চিত্রকলার ভাষা

চিত্রকলার ভাষা নিয়ে আলোচনাটা দীর্ঘদিনের। আমরা অনুমান করতে পারি আদিম কোনো গুহার গায়ে শানিত পাথর অথবা ধাতুর আঁচড়ে একটা ছবি যখন আঁকা হতো, অথবা গাছের বাকলে বা মৃত পশুর ছড়ানো চামড়ায়, তখনই তো প্রশ্নটা জাগত : ছবিটা কিসের? হয়তো কোনো প্রাণীর, না হয় চেনা কোনো বস্তুর, কিন্তু এরপরের প্রশ্নটা হয়ে দাড়াত : কী বলতে চাইছে ছবিটা? ভয়, স্বস্তি, প্রশান্তি, নাকি শুধুই আঁকার আনন্দের কথা? ছবিটা তার নিজের পরিসর ছেড়ে বাইরের জগতের সঙ্গে একটা সম্পর্ক যে গড়ে নিয়েছে দর্শক তা বুঝেছেন, দর্শক একজন হলেও, অর্থাৎ যিনি ছবিটা এঁকেছেন শুধু তিনি হলেও; কিন্তু কিভাবে? প্রকৃতিতে চরে বেড়ানো প্রাণীটি কি যথাযথ আদল পেয়েছে ছবিতে, তার চরিত্রটার কি অদল-বদল হয়েছে? যদি হয়, কেন? ধরে নেওয়া হলো একটি বুনো প্রাণীর ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছবিতে, তাহলে তার শক্তি অথবা অদম্যতা মুখ্য হয়েছে, নাকি তাকে বাগে আনার একটা ইচ্ছা, অথবা যে উত্তেজনা বা ত্রাস সে সৃষ্টিকরে সামনাসামনি পড়ে গেলে, তা?

এই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর লুকানো আছে ছবিটিরভাষায়। কিন্তু ছবির ভাষার কোনো সুনির্দিষ্ট বাক্যবিন্যাসনেই, মুখের ভাষায় যা আছে; কোনো শব্দভাণ্ডার নেই, মুখের ভাষায় যা আছে; প্রকাশ-বহুত্বও নেই, মুখের ভাষায় যা আছে। প্রশ্ন হলো, এগুলো যদি না থাকে, তাহলে ছবির ভাষা আমরা কিভাবে বুঝি? এমনকি বিমূর্ত ছবির? এর উত্তর অনেক শিল্পী, শিল্পতত্ত্ববিদ এবং সমঝদার অনেকভাবে দিয়েছেন। অনেকে বলেছেন, ছবির শব্দভাণ্ডার তার রং; তার বাক্যবিন্যাস হচ্ছে তার আকার আর ফর্ম-বা রূপসমূহের বিন্যাস; তার প্রকাশবৈচিত্র্য নিহিত আছে তার নানা চিহ্ন ও প্রতীকে, টেক্সচার এবং আলোছায়ার খেলায়, তার বর্ণতলের ব্যাপ্তিতে। নৈঃশব্দ্যের যে রকম ভাষা আছে-যা শব্দের সঙ্গে জড়িত নানা উপস্থিতিকে এড়িয়ে বা তাদের বিপরীতে গিয়ে এক অনুপস্থিতির জায়গায় আমরা আবিষ্কার করি; যা নেই তা বেশি করেই যেন ধরা দেয়; ছবির ভাষাও নির্ধারিত হয় উপস্থিতি-অনুপস্থিতির দ্বন্দ্বে অথবা দ্বৈরথে; দেখার প্রচলিত পথের বাইরে গিয়ে করা দৃষ্টিপাতে। ছবির ভাষায় ছায়া ফেলে, তাকে নির্মাণ করে, ছবির বাইরের জগৎ -যেমন করত গুহাচিত্রের ভাষানির্মাণে। কবিতা-গল্প-গানের মতো ছবিও মানুষের মনকে কেন্দ্রে ধারণ করে-মানুষের মনকে বাইরে রেখে ছবি তৈরিহয় প্রকৃতিতে, যেমন এক অপূর্বসূর্যাস্ত-কিন্তু এই ‘অপূর্ব’ কথাটিই প্রমাণ করে সেটি দেখার সময় মানুষের মন তা নিজের দখলে নিয়ে আসে। ছবিতে শিল্পীর আবেগ-অনুভূতি এবং তার মনস্তত্ত্বের নানাদিক প্রকাশিত-সব একসঙ্গে না হলেও, অথবা সীমিত পরিসরে হলেও। মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে তার সময়, সমাজ, পরিপাশর্^; তার ঘর থেকে নিয়ে রাষ্ট্র, সর্বত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা, সেগুলোর অভিঘাত অথবা সেগুলো এড়িয়ে চলার চিন্তা। মানুষের তৈরি সাহিত্যে এবং চিত্রকলায় সেগুলির প্রতিফলন পড়বেই-কখনো, কোনো যুগে সরাসরি, কখনো প্রতীক-রূপক-উপমা-উৎপ্রেক্ষার আবরণে অথবা আড়ালে। কোনো কোনো সময় সেই প্রকাশে নৈর্ব্যক্তিকতা থাকে, যখন বাস্তবকে নিরাবরণ এবং নিরাভরণ দেখানোর একটা প্রয়োজন দেখা দেয়; কোনো কোনো সময় সেই বাস্তবকে নানা কোণ থেকে দেখে, তার ভেতর ও বাইরের নানামাত্রাকেউন্মোচিত করে তার প্রকাশ্য-অন্তঃস্থিতরূপগুলোকেচিহ্নিতকরার চেষ্টা চলে। সাহিত্যে সেসব প্রয়াস সহজে প্রকাশ সম্ভব, যেহেতু লিখিত ভাষার একটা নিজস্ব ভুবন আছে। সমাজের মানুষ নিজেদের সঙ্গে যোগাযোগের, একে অপরের কথা বোঝার একটা পদ্ধতি তৈরি নেন, যার মাধ্যম ভাষা। ভাষা জন্ম থেকে একটা উত্তরাধিকার হিসেবে মানুষ পায়, সেই ভাষায় তার প্রথম কথা ফোটে, তাতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সে যোগাযোগ সক্ষমতাবাড়ায়। এজন্য ভাষার কাঠামোটি একটাসামাজিক সম্মতির মধ্য দিয়ে স্থিতিস্থাপকতা অর্জনকরে। এ সবই আমাদের সাধারণ জ্ঞানের বিষয়। কিন্তু ছবির ব্যাপারে আমরা এই কথাগুলো বলতে পারি না, যদিও কোনো কোনো ভাষায় ছবি চিহ্ন শব্দের জায়গা নেয়। বলা যায়, ছবি থেকে তৈরি হয় শব্দ। তবে ভাষাবিদরা (যেমন সুইস ভাষাবিজ্ঞানী ফার্ডিনান্ডস্যসুর) বলেন, ভাষার শব্দচিহ্নগুলোর সঙ্গে তাতে নির্দিষ্ট বস্তুর সম্পর্কটা সহজাত নয়, তা অপ্রকৃত। একটি গোলাপকে যে নামে ডাকি না কেন তা যদি গোলাপ হয়, তাহলে ‘গোলাপ’ কথাটার সঙ্গে ওই নামের ফুলটির সম্পর্ক আপতিক। তার মানে ভাষার একটা স্বাধীনতা আছে একটা বস্তুকে নানাভাবে বর্ণনা করার। চাঁদের কথাই ধরি, ছেলেবেলা এর দশটির মতো প্রতিশব্দ শিখেছিলাম। শুধু বাংলা ভাষাতেই। আমাদের দেশের আদিবাসী ভাষাগুলো যদি তাতে যোগ হয় এবং বিশে^র অন্যান্য সবভাষা, তাহলে তো হাজারটা থেকে বেশি শব্দ দিয়ে চাঁদকে বোঝানো যাবে। কিন্তু ছবির তো সেই স্বাধীনতা নেই। চাঁদের ছবিঘুরে ফিরে ওই চাঁদেরই। যদি দশভাবে চাঁদটাকে দেখাতে হয়, তাহলে চাঁদের যে আকার বা শেইপ, রূপ বা ফর্ম, তা ভাঙতে হবে।

