বিপ্লবী জহির রায়হান ও তাঁর রাজনৈতিক চলচ্চিত্র

বলছি ভাষা-আন্দোলনের সূচনাকালে, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে কারাবরণকারী প্রথম দশজনের গ্রুপের অন্যতম সদস্য এক বেপরোয়া যুবকের কথা। ওইদিনের ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। একই বছরের জুন মাসে দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতার হয়ে তিন মাস কারাভোগ করেন এই তরুণ। ছাত্রজীবনের এই পর্বে চলচ্চিত্রের পোকা ঢোকে মাথায়। তাই ১৯৫২ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরই চলে যান কলকাতায়, চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষালাভের জন্য ‘প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল ইনস্টিটউট অফ সিনেমাটোগ্রাফি’তে ভর্তি হন; কিন্তু ছয় মাস পর অর্থাভাবে কোর্স অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। সেই যুবকের নাম জহির রায়হান। ভাষাসংগ্রামী সেই অদম্য তরুণই হলেন অসম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা জহির রায়হান – একাধারে প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্রকার, বিপ্লবী রাজনীতিবিদ, তুখোড় সাংবাদিক, উদীয়মান নাট্যকার, অমর কথাসাহিত্যিক এবং পত্রিকা-সম্পাদক।

জন্মেছিলেন ব্রিটিশ ভারতে ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট, নোয়াখালি (বর্তমান ফেনী) জেলার মজুপুর গ্রামে। পিতৃদত্ত নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। পিতা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক আর মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন গৃহিণী। জহির রায়হান পিতার কর্মসূত্রে চল্লিশের দশকে কলকাতা মডেল স্কুল, মিত্র ইনস্টিটিউশন ও আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। শৈশবেই অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সারের প্রভাবে বামপন্থী রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। কমিউনিস্ট পার্টির কুরিয়ার হিসেবে সদস্যদের মধ্যে চিঠিপত্র ও খবর আদান-প্রদানের গোপন কাজ ছিল তাঁর, প্রকাশ্যে বিক্রি করতেন পার্টির মুখপত্র স্বাধীনতা। মাত্র দশ বছর বয়সে, ১৯৪৫ সালে তিনি কলকাতায় ‘ভিয়েতনাম দিবসে’র মিছিলে যোগদান করেন এবং পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনি এবং ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৫০ সালে নোয়াখালির আমিরাবাদ হাইস্কুল থেকে প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে জগন্নাথ কলেজে আইএসসিতে ভর্তি হন।

বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও গোপন রাজনীতির প্রতি অনুরক্ত জহিরুল্লাহ বাবার ইচ্ছানুসারে ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেও পরে পুনঃভর্তি হন বাংলা বিভাগে। এ-সময়েই প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন তিনি এবং কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ লাভ করেন। সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে নব-সৃষ্ট পাকিস্তানে তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। পার্টির সদস্যদের তাই গোপনে কাজ করতে হতো। অতএব পার্টির নেতা কমরেড মণি সিংহ তাঁর ছদ্মনাম রাখলেন ‘রায়হান’। পরবর্তীকালে জহিরুল্লাহ নিজের নাম সংক্ষিপ্ত করে সঙ্গে রায়হান যোগ করে হয়ে গেলেন ‘জহির রায়হান’। এই রূপান্তরিত জহির রায়হান ১৯৫৭-৫৯ সময়পর্বে হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘সংস্কৃতি সংসদে’র সভাপতি। পরবর্তীকালে এই নামেই তিনি তুখোড় সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও চলচ্চিত্রকার হিসেবে সাধারণ্যে পরিচিতি লাভ করেন। ষাটের দশকে তিনি ইংরেজি সাপ্তাহিক এক্সপ্রেস এবং বাংলা মাসিক পত্রিকা প্রবাহ সম্পাদনা করতেন।

বিশ শতকের ষাটের দশকে জহির রায়হান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একজন রাজনীতি-সচেতন সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক নেতা হিসেবে ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তখন বাংলা হরফের বদলে উর্দু হরফে বাংলা ভাষা চালুর পাঁয়তারা করছিল। ১৯৬৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাংলা বর্ণমালা ও বানান সংস্কারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে এই পরিকল্পিত পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের তীব্র প্রতিবাদ করে জহির রায়হানসহ ৪১ জন বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্বে, ১৯৬৯ সালে ১১ দফার মিছিলে গুলি চালিয়ে ছাত্র ও গণহত্যার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী, লেখক, কবি, শিল্পী ও চলচ্চিত্রকাররা লিখিতভাবে যে-প্রতিবাদ জানান, জহির রায়হান সেই লিখিত বিবৃতিতেও স্বাক্ষর করেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে তিনি ডাকসুর নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯৭১ সালের মার্চে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজে’র ব্যানারে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার শপথ নেন।

সাহিত্যিক জহির রায়হান

ভাষা-আন্দোলনের গভীর প্রভাব পড়েছিল জহির রায়হানের সাহিত্যকর্মে। তাঁর প্রথম উপন্যাস শেষ বিকেলের মেয়েসহ (১৯৬০) তৃষ্ণা (১৯৬২), হাজার বছর ধরে (১৯৬৪), আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯), একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৭০), আর কতদিন (১৯৭০), মহামৃত্যু, একুশের গল্প ও অন্যান্য সাহিত্যকর্মে এই প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট। বিষয়টি লক্ষ করে হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, জহির রায়হানই সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র কথাসাহিত্যিক যাঁর উদ্ভবের পেছনে আছে ভাষা-আন্দোলন। যদি বায়ান্নর একুশ না ঘটত, তবে জহির রায়হান হয়তো কথাশিল্পী হতেন না।

ভাষা-আন্দোলন জহির রায়হানের মনের ওপর কতটা গভীর প্রভাব ফেলেছিল, তার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া-তে (১৯৭০)।

যখন চলচ্চিত্রকার

ঢাকায় ১৯৫৭ সালে ইস্ট পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দু-বছর পর ১৯৫৯ সালে ইপিএফডিসিতে নির্মিত জাগো হুয়া সাভেরা, এদেশ তোমার আমার, আকাশ আর মাটি এবং মাটির পাহাড় – এই চারটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এর মধ্যে প্রথম দুটি চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। এরপর তিনি নবারুণ (১৯৬০) এবং যে নদী মরুপথে (১৯৬১) চলচ্চিত্র দুটিতেও সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।

তদানীন্তন পাকিস্তানের বয়ঃকনিষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানকে বলা হয় বাংলা চলচ্চিত্রের মাইকেল মধুসূদন দত্ত। স্বল্প ব্যয়ে ও স্বল্প সময়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ১৯৬৭ সালে তিনি ‘সিনে ওয়ার্কশপ’ গোষ্ঠী গঠন করেন। এ-সময়ে মাত্র তিন সপ্তাহে দুই ভাই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। জহির রায়হান ১৯৬৯ সালে ঘোষণা করেন মনের মতো বউ, বধূ, মা, বেদের মেয়ে ও শেষ পর্যন্ত নামে পাঁচটি বাংলা চলচ্চিত্র ও নিজের পরিচালনায় জ্বলতে সুরুজকে নিচে নামে একটি উর্দু চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা।

ষাটের দশকে ঢাকায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জহির রায়হান। চলচ্চিত্র নির্মাণের সকল শাখায় কাজ করে তিনি ঢাকার চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে একজন প্রভাবশালী পরিচালক, প্রযোজক, কাহিনিকার ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে আবির্ভূত হন। জহির রায়হানের নামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মোট ৩১টি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে চারটিতে সহকারী পরিচালক, আটটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পরিচালক, ১২টিতে প্রযোজক, ১৬টিতে চিত্রনাট্যকার এবং ১২টি চলচ্চিত্রের কাহিনিকার ছিলেন তিনি। বাংলা, উর্দু, ইংরেজি ও রুশ ভাষায় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি প্রামাণ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেন জহির রায়হান।

