বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ও কাব্যচিন্তার মৌল সদৃশতা

বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে বাঙালি পাঠকের একটা বেশ বড়ো অংশের রয়েছে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সমীহ। সেই অর্থে তাঁকে নিয়ে এখনো পর্যন্ত নেতিবাচক সমালোচনা খুব বেশি নেই। এর একটা কারণ হচ্ছে, বুদ্ধদেবের সাহিত্যচিন্তার মধ্যে রাজনীতির অংশটা তুলনামূলকভাবে কম; কখনো-কখনো নেই বলেই মনে হয়। ভাববাদী সমালোচনাকে তিনি একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন, সেটিকে একটি স্বীকৃত আকৃতি দিয়েছিলেন। এছাড়া গতিশীল প্রাণবান জীবনের বহমান সৃষ্টিশীলতার যে-কথাটি নানাভাবে বলা হয়, তার অনবদ্য একটি নমুনা আমরা বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে দেখতে পাই।

দুই

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী, প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে খানিকটা জড়িয়ে গিয়েছিলেন। এ-সম্পর্কে অনেক পরে বুদ্ধদেব স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘সুখের হয়নি আমার পক্ষে, যুদ্ধকালীন কলকাতার সেই যোড়বহুল রাজনীতি … কোনো তৎকালিক বিষয়ে … আমার একফোঁটা উৎসাহ নেই। আমি পাই না সেই বাতাসের ছোঁওয়া যাতে অস্পষ্ট রেণু উড়ে বেড়ায়, সেই অর্ধালোক যেখানে কল্পনা খেলা করতে পারে।’ আর তারপরই বুদ্ধদেব তাঁর সেই জৈবনিক পর্বের ইতি টেনে নিজের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করেছেন এইভাবে – ‘অনেক বিক্ষেপ ও বিশৃঙ্খলা ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে, উদ্যমের অনেক অপব্যয় ও আবেগের অনেক ব্যর্থতা পেরিয়ে ধীরে ধীরে আমার অনুভূতি হলো যে সব গতি ও প্রগতি ও পতন ও বিতর্কের পরে অবশেষে কোনো-এক গভীর রাত্রে নিজের মধ্যে নিবিষ্টতা ভালো।’ বলা যায়, এই নিবিষ্টতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে বুদ্ধদেব বসুর যাবতীয় সাহিত্যকর্মের প্রার্থিত ও প্রাণময় চেতনা। তাঁর মৌলিক সৃষ্টিপ্রতিভার সমস্ত উৎসমুখ সেখান থেকেই উৎসারিত হয়েছে, হয়েছে বিকশিত আর উৎসিক্ত। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পদাতিক কাব্যের আলোচনার উপসংহারেও তিনি বলেছিলেন, ‘দুদিক বজায় রাখা চলবে না। … হয় তাঁকে [সুভাষ মুখোপাধ্যায়] কর্মী হতে হবে নয়তো কবি।’

তিন

এসবের মানে এইটি নয় যে, বুদ্ধদেব বসু নির্বিকারভাবে তাঁর সাহিত্যচিন্তাকে গ্রহণ করেছিলেন, যার মধ্যে শুধু কল্পনার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। বিষয়টি ঠিক তেমন নয়। আত্মজিজ্ঞাসাকে তিনি বরাবরই গুরুত্ব দিয়েছেন আর তাঁর সাহিত্যচিন্তার মধ্যে আমরা সেই আত্মজিজ্ঞাসারই একটি সদর্থক ও সকর্মক অভিযান দেখতে পাই। আর সেসবের সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছিলেন সাহিত্যচিন্তার দ্ব্যর্থময় দ্যুতি, যাকে কখনো-কখনো একজন সাহিত্যিকের, একজন সৃষ্টিশীল মানুষের চৈতন্যের জাগরণ হিসেবে অভিহিত করতে চেয়েছেন। আর তিনি দৃঢ়ভাবে এই বিশ্বাসে স্থিত হয়েছিলেন যে, ‘চৈতন্য মানেই আধ্যাত্মিকতা’। এসবের সঙ্গে ধর্মের কোনো সরাসরি সংযোগ নেই, যদিও কখনো-কখনো নিজেকে তিনি সরাসরি ‘হিন্দু’ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বরিস পাস্তেরনাক যেমন স্বীকার করেছিলেন, ‘খ্রিষ্ট এসেছিলেন আমার কাছে, তাঁকে না পেলে এই যুগের যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারতাম না।’ তাঁর কবিতার মধ্যেও আমরা সেই স্বীকারোক্তির কাব্যিক নমুনা দেখতে পাই –

