স্বপ্নছোঁয়ার পদযাত্রা

অবাধে জন্ম নেওয়া আট ভাইবোনের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের চতুর্থ সন্তান নাহিদ যখন মাস্টার্স শেষ করে একটা চাকরির ধান্দায় ব্যস্ত, তখন তার মনের আরেকটি অংশের সবটুকু জুড়ে থাকে উচ্চমধ্যবিত্তের অনার্স পড়ুয়া সুদর্শনা মীরা খানম। নাহিদের অবসরপ্রাপ্ত বাবার উপার্জনহীনতায় বড় দুই ভাইয়ের  সামান্য আয়-রোজগারে এত বড় সংসারের উদরপূর্তির পর যা হাতে থাকে তা দিয়ে বাকি ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচটা কোনোমতে চলে।

সচ্ছল পরিবারের মীরা খানমের বাবাটাই শুধু নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারের অব্যর্থ গুলিতে বুকটা ফুটো হয়ে প্রাণ যায় তাঁর। অভাব বলতে এটুকুই। নাহিদের স্কুলজীবনের ক্লাসমেট, পরবর্তীকালে বড় ব্যবসায়ী বড়ভাই সেলিম খানের কড়া গার্ডিয়ানশিপের অধীনে থেকে এক প্রতিবেশী পরিবারের স্বপ্নপুরুষ নাহিদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার কোনো সুযোগ পায় না মীরা। এখনকার মতো মোবাইলও তখন ছিল না। তাই বলে কথা বা দেখাদেখি একেবারে বন্ধও থাকে না। একতলা বাড়ির পেছনের ঘরের সবুজ জানালার শিক ধরে নির্দিষ্ট একটা সময়ে দেড়শো গজ দূরে কদমতলায় দাঁড়িয়ে থাকা নাহিদের সঙ্গে চোখাচোখি, চোখের ভাষায় ভালোবাসার সুগন্ধিবিনিময়ে কোনো সমস্যা হয় না। এদিকটায় লোকচলাচল খুব কম। রাতে অন্ধকার থাকায় ভয়ে এদিকে কেউ আসেও না। তখন বিকল্প আরেকটি পথে যাওয়া-আসা চলে। তো সেখানে শুধু যে দেখাদেখি, তা নয়, জানালার নিচে মাটিতে চিরকুট সাইজের চিঠিও ফেলে দেওয়া হয়। নাহিদ রাতের অন্ধকারে সুযোগ বুঝে সেই চিরকুট উদ্ধার করে

বিনিময়-চিরকুটও রেখে আসে। যে-কোনো ছুটিতে বাড়ি এলেই ওদের দেখাদেখি, চিরকুট-বিনিময়ের পর্বটা এভাবেই চলে। এবারেও গরমের ছুটিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে মীরা। ওর অনার্স ফাইনালের আগে পর্যন্ত দুজনের নীরব প্রণয়পর্বের গল্পটি এভাবেই চলছিল। এখন শুধু মীরার অনার্স ফাইনাল আর নাহিদের একটা চাকরির অপেক্ষা।

তাহলেই প্রণয়ের ফাইনাল পর্বের দিকে এগোবে ওরা। মোটামুটি এরকমই সিদ্ধান্ত হয়ে আছে ওদের মধ্যে।

কিন্তু জীবনের কোনো পর্বই চিরকাল একই সরলরেখায় চলে না। বিপত্তি ঘটল তাদের প্রণয়পর্বেই। একদিন রাতে নাহিদ এসে চিরকুটের দেখা পায় না। অথচ বিকেলেই মীরার হাত থেকে চিরকুটটি পড়তে দেখেছে নাহিদ। কীভাবে চিরকুটটি খোয়া গেল? কে নিল? সমবয়সী চাচাতো বোন ইলা খানমের হাতে যায়নি তো? ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া চতুর ইলা খানমও কদিন আগে গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। ওর সঙ্গে বেশ ভালো ভাব মীরার। কিন্তু প্রণয়ের বিষয়টি ইলার অজানাই রয়েছে বলে এখনো পর্যন্ত জানে নাহিদ। তাহলে তো কোনো কারণেই এদিকে আসার কথা নয় ইলার। একে তো রাতের অন্ধকার, তার ওপর চিরকুট খোয়া যাওয়ায় অন্ধকারটি আরো গাঢ় হয়ে নেমে আসে নাহিদের চোখে। কী লিখেছিল মীরা? ভালোবাসার আবেগজনিত কোনো কথা নেই তো? থাকাটাই স্বাভাবিক। তাহলেই তো সর্বনাশ! মাথাটা গরম হতে শুরু করে নাহিদের। কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই জানার।

প্রায় চব্বিশটা ঘণ্টা বুক ঢিপ ঢিপ করা অপেক্ষা করেও কোনো আলো দেখা গেল না। পরদিন বিকেলেও সেই অন্ধকার। সেই সবুজ জানালার কপাট দুটি আর খুললো না। রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরেও না। বুকের ভেতর ধসে পড়া পাহাড়ি মাটির ধড়াস্ ধড়াস্ পতনধ্বনি শব্দ শুনতে পায় নাহিদ। সেই শব্দে চোখের ঘুমও উধাও দুদিন ধরে। দেখা নেই মীরার। মন পুড়তে থাকে ধিক ধিক করে। সে-আগুন ছড়িয়ে পড়ে শরীরেও। কিন্তু এভাবে আর কত অপেক্ষা? খুব কাছেই ইলাদের বাড়ি। ইলার সঙ্গে তেমন কথাবার্তা না হলেও ওর বড়ভাবির সঙ্গে ভালো একটা রিলেশন আছে নাহিদের। সেখানে ভাবির সঙ্গে মাঝেমধ্যে আড্ডাও হয়। সে-আড্ডায় মাঝেমধ্যে

ইলা-মীরা দুজনই থাকে। মীরা-নাহিদের চোখের মিলন থেকে মনের মিলন সেখান থেকেই। তবে একান্তে কথা বলার সুযোগ সেখানে থাকে না। সুযোগটা এতদিন ধরে মিলেছিল ভার্সিটিতে। নাহিদের মাস্টার্সের আগে পর্যন্ত প্রায়ই মন খুলে কথাবার্তা চলত সেখানে। ভার্সিটি ছেড়ে আসার পর এখন চিঠি-চিরকুটই হয়েছে কথা বলার একমাত্র ভরসা। মীরা বাড়িতে এলেও তাই। হঠাৎ মাথায় আসে ইলাদের বাড়িতে গিয়ে তো বড়ভাবির সঙ্গে কথা বলে খবর নিতে পারে সে মীরার। সেই ভাবনা থেকে সেদিন বিকেলেই চলে যায় নাহিদ ইলার বড়ভাবির কাছে। বড়ভাবি খুব মিশুক প্রকৃতির, হাসিখুশি মহিলা। নাহিদকে দেখে হাতের কাজ ফেলে ছুটে আসেন তিনি। মীরার সঙ্গে নাহিদের সম্পর্কের একটুখানি জানেন বলে হাসিঠাট্টা করতে ছাড়েন না ভাবি। 

‘আরে নাহিদ? আজকাল দেখাই যায় না যে? কেমন আছো? কী করছো?’

ড্রয়িংরুমের একটি সোফায় বসতে বসতে একটা শুকনো হাসি দেয় নাহিদ। মুখোমুখি বসেন ভাবি।

‘তেমন কিছু না ভাবি। বেকার জীবন। বসে বসে কী আর করবো। খাইদাই-ঘুমাই আর চাকরির ধান্দা করি, এই আর কী।’

‘মীরার সঙ্গে দেখা হয়?’ বলেই মিটমিট করে হাসেন ভাবি।

‘না ভাবি, ওকে তো কোথাও বেরোতেও দেখি না। দেখা   হবে কেমনে?’

‘পাখি যে উড়াল দিচ্ছে সে-খবর জানো?’

‘উড়াল দিচ্ছে মানে? বিয়ে হচ্ছে নাকি?’ নাহিদের গলায় কাঁপা উৎকণ্ঠা।

‘হ্যাঁ, সৌদির এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে । ভালো ছেলে। কথাবার্তা পাকাপাকি।’ নাহিদের চোখেমুখে বিস্ময়ের ঘোর। গলা থেকে কোনো কথা বেরোয় না। ঠিক এই সময়ে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই চলে আসে মীরা ওদের সামনে। চোখমুখ শুকনো। উস্কোখুস্কো চুল। ঘুমোয়নি সম্ভবত সে-ও। ভাবি ওকে দেখে বলেন, ‘কী রে মীরা, মেঘ না চাইতেই জল! হঠাৎ এদিকে যে! বুঝলি কী করে যে নাহিদ এসেছে?’

‘না ভাবি, আমি আপনার কাছেই এসেছিলাম বিশেষ একটা দরকারে। মা পাঠালো।’

‘ঠিক আছে, এলিই যখন, শেষবারের মতো দেখে নে তোর প্রাণপাখিরে। আর হয়তো সুযোগ নাও পেতে পারিস। আমি চট করে একটু চা বানিয়ে আনি।’ হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন ভাবি। এ এক মহার্ঘ সুযোগ নাহিদ ও মীরার জন্য। কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজনই। পরে মীরাই মুখ খোলে।

‘দেখা হয়ে ভালোই হলো। মনে মনে অনেক খুঁজছি তোমাকে। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। ইলা সম্ভবত এখনো ভাতঘুম দিচ্ছে। ও এসে পড়লে বিপদ। আর শুনেছো বোধহয় আমার খবর। সেদিনের চিরকুটটাই সর্বনাশ করেছে।  কীভাবে যেন ওটা ইলার হাতে চলে যায়। তারপর থেকেই আমি ঘরবন্দি। কোথাও যেতে দেয় না মা। বড়চাচা আর বড়ভাই বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে পড়েছে। আমি তবু মাকে তোমার কথাটা বলেছিলাম। কিন্তু মা বললো, ঘর নেই, চুলো নেই। তার ওপর বেকার। কীভাবে দেব ওর হাতে, বল? কেউ তো মানবে না। তো এই হলো অবস্থা। আমি কিছু ভেবে পাচ্ছি না। এদিকে বিয়ের তারিখটা আজই ফাইনাল হয়ে যাবে শুনেছি। এখন তুমি যদি কিছু করতে পারো তো করো।’

‘এ হতে পারে না মীরা। নেভার। যেভাবেই হোক তোমাকে আমি হারাতে দেব না। দরকার হলে দুজনে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো। তুমি রাজি কি না সেটা বলো।’ চোয়াল দুটো শক্ত করে বলে নাহিদ। 

‘পালাতে গিয়ে যদি ধরা পড়ি?’

‘ধরা পড়লে পড়বো। কিন্তু আমরা কেউ কারো হাত ছাড়বো না। ঘরেও ফিরবো না। প্রমিজ?’

‘তুমি যা ভালো মনে হয় করো। আমি থাকবো তোমার সঙ্গে। বাড়িটা হয়ে গেছে আস্ত একটা জাহান্নাম। বোঝা হয়ে গেছি আমি সবার। আমার পড়াশোনার কথা, কোনো ইচ্ছের কথা কেউ শুনছে না। বিয়ে দিতে পারলেই যেন বাঁচে সবাই। এই জাহান্নাম থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই, যেভাবেই হোক। এখন সবকিছু নির্ভর করছে তোমার ওপর। ওকে, আমি আর বসবো না। ইলা চলে আসতে পারে। যা করার দ্রুত করতে হবে। তুমি বাসায় গিয়ে ভাবো। কীভাবে কী করবে তা লিখে সন্ধের পর ঠিক সাতটায় ওই জায়গাটায় রাখবে। আমি জানালার কাছে থাকবো ওই সময়। তোমার চিঠির বিষয়ে আমার যদি কিছু বলার থাকে, তাহলে রাত ন’টায় একটা চিরকুট ফেলবো ওইখানে। তুমি টাইমলি এসে নিয়ে যাবে। না পেলে মনে করবে তোমার প্ল্যানের সঙ্গে আমি একমত। ওকে? এখন যাই তাহলে।’

‘ভাবির সঙ্গে দেখা করবে না?

‘না।’

চলে গেল মীরা। ভালোবাসার মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে। ভাবির হাতের চা-নাস্তা একটুখানি মুখে দিয়ে চলে আসে নাহিদও।

খাটে গা এলিয়ে দিয়ে আকাশপাতাল ভাবতে থাকে নাহিদ চিরকুটে কী এমন লিখেছিল মীরা যে বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সবাই? কিসের ভয়ে? অনার্সের ফাইনাল ওর সামনে। এখন কি বিয়ের সময়? সন্ধে প্রায় ছ’টা। ঘণ্টাখানেক সময় মাত্র বাকি। কাগজ-কলম নিয়ে বসে সে। একটা জুতসই প্ল্যান তৈরি করতে হবে। কোনো ফাঁকফোকর রাখা যাবে না। কাল বুধবার। দিনটা কাল হলেই ভালো হয়। লিখতে থাকে নাহিদ। ‘কাল বুধবার ০৭.০৪.১৯৮১ তারিখ দিনশেষে রাত ঠিক তিনটায়। তুমি তার আগে ছোট হ্যান্ডব্যাগে এসএসসি, ইন্টারের সার্টিফিকেট আর ভার্সিটিতে পড়াশোনা সংক্রান্ত কাগজপত্র রাখবে। টাকাপয়সা কিছু জমানো থাকলে নেবে। এক সেট কাপড় নেবে। কিছু খাবারও নিয়ো সঙ্গে। কারণ, তোমার তো আবার ঘন ঘন খিদে পায়। একটুও ঘুমোবে না। তুমি তো বোরখা পরো না। পরলে ভালো হতো।

‘যাহোক, কালো জামা ওড়না পরবে। ওড়না দিয়ে মুখটা ভালো করে ঢেকে নেবে। তিনটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে মেইন গেইট দিয়ে বেরিয়ে সামনের লাইটপোস্টটা দ্রুতপায়ে ক্রস করবে। চলে আসবে কদমতলার কাছে। সেখানে জঙ্গলের ছায়ায় আমি দাঁড়িয়ে থাকবো। মিন্টু চাচার বাড়ির সামনের রাস্তাটুকু আমাদের একটু হাঁটতে হবে। এইটুকু রাস্তা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ওই সময়টায় মিন্টু চাচা রাতের ডিউটি সেরে বাসায় ফেরেন। চেনাজানা আরো অনেকেই এ-সময় যাওয়া-আসা করে। তোমার বড়ভাইও অনেক সময় ব্যবসায়িক প্রয়োজনে অনেক রাতে বাসায় ফেরেন। কপাল মন্দ হলে ফকিরবাড়ির মোড়ে তাঁর মুখোমুখিও হতে পারি। ওটা হলে তো পুরো প্ল্যানই ভেস্তে যাবে। কিন্তু উপায় নেই। কদমতলায় রিকশা রাখা যাবে না। রাস্তার লাইটের আলোয় যে কেউ দেখে ফেলতে পারে। সো, নো রিস্ক নো গেইন। বশির মিয়া খুব বিশ্বস্ত, আমার ছোটবেলার বন্ধু। ওর রিকশাটা ফকিরবাড়ির মোড়ে দাঁড়ানো থাকবে। তারপর রিকশায় উঠে আমরা সোজা রেললাইনের সামনে গিয়ে নামবো। সেখান থেকে আবছা অন্ধকারের মধ্যে খানিকটা হেঁটে স্টেশনের প্লাটফরমে যাবো। এইটুকু পথ হাঁটাও খুব রিস্কি। তোমার তো অভ্যাস নেই। তাই রেলের সিøপারে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে পারো। ওই সময় তোমার হাতও ধরতে পারবো না। চেনাজানা কিছু লোক ওই সময় অন্ধকারে বসে গাঁজা খায়। তাদের কেউ দেখে ফেলতে পারে। সো, তোমাকে ওই পথটুকু সাবধানে দেখেশুনে হাঁটতে হবে। দশ মিনিটের পথ। কিন্তু তোমার সেখানে বিশ মিনিট লাগতে পারে। রাত চারটার ঢাকাগামী ট্রেনে উঠে পড়বো আমরা। ট্রেনে খুব ভিড় হয়। সেটা একটা সুবিধা। তুমি মুখের অর্ধেকটা ঢেকে রাখলে কেউ চিনতে পারবে না। আমাদের রাতের মধ্যেই ঈশ^রদী ছাড়তে হবে, কারণ, ঈশ^রদীর আশেপাশে এমন বিশ^স্ত কেউ নেই যে আমাদের আশ্রয় দেবে। এজন্যেই ঢাকা যাওয়ার প্ল্যান। ঢাকায় চেনাজানা যদিও কেউ নেই আমাদের, তবুও বিরাট রাজধানী শহর, একটু নির্ভয়ে থাকা যাবে। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে কোনো হোটেলে উঠে প্রথমেই বিয়ের কাজটা সেরে নিতে হবে। এখানেও প্রথম রাতে একটা ঝুঁকি আছে। আমরা আসলেই স্বামী-স্ত্রী কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ করতে পারে হোটেল ম্যানেজার। তুমি যে সত্যিই আমার স্ত্রী সেটা দরকার হলে জোরের সঙ্গেই তোমাকে বলতে হবে। নার্ভাস হলে চলবে না। বাকিটা আমি সামাল দেব। বিয়ের ব্যাপারেও তোমাকে দ্বিধাহীন থাকতে হবে। কারণ, বাবা-মাকে ছেড়ে পালিয়ে বিয়ে করার সময়ে অনেক শক্ত মেয়েও মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে যায়, মেনে নিতে পারে না। তুমি সাহসী মেয়ে। তোমার ভালোবাসাও মনে করি প্রশ্নাতীত। আশা করি  তুমি কাজি অফিসে কোনো সিনক্রিয়েট করবে না। চটজলদি বিয়ে করার বড় কারণ হলো – আমরা দুজনই ম্যাচিউরড। বিয়ে নিয়ে তাই কোনো প্রশ্ন উঠবে না। তারপরেও ডিভোর্স দিতে বাধ্য করার জন্য তোমার ভাই-চাচারা থানা পুলিশ করতে পারে। আমাকে পুলিশকে দিয়ে প্যাঁদানিও খাওয়াতে পারে। সেজন্যে আমি রেডি। তোমার মুখের দিকে চেয়ে সব ধরনের কষ্টই আমি সইতে পারবো। তবুও আমাকে ওরা মাথানত করাতে পারবে না। আমার বিশ্বাস তোমাকেও ডিভোর্সে বাধ্য করাতে পারবে না। বিশ্বাসের মর্যাদাটা রেখো। না পেরে একসময় ওরা আমাদের মেনে নিতে বাধ্য হবে। তাহলে বুঝতেই পারছো পুরো ব্যাপারটাই ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু  নিজেদের পেতে হলে এই ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জটি নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। পদে পদে বিপদ। কোথায় যে আটকে যাবো, অথবা যাবো না – ওনলি গড নোজ। তবে কোনোভাবেই ঘাবড়ে যাওয়া যাবে না। সব ধরনের বিপদকেই সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ওভারকাম করতে হবে। সব ঝুঁকি কাটিয়ে কোনোমতে ট্রেনে উঠতে পারলেই মিশন সাকসেসফুল। সোজা ঢাকা। এরপর আমাদের আর পায় কে? তো এই হলো পুরো পলায়ন পরিকল্পনা। প্ল্যান অনুযায়ী সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখো। আমি তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবো। লাভ।’

লেখা শেষ করে চিঠিটা ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় জায়গামতো রেখে আসে নাহিদ। তবে একেবারে সরে আসে না। কিছু দূরে একটা বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মীরার আসার অপেক্ষায় থাকে। মিনিট দশেক পরে মীরা এসে চিঠিটা নিয়ে গেল দেখতে পায়। নিশ্চিত হয়ে ফিরে আসে ঘরে নাহিদ। এবার প্রস্তুতি নেওয়ার পালা। হাতে সময় আছে যথেষ্ট। ঘণ্টাখানেক পরে রিকশাওয়ালা বশির মিয়ার বাড়িতে যায় নাহিদ। বশির ওর প্রাইমারি স্কুলজীবনের বন্ধু। টাকা-পয়সার অভাবে প্রাইমারির পরে আর পড়তে পারেনি। পেটের তাগিদে বৃদ্ধ বাবার রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে ওকে। কিন্তু ওদের ছোটবেলার সেই বন্ধুত্বটা এখনো আগের মতোই প্রগাঢ়। বাড়িতেই পেয়ে যায় নাহিদ বশিরকে। গোপনে বশিরের সঙ্গে কথা সেরে চলে আসে নাহিদ বাসায়। মীরার কথা অনুযায়ী রাত ন’টার দিকে নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করে এগোতে থাকে । ওদের বাড়ির পাশের সেই ঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়। ন’টা দশ। তারপরে আরো দশ মিনিট। না। কোনো চিরকুট পড়লো না। তার মানে প্ল্যানটা ফাইনাল। হাতে এখন অনেক সময়। কালকের দিনটা কোনোমতে পার করে রাতের পলায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবা যাবে। একটা স্বস্তির নিশ^াস ছেড়ে ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় নাহিদ।

পরেরদিন ঝকঝকে রোদ্দুর চোখে নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে নাহিদ। ভালোবাসার মানুষটি এখনো নাহিদের হাতের মুঠোয়। মাত্র ত্রিশটা ঘণ্টা পেরোলেই মীরাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু হবে ওর। যদিও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং তবু জিততে পারলে সে-ই রাজা। সবার চোখের আড়ালে থেকে মীরার সঙ্গে শুরু হবে দারুণ এক যুগলবন্দি রোমাঞ্চকর জীবন। এসব ভাবতে ভাবতেই দিনটা কেটে যায় নাহিদের। মীরা যে কী করছে কে জানে। বিয়ের তারিখটা কি ফাইনাল হলো? হওয়ারই কথা। অন্তত এটুকু নিশ্চিত যে মীরাকে যেভাবেই হোক বিদায় করবে ওরা। ট্যাক্সি ড্রাইভার না হলে রিকশা ড্রাইভার হলেও ক্ষতি নেই তাদের। তাতে অন্তত বেকার নাহিদের হাত থেকে তো মেয়েটাকে বাঁচানো যাবে। এই হলো অর্ধশিক্ষিত চাচা-ভাইদের উজবুকি ভাবনা। দূর! যা ভাবে ভাবুক ওরা। চ্যালেঞ্জটা তো নিয়ে ফেলেছে নাহিদ-মীরা। এখন এটিই ইমপরট্যান্ট।  

রাত দশটা। খিদে পেয়েছে নাহিদের। রাতের খাবারটা খেয়ে নিয়ে একটু রেস্ট নিতে ইচ্ছে করে ওর। এমনটা ভাবার সময় মা এসে ঢোকেন ঘরে।

‘কী রে, বারবার যাচ্ছিস-আসছিস, হয়েছে কী তোর? মুখটা অত শুকনো কেন?’

‘কিছু হয়নি মা। খাবার রেডি থাকলে দাও। খিদে পেয়েছে।’

‘কিছু যে একটা হয়েছে তা তো বুঝতেই পারছি। মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ না। চাকরি নিয়ে অত ভাবার দরকার নেই। তুই তো চেষ্টা করছিসই। বাকি আল্লার ইচ্ছা।’

‘চাকরি নিয়ে ভাবছি না মা। তুমি পারলে খাবারটা এখানেই দিয়ে যাও।’

মা আর কিছু না বলে খাবারটা আনতে যান। এই ফাঁকে নাহিদ প্যান্টের পকেটের দিকে তাকায়। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক থেকে। মাত্র পঁয়তাল্লিশ টাকা আছে পকেটে। তাতে দুজনের ট্রেনের টিকিটটা শুধু হবে। টিউশনির টাকা পেতে এখনো দিন দশেক বাকি। পালাতে গেলেও যে টাকার দরকার সে-কথা এতক্ষণ মাথায় আসেনি। মীরা যদি কিছু টাকা-পয়সা নিতে পারে, তাহলে ভালো হয়। কিন্তু ও টাকা পাবে কোত্থেকে? কোনো ইনকাম তো ওর নেই। পড়ার খরচ হিসাব করে যা দেয় বড়ভাই তা দিয়েই চলে। যাকগে, না পারলেও সমস্যা নেই। দরকার হলে দু-তিনদিন বিস্কিট-পানি খেয়েই কাটাবে। কোনোমতে ঢাকায় যেতে পারলে ছোটখাটো কোনো কাজের ব্যবস্থা হয়েই যাবে। স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটতে গেলে অত ভাবলে চলে না। খেতে খেতে মাকে বলে সে, ‘মা, একটা জরুরি কথা বলা হয়নি তোমাকে। আজ রাতের ট্রেনে ঢাকায় যেতে হচ্ছে। কাল চাকরির একটা ইন্টারভিউ আছে। দেখি কী হয়।’ মা কিছুটা অবিশ্বাসের চোখে তাকান কিন্তু কিছু বলেন না।

নাহিদের মাথায় তখন অন্য ভাবনা। সারাদিনে মীরা মনের দিক থেকে ঠিক আছে তো? এভাবে চুরি করে পালানোতে মনটা যদি শেষমেশ সায় না দেয়? চতুর মেয়ে ইলা যদি ওর পালানোর বিষয়ে সন্দেহ করে রাতে থেকে যায় ওর কাছে? তাহলে তো সর্বনাশ! কিংবা মীরা নিজেই যদি ভালো মেয়ের সুনাম বজায় রাখার কথা ভেবে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে? পরে নাহিদ নিজেকে সান্ত্বনা দেয় এভাবে যে, সে পালাতে না চাইলে করার তো কিছু নেই। ভালোবাসার জোর থাকলে আসবে, না থাকলে আসবে না।  দোষ তো আর দিতে পারবে না। কিন্তু ওকে নিয়ে পালানোর মতো মেজর একটা অ্যাকশনে গেলে নেতৃত্বটা  তো দিতে হবে নাহিদকেই। তখন টাকাটা একটা বড় ফ্যাক্টর। টাকা দিয়ে অনেক খারাপ সিচুয়েশনকেও ম্যানেজ করা যায়। কিন্তু বিপদের সময় টাকা পাবে কোথায় সে? মীরার কাছে তো আর চাইতে পারবে না। তাহলে? টেবিলে রাখা ছোটবোনের গলার চেইনটার কথা মনে পড়ে তখন নাহিদের। একমাত্র মেয়েকে বাবার উপহার দেওয়া চেইন। বেখেয়ালে চেইনটা টেবিলে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। রাত তখন কত? দেয়ালঘড়ির দিকে তাকায়। বারোটা পেরিয়ে সাত। মার সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়া ছোটবোনের চেইনটা হাতে তুলে নেয় নাহিদ। বুকের ভেতরটায় একটু চিন চিন করে নেওয়ার সময়। বোনটি খুব কষ্ট পাবে। কষ্ট পাবে বাবাও। কিন্তু উপায় নেই। মনের মানুষকে পেতে হলে কোনো কষ্টকেই পাত্তা দেওয়া যাবে না। রাত পৌনে তিনটা। কদমতলায় যেতে তৈরি সে এখন। একটা কালো চশমা পরে নেয় নাহিদ। যাতে চট করে কেউ ওকে চিনতে না পারে। আরো সতর্ক হতে মাথায় একটা হ্যাটও পরে নেয়। জিনস প্যান্টের সঙ্গে কালো টি-শার্ট। নিজেকে এখন ক্রিকেটের ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন লাগছে নাহিদের। এত টেনশনেও ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে ওর। ঠিক তিনটায় কদমতলার আলো আঁধারিতে গিয়ে দাঁড়ায় নাহিদ। আট মিনিট গেছে। মীরার দেখা নেই। ভেতরে ভেতরে ঘামতে থাকে নাহিদ। তাহলে কি গ্যাঁড়াকলে আটকে গেল মীরা? নাকি নিজেই …। হঠাৎ দৃষ্টি যায় সজনে গাছের তলে। ওই তো, ওই তো আসছে মীরা। গাছের ছায়ায় নিজেকে আড়াল করে করে আসছে সে। বুদ্ধি আছে মেয়েটার। পরনে কালো থ্রিপিস। ওড়না দিয়ে মুখের কিছুটা ঢাকা। কাঁধে মাঝারি সাইজের একটা ব্যাগ। কদমতলায় এসে খানিকটা হাঁপায় সে। নাহিদের ইশারায় খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটতে শুরু করে মীরা। এখন গন্তব্য ফকিরবাড়ির মোড়। ওখানে বশিরের রিকশা দাঁড়ানো। একটা রিকশা পাশ কেটে চলে যায়। মিন্টু চাচা ফিরলেন। নাহিদের দিকে তাকালেনও। কিন্তু চিনতে পারলেন না সম্ভবত। নাহিদ দ্রুত পা চালায়। মীরাও। ফকিরবাড়ির মোড়ে এসেই বশিরের রিকশায় উঠে পড়ে ওরা।

রিকশা দ্রুত এগোতে থাকে স্টেশনের দিকে। রিকশায় মীরার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে নাহিদ, ‘বাড়ির কেউ টের পায়নি তো? ’

‘না। মা একটু টের পেলেও কিছু বলেনি। হয়তো ভেবেছে বাথরুমে যাচ্ছি।’

‘সেলিম কি বাড়িতেই?’

‘হ্যাঁ। তবে একবার লাইট জ্বালিয়েছিল। কেন বুঝতে পারলাম না।’

‘ও কিছু না। বুঝতে পারলে ফলো করত। তুমি ঠিক আছো তো?’

