বাঙলা উপন্যাস : শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও বাস্তবধর্মী উপন্যাস

অনুবাদ : সুব্রত বড়ুয়া

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, দর্শনশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, লেখক ও রাজনীতিক অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ১৯৬৭ সালে আমন্ত্রিত হয়ে আমেরিকার ম্যাডিসনের ইউনিভার্সিটি অব ভিসকনসিন-এ ‘টেগোর মেমোরিয়াল লেকচার’ প্রদান করেন। তাঁর এই চারটি বক্তৃতা পরবর্তীকালে ১৯৬৮ সালে The Bengali Novel নামে কলকাতা থেকে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এটিও মোট চারটি অংশে উপস্থাপিত হয়েছে। সে অংশগুলি হলো যথাক্রমে : (১) Bankimchandra and the birth of the Bengali Novel; (২) Rabindranath Tagore; (৩) Sarat Chandra Chatterjee and the Realistic Novel; এবং (৪) The Novel in Contemporary Bengal। হুমায়ুন কবিরের জন্ম ১৯০৬ সালে, মৃত্যু ১৯৬৯ সালে।

কালি ও কলম-এর এই সংখ্যায় গ্রন্থটির তৃতীয় অংশটির বঙ্গানুবাদ পত্রস্থ করা হলো।

আমরা দেখেছি, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ঐতিহাসিক প্রণয়োপাখ্যানগুলির মাধ্যমে বাঙলা উপন্যাসের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রোমান্স বা প্রণয়োপাখ্যানের একটি বৈশিষ্ট্য হলো কল্পনা এবং বিস্ময়ের লব্ধিজাত জ্ঞানের উপর এর গুরুত্ব আরোপ। অস্বাভাবিক ও কখনও কখনও অতিপ্রাকৃতিক শক্তিগুলি বঙ্কিমের চরিত্রগুলিকে চালিত করে এবং এর ফলে তিনি সচরাচর সংঘটিত ঘটনাবলি অথবা মানবিক অনুভূতির বিশ্লেষণে অপর্যাপ্ত আগ্রহ দেখান। তাঁর কাছে তীব্র আবেগানুভূতি একটি মৌলিক শক্তির মতো যা অভাবিতভাবে সম্মুখপানে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। তীব্র অনুভূতিগুলির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব প্রায়শ তাঁর প্রধান উপন্যাসগুলিতে বিয়োগান্ত উপাদান জোগায়, কিন্তু একটি রোমান্টিক নেতি জীবনকে সামগ্রিকভাবে দেখার কাজে তাঁকে বাধা প্রদান করে।

বাস্তবতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ওপর ব্যাপকতর নির্ভরতার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ বাঙলা উপন্যাসের বিকাশের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিকনির্দেশ করেছিলেন। তাঁর ছোটগল্পে বাঙলার সামাজিক জীবনের নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায় এবং এই একই গুণ দেখা যায় তাঁর অনেক উপন্যাসেও। অতএব তাঁর দেখায় রোমান্স থেকে দূরে সরে যাওয়ার বিষয়টি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে, কিন্তু তাঁর কবির মেজাজ তাতে বাস্তবতার উপস্থাপনে একটি নতুন বাঁক নির্দেশ করে। তিনি ঐতিহাসিক প্রণয়োপাখ্যান পরিত্যাগ করেন, কিন্তু তাঁর রচনায় উঠে আসে রোমান্টিক গুণসমেত প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাবলি। কিন্তু রোমান্টিক রচনাভঙ্গি ক্রমশ প্রবলতর হয়ে উঠতে থাকে এবং প্রকৃত অবস্থান চিত্রায়নের পরিবর্তে কল্পনার প্রভাব ক্রমাগত আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে, যদিও তাঁর সর্বশেষ পর্যায়ের উপন্যাসগুলিতে বুদ্ধিবৃত্তি কখনও কখনও ক্ষয়কারী শক্তি হয়ে ওঠে। শুরু থেকেই তিনি নৈতিক প্রশ্নগুলির ক্ষেত্রে শিল্পীসুলভ নিরপেক্ষতার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্কিম যেভাবে গৃহীত মানসমূহ থেকে যে-কোনো বিচ্যুতির নিন্দা করেছেন রবীন্দ্রনাথ তা না করে মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে নারী ও পুরুষের বিচার করেছেন এবং তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির মধ্যে আবেগের অবাধ ক্রিয়ার সুযোগ দিয়েছেন।

শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক সূচিত বাস্তবতার প্রতি অগ্রসরতাকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রথাসমূহ থেকে মুক্তির বিষয়টিকে সমর্থনদান করেছেন এবং প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথে বস্তুত আরও এগিয়ে গেছেন। চোখের বালিকে তিনি প্রায়শ বর্ণনা করতেন বাঙলা ভাষায় রচিত প্রথম উপন্যাস হিসেবে, যে উপন্যাস মুক্ত ছিল নৈতিকতার অতিস্বর থেকে। এক অর্থে শৈল্পিক গুণের বিবেচনায় তিনি এমনকি রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি নিরপেক্ষ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেসব প্রশ্ন তুলেছিলেন যেগুলির একটি উত্তর নিহিত তাঁর সার্বিক জীবনদর্শনের মধ্যে। পক্ষান্তরে শরৎ চন্দ্র বিশ শতকের অধিকাংশ সাহিত্য-বৈশিষ্ট্যের অনুগামী ছিলেন, যেগুলিতে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে কিন্তু উত্তর দেওয়ার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। ইবসেন এবং বার্নার্ড শ শুধু প্রশ্নই উত্থাপন করেননি বরং উত্তরও প্রস্তাব করেছেন, কিন্তু শরৎ চন্দ্র প্রায়শ শুধু প্রশ্ন তুলেই সন্তুষ্ট ছিলেন।

সমাজের লাঞ্ছিত ও নিপীড়তরা শরৎ চন্দ্রের গভীরতম সহানুভূতি পেয়েছিল। তিনি পর্যবেক্ষণের সূক্ষ্মতা ও বিশ্লেষণ সহযোগে তাদের অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন যা অবশ্যই উল্লেখের দাবি রাখে। তাঁর বাস্তববাদিতায় তিনি অনুসরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের প্রথমদিকের উপন্যাসগুলির ঐতিহ্য, কিন্তু তাঁর মৌলিকতার ছাপ রয়েছে সামাজিক প্রথাসমূহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সহানুভূতি প্রকাশের মধ্যে। তিনি সামাজিক সমস্যাগুলির কোনো সমাধান নির্দেশের চেষ্টা করেননি, তবে আমাদের আনুগত্যের প্রতি সমাজের দাবি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। সামাজিক বিধিনিষেধগুলি দ্বারা সৃষ্ট দুঃখ-কষ্ট ও দুর্দশা বিষয়ে তিনি গভীরভাবে পীড়িত ছিলেন। এর পরিণামস্বরূপ অবৈধ ও অসামাজিক প্রেম নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ব্যতিক্রমী সাহস ও সহানুভূতি। তিনি গৃহীত প্রথাসমূহ ও ঐতিহ্যকে তাঁর অনুসন্ধানমূলক নিরীক্ষণের বিষয় করেন এবং মুক্ত ও খোলা মন নিয়ে মানব-মানবীর সম্পর্ককে যাচাই করে দেখেন। এ-কথা বলা অন্যায় হবে না যে, তাঁর খ্যাতির কারণগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে সহানুভূতির প্রচলিত সামাজিক নীতিমালা অমান্যকারী নারী ও পুরুষদের চরিত্রচিত্রণ।

বাঙলা উপন্যাসের বিবর্তনে শরৎ চন্দ্র চট্টেপাধ্যায়ের অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে যে বিষয়টি আমাদের চোখে ধরা পড়ে তা হলো, বাঙালি পাঠকদের মধ্যে তাঁর অতুলনীয় জনপ্রিয়তা। বহু ভারতীয় ভাষায় তাঁর বইগুলি অনূদিত হয়েছে এবং সেসব ভাষায় উপন্যাসের বিকাশকে তা প্রভাবিত করেছে। তা সত্ত্বেও এ-কথা বলতে হয় যে, গুণগত উৎকর্ষের দিক থেকে তিনি বাঙলারই ঔপন্যাসিক। বাঙালি চরিত্রের শক্তি ও দুর্বলতাগুলি তাঁর লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে, উষ্ণ সহানুভূতি ও ত্বরিত সংবেদিতা গুণসহ, অধিকতর নিখুঁতভাবে সম্ভবত অন্য যে-কোনো লেখকের চেয়ে। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির গড়পড়তা মানুষের জীবনের বৈশিষ্ট্য যে ভাবপ্রবণতা তা উঠে এসেছে তাঁর লেখায় বিরল বিশ্বস্ততার সঙ্গে। বাঙলা ভাষায় তাঁর চাইতে মহত্তর বা অধিক জ্ঞানঋদ্ধ লেখক থাকতে পারেন অথবা নাও পারেন, কিন্তু নিশ্চিতভাবে সেখানে এমন কেউ ছিলেন না যিনি মানুষের ভালোবাসা তাঁর চেয়ে বেশি পেয়েছেন।

শরৎ চন্দ্র  চট্টোপাধ্যায়ের প্রথমদিকের উপন্যাসগুলিতে গঠনের দিক থেকে অনেক ত্রুটি ছিল এবং সেগুলিতে আবেগপ্রবণতাও ছিল অত্যন্ত বেশি। সেগুলির উচ্ছ্বাসময় আবেগপ্রবণতা শিল্পে যে প্রশান্তি ও ভারসাম্য দাবি করে প্রায়শ তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তবুও সেগুলি সাধারণ বাঙালি পাঠকদের হৃদয়ের নিকটতম তন্ত্রীতে আঘাত করে। এর কারণ হলো, পাঠক যা চায় সেগুলি পাঠককে তা দিতে পারে। তাঁর উপন্যাস দ্রুত ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, কিন্তু তা অর্জিত হয়েছিল সেগুলির শিল্পগুণের ঘাটতির বিনিময়ে। তবে যাই হোক না কেন, শরৎ চন্দ্রের প্রথমদিকের রচনাগুলি কোনো নতুন পথ নির্দেশ করতে পারেনি। বলা হয়ে থাকে, বড় দিদি উপন্যাসটির প্রথম দুই পরিচ্ছেদ যখন প্রকাশিত হয় তখনও লেখকের নাম তেমন কেউ জানত না; অনেকেই মনে করেছিল যে, এটি রবীন্দ্রনাথের নতুন কোনো গল্প। রবীন্দ্রনাথ তখন নিজেই একটি সাময়িকী সম্পাদনা করছিলেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত সচিব এই বলে এর প্রতিবাদ করেছিলেন যে – রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে তাঁর কোনো প্রতিপক্ষ সাময়িকীতে নিজের নতুন উপন্যাস ছাপতে দেবেন – এমন কাজ ঠিক নয়। বিস্মিত রবীন্দ্রনাথের অস্বীকৃতি হজম করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়েছিল। এই ঘটনাটি প্রমাণ করে, সাধারণ মানুষের মনে শরৎ চন্দ্রের গল্পটি কী প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু এই ইঙ্গিতও দিয়েছিল যে, এমনকি কট্টর পাঠকরাও তাতে রবীন্দ্রনাথের দ্বারা জনপ্রিয়কৃত শৈলীর পরিচয় পেয়েছিলেন।

শরৎ চন্দ্র তাঁর শেষের দিকের উপন্যাসগুলিতে প্রায়শ নতুন  নতুন ধারণা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলির সঙ্গে গভীর পরিচয় বা সম্পর্ক স্থাপনে তিনি সবসময় সফল হতে পারেননি। তাঁর সব লেখায় একটি শক্তিশালী উদ্দেশ্যমূলক পর্যবেক্ষণ বর্তমান, কিন্তু সর্বশেষ উপন্যাসগুলিতে তা কট্টর ও রূঢ় হয়ে পড়েছে। প্রচারের দাবিকে তিনি সেখানে শিল্পের দাবি অতিক্রম করতে দিয়েছেন। এর কারণ ছিল অংশত সেসব বিরাট পরিবর্তন, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কাল থেকে ভারতীয় মন-মানসে ঘটছিল। জাতীয় স্বাধীনতার একটি নতুন আগ্রহ সৃষ্টি হয় ভারতীয়দের মধ্যে যারা স্বপ্ন দেখেছিল নতুন এক সামাজিক শৃঙ্খলার যেখানে পুরোনোদের হতাশা আর থাকবে না। নবজাগরণ ও পুনর্জাগরণের শক্তিগুলি লড়াই করছিল ভারতীয় মননের দখল নিতে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন কিছুটা প্রশমিত হয়ে আসার পর নৈরাশ্য ও প্রতিক্রিয়া নতুন এই জাগরণের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এতদ্সত্ত্বেও জীবনের পুরোনো ধাঁচ আর ফিরিয়ে আনা যায়নি যেহেতু এই আন্দোলনগুলি ছিল জোয়ারের ঢেউয়ের মতো, যেখানে কিছুটা  সময়ের পর জোয়ারের পানি নেমে যায় কিন্তু সৈকতে থেকে যায় কিছু পরিবর্তন। শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে জাতীয় এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিলেন এবং  তাঁর কাজগুলিতে এর স্থায়ী চিহ্ন থেকে যায়। তিনি নতুন নতুন ধারণার আবেদন অনুভব করতে পেরেছিলেন, কিন্তু তাঁর কল্পনাশক্তির মধ্যে সেগুলির পূর্ণ গুরুত্ব সংহত করতে পারেননি। এ থেকেই কিছুটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কেন তাঁর শেষদিকের অনেক রচনায় চরিত্র নির্মাণের চাইতে প্রচারধর্মিতাই অধিকতর প্রবল হয়ে উঠেছে।

শরৎ চন্দ্রের প্রতিভার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে তাঁর জীবনের মধ্যপর্বের কাজগুলির মধ্যে। সেগুলিতে রয়েছে সত্যের ছাপ যেহেতু এই বইগুলিতেই তিনি চিত্রিত করেছেন সেই চরিত্রগুলি যেসব চরিত্র তাঁর গভীরভাবে চেনা। তারা জীবন্ত, যেহেতু তারা সেইসব নারী ও পুরুষ যাদের জীবনের সঙ্গে তিনি নিজের জীবনকে ভাগ করে নিয়েছিলেন। তারা কোনো পূর্বধারণাকৃত পরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্ট নয়, বরং কল্পনা ও অভিজ্ঞতার মিলনের ফল হিসেবেই তাদের সৃষ্টি। সেগুলি আমাদের সামনে বাঙালি সমাজের বিপুলসংখ্যক নানা ধরনের মানুষের চিত্র তুলে ধরে। একদিকে আমরা এমন স্বাভাবিক নারী ও পুরুষদের সাক্ষাৎ পাই যারা প্রচলিত ধরনের জীবনযাপন করে এবং প্রতিষ্ঠান ও ঐতিহ্যসমূহের অভিভাবক। অন্যদিকে রয়েছে বিদ্রোহী ও দুর্বোধ্য মানুষেরা যারা সমাজের বাঁধা সীমানার বাইরে বাস করে ও সামাজিক শৃঙ্খলার পক্ষে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। শরৎ চন্দ্র নির্দয় সঠিকতার সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণিসমূহের সংকীর্ণ ও সীমিত জীবনকে শনাক্ত করেছেন, কিন্তু যে স্বাভাবিক সহানুভূতি তাদের জীবনের দুঃখকষ্টকে সহনীয় করে তোলে তার কথাও ভুলে যাননি। একজন ব্যক্তির মধ্যে নিষ্ঠুরতা ও ভাবালুতার পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের ভারসাম্য রক্ষা করা হয় সামাজিক অবিচার ও ঔদাসীন্যের সমন্বয়ের দ্বারা। কোনো কিছুই তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। কারণ এসব পরিণত রচনায় একজন দর্শকের অব্যর্থ দৃষ্টি অবলম্বনের মাধ্যমে তিনি সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দিক চিত্রিত করেছেন। সেগুলিতে কোনো অসংশ্লিষ্ট উদ্দেশ্য তাঁর লক্ষ্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। চরিত্রগুলি যেমন প্রাণপ্রাচুর্যময় জীবনীশক্তিতে উজ্জ্বল, তেমনি রচনার গণপ্রেক্ষাপট সঞ্জীবিত হয়েছে চিরন্তন সত্য দ্বারা।

শরৎ চন্দ্র প্রধানত একজন গল্প-বলিয়ে। তাঁর বিষয়বস্তুগুলি সরল ও সহজবোধ্য, যদিও আখ্যানসমূহ প্রায়শ জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। নিজের বর্ণনাক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত বলেই তিনি পুরোনো বিষয়বস্তুতে ফিরে যেতে কখনও দ্বিধা করেন না। নারী ও পুরুষের চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রেও তাঁর কিছু ঘাটতি রয়েছে। তিনি আমাদের স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য প্রায়শ একটি বা দুটি বৈশিষ্ট্যকে অতিরঞ্জিত করে সন্তুষ্ট থেকেছেন। একই চরিত্র প্রায়শ ভিন্ন ভিন্ন নামে ফিরে এসেছে। কখনও কখনও একটি একক চরিত্র সৃষ্টি করার বদলে তিনি বরং চরিত্রের ধরন তুলে ধরেই তৃপ্ত থেকেছেন। প্রথম সারিতে জায়গা পাওয়ার দাবিদার একজন কথাশিল্পীর বিরুদ্ধে এগুলি গুরুতর অভিযোগ। সঠিক অথবা ভুল ভাবে যেভাবেই হোক না কেন – এসব অভিযোগই এসেছে শরৎ চন্দ্রের বিপক্ষে। কিন্তু একজন গল্প-বলিয়ে হিসেবে তাঁর দক্ষতা বিষয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। তিনি একজন অসাধারণ গল্প-বলিয়ে এবং তাঁর বর্ণনার সহজ ভঙ্গি ও অবাধ প্রবাহ আমাদের তাঁর আখ্যানসমূহের সকল ত্রুটি এবং চরিত্রসৃজনের সব দুর্বলতার কথা ভুলিয়ে দেয়। পূর্ণস্ফীত বন্যার স্রোতের মতো তাঁর কাহিনিগুলি আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় এবং আমরাও রুদ্ধশ্বাসে তাতে ভেসে যাই।

সামন্ততান্ত্রিক ভারত পাশ্চাত্যের আধিপত্যের চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হওয়ার শেষ প্রয়াস চালিয়েছিল। পরাজয় সামন্ততন্ত্রের ভাগ্য নির্ধারিত করে দিয়েছিল এবং কিছুকালের জন্য দেশের বিরাট অংশগুলিতে নেমে এসেছিল নৈরাশ্য ও নিস্পৃহতার ভাব। কয়েকটি ক্ষেত্রে বাঙলা ছিল এর ব্যতিক্রম। অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক দ্রুততার সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে বাঙলা গ্রহণ করে নিয়েছিল। এখানে বুদ্ধিজীবীদের একটি নতুন শ্রেণি গড়ে উঠেছিল যাঁরা পাশ্চাত্যের মূল্যবোধগুলিকেও ভারতীয় ঐতিহ্যের অঙ্গীভূত করতে চেয়েছিলেন। সচেতনতা জাগ্রত হওয়ার একটি আবহ তখন তৈরি হচ্ছিল এবং সাহসী তরুণ হৃদয়গুলি স্বপ্ন দেখছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক সংস্কারের। আমরা দেখেছি, ভারতীয় মনের উপর পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাবজনিত অভিঘাতের ফলে বাঙলা উপন্যাসের জন্ম কিভাবে হয়েছিল। ইতোমধ্যে শরৎ চন্দ্রের জন্ম হয়েছে, ভারতীয় নবজাগরণের আরো অগ্রগতি ঘটেছে। গ্রামীণ জীবনে দারিদ্র্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ও সেই সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় বহু মানুষ শহরাঞ্চলে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছিল। আবার শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকায় ধারণাগুলিও প্রচারিত হচ্ছিল আরো দ্রুততার সঙ্গে। মধ্যবিত্ত শ্রেণিগুলির শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের নতুন দাবিও উঠছিল। বাঙলার হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণিগুলি ছিল এই আন্দোলনের অগ্রদূত এবং এই শ্রেণির একজন হিসেবে শরৎ চন্দ্রও নতুন জাগরণে শরিক হয়েছিলেন।

শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাঙলার প্রত্যন্ত এক জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তিনি জন্মসূত্রেই পেয়েছিলেন। তিনি বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির একজন মানুষের মতোই জীবন কাটিয়েছেন, তবে তিনি ভারতের কেন্দ্রস্থলের আরো সরল এবং কোনো কোনো দিক থেকে সচ্ছল জীবনযাপনকারী মানুষদের সাহচর্যেও এসেছিলেন। তাঁর সংবেদনশীল ও কৌতূহলী মন তাদের সামাজিক রীতিনীতি ও সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা লক্ষ করতে পেরেছিল। পাশ্চাত্য ও ভারতীয় আদর্শের দ্বন্দ্ব এবং এমনকি আরো বেশি ভারতীয় ঐতিহ্যগুলির মধ্যে পারস্পরিক ভিন্নতা তাঁর মনকে উদার এবং তাঁকে বহু প্রচলিত সামাজিক রীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। এই বিদ্রোহ যে শুধু তাঁর লেখার মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে তা নয়, বরং তাঁর জীবনেও প্রতিফলিত হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে, তাঁর মতো সামাজিক পটভূমি ও ঐতিহ্যের কোনো যুবক প্রচলিত পথ ধরে শিক্ষিত হয়ে উঠতেন এবং তখনকার দিনের কোনো একটি স্বীকৃত পেশা গ্রহণ করে জীবন কাটিয়ে দিতেন। তাঁর ভেতরকার বিদ্রোহী সত্তা তাঁকে তা করতে দেয়নি। তরুণ বয়সেই তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত জীবনের আশ্রয় ত্যাগ করেন।

তীক্ষè সামাজিক ও রাজনৈতিক এক সচেতনতা শরৎ চন্দ্রকে নতুন পথে চালিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং বাধ্য করেছিল সুদূর বার্মায় [মিয়ানমার] ভাগ্যান্বেষণে যেতে। যে দশ বছর তিনি সেখানে কাটিয়েছিলেন সে-সময়ে ভারতীয় জীবনের প্রায় সব ধরনের মানুষের সান্নিধ্যে তিনি এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় সব প্রদেশের ও সব সামাজিক ধরনের মানুষ সেখানে ছিলেন। স্থান, সময় ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একে অপরের কাছ থেকে অনেক দূরে অবস্থানকারী নারী ও পুরুষ সেখানে আকস্মিকভাবে এক জায়গায় মিলিত হতে এবং এক অভিন্ন জীবনের অংশীদার হতে বাধ্য হয়েছিল। শরৎ চন্দ্রও দেখেছিলেন, মানুষ যখন একবার সামাজিক প্রতিবেশের বাইরে চলে আসে তখন কীভাবে ঐতিহ্যগত বাধাগুলি ভেঙে পড়ে। তারা হয়ে যায় প্রবৃত্তির দাস এবং যেসব বাধা পূর্বে অনতিক্রম্য মনে হয়েছিল সেসব বাধাও অনায়াসে অতিক্রম করে যায়। সামাজিক বাধাসমূহ দুর্বল হয়ে পড়ায় এবং ব্যক্তিমানুষ তার নিজ প্রবৃত্তি ও স্বভাবের কাছে ফিরে যাওয়ায় নতুন একটি সমাজ গড়ে ওঠে।

সাধারণভাবে শ্রীকান্ত উপন্যাসটিকে শরৎ চন্দ্রের শ্রেষ্ঠ রচনা বলে বিবেচনা করা হয়। এটি প্রধানত একটি আত্মজীবনীমূলক রচনা এবং এর মূল অবলম্বন তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে, এতে রয়েছে বার্মায় বসবাসকারী ভারতীয়দের একটি নিখুঁত বিবরণ। বার্মায় প্রবাসজীবন যাপনকালে বাঙলার পল্লি এলাকা ও শহরাঞ্চলের নারী ও পুরুষ সকলেই প্রত্যন্ততম সীমান্ত এলাকার মানুষজনের সঙ্গেও গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলাত। উড়িষ্যার কারুশিল্পী ও সিন্ধু প্রদেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, অন্ধ্রের শ্রমজীবী এবং রাজস্থানের ব্যবসায়ী – সবাই ছিল সেখানে। যখন তারা প্রথমে জাহাজে উঠত প্রত্যেক ব্যক্তি ও দল জাহাজে নিজেদের জায়গা চিহ্নিত করে রাখত। জাহাজটি তখন হয়ে উঠত ভারতের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায় রক্ষা করে চলেছে তাদের পৃথক পরিচয়সত্তা এবং একে অন্যের সঙ্গে কেবল আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন করে। সমুদ্রযাত্রা শেষ হওয়ার আগেই এসবের সমাপ্তি ঘটে। একটি সাইক্লোন জাহাজটিকে আঘাত করে এবং ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিমানুষ ও সামাজিক সত্তার মানুষকে লণ্ডভণ্ড ও একাকার করে ফেলে। জাহাজযাত্রীরা যেসব কৃত্রিম বাঁধ তৈরি করেছিল সেগুলি ভেসে যায় এবং মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়ে। অন্ধ্রের মানুষটি নিক্ষিপ্ত হয় সীমান্ত প্রদেশের পাঠানের বাহুযুগলের মধ্যে। বাঙালি মিশে পড়ে রাজস্থানের ব্যবসায়ীর সঙ্গে আর উড়িষ্যার লোকটি নিজেকে আবিষ্কার করে সিন্ধু প্রদেশের ব্যবসায়ীর পাশে। তারা একজন অন্যজনকে আঁকড়ে ধরে এবং একে অপরের সঙ্গ থেকে শক্তি খোঁজে। ঝড় থামার পর তারা নিজেদের খোলসের মধ্যে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা সবাই জানে যে, বাঁধগুলি ভেঙে পড়েছে। ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় জীবনের আপাত প্রতীয়মানতা পুনঃস্থাপিত হয়, কিন্তু তারা সবাই অনুভব করে যে সেটি শুধু একটি আভাসমাত্র। সমুদ্রের ঝড় তাদের পূর্বসংস্কারগুলি চুরমার করে দিয়েছে এবং তারা অন্তত বার্মায় যে-কয়দিন থাকবে সে-কয়দিন পুরোনো সামাজিক বিশ্বাসগুলির প্রভাব তাদের উপর খুব সামান্যই থেকে যাবে।

শরৎ চন্দ্র নগ্ন বাস্তবতার সঙ্গে সামাজিক বন্ধনগুলি থেকে মুক্তির পরিণামগুলি চিত্রিত করেছেন। তিনি জানতেন, কেবল অল্পকিছু মানুষই তাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ভিত্তিতে নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের জীবন পরিচালনার জন্য প্রচলিত রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের উপর নির্ভর না করে বাঁচতে পারে না। সামাজিক অনুশাসনগুলি না থাকার ফলে বার্মা-প্রবাসী ভারতীয়রা তাদের অনেক সামাজিক নিষেধ ও কুসংস্কার থেকে মুক্তি পায়। একই সঙ্গে তা পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক নৈতিকতার দায়গুলিকেও আলগা করে দেয়।

হিন্দু সমাজ যুগ যুগ ধরে টিকে ছিল বর্ণব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে। বর্ণব্যবস্থা আবার টিকে থাকে আন্তঃভোজন ও আন্তঃবর্ণ বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞাকে ভর করে। বার্মায় বসবাসকারী ভারতীয় সমাজ অথবা অন্তত এর বড় একটি অংশ এই নিষেধাজ্ঞাগুলির কোনোটিই মেনে চলত না। শরৎ চন্দ্র তাঁর পথের দাবী উপন্যাসে একটি বর্মি পরিবারের বর্ণনা প্রদান করেছেন, যাদের বড় মেয়েটি বিয়ে করেছে মাদ্রাজের এক মুসলমানকে, দ্বিতীয় মেয়েটি চট্টগ্রামের এক ভারতীয় পর্তুগিজকে, তৃতীয়টি একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানকে ও চতুর্থটি একজন বার্মাবাসী চীনাকে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা নয়। উপন্যাসের নায়িকা নিজেও একজন বাঙালি ব্রাহ্মণের কন্যা, কিন্তু তার পিতার মৃত্যুর পর তার মা থাকছে ব্যাঙ্গালোরের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের সঙ্গে।

ভারতের বাইরে এই ভারতীয় সমাজে শুধু যে সামাজিক প্রথা ও ঐতিহ্যসমূহই ভেঙে পড়েছিল তা নয়, সামাজিক মূল্যবোধসমূহের অনেকগুলিও সেইসঙ্গে অন্তর্হিত হয়েছিল। দেশত্যাগীরা তাদের সামাজিক বন্ধনসূত্রগুলি হারিয়ে ফেলেছিল এবং অনেকের জীবনেই স্বার্থপরতা ও  লোভ-লালসা ছাড়া অন্য কোনো পথনির্দেশক নীতি ছিল না। তাদের মধ্যে অনেকেই অপেক্ষা করে বসে ছিল সেই দিনটির জন্য যেদিন তারা ভারতে ফিরে আসবে এবং তাদের পুরোনো মূল্যবোধগুলি আবার অবলম্বন করতে পারবে। ইতোমধ্যে তারা বার্মায় নিছক সুবিধাবাদ ও স্বার্থপরতার এক জীবন যাপন করে যাচ্ছিল। শ্রীকান্ত উপন্যাসে শরৎ চন্দ্র নীতিভ্রষ্টতার এক রূঢ় চিত্র এঁকেছেন যাতে আক্রান্ত হয়েছিল তাঁর স্বদেশবাসীদের মধ্যে অনেকেই। বাঙলা থেকে আগত এক ব্যক্তি বহু বছর ধরে বার্মায় থেকেছে এবং এখন সে দেশে ফিরে আসার পরিকল্পনা করছে। সে এক বর্মি মহিলার সঙ্গে ঘর বেঁধেছিল, কিন্তু মহিলাটি তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করলেও সে কখনো সেই মহিলাকে মনের দিক থেকে তার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে চায়নি। মহিলাটিকে সে বলেছিল যে, এক জরুরি আহ্বানে সে ভারতে যেতে বাধ্য হচ্ছে এবং শীঘ্রই সে ফিরে আসবে। মহিলাটি তাকে বিদায় জানাতে এসেছিল তার বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে। লোকটি দুঃখের ভান করছিল এবং

বাইরে তার প্রস্থানের জন্য হা-হুতাশ করে যাচ্ছিল। প্রকৃতপক্ষে অবশ্য সে মহিলাটিকে নিয়ে তামাশা করছিল এবং বিদ্রূপ করার জন্য তার সঙ্গী জাহাজযাত্রীদের সামনে মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরেছিল।

শরৎ চন্দ্র যে দশ বছর বার্মায় কাটিয়েছিলেন সেই দশ বছরে মানব-মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে গভীরতর অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, মানুষ কি পরিমাণ স্বার্থপর ও নির্লজ্জ হতে পারে যখন সামাজিক বাধানিষেধগুলি অপসারিত হয়ে পড়ে। তিনি আরো দেখেছিলেন, অনুভূতির সূক্ষ্ম তারতম্য কত সীমাহীন হতে পারে যখন সমাজ দ্বারা আরোপিত সমরূপতা বিসর্জন দেওয়া হয়। গড়পড়তা সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রে অভ্যাস ও ঐতিহ্যগুলি বিশ্বাসের স্থান গ্রহণ করে। তারা একটি গোলক তৈরি করে যা আমাদের কাছ থেকে তার হৃদয়ের অন্তস্তলের গোপনীয়তাগুলি লুকিয়ে রাখে। তার নৈতিকতা ও ধর্ম বহুলাংশে ঐতিহ্যবাহী এবং তার প্রাতিস্বিকতার স্ফূরণ দমিত করে রাখে। সামাজিক চাপগুলি একবার সরিয়ে নেওয়া হলে, নৈরাজ্য ও উচ্ছৃঙ্খলতার ঝুঁকি থেকে যায়, তবে সেখানে প্রাতিস্বিক গুণাবলির পূর্ণ বিকাশের সম্ভাবনাও থাকে। যখন কোনো একক ব্যক্তিসত্তা নিজেকে খুঁজে পায়, নৈতিকতা ও ধর্ম তার জন্য কেবল সামাজিক অভ্যাস থাকে না, বরং তা হয়ে ওঠে তার গভীরতম অভিজ্ঞতার ফসল।

শরৎ চন্দ্রের গোঁড়ামিমুক্ত জীবন ও কঠিন অভিজ্ঞতাসমূহই প্রধানত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ভিন্নতার কারণ। শরৎ চন্দ্র বারবার রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর ঋণের কথা স্বীকার করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথ যে অনেকভাবে তাঁকে প্রভাবিত করেছেন তা লক্ষ করা যায়। এটি কেবল তাঁর চেতনার অভিগামিতা ও রচনারীতির মধ্যে নয়, এমনকি তাঁর ভাষায়ও দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও স্বীকৃত সামাজিক রীতিগুলিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং সামাজিক নিপীড়নের প্রতিবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও পুরোনো মূল্যবোধগুলি পুনর্মূল্যায়নের চেষ্টা নিয়েছেন। উপন্যাসে বৃহত্তর বাস্তবতা নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণও করেছেন এবং প্রকৃতপক্ষে এই প্রয়াসকে বাস্তবতার আরো কাছাকাছি নিয়ে গেছেন। এসব অনুরক্তি সত্ত্বেও, শরৎ চন্দ্রের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্পের প্রতি প্রবণতা অত্যন্ত ভিন্নধরনের। রবীন্দ্রনাথ প্রথমত ও প্রধানত একজন শিল্পী এবং তাঁর মূল্য লক্ষ্য হলো সৌন্দর্য সৃষ্টি। শরৎ চন্দ্রও একজন শিল্পী, কিন্তু তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, একজন শিল্পীর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। তিনি মনে করতেন, একজন ঔপন্যাসিকের মানবিক আবেগসমূহ বিশ্লেষণ ও চিত্রণ শুধু শিল্পকর্ম সৃষ্টির মধ্যে আবদ্ধ থাকা উচিত নয়, বরং তা মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকারী ঘৃণা ও দ্বন্দ্বসমূহের নিরসনেও সহায়ক হওয়া উচিত।

অতএব শরৎ চন্দ্র যা কিছু লিখেছেন তার মধ্যে একটি গভীর সামাজিক উদ্দেশ্য সম্পৃক্ত রয়েছে। উদ্দেশ্যের জায়গা থেকে বিচার করা হলে তাঁর কাজগুলিকে চারটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণিটিতে রয়েছে তাঁর গল্পগুলি যেখানে সামাজিক উদ্দেশ্যটি রয়েছে গভীরে নিহিত এবং কদাচিৎ তা বুঝতে পারা যায়। দ্বিতীয় শ্রেণিটিতে রয়েছে একটি ব্যক্ত সামাজিক উদ্দেশ্য, তবে তা অঙ্গাঙ্গিভাবে অন্তর্ভুক্ত কাহিনির মধ্যে যা এগিয়ে যায় এর নিজস্ব প্রেরণাশক্তি নিয়ে। তৃতীয় শ্রেণিতে উদ্দেশ্য কাহিনিকে পূর্ণরূপে প্রভাবিত করে এবং শরৎ চন্দ্র এই বিষয়টি গোপন রাখেন না। চতুর্থ শ্রেণিতে রয়েছে সেই বইগুলি যেখানে কাহিনি হয়ে পড়েছে উদ্দেশ্যের অনুগামী এবং শিল্প প্রায়শ প্রচারের রূপ গ্রহণ রয়েছে।

প্রথম শ্রেণিটির মধ্যে রয়েছে বিন্দুর ছেলে গল্পটি ও দত্তার মতো উপন্যাসগুলি। এসব রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উদার ও উষ্ণ মানবিকতা। সেখানে সরাসরি কোনো সমস্যার প্রতি ইঙ্গিত নেই, কিন্তু মানুষ যেখানে একত্র সমাবিষ্ট হয়, সেখানেই সংঘাত ও সংঘর্ষ প্রায় অবধারিতভাবে উপস্থিত হয়। বিন্দুর ছেলেতে সংকটের সৃষ্টি হয় অমূল্যর জন্য বিন্দুর আত্যন্তিক স্নেহের কারণে। সে বিন্দুর নিজের সন্তান নয়, কিন্তু একজন নিঃসন্তান মায়ের সব স্নেহ-ভালোবাসাই উৎসারিত হয় তার ওপর। তবে বিন্দুর মাতৃস্নেহ নিঃস্বার্থ নয়। সে ছেলেটির সব স্নেহকামনা তার একার প্রতি ধরে রাখতে চায় এবং ছেলে অন্য কাউকে ভালোবাসবে এটা সে সহ্য করতে পারে না। তার এই অসম্ভব দাবি সংসারে সংকটের সৃষ্টি করে এবং সে-সংকটের অবসান ঘটে কেবল তখনই যখন কষ্টভোগ তাকে নমিত করে।

নির্মাণ-কাঠামো ও চরিত্রচিত্রণের দিক থেকে দত্তা উপন্যাসটিকে অনেকেই শরৎ চন্দ্রের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির একটি বলে মনে করেন। এই উপন্যাসটিতে কোনো সামাজিক সমস্যার অবতারণা করা হয়নি, কিন্তু এতে তুলে ধরা হয়েছে পরস্পরবিরোধী ইচ্ছা ও কামনার দ্বারা পীড়িত নায়িকার ব্যক্তিগত সমস্যা। বিজয়া ভালোবাসে নরেন্দ্রকে, কিন্তু সে মনে করে যে, তার মৃত পিতার ইচ্ছানুযায়ী সে বিলাসকে বিয়ে করতে বাধ্য। বিলাসের পিতা রাসবিহারী ক্রমাগত তাকে মনে করিয়ে দিয়ে চলেন যে, বিজয়ার পিতা তাঁকে এই মর্মে কথা দিয়েছিলেন। যেহেতু পিতার মৃত্যুর পর রাসবিহারীরাই তার অভিভাবক হয়েছেন, অতএব সে তাঁকে অবিশ^াস করতে পারে না এবং তবুও সে তার ভবিষ্যতের এই ইঙ্গিতকে স্বাগতও জানাতে পারে না। যখন নরেন্দ্র তাকে প্রমাণ হিসেবে তার পিতার চিঠিটি দেখায় যে, তিনি চেয়েছিলেন বিজয়া নরেন্দ্রকে বিয়ে করুক, বিলাসকে নয়; তখন তার মনের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। এমনটা ঘটার পর বাইরের বাধাগুলি আর অনতিক্রম্য থাকে না এবং উপন্যাসটির মধুর সমাপ্তি ঘটে। শরৎ চন্দ্রের অন্য প্রায় যে-কোনো উপন্যাসের চেয়ে দত্তায় অধিকতর স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে, বাইরের শক্তিগুলির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্বের চাইতে বরং মানুষের নিজের মধ্যকার দ্বন্দ্বের চিত্র ফুটিয়ে তুলতেই তিনি অধিক পারদর্শী। বিজয়া তাঁর প্রিয় নায়িকাদের অন্যতম কারণ সে নারীসুলভ বিনয়ের সঙ্গে কামনার দ্বন্দ্বকে নিজের ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে প্রকাশ করে। এর কাহিনিটি বর্ণিত হয় বাকসংযম ও অসাধারণ সাবলীলতার সঙ্গে যা রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কাজগুলির কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।

শরৎ চন্দ্রের দ্বিতীয় প্রকারের উপন্যাসগুলির মধ্যে রয়েছে গৃহদাহ, চরিত্রহীন ও শ্রীকান্তের মতো বইগুলি। সেগুলিতে লেখক সামাজিক সমস্যা ও দ্বন্দ্বসমূহ সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন, কিন্তু সেগুলি তাঁর কাহিনি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। শরৎ চন্দ্র তাঁর সবচেয়ে পরিণত উপন্যাসগুলির অধিকাংশতেই সমস্যাগুলির কথা তুলেছেন, কিন্তু কোথাও তার কোনো সমাধান নির্দেশ করেননি। শ্রীকান্ত, যেটি অনেকের মতেই তাঁর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কাজ, শুরু হয়েছে একটি ভ্রমণকাহিনি হিসেবেই, কিন্তু শীঘ্রই তা হয়ে ওঠে একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস। কাহিনি আবর্তিত হয় বাল্যপ্রেমিকা রাজলক্ষ্মীর প্রতি শ্রীকান্তের ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে, যে শ্রীকান্তের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল এক বৃদ্ধের সঙ্গে বিবাহের পর। বিধবা হওয়ার পর সে একজন পেশাজীবিনী গায়িকার জীবন অবলম্বন করে; বিদ্যমান ভারতীয় সমাজে এ-ধরনের গায়িকাদের সচরাচর পতিতা বলে ঘৃণা করা হয়। রাজলক্ষ্মী গায়িকার পেশাজীবন গ্রহণ করে, কিন্তু অন্তরজীবনের পবিত্রতা রক্ষা করে চলে। নিতান্ত ভাগ্যক্রমে আবার সে শ্রীকান্তের সান্নিধ্যে আসতে সক্ষম হয়। দুজনের সাক্ষাৎ ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই রাজলক্ষ্মী বুঝতে পারে যে, সারা জীবন ধরে সে তাকে ভালোবেসেছে ও তার জন্য অপেক্ষা করেছে। বৈধব্যের প্রতি হিন্দু সমাজের চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং পালিত সন্তানের শ্রদ্ধা ধরে রাখার জন্য উৎকণ্ঠার কারণে তার ভালোবাসা পূর্ণতা লাভ ধরে না। তার ট্র্যাজেডি নিহিত জীবনের এই অপচয়ের মধ্যে যার উদ্ভব ঘটেছে আবেগের দ্বন্দ্ব থেকে। সে তার সমস্ত হৃদয় দিয়ে শ্রীকান্তকে কামনা করে এবং গোপনে আশা পোষণ করে তার ঔরসে সন্তান ধারণের। তার সচেতন মন সমাজ কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সে এমনকি এও বলে যে, শ্রীকান্তের প্রতি তার ভালোবাসা সামাজিক বিধিবিধানের বিরুদ্ধে হতে পারে, কিন্তু নৈতিক বিধানকে তা লঙ্ঘন করে না। এতদ্সত্ত্বেও শত শতাব্দীর ঐতিহ্য তার সচেতন বিদ্রোহকে পরাজিত করে এবং শ্রীকান্তের প্রতি তার ভালোবাসাকে চরিতার্থ করার পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি ও কল্পনাশক্তির সাহসিকতার দিক থেকে বিচার করলে চরিত্রহীন হচ্ছে শরৎ চন্দ্রের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির মধ্যে একটি। দুটি প্রেমকাহিনি ঘিরে এটি আবর্তিত হয়েছে। উপেন্দ্রর প্রতি কিরণময়ীর ভালোবাসা এবং সতীশের জন্য সাবিত্রীর ভালোবাসা। শরৎ চন্দ্রের সাহিত্যভুবনে কিরণময়ী সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্রগুলির মধ্যে একটি। সে সামাজিক রীতিগুলিকে অগ্রাহ্য করে এবং জনপ্রিয় বিশ্বাসগুলিকে উপহাস করে। সে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এবং তার ইচ্ছাগুলি পূরণ করার জন্য নিজের সৌন্দর্যকে ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। নিজের স্বামীর প্রতি তার আকর্ষণ অতি সামান্য এবং এক পর্যায়ে সে তার শারীরিক ক্ষুধা মেটানোর জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত থাকে। সে ধর্ম কিংবা প্রথা কোনো কিছুই স্বীকার করে না এবং বস্তুগত সুখকেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করে। উপেন্দ্র যখন তার ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করে তখন সে তার দুর্বলতম জায়গাগুলির একটিতে আঘাত করার মাধ্যমে নিজে নিজেই প্রতিশোধ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। উপেন্দ্রর প্রায় সন্তানতুল্য আত্মজন দিবাকরকে তার প্রতি প্রলুব্ধ করার জন্য সে একটি পরিকল্পনা করে। এরপর যখন সে এতে সফল হয় তখন সে আবিষ্কার করে যে, দিবাকরকে সে ধ্বংস করে ফেলেছে, কিন্তু সুখ বা শান্তি কিছুই সে পায়নি। পক্ষান্তরে সাবিত্রী সতীশকে ভালোবাসে প্রায় নিষ্কাম প্রেমের মতো। সতীশকে পাওয়ার ইচ্ছা সে পোষণ করে, কিন্তু উপলব্ধি করে যে, তার অতীত তাদের মিলনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাহিনি আরো জটিল আকার ধারণ করে যখন সতীশ আকৃষ্ট হয় সরোজিনীর প্রতি। সরোজিনীর মনেও সতীশের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে উঠতে দেখে সে কষ্ট পায়, কিন্তু সে যে শুধু বাধাই দেয় না তা নয়, বরং সরোজিনীকে বিয়ে করার জন্য সতীশকে উৎসাহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সর্বতোভাবে সবকিছু করে। উপেন্দ্রকে চিত্রিত করা হয়েছে একটি আদর্শ চরিত্র রূপে, কিন্তু সে পুরোপুরি বিমূর্ত ও প্রাণহীন থেকে যায়। কেউ কেউ সতীশকে সহজ নৈতিকতার মানুষ বলে মনে করে, কিন্তু তার মধ্যে একটি দৃঢ়তা ও স্পষ্টতা আছে, যা সাবিত্রী ও সরোজিনীর মতো দুটি অকৃত্রিম ও বিপরীত চরিত্রের ভালোবাসা জয় করতে পারে।

মানবিক আবেগসমূহের বিয়োগান্ত বিপর্যয় দেখা গেছে গৃহদাহ উপন্যাসে এর চরম রূপে। কয়েকটি বিবেচনায় গৃহদাহকে গণ্য করা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঘরে বাইরে উপন্যাসে যেসব সমস্যা উত্থাপন করেছেন সেগুলির উত্তর হিসেবে। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে বিমলা স্বামী নিখিলকে ভালোবাসত তার নিজের জীবনে  সন্দ্বীপের উপস্থিতি না ঘটা পর্যন্ত। কখনো বা মনে হয়েছে যেন এই অভিঘাত তাকে তার নিজ কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করবে; কিন্তু শীঘ্রই সে সন্দ্বীপের মধ্যে যেসব অপর্যাপ্ততা রয়েছে সেগুলি আবিষ্কার করতে সক্ষম হলো। ঘটনার বিপর্যয়মূলক পরিণতি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলো; কিন্তু এর একমাত্র কারণ হলো সন্দ্বীপ ছিল একজন অসম প্রতিদ্বন্দ্বী। গৃহদাহ-এ অচলা নিজেই নিজের মধ্যে বিদীর্ণ হচ্ছিল মহিম ও সুরেশ উভয়ের প্রতি তার ভালোবাসা দ্বারা। কিছু কিছু দিক থেকে মহিম সবলতর চরিত্র। কিন্তু সুরেশের মধ্যে রয়েছে আবেগতাড়িত আভিজাত্য যা প্রায়শ মেয়েদের কাছে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। সে সুচিন্তিতভাবেই সুরেশের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে মহিমকে বিয়ে করেছিল, কিন্তু যখনই সে তাকে বিয়ে করল তখনই সে তার কাজের জন্য এবং এর ফলে সুরেশও যে কষ্ট পেয়েছে সে-কথা ভেবে অনুতপ্ত হয়ে পড়ল। প্রথমদিকে সে তার উদগ্র ভালোবাসার দ্বারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু যখন সে এর সঙ্গে তুলনা করে দেখল তার স্বামীর শীতলতা ও অনাগ্রহের তখন সে কামনা করতে শুরু করল সুরেশের উষ্ণতা ও প্রেম। বস্তুত সে মহিমের প্রতি তার বিশ^স্ততা ও সুরেশের প্রতি তার আকর্ষণের দোলাচলের মধ্যে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। অবশেষে সে সুরেশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু সেটি করে সে তার প্রবল আবেগের কারণে নয়, বরং আপাত প্রতীয়মানতার প্রতি মিথ্যা বিশ্বাসের কারণে। এর ত্বরিত প্রতিক্রিয়া ঘটে এবং এক অপরাধবোধ ও অনুতাপ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। মহিমের প্রতি ও সুরেশের প্রতি আকর্ষণ দ্বারা ক্ষতবিক্ষত হয় সে। আবেগের এই বিভাজনই তার গৌরব এবং একই সঙ্গে বিয়োগান্ত ঘটনাও।

দ্বিতীয় প্রকারের এই উপন্যাসগুলিতে সামাজিক উদ্দেশ্য বেশ প্রকাশ্যভাবেই এসেছে, কিন্তু সেগুলিকে কাহিনি থেকে আলাদা করা যায় না। এসব দুঃখ ও নিষ্ফলতার মধ্যে জীবনে নিয়তির ছোট ছোট খেলা অনুভব করা যায়, কিন্তু শরৎ চন্দ্র তাঁর কাহিনিগুলিতে শুধু সেগুলি অন্তর্ভুক্ত করেই তৃপ্ত থেকেছেন কোনো উত্তর দেওয়ার চেষ্টা ছাড়াই। শ্রীকান্ত উপন্যাসে তিনি ভালোবাসা ও তজ্জনিত হতাশার কথাই বিবৃত করেছেন, কিন্তু এর ধারণাজনিত কাঠামোর মধ্যে কিভাবে সে সমস্যার সমাধান হতে পারে সে-কথা আমাদের বলেন না। অন্নদা দিদি প্রথার বন্ধনে সাড়া দিয়ে দুঃখ পেয়েছিলেন। ইন্দ্রনাথ তার হৃদয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল এবং দুঃখ পেয়েছিল। শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মী দুজনেই তাদের একে অপরের প্রতি ভালোবাসার আকর্ষণ গভীরভাবে অনুভব করে, কিন্তু তবুও এর পূর্ণতাসাধনের কোনো উপায় খুঁজে পায় না। অভয়া ছাড়া, যে সামাজিক নিয়মপ্রথা অগ্রাহ্য করে দ্বন্দ্বের সমাধান করেছিল, এই শ্রেণির অন্য কোনো চরিত্র এমনকি বিদ্রোহের চেষ্টাও করেনি। চরিত্রহীন-এর সাবিত্রীকে বাধ্য হয়ে প্রেমহীন হতাশাজর্জরিত জীবন কাটাতে হয়। শরৎ চন্দ্র নিষ্ফলতা ও অপচয় প্রত্যক্ষ করেন এবং তাঁর মন গভীর সহানুভূতিতে আলোড়িত হয়। কিন্তু তিনি এর কোনো সমাধান বা প্রতিকার নির্দেশ করেন না। তাঁর শিল্পসৃষ্টি তৃপ্ত থাকে কেবল প্রত্যক্ষণ ও চিত্রণের মধ্যেই। তিনি কখনও বিচার করতে ও সমাধান নির্দেশ করতে প্রয়াসী হন না।

এসব সামাজিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার প্রতি আরো বেশি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাতই ছিল শরৎ চন্দ্রের তৃতীয় প্রকার উপন্যাসগুলির বৈশিষ্ট্য। শরৎ চন্দ্র এখন আর তৃপ্ত থাকেননি শুধু পর্যবেক্ষণ ও লিপিবদ্ধকরণের মধ্যে, বরং সেগুলির
ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সমাধানেও ব্রতী হলেন। নিপীড়িতদের প্রতি  তাঁর সহানুভূতি এখানেও তেমনি গভীর, কিন্তু এখন তাতে যুক্ত হয়েছে কপটতা ও প্রতারণার প্রতি তিক্ত মনোভাব। তাঁর রচনায় শ্লেষ আরো গভীর রূপ পেতে থাকে, কিন্তু পাপীকে পাপের সঙ্গে একাত্ম করে দেখার ব্যাপারে তিনি হয়ে পড়েন অনেক বেশি মানবিক। রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁর মধ্যেও রয়েছে শিল্পীর নিরাসক্ততা, যা রুক্ষতা ছাড়াই মন্দকে ঘৃণা করতে পারে। পল্লী সমাজ উপন্যাসে তিনি গ্রামীণ জীবনের দারিদ্র্য ও অবনতিকে চিত্রিত করেছেন নগ্ন বাস্তবতার সঙ্গে। অধিকাংশ চরিত্রের ক্ষেত্রে ধর্মাচারই গ্রহণ করেছে ধর্মবিশ্বাসের স্থান। এমনকি সবচেয়ে সবল দুই চরিত্র রমা ও রমেশও তাদের সামাজিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে যেতে পারেনি। রমা ভালোবাসে রমেশকে, কিন্তু সামাজিক অপবাদের ভয়ে তাকে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করে। অপ্রচলিত সামাজিক প্রথাসমূহ থেকে উদ্ভূত নিষ্ঠুরতা ও নীচতা এখানে তুলে ধরা হয়েছে অনুকম্পাহীন যুক্তিসহকারে। বামুনের মেয়ে উপন্যাসে জাতপাতের একাকিত্ব ও গর্বের ভণ্ডামি সম্পর্কে কঠোর আলোকপাত করা হয়েছে। হিন্দু সমাজে জাতপাতের বিন্যাসে ব্রাহ্মণদের অবস্থান সবার উপরে এবং ব্রাহ্মণদের মধ্যে আবার কুলীনরাই সর্বোচ্চ শ্রেণির। এই উপন্যাসের নায়িকা সন্ধ্যা কুলীন পরিবারগুলির মধ্যে সবচেয়ে অভিজাত শ্রেণির ব্রাহ্মণকন্যা। সে কেবল তার জন্মের জন্যই গর্বিতা নয়, একই সঙ্গে জন্মসূত্রের দায়িত্বসমূহ সম্পর্কেও সচেতন। এ কারণে সে তার ছেলেবেলার সঙ্গী কিছুটা নিম্নকুলজাত এক ব্রাহ্মণতনয়ের প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করে। তাকে সে ভালোবাসে, কিন্তু নিজ কুলের চেয়ে নিম্নতর কুলের সন্তান বলে বিয়ে করতে পারে না। তার বিয়ে ঠিক হয় তাদের সমমর্যাদাসম্পন্ন অপর এক কুলীনের সঙ্গে, যদিও পাত্রটি বয়সে তার পিতামহপ্রতিম। তবে ভাগ্য এখানে তার সঙ্গে এক নিষ্ঠুর খেলা খেলে। ছেলেবেলার খেলার সাথিকে সন্ধ্যা প্রত্যাখ্যান করেছিল সে তাদের পারিবারিক অবস্থানের চেয়ে নিম্নতর অবস্থানের ব্রাহ্মণসন্তান বলে, কিন্তু বিয়ের রাতে সে জানতে পারে যে, সে নিজে আসলে নিম্নশ্রেণির এক নাপিতের নাতনি এবং তার কোনো মর্যাদাই নেই।

এই প্রকারের রচনার মধ্যেই আমরা প্রথম লক্ষ করি যে, শরৎ চন্দ্রের শিল্পকর্মে চিড় ধরতে শুরু করেছে। এ-উপন্যাসে সন্ধ্যার ভাগ্যে যে পরিণতি ঘটেছে তা বিশ্বাসযোগ্য কোনো উপাদান নয়। তার জীবনেতিহাস অঘটনীয় আখ্যা দিয়ে বাতিল করা যায় না, কারণ জীবনে অনেক অদ্ভুত ঘটনাও ঘটে। বাস্তবিক পক্ষে, এ-কথা বলাও হয়েছে যে, এই কাহিনির ভিত্তি একটি সত্য ঘটনা। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য এমন যুক্তি অপ্রাসঙ্গিক, কারণ সত্য ঘটনাকে শিল্পে গ্রহণযোগ্য করবার জন্য তাতে কল্পনার সত্যসদৃশতার আবরণ যুক্ত করতে হয়। এই একই কথা প্রযোজ্য হতে পারে পল্লীসমাজ-এর অনেক চরিত্রের ক্ষেত্রে। তবুও এই প্রকারের রচনাগুলির মধ্যে সামাজিক বার্তার শৈল্পিক সংশ্লেষ ঘটানোর প্রয়াস লক্ষণীয়। শরৎ চন্দ্রের ভক্তদের মধ্যে কেউ কেউ এমনকি এই মতও পোষণ করেন যে, পল্লীসমাজ সম্ভবত তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজ।

শরৎ চন্দ্রের শেষ প্রকারের রচনায় এমনকি শিল্পের ভানটুকুও পরিত্যক্ত হয়। সেগুলিতে যে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয় সেটিই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা একটি নতুন নির্বন্ধের দিকে ধাবিত হয়। শিল্প-প্রবণতা গ্রহণ করে প্রচারের ভূমিকা, যদিও গল্প-বলিয়ে হিসেবে তাঁর দক্ষতা তখনও অদৃশ্য হয়ে যায়নি। তাঁর রচনাশৈলীর দক্ষতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই যে, তাঁর একেবারে শেষদিকের লেখাগুলিতে প্রকাশ্য নীতিবাদিতার চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠলেও তিনি তাঁর পাঠকদের আগ্রহ ধরে রাখতে পেরেছিলেন। তিনি যেভাবে কাজ করেছেন তাতে তাঁর সাফল্য অর্জনের দুটি কারণ ছিল। তিনি এমন বিষয়বস্তু বেছে নিতেন যা তাঁর পাঠকদের কাছে ছিল জ¦লন্ত আগ্রহের একটি বিষয় এবং সে-বিষয়টি তিনি ব্যবহার করতেন আন্তরিকতা ও আবেগ দিয়ে। বিষয়বস্তুর প্রতি আগ্রহ ত্রুটির অর্ধেকটা পুষিয়ে দেয় এবং তাঁর ঐকান্তিকতা পুষিয়ে দেয় বাকি অর্ধেকটা। এছাড়াও তিনি কখনও তাঁর শৈল্পিক নিরাসক্তি পুরোপুরি বিসর্জন দেন না, যদিও তিনি প্রায়শ কষ্টদায়কভাবে তার প্রান্তসীমায় চলে আসেন। এছাড়াও, নিজের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করার জন্য মানুষের অগ্রগতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন।

পথের দাবী, শেষ প্রশ্ন শেষ পরিচয় তাঁর এই শেষ প্রকার কাজগুলির মধ্যে পড়ে এবং সেগুলির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরল প্রচারমূলক উৎসাহ।

শেষ পরিচয় উপন্যাসটি তিনি অসমাপ্ত রেখে যান এবং রাধারানী দেবী সেটি সমাপ্ত করেন। অতএব সেটি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। পথের দাবীর ঘটনাবলি বিবৃত হয়েছে ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত এক বিপ্লবীর কর্মকাণ্ডকে ঘিরে। এমন বিপ্লবীরা অবধারিতভাবে রোমান্টিক যেহেতু তাঁরা বেঁচে থাকেন মৃত্যুর সার্বক্ষণিক ছায়ার নিচে। যেহেতু তাদের রয়েছে এক গোপন জীবন, যা ভয়ের কারণ যখন হয় এমনকি তখনও ঔৎসুক্যের উদ্রেক করে, অতএব পাঠকের বিচারবোধকে নিস্তেজ করে দেয়; ফলে লেখক এমন বহু বিষয় তাতে নিয়ে এসেও পার পেয়ে যান যেগুলি পাঠকের অধিকতর সচেতনতা অন্যথায় প্রত্যাখ্যান করত। শেষ প্রশ্ন-এ কমল একটি আধুনিক চরিত্র যার মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহাও রয়েছে। সে প্রগতিতে বিশ্বাস করে এবং তার সব ধারণা সামাজিক অগ্রগতির বিষয়ে সমকালীন বিশ্বাসগুলির সঙ্গে মিলে যায়। যেহেতু এই প্রজন্মের অধিকাংশ শিক্ষিত ভারতীয় প্রগতিতে ও এই চিন্তায় বিশ্বাস করত যে, প্রগতি অর্জিত হবে উপন্যাসে বর্ণিত উপায়ে, সে-কারণে তারা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই শরৎ চন্দ্রের তত্ত্বগুলি গ্রহণ করে নিয়েছিল। পথের দাবী অথবা শেষ প্রশ্ন-এ পাঠক কদাচিৎ লক্ষ করে কীভাবে লেখকের কল্পনা ঝুলে পড়েছে এবং চরিত্রের ধারণা অবাস্তব ও ছকে-বাঁধা হয়ে গেছে। তাঁর কাজে এই প্রথমবারের মতো আমরা লক্ষ করি এমন সব চরিত্র যারা পুরোপুরি  দুষ্ট প্রকৃতির অথবা পুরোপুরি ভালো। এই উপন্যাসগুলি তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। একই ঘটনা ঘটেছিল বঙ্কিমের নৈতিকতাপীড়িত অনেক উপন্যাসের ক্ষেত্রেও। তাহলে আমরা কীভাবে নিশ্চিত হতে পারি যে, শরৎ চন্দ্রের এসব রচনাও বঙ্কিমের অনুরূপ রচনাগুলির মতো একই ভাগ্য বরণ করবে না?

শরৎ চন্দ্রকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল যা তা হলো মানবচরিত্রে সহজাত বুদ্ধি ও ঐতিহ্যের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। আমরা একদিকে বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও কল্পনার আন্তঃক্রিয়াজাত বিশ্বাস ও প্রবণতাগুলি দ্বারা তাড়িত হই; আবার এর একটি বিপরীত শক্তিও রয়েছে যার মূল নিহিত আমাদের স্বভাবের গভীরতার মধ্যে এবং যা বুদ্ধিবৃত্তিজাত ও সামাজিক বাধাসমূহের উভয়গুলিকে অগ্রাহ্য করে। শরৎ চন্দ্রের শ্রেষ্ঠ কাজ হচ্ছে সেগুলি যেখানে এই দুটি প্রভাবের ভারসাম্য রক্ষিত হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভারসাম্য পাওয়া যায় প্রায়শ পুরুষ চরিত্রের চেয়ে নারী চরিত্রেই বেশি। অতএব এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না যে, নারী চরিত্র চিত্রণেই তিনি অধিক নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। পুরুষ বেশি পরিচালিত হয় তার বুদ্ধি দ্বারা আর নারী তার স্বজ্ঞা দ্বারা। তাঁর বিশ্বাস ও প্রবণতা অধিক প্রভাবিত হয়েছে তাঁর মন দ্বারা, যেখানে তাঁর অভিজ্ঞতাকে রাঙিয়েছে নারী এবং অনুভূতি অধিক প্রভাবিত করেছে তাঁর বিশ্বাসকে। সামাজিক রীতিনীতি নারীর জন্য এমনভাবে সৃষ্ট যা তাদের প্রকৃতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। পুরুষ এগুলিকে দেখে তির্যকভাবে এবং সেগুলিকে মনে করে এমন বাহ্যিক বাধা হিসেবে যা অতিক্রমযোগ্য এবং অতিক্রম করা উচিত।

শরৎ চন্দ্রের প্রিয় বিষয়বস্তুগুলির একটি হচ্ছে নারীসুলভ অনুভূতি ও সামাজিক বিধি-নিষেধগুলির মধ্যেকার বিরোধ। ভালোবাসা একজন নারীকে অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে আকর্ষণ করে। তার চিরাচরিত বিশ্বাসগুলিও অবশ্য সমভাবে শক্তিশালী এবং তা প্রায়শ তাকে ভালোবাসার আহ্বান প্রতিরোধ করতে বাধ্য করে। এই দ্বন্দ্বের কোনো সমাধান নেই এবং তা সত্ত্বেও দ্বন্দ্ব কোনো স্থায়ী কল্যাণ সাধন করে না। ঐতিহ্য ও সহজাত প্রবণতার এই অবিরাম সংগ্রাম মানবজীবনের অধিকাংশ বিয়োগান্ত ঘটনা অর্থাৎ ট্র্যাজেডির মূল। এই দ্বন্দ্বই পল্লী সমাজ উপন্যাসে রমেশ ও রমার ভালোবাসাকে প্রহসনে রূপান্তরিত করেছিল। চরিত্রহীন উপন্যাসে সাবিত্রী তার সকল হৃদয় দিয়ে সতীশকে ভালোবেসেছিল, কিন্তু সে জানত তার ভালোবাসায় পূর্ণতা কোনোদিন আসবে না। অনুরূপভাবে শ্রীকান্ত উপন্যাসে রাজলক্ষ্মীর ভালোবাসাও অপূর্ণ থেকে যায় তার ভালোবাসা ও বিশ্বাসের মধ্যে টানাপড়েনের কারণে। কিরণময়ী প্রচলিত রীতিসমূহ অগ্রাহ্য করতে চেয়েছিল, কিন্তু নিজের এই হঠকারিতার জন্য তাকে ভয়ানক মূল্য দিতে হয়। যে একটিমাত্র চরিত্র সাফল্যের সঙ্গে ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছিল সে হচ্ছে অভয়া; কিন্তু সে হচ্ছে এক ব্যতিক্রমী নারী যে বাস করছিল অস্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যে।

শরৎ চন্দ্রের মধ্যে তাঁর বৈপ্লবিক আকুলতা সত্ত্বেও, রক্ষণশীলতার একটি উপাদান ছিল যা প্রায়শ মানুষজনকে বিস্মিত করেছে। এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় তাঁর নারী চরিত্র চিত্রণে। তাঁর নায়িকাদের মধ্যে অনেকেই সামাজিক নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে। তাদের কারো কারো মধ্যে রয়েছে দ্যুতিময় বুদ্ধিবৃত্তিক স্থিতাবস্থার গুণাবলি। তাদের সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধনমুক্তি সত্ত্বেও তারা জটিল মুহূর্তগুলিতে এমনকি সেসব প্রথার প্রতিও অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করে যেগুলির রয়েছে সামান্য প্রাণশক্তি বা মূল্য। শ্রীকান্তে রাজলক্ষ্মী অথবা চরিত্রহীনে সাবিত্রীকে পতিতা বলা যেতে পারে। অন্তরের পবিত্রতা যে তাদের রক্ষা করা উচিত এতে আমাদের বিস্ময়ের কিছু নেই, কিন্তু তাদের যখন গোঁড়া হিন্দু বিধবাদের পালনীয় ধর্মাচার ও আনুষ্ঠানিকতা অনুকরণ ও অনুসরণের চেষ্টা করতে দেখি আমরা তখন তা আমাদের বিস্মিত করে।

এ বিষয়টিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এর একটি ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে, মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিপূরণ সূত্র অনুযায়ীই রাজলক্ষ্মী ও সাবিত্রী তাদের অতীতের প্রায়শ্চিত্ত- চেষ্টার কারণেই ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাগুলি কঠোরভাবে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিল। এ-কথা সবারই জানা যে, দুশ্চরিত্র মানুষ ও বেশ্যাদের মধ্যে অনেকেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে। সংশোধিত পাপী ও সংশয়বাদীদের রুক্ষতা সবসময় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু এমন ব্যাখ্যা রাজলক্ষ্মী ও সাবিত্রীর চরিত্র সম্পর্কে পুরোপুরি ভুল ব্যাখ্যা তুলে ধরে। শরৎ চন্দ্রের অনুরূপ চরিত্র উপস্থাপন সম্পর্কে বলা যায় যে, যদি সারা বিশ^ তাদের ভ্রষ্টা নারী বলে মনেও করে, তবু তারা তাদের অন্তরের পবিত্রতা কখনও হারিয়ে ফেলেনি। একজন কলঙ্কিতা নারী কৃচ্ছ্রতার কঠোরতা অনুসরণের মাধ্যমে তার পতনের প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করত, কিন্তু রাজলক্ষ্মী কিংবা সাবিত্রী কেউই সে শ্রেণির মধ্যে পড়ে না। শ্রীকান্তের অন্নদা দিদি সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযোজ্য। তারা সবাই সামাজিক অবিচারের শিকার, কখনও কখনও তারা সামাজিক বিদ্রোহী, কিন্তু কদাপি সামাজিক অপরাধী নয়। নারীত্বের নিখুঁত প্রতিমূর্তি এই নারীরা প্রায়শ্চিত্তের জন্য অর্থহীন সামাজিক প্রথা ও কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে থাকবে – অতীতের ভুলের প্রায়শ্চিত্তের তত্ত্ব হিসেবে একে ব্যাখ্যা করা যায় না।

শরৎ চন্দ্র তাঁর উপন্যাসে অন্য কয়েকটি চরিত্রের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের ইঙ্গিত তুলে ধরে এর প্রকৃত ব্যাখ্যার সূত্র আমাদের দিয়েছেন, যাদের অনুরূপ সামাজিক কলঙ্কচিহ্ন স্পর্শ করতে পারেনি। পথের দাবীর ভারতী, শেষ প্রশ্নের কমল অথবা বিপ্রদাসের বন্দনা এসেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক স্তর থেকে। তারা শিক্ষিতা ও সংস্কৃতিবান এবং তাদের কোনো প্রশ্নবোধক অতীত নেই। তারা বুদ্ধিমতী, এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে অগ্রসর এবং প্রচলিত বিশ্বাস ও কুসংস্কার সম্পর্কে সমালোচনামুখরও। তবে তাদের সবরকম সংস্কারমুক্ততা সত্ত্বেও তারা অবশ্য গোঁড়া হিন্দু সমাজের রীতিনীতি ও পূর্বসংস্কারগুলিকে অতিক্রম করতে পারেনি। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিবারে বড় হয়ে ওঠা ভারতী শুধু পোশাক নয়, বরং একটি গোঁড়া হিন্দু মেয়ের আচার-ব্যবহার ও প্রথাগুলিও গ্রহণ করে। বন্দনা তার সকল আধুনিক শিক্ষা ও আলোকিত জীবন নিয়েও ক্রমাগত চেষ্টা করে যায় নিজেকে প্রাচীন ধাঁচে ঢেলে সাজানোর। সবার মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, শরৎ চন্দ্র যাকে প্রচলিত আচার-পদ্ধতি ও বিশ্বাসের ক্ষমাহীন বিরোধী হিসেবে চিত্রিত করেছেন সেই কমল তার আচরণে জীবিকাকে অনুসরণ করে না। অবাধ প্রেমের সমর্থনদাত্রী ও ভবিষ্যতের সমাজের অগ্রপথিক – যদিও কারো কারো মতে আধুনিকতাবাদী বাকসর্বস্বতার একটি উদাহরণ ছাড়া অন্য কিছু নয় – কমল বিনাবিচারে নিরামিষ ভোজনের আধ্যাত্মিক শক্তির গ্রহীতা রূপে সবচেয়ে বেশি আধুনিক।

অতএব শরৎ চন্দ্রের রক্ষণশীলতাকে অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে মর্যাদা অর্জনের উদগ্র বাসনার তত্ত্বপ্রকল্প ব্যতীত অন্য কোনোকিছুর ভিত্তিতে। বার্মায় তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সম্ভবত তা থেকে এর প্রকৃত ব্যাখ্যার একটি সূত্র পাওয়া যাবে। যদি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি ভালো-মন্দ সব মানুষের ক্ষেত্রে অত্যধিক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সব মানুষের জন্য কি অনুরূপ নিয়ন্ত্রণ কাঙ্ক্ষিত নয়? যেমনটি স্টিভেনসন বলেছেন, প্রবল আবেগ হচ্ছে একটি সিংহের মতো এবং গার্হস্থ্য জীবনের জন্য কদাচিৎ তা উপযোগী। প্রতিভাবান ব্যক্তিও অনুরূপভাবে সমাজের বিধি-নিষেধগুলি দ্বারা নিজে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে ভাবতে পারে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই সিংহ নয় এবং কখনও তা হতেও চায় না। তারা সুখের চেয়ে স্বস্তিই চায় বেশি, তেমনি প্রবল আবেগের বন্যতার চেয়ে গার্হস্থ্য জীবনের স্থিরতা। পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে গার্হস্থ্য জীবনের সুখ ও স্বস্তির কামনা যে অধিকতর প্রবল হবে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এর একটি কারণ হচ্ছে সামাজিক বন্ধনসমূহের অবসানের কারণে নারীরাই কষ্টভোগ করে বেশি। আরেকটি কারণ হচ্ছে, প্রকৃতিগতভাবে পুরুষেরা নারীদের চেয়ে অধিক আত্মকেন্দ্রিক। বস্তুত, এর কোনো জীবতত্ত্বগত কারণও থাকতে পারে। প্রজাতির  অনুবর্তনের ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা নৈমিত্তিক ও ক্ষণস্থায়ী। প্রবল আবেগের চাহিদা পূরণ হয়ে গেলে পুরুষ প্রায়শ এর সামাজিক ফলাফলের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। নারীর ক্ষেত্রে সেটি অন্যরূপ। তার প্রবল আবেগ কেবল যৌনমিলন দ্বারাই শেষ হয়ে যায় না। সে মাতৃত্বের মধ্যে এর ফলাফল পেতে চায়। পুরুষের জন্য পিতৃত্ব একটি দৈব ঘটনা মাত্র। নারীর ক্ষেত্রে মাতৃত্ব যৌনমিলনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। শরৎ চন্দ্রের পুরুষ চরিত্রগুলি খামখেয়ালিপূর্ণ ও অহংসর্বস্ব। পক্ষান্তরে তাঁর নারী চরিত্রগুলির অধিকাংশেরই বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বাভাবিকতা ও কোমলতা। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাঁর নায়িকারা তাদের নায়কদের ভালোবাসে প্রায় মায়ের মতো ভালোবাসা দিয়ে। নারীরা সমাজসৌধের সিমেন্ট; পুরুষ বড়জোর এর ইট ও পাথর।

শরৎ চন্দ্রের উচ্চতর সামাজিক সচেতনতাই তাঁকে নারীর সহজাত-রক্ষণশীলতা আবিষ্কারের দিকে চালিত করেছিল। অন্য দুটি উপাদান জোরদার করেছিল তাঁর এই অন্তর্দৃষ্টিকে। অতীতের পাপগুলির জন্য প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিপূরণের আইন/ সূত্র তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির এই রক্ষণশীলতার উপাদানের কারণ হতে পারে না। কিন্তু মানবজীবনের সঙ্গে একবার প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটার ফলেই তাঁর মনে রক্ষণশীলতার এই পোকা জন্ম নেয়। এর ক্রমবৃদ্ধি ঘটারও এটিই কারণ। এটি কাজ করে এমন উপায়ে যা যথেষ্ট সাধারণ এবং একে জীবনের অন্যান্য ধরনের ক্ষেত্রেও বর্ণনা করা যায়। যারা বড় ধরনের অপরাধ করে তারা প্রায়শ ছোটখাটো অপরাধ করার সময় দ্বিধায় ভোগে। আমরা যাদের বড় ধরনের ক্ষতি করে ফেলেছি তাদের প্রায়শ ছোটখাটো ব্যাপারে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করি। যুক্তির দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, এর মধ্যে হয়তো সামান্য যৌক্তিকতাই আছে। এমনকি একজন সাংঘাতিক শত্রুর প্রতি সামান্য ভদ্রতা প্রদর্শনও দুর্বলতার পরিচয় হতে পারে। আমরা একবার যাদের আহত করেছি তাদের সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দেওয়ার কাজটি অধিকতর রাজনৈতিক প্রকৃতির হতে পারে। এতদ্সত্ত্বেও এ-কথা সত্য যে, বাস্তবজীবনে আমাদের বিরাট অন্যায়গুলির প্রতিকার সাধনের জন্য আমরা খুব সামান্যই চেষ্টা করি। নিখাদ পরহিতব্রতের মতো পুরোপুরি নিষ্ঠুরতাও বিরল। মানুষ তার চরিত্রের মধ্যেকার অদ্ভুত অসংগতিগুলির সঙ্গে যুক্তিহীনভাবে ক্রমাগত এগিয়ে যায়। এই একই কারণে শরৎ চন্দ্রের নায়িকারাও অযৌক্তিক আচরণ করে। তারা সম্ভবত অনুভব করে যে, নৈতিকতার মৌলিক অনুমানগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হলে অল্প সময়ের মধ্যেই কাজটি তারা করতে পারবে।

শরৎ চন্দ্রের রক্ষণশীলতায় অপর যে-বিষয়টি ভূমিকা রেখেছে তা এসেছে তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে। যেসব মানুষ রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন তাঁরা প্রায়শ সামাজিক বিবেচনার দিক থেকে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছেন। পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক প্রভুত্বের বিরুদ্ধে তাঁদের বিদ্রোহ প্রসারিত হয়েছে পাশ্চাত্যের সামাজিক ধারণাগুলি পর্যন্ত। রাজনৈতিকভাবে অধীন একটি দেশে দেশপ্রেম গুলিয়ে ফেলা হয় প্রাচীন পূর্বসংস্কারগুলির সঙ্গে। দেশপ্রেম প্রায়শ এর কুসংস্কারগুলির প্রতি ভালোবাসার রূপ গ্রহণ করে। নবজাগরণ ক্রমশ অবোধ্যভাবে পুনর্জাগরণের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। শরৎ চন্দ্রের দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং তার সামাজিক দুর্ঘটনাসমূহের আড়ালে রাজনৈতিক অন্যায়গুলি সম্পর্কে তাঁর অনুভব সম্ভবত তাঁকে প্রচলিত রীতিনীতি ও বিশ্বাসগুলির একজন অসচেতন প্রতিরোধকারীতে পরিণত করেছিল। তাঁর সচেতন মন ব্যক্তিত্বের অবাধ প্রকাশকে বাধাদানকারী কুসংস্কার ও পূর্বসংস্কারগুলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে, যে-কোনো একটি ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতাকে ক্রমশ দুর্বল করে ফেলা হলে তা অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রগতির শক্তিকে সাহায্য করবে। এতদ্সত্ত্বেও তাঁর অচেতন মন এমনকি কুসংস্কারগুলিকেও অগ্রাহ্য করতে পারেনি। সেগুলির স্বকীয় মূল্য হয়তো সামান্য ছিল, কিন্তু সেগুলির উৎপন্ন প্রভাব তাঁর কাছে ছিল অনেক বেশি। সেগুলি তাঁর প্রিয় ছিল শুধু এ-কারণে যে, তিনি যে মানুষদের ভালোবাসতেন তাদের সামাজিক সচেতনতার একটি অংশ ছিল তা।

এভাবেই বৈপ্লবিক তাড়না ও রক্ষণশীল পুনরাবৃত্তি শরৎচন্দ্রের চরিত্রে ও কর্মে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে গিয়েছিল। এই দ্বন্দ্ব তাঁর রচনাকর্মকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে এবং এখানেই নিহিত সেগুলির প্রতি আমাদের বিশেষ আগ্রহের বিষয়টি। কারণ আমরা সবাই এই দ্বন্দ্ব ও অনিশ্চয়তার ভাগীদার। আমরা পুরোনো ধরনগুলি ও প্রথাসমূহের ব্যাপারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি এবং সেগুলি পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করতে চাই। কিন্তু একেবারে আক্রমণের মুহূর্তেও আমাদের মধ্যে যে একটি উপাদান রয়েছে সেটি দ্বিধায় ভুগতে থাকে। আমরা পুরোনো মূল্যবোধগুলিকে প্রত্যাখ্যান করতে চাই, কিন্তু সেগুলি আমাদের সত্তার একেবারে মূলের মধ্যে প্রবেশ করে আছে। সেগুলি প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে মনে হয় আমরা যেন আমাদের ব্যক্তিত্বকেই জীব-ব্যবচ্ছেদ করছি। আমাদের প্রয়োজনসমূহের অত্যাবশ্যকীয়তা দাবি করে নতুন থেকে নতুনতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কিন্তু সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলি নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বহন করে নিয়ে চলে ঐতিহ্যের উপাদান।

মানুষের মধ্যেকার এই দ্বন্দ্বের নানারকম নাম নেওয়া হয়েছে। ঐতিহ্য ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বৈপ্লবিক তাড়না ও রক্ষণশীল পূর্বানুবৃত্তি এবং যৌবন ও বার্ধক্যের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব – সবকিছুই এই মৌলিক তথ্যটি প্রকাশ করতে চায় যে, মানুষ সময়ের দুটি মাত্রার মধ্যে বসবাস করে। তার সব ক্রিয়াকর্ম পরম কারণবাদমূলক এবং সে ভবিষ্যতের এক জাতক। জীবনের চাহিদাগুলি তাকে সামনের দিকে চালিত করে এবং সে তার হৃদয়ের স্বপ্নগুলি বাস্তব ঘটনায় রূপান্তরিত করতে চায়। কিন্তু যে মুহূর্তে সে ওই কাজটি করার প্রয়াস পায় সে-মুহূর্তে তার অতীত নিজেকে পুনরধিষ্ঠিত করে। পুরোনো প্রথা ও বিশ্বাসগুলি, আত্মগত অভ্যাসগুলি এবং অভিজ্ঞতার অনুমিতিসমূহ তাকে লৌহশিকলে আবদ্ধ করে ও অতীতের বন্দিতে পরিণত করে। আগামীকালের দ্রুত ও আকুল রোমাঞ্চকর যাত্রা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে তার গতকালের সব ভারী বোঝায়। এই দ্বন্দ্ব মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতার সারাৎসার। তার বর্তমান শুধু একটি ফোকাস বা মূলবিন্দু যেখানে মিলিত হয়েছে অতীত ও বর্তমান।

শ্রীকান্ত শরৎচন্দ্রের মহত্তম সৃষ্টি, কারণ এতে এই দ্বন্দ্বটি শুদ্ধতম রূপে প্রকাশ পেয়েছে। সমস্যাটি নিয়ে আসা হয়েছে বইটির একেবারে শুরুতে। তরুণ, বুদ্ধিমান ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর ইন্দ্রনাথ মানুষের স্বাভাবিক স্বজ্ঞার প্রতীক। তার মধ্যকার তাড়না হচ্ছে জীবনের দাবিগুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া। সে প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি প্রত্যাখ্যান করে না; তার কাছে সেগুলির কোনো অস্তিত্বই নেই। অবশ্য নৈতিকতা একটি সামাজিক ধারণা এবং যথার্থভাবে এই কারণেই ইন্দ্রনাথের কাজগুলি কখনও অনৈতিক নয়। তার সহজাত বুদ্ধি যা তাকে করতে বলে সে তা-ই করে এবং সেগুলির নৈতিক নিহিতার্থ বিষয়ে পুরোপুরি অসচেতন। সেগুলি তার স্বতঃস্ফূর্ততা এবং পরী বা রোমান উপকথার বনদেবতার কাজের মতোই নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কহীন। ইন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম দেখায় শ্রীকান্ত কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিল, কিন্তু তা তাকে এক ধরনের মুক্তির স্বাদ দিয়েছিল। এমন মানুষ কে আছে যে গোপনে রীতিনীতি ও দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যেতে চায় না, চায় না প্রথা ও বিশ্বাসগুলির বোঝা ফেলে দিয়ে একেবারে নিজের মতো করে নির্ভার হতে?

যতবারই ইন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীকান্তের দেখা হয় ততবারই সে তার প্রাণশক্তির প্রাবল্যে ভেসে যায়। যখন ইন্দ্রনাথ সেখানে থাকে না তখনও প্রচলিত প্রথাসমূহ ও রীতিনীতি শ্রীকান্তকে সামাজিক প্রাকৃতদর্শনের কাছে আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে সাবধান করে দেয়। জাগতিক জ্ঞান এবং দায়িত্বশীলতার প্রতি আনুগত্য প্রচলিত জীবনপদ্ধতির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। সেখানেই রয়েছে সুখ এবং নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু ইন্দ্রনাথ উদ্দামতার প্রতীক এবং বিপজ্জনক। শ্রীকান্তের মধ্যে যে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো মানুষটি রয়েছে সেটি ইন্দ্রনাথের এই আবেদন অগ্রাহ্য করতে পারে না। ইন্দ্রনাথ যখন তাকে মাছ ধরতে যাওয়ার লোভ দেখায় তখন সে তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। অন্ধকার রাত ও স্রোতস্বিনী নদীর অভিজ্ঞতা এবং অপ্রতিরোধ্য বাতাস মিলেমিশে একেবারে একাকার হয়ে যায় তাকে উদ্দামতার মহিমা এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখাতে আর সেটি তার জীবনের মর্ম অনুভব করার বিষয়টিকে

চিরদিনের মতো বদলে দেয়।

ঐতিহ্য, মনে হয়, যুদ্ধে হেরে যায় এবং এর পর থেকে শ্রীকান্তের জীবন হয়ে উঠবে স্বাভাবিক প্রবৃত্তিসমূহের অপরিহার্যতা দ্বারা প্রভাবিত। অবশ্য স্বজ্ঞা বা সহজাত বুদ্ধি ও পূর্বসংস্কারের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব একটি দীর্ঘস্থায়ী বিষয় এবং অন্নদা দিদি এবার মঞ্চে আবির্ভূত হন ইন্দ্রনাথের ভাগ্য বরণ করা থেকে শ্রীকান্তকে রক্ষা করতে। তিনি পূর্বসংস্কারগুলির প্রতিভূ যেমনটা ইন্দ্রনাথ প্রবৃত্তিশক্তিগুলির। অতীতের প্রতি গভীর বিশ্বাস তাঁর জীবনের সব আকাঙ্ক্ষাকে নির্বাপিত করেছে। ইন্দ্রনাথ যেমন ভবিষ্যতের মধ্যে বেঁচে থাকে, তিনিও তেমনি বেঁচে থাকেন অতীতের মধ্যে। তাঁর বর্তমান অন্ধকার এবং ভবিষ্যৎ আরো বেশি অন্ধকার। সমাজ তাঁকে ঘৃণা করে তাঁর অনুমিত বিচ্যুতির জন্য, কিন্তু তিনি জানেন, এমনকি সুনাম হারানোর বিনিময়েও তিনি তাঁর পূর্বসংস্কার আঁকড়ে ধরে আছেন। তাঁর জীবন হচ্ছে নিজ  সতীত্বের আদর্শের জন্য নিরন্তর আত্মত্যাগ।

ইন্দ্রনাথ ও অন্নদা দিদি, মানবিক দিক থেকে যতটা সম্ভব বিশুদ্ধ প্রবৃত্তি ও বিশুদ্ধ পূর্বসংস্কারের প্রতিভূ। অবশ্য মানবপ্রকৃতি জটিল এবং একজন মানুষের মধ্যে উভয়ের সংমিশ্রণ অবশ্যই থাকবে। সেটিই সম্ভবত একমাত্র কারণ কেন উভয়েই শীঘ্র মঞ্চ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। শরৎ চন্দ্র তাঁর সহজাত বুদ্ধি দ্বারাই অনুভব করেছিলেন যে, তারা যদি বেশিদিন ধরে মঞ্চে থাকে তাহলে তারা অবশ্যই আর জীবনের বিশুদ্ধ রূপের প্রতিভূ থাকবে না। জীবন নিয়ন্ত্রণকারী নীতিমালা হিসেবে একটি আবক্ষচিত্রের রূপে তাদের প্রকাশ ঘটবে। কিন্তু তাদেরকে রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে চিত্রিত করার জন্য একটি পূর্ণাবয়ব চিত্রের প্রয়োজন হবে। অতএব কাহিনি পুরোনো হওয়ার আগেই অন্নদা দিদিকে অবশ্যই মরতে হবে। আবার ইন্দ্রনাথকেও অবশ্যই ধূসর হয়ে যেতে হয়, কারণ সে অন্নদা দিদির পরিপূরক। তাঁর অন্তর্হিতির সঙ্গেই তাকেও অবশ্যই উপাদানগুলির মধ্যে অবসিত হতে হবে।

ইন্দ্রনাথ ও অন্নদা দিদির প্রভাব অবশ্য থেকে যায়।

পূর্বসংস্কার ও সহজাত বুদ্ধির দ্বন্দ্ব নিজেই আবির্ভূত হয় উপন্যাসটির নির্দেশনা-নীতি রূপে। শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীর জীবন এবং তাদের পরস্পরের সম্পর্কের মধ্যেও এই দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ে। কখনও জয়ী হয় পূর্বসংস্কার, কখনও বা জীবনের অপরিহার্যতা। শ্রীকান্ত হয়ে পড়ে একজন ভবঘুরে এবং রাজলক্ষ্মী একজন পেশাজীবী গায়িকা। পরিবারের বন্ধন ও পূর্বসংস্কারের অনুবদ্ধতা তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা দমিয়ে রাখতে পারে না। কিন্তু ইন্দ্রনাথের বিজয়ও কখনও সম্পূর্ণ হয় না। ভালোবাসা ও সহজাত বুদ্ধি বারবার শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীকে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসে। তারা অবশ্য পূর্বসংস্কার ও সামাজিক নিয়মের বাধাগুলি  অতিক্রম করতে পারে না। তাদের ভালোবাসা অপূর্ণ থেকে যায় এবং আকর্ষণ ও বিকর্ষণের দুই মেরুর মাঝখানে পড়ে তারা ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। ঐতিহ্যের একজন প্রতিনিধি ও শিকার অন্নদা দিদি জয়ী হন।  পূর্বে যেমনটা বলা হয়েছে, শ্রীকান্ত উপন্যাসের অপর এক চরিত্র অভয়া সম্ভবত শরৎ  চন্দ্রের একমাত্র কন্যা যে অতীতের মৃত হাত সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।

শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অতএব, রবীন্দ্রনাথের দ্বারা সূচিত বাস্তবতাকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ চরিত্র, তাদের আদর্শবাদিতা সত্ত্বেও, সাধারণ জীবনের মানব-মানবী। বঙ্কিম চেষ্টা করেছিলেন বীরের চরিত্র নির্মাণ করতে এবং সেজন্য তাঁর উপন্যাসে অনুভূতির আন্তঃক্রিয়ার চাইতে ঘটনাবলিই প্রায়শ অধিক প্রাধান্য পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, বিশেষত তাঁর প্রথমদিকের উপন্যাসগুলিতে, প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাবলি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। নৌকাডুবি উপন্যাসে রমেশ ও কমলাকে একসূত্রে নিয়ে এসেছে একটি দুর্ঘটনা, কিন্তু তাদের জীবনযাপনের চিত্র এমন যা যে-কোনো নববিবাহিত দম্পতির জীবনে ঘটতে পারত। মহেন্দ্র যে বিনোদিনীর প্রতি আকৃষ্ট হয় তার কারণ কোনো আকস্মিক মনোবেগ নয়, বরং তা অনেক ছোটখাটো অভিজ্ঞতায় দুজনে একত্রে থাকার কারণে। শরৎ চন্দ্র এই ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন এবং যেসব উপায়ে চরিত্রগুলির পরিবর্তন ঘটেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেছেন। নায়ক ও নায়িকারা সাধারণত চেনা অবয়বের এবং আমরা সহজেই কল্পনা করতে পারি যে, তারা বেঁচে রয়েছে আমাদের চারপাশে। তিনি তাদের হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে প্রবেশ করতে পারেন এবং তাদের গোপন আশা ও ভয়গুলি তিনি বর্ণনা করেছেন। আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি, তিনি যেমন সহানুভূতির সঙ্গে সমাজ-পরিত্যক্ত ও বিপথগামীদের কথা বর্ণনা করতে দ্বিধা করেননি, তেমনি স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষদের সামাজিক জীবনও সহমর্মিতার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন।

শরৎ চন্দ্র অন্য একভাবে বাঙলা উপন্যাসের পরিধি বর্ধিত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের চরিত্রগুলি অধিকাংশই বিত্তশালী সমাজের মানুষ। রবীন্দ্রনাথ মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন চিত্রিত করেছেন এবং সেখানে মাঝে মধ্যে দারিদ্র্য ও অভাবের চিত্রও অঙ্কিত হয়েছে। তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসেই অবশ্য সুবিধাজনক অবস্থার মানুষদের কথা বলা হয়েছে। তবে সে যাই হোক না কেন, সেখানে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই যে, তাঁর কোনো একটি চরিত্রেরও পতনের কারণ দারিদ্র্য। কিন্তু শরৎ চন্দ্রের ক্ষেত্রে তা অন্যরূপ। তাঁর অনেক নায়ক ও নায়িকাও তুলনামূলকভাবে অবস্থাপন্ন, কিন্তু তিনি বঙ্কিম অথবা রবীন্দ্রনাথ যে-কারো চেয়ে দারিদ্র্য ও এর ক্ষতিকারক প্রভাবের ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন। রাজলক্ষ্মী পিয়ারী বাইজী হয়ে ওঠে প্রধানত সম্পদ অর্জনের উদ্দেশ্যে। সাবিত্রী এসেছে একটি দরিদ্র পরিবার থেকে।  এমনকি দারিদ্র্যের বিভাজনকারী প্রভাব আরো বেশি স্পষ্টভাবে দেখা যায় কিরণময়ী চরিত্রে। দারিদ্র্যের কারণেই সে অনঙ্গের এগিয়ে আসাকে প্রশ্রয় দেয়, কিন্তু দারিদ্র্যের সবচেয়ে বেশি নগ্নচিত্র দেখা যায় অরক্ষণীয়া-য়। শরৎ চন্দ্র তাঁর এসব কাজের মাধ্যমে বাঙলা উপন্যাসের বিকাশের পরবর্তী পর্যায়টির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন যেখানে নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে আসা হবে প্রধানত সেইসব শ্রেণি থেকে যেগুলি তখনও পর্যন্ত সাহিত্যে কোনো স্থান লাভ করতে পারেনি।

 শৈল্পিক কল্পনা ও সত্যসন্ধতা শরৎ চন্দ্রকে একজন বিপ্লবী ও অভীষ্টসাধনকারী লেখকে পরিণত করেছিল। এটি তাঁকে আরো যা দিয়েছিল তা হলো মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে নতুন সচেতনতা। বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি সম্পর্কে তাঁর প্রথমজীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে দেখিয়েছিল একজন মানুষের যথার্থ মূল্য অনুমানের ক্ষেত্রে সামাজিক বিচার কত গভীরভাবে ভুল করতে পারে।  একটি সমাজ যা ক্ষমা করে বা এমনকি প্রশংসাও করে, অপর একটি সমাজ তা ঘৃণা করে। বার্মায় তাঁর অভিজ্ঞতা তাঁকে দেখিয়েছিল, সামাজিক বন্ধনগুলি শিথিল হয়ে পড়লে কিভাবে মানুষের ভেতরকার ভালো অথবা মন্দ বাইরে বেরিয়ে আসে। সে-অভিজ্ঞতা তাঁকে আরও দেখিয়েছিল – অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে সামাজিক বন্ধনগুলি নৈমিত্তিক থেকে যায় এবং সামান্যতম অজুহাতেও কিভাবে সেগুলি ছুড়ে ফেলা যায়। এসব অভিজ্ঞতা তাঁর মধ্যে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল করেছিল যে, মানুষই একমাত্র বিবেচ্য, তার সামাজিক ছাপ নয়।

শরৎ চন্দ্রের মনের বৈপ্লবিক দিকটির একটি প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় সমাজ কর্তৃক বিতাড়িত ও নির্যাতিতদের প্রতি তাঁর সহানুভূতির মধ্যে। তিনি সবসময় অসহায়দের পক্ষে। নির্যাতিতরাই তাঁর হৃদয় জয় করে নেয়, নির্যাতনকারী নয়। সাধারণ মানুষদের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কেবল অন্য একটি দিক এটি। সাধারণ মানুষ তৈরি হয় শক্তি ও দুর্বলতা এবং গুণ ও দোষ সমাহারে। এমনকি তার নৈতিকতাও নেতিবাচক, কারণ সে যদি ইতোমধ্যে নীতিভ্রষ্ট না হয়ে থাকে, তাহলে সম্ভবত এর সুযোগ সে পায়নি। যাদের পতন ঘটেছে তাদেরকে অধিক করুণা করা উচিত তাদের দুর্বলতার জন্য, তাদের চরিত্রভ্রষ্টতার জন্য ঘৃণা করার চাইতে বেশি। আর এমনকি যদি তাদের অভিযুক্তও করতে হয়, তাহলে আমাদের মধ্যে নিষ্কলঙ্ক এমন কে আছে যে পাপীর দিকে প্রথম পাথরটি ছুড়ে মারবে? শরৎ চন্দ্রের অধিকাংশ কাজের মধ্যে ব্যক্ত হয়েছে বিপথগামী ও দুঃখভোগী মানুষদের জন্য অসীম করুণা ও দয়া এবং এর ভেতরেই সেই ব্যাখ্যা রয়েছে যে কেন তাঁর পাঠকরা তাদের সঙ্গে নিজেদের একান্ত সম্পর্ক অনুভব করে।

গোঁড়া হিন্দু সমাজে, সম্ভবত সব হিন্দু সমাজেই, কোনো নারী যদি একবার যৌন নীতিমালা ভঙ্গ করে তাহলে তাকে সামাজিক গণ্ডির বাইরে রেখে দেওয়া হয়। শরৎ চন্দ্র কখনও জোর দিয়ে এ-কথা বলা থেকে বিরত থাকেননি যে, দৈহিক সতীত্ব ও মানবিক উৎকর্ষ সমর্থক হতে পারে না। এটি সাধারণভাবে পুরুষের ক্ষেত্রেই স্বীকৃত এবং পুরুষের সীমালঙ্ঘনকে সমাজ সদয়ভাবে দেখেছে। তার বন্যজীবন যাপনের প্রবণতা প্রায় একটি স্বীকৃত অধিকার। পুরুষ যে চিরকালের জন্য জাহান্নামে যায় না তার একমাত্র কারণ হলো তারা তাদের উষ্ণ রক্তকে সুযোগ দিয়েছে তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে। নারীদের ক্ষেত্রে তা অন্যরূপ। বহু সমাজেই দৈহিক সতীত্বই নারীর মূল্যের একমাত্র পরীক্ষা। নারীর অন্যান্য যত গুণই থাকুক না কেন তার সবগুলিই নষ্ট হয়ে যায় তার যৌনজীবনে একটিমাত্র বিচ্যুতির কারণে। একজন মানুষ শুধু যৌন সম্পর্কের দিক থেকে সচ্চরিত্র হলেই আমরা তার ধৃষ্টতা বা বিশ^াসঘাতকতা মেনে নিই না। আমরা প্রায়শ একজন বদমেজাজি দাম্ভিকের চাইতে একজন সহৃদয় লম্পটকে অধিক পছন্দ করি। নারীচরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে শরৎ চন্দ্র এই নীতি প্রয়োগ করেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়ে বলেছেন যে, নারীদেরও বিচার করতে হবে পুরুষের সমরূপ মানদণ্ড ব্যবহার করে। আমরা কি সেই নারীদের প্রায়শ দেখিনি যাঁরা তাঁদের গুণাবলি ও শ্রদ্ধালাভের উপযুক্ততার দিক থেকে গর্ব অনুভব করতে পারেন এবং তবুও তাঁদের ওপর নির্ভরশীলদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে নীচাশয় এবং ধূর্ত ও বিদ্বেষপূর্ণ এবং তাঁদের সামাজিক সম্পর্কগুলির ক্ষেত্রে স্বার্থপর ও লোভী? সমাজে সতীত্ব নিয়ে বড়াই করার লোকের অভাব নেই – নারীদের মধ্যে যেমন, তেমনি পুরুষদের মধ্যেও। শরৎ চন্দ্র আমাদেরকে পদকের অপর পাশর্^টিও তুলে ধরেছেন – সেই নারীদের ছবি যারা সমাজ থেকে বহিষ্কৃত, কিন্তু তবুও অপরূপ মহিমা ও সৌন্দর্যে পরিপূর্ণা।

শরৎ চন্দ্রের বৈজ্ঞানিক তাড়না তাঁর সহানুভূতি ও কল্পনাকে দুটি দিকে প্রসারিত করে। এটি তাঁকে উৎসাহিত করে সেই মানুষদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ ও মর্যাদা খুঁজতে যাদের সমাজ বাতিল করে দিয়েছে। এমনকি দুশ্চরিত্র ও পতিতা, ভবঘুরে ও মদ্যপদের চরিত্রেও রয়েছে মহত্ত্বের উপাদান। উপযুক্ত পরিবেশ বা পরিস্থিতি পেলে তারাও এমন উচ্চতায় পৌঁছতে পারে যা আমাদের বিস্মিত ও মানবিক সহানুভূতিগুলিকে উদ্দীপিত করবে। যদি এমনকি পতিতা ও সমাজতাড়িত মানুষদের মধ্যেও এমন গোপন মহত্ত্ব থাকতে পারে, তাহলে জীবনের নিম্নতর স্তরের পুরুষ ও নারীদের সম্পর্কে কোন ধারণা আমরা গ্রহণ করতে পারি? সাহিত্য মাত্র সাম্প্রতিককালে তাদের মানবিক মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদেরকে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। অতীতে তাদের ব্যবহার করা হতো শুধু সমাজযন্ত্রের খাঁজ, কাঁটা ও চাকা হিসেবে। তাদের প্রয়োজনও হতো নায়ক-নায়িকাদের পরিচর্যার জন্য এবং শিল্পের পবিত্র অঙ্গনে তাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হতো শুধু সীমিত উপস্থিতির সুযোগ দিয়ে ও তাদের নিজেদের মানবিক গুরুত্বের কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই। শরৎ চন্দ্র বাঙলার সেই প্রথম লেখকদের একজন যিনি তাঁর চরিত্রগুলিকে নিয়ে এসেছেন জীবনের নিম্নতর স্তর থেকে এবং মানুষ হিসেবে তাদেরকে তুলে ধরেছেন সকল আনন্দ ও দুঃখ, আশা ও ভয়সহ যা তাদের চেয়ে অধিকতর সৌভাগ্যবান মানুষদেরও রয়েছে।

উভয় ক্ষেত্রেই চার্লস ডিকেন্সের সঙ্গে শরৎ চন্দ্রের লক্ষণীয় মিল রয়েছে। তাঁরা দুজনেই ছিলেন নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আগত এবং তাঁদের প্রেরণা গ্রহণ করেছেন সেই জীবন থেকে। তাঁরা দুজনেই তাঁদের শ্রেষ্ঠ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন যখন তাঁরা তাঁদের নিজেদের শ্রেণির মানব-মানবীর আশা ও হতাশার বর্ণনা প্রদান করেছেন। যখন তাঁরা কম সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা লোকজন সম্পর্কে লিখেছেন তখন তাঁরা তাঁদের সীমাবদ্ধতাগুলি অতিক্রম করতে পেরেছেন, কিন্তু যখন তাঁরা নিজেদের সামাজিক শ্রেণির উপরের লোকদের চিত্র তুলে ধরতে গেছেন, তখন তাঁরা দুজনেই কিছু না কিছু ভুল করেছেন। তাঁদের দুজনেরই রয়েছে সমাজের পথভ্রষ্ট ও গৃহহীন পরিত্যক্তদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি। যেসব মানুষ নিচুতলার জীবনে দিন কাটাচ্ছে তাদের জীবনচিত্র আঁকতে গিয়ে তাঁরা দুজনেই বিশেষ আনন্দ লাভ করেছেন। দুজনেই ঘোষণা দিয়েছেন যে, মানুষের মূল্য বিচার করার ক্ষেত্রে সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক। আমাদের মধ্যে যারা একেবারে সবচেয়ে নিচুতলার মানুষ তাদের ভেতরকার সুপ্ত মহত্ত্ব ও উদারতার উপাদানগুলির ব্যাপারে তাঁরা দুজনেই ছিলেন সংবেদনশীল।

শরৎ চন্দ্রকে কখনও কখনও বলা হয় তরলীভূত রবীন্দ্রনাথ। তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত যুক্তিবাদ অনুসরণ করেছিলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টির নৈশ্চিত্য তাঁর ছিল না। তবে তিনি এই ঘাটতি পূরণ করেছিলেন গল্প-বলিয়ে হিসেবে তাঁর দক্ষতা দিয়ে এবং তাঁর সবচেয়ে বড় ক্ষমতা নিহিত বর্ণনার শক্তির মধ্যে। এটি অবশ্য কখনও কখনও তাঁর দুর্বলতার উৎসও হয়ে উঠেছে।  যখন তাঁর কল্পনাশক্তি ব্যর্থ হয়েছে তখন তিনি সেটি আড়াল করার জন্য ভাববিলাসিতার দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁর রচনাশক্তির সর্বাধিক দক্ষতা দেখা গেছে যখন তিনি নিচু শ্রেণির মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন এবং হোঁচট খেয়েছেন বেশি যখন তিনি উচ্চতর সামাজিক বা অর্থবান শ্রেণির মানুষদের বর্ণনা দিয়েছেন। তবে ভাববিলাসিতা সত্ত্বেও শরৎ চন্দ্র সবসময় একজন যুক্তিবাদী মানুষই থেকে গেছেন। তাঁর মানসিক গঠনের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তির কোনো ঘাটতি ছিল না সম্ভবত শুধু একেবারে শেষ পর্যায়ের কিছু ক্ষেত্র ব্যতীত। তবে কিছু গতানুগতিক ও আকর্ষণীয় শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা তাঁর মধ্যে অতিমাত্রায় ছিল। ফলে প্রগতির জন্য তাঁর আকুতি থাকা সত্ত্বেও বাঙলা উপন্যাসের সূচনাকারী নবজাগরণকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তা বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শরৎ চন্দ্রের অপরিহার্য মানবতা এবং মানুষের মর্যাদার প্রতি তাঁর স্বীকৃতিকে গণতান্ত্রিক মনোভাবের সাধারণ বিকাশের একটি আশয় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে এরূপ বিকাশের কারণগুলি এখানে আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। এ-কথা মনে রাখাই যথেষ্ট  যে, এই বিকাশ একটি প্রকৃত ঘটনা। শরৎ চন্দ্রের ক্ষেত্রে এর বৃদ্ধি ঘটে সাহিত্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণের ফলে। সাধারণ মানুষের উপর নির্ভরতা তাঁর যোগ্যতাকে নতুন শক্তিতে উৎসাহিত করে। ডিকেন্স ও শরৎ চন্দ্রের মধ্যে মিল খোঁজার ব্যাপারে এটি আরও একটি বিবেচ্য বিষয়। তাঁরা দুজনেই যে সাধারণ মানুষকে নতুন করে আবিষ্কারের দিকে চালিত হয়েছিলেন তা কেবল তাঁদের বৈপ্লবিক আকুতি ও গণতান্ত্রিক মনোভাবের দ্বারাই নয়, বরং যেসব অবস্থার মধ্যে তাঁদেরকে শিল্পচর্চা করতে হয়েছিল তার দ্বারাও। এটি কোনো দৈব ঘটনা নয় যে, শরৎ চন্দ্রই বাঙলার প্রথম পেশাজীবী ঔপন্যাসিক যিনি উপন্যাস রচনাকে তাঁর বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং এই কাজকে কোনো শখ বা খণ্ডকালীন কাজ বলে বিবেচনা করেননি।

এক অর্থে শরৎ চন্দ্রকে একজন রোমান্টিক লেখক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তিনি খুব সাধারণ ও পরিচিত অভিজ্ঞতাগুলির মধ্যে বিস্ময় ও সৌন্দর্য পুনরাবিষ্কার করেছেন। মানবহৃদয়ের অসীম বৈচিত্র্যের মুখোমুখি হয়ে তাঁর মনোভাব হচ্ছে ঔৎসুক্য ও বিস্ময়ের। প্রতিটি মানুষ হচ্ছে অজানা সমুদ্র দিয়ে ঘেরা একটি দ্বীপের মতো। মানুষেরা তাদের একান্ত নৈকট্য দিয়ে আমাদের হতবুদ্ধি করে দেয় এবং থেকে যায় সুদূরতম নক্ষত্রের মতো অজানা অচেনা। এই রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি ত্রুটির ব্যাখ্যা প্রদান করে যা কখনও কখনও শরৎ চন্দ্রের লেখায় ধরা পড়েছে। সমাজ যেসব পুরুষ ও নারীর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করেছে তিনি প্রায় সবসময় তাদের উচ্চপ্রশংসা করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারেন, কিন্তু সমাজচ্যুতদের মধ্য থেকে সব নায়ক-নায়িকা গ্রহণ করা কী উচিত? এমন হতে পারে যে, হাজার বছরের মধ্যে একবার হয়তো সাবিত্রীর মতো একজন নারী তার সামাজিক ও ব্যক্তিক ইতিহাসের মধ্য থেকে একটি ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হতে পারে। অন্নদা দিদি ও কমল সম্ভবত আরও বেশি বিরল ঘটনা। তবুও শরৎ চন্দ্রের রচনায় সাধারণভাবে ক্রমাগত আমরা এসব চরিত্রের সাক্ষাৎ পাই। এর ফলে কি জীবনের সত্য মিথ্যা হয়ে যায় এই ধারণা সৃষ্টির মধ্যে যে, এসব অসাধারণ-প্রকৃতির মানুষ তৈরি হয় শুধু এ ধরনের অসম্মানজনক পরিবেশের ভিতর দিয়ে? পদ্মের মতো যার শেকড় অবশ্যই থাকতে হবে পিচ্ছিল ও প্রতারক কাদার ভেতরে?

শরৎ চন্দ্রের উত্তর হয়তো এমন হতো যে, মহত্ত্ব ও অসাধারণত্ব বিদ্যমান সাধারণ সমাজে যেমন বিরল তেমনি সমাজতাড়িতদের সাহচর্যের মধ্যেও। চরিত্রগুলি যদি অবাস্তব হয়ে থাকে, তাহলে নিন্দাবাদ তাঁর প্রাপ্য অবশ্যই। তবে তাঁর কল্পনা তাদের জীবন দিয়ে থাকে; তাহলে তারা মানবজাতির মধ্যে বিরল প্রজাতি অথবা একটি ঝোপের সাধারণ ব্ল্যাকবেরি কি না সেটি বিবেচ্য নয়। এ-কথা অবশ্যই স্বীকার করে নেওয়া উচিত যে, শরৎ চন্দ্র প্রায়শ সফল হয়েছেন এই সমাজতাড়িত পুরুষ ও নারীদের জীবন ও জীবনশক্তিতে দেদীপ্যমান করে তুলতে। এর ফলে, তারা শুধু আমাদের স্মৃতিতে বেঁচে নেই, বরং ভাস্বর আমাদের কল্পনায় এবং হৃদয়েও।

শরৎ চন্দ্রের অভিজ্ঞতার পরিধি ও গভীরতা তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলিকে বাস্তবতা দিয়েছিল। তাঁর সত্যশীলতা ও সৎসাহস আমাদের যেমন আনন্দ দেয়, তেমনি ধাক্কাও প্রদান করে। তাঁর বলিষ্ঠতা ও কর্মশক্তি আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় এবং তাঁর কাজ কতদূর সত্যসদৃশ তা পরখ করে দেখার জন্য এক মুহূর্তও আমাদের থামতে দেয় না। তাঁর শ্লেষ ও পরিহাস দ্রুত আমাদের আঁকড়ে ধরে এবং তিনি যাদের পক্ষ নেন তাদের পক্ষ নিতে আমাদেরকে বাধ্য করে। তাঁর কোমলতা ও ভাবপ্রবণতা আমাদেরকে আঘাত করে আমাদের দুর্বলতম জায়গায় এবং প্রায়শ তাঁর ব্যর্থতাগুলির প্রতি আমাদেরকে অন্ধ করে রাখে। এটি শুধু অকারণে নয় যে, শরৎ চন্দ্র হচ্ছেন বাঙলার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। বাঙলা তাঁকে তার হৃদয়ে বরণ করে নিয়েছে এবং তাঁকে যে ভালোবাসা দিয়েছে তেমন ভালোবাসা সম্ভবত অন্য কোনো লেখককে দেয়নি। তাঁর শিল্পসৃষ্টিতে ত্রুটি আছে, তাঁর কল্পনা কখনও কখনও তাঁকে তুলে ধরতে পারেনি, তিনি প্রায়শ ছদ্মভাবালুতার জন্য অভিযুক্ত হয়েছেন, তাঁর বিচারবোধকে প্রায়শ আচ্ছন্ন  করে রেখেছে সস্তা বুদ্ধিবৃত্তিকতা –  এসব কথা সত্য, কিন্তু সবকিছুই মানুষ ভুলে গেছে বাঙলা এবং বাঙলার সাধারণ মানুষদের প্রতি তাঁর অসাধারণ ভালোবাসার কারণে। তিনি তাদের ভালোবেসেছিলেন এবং তারাও প্রতিদানে তাঁকে ভালোবেসেছে।

এটিই সম্ভবত শরৎ চন্দ্র সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য। তিনি বাঙলার মানুষদের জন্য বাঙলাকে পুনরাবিষ্কার করেছিলেন এবং এই আবিষ্কারই তাঁকে অসাধারণত্ব এনে দিয়েছে। বাঙলার সাধারণ মানুষদের মধ্যে যে বিস্ময়কর সম্ভাবনাগুলি নিহিত রয়েছে তিনি তা প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন। তিনিই প্রথমবার সবিস্তারে চিত্রিত করেছেন ভালোবাসা ও ঘৃণা কী, আকুতি ও হতাশা কী, বাঙলার জীবনের আপাত একঘেয়েমির আড়ালে কোন মিলনান্ত ও বিয়োগান্ত কাহিনি লুকিয়ে আছে। এভাবেই তিনি বাঙলার গ্রাম ও শহরগুলির লক্ষ লক্ষ নির্জীব মানুষের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছিলেন যারা প্রচলিত প্রথা ও অনুমোদনের অন্ধকার ছায়ায় দৈনন্দিন জীবন যাপন করে চলে। শরৎ চন্দ্র যদি অন্য কোনো-কিছু না-ও করতেন, তবুও শুধু তাঁর এই কাজই তাঁকে বাঙলা উপন্যাসের ইতিহাসে একটি সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত করে রাখত।