ভাষা সর্বদাই দর্শক, পাঠক অথবা শ্রোতার মনে আঁচড় কাটবে। মানুষের কল্পনাসমৃদ্ধ জগৎ তোলপাড় করবে। ভাষা পাবে বাহবা। তবে সবক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না।

যাঁরা গল্প-উপন্যাস লেখেন, তাঁদের সুবিধা হলো, নির্দিষ্ট কিছু বোধের কিংবা চিন্তাপ্রবাহের তীব্র দ্যুতিময় প্রকাশকেতাঁরা শব্দ, চিহ্ন, ইঙ্গিত, মেটাফোর-মেটোনিমিতে ধারণ করতে পারেন। সাহিত্যে ‘কুকুর’, ‘কুত্তা’, ‘কুইত্তা’ যে-শব্দই আসুক না কেন, এই শব্দের মূল ভাবে নিস্পৃহতা, অনুযোগ, ঘৃণা, বিরক্তি, অবহেলা ইত্যাদি নির্দেশ করে। তবেচলচ্চিত্রেও যে তা সম্ভব তার প্রমাণ আমার দেখেছি। যেমন : কথ্যরীতির ‘কুইত্তা’ শব্দটি একটি নারীর বেদনা-ব্যঞ্জনাকে তীক্ষè থেকে তীক্ষèতর ইঙ্গিতরূপে প্রকাশ করতে সমর্থ হয় চলচ্চিত্র। ঋত্বিক কুমার ঘটক তিতাস একটি নদীর নাম-এ তা দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দিয়েছেন। সন্তান স্নেহকাঙাল বাসন্তীকে ছেড়ে উদয়তারার সঙ্গে এতিম অনন্তের দূরগ্রামে চলে যাওয়ার দৃশ্যে একজন নারীর দুঃসহ অপমান ও মনোজগতের দ্বান্দ্বিকতা প্রকাশে বাসন্তীর কণ্ঠে ‘কুইত্তা’ কথাটি তিনি জুড়ে দিয়েছেন। নারীকে অঝোর বৃষ্টিধারায় দাঁড় করিয়ে ঘৃণা প্রকাশের শব্দটি জীবনজিজ্ঞাসার একটি মেটাফোর সৃষ্টি করেছে। বাংলা চলচ্চিত্রে এক মহাকাব্যোচিত উদাহরণ এটি।

চলচ্চিত্রের ভাষা নির্মিত হয় নির্মাতার বোধের অভ্যন্তরীণ তাগিদে। পাঠকের দৃষ্টি চলচ্চিত্রের মশলা গীত অথবা আইটেম সং-এর দিকে স্থির করা হলে সংগীত ও গীতশব্দের সম্মোহনে কেমন ভাষা সৃষ্টি হয় তার ধারণা দেওয়া সহজ হবে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সবদেশেই চলচ্চিত্রে মশলাগীত অথবা আইটেমসং-এর ভাব-ধারণা ও উদ্দেশ্য মূলত একই : রমণীর রমণীয় দেহ প্রদর্শন, যৌনতাবোধ জাগানো, দর্শকের আবেগীয় বিচলন ঘটানো। দৃশ্যের নৃত্যভঙ্গি, আলোর মৃদু বা তীব্র ঝলকানি, দেহাঙ্গের উদ্দেশ্যমূলক ভঙ্গি, চোখ ও ঠোঁটের কামার্ত প্রকাশ, দৃশ্যপরিকল্পনা-সবকিছুই দর্শকদের আমোদিত করার উপকরণে সাজানো হয়। মশলাগীত দৃশ্যপটই একধরনের উদ্দীপক ভাষা তৈরি করে। ‘সুজন আমার আসবে কবে যাকে খুঁজে মরি/ আমি ডানা কাটা পরি’ –এই গীতবাণী সরল হলেও চলচ্চিত্রের দৃশ্যভাবে উদ্দীপক আবেগ ছড়ায়, যা সম্ভব হয় দৃশ্যমান রূপধর্মে, সংগীতের সম্মোহন রূপকল্পে অথবা সংলাপের অনুভবগত তাৎপর্যে।

চার

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ইতিহাস এসেছে, হাজার বছরের দেশজ সংস্কৃতি থেকে। আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে চলচ্চিত্রের ভাষা মাধ্যমটিকে সমৃদ্ধ করেছে। পাশাপাশি বাংলা ভাষা চলচ্চিত্রের সহায়ক শক্তির ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে অশ্লীল শব্দ ও ভাষারও অভাব নেই, যা রুচির অভাবকেই তুলে ধরে। যেমন : ‘হিন্দু মেয়েদের গায়ে নাকি কটুগন্ধ? শুনেছি মাদী কুকুরের মতো।’ চলচ্চিত্রের সংলাপে, ‘হিন্দু আউরত মিলগিয়ারে। ও I am getting hot now ইত্যাদি। এখানে সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশটাও লক্ষণীয়।

ভাষা একটি সংস্কৃতির পরিবর্তনের ভূমিকায় সরব থাকে। আবার সংস্কৃতিও তাকে প্রভাবিত করে। কিছু লোক শব্দতার প্রমাণ, যেমন-কৃষ্ণমালা, সাইজ, ভাঙ্গারি, হালকা, চিকা- এ-ধরনের সংকেত-শব্দ অপরাধজগতের ভাষা। ঐতিহ্যবাহী ফোকলোর একটি জাতির অতীত এবং বর্তমানকে সমন্বিত করে। ফোকলোর অনুষঙ্গপ্রবাদ-প্রবচনশিল্প-সাহিত্য তথা চলচ্চিত্রের উপাদান হয়েও বিশেষায়িত এবং বিশ্লেষিত হওয়ার দাবি রাখে। ১৯৬৫ সালে ছিল উর্দু চলচ্চিত্রের দাপট। সে-সময়ে বাংলা ভাষায় বাংলার অতি সাধারণ মানুষের গল্পে নির্মিত হলো রূপবান। তৎকালীন বাংলাদেশের মানুষের মূল্যবোধ, বিশ্বাস, সংস্কার এবং একজন লোকনারীর ত্যাগ-তিতিক্ষার কাহিনি বাংলার দর্শককে চমৎকৃত করলো। দ্রোহচেতনায় বাংলাভাষার মানুষকে আলোড়িত করলো। সেই আলোচিত চলচ্চিত্র রূপবান থেকে বেহুলা হয়ে বেদের মেয়ে জোসনা, অতঃপর খায়রুনসুন্দরী। আজো সেই চলচ্চিত্র বাঙালি দর্শকের মনোজগতের সঙ্গে সম্পর্কিত। চলচ্চিত্রের পর্দায় যখন লোকসংগীত, ছড়া, প্রবাদ-প্রবচনে লোকজ বাংলার শব্দ-সংলাপ শোনা যায়, তখন বাঙালির চিন্তাজগৎ আদিম গুহাচিত্র দেখার মতো স্মৃতিতাড়িত হয়ে পড়ে। যেমন, ‘সোনার চান পিতলা ঘুঘু’, ‘মেরেছো কলসির কানা তাই বলে কি প্রেম দেবো না’, ‘বাপের ধন, হাপেরে দিয়া খাওয়ায়’, ‘সাত গোষ্ঠী ঠেঙ্গের তলানা পায়ের ধুলা’, ‘মানুষের কুটুম আহনে যাওনে, গরুর কুটুম লেহনে পোছনে’, ‘মা মরলে বাপ তালই’ ইত্যাদি চিত্তকেস্পর্শকরা মনস্তাত্তিকভাব-ভঙ্গিমার বাংলা বচন। দর্শকমনকে তৃপ্ত করে। দর্শক জানতে পারে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর চৈতন্যে সাড়া দেওয়া আবহমান বাংলার লোকসংস্কৃতির অভিপ্রায় দর্শকের কাছে ফোকলোর সংজ্ঞায়িত হয় লোকজীবনের জীবনদর্শনের প্রতিফলন হিসেবে। লোক সংস্কৃতির উপাদানে নির্মিত মাটির ময়না চলচ্চিত্রে দর্শক গীতবাণীতে ভাববাদী দর্শনের মাঝে কৌতুকের সন্ধান পায়। যেমন, ‘ফকিরেরা জিকির করে নামাজ ফাঁকি দিয়া।’ সূর্যদীঘল বাড়ীতে পরিচালক শাকের নিয়ামত সংলাপ দ্বারা ধর্ম ও সমাজকাঠামোর ভেতরকার দ্বন্দ্বরূপ হাজির করেন। পঞ্চাশ সালের আকালে যখন বাংলার মানুষ বিপর্যস্ত, গ্রামের বয়স্ক মহিলা রোজার মাসে বলছেন, ‘আকালের দিন আবার কিসের রোজা।’ বাংলা ভাষায় এমন তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবাদ ধ্বনিত সংলাপ বহুকাল নিম্নজনেরস্মৃতিতে সজীব থাকার মতো বিষয়।

পাঁচ

সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রের ভাষার পার্থক্য নির্ণয় বর্তমান রচনার উদ্দেশ্য নয়। তবে যে-কোনো অক্ষর ভাষার সহায়ক হয় অযুত শব্দ; বাক্য গঠনে সংকোচন-প্রসারণ-সংযুক্তি-বিয়োজন এবং বস্তুবিষয়ের ভাবগত, স্মৃতিগত, বিশ্বাসগত কিংবা রহস্যগত অনন্তরূপ প্রকাশে ভাষার কারুদক্ষতা যতটা আবশ্যিক, ততটাই স্বতঃসিদ্ধ। তবে চলচ্চিত্রে অক্ষরভাষাততটা আবশ্যিক নয়। চলচ্চিত্র নিজেকে প্রকাশ করে দর্শককে কৌতূহলী করে তোলে নিজস্ব ভাষার প্রয়োগ ও শাসনে। এটাই চলচ্চিত্রের নিজস্ব চলন-বলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বীকার করেছেন, ‘ভাব চলাচলের পথ হইল ভাষা।’ চলচ্চিত্রের ভাব চলাচলের পথ শুধু ভাষা নয়, চলচ্চিত্রে অক্ষর-ভাষা পল্লবিত হওয়ার সুযোগ সীমিত, যতটা উন্মুক্ত সাহিত্যের নানা শাখায়। চলচ্চিত্র ভাষার শক্তিতে পদ্মপুরাণে স্থান করে নেওয়া পুরাণকালের লোকজীবনের চিত্রটি জহির রায়হানের চলচ্চিত্র ভঙ্গিতে হয়ে উঠলো দর্শকের কাছে মানুষের কাব্য। বাসর শয্যায় লখিন্দরকে কালনাগিনী দংশন করলো। স্বামীর এই বিপদ দেখে বেহুলার ‘না’ শব্দটিপরিচালক ১৯টি নানা দৃষ্টিকোণের শটের সংযোজনে গগনবিদারী আর্তনাদে দর্শকদের সামনে হাজির করলেন। মঙ্গলকাব্যের বিশেষণযোগ্য বর্ণনা চলচ্চিত্রের মন্তাজ ভাষার অলংকরণে নতুন মাত্রা পেল। এখানেই চলচ্চিত্র ও ভাষা-সংস্কৃতির বিভেদরেখা। চোখেদেখার শিল্প চলচ্চিত্র, যেখানে মানুষের মৌখিক ভাষা মুখ্য বিষয় নয়।

সংলাপের উদ্দেশ্য নির্ধারিত থাকে। সংলাপ ধারণা দেয়, প্রকাশ করে গল্পের আগাম বার্তা, চরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাত, কখনো সংঘাত। অথবা চরিত্রের অভিপ্রায়, অনুভূতি কিংবা অন্তর্গত প্রবৃত্তি। বাক স্ফূর্তির কারণে একই ভাষায় অন্য ভাষার অনুপ্রবেশ সাদরে গৃহীত হয়; কিন্তু একজন পরিচালক চাইলে সংলাপহীন ভাবে নিঃশব্দেই সবধরনের ভাবান্তক বিষয় চলচ্চিত্রে প্রকাশ করতে পারেন।  প্রয়োজনে তাকরেও থাকেন। অর্থাৎ বিষয়টা এই দাঁড়ালো, মানুষের মৌখিক ভাষা গুণের চেয়ে চলচ্চিত্রের নিজস্ব দৃশ্যরূপ ভাষা অনেক বেশি ক্ষুরধার হতে পারে, যদি চিত্রনাট্যকার ও পরিচালকের থাকে উঁচুমাপের দক্ষতা।

ছয়

সামাজিক বাংলা চলচ্চিত্রের দৃশ্যপরিপ্রেক্ষিত কেমন হতে পারে তার একটি আলাপ সেরে নেওয়া যায় একটি চলচ্চিত্রকে মাথায় রেখে। চলচ্চিত্রে রূপায়িত সংসারের মা চরিত্রটি রংপুরের গৃহস্থকন্যা। বাবা পশ্চিমবঙ্গে পড়ুয়া আইনব্যবসায়ী। গৃহভৃত্য নোয়াখালীর। মিশ্রভাষারীতির সংসারে সংলাপ হবে অবশ্যই মানানসই মুখের ভাষা। চলচ্চিত্রকে টিকে থাকতে হয় বাজার ব্যবস্থাপনার দক্ষতাকে সম্বল করে। তাকে হিসাবে নিতে হয় দর্শকের প্রকাশ্য ও গুপ্ত আকাক্সক্ষাগুলিকে। ভাষায় শ্রীবৃদ্ধি নানান প্রকরণভেদে ঘটে-শব্দ, বাক্য, ধ্বনিবাছন্দ ও অলংকারপ্রকরণে। যেমন, ‘খসিয়া আসমানের চান্দ ভুঁয়েতে পড়িল। কেউ বলে বনের লক্ষ্মী বনবাসে আইল’ (কাঞ্চনমালা)। চলচ্চিত্রের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেই মেজের মায়া জাল বিস্তারে। মায়াজালে জড়ানো থাকে মানব, মানবের সামাজিক সংগঠন, পরিবেশসংকট, সংঘাত, তার সম্পৃক্তির অথবা বিছিন্নতার নানা সম্পর্ক। একই মানুষ একই কণ্ঠে, নানান ভঙ্গিতে নিজস্ব প্রয়োজনে ভাষাকে ব্যবহার করে। চলচ্চিত্রের দর্শক তা গ্রহণও করে। ভাষায় মানুষে মানুষে সম্পর্ক তৈরি হয়। তেমনি লৈঙ্গিক প্রভাবও ভাষা নির্বাচনে ক্ষমতা রাখে। কখনো পরিবেশ ভাষাকে বিপথগামী করে; কিন্তু চলচ্চিত্রের নারীচরিত্র সর্বদাই যেন শিষ্টতার কারণে নিজেদের ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ রাখে। সহসা সাধারণত নারীর কণ্ঠে শোনা যায় না যৌনতাসূচক অথবা বিকৃতস্বর-শব্দের ভাষা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রেমিকা তার প্রেমিককে যখন বলে, ‘আমাকে যদি দেখতে মন চায় বাংলার মুখ তুমি দেখেনিও।’ এখানে নারীচরিত্রটির ভাষা ভাবমূলকতায় রসিয়ে-ঘুরিয়ে বলা হলো।

কিন্তু বিপথগামী পুরুষচরিত্রের মুখের ভাষা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। চলচ্চিত্রে খলনায়ক চরিত্রগুলি তাদের আচারভঙ্গি ও উচ্চারিত সংলাপ দিয়ে তাদের লৈঙ্গিক প্রভাব বিস্তার করে। তাদের কথনশৈলীতে থাকে একধরনের সিগনেচার টোন। তবে তাদের শব্দে-সংলাপে-বাক্যে দর্শক শৃঙ্গাররসের আনন্দময়তা লাভ করে। বিশেষ কোনো চরিত্রের সংলাপের অর্থ হেরফের শুধুচ লচ্চিত্রের দৃশ্যধারণার কারণে ঘটে। যেমন, একজন গ্রাম্যবালক তার মাকে যদি বলে, ‘পুকুরে সাঁতার কাটমু’, তার ভাষা সরল একটি ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু যখন চলচ্চিত্রের পর্দায় কোনো সুন্দরী কন্যাকে আটকে রেখে ভিলেন চরিত্র উদ্দেশ্যমূলক অভিব্যক্তিতে বলে, ‘পুকুরে সাঁতার কাটুম সারারাত […]।’ তাহলে ভাষার অর্থ প্রকাশ দৃশ্যগ্রন্থনার কারণে বদলে গেল। এভাবেই বাংলাভাষার অনেক শব্দ-বাক্য শ্লীলতা হারিয়ে চলচ্চিত্রে অর্থবিভ্রান্তি ঘটায়। উদাহরণ- ‘কবুতরের বাচ্চা’, ‘তাফলিং’, ‘দিবোরে হান্দাইয়া’, ‘যাবি আমার লগে পাটক্ষেতে’, ‘হুমামারাশেষ’, ‘আমারটা দেখায়’, ‘পোস্টমর্টেম কইরা দিমু’ ইত্যাদি। 

সাত

কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় সমৃদ্ধ বাংলা ভাষায় শব্দের কত চমৎকার স্বার্থবোধক অর্থ সমাহার। ‘অন্ধকার দিয়ে ঢাকে লাল দিঘির লাল অন্ধকার’ (বিষ্ণুদে), অথবা ‘শুকনো রুটি খায় তৃষ্ণার জলে’ (শামসুর রাহমান)। উপমা-ইঙ্গিতে, যাপিত অভিজ্ঞতায় কল্পসূক্ষ্মতায় বাংলাভাষার শব্দগুলোর ন্যায্য প্রতিপাদন ঘটে, যেখানে অস্ত্র ভাষা, রাষ্ট্রের দমন ভাষা সবই ব্যর্থ হয়ে যায়। বাক্যের নকশায় অথবা অনবদ্য ভাষাশৈলীর কারণে কিংবা নিরীক্ষাধর্মী ব্যঞ্জনময়তার গুণে হাসান আজিজুল হক অথবা সৈয়দ শামসুল হক পাঠকের মগ্নচৈতন্যে টংকার তোলেন। ওরহান পামুকের এক বর্ণনায়, পাঠক মনোজগতের এক গভীর তলে পৌঁছে যায় : ‘আমিএকগলিত শবকুয়োর তলায় পড়ে আছি। অনেক আগেই বুকের ধুকধুকানি শেষ হয়ে গেছে। এমনকি শেষ নিশ্বাসও। ওই জঘন্য খুনিটা ছাড়া সত্যি আমার কী হয়েছে তার খবর আর কেউ জানে না (সংগৃহীত)।’ এসব যেন শাব্দিক চিত্রায়ণ। কবিতার তাত্ত্বিকগণ বলেন, কোনো একটি কবিতা একমাত্র সেইকবিতাটির জন্যই লেখা হয়, আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। এখানে কবি সৌন্দর্য অথবা নিজ স্বভাব প্রকাশে স্বাধীনতা লাভ করলেন, তার শব্দাবলির উচ্চারণ-ধ্বনির নিপুণ ব্যবহার করলেন, গাঢ়তর ব্যঞ্জনা সৃষ্টির প্রয়াসে কবি লিখলেন,

কেতকী কেশরে কেশ পাশ করো সুরভি

ক্ষীণ কটি তটে গাঁথি লয়ে পরো করবী

(‘বর্ষামঙ্গল’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

তবে চলচ্চিত্রের চরিত্রদের ভাষাতেও সমুন্নতির অনেক উদাহরণ রয়েছে। এর সংকটকালেও কিছু শব্দ ব্যবহারের যেমন আছে উদাহরণ, গল্পের রোমান্টিক পর্বেও চমৎকার ভাষায় আশাবাদ ব্যক্ত করার বিষয়টি উপেক্ষিত নয়। এই ধরনের পরিবেশধর্মী শব্দসম্ভার প্রীতিপদ ভাবধ্বনিতে চলচ্চিত্রের দৃশ্যে সম্মোহনী প্রভাব বিস্তার করে। দর্শকের আবেগ-অনুভূতিকে উচ্চকিত করে। যেমন, মাটি ও মানুষের মৌখিক ভাষার রচনা, ‘আজ পাশা খেলব রে শ্যাম, ও শ্যামরে তোমার সনে।’ এখানে শ্যাম, পাশা খেলা প্রেম বিষয়ক যোগাযোগ বার্তা বহন করে, যেহেতু মানুষের মনোজগতের সঙ্গে তার সম্পর্ক। কিন্তু এর বিপরীত প্রকাশও আছে। যেমন, গীতটি যখন চলচ্চিত্রের হিংস্র মানুষটি অসহায় নারীচরিত্রটিকে জাপটে ধরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে গায়, কোনো কোনো দর্শক তা দেখে উল্লাস প্রকাশ করে। ভক্তিভাবের, অনুভবের অথবা মনোযোগের ভাষার গীতটি হয়ে যায় পতনমুখী। থাকলো না রেফারেন্সিয়াল কোনো ধারণা। সংকেত সংশ্রয় পুরোটাই বদলে গেল। কার্ল মার্কস বলেছেন, ভাষা হলো চৈতন্যের মতো, যা উদ্ভূত হয় প্রয়োজনে অন্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার তাগিদে। চলচ্চিত্রের নৃত্যদৃশ্যে শুধু যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা হলো না, ভাষিক অবরোধও তৈরি করা হলো। তাতে চলল নিপীড়নমূলক আচরণ। দৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিত দর্শকদের তেমনই অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করায়।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বারবার এই ধরনের দৃশ্য-ঘটনার আবশ্যিকতা কেন? এদেশের চলচ্চিত্র কোন শ্রেণির দর্শকের চাহিদা, চিন্তা-চেতনার খোরাক জুগিয়ে চলে? বলতে গেলে কৃষকের, নিম্নবিত্তের। পরে যোগ হয়েছে নগরকেন্দ্রিক শ্রমজীবী। এই ধরনের হিসাব-নিকাশ শুধু এদেশেই নয়, এই উপমহাদেশ এবং অন্যত্রও। শুরু থেকেই চলচ্চিত্র ছিল সাধারণ মানুষের বিনোদনের বিষয়। তবে চলচ্চিত্রকে অভিজাত শ্রেণিতে দাঁড় করাতে অথবা রুচিবানদের প্রেক্ষাগৃহমুখী করতে জনপ্রিয় মঞ্চনাটক, বিশেষ সাহিত্যকর্মের চিত্রায়ণ হওয়ার ইতিহাস আছে। বাংলাদেশের দর্শকশ্রেণির সুনির্দিষ্ট আকাক্সক্ষা কী? নিশ্চিত করে তা বলা মুশকিল। কিন্তু মোটা দাগে বলা যায়, সাধারণ দর্শক অজটিল গল্পই চায়। যে-গল্পের নায়িকাকে হতে হবে স্বাস্থ্যবতী। এটাই অপুষ্টি-অনাহারে থাকা কৃষক-শ্রমিকের কাছে সৌন্দর্যের মনগড়া সংজ্ঞা। ঐতিহ্যগত ধারণা। অথবা অতিকল্পনা। তাদের ধারণায়, চলচ্চিত্র বুঝে নেওয়ার কিংবা উপভোগ করার সংস্কৃতি। এসবকে পুঁজি করেই পেটি বুর্জোয়া জুতসইভাবে চলচ্চিত্রের শব্দ-সংলাপ-ভাষায় নয়-ছয় করে যাচ্ছে। বাংলা ভাষা নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। যেমন, মার্কিন মুলুকের চলচ্চিত্রে সর্বদাই দেখা যায়, যন্ত্রদানব আর অতিমানবের মারাত্মক মোহ জাল বিস্তার করা কাল্পনিক জগৎ।

প্রতিপাদ্যসার

চরিত্রের মান-ভান-ভঙ্গিতেও ভাষা আছে। রঙ্গ-কৌতুকে সৌন্দর্য আছে। থাকে ভিন্নতর ইঙ্গিত, প্রতীকী তাৎপর্যসহ বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা, যা আক্ষরিক অর্থকে অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। অনেক চিত্রশিল্প একরৈখিক দৃষ্টিকোণে সরলপাঠে অর্থউদ্ধার করা কঠিন। শিল্পী বিভিন্ন রং মিশ্রণে ভাষাগত উপকরণগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় আনার চেষ্টা করেন। বিশৃঙ্খলার মাঝেই শৃঙ্খলা খোঁজা শিল্পীর শাশ্বত পিপাসা। প্রকৃতির মাঝে যেমন স্বাভাবিক শৃঙ্খলা থাকে, যে শৃঙ্খলার বিনাশ ঘটায় প্রযুক্তি, তেমনি ভাষারও শৃঙ্খলা ভাঙা আছে, বাঁকপরিবর্তনে নতুন পথ খুঁজে পাওয়ার ঘটনা আছে। অনেক ভাষা হারিয়ে যায়, কিন্তু যাওয়ার আগে পর্যন্ত তার চলমান তাকে ধরে রাখে। কোনো শিল্পের অথবা ভাষার চূড়ান্ত বলে কিছু নেই। তার সমাজের অবয়ব যেমন নির্মাণ করে অর্থনীতি, সেই সমাজের সংস্কৃতির এক মাধ্যমই তো চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র একা চলে কিকরে? চলচ্চিত্র চালিত হয়। চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। যতই দর্শক ধারণা করে, চলচ্চিত্র হলো বুদ্ধিজাত এবং অনুভবজাত পারসেপশন, সার্বিক অর্থে চলচ্চিত্র একটি অপারেশন সিস্টেম, যার নিজস্ব ভাষাশক্তি এবং চলনপদ্ধতি আছে। চলচ্চিত্রে কনটেক্সটেরও একধরনের কম্পন আছে। চলচ্চিত্র স্থূল অবয়বের হতে পারে। যদি স্থূল অবয়বের চলচ্চিত্রেরই সংখ্যা বাড়ে তার কথ্য ও কাঠামোগত ভাষায় অবনমন হবে। হয়তো আগামীতে এর ব্যাপ্তি আরো বাড়বে, অথবা, কে জানে, মান ও রুচির ঘরে উন্নতি ঘটবে।

গোলকায়নের আহ্বানে সাড়া দিতে আমরা সবাইইঁদুর-দৌড়ে যখন ছুটছি, তখন চলচ্চিত্রকে নানা শিরোনামে প্রশ্নের দাঁড়িপাল্লায় না রেখে একধরনের উদ্দেশ্যবোধক সমঝোতা বোধে আসা যায়।

যাঁরা চলচ্চিত্র বোঝেন, যাঁরা চলচ্চিত্র ভাষা রপ্ত করেছেন। যাঁরা চলচ্চিত্র বোঝেন না, অথচ বোঝার ভান করেন, কিংবা একদমই বুঝতে চান না, তারপরও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, তাঁদের সবার সমঝোতা। কেন এই সমঝোতা? কারণ সংকেত আসছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বাংলাভাষার অবনমন ঘটাচ্ছে। অধ্যপক আনিসুজ্জামান নিজেই স্বীকার করে গেছেন, ‘বাংলা ভাষা ব্যবহার নিয়ে আমাদের বিভ্রান্তি ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একতলা দোতলা হচ্ছে প্রথম তলা, দ্বিতীয় তলা।’

সর্বক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার সংকটকাল। সেখানে চলচ্চিত্র কি আক্রান্ত হবে না? হতেই পারে। ভাষার সঙ্গে সখ্য করেই চলচ্চিত্রকে ভ্রমণ করতে হয়। তাহলে প্রাথমিক ভাবে ধরে নেওয়া যায়, বাংলা ভাষা সংকটে আছে। দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্রের সামষ্টিক কর্তাসত্তাকারা, কী চায় তারা, তাদের চেতনা কিংবা ভাষা অনুমান কেমন, চলচ্চিত্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের শর্তগুলো কী, কীভাবে তারা চলচ্চিত্র ইতিহাসে যুক্ত থাকতে চায় এবং চলচ্চিত্র সেই চাওয়ায় কেন শক্তিখুঁজে পায় ও এতো বিরোধমূলক প্রশ্নের মীমাংসাই বা কী। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আজো বাঙালির গোত্রীয় রক্তের আনুপাতিকহার অনির্ণীত। যারা বাংলা গদ্যের সূচনালগ্নে সংস্কৃতানুগ ভাষা দিয়ে নিজেদের সভ্যতা গড়ে তোলে এবং তারা প্রতিদিনের ভাষাকে ছন্দিত করার পরিবর্তে স্থূল করছে, তাদের ভাষাগত বিচ্যুতি থাকতেই পারে। তাদেরই থাকবে, যারা নিজেদের জীবনযাপনে নিজের মতে তৃপ্ত থাকে। বাঙালি বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রে ছিল বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষা।  সেই পরিপ্রেক্ষিত দাবিতে ১৯৭২ সালে সংবিধানে লেখা হলো প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সংবিধানও লেখা হলো বাংলা ভাষায়, তবুও কি আমরা ভাবতে পেরেছি বাংলা নামের রাষ্ট্রেরও ভাষারীতি থাকা আবশ্যক। ভাষার অপমৃত্যু রোধ করতে হলে ভাষা সংগঠন জরুরি। চলচ্চিত্র যেমন ঐতিহ্যবাহিত তেমনই সমাজাচরণের চিহ্নবাহিত শিল্পকলা। সেই সমাজের অংশ হলো মানুষ। চলচ্চিত্রের কারণে সমাজ, সভ্যতা অথবা ভাষা-সংস্কৃতির স্খলন-পতনের দায়ভার চলচ্চিত্রের মানুষেরই। কোনোরূপ বিদ্যায়নয়, চিহ্নবিদ্যায়নয়, অথবা জটিল কোনো তত্ত্ব বিদ্যায়নয়, চলচ্চিত্রে বাংলাভাষার সমুন্নতি একধরনের অনুশীলনকর্ম। কারণ চলচ্চিত্র নিজে দাবি করে তার নিজস্ব ভাষাশক্তির কথা। ভাষাশক্তিকে আরো বলবান করার জন্য চলচ্চিত্রকে নিজের দিকে তাকাতে হবে।