তার মানে শেইপ ও ফর্মকে যে ভাষার বাক্যবিন্যাস বা Syntax কাঠামোর প্রধান উপকরণ বলা হয়েছে, তার সত্যতা আছে। প্রখ্যাত শিল্পতত্ত্ববিদ ই. এইচ. গোমব্রিচ তাঁর আর্ট অ্যান্ড ইল্যুশন (১৯৬০) গ্রন্থে যেমন বলেন, ছবি হচ্ছে একটি ভাষা, কারণ লিখিত ভাষার মতো ছবিরও একটা ঝুহঃধী বা গঠনপদ্ধতি আছে। তাঁর কথার সূত্র ধরে কার্টিস এলকার্টার লিওনার্দো নামক ম্যাগাজিনে লেখা একটি প্রবন্ধে (‘পেইন্টিং অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ : এ পিক্টোরিয়াল সিনট্যাক্স অফ  শেইপস’, খণ্ড ৯,

পৃ ১১১-১১৮, ১৯৭৬)-এ লিখলেন, ছবির সিন্টাক্টিক্যালবা ‘বাক্যগঠন’ সংক্রান্ত নিয়ম আছে এবং শেইপ বা আকার এই গঠন প্রক্রিয়ার উপাদান। ফর্মের আকার আর মাধ্যমে ছবি বাক্সময় হয়, শুধু বস্তুর সাদৃশ্য বা কল্পিত রূপ দিয়ে নয়। বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করা যাক।

চাঁদের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। ধরা যাক নানা ঋতুতে রাতের নানা সময়ে দেখা চাঁদের ছবি আঁকা হলো। যদি সেগুলো হয় বাস্তবধর্মী, তাহলে তারা একটা অর্থ আমাদের উপহার দেবে, এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত নানা অনুভূতি-ভাব-চিন্তাও। অর্থাৎ চাঁদের যে ফর্ম (বাস্তবধর্মী, সদৃশ) তা একটা অর্থ উপহার দিলো। আবার চাঁদের ফর্ম ভেঙে, আধাবিমূর্তশৈলীতে চাঁদকে আঁকা হলো কয়েকটি ছবিতে। সেসব ছবি বাস্তবের সাদৃশ্য নির্মাণের পরিবর্তে এর এক একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা দেবে, সেগুলোতে বাস্তবের বাইরেও একটা মাত্রা থাকবে, যাতে প্রতিফলিত হবে এমন কিছু অনুভূতি যেগুলো বস্তুর সাহায্যে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, যেমন বিরহ চিন্তা, একাকিত্ব অথবা বিচ্ছিন্নতার কোনো ভাবনা। আবার কোনো ছবিতে চাঁদ হয়তো অনুপস্থিত, কিন্তু তার ফর্মের বিন্যাসে চাঁদের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু সূত্র উপস্থাপিত হলো (যেমন চাঁদের বুড়ির প্রসঙ্গ, চাঁদের না-দেখা পিঠের দিকে ঈঙ্গিত) তাহলেও তাতে চাঁদের একটা উপস্থিতি চলে আসবে। আর কোনো ছবিতে শুধু কিছু রং ফেলে তার শিরোনাম দেওয়া হলো ‘চাঁদ’, তাতেই চাঁদটি তার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি পেছনে ফেলে উদয় হবে, যদিও দৃশ্যমান হবে না। এই শেষোক্ত ছবির ফর্ম নির্ধারণ করবে ছবিটিতে চাঁদ কেন এলো, কতটা এলো অথবা এলো না, তার ওপর। এজন্য যুগে যুগে সাহিত্যের ভাষা যেমনপাল্টেছে-পশ্চিমে বাস্তববাদের যুগে, আঠারো শতকে, রোমান্টিক যুগে, ভিক্টোরিয়ান, শেষ-ভিক্টোরিয়ান এবং শুরু-আধুনিক, উচ্চ-আধুনিক, উত্তর-আধুনিকযুগে-তেমনি পাল্টেছে চিত্রকলার ভাষাও-অর্থাৎ তারফর্ম, তারশৈলী, তার রঙের ব্যবহার। উত্তর-আধুনিক যুগে ছবি তো ক্যানভাস ছেড়ে ভিডিও ফ্রেমে চলে গেছে, শিল্পীর স্বাক্ষর এবং স্থায়িত্ব চিন্তার তোয়াক্কা না করে স্থাপনা শিল্পের আপাতস্বাক্ষরহীনতা এবং স্বল্পজীবিতার জায়গাতেও। সাহিত্যেওতাইহয়েছে।

শিল্পকলা এবং সাহিত্যের এই যুগল পথচলা একটা বিষয় প্রমাণ করে, এবং তাহলো উভয়ের ভাষায় যুগের ঘনিষ্ঠ প্রতিফলন। সাহিত্য ও শিল্পকলার ভাষা ভিন্ন হলেও যুগের, সময়ের, মানুষের ভেতর ও বাইরের নানা পরিবর্তনের প্রকাশ ও প্রভাব যেভাবে তারা ধরে রাখে, তাতে আরেকটি সত্য প্রতিষ্ঠাপায়-চিত্রকলা বা শিল্পকলা, যাইহোক, তার এক বা একাধিক ভাষা আছে। যে-কোনো ভাষার কাঠামো, বিন্যাস এবং অর্থ যেহেতু তৈরি হয় দৃশ্যগ্রাহ্যতার একটা যুক্তি-প্রকাশ্যভাবে হোক অথবা প্রচ্ছন্নভাবে হোক-মেনে নিয়ে, সেজন্য দেখার নানা উপায়ও ছবির ভাষা বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ হয়। জন বার্জারতাঁর ১৯৭২ সালে প্রকাশিত বই ওয়েজ অফসিইং (শামসুদ্দিন চৌধুরী দেখার যত উপায় নামে এর বাংলা তর্জমা করেছেন) বইতে যেমন দেখিয়েছেন, মানুষ ‘ইমেজ’ বাছবির মাধ্যমে তার পৃথিবীকে অনুধাবন করতে পারে, সেজন্য ‘ইমেজ’-এর মধ্যে আদর্শবাদ সঞ্চারিত হয়, এবং আপাতদৃষ্টিতে একটি ছবি যা দেখায়, তার চাইতে অনেক বেশি দেখায় গভীরতর তলে নানা মাত্রায় বিন্যস্ত অর্থসমূহে। বার্জারের চিন্তার অনেক ব্যাপ্তি-সেসব দিকে না গিয়েও সংক্ষেপে বলা যায়, একটা ছবিকে দেখার অনেক উপায় আছে, যেহেতু আমরা যা দেখি, তার বাইরে ছবিটির অনেক দ্যোতনা ও অর্থ থাকে।

সেসব অর্থ অনুধাবনের জন্য ছবির ভাষাটা বোঝা জরুরি।

যেমন অবয়বধর্মী ছবিগুলোতে যেসব দ্যোতনা এবং অর্থ তৈরিহয়, সেসব প্রধানতশিল্পী উপরিতলে কী দেখাতে চাইছেন, সে অনুযায়ী দর্শক বুঝে নেয়, অর্থাৎ ছবিতে দেখানো বাস্তবতার একটা ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু নিম্নতলে-অর্থাৎ বাস্তবের বাইরে, প্রতীক, ইঙ্গিত, ন্যারেটিভ অথবা অর্থবহ নানা চিহ্নের মাধ্যমে শিল্পী হয়তো ভিন্ন কিছু অর্থও উপহার দেন। যেমন, এস এম সুলতানের ‘চরদখল’ ছবিটি। প্রথম দৃষ্টিতে এই ফিগারবহুল ছবিটি বাংলাদেশের পুরনো একটি সহিংসচর্চার বাস্তবধর্মী চিত্র তুলে ধরেছে। দেখা যায়, দা, বর্শা, কুড়াল ইত্যাদি অস্ত্রহাতে একদল দখলকারী-যারা কোনোশক্তিমান পক্ষের পাইক-পেয়াদা অথবা ভাড়া করা হামলাকারী হতে পারে, অন্যকোনো পক্ষ হতে পারে-পায়ে হেঁটে, গরুর গাড়ি চড়ে চর দখলের জন্য যাচ্ছে। সুলতানের গ্রাম-জীবনের চিত্রায়ণে নারী-পুরুষ সকলেই বলশালী, পেশিবহুল এবং বিশালদেহী। এ –ছবিতে ওতাই। প্রথম দর্শনে এই ছবিটিকে সুলতানের গ্রামের শান্ত গৃহকোণের সঙ্গে মেলানোর কোনো সুযোগ নেই। এ-ছবির ভাষা যে অর্থ দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়, তা বাস্তবে সমর্পিত, বাস্তবসমর্থিত। এই ছবিটি উদ্বেগের, উৎকণ্ঠার, হিংস্রতার, কিন্তু সুলতানের ফিগারবৈশিষ্ট্যের অনন্যতা বাদ দিলে ইতিহাস-আশ্রিতওবটে। এই ভাষার উপাদান সেই আকার ও ফর্ম এবংরংও। সুলতানকে শিল্পী হিসেবে চেনেন না, কোনোদিন তাঁর কাজ দেখেননি, এমন মানুষও নানা আকার দেখে (জ্যামিতিক বা প্রাকৃতিক যেভাবেই তা প্রতিভাত হোক, আকারের ক্রমিকবিন্যাসে এ-ছবিতে তৈরি হয় অবয়ব, গরুরগাড়ি, চাকা, গাছপালা, মাঠ), ফর্ম (একটি দ্বিমাত্রিক তলে ত্রিমাত্রিক তারআভাস তৈরি করে যেসব দৃশ্য-উপাদান, ছবির বস্তুগতচরিত্র, শৈল্পিক প্রকাশের একটি মাধ্যম, যেভাবেই ফর্মকে দেখা হোক) এবং মাঠের ধান বা শরীরের বর্ণের স্বাভাবিকতা বিবেচনায় নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে নেবেন, এটি চরদখলের একটি ছবি, যেহেতু শিরোনামে তা লেখাআছে। শিরোনামটি এক্ষেত্রে চিত্রভাষার একটি সংক্ষিপ্তসার তৈরি করে। যদি শিরোনাম না থাকে, এ-ছবিতে হয়তো চর দখলের বিষয়টিপ্রথমেইআসবে না, যা আসবে, তা কোনো আক্রমণ বা প্রতি-আক্রমণ, যা ছবিতে একটি সহিংস সংঘর্ষের উদ্বেগ রেখে যাবে।