শুরু থেকেই নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র নির্মাণে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি। এককভাবে তাঁর নির্মিত আটটি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্রের মধ্যে কখনো আসেনি (১৯৬১), কাচের দেয়াল (১৯৬৩), বেহুলা (১৯৬৬), আনোয়ারা (১৯৬১), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) – এই পাঁচটি চলচ্চিত্রই নারীর অধিকার, বেদনা ও জীবনসংগ্রামকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মাত্র ২৬ বছর বয়সে জহির রায়হান তাঁর প্রথম পূণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র কখনো আসেনি (১৯৬১) নির্মাণ করেন। এ-চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা তাঁর। প্রতীকী এই চলচ্চিত্রে বন্দি নারীর জীবনের করুণ পরিণতি, আর্তনাদ, অবদমিত আকাক্সক্ষা ও দারিদ্র্যপীড়িত যুবকের স্বপ্নের ট্র্যাজিক পরিণতি উপস্থাপিত হয়েছে।

এর মূল বক্তব্য হলো, পাথরের মতো

ভারি ও বন্দি জীবন থেকে নারীকে মুক্তি দেওয়ার জন্য কেউ ‘কখনো আসেনি’, কেউ নারীর মনের দুঃখ বুঝতে পারে না এবং কেউ বন্দি জাদুঘর থেকে নারীকে মুক্তও করে না। চলচ্চিত্রটি বাণিজ্যিকভাবে সফল না হলেও ব্যতিক্রমধর্মী কাহিনি, সাবলীল ভাষা, উপস্থাপনা ও নির্মাণশৈলীর জন্য সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ

করে। প্রথম চলচ্চিত্রেই জহির রায়হানকে একজন অগ্রসর নির্মাতা হিসেবে

চিহ্নিত করেন তাঁরা।

জহির রায়হান পরিচালিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র কাচের দেয়ালও নারীকেন্দ্রিক ভাবনা নিয়ে নির্মিত। এ-ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা – সবই জহির রায়হানের। ছবিতে অসহায় এক তরুণীর কাহিনি তুলে ধরা হয়। মামাবাড়িতে সে লালিতপালিত হয়। মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবা হয়ে যায় বাউন্ডুলে। মামার পরিবারে মেয়েটির লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শেষ নেই। মেয়েটি হঠাৎ লটারিতে প্রচুর টাকা পেয়ে যায়। এ-সময় মামার পরিবারে তার আদরযত্ন বেড়ে যায়; কিন্তু কিছুদিন পরে যখন সংবাদ আসে যে লটারিটি মিথ্যা, মেয়েটির ভাগ্যে আবার দুর্ভোগ নেমে আসে। শেষ পর্যন্ত সে বিদ্রোহ করে বাড়ি থেকে অবরোধের ঠুনকো কাচের দেয়াল ভেঙে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ঢাকার চলচ্চিত্রে এই প্রথম আমরা অচলায়তন ভাঙা নারীর উপস্থিতি লক্ষ করি।

ষাটের দশকে জহির রায়হান উর্দু ভাষায় দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এর প্রথমটি সঙ্গম (১৯৬৪), অন্যটি বাহানা (১৯৬৫)। এই দুটিই হলো সমগ্র পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যথাক্রমে প্রথম রঙিন এবং প্রথম সিনেমাস্কোপ সিনেমা। উর্দু চলচ্চিত্র নির্মাণের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য এ-সময় সমালোচনার মুখে পড়েন জহির রায়হান। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, ভাষাসংগ্রামী জহির কেন উর্দু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন? এই বিতর্কের অবসান হওয়ার আগেই তিনি বাংলা ভাষায় লোককাহিনিভিত্তিক বেহুলা (১৯৬৬) চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। তখন তাঁর বিরুদ্ধে আবারো প্রশ্ন ওঠে, রূপবানের (১৯৬৫) সাফল্য দেখে তিনি লোককাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র বেহুলা (১৯৬৬) নির্মাণে প্রয়াসী হলেন কি না? জহির রায়হানের ক্ষেত্রে এসব অভিযোগ যে আদৌ বস্তুনিষ্ঠ নয়, তা বলাই বাহুল্য। কারণ উর্দু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে একজন উদীয়মান বাঙালি চলচ্চিত্রকার হিসেবে জহির রায়হান সমগ্র পাকিস্তানের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। সে-সময়ে ঢাকার মুমূর্ষু চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে জহির রায়হানের এ-উদ্যোগ ছিল সুদূরপ্রসারী, পাকিস্তানের দুই অংশের প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি ভাষাভিত্তিক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তা বাঙালিদের এগিয়ে দিয়েছিল সুস্পষ্টভাবেই। অপরপক্ষে বেহুলা ছবির ব্যতিক্রমধর্মী বক্তব্য ও উপস্থাপনা দেখলেও এ-কথা পরিষ্কার হয়ে যায়, জহির রায়হানের বিরুদ্ধে গড্ডলিকা প্রবাহে