‘বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে। কেউ দেখতে পেলে কাউকে মুখ দেখাতে পারবো না।’ বিষণ্ন গলায় বলতে বলতে মাথাটা নাহিদের কাঁধে রাখে মীরা। যেন ভরসার শক্ত জমিন খুঁজতে থাকে সে নাহিদকে জড়িয়ে ধরে।

‘ওসব ভেবো না তো। বেরিয়ে যখন পড়েছি তখন আর পেছনে তাকানোর সুযোগ নেই। মনটাকে শক্ত করো।’

বুকের কাছে চেপে ধরে সাহস দেয় ওকে নাহিদ। রেললাইনের পাশে এসে দাঁড়ায় রিকশা।  এ-পাশটায় আলোটা বেশ কম। রেললাইন দেখে দেখে হাঁটা বেশ কঠিন। লাইনের ওপর উঠতেই পাকশী থেকে ট্রেন আসার শব্দ পায় ওরা। ইঞ্জিনের আলোতে চারপাশটা ঝলমল করে ওঠে হঠাৎ। এই ট্রেন সিরাজগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত যাবে। যমুনা নদী ফেরিতে পার হয়ে ওপারে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে দাঁড়ানো আরেকটি ট্রেনে উঠতে হবে। সেই ট্রেনেই ঢাকা যাওয়া। ট্রেন স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মিনিট বিশেক দাঁড়াবে। এই সময়ের মধ্যেই পৌঁছতে হবে ওদের। হাতে সময় আছে। রেললাইনের ওপর উঠে আবছা অন্ধকারে হাঁটতে একটু অসুবিধাই হচ্ছিল। বিশেষ করে মীরার। ওর হাত ধরে হাঁটিয়ে নিতে বাধ্য হয় নাহিদ। কিছু লোক দূরে দূরে বসে গল্প করছে, কেউ কেউ গাঁজায় দম দিয়ে নানান অঙ্গভঙ্গি করছে। নাহিদরা তাদের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে থাকে। ফিসফিস করে বলে নাহিদ, ‘কী মীরা, এখনো ভয় করছে?’

‘একটু একটু। চেনাজানা কেউ যদি দেখে ফেলে, সেই ভয়।’

‘আরে না, এখন আর ভয় নেই। ট্রেনে কোনোমতো  উঠতে পারলেই কেল্লা ফতে। যা যা বলেছিলাম নিয়েছো তো?’

‘উহ্ মাগো!’ হঠাৎ হোঁচট খেয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল মীরা। ওর হাতটা ধরে থাকায় স্লিপারের ওপর পড়া থেকে বেঁচেছে। কিন্তু একটি পায়ের আঙুলে বেশ ভালোই চোট পেয়েছে। রক্ত বেরুচ্ছে কি না বোঝা গেল না। কিন্তু হঠাৎ দু-হাঁটুর ওপর ভর করে বসে পড়ে মীরা। দু-হাঁটুর মাঝখানে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে। হতভম্ব নাহিদ মাথায় হাত রেখে বলতে থাকে, ‘এই মীরা, কাঁদছো কেন, ব্যথাটা কি খুব বেশি?’

‘না ব্যথা তেমন না, অন্য কিছু।’

‘কী সেটা?’ ভীষণ উৎকণ্ঠা নাহিদের গলায়।

‘আমরা না হয় ফিরে যাই নাহিদ। প্লিজ – এভাবে চুরি করে যেতে ভাল্লাগছে না। চলো আমরা দুজনই মায়ের পা ধরে বলি। কেঁদেকেটে বললে মা অমত নাও করতে পারে। তোমার কিছু না থাক, শিক্ষাটা তো আছে। বেশিদিন তো আর বেকার থাকবে না। প্লিজ নাহিদ, চলো …।’

‘না মীরা, এখন আর সেটা হয় না। মা রাজি হলেও

ভাই-চাচারা মোটেও রাজি হবে না। তাছাড়া এতক্ষণে হয়তো সবাই জেনে ফেলেছে। রাস্তায় বেরিয়েও পড়তে পারে খুঁজতে। এদিকেও আসতে পারে। আমি ধরা পড়তে চাই না। তুমি এমন করবে সেটা আমি কল্পনাও করিনি। এখন তোমার এমন রিঅ্যাকশন মানায় না মীরা। আমরা খুব জেনেবুঝেই এ-রাস্তায় পা বাড়িয়েছি। এখন ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।  সো, ওসব অসম্ভব ভাবনা বাদ দাও। উঠে দাঁড়াও। সময় নেই।’

শেষ কথাটা বেশ জোরের সঙ্গেই বলে নাহিদ।  মীরাকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না সে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্লাটফরমের ঢালুতে পা রাখে মীরা। আলো ঝলমলে প্লাটফরম। ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট দশেক পরেই ছাড়বে। টিকিট কাটার দরকার ছিল। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। ট্রেনে উঠতে হবে তাড়াতাড়ি। ট্রেনভর্তি যাত্রী। অনেকেই দাঁড়ানো। কোনোমতে জোরে হেঁটে হেঁটে ছোট একটা কামরায় উঠে পড়ে ওরা। কামরাটায় ভিড় কম। একটা লম্বা সিটে কোনোমতে ঠেলাঠেলি করে বসারও সুযোগ পেল ওরা। কিন্তু সামনের সিটেই বসা ছিল বিরাট এক অকল্পনীয় বিপদ। মীরার খোলা মুখ দেখে সামনের সিটের মধ্যবয়সী এক টুপিপরা খোঁচা খোঁচা দাড়ির ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘আরে মীরা তুই! এত রাতে কোথায় যাচ্ছিস?’

মীরার মেজমামা। ঢাকায় ব্যবসা করেন। মীরা প্রথমে একটু থতমত খেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে একটু বুদ্ধি করে বলে, ‘এই তো মামা, ঢাকায় যাচ্ছি। ঢাকা ভার্সিটিতে একটা ডিবেট কমপিটিশনে পারটিসিপেট করতে। কালই কমপিটিশন। তো আপনি কোত্থেকে? বাসায় গেলেন না যে!’

‘একটা ব্যবসার কাজে এসেছিলাম। সময় পাইনি রে মা আপার সঙ্গে দেখা করার। তো ভালোই হলো, আমার বাসাতেই থাকতে পারবি। তোর মামিও খুশি হবে। জিগাতলায় আমার বাসা। তো, তোর সঙ্গে ওই ছেলেটি কে?’

‘ও-ও যাচ্ছে আমার সঙ্গে। ওরও পার্টিসিপেশন আছে।’

মামা তখন নিজের পাশে খানিকটা জায়গা করে নিয়ে বলেন, ‘এইখানে আয়, বোস।’

মীরা মন খারাপ করে মামার পাশে এসে বসে। মন খারাপ করে একা বসে থাকে নাহিদ। নাহিদের সঙ্গে কোনো কথা বললেন না মামা। নাহিদের আশা, প্ল্যান সব তখন ভেঙে যেতে যেতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ভাবে – শেষ পর্যন্ত এই ছিল ভাগ্যে! এই ব্যাটাটা এত রাতে কোত্থেকে এসে জুটলো? তার কাছ থেকে মীরাকে আর আলাদা করাই যাবে না। শেষ পর্যন্ত তীরে এসে তরী ডুবলো। হারাতেই হলো বুঝি মীরাকে। এখন কী করা যায় সে-ভাবনাও আর মাথায় আসছে না। ট্রেন চলছে দ্রুত। হঠাৎ মামা দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তুই একটু বস মা। আমি একটু টয়লেট থেকে আসি। এই যাবো আর আসবো।’

নাহিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই ছেলে, ওকে একটু দেখে রেখো। ওর পাশে যেন কেউ না বসে।’

মামা টয়লেটের দিকে এগোতে থাকেন। হঠাৎ নাহিদের চোখ দুটো আশায় চকচক করে ওঠে। মনে হয় এই তো সুযোগ! সামনের স্টেশনে ট্রেনটা থামলেই মীরাকে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে কামরা চেঞ্জ করবে সে; কিন্তু সুযোগ এসে গেল আরেকটা। ট্রেন সামনের স্টেশনে যাওয়ার আগেই আউটার সিগন্যালে কে যেন চেইন টানলো। হুইসেলের চিৎকার দিতে দিতে থেমে গেল ট্রেনটা। নাহিদ আর এক মুহূর্তও দেরি করে না। মীরার হাত ধরে টেনে দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে পড়ে ওরা। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোনো একটা গ্রাম হবে হয়তো। তাতে কী? দুজনে বিপদ তো এড়াতে পেরেছে। পরের কোনো ট্রেনে ঢাকা গেলেই হবে। ট্রেন আবার চলতে শুরু করে।  নাহিদ স্টেশনের উল্টো দিকে মীরার একটা হাত ধরে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, ‘হুররে, ডেঞ্জার ইজ ওভার! উই ওন দ্য গেম! মীরা এখন আমার। টোটালি আমার …।’ মীরা নাহিদের হাতটা টেনে ধরে অনেকটা ধমকের সুরে বলে, ‘এই পাগল ছেলে, আবেগে অত চিৎকার করছো কেন? সামনে আরো কত বিপদ আছে জানো? মেজমামা আমাদের না পেয়ে কী যে তুলকালাম কাণ্ড বাধাতে পারে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। এই অন্ধকারে ঢাকা গ্রামেও যে বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে, ভেবেছো সেটা?’

নাহিদ একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মীরাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ঠিকই বলেছো মীরা। এখনো অনেক পথ বাকি। বিপদও থাকতে পারে। আনন্দে একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। স্যরি মীরা। তুমি সত্যিই একটা ইনটেলিজেন্ট গার্ল। তবে তোমার মতো মেয়ে পাশে থাকলে কোনো বিপদই বিপদ না। চলো হাঁটতে থাকি।’ গ্রামীণ মেঠোপথে অন্ধকার চিরে হাঁটতে থাকে ওরা … রাতের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে ততক্ষণে। ভোরের মিষ্টি বাতাস ওদের সারারাতের ক্লান্তি মুছে দিতে থাকে পরম আদরে …