বাংলার যুগপুরুষ আনিসুজ্জামান

বাংলা সাহিত্য ও ভাষার ইতিহাস রাষ্ট্রের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকেও কোনো রাষ্ট্র-সীমান্ত দ্বারা বদ্ধ নয়। সাহিত্য সীমান্ত নয়, দিগন্ত। আনিসুজ্জামানের দীর্ঘ কর্মজীবন এবং পুস্তকসমূহে তিনি আমাদের এই চরম শিক্ষা দিয়েছেন।
আনিস স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয় ঢাকা শহরে আমার ডক্টরাল গবেষণাকালে। ২০১৭ সালের আগে বাংলাদেশের ইতিহাস সম্বন্ধে আমি যা জানতাম সবই বইপড়া বিদ্যা। তাঁর বই তার মধ্যে অন্যতম। প্রাচীন বাংলা থেকে মধ্যযুগ, অষ্টাদশ শতাব্দীর দোভাষী ধারা, বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাময়িকপত্র তালিকা, বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি যুগকে তিনি তাঁর গবেষণায় নতুন আলোকে দেখিয়েছেন। তবে বাংলাদেশে পৌঁছেই আমি প্রথম বুঝি যে তিনি ফেলে-আসা-যুগের ইতিবৃত্তকারই শুধু নন, বাংলার বিংশ শতাব্দীর যুগপুরুষও বটে।
যখন আমি আনিস স্যারকে বলি যে, আমি ভাষার ইতিহাস মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে লিখতে চাই এবং কলকাতায় বড় হওয়ার দরুন হয়তো বাঙালি মুসলমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের অতি সূক্ষ্ম তারতম্য আমি বুঝতে পারি না, তিনি আমাকে বহিরাগত হিসেবে দেখেননি। একান্তই স্নেহ এবং বাৎসল্য দ্বারা তিনি আমাকে পথ দেখিয়েছিলেন। সাহিত্যক্ষেত্রে কি আসলেই কেউ আগন্তুক?
আবার বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে দেশভাগ অবধি ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে দেখি, এই বাংলা ভাষা যেমন ছিল চারণভূমি, তেমনই রণক্ষেত্র। সাহিত্যজগতে হিন্দু ভদ্রলোকগোষ্ঠী মুসলমান বাঙালিদের অনায়াসে বহির্ভূত করে রাখে। তাই রবীন্দ্রনাথও ‘খুন’ শব্দ প্রয়োগে নজরুলকে তিরস্কার করছিলেন। এক ভাষার উত্তরাধিকারী দুই সম্প্রদায় যে কীভাবে আধুনিক যুগে এই ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যেই ক্রমশ বিখণ্ডিত হয়ে গেল, তা দেখা যায় আরো স্পষ্টভাবে চল্লিশের দশকে। ১৯৩৫-পরবর্তীকালে পার্টিশন-প্রক্রিয়ার মূল দায়বদ্ধতা হিন্দু গোষ্ঠীর। তাও ১৯৪০-এ পাকিস্তান-আহ্বানকে যখন বহু বাঙালি মুসলমান নেতা-বুদ্ধিজীবী মেনে নেন, পূর্ব পাকিস্তানি জাতীয়তাবোধেরও ভিত্তি হয় ভাষা-সাহিত্য। ১৯৪৩ সালে কলকাতার পাকিস্তান রেনেসাঁস সোসাইটি এবং ঢাকার পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ আলোচনা সভা যখন আয়োজন করে, আলোচ্য বিষয়বস্তু হয় বাঙালি মুসলমান নবজাগরণ। বক্তারা মনে করিয়ে দেন যে, হিন্দু-সাহিত্যিকদের আধুনিক সাহিত্য এবং ইতিহাসধারা এতদিন অবজ্ঞা করেছে বাঙালি মুসলমানের জীবন, মনন এবং অবদান। আবুল মনসুর আহমদের কথায়, পূর্ব পাকিস্তান হবে ‘কালচারাল অটোনমি’র নির্মাণভূমি। কিন্তু ১৯৪৭-এর পূর্ব পাকিস্তানের স্বপ্ন সেই লিপি অনুযায়ী যায়নি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উঠল দেশভাগের পরেই। ১৯৫২ সালে হলো ভাষা-আন্দোলন।
পূর্ব পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানি কূটনীতি এবং বাংলা ভাষাভিত্তিক রাজনীতি দুটি বিপরীত মেরুর তত্ত্ব ও নীতি হয়ে দাঁড়ায়। এই সময়ে আনিসুজ্জামান ভাষাভিত্তিক রাজনীতির এক প্রধান ভাবাদর্শী হয়ে ওঠেন। যদি ধরে নিই কূটনীতি সংকীর্ণ, তবে সেই নতুন ভাষানীতি সুবৃহৎ। একদিকে ছিল রাষ্ট্র-সীমান্ত, অন্যদিকে এক ব্যাপক বাঙালি জাতীয়তা। এই ভাষা-সাহিত্যের জাতীয়তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এখানেই আনিসুজ্জামান পড়াশোনা করেছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, মুহম্মদ আবদুল হাই এবং মুনীর চৌধুরীর শিক্ষকতায়। আনিস স্যারের সঙ্গে গল্প করতে করতে (অনেক প্রশ্ন ছিল মনে) হঠাৎ তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ। বেকুবের মতো বললাম, ‘স্যার, আমি বিদ্যাসাগর পড়েছি, আবার সেই প্রবন্ধ পড়ব?’ তিনি হেসে বললেন, ‘তুমি কি আমার বিদ্যাসাগর পড়েছ?’ তাঁর বিদ্যাসাগর? আসলে যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ থেকে বই আসা পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ছিল, মুহম্মদ আবদুল হাই এবং আনিসুজ্জামান ১৯৬৯-এ স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে এ-বইটি প্রকাশ করেন।
অনেকেই হিন্দু-মুসলমান, দেশভাগ এবং এই নিত্যদিনের সাম্প্রদায়িক কলহের ইতিহাস লিখেছেন। কিন্তু সাহিত্য শুধু বিবাদের ইতিহাস নয়, ঐক্যের ইতিহাসও বটে। রাষ্ট্রের ইতিহাসে বিবাদ ও রক্তপাত অনিবার্য, কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম এমন এক জাতীয়তার ভিত্তিতে যার মধ্যে বিবাদ বাদেও একটি ব্যাখ্যাতীত সৌন্দর্য আছে। ভাষা-সাহিত্য হচ্ছে মানসের প্রতিবিম্ব। এবং সেই মানসের একাধিকত্বকে আনিস স্যার তাঁর কিতাবেই শুধু নয়, তাঁর অন্য রাজনৈতিক ভূমিকায়ও তুলে ধরেছিলেন। তিনি পথ দেখান কীভাবে বাঙালি নতুনভাবে আত্মবিশ্লেষণ করতে পারে। বিদীর্ণ অতীতের ঊর্ধ্বে উঠে দুই বাংলারই সময় এসেছিল আত্মজিজ্ঞাসার, নিজের পরিচয়কে নতুনভাবে ভাবার। ওঁর সমসাময়িক আহমদ ছফা, আহমদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের বুদ্ধিজীবী ছিলেন এবং তাঁরা হিউম্যানিস্ট স্কলারশিপকে একটি পলিটিক্যাল প্রজেক্টেরই প্রসারণ হিসেবে দেখেছিলেন। যেমন দেখেছিলেন মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং অন্যরা। ১৯৭১ সালের পূর্বে।
আনিসুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাতে এবং তাঁর নানাবিধ বই পড়ে এই মানুষটির বহুমুখী প্রতিভা উপলব্ধি করেছি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সাহিত্যিকরা একটি শব্দ প্রয়োগ করতে বড় ভালোবাসতেন – সাহিত্যসেবক বা সাহিত্যসেবী। আনিসুজ্জামান প্রকৃত অর্থে সাহিত্যসেবক ছিলেন। ইতিহাসের নানা লুপ্ত দলিলপত্রকে সংগ্রহ করা, প্রয়াত কবি-লেখকদের পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করা, ঐতিহাসিক দলিল সংরক্ষণ করা – তিনি এসব কাজ করেছেন। এছাড়াও ছিলেন ইতিহাসের দ্রষ্টা এবং সাক্ষী, যার পরিচয় আমরা পাই তাঁর আত্মকথায় – আমার একাত্তর, কাল নিরবধি এবং বিপুলা পৃথিবী । তাঁর দুটি আত্মকথার শিরোনাম রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলা জাতীয় সাহিত্য’ থেকে নেওয়া। আনিস স্যার তাঁর জীবন এবং লিখন দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু বাক্যকে বাস্তবেই পরিণত করেছেন – ‘স্বার্থও নহে, খ্যাতিও নহে, প্রকৃত সাহিত্যের ধ্রুব লক্ষ্যস্থল কেবল নিরবধি কাল এবং বিপুলা পৃথিবী । সেই লক্ষ্য থাকে বলিয়ান সাহিত্য মানবের সহিত মানবকে যুগের সহিত যুগান্তরকে প্রাণবন্ধনে বাঁধিয়ে দেয়।’