কিন্তু সুলতান এই ছবির আড়ালেআমাদের গ্রাম সমাজে ক্ষমতার ইতিহাস ও সহিংসতার সমাজতত্ত্ব এবং জমির মালিকানা থাকা-না থাকা ঘিরে তৈরি হওয়া সামাজিক-রাজনৈতিক বয়ানগুলোকেও যে তুলে এনেছেন, এবং একটি প্রতি-আখ্যানও যে তৈরি করেছেন যার শুরু তাঁর কিষান-কিষানিদের জীবন-থেকে-বড় করে দেখা, তাদেরকে স্বয়ম্ভর চরিত্রে স্থাপন করে চিরকালের বঞ্চিত, শোষিত, স্বাস্থ্যহীন ইত্যাদি বর্ণনা থেকে মুক্ত করে তাদের নিয়ে একটি সম্ভাবনা রচিত্র আঁকা থেকে (যেহেতু এক সময় এমনও তো মনে হতে পারে যে এই কৃষকরাই যাচ্ছে দখলদারদের উচ্ছেদ করে চরের মালিকানা তাদের হাতে নিয়ে নিতে এবং এটিওতো বিবেচ্য যে ছবিতে কোথাও কোনো ইঙ্গিত নেই কোনো ক্ষমতাশালীর নেতৃত্বেই অভিযানটি চলছে)। অর্থাৎ ছবির এই অ-প্রকাশ্য ভাষা বুঝতে হলে সুলতানের ছবির সঙ্গে, মানুষ ও সমাজকে নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা-দর্শনের সঙ্গে পরিচয়টা সহায়ক। একটি বাস্তবের চিত্র থেকে নিম্নতল এবং গভীরের বাস্তবেউপনীত হওয়ার জন্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এই পথে আরেকটু এগিয়ে গেলে সুলতানের উপনিবেশবিরোধী অবস্থান, তাঁর ছবিতে ক্ষমতা, অস্ত্র, আধিপত্য ইত্যাদির মাধ্যমে উপনিবেশেরটিকে থাকা এবং মানুষকে ক্রমাগত ক্ষমতাহীন করে তার নিজস্বতা এবং সক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার উদ্বেগের পাশাপাশি সেসব ন্যারেটিভের বেড়াজাল ভেঙে কৃষকের (যে-কোনো ক্ষমতাচর্চায় প্রান্তজনেরাই সবচেয়ে বেশি দুর্গত) অস্তিত্ব-পরিচিতি-সক্ষমতা ফিরে পাওয়ার প্রতি-আখ্যান নির্মাণ, পুরুষতন্ত্রের (যাযে-কোনো ক্ষমতা কেন্দ্রের অনুবর্তী একটি কাঠামো) নিষেধ অকার্যকর করে সমাজ বা পারিবারিক কাঠামোনা ভেঙে, তার ভেতরে থেকেই গ্রামের নারীদের নিজস্ব অস্তিত্বঘোষণা-এসবের একটা খতিয়ান দর্শকের পাওয়া হয়ে যাবে। এজন্য সুলতানের ছবির ভাষা বোঝার জন্য সমাজ ও ক্ষমতা, পুরুষতান্ত্রিকতা ও রাজনীতির ভাষার সঙ্গে একটা পরিচিতিও প্রয়োজন। অর্থাৎ ছবির ভাষা একটা পর্যায়ে সমাজ, রাজনীতি, সমকালীন ঘটনা, ইতিহাস, ব্যক্তি ও সমষ্টির মনোস্তত্ত্বেও তার বিস্তার ঘটায়। এজন্য যুগে যুগে ছবির ভাষা পাল্টায়, তার শৈল্পিক ফর্মে পরিবর্তন ঘটে, তার শৈলী এবং মাধ্যমেরও বিবর্তন হয়।

দুই

চিত্রকলার ভাষা নিয়ে আলোচনাটি যেহেতু একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্মরণে রেখে লেখা হচ্ছে, এবার তাহলে বাংলাদেশের শিল্পকলার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। আমাদের দেশে শিল্পকলাচর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো, যদিও পাল যুগের কিছু ছবি এবং মধ্যযুগের চিত্রিত পুঁথি বাদ দিলে কাগজে-কাপড়ে আঁকা পুরনোছবির তেমন কোনো সংগ্রহআমাদের কোনো সংগ্রহ শালাতে নেই। কিন্তু চিত্রিত পুঁথিগুলো সাক্ষ্য দেয়, লোককল্পনা, গাথা, কিংবদন্তি এবং প্রাত্যহিক জীবনকেই ছবিগুলোতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের দেশের চিত্রকলার আদি ভাষায় আমাদের কল্পনা ও সৃষ্টিশীল মনীষার একটা স্বাক্ষর পাওয়া যায়, যার বিস্তার ঘটে লোকজীবনে। এই জীবনটি গুরুত্ব নিয়ে কুড়ি-একুশশতকেওস্পন্দমান, যদিও নাগরিক নানা নির্মিতির চাপে এর শক্তি খর্ব হচ্ছে। শিল্পের আধুনিকায়ন ভাষাকেও জটিলকরেছে। তবে সে প্রসঙ্গে পরে যাওয়া যাবে।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরই আমাদের দেশে চিত্রকলার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার শুরু, যদিও খুলনায় শতাব্দীর শুরুতে একটি চিত্রকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিছুদিন সক্রিয় ছিল। জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে যে শিক্ষাকেন্দ্র চালু হলো, তাতে স্থানীয়ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ধারাগুলোকে সমান গুরুত্ব দেওয়াহলো। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের যেসব ছবি এঁকে জয়নুল সর্বভারতীয় স্বীকৃতি লাভ করেন, সেগুলো ছিল বাস্তবধর্মী চিত্রভাষার এক অনুপম প্রকাশ। এসবছবিতে (প্রধানত স্কেচ-ড্রইং) ফুটপাতে মানুষ ও প্রাণীর সহাবস্থান, কাকের আনাগোনা, ক্ষুধা, ক্ষয় ও মৃত্যুর এক মর্মান্তিক মোজাইক কালোকালি ও কাঠকয়লায় জোরালো ভাষায় তুলে ধরেছিলেন জয়নুল। ১৯৪৮-এর শেষেই বাঙালির কাছে যখন পরিষ্কার হয়ে গেল, ইংরেজদের উপনিবেশ থেকেমুক্ত হয়ে তারা পাকিস্তানের নয়া উপনিবেশের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়েছে, তা ভাঙারআয়োজনওসঙ্গেসঙ্গেই শুরু হয়ে গেল। বাঙালির রাজনীতির ভাষা হয়ে দাঁড়ালো প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং দ্রোহের। চিত্রকলার ভাষায়সেইপ্রতিবাদ এবং দ্রোহের সঞ্চার হতে দেরি হলো না। যে-শিল্পীর ছবিতে শুধু মন্বন্তরের বীভৎসতা, মানুষের প্রতি মানুষের প্রবঞ্চনা এবং জাগতিক লোভের সর্বগ্রাসি তাই ফুটে ওঠেনি, বরং বর্বর উপনিবেশী শক্তিকেও এই নির্মমতার জন্য কাঠগড়ায় তোলাহয়েছে, সেই জয়নুল আবেদিন যে শিক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন, তার শিক্ষার্থীদেরকাছে তাঁর ভাষাটি শিখেনেওয়াযেএকটাআবশ্যকতাহয়েদাঁড়াবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছুনেই। এবং ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ভাষা-আন্দোলন যে এই তরুণশিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করবে, বাহান্নর একুশের ভাষায় তারাও ছবি আঁকবেন, তাও ছিল স্বতঃসিদ্ধ। সেজন্য একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে যে প্রথম সংকলনটি প্রকাশিত হয় কবি হাসান হাফিজুর রহমানেরসম্পাদনায় ও পুথিপত্রেরপ্রকাশনায় (১৯৫৩) তাতে স্থান পেয়েছিলমুর্তজা বশীর ও বিজন চৌধুরীর (যদিও তাঁর নামটি দেওয়া হয়নি) অসামান্য কিছু স্কেচ। এগুলোর ভাষা ছিল শামসুর রাহমান অথবা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কবিতার ভাষার অনুরূপ। প্রতিবাদের ভাষার শক্তিটা চিত্রকলা এমনভাবে ধারণ করেছিল যে, আল্পনার মতো এক নান্দনিক এবং উদযাপনের অনুভূতিতে সিক্ত শৈল্পিক বিন্যাসও খুব দ্রুতই ভাষারমাসে রাজপথে আঁকা হতে লাগল। আল্পনার উৎস গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে, নতুন চালের গুঁড়ায়, নিকোনো উঠানে যা আঁকা হতো নবান্নর উদযাপনে, এবং পূজা-পার্বণ-বিয়ের উৎসবে, তাতেই যুক্ত হলো নতুন এক ভাষা-প্রতিবাদের। এই নতুন ভাষাটি আল্পনার দিকে শুধু একটা চোখ রেখে তাকালে বোঝা যাবে না, তা বুঝতে হলে দুটো চোখই ফেরাতে হবে আমাদের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের প্রধান শক্তিকেন্দ্র গ্রামের কৃষক, শ্রমিক এবং মেহনতি মানুষের জীবনে। এই জীবনে নবান্নসবসময়ই স্বস্তি এবং আনন্দ নিয়ে দেখা দিয়েছে। এবং আল্পনা ছিল এর প্রতীক, যা আঁকতেন ঘরের নারীরা, নবান্নের সাফল্যের পেছনে যাদের পরিশ্রম ছিল পুরুষের তুল্যই। এই স্বস্তির প্রতীকটি শিল্পীরা ঘুরিয়ে তাক করলেন অস্ত্রধারী উপনিবেশবাদীদের দিকে। একদিকে অশুভ, বীভৎসতা, ক্ষমতার দাপট, অন্যদিকে শুভ ও মঙ্গল, স্বস্তি ও প্রশান্তি এবংসমষ্টির উদযাপন। পাল্লাটা শেষ পর্যন্ত গেছে শুভর পক্ষে।