ক্ষান্ত কলরোল। আমি বেরিয়ে আসি রঙ্গমঞ্চে।

দরজার খুঁটিতে হেলান দিয়ে

দূর প্রতিধ্বনি থেকে আন্দাজ করে নিতে চাই

আমার আয়ুষ্কালের আসন্ন ঘটনাগুলিকে।

হাজার দূরবীনের দৃষ্টি ধারে-ধারে

আমাকে তাক করে আছে রাতের অন্ধকার।

আব্বা, পিতা, যদি সম্ভব হয়

আমার এই পাত্র হোক হস্তান্তরিত।

(অনুবাদ : বুদ্ধদেব বসু)

অন্যদিকে, বুদ্ধদেব বসুর ভাষ্য হচ্ছে এ-রকম : ‘আমরা হিন্দু, আমাদের পক্ষে নিজেদের বা অন্যদের কোনো ধর্মই আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।’ কেন সম্ভব নয়? – সেটি আরো বিশদে গিয়ে বুদ্ধদেব বলেছেন, ‘পৌত্তলিক আমরা, আমাদের কাছে সবই রূপ হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে রূপক বা প্রতীক; আমরা জানি যে ধ্যান ভিন্ন মুক্তির পথ নেই।’ আর সেইসঙ্গে তিনি সেই ধ্যানের গুণ ও ক্রিয়া সম্পর্কে নিজের উপলব্ধিকে প্রকাশ করেছিলেন এইভাবে : ‘ধ্যানের লক্ষ্য যা-ই হোক, তাতে এসে যায় না; হোক না তা নারী, বা কবিতা, বা দেবতা।’ হাঙ্গেরির নোবেলজয়ী লেখক ইমরে কার্তেজ (Imre Kertesz : 1929 – 2016) তাঁর নিজের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে বলতে গিয়ে একবার জানিয়েছিলেন, ‘My Jewsishness is shaped by the Holocaust. I do not speak Hebrew, I did not have a religious education… I am not familiar with Jews philosophy’ আর এসব বলতে গিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত নিজেকে একজন ‘non-Jewish Jew‘ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। বুদ্ধদেবের উপলব্ধির সঙ্গে এই যে অন্য দেশের লেখকদের ভাবনার সামীপ্য, সেটি তাঁর সাহিত্যচিন্তার সামূহিক সিদ্ধান্তকেই যেন এক ধরনের পূর্ণতা প্রদান করে থাকে। কেননা, এই সাহিত্যচিন্তার মধ্যে দিয়ে একজন লেখকের বহুমুখী প্রতিভার যে-দায়িত্বের ভার, সেটি প্রকাশিত হতে থাকে। বুদ্ধদেব বসুর বেলাতেও সেটি ঘটতে দেখা গিয়েছে। আত্মজিজ্ঞাসার উপান্তে পৌঁছে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন –

কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর।

লেখা, পড়া, প্রুফ পড়া, চিঠি লেখা, কথোপকথন,

যা-কিছু ভুলিয়ে রাখে, আপাতত, প্রত্যেহের ভার।

দুরূহ, নূতনতর, ক্ষমাহীন দায়িত্বের ভার।

কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নেই আর।

(‘দায়িত্বের ভার’)

একজন লেখকের দায়িত্বের সেই ভার বিষয়ে সচেতন ছিলেন বলেই, সাহসে ভর দিয়ে, লিখতে পেরেছিলেন – ‘শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত। গভীর সন্ধ্যায়/ নরম আচ্ছন্ন আলো; হলদে-মøান বইয়ের পাতার/ লুকোনো নক্ষত্র ঘিরে আকাশের মতো অন্ধকার।’ বলা যায়, ব্যক্তিগত পবিত্রতায় নিজেকে সমর্পিত করতে পেরেছিলেন বলেই বুদ্ধদেবের সাহিত্যচিন্তার মধ্যে দায়িত্বের ভারের পাশাপাশি একজন সাহিত্যিকের আত্মমর্যাদার বোধটুকুও প্রকাশিত হতে থাকে।

চার

সাহিত্যের সর্বমুখিতায় আস্থাবান ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। সেইসঙ্গে আরো বেশি বোধহয় হয় আস্থা রাখতেন কবিতার সমগ্রতায়। এর ফলে তাঁর মনে মুক্তচিন্তার একটা কাঠামো, একটা ভিন্ন আদল গড়ে উঠেছিল। এ-প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ‘বুদ্ধদেবের মনের বিশেষ একটা মুক্তির চরিত্র, যেখানে অনুরাগ কখনো অন্ধ-অনুরাগে পৌঁছয় না, যেখানে পরম স্তুতির পাশেই অনিবার্য আপত্তির কথাও তিনি তুলতে পারেন সহজেই, স্বচ্ছভাবেই জানাতে পারেন তাঁর ভিন্নরুচির কথা। লেখক-সমালোচক-পাঠকের এই ভিন্নরুচির অধিকারকে তিনি খুবই আন্তরিকতার মধ্যে দিয়ে স্বীকার করে নিতে পেরেছিলেন। তাঁর সাহিত্যচিন্তার মধ্যে, তাঁর সমালোচক-সত্তার মধ্যেও আমরা সেই ভিন্ন রুচিকে নানাভাবে অবলোকন করি। সে-কারণেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠিক সেই জাতের লেখক, সমগ্রভাবে না-দেখলে যাঁকে চেনাই যাবে না। তিনি যে মহাকবি, বিশ্বের মহত্তমদের অন্যতম, এ নিয়ে বাংলাদেশে আজকের দিনে আর তর্ক নেই।’ আর এর পরপরই তিনি সোজাসুজি দ্বিধাহীনভাবে জানিয়েছেন, ‘যেখানে তিনি পাঠকের পক্ষে বিপত্তিস্থল এবং সমালোচকের পক্ষে হতাশাস্বরূপ – সেটি এই যে তাঁর মহত্ত্ব তাঁর সমগ্রতায়।’ এর কারণ জানাতে গিয়ে বুদ্ধদেব তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘বিচ্ছিন্ন পঙ্ক্তিতে তাঁকে পাওয়া যাবে না, কোনো-একটি কবিতায় কিংবা সম্পূর্ণ একটি গ্রন্থেও তাঁর পরিচয় বিধৃত হয়ে নেই। যে-কোনো অংশের চাইতে তাঁর সমগ্র রচনাটি বড়ো, যে-কোনো একটি গ্রন্থের তুলনায় অনেক বড়ো তাঁর সমগ্র রচনাবলি – শুধু আয়তনে নয়, অর্থবহতায়।’ সাহিত্যের শিল্পমূল্যের পাশাপাশি তার সেই অর্থবহতাকে বুদ্ধদেব বসু আমৃত্যু মান্যতা দিয়ে গিয়েছিলেন। কেননা, এই রচনার এই অর্থবহতার মধ্যে তিনি একদিকে যেমন একজন লেখকের ধৈর্যকে আবিষ্কার করতে পারতেন, ঠিকই তেমনই রচনার রীতিকেও যেন সদর্থে দেখতে পেতেন। বুদ্ধদেবের একসময়ের স্বজন প্রদীপ ঘোষ, সে-কারণেই বোধকরি, সংগতভাবেই বলতে পেরেছিলেন, ‘বুদ্ধদেব বসুর কথা যখন মনে পড়ে, তখন অনেক কথাই মনে পড়ে, বিশেষ করে শেষের দিকে একটি কথা : ‘ধৈর্য, ধৈর্যই সব, অথবা বাধ্যতা।’ যে-কারণে বুদ্ধদেবকে কোনো একটি সাধারণ বিশেষণে আখ্যায়িত করাটা বেশ কঠিনই বটে, অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। ‘আমার মিনার’ কবিতায় নিজের সম্পর্কে তিনি দ্বিধাহীনভাবে বলেছিলেন –

কেউ-কেউ বলে, আমার মিনার গজদন্তে তৈরি। ভুল

বলে।

      আমার মিনার বেহালার বস্তিতে খোলার ঘর,

সান ফ্রানসিস্কোর চল্লিশ-তলা হোটেল, আটলান্টিকের

গরীয়ান জাহাজ, বা কলকাতার বর্ষায় স্যাঁৎসেঁতে

একটি বাথরুম – যার টবের জলে কাপড়-কাচা সর

ভেসে থাকে, আর ফাটা দেয়ালে ঘুরে বেড়ায়

আরশোলা।

এসব পঙ্ক্তির পরেই তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন : ‘আসলে আমার মিনার এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই;/ তা চলমান, সপ্রাণ, বহুরূপী।’ বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে এর  চেয়ে বড়ো সত্যি কথা আর কিছুই হয় না, হতে পারে না।

পাঁচ

সুধীন্দ্রনাথ দত্তর মতো প্রাজ্ঞ কবি-সমালোচক বলেছিলেন, ‘বুদ্ধদেব বসুর মতো সাবলীল লেখক এ-দেশে বেশী জন্মায়নি; এবং নির্বিকার স্বাচ্ছন্দ্যের আড়ালে তাঁর নিরন্তর পরিণতি আপাতত চোখে পড়ে না। আসলে তাঁর বর্তমান বস্তুনিষ্ঠা সজ্ঞান সাধনার ফল।’ বুদ্ধদেবের আত্মজিজ্ঞাসা এবং সাহিত্যচিন্তার এটি হচ্ছে এক যুগ্ম পরিণতি, যেদিকে সুধীন্দ্রনাথ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আর সুধীন্দ্রনাথ আরো খানিকটা অগ্রসর হয়ে বলতে সমর্থ হয়েছিলেন : ‘তাঁর [বুদ্ধদেব বসু] মনীষাও অসাধারণ; এবং তিনি সহজাত প্রতিভায় সন্তুষ্ট নন, চৈতন্যের ব্যাপ্তি কামনায় নানা বিদ্যা আয়ত্ত করেছেন।’ এতে যেটা বুদ্ধদেব বসু ও সাহিত্যের পাঠকের পক্ষে লাভজনক হয়েছে, সেটি হচ্ছে – সুধীন্দ্রনাথের ভাষায় – ‘তাঁর লেখা স্বানুরক্তির প্রচারপত্র নয়, সমাজের যে-স্তর শিক্ষিত বাঙালীর অবলম্ব, তারই পুঙ্খানুপুঙ্খ মানচিত্র; এবং বুদ্ধদেবের উচ্ছ্রিতি সেখানে বদ্ধমূল বলে, তার পরিচয়ে আমরা তাঁকেই পাই।’ এখানে বলার কথা এই যে, সেই পরিচয়টিও ভিন্ন-ভিন্ন চেহারা নিয়ে প্রকাশিত –

আমাকে দিয়ো না দৃষ্টি। বিচ্ছেদে ভরে আছে মন।

যত গাঁথি মালা, তত সরে যায় দূর আর কাছে।

বহুদিন-প্রতিশ্রুত আজ আর কালের চুম্বন

অবশেষে ঠেকে যায় স্বচ্ছ এক ক্ষমাহীন কাচে।

জানি আমি, স্বর্গের অপ্সরী

তুমি, শাপভ্রষ্ট। কিন্তু সেই শাপের মোচনে

আমার আসেনি ডাক। এখনো যথেষ্ট নই কবি।

(‘কোনো এক কুকুরের প্রতি’)

বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ‘একাধারে আত্মোপলব্ধিতে সার্থক ও ভূমানন্দে ভাস্বর’ বলেই কেতকী কুশারী ডাইসন এইভাবে তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যিক ক্রিয়াকলাপের গঙ্গোত্রী তাঁর কবিসত্তা। কৈশোর থেকে জীবনের শেষ পর্ব অবধি তিনি যা-কিছু করেছেন তাঁর দর্পণে তাঁর সেই মৌল সত্তাটিকে চেনা যায়।’ সেই মৌল সত্তার মধ্যে বুদ্ধদেবের কাব্যচিন্তা ও কবিতা পাশাপাশি জড়িয়ে আছে, ছড়িয়ে আছে।

এখানে আরেকটি কথা রয়েছে বলবার, সেটি এই যে, তিনি তত্ত্বের ভার সাহিত্যের ওপর কখনো চাপিয়ে দেননি। তাঁর কাছে সাহিত্যের তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই, কিন্তু সেটি কখনোই সাহিত্যের অধিগম্যতাকে ছাড়িয়ে যায়নি। সাহিত্যের শক্তির ওপর সবসময়ই ভরসা রাখতে চেয়েছেন, তত্ত্ব দিয়ে তাকে অযথা জটিল করেননি, তাকে দুরধিগম্য করে তোলেননি। তিনি এ-ও বিশ্বাস করতেন যে, ‘জীবনকে দেখতে শেখাই লেখকের প্রধান দায়িত্ব।’ যে-ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি এই কথাটি বলেছিলেন, তার সূত্র ধরিয়ে দিতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘সমস্ত জীবনই লেখকের কাঁচামাল; কিন্তু জীবন বিশৃঙ্খল ও স্বেচ্ছাচারী, সেই উত্তাল আবর্ত থেকে কোন সময়ে কতটুকু তিনি নেবেন, এবং কীভাবে সেটা ব্যবহার করবেন, তার জন্যে নিজের রুচি ও বিচারবুদ্ধি … স্বোপার্জিত শিক্ষার উপরেই তাঁকে নির্ভর করতে হবে।’ বুদ্ধদেব তাঁর এই চিন্তাকে, এই উপলব্ধিকে শুধু ভাবনার জায়গাতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, তাঁর কবিতার মধ্যেও সেটি নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ কবিতায় তিনি বলেছেন – ‘ভাঙলো ঘুম, লাল আগুন/ ধৈর্যহীন শিরায়/ উল্লসিত হুল্লোড়ের/ আনলো কড়া নাড়া। আকাশে তারই স্বৈরাচার;/ কখনো নীল মেঘের ভার,/ আলোর বাঘ কখনো ছায়া -/হরিণে করে তাড়া;/ আশার দাঁত চিবিয়ে ছেঁড়ে/ দ্রৌপদীর শাড়ি।’ এই যে কবিতায় ভাব-অনুভাব প্রকাশের সত্যিটাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারার সামর্থ্য, একে বুদ্ধদেব বসু সবসময়ই স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি মনে করতেন যে, ‘কবি যতই স্মৃতি খুঁড়ে-খুঁড়ে তথ্য টেনে আনুন, যতই কেরামতি খাটান সমালোচকেরা, কবিতার জন্মকথা সম্পূর্ণরূপে অনাবৃত হয় না কখনো, তার একটা অংশ চিরকাল গোপন থেকে যায় – আর সেই অংশটাই আসল।’ বুদ্ধদেব বসু সেই ‘আসলটাকে’ নিয়ে চিরদিনই অহংকার করেছেন, যাকে আমরা বলতে পