বিষাদ-সিন্ধুর মানস-পরিচর্যা : এ-সময়ের চোখে

ছোট্টবেলার কিছু স্মৃতি, আত্মভঞ্জন শর্তে, পাঠকদের বলতে চাই। প্রসঙ্গ বিষাদ-সিন্ধুর গল্প। রাত্রির লণ্ঠনের আলোয় তখন – সুর করে পিতা পাঠ করছেন হাসান-হোসেন বা মাসহাব কাক্কার গল্প। মা ও তাঁর সন্তানরা অশ্রু ও ভয় নিয়ে তা শুনে চলেছেন। বুঝি সত্যিই আঁধার-ঘনানো অন্ধকারে দুলদুল ঘোড়ায় আসীন হোসেন খুব বিপদগ্রস্ত। অন্ধকারে হেঁটে আসছেন বুঝি তিনি! এমনটা চলছিল প্রায় প্রতিদিন, তবে জোর দিয়ে সিরিয়াসলি পড়া হয় মহররম মাসের প্রথম দশ দিন। যা হোক, এখন শিরোনামস্থিত ‘লেকচারস অন অ্যাসথেটিক্স’। দার্শনিক ফিওদর হেগেলের শিল্প-প্রকরণবিষয়ক এ-শিরোনামের ভেতরে এখন আমার শিরোনামটির অর্থ ব্যাখ্যা করতে চাই। গ্রন্থটির প্রথম খণ্ডের প্রকাশ (১৮৮৫-৯২)। সে-সূত্রে বিষাদ-সিন্ধুর প্রকাশ – উনিশ শতকের পরিণতি-পর্বে। তার আগে বঙ্কিম চোদ্দোটির মধ্যে অধিকাংশই লিখে ফেলেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর জীবৎকালে শুধু উপন্যাসই লিখেছেন – তা নয়। মূল্যবান চিন্তাশীল মননের প্রবন্ধের চর্চাও করেছেন। ওসবের ভিত্তি, পাশ্চাত্য চিন্তকগণ। বুঝে নিই, কলোনি-শাসন তখন পরিণত। পটভূমি প্রসারিত। কলোনাইজারবৃন্দ জেনে গেছেন, কলোনাইজড অংশটি আর নিজেদের কোনোভাবেই ‘অজিজ্ঞাস্য’ রাখতে চায় না। রাজনৈতিক দল-সভা-সমিতি-সংঘ ওঁদের প্রতিপক্ষকে অ্যালার্ট করছে।

ঐতিহ্যিক-সারণি পুনর্গঠিত করতে চাইছে। সহায়তা বা প্রভাব সরল ও আকর্ষক কথা। এখন যখন বিষাদ-সিন্ধু নিয়ে লিখতে বসি, তখন মুনীর চৌধুরী [মীর-মানস, ১৯৬৪] থেকে শান্তনু কায়সার [তৃতীয় মীর (১৯৯৪)] পেরিয়ে এমে সেজেয়ার, ফ্রাৎস ফানন ধরে এদুয়ার্দ

সাঈদ-কথিত [ÔNarrative is crutial to my argument here, my basic point being that stories are at the heart of what explores and novelists say about strange regions of the world, they also become the method colonized people use to assert their own identity and existence of their own historyÕ]

আত্মপরিচয় ও আত্ম-ইতিহাসের অস্তিত্ব চেনা-খোঁজা ও জানা এবং তার অর্থবহতার সমসাময়িক উদ্বোধন-কলা নির্ণয় জরুরি বলে মনে হয়। এই অনিবার্য নির্ণয়, এক্ষণে জরুরি। গদ্যকার মীর মশাররফ হোসেন আমাদের কলোনির গল্পকার। তাঁর পূর্বজ লেখক হতে পারেন মুকুন্দরাম বা তারও আগের কেউ, আর একালে কালীপ্রসন্ন-প্যারীচাঁদ হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁরা বিধৃত লেখাসমূহে এই শাসিত ভূখ-ের গল্প শুনিয়েছেন – হতে পারে তা তাঁদের কালের বা পূর্বের। তবে এই কাহিনিই কি বিষাদ-সিন্ধু? তবে এর নতুন তত্ত্ব কী? প্রসঙ্গত, যে-আত্মকথন দিয়ে শুরু করেছি, তা শতবর্ষের পরের ‘প্রয়োজন’ – এবং সে-প্রয়োজনটি নির্মিত স্বাদেশিক ও স্বভাষার করণকৌশলের ভেতর ধরে নির্ণীত। বোঝাতে চাই, এখনো যে কলোনি-শাসন নেই, তা নয়।

করপোরেট-পুঁজির আগ্রাসন ধরিয়ে দেয়, নব্য-কলোনাইজারদের ভৌতিক, রগরগে ভোগবাদিতার বিক্রীত অন্তঃসার এখনকার ব্যক্তি। তাঁরা গত পাঁচশো বছরের তত্ত্বগত প্রতিপাদ্যে তাদের ভুঁইফোঁড় টেকনিককে [লুকাস/ বাখতিন (তত্ত্বালোচনায় তাঁরা অবশ্যই অশ্রদ্ধেয় নন)] চাপিয়ে দেয় – আমাদের কলোনি-কথাকারদের ওপর। এটি কলোনাইজারদের ‘ওভারকোট’। এখন আমাদের ‘কলোনাইজড’ [করপোরেট-কলোনি] কনটেক্সটের এই ওভারকোট খোলার বিষয়টি আমলে নিয়ে উপন্যাসের সমস্যাকে যাচাইয়ের নিমিত্ত স্বাদেশিক ও স্বভাষিক তত্ত্বপটে বিষাদ-সিন্ধুর সৃষ্টিশক্তিকে (‘লেকচার অন

অ্যাসথেটিক্স’ বলেছি) আমলে নিতে চাই, এক অর্থে নেওয়ার চেষ্টা করি।

দুই

‘উচ্ছ্বাসময় গদ্য’ – কথাটি বিষাদ-সিন্ধুর আখ্যান-গঠন সম্পর্কে এখনো গতায়ু হয়নি। বিষয় ও আঙ্গিকের ঐক্যে এ-টার্ম যৌক্তিক মান্য। কীভাবে? উদাহরণ : ‘প্রথম কথাতেই জয়নাবের মনের ভাব এজিদ অনেক জানিতে পারিয়াছেন, সুতীক্ষ্ণ ছুরিকাও দেখিয়াছেন। সে অস্ত্র তাহার বক্ষে বসিবে না, যাঁহার অস্ত্র, তাঁহারই বক্ষ, তাঁহারই শোণিত – কিন্তু বিনা আঘাতে, বিনা রক্তপাতে, তাঁহার হৃদয়ের রক্ত আজীবন শরীরের প্রতি লোমকূপ হইতে যে অদৃশ্যভাবে ঝরিতে থাকিবে, তাহাও তিনি বুঝিয়াছিলেন।’ (উদ্ধার পর্ব ২৯) আরো একটি উদ্ধৃতি : ‘বিবি জয়নাব! … শত সহস্র চক্ষু আমাকে দেখিতে ঔৎসুক্যের সহিত ব্যস্ত হইল, কেবল আপনার দুই চক্ষুই ঘৃণা প্রকাশ করিয়া আড়ালে অন্তর্দ্ধান হইল। সে দিনের সে অহঙ্কার কই? সে দোলায়মান কর্ণাভরণ কোথা? সে কেশ শোভা মুক্তার জালি কোথা? এ ভীষণ সময় কাহার জন্য? এ শোণিত প্রবাহ কাহার জন্য? কি দোষে এজিদ আপনার ঘৃণার্হ? কী কারণে আপনার চক্ষের বিষ? কি কারণে দামেস্কের পাটরাণী হইতে আপনার অনিচ্ছা?’ (উদ্ধার পর্ব ৩) উচ্ছ্বাসময়তার ভেতরে একটি কৃষ্টি এখানে গড়ে ওঠে। এ কৃষ্টি কেমন? দেশাল, দৈশিক, প্রাচ্যীয়, আসমুদ্রহিমাচলব্যাপী। মীরের বিষাদ-সিন্ধুর কেন্দ্রে এজিদ-জয়নবের ‘রূপজ’ প্রেম। প্লট ও পরিশিষ্টের মেসেজও তাই। কিন্তু সেইটিই উপন্যাসের (যদি উপন্যাস বলি!) গুরুত্ব নয়, গুরুত্ব কলোনাইজড

কৃষ্টির সন্ধিৎসা – একালের বিশেষত্বে। ‘মধ্যযুগীয় ধর্মচেতনার জীবনবিমুখ আচ্ছন্নতাকে অপসারিত করে ইহলোকের ইন্দ্রিয়পরবশ মানব-মানবীর হর্ষশোকের মহামূল্যকে তিনি যে কল্পলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, সেটাই তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয়।’ এই পরিচয়ের ভেতরে দেব-দানব, অলৌকিকত্ব কিংবা বিশ্বাসের আতিশয্যের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ‘মানুষ’। কেমন মানুষ? প্রাকৃত বা অন্ত্যজ বা আর্থনীতিক শর্তের গণ-মানুষ, সরল-সাধারণ মানুষ। ‘পুঁজি’ তার অনুসরণ-বিন্দু। কথক বলেন, ‘অর্থ! হায়রে পাতকী অর্থ!!’ কিংবা ‘অর্থই অনর্থের মূল’। মশাররফ মহাকাব্যের সময়ে মহাকাব্য রচনা করেননি, লিখেছেন গদ্য-মহাকাব্য ‘উপন্যাস’। গদ্য ফর্মের শিল্প। কেন? কেন-র ভেতরেই

আখ্যানের তাৎপর্য নিহিত। যে-পুঁজিবিকশিত সমাজে মীর জন্মেছেন – সেখানে কলোনিশাসনের একটি পর্যায় তিনি স্পর্শ করেছেন – প্রসঙ্গত, বিষাদ-সিন্ধু রচনার প্রায় শতবর্ষ পূর্বে লর্ড

কর্নওয়ালিসের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ (১৭৯৩) জারি হয়েছে। বণিকশ্রেণি তৈরি হয়েছে। কলকাতায় প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি

আইন-বিচারের আদালত বসেছে। ফারসির বদলে ইংরেজির গুরুত্ব বেড়েছে।  রাষ্ট্রীয়ভাবেই সে-গুরুত্ব তৈরি করে সর্বত্র সে-লক্ষ্যে কাজের মানুষ সৃষ্টি করছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কলোনি শাসকরূপে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ পাচ্ছেন। তিনি শিল্পীও। ‘কমলাকান্ত’ নামে তাঁর নিজের কথা বলতে হচ্ছে। মীর মশাররফের আখ্যান ওই কলোনি-প্রভাবিত – ফলে শিল্পী-মশাররফ আর ব্যক্তি-মশাররফের দ্বন্দ্ব তীব্র – যেমনটা মধুসূদন বা বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যেও ছিল। রামের পরিবর্তে রাবণ আর হোসেনের পরিবর্তে এজিদ – নায়কের আসনে অধিকৃত। সেখানে সে রক্তমাংসরূপী সাধারণ, ইন্দ্রিয়-কামুক বাসনা দুর্বিনীত ব্যক্তি। ক্ষমতা কিংবা তৎসৃষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি সামন্ত ধারণাপ্রসূত হলেও সে নীতিভ্রষ্ট, ‘পাপী’, ধর্মভ্রষ্ট, একপ্রকার ব্রাত্যও। উৎসব-প্রাণতায় ভরপুর সে। ফলে তার বিকাশ ভয়ংকর, প্রলয়বিনাশীও। মুনীর চৌধুরী বলেন : ‘রণক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনায় সে অকুতোভয়, রূপজ মোহে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার মতো সংবেদনশীল হৃদয়ের

অধিকারী। স্বপক্ষীয় কৃতী সৈনিককে পুরস্কার দানে সে মুক্তহস্ত, অসহায় বন্দীনিকে লাঞ্ছিত করতে সে কুণ্ঠিত। তার অত্যাচারের মধ্যে নৃশংসতা ও নির্মমতা থাকতে পারে কিন্তু ক্ষুদ্রতা ও নীচতা নেই।’ এ নিশ্চয়ই কোনো ধর্ম বা পুরাণাশ্রিত চরিত্র নয়। হৃদয়ই মুখ্য। সে মানবহৃদয়। এর আদলে বা গঠনে এদেশের মাটি-ঐতিহ্য,

পুঁজি-প্রভাবিত লক্ষণের ইহলৌকিক ধারাটি পুনর্গঠিত। এ দায়টি মীর-মানসে ছিল। প্রসঙ্গত, Ô…a moral synthesis in the opposite direction, or one that is very clearly distinct, is formed or rather devolps under the stress of
circumstances. It is by no means new; it carrieson a
tradition of some standing; that of classicism and
rational philosophy as we have them in the eighteenth century. But economic and social forces enter more than ever into cooperation with it.Õ – মীরের বিষাদ-সিন্ধু রচনার পরিপ্রেক্ষিত এমন অভিপ্রায়ে অবিবেচ্য মনে হয় না। সাহিত্যের ‘মেইন ইম্পালস’ কী? মীর মুসলিম কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের উপাদানকে যে অলৌকিক রোমান্সে আখ্যানে প্রবেশ করান তা কোনো ভেদ বা ধর্ম-বর্ণ আরোপে নয়। বরং তা রহস্যের নিগড়েই অনুরুদ্ধ। তাতে ক্লাসিক বা র‌্যাশনাল চিন্তার প্রবিষ্টতা থাকে। যেমন উদ্ধার পর্বের ২৫ প্রবাহে মারওয়ান বলে, ‘আমি তো তোমার মতো মূর্খ নহি যে কারণ, কার্য ও যুক্তি অবহেলা করিয়া কেবল ঈশ্বরের প্রতি চাহিয়া থাকিব’ কিংবা ‘ছেলে হলো মোসলেমের, মাথা কাটিবে জেয়াদ, তাহাতে তোমার চক্ষে জল আসিবে কেন?’ – এরকম স্বার্থান্বেষী চরিত্র বুর্জোয়া লক্ষণাক্রান্ত, যদিও বিষাদ-সিন্ধুতে ভালো-মন্দ ধরনের যে-চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাতে নীতিভ্রষ্ট আর নীতিযুক্তর বিপরীত দ্বন্দ্বে একদিকে ধর্মীয়, অন্যদিকে অধর্মপ্রবণ চরিত্রের সরল ভাগে সফল জনপ্রিয়      আখ্যানের মর্যাদা  অর্জন করে। এ-অর্জনে মানবিক বোধ ও অনুভূতির স্বরূপ বিচার্য – যা Ôco-operation with itÕ|।

আরো একটি বিষয়,  হোসেনের খণ্ডিত মস্তক নিয়ে আজরের অবস্থান সম্পর্কে লেখক বলেন : ‘দেব-দেবীর উপাসক হউন, এসলাম ধর্ম বিদ্বেষীই হউন, এ নিদারুণ দুঃখের কথা শুনিলে কে-না ব্যথিত হয়েন?’ আজর ধর্মে ব্রাহ্মণ কিন্তু সে মানবিক বোধে উত্তীর্ণ। রক্ত-মাংসের মানুষের অনুভূতি নিয়ে সে বলেছে : ‘মনুষ্য মাত্রই এক উপকরণে গঠিত এবং এক ঈশ্বরের সৃষ্টি।’ শিল্পী মশাররফ অনন্য উচ্চতা স্পর্শ করেন যখন কাসেম, সখিনা, মাসহাব কাক্কা, আক্কাস, সীমার, আবদুল্লাহ, আবদুল জব্বার, আবদুল ওহাব প্রভৃতি চরিত্র অঙ্কন করেন। নামগুলোও মুসলিম পুরাণাশ্রিত। কোনোটাই সামন্ত নয়। কিংবা আর্থিক ক্ষমতাপ্রবণও নয়। এবং লেখকের বিবরণে তার স্বভাষার প্রয়োগ আছে : ‘আবদুল জব্বারের প্রাণ এত কঠিন, ইহা ত আমি আগে জানিতাম না। কোন প্রাণে সোনার জয়নাবকে পথের ভিখারিণী করিয়া বিষাদ সমুদ্রে

ভাসাইয়া নিয়াছে।’ ‘সোনার’ জয়নাব, ‘পথের ভিখারিণী’ ‘হতভাগিনী’ – বিষাদ-সিন্ধুর মূল। কে সে? জয়নাব। এই জয়নাব-সৃজনে মীর কোনো ধর্মীয় উপাদানাশ্রিত

নীতিগুণবিশিষ্ট চরিত্রকে নয়, নীতিভ্রষ্ট এজিদকেই নায়ক করেছেন। এই এজিদ ভঙ্গুর সামন্তবাদের ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া সমকালের অবিকশিত পুঁজি-সংলগ্ন ব্যক্তি-চরিত্র। এ-চরিত্র শুধু ব্যক্তিক বিবেচনার নয়, সামষ্টিক সামাজিক বা রাষ্ট্রিক পরিপ্রেক্ষিতও বিবেচ্য। লেখকের বক্তব্যে তার উল্লেখ আছে। আর বিষাদ-সিন্ধুর

অলৌকিক আবেগ-অনুরাগ উদ্ধার পর্বের ২৫ প্রবাহে ‘মস্তিষ্ক-সিন্ধু’র আখ্যা পেলে যুক্তি ও বুদ্ধির উপাদান তাতে যোজিত হয়ে পড়ে। বিষাদ-সিন্ধুর স্বভাষিক পরিচর্যায় যে-ধারা অনুসরিত তা অবশ্যই পূর্ববর্তী লেখকগণের (মধুসূদন-বঙ্কিম) অনুবর্তী। ঐতিহ্যিক আয়াসে সীমারের পরিচয় এখানে আছে। ‘সীমারের ধবল বিশাল বক্ষে লোমের  চিহ্নমাত্র নাই,  মুখাকৃতি  দেখিলেই   নির্দয়   পাষাণ-হৃদয় বলিয়া বোধ হইত – দন্তরাজি দীর্ঘ ও বক্রভাবে জড়িত – প্রাচীন কবির এই মাত্র আভাস এবং আমারও এই মাত্র বলিবার অধিকার, নাম সীমার।’ ঠিক মনে পড়ছে, যোগাযোগ উপন্যাসে পুঁজি-আশ্রিত মধুসূদন চরিত্রের রবীন্দ্র-বিবরণ! মীর নির্দয় পাষাণ হৃদয়ের মধ্যে অর্থ, পাতকী-অর্থকেই দায়ী করেছেন। সেভাবেই সীমারের‘প্রত্ন’-নির্মাণ করেন। এটি ‘আর্কেটাইপ’। ‘সামষ্টিক অবচেতনে’ নিষ্ঠুর সত্তাধারাটি ‘সীমারে’র ভেতর দিয়েই তা জনস্রোতে প্রবাহিত, যা প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজি-বিকশিত এই করপোরেট সমাজে অধিকতর অধিকৃত। মীরের উপন্যাসের যুক্তিও সেখানেই।

মীর   শত্রু-মিত্র, পাপ-পুণ্য  অনুধ্যানে   মোটা    দাগের  আখ্যান বানিয়েছেন। কিন্তু সেখানে অনুরুদ্ধ শিল্পীসত্তা অনেককিছুর রেখাকে অতিক্রম করে যায়। যে রক্তাক্ত পটচিত্র মীর বয়ান করেছেন – তার পশ্চাৎভূমিতে ধর্মীয় ঐতিহ্য-উপাদান থাকলেও বস্তুত স্বীয় শিল্পী-আজ্ঞাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। স্ত্রী-পুত্র, পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, কন্যা-জামাতা সম্পর্ক প্রাচ্যীয় মূল্যবোধে হার্দিক হয়ে ওঠে। কিন্তু ক্রোধ, ঈর্ষা, মোহ ও ক্ষমতার মুখে যুদ্ধক্ষেত্রের রোমহর্ষক যে-বিবরণ শিল্পী মশাররফ অন্তর্বয়ন করেন তা জীবনের গূঢ়ত্ব ও মাহাত্ম্য ভাষিক বয়নে অপরূপত্ব অর্জন করে। যে আবদুল ওহাব স্ত্রীর মুখ-দর্শনের আশায় গৃহে ফিরে এসে বলেন : ‘ভাবিলাম তোমাকে দেখিলে বোধহয় কিছু শ্রান্তি দূর হইবে, পিপাসাও নিবারণ হইবে। এই মনে করিয়াই আসিয়াছি, কিন্তু অশ্ব হইতে নামিবার আদেশ নাই। মাতার আজ্ঞা, অশ্বপৃষ্ঠে বসিয়াই সাক্ষাৎ।’ উদ্ধার পর্বে আবদুল ওহাবের মৃত্যু হলে লেখক বলেন : ‘তোমার মস্তক কি হইল? তুমি কি সেই আবদুল ওহাব? যিনি চিরপ্রণয়িনী প্রিয়তমা ভার্যার মুখখানি একবার দেখিতে বৃদ্ধা মায়ের নিকট অনুনয় বিনয় করিয়াছিলেন, মাতৃআজ্ঞা পালনে অশ্বপৃষ্ঠে থাকিয়াই যিনি বীর রমণী বীরবালার বঙ্কিম আঁখির ভাব দেখিয়াও রণোত্তেজক কথা

শুনিয়া অসংখ্য বিধর্মীর প্রাণবিনাশ করিয়াছিলেন – তুমি কি সেই আবদুল ওহাব!’ এ বিবরণে সত্য-ধারণার জয় আছে। চিরন্তনত্ব আছে। জনপ্রিয়তাও কেন্দ্রও তাই। শতবর্ষ পরে বিষাদ-সিন্ধু পঠনের গুরুত্বও সেখানে। ওই চরিত্রের আধারে লোকজ উৎসারণ আর জীবন সম্ভাব্যতার স্বরূপ নির্ধারণ। ক্বাসীদা, ফারসি-কৃষ্টি, রোমান্সের অনুগমন – ‘মুক্তল হোসেন’, ‘শাহাদাত হোসনায়েন’ কিংবা পুঁথির বয়ান, সংস্কৃত নাটকের আখ্যা, পাশ্চাত্য রোমান্স সাহিত্য বা ট্র্যাজেডি প্রভৃতির উত্তরাধিকার একজন শিল্পী পাবেন কি-না তার চেয়ে মুখ্য সমকালিক সমাজ স্বভাবের নৈর্ব্যক্তিক অনুসরণ। শিল্পী হিসেবে নির্ধারিত ওই সমাজের বিশ্বস্ত রূপায়ণই গুরুত্বপূর্ণ। সেটি

ব্যক্তি-মীরকে ছাড়িয়ে যায়। ধর্ম-বর্ণ-পাপ-পুণ্য-শ্রেণিবিচার ছাড়িয়ে নির্মোঘ সত্যটি প্রতিশ্রুত হয়। বস্তুত, এ-লক্ষ্যে আখ্যানের মৌল উৎসটি খুঁজে নেওয়া – আর সে-লক্ষ্যে বিবরণে পৌঁছান, শিল্পী একপ্রকার অজান্তেই এ অবচেতন সত্তাটি পুনর্গঠন করেন। সেখানে স্ব-সম্প্রদায় বা ধর্মবোধ

তাঁকে ছাড়িয়ে যায়। যে-প্রস্তাবনাটি এখানে প্রথমে উল্লেখ হয়েছে – তা হলো, কলোনাইজারদের আধিপত্যশীল সমাজে ‘কলোনাইজড’ কৃষ্টির প্রতিষ্ঠা। সেটি নির্মাণে মীর যে-নামগুলো আখ্যানের উপলক্ষ করেছেন কিংবা ওইসকল নির্ধারিত নামের ভেতর দিয়ে যে দ্বান্দ্বিক

ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার স্বরূপ নির্ধারণ করেছেন – কার্যত ভঙ্গুর সামন্তব্যবস্থার ভেতরে পুঁজিশীল সমাজের বিকাশ ও

ক্রম-বিকাশোন্মুখ চরিত্র তৈরি ঔপন্যাসিকের দায়শীল অভিমুখ তৈরি করে। এ লক্ষ্যে সীমার, এজিদ, মারওয়ান, জায়েদা যেমন একটি পক্ষরূপে বিনির্মিত তেমনি ধর্মন্যায়ে হোসেন, কাসেম, ওহাব প্রমুখ দ্বৈরথে দৃশ্যমান হয়। নির্মিত আখ্যানে যে অলৌকিক রোমান্স, স্বপ্ন-কল্পনার যে-ন্যারেশন বিবৃত হয় তা কলোনাইজড সমাজের অনুরুদ্ধ কৌশল (টেকনিক)। সপত্নীবাদ,  রূপজ মোহ, সোনার   জয়নাবের প্রতি মোহাচ্ছন্নতা,

পতিপ্রেম, অর্থদম্ভ, ক্ষমতা কেন্দ্রে ‘পাপ’ (অনিয়মের) জৌলুস আর অলৌকিক বিশ্বাসের প্রতি অতিশয় সম্ভ্রম – সবটুকুই কলোনাইজড রীতি ও আচারধর্মিতা। বিষাদ-সিন্ধু সে-অর্থেই পাশ্চাত্য ফর্মে বা আনুষ্ঠানিকতায় বাঁধা নয়। কোনো তুল্যমূল্য আঙ্গিক-কাঠামোর ‘বিশেষ কুশল’ও নয়। এটি পূর্ণাঙ্গরূপে উপন্যাসের ‘সংকট’কে তুলে ধরে। এ-সংকটের দায়েই এর অনির্বচনীয় আঙ্গিক :

রক্তদর্শনে হোসেন চমকিয়া উঠিলেন। আজ ভয়শূন্য মানসে ভয়ের সঞ্চার হইল। সভয়ে চতুর্দ্দিকে চাহিয়া দেখিলেন,

আব্দুল্লাহ, জেয়াদ, অলীদ, ওমর, সীমার এবং আর কয়েকজন সেনা চতুর্দ্দিক ঘিরিয়া যাইতেছে। সকলের হস্তেই তীরধনু। ইহা দেখিয়াই চমকিত। যে সমুদয় বসনের মাহাত্ম্যে নির্ভয়হৃদয় ছিলেন – তৎসমুদয় পরিত্যাগ করিয়াছেন; তরবারি, তীর, নেজা, বল্লম, বর্ম্ম, খঞ্জর কিছুই সঙ্গে নাই, কেবল দুখানি হাত মাত্র। অন্যমনস্কভাবে দুই এক পদ করিয়া চলিলেন; শত্রুরাও পূর্ব্ববৎ ঘিরিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিল।

(মহরম পর্ব, ষড়বিংশ প্রবাহ)

এই পরিস্থিতি মানবধর্মকে আখ্যানলব্ধ করে। প্রভূতভাবে, ক্লাইমেক্সের ইঙ্গিত এবং বিজয়ী ও বিজিতপক্ষের মুখোমুখি

অবস্থানের ভেতরে পরাস্ত ন্যায়পক্ষের শিহরণ-ধরা সহানুভূতি রোমাঞ্চকর ও ভয়ার্ত পরিবেশ ডিমান্ড করে। পাশ্চাত্য আখ্যানে অ্যাডভেঞ্চারের স্বরূপ থেকে বেরিয়ে আসার সময় রোমান্টিক যুগে। সেখানে উপন্যাস-সৃজনের যুক্তিও তৈরি হয় ওই অকুস্তলে। তবে প্রাচ্য-বীক্ষণটি ঠিক সে-আস্থায় ধরা না দিলেও Ôeconomic and social forces enter more than ever into cooperation with it.Õ – বিষাদ-সিন্ধুতে পূর্ণাঙ্গ না হোক, সে সমাজ অঙ্গীকারের যুক্তিটুকু প্রশ্রয় পায়। একাকী শত্রুপরিবেষ্টিত হোসেন, সেখানে তাঁর অনুগামীগণ কেউ নেই, অঞ্জলি-পরিমাণ জল তুলে নিয়েও ফেলে দিলেন – কারণ, এ-জলের জন্য তাঁর আত্মীয়-পরিজন অনেকেই নিহত হয়েছেন – এ-আবেগ, অনুভবের  বিচ্ছুরিত  সীমানা,  প্রতিপক্ষের  নিষ্ঠুরতা – এই শ্রেণিবিভক্তি ও ধর্মাতিশয্যপ্রবণ ক্ষমতা অনেকটাই একসূত্রে গাঁথা। সেখানে মানবমহিমার দায়ই তো উপন্যাসের উপলভ্য যুক্তি। দীর্ঘায়ত এ-উপন্যাসে   নির্ধারিত বা কাক্সিক্ষত ব্যক্তির শুধু জয়-পরাজয়

দেখানোই উদ্দেশ্য নয় – সেটি একমাত্র উদ্দেশ্য হলে শতবর্ষ পরও এর জনপ্রিয়তার রেখাচিত্র এমন হতো না – বস্তুত, বিচ্ছেদ-বেদনা, ক্রান্তিলগ্ন অতিক্রমণের সাহস ও শক্তি, ভয়কে জয় করার ঈপ্সিত লক্ষ্য, অকুতোভয় মানবচরিত্র, জীবনের অনুল্লেখ্য সম্ভাব্যতা নির্মাণই ঔপন্যাসিকের কাজ। সেক্ষেত্রে মীর অসম বা অবিশ্বস্ত কিছু করেননি। বেছে নিয়েছেন, লোকায়ত গণমানুষের চিরায়ত জান্তব ক্ষেত্র। সেখানে দ্বন্দ্ব আছে, ব্যক্তি ও শিল্পীর দ্বন্দ্ব, ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব – কিন্তু মানুষের স্বভাব-স্বাতন্ত্র্যটুকু শিল্পিত করাই মুখ্য কাজ। সেজন্যই ‘ন্যারেশন অ্যাজ ডিসকোর্স’ – চিনে নিতে পারা যায় বক্ষ্যমাণ – মাটি ও মানুষের সংবাদ। সংস্কৃতির বিবর্তিত কাঠামোর অপরূপত্ব। বাঙালি মুসলমানের জীবনধর্মই এই বিষাদ-সিন্ধু। তাদের কাক্সিক্ষত ন্যায়, ন্যায়শীল-নিষ্পাপ নূরনবী দৌহিত্র হাসান-হোসেন।  মিথপ্রবণ এ বিশ্বাস জনগোষ্ঠীর অজস্র  দ্বন্দ্বের ভেতর  দিয়ে

প্রতীয়মান। অশিক্ষিত নিরক্ষর জনতার কাঞ্চন-কল্পনায় মূর্তমান হাজার বছরের কৃষ্টির দান রক্তাক্ত কারবালা উপাখ্যান। মীরের পূর্বসূরি মধুসূদন ও বঙ্কিমও স্বীয় আখ্যানে এমন সাদৃশ্য রেখেছেন। পাশ্চাত্য প্রভাবিত হয়েই তা করেছেন। কিন্তু মীর (পাশ্চাত্য শিক্ষায় ‘শিক্ষিত’ ছিলেন না?) আসঞ্জন-উল্লাসে পূর্বোক্ত দুই শিল্পীর ধারা অনুগত রেখেই প্রকৃত কলোনাইজড-কৃষ্টি গড়ে তোলেন। সে জন্য বহুকালাশ্রিত আর্কেটাইপকে সামষ্টিক অবচেতনে ধারণ করেন। চিরপরিচিত মানবাভিজ্ঞতাকে মুকুরম-িত করে ম-নকলায় শোভিত করেন। রাশিরাশি অশ্রুরাশির আপ্লুত ধারাটি আখ্যানে উপলভ্য করেন। ‘রূপজ মোহ’ কিংবা ধর্মীয় চরিত্রের ভেতরে রক্তমাংসের মানবগুণ

আরোপের কাহিনি মীরের আগেও আছে।

কিন্তু মহাকাব্যিক যে-পরিক্রমায় বিস্তর প্রজন্মধারার যে-স্বরূপ দুর্মর কল্পনারাশিতে আলেখ্য করলেন তিনি তা স্বভাষিক এবং স্বীয় পরিচিত সংস্কৃতির স্বরূপেই সকলের নিকট সমন্বিত হলো। এ সমন্বয়টুকু প্রত্যক্ষভাবে ভূমি-সমাজ ছাড়া হওয়ার প্রশ্ন যেমন ওঠে না, তেমনি পরোক্ষভাবে মানবসৃষ্ট প্রান্তগুলো অস্বীকারের ব্যাপারও তৈরি করে না। এই প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সময়-ধারাবাহিকতায় পরিপুষ্ট। কারো অনুকরণ বা ম্যানারিজমের গ্যাঁড়াকলে তৈরি নয়। রামায়ণ, মহাভারত, গুলে বকাওলি, বেতালপঞ্চবিংশতির উর্বর ভূমিতে মীরের যে-কাহিনি উপন্যাসের দায়ে জনলব্ধ হয় – তা আসলে নিজস্ব স্পর্শকাতরতায় মানব-সংস্কৃতির অপরিমেয় দান। সে জন্য এর ন্যারেশনে বলা যায় :

ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের সমস্ত বিভাগের ধ্বংস এবং ঔপনিবেশিক পদ্ধতির অন্তর্গত দ্বন্দ্ব ভূমিপুত্রের সংগ্রামশীলতাকে গড়ে তোলে; তাকে জোরদার করে; সেই সঙ্গে জাতীয় চেতনাকে ঊর্ধ্বে ধরে তাকে সমর্থন জোগায়। নতুনপ্রাপ্ত এসব উত্তেজনা উপনিবেশবাদের আসল চরিত্রের সকল পর্যায়েই বিদ্যমান; সমস্ত সংস্কৃতির স্তরেই রয়েছে তার প্রতিক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ সাহিত্যে রয়েছে তুলনামূলক উপরি-উৎপাদন। ক্ষুদ্র পরিসরে আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জবাব দেয় থেকে শুরু করে ভূমিপুত্র-বিরচিত সাহিত্য বিভিন্ন শাখায় বিস্তৃত। নিপীড়নের আমলে যে-বিদ্বৎসমাজ ছিল মূলত পাঠক, তারাও লেখক হয়ে ওঠে। এই সাহিত্য

প্রথমত বিয়োগান্তক এবং কাব্যিক স্টাইলে সীমিত থাকে; কিন্তু পরবর্তীকালে উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ লেখারও উদ্যোগ নেয়া হয়। যেন বা আগে থেকেই এমন একটা অন্তর্লীন সংগঠন বা প্রকাশভঙ্গীর অস্তিত্ব ছিল – যার নিয়ম হলো এই যে, মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্য এবং পদ্ধতি যতই স্পষ্টতর হবে, কাব্যিক অভিব্যক্তিও তুলনামূলকভাবে ততই কমে আসবে। বিষয়বস্তু পুরোপুরি বদলে যায়।

(জগতের লাঞ্ছিত, পৃ ১৭৩)

এই বদলই বিষাদ-সিন্ধুর অন্তর্লীন গতি। প্রসঙ্গত বলি : ‘ঃযব

Ôthe
eye-witness in narrative can be telling on ostensibly actual tale or a plainly made-up one. He can be protagonist or observer or both. He can be inwardly directed autobiographer or the outwardly directed memoirist or both… We must consider all these possibilities and more, not so as to devise new pigeonholes for narrative works, but so as to preserve our own flexibility of response to one of the most flexible aspects of the narrative art.Õএভাবে বিষাদ-সিন্ধুর স্বভাষিক ও স্বদৈশিক পরিচর্যাটি অনুধাবন করা অসম্ভব হয় না। বোধ করি, একালের আয়নায় উপন্যাসের যে-যুক্তি বা আখ্যান-অভিসন্ধি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তার ঐতিহ্যসূত্র নির্ণয়ে বিষাদ-সিন্ধু একটি তরঙ্গমাত্র – বিশেষ করে বাস্তববাদী পদ্ধতি ধারার যোগাত্মক প্রয়োগ-প্রবণতায়। এ লক্ষ্যে মীর মশাররফ হোসেনের গদ্য মহাকাব্যটি চলতি করপোরেট সমাজের বিপর্যয় ও যুদ্ধে উপন্যাসের সংকট ও দায়কে নতুন করে প্রশ্ন-জিজ্ঞাসার মুখোমুখি করবে। উপনিবেশায়ন এখনো শেষ হয়নি। উত্তর-উপনিবেশ চিন্তাধারার ভেতরেও তা এখন কলোনাইজড ও কলোনাইজারদের দ্বৈরথে যুক্ত। উনিশ শতকের উপনিবেশিত সমাজে উপন্যাস যে দায়ে অধিকৃত ছিল এখনো তা অনিঃশেষরূপে বর্তমান। বরং সমস্যার প্রকোপ আরো বেড়েছে। সেখানে মীরের বিষাদ-সিন্ধু চলতি কালধারায় অতি-কঠিন অব্যর্থ জীবনের প্রশ্নকে আরো অধিক পুনরুজ্জীবিত করবে, তাতে সন্দেহ কী!