গা-ভাসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ মোটেও খাটে না।

সময়টা স্মরণ করুন, ব্যতিক্রমী লোককাহিনিভিত্তিক ছবি বেহুলা চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে, বাঙালি জাতির মুক্তি-সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণার বছরেই। এ-কথা সত্য, রূপবানের (১৯৬৫) অভাবনীয় বাণিজ্যিক সাফল্য দ্বারা প্রাণিত জহির রায়হান এই চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তবে দেশের এই অগ্নিগর্ভ সময়ে লোককাহিনিভিত্তিক বেহুলা নির্মাণ করে নতুন এক সূক্ষ্ম রাজনৈতিক মাত্রা দান করেন জহির রায়হান। ফলে চলচ্চিত্রটি আর শুধু লোককাহিনির বৃত্তে আবদ্ধ থাকে না। এই অসাধ্য সাধন কেবল জহির রায়হানের পক্ষেই সম্ভব ছিল। তিনি নিজেই ছিলেন ছবিটির চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক। ছবিটি নির্মিত হয়েছে বাংলার প্রচলিত লোককাহিনি, হিন্দু পুরাণ মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা-লখিন্দর উপাখ্যান অবলম্বনে। বেহুলা প্রাচীন বাংলার সুবিখ্যাত মঙ্গলকাব্য মনসামলের প্রধান চরিত্র এবং চম্পকনগরের চন্দ্রবণিক বা চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিন্দরের স্ত্রী। চাঁদ সওদাগরের কনিষ্ঠ পুত্র লখিন্দর ও তার উজানীনগরের ব্যবসায়ী সতীর্থ সাহার

কন্যা বেহুলা।

চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে, বিদ্রোহী চাঁদ সওদাগর সর্পদেবী মনসাকে পূজা দিতে অস্বীকার করায় তার রোষানলে পতিত হন। তাই ক্রুদ্ধ মনসার অনুগত সাপ একে একে দংশন করে চাঁদ সওদাগরের সকল পুত্রকে হত্যা করে এবং সবশেষে সকল রকম পূর্ব সতর্কতা সত্ত্বেও কনিষ্ঠ পুত্র লখিন্দরকে দংশন করে। বেহুলা ছিলেন সতী-সাধ্বী, পরমা সুন্দরী এবং সর্বগুণে গুণান্বিতা। সর্পদেবী মনসার আক্রোশে বিবাহ-রজনীতে লৌহবাসরে সর্প-দংশনেই স্বামী লখিন্দরের মৃত্যু হলেও স্বামীর পুনর্জীবন কামনায় বেহুলা কলাগাছের ভেলায় স্বামীর শব নিয়ে গাঙুরের জলে ভেসে দেবপুরীর উদ্দেশে এক অজানা দুর্গম পথে যাত্রা করেন।

অহংকারী ও অত্যাচারী মনসা দেবীর বিরুদ্ধে মানুষ চাঁদ সওদাগরের বিদ্রোহের ঘোষণা ও বেহুলার নারীজীবনের অব্যক্ত বেদনা ও ভিন্নতর সংগ্রামের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে এই বেহুলা-লখিন্দর লোককাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্রে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করলে