জয়নুল যে শক্তি তাঁর স্কেচ/ড্রইং-এ সঞ্চারিত করেছিলেন, সেই শক্তি আল্পনা ফুটিয়ে তুলল, এবং খুব সাম্প্রতিক (কোভিড মহামারি শুরুর বছর দেড়-দুয়েক আগে) স্বল্পজীবী কিছু সড়ক-দেয়ালচিত্রে, যাদের অনেকে বলছেন ‘সুবোধ’ সিরিজ। ‘সুবোধ তুইপালিয়ে যা’ –একটা ছবির নাম। অনেকটা ১৯৯০-এর দশক থেকে সক্রিয় ইংল্যান্ডের সড়ক-শিল্পী ব্যাংক সির করা গ্রাফিটি ঘরানার এবং স্টেনসিল টেকনিক ব্যবহার করে আঁকা শানিত রাজনৈতিক অনুভব, বিদ্রƒপ এবং কৌতুক মেশানো ছবির মতো এই ‘সুবোধ’ ছবিটিও। এতে মুক্তবুদ্ধির ওপর আঘাত, সংখ্যালঘুদের বিপন্নতাসহ অনেক বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। ‘সুবোধ’ সিরিজটিও আমাদের প্রতিবাদী চিত্রকলা-ভাষারসর্বশেষ একটি উদাহরণ।

তিন

বাংলাদেশের সাহিত্যের মতো চিত্রকলার ভাষাতেও আছে বৈচিত্র্য এবং বহুমাত্রিকতা। এর শুরু লোকচর্চায়, লোকজীবন ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে। দীর্ঘদিন এর চর্চা হয়েছে স্থানীয়ভাবে। এসব কোনো দীর্ঘস্থায়ী মাধ্যমে হতো না বলে পুরনো চিত্রশিল্পের নমুনা আামাদের নেই। তাছাড়া প্রতিষ্ঠান ছিল না; বিত্তশালীরাও লোকচিত্র সংগ্রহ করায়উৎসাহী ছিলেন না। তারপরও যে সামান্য কিছু নমুনা আমাদের চোখে পড়েছে (যেমন ঢাকা, কলকাতা ও লন্ডনের জাদুঘরে, আমাদের লোকচিত্র নিয়ে লেখাদেশি-বিদেশি বইপত্রে) তাতে মনে হয়েছে, এর ভাষায় প্রতিদিনের জীবনযাপনের, শিল্পীরকল্পনার, নানান কিংবদন্তির অজটিল প্রকাশটাই মুখ্য হয়েছে। অজটিল, কারণশৈলীর অন্তরঙ্গ এবং বৈঠকী মেজাজ, তার সহজবোধ্যতা এবং বর্ণলেপনে উজ্জ্বল রঙের উপস্থিতিতে বিষয়বস্তু যাতে প্রাঞ্জলভাবে ফুটে ওঠে, তার ওপরই জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের শিল্পচর্চার আধুনিকতার সময়ও অনেক শিল্পীর কাজে এই সহজ প্রকাশটি গুরুত্ব পেয়েছে। জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান থেকে শুরু করে কাইয়ুম চৌধুরী বা আবদুশ শাকুর শাহ পর্যন্ত যাঁরা ইলোকজীবন ও লোকগল্পের রূপায়ণ করেছেন, তাঁদের কাজে আছে স্বতঃস্ফূর্ততা, অবয়বধর্মিতা, রঙের প্রকাশবৈশিষ্ট্য এবং রেখার বলিষ্ঠ অথবা সূক্ষ্মকাজ। যাঁরা প্রকাশ বা প্রভাববাদী কাজ করেছেন অথবা বিমূর্ত ছবি এঁকেছেন, তাঁরাও লোকশিল্পকে ‘নিচুশিল্প’ বলে প্রত্যাখ্যান করেননি, বরং এর সাবলীলতাকে তাঁদের ফর্মের কাঠামোতে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন, সাধারণত রং ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। মোহাম্মদ কিবরিয়ার ধূসর, নীল ও বাদামি রঙের পাশাপাশি কোনো ছবিতে যে একটুখানি সুবজ উঁকি দেয়, তা এ-বিষয়টিকে মনে করিয়ে দেয়। নাগরিকজীবনে স্থাপিত তাঁর চিত্রভাষায় অনেকসময় প্রকৃতি সংলগ্নজীবনওছায়াফেলে। এ-বিষয়টি সাহিত্যে অনেক ব্যাপক, অনেক বেশি স্বতঃসিদ্ধ। তবে বাংলাদেশের শিল্পীদের কাছে নগর সর্বস্বতা নির্বিকল্প ও একক-বিশিষ্ট তেমন হতে পারেনি কারণ গ্রামের সঙ্গে, লোকসংস্কৃতির সঙ্গে তাদের কথোপকথন সবসময়ই চলমান। আমাদের শহরগুলো পশ্চিমের শহরগুলোর মতো শিকড়হীন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে ওঠেনি, গ্রামের সঙ্গে একটা সংযোগ-যাকে আমরা নাড়ির টান বলি-তা এখনো আছে। তবে গ্রাম তো একটা স্মৃতিরও নাম; যাদের গ্রামে কোনো ঠিকানা এখন নেই, তাদের জন্য। তাছাড়া, শহর থেকে একপা বেরুলেই তো গ্রাম। প্রতিবাদী শিল্প-সাহিত্যে অবশ্য গ্রামশহরকেন্দ্রিক ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোর একটি বিকল্প তৈরি করে, যেমন করে বাজার শাসিত, পুঁজিনিয়ন্ত্রিত বস্তুবাদের পীঠস্থানগুলোর, যেহেতু এদের জটিল, কল্পনা ও পরিসরবিরোধী, সংঘাতময় এবং বস্তুতান্ত্রিক চরিত্রের বিপরীতে দাঁড়ায় গ্রাম। লোকচিত্রে আছে কল্পনার উদ্ভাস, পরিসরের বিস্তার এবং বস্তু পৃথিবীকে দূরে রাখার বিষয়গুলো, এবং এর ভাষাতেও সেসবের প্রকাশ তাৎক্ষণিক।

বাংলাদেশের শিল্পকলার ভাষায় লোকচিত্রের এইসব প্রকাশ আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে ঘটেছে। ষাটের দশকে যখন আমাদের শিল্পভাষা আধুনিকতার নৈর্ব্যক্তিকতা, নিরীক্ষাধর্মিতা, বিমূর্ততা, ফর্মের খণ্ডায়ন ও জ্যামিতিক বিন্যাস-এসবের প্রকাশ ঘটিয়েছে, তখনো শিল্পীরা তাঁদের শৈলী, পদ্ধতি ও চিন্তায় আধুনিকতাবাদের প্রতিফলনে যতটা আন্তর্জাতিক ততটা দেশীয়। সফিউদ্দীন আহমেদ তাঁর ছবিতে চোখ-কে একটি প্রতীকী মাত্রায় উপস্থিত করতেন। তাঁর চোখ-এর একটি পরিচয় ছিল এর অতন্দ্র ও জাগরূক অবস্থান, যেন চোখ জানিয়ে দিচ্ছে, শিল্পীর চোখ আছে ইতিহাস, সময় এবং পরিপাশের্^র ওপর। এই জাগ্রত চেতনা ছিল বাঙালির শক্তি। যে চারুকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সফিউদ্দীন এবং অন্য শিল্পগুরুরা পড়াতেন, তা ষাটের দশকে ছিল বাঙালির প্রতিরোধ-আন্দোলনের কেন্দ্রে। সত্তর ও আশির দশকে, এবং তার পরও। আশির দশক জুড়ে যখন দেশে চলছে সরাসরি এবং ছদ্মবেশী সামরিক শাসন, তখন এর শিল্পীরা গণতন্ত্রের পক্ষে এবং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছবি এঁকেছেন, বাংলা নববর্ষের নতুন উদযাপন শুরু করেছেন-যার মূল উদ্দেশ্যের একটি ছিল গ্রামের ঐতিহ্যের শক্তি দিয়ে, এর সর্বজনীনতা দিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিসরের অবমুক্তি। আশির দশকে আত্মপ্রকাশ করা শিল্পীরা (যাঁদের কয়েকজন ‘সময়’ নামে একটি গ্রুপ তৈরি করেছিলেন) তাঁদের শিল্পভাষায় প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধকে ব্যঙ্গ ও বিদ্রƒপ, স্যাটায়ার এবং আয়রনির মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। শিশির ভট্টাচার্য্যরে ‘খেলা দেখে যান বাবু’ সিরিজটি এর একটি চমৎকার উদাহরণ। এর প্রতিটি ছবির ভাষা বলিষ্ঠ-যা প্রধানত রেখা ও ফর্মের বিন্যাসকে ভিত্তি করেই উচ্চারিত।

দৃশ্যমাধ্যমের বিস্তার ঘটলে, আধুনিকতার যুক্তি এবং বুদ্ধিভিত্তিক দাবিগুলো যুদ্ধ-মহাযুদ্ধের বর্বরতা, উপনিবেশ ও পুঁজির ইতিহাসেমøান অথবা নাকচ হতে থাকলে যে উত্তর-আধুনিক চিন্তার উন্মেষ ঘটল, তাতে লোকশিল্প তার আসনটি ফিরে পেল, উঁচু-নিচু শিল্পবিভাজন পরিত্যাজ্য হলো, ইমেজ বাছবির গুরুত্ব বাড়ল। শিল্প-সাহিত্যের ভাষায় এলো সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের প্রভাব; ঠাট্টা, আয়রনি, কৌতুক এবং উদযাপনের সমাবেশ এবং অতীতের সঙ্গে বর্তমানের এক সেতুবন্ধন। আমাদের দেশেও এই সময়ের শিল্পীদের চিত্রভাষায় উত্তর-আধুনিকতার বেশকিছু প্রকাশ সহজেই চোখে পড়ে-আতিয়া ইসলাম এ্যানি অথবা রনি আহমেদের কাজে আছে সেসবের প্রকাশ। এ্যানি তাঁর কয়েকটি কাজে মোনালিসাকে যেভাবে বাঙালি আবহে স্থাপন করে রক্ষণশীলতার নামে মেয়েদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তা কৌতুক ও প্যারোডির ব্যবহারে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রনি আহমেদ ভিন গ্রহের জীবনকে আমাদের অভিজ্ঞতায় বিন্যস্ত করে সমাজের মধ্যে জমে থাকা অসুন্দরের একটা ব্যবচ্ছেদ করেছেন। অনেক শিল্পী থেকে এ দুই শিল্পীকে বেছে নিলেও উত্তর-আধুনিক চিত্রভাষায় যে আমরা নিজেদের মতো সময়কে নিরীক্ষণ করার ও একে বিশ্লেষণ করে এর নানা প্রবণতা ও প্রবাহকে বোঝার ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি, তাতে আমরা যে আমাদের নিজস্বতা ধরে রাখতে পেরেছি, তা প্রমাণ করতে অসুবিধা হয় না।

চার

চিত্রভাষা ও আমাদের সাহিত্যের, রাজনীতির অথবা সামাজিক নানা ডিসকোর্সের ভাষার মতো পাল্টায়। তবে চিত্রভাষা এসবের মতো স্পষ্ট উচ্চারণে বা বিস্তৃত পরিসরে সব প্রকাশ করে না, অনেক সময় সেই ভাষা থাকে অনুচ্চারিত, ছবির নানা স্তরে বাক্সময়। সেই স্তরগুলোর উন্মোচন না হলে ভাষাটি পড়া যায় না। এজন্য চিত্রভাষাকে বুঝতে হলে ছবির ব্যাকরণ-অর্থাৎ এর আকার, ফর্ম, রেখা ও রং, এবং টেক্সচারের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বোধগম্যতা অর্জনের বিষয়টি সম্পর্কে পরিচিত থাকাটা সুবিধাজনক। তবে এর অভাবে ও শিল্পের ভাষা বুঝতে দর্র্শক নেহায়েত অপারগ হন, তা-ও নয়। সেজন্য শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অল্পখানি সচেতনতা আমাদের অনেকটা পথ এগিয়ে নিতে পারে।