বোঝা যায়, বেহুলা চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অপমৃত্যু, জনসাধারণের বিদ্রোহ ও বাঙালির অপহৃত আশা-আকাক্সক্ষার পুনর্জন্ম সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে। তাই বেহুলা চলচ্চিত্রটি কোনো গতানুগতিক সাধারণ লোককাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্রের গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে তা শিল্প-সুষমামণ্ডিত রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের লক্ষণযুক্ত হয়ে ওঠে।

লক্ষ করলে দেখা যাবে, বেহুলা চলচ্চিত্রে সংগীতের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঢাকায় নির্মিত সংগীতপ্রধান এ-চলচ্চিত্রের পর্দায় প্রায় ৪৫ মিনিট সময়কাল জুড়ে মোট ১৪টি পূর্ণ ও খণ্ড গানের চিত্রায়ণ উপস্থাপিত হয়েছে। প্রখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদ এ-চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন। তাছাড়া এই চলচ্চিত্রে জহির রায়হান ‘বেহুলা’ চরিত্রের জন্য নির্বাচন করেন নবাগত নায়িকা সূচন্দাকে; এটি ছিল তাঁর অভিনীত মাত্র দ্বিতীয় ছবি। অন্যদিকে লখিন্দরের ভূমিকায় তৎকালীন নায়কদের পছন্দ না হওয়ায় তিনি নতুন কাউকে নেওয়ার কথা ভাবেন এবং নানান প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বাংলা ছবির একস্ট্রা অভিনেতা রাজ্জাককেই নায়ক হিসেবে চূড়ান্ত করেন। এই বেহুলার মাধ্যমেই ঢাকার বাংলা-সিনেমার ‘নায়করাজ’ রাজ্জাকের চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় এবং ঢাকার চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় রাজ্জাক-সূচন্দা জুটিরও সূচনা ঘটে। এভাবেই সাহসী নির্মাতা জহির রায়হান প্রতিবন্ধকতাকে সাফল্যের পদচিহ্নে রূপান্তরিত করেন।

জহির রায়হানের নারী চরিত্রকেন্দ্রিক আরেকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র আনোয়ারা (১৯৬৭)। ছবিটি নির্মিত হয়েছে সাহিত্যরত্ন মোহাম্মদ নজিবর রহমানের বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক উপন্যাস আনোয়ারা অবলম্বনে। এ-চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন জহির রায়হান।

তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত ও তাৎপর্যমণ্ডিত হলো জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)। বাংলা চলচ্চিত্রের মাইলফলক এই চলচ্চিত্রটি তদানীন্তন পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। ছবিটি শুরু হয় প্রভাতফেরির বাস্তব দৃশ্য দিয়ে, সঙ্গে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান, আর ছবিটি শেষ হয়েছিল ‘মুক্তি’ নামে এক নবজাতকের জন্মকালীন কান্নার চিৎকার-ধ্বনি দিয়ে। সে যেন বিশ্ব মানচিত্রে নতুন ভাষারাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তির আগমনী বার্তা!

এই ছবির পাঁচটি বিখ্যাত গানের ব্যবহারও খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত। এর মধ্যে ‘আমার সোনার বাংলা’ পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

চলচ্চিত্রটি ১৯৭০ সালের এপ্রিলে মুক্তি পায়। বাঙালি জাতির জীবনে মুক্তিসংগ্রামের অগ্নিগর্ভ সময়ে এ-চলচ্চিত্রে বাঙালির তৎকালীন স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। এটি জহির রায়হান-নির্মিত শেষ মুক্তি পাওয়া কাহিনিচিত্র। সিনেমার স্টোরিলাইন গড়ে উঠেছে বাংলার অতিসাধারণ এক পরিবারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। একটি পরিবারে দুই ভাই আনিস (শওকত আকবর) ও ফারুক (রাজ্জাক), বড় বোন (রওশন জামিল) এবং বোনের স্বামী (খান আতাউর রহমান)। বড় বোন থাকেন বাবার বাসাতেই। তার স্বামী অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির এবং সংসারের সব ক্ষমতা বড় বোনের হস্তগত। এই ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি স্বামীসহ নিজের দুই ভাই ও ভাইবউদের ওপর স্বৈরশাসন চালাতে থাকেন। আঁচলে চাবির গোছা নিয়ে ঘোরেন, পেছনে পেছনে পানের বাটা নিয়ে ঘোরে বাড়ির গৃহপরিচারিকা। তার দোর্দণ্ড প্রতাপে অস্থির সবাই।

এই ফ্যাসিস্টধর্মী চরিত্রের মধ্য দিয়েই তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসকের দুঃশাসনের চিত্র রূপক আকারে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে চলচ্চিত্রটিতে। এ-চলচ্চিত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের কথা। বাংলার মানুষের চাওয়া-পাওয়ার কথা। বড় পর্দায় জনগণের রাজনৈতিক চাহিদার এতো স্বতঃস্ফূর্ত রূপায়ণ বাংলাদেশের আর কোনো সিনেমায় দেখা যায়নি। স্পষ্টতই বোঝা যায়, বিপুল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেই জীবন থেকে নেয়া নির্মাণ করেন জহির রায়হান। ছবির শুটিং চলাকালেই সরকারি নজরদারিতে পড়ে চলচ্চিত্রটি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা ফ্লোরে এসে ছবির শুটিং বন্ধ করে দেয় এবং ছবির পরিচালক জহির রায়হান ও প্রধান অভিনেতা রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলি, মেজর মালেক ও তার দোসররা সেন্সর বোর্ডে এ-ছবি আটকে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। স্বাধিকার আন্দোলনে তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল। বাঙালি দর্শকেরা পাকিস্তানি শাসকদের মনোভাব বুঝতে পেরে প্রতিবাদী মিছিল শুরু করে। তখন গণরোষের চাপে সামরিক সরকার চলচ্চিত্রটিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। সারাদেশে হইচই পড়ে যায়; কিন্তু মুক্তির প্রথম দিনেই নিষিদ্ধ হয় এর প্রদর্শনী। সেনাবাহিনী হল থেকে জব্দ করে নিয়ে যায় রিল। এবার ঢাকার গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনেই শুরু হলো বিক্ষুব্ধ জনতার ব্যাপক বিক্ষোভ। পরদিন রাও ফরমান আলির উপস্থিতিতে সেন্সর বোর্ড ছবিটি পুনঃনিরীক্ষায় বসে। অনেক বিতণ্ডার পর চলচ্চিত্রটি মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সেন্সর কর্তৃপক্ষ। তবে ওই সভায়ই রাও ফরমান আলি নির্মাতাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এভাবেই সিনেমাটিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়িত জনতার অব্যক্ত বেদনার প্রতিফলন ঘটিয়ে বাঙালি চলচ্চিত্রকারদের সামনে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ-কৌশলের অভূতপূর্ব এক উদাহরণ সৃষ্টি করেন নির্মাতা জহির রায়হান।

ঘটনাটি উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেনের দ্য ভিজিট ফিল্ম (১৯১২) নিষিদ্ধ করার ঘটনার সঙ্গে তুলনীয়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে রাজনৈতিক কারণে চলচ্চিত্রের প্রদর্শন নিষিদ্ধ ঘোষণার সেই ছিল প্রথম ঘটনা। সম্রাট পঞ্চম জর্জের সস্ত্রীক ভারত আগমন উপলক্ষে ১৯১১-১২ সালে সরকারি আমন্ত্রণক্রমে হীরালাল সেন তৈরি করেন Visit Film (১৯১২), যা সারাবিশ্বেরও প্রথম সংবাদনির্ভর তথ্যচিত্র, সরকারি বিধিনিষেধে যার প্রদর্শনী নিষিদ্ধ হয়েছিল। ভারতের বড় লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দিল্লি দরবারে সম্রাট পঞ্চম জর্জের মুখ দিয়ে সেদিন ‘বঙ্গভঙ্গ রদে’র ঘোষণা করিয়েছিলেন। এ-বৈঠকে আরো তিনটি গুরুতর সিদ্ধান্ত হয়েছিল – ১. ভারত সাম্রাজ্যের রাজধানী বাংলার কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নেওয়া, ২. পূর্ববঙ্গ ও আসাম টেরিটরি থেকে আসামকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা প্রদেশ গঠন এবং ৩. বঙ্গপ্রদেশ (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ) থেকে উড়িষ্যা ও বিহারকে বিছিন্ন করে আলাদা প্রদেশ গঠন। হীরালাল সেন এই বৈঠকেরই চিত্র ধারণ করেন। তাঁর Visit Film-এর দিল্লি দরবার খণ্ডে এই দৃশ্যের চিত্রায়ণ করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশে প্রজাসাধারণের মধ্যে নতুন করে গণঅসন্তোষ ও বিদ্রোহ জাগিয়ে তুলতে পারে – এই আশঙ্কা জেগে ওঠে সাম্রাজ্য হারানোর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ও তটস্থ ব্রিটিশ শাসকদের মনে। তাই সরকার মুক্তি না দিলেও হীরালাল সেন নিজের ল্যাবরেটরিতে তড়িৎগতিতে পরিস্ফুটন করে ১৯১২ সালের ৫ জানুয়ারি কলকাতায় মুক্তি দেন ছবিটি। এই ছবি মুক্তি পাওয়ার পর মাত্র দুদিন (৫ ও ৬ জানুয়ারি) হলে দেখানো সম্ভব হয়, ৭ই জানুয়ারিতে রাজনৈতিক কারণে জনসমক্ষে ছবির প্রদর্শন বন্ধ করে দেয় সরকার। হীরালাল সেন চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণে রাজরোষে নিপতিত হন।

মাতৃভূমির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় বাঙালির গৌরবময় রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণের এ-দুটি ঘটনাই ঘটেছিল একই নিগড়ে বাঁধা দেশের পরাধীনতার কালে। প্রথমটি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে আর দ্বিতীয়টি প্রথম ঘটনার ৫৮ বছর পর ১৯৭০ সালে দখলদার পাকিস্তানি শাসনামলে। ভিজিট ফিল্ম তাই অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের সূচনাপর্বের প্রথম ছবি, আর জীবন থেকে নেয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলনভিত্তিক প্রথম ছবি। কী আশ্চর্য, দুটি ছবিই নির্মিত হয়েছিল পরাধীনতার দুই পর্বে দুই যুগের দুই অকুতোভয় বিপ্লবী পুরোধা-বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতার হাতে।

জহির রায়হান ছিলেন চিরকালীন বিপ্লবী এক রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঘরে বসে থাকেননি তিনি, ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় অবস্থানকালে জহির রায়হান সাংগঠনিক কাজের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে পাকিস্তানি বর্বরতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নেন। তিনি ও তাঁর ক্যামেরা ইউনিট সরাসরি রণাঙ্গন থেকে মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ গ্রহণ করতেন। তিনি নিজে স্টপ জেনোসাইড ও এ স্টেট ইজ বর্ন শীর্ষক দুটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং আলমগীর কবির ও বাবুল চৌধুরীর মাধ্যমে নির্মাণ করেন যথাক্রমে লিবারেশন ফাইটার্স ও ইনোসেন্ট মিলিয়নস। এই চারটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রই আজ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

জহির রায়হান ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষ ভাগে বেসরকারি পর্যায়ে কলকাতায় গঠিত ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি’র সভাপতি এবং ‘বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তি সংগ্রাম পরিষদে’র সাধারণ সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি ৯ জুলাই কলকাতায় মার্কিন দূতাবাসের সামনে বাঙালি নিধনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও মিছিলের আয়োজন করে। ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্ব^রের পর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রাক্কালে জহির রায়হানের নেতৃত্বে দুটি চলচ্চিত্র ইউনিট গঠিত হয়। একটির নেতৃত্বে ছিলেন জহির রায়হান নিজে, অপরটির নেতৃত্বে ছিলেন আলমগীর কবির। জহির রায়হান ঢাকা-ময়মনসিংহ নিয়ে গঠিত পূর্ব সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার চিহ্ন এবং মিত্র বাহিনীর অগ্রাভিযানের চিত্র ক্যামেরায় ধারণ করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল স্টপ জেনোসাইড এবং এ স্টেট ইজ বর্ন  প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে জহির রায়হান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতির ওপর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর অত্যাচার, গণহত্যা ও নির্মমতার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। স্টপ জেনোসাইডের শুরুতেই লেনিনের স্কেচ ও বক্তব্য, ভিয়েতনামে মার্কিন বোমাবাজির দৃশ্য, ভিয়েতনামি শিশুর লাশ ও নাৎসি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য প্রমাণ করে এটা শুধু আমাদেরই নয়, এই ছবি পৃথিবীব্যাপী সব মুক্তিকামী মানুষের চেতনার প্রতীক। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে তিনি দেখেছিলেন পৃথিবীব্যাপী সব দেশের সকল নিপীড়িত মানুষের মুক্তিসংগ্রামের অংশ হিসেবে। ১৯৭১ সালের জুন-আগস্টের মধ্যে স্টপ জেনোসাইড নির্মাণ শেষ হলেও একশ্রেণির লোকের বিরোধিতার কারণে এর ছাড়পত্র পেতে দেরি হয়। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের হস্তক্ষেপে সেপ্টেম্ব^র মাসে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী চলচ্চিত্রটির ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং আন্তর্জাতিক মহলেও চলচ্চিত্রটি প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়।

১৯৭১ সালে কলকাতায় জহির রায়হান-নির্মিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়ার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে-সময়ে তিনি চরম আর্থিক দৈন্যের

মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তাঁর চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে দান করেন। কলকাতায় অবস্থানকালে জহির রায়হান যৌথভাবে আলমগীর কবিরের সঙ্গে এবং ধীরে বহে মেঘনা নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণেরও পরিকল্পনা করেন। আলমগীর কবির এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, কলকাতায় অবস্থানের সময় জহির রায়হান ‘স্বাধীন বাংলাদেশে

চলচ্চিত্র শিল্প জাতীয়করণের খসড়া’ও প্রণয়ন করেন; কিন্তু দুর্ভাগ্য, তিনি তা বাস্তবায়নের সুযোগ পাননি।

ট্র্যাজেডিপূর্ণ অন্তর্ধান

জহির রায়হান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্ব^র ঢাকায় ফিরে আসেন এবং তাঁর নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে শুরু করেন, যিনি স্বাধীনতার ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তানি আর্মির এদেশীয় দোসর আল-বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন। ভাইয়ের সন্ধানে তিনি মিরপুরে যান এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির পর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মিরপুর ছিল ঢাকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত স্বাধীনতাবিরোধী বিহারি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা। এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, সেদিন বিহারিরা ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের ওপর সম্মিলিত আক্রমণ ও গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন।

দৈনিক ভোরের কাগজ ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘নিখোঁজ নন, গুলিতে নিহত হয়েছিলেন জহির রায়হান’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে জানায়, যুদ্ধের ২৮ বছর পর ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারিতে মিরপুরের যুদ্ধে আহত নায়েক আমির হোসেনের সন্ধান পাওয়া যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি বেঁচে এসেছিলেন বিহারিদের আক্রমণ থেকে। তিনি জহির রায়হানকে গুলিবিদ্ধ দেখেছিলেন পানির ট্যাংকের দেয়ালের পাশে। তাহলে কারা খুন করেছিল জহির রায়হানকে? মাত্র ৩৬ বছর ৫ মাস বয়সে ক্ষণজন্মা বিপ্লবী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের অন্তর্ধান ঘটল, অথবা ঘাতকের আঘাতে তিনি নিহত হলেন। আমাদের দেশের পথিকৃৎ চলচ্চিত্রকারদের সবাই ক্ষণজন্মাই ছিলেন। হীরালাল সেন ৫১ বছর, আলমগীর কবীর ৫১ বছর, তারেক মাসুদ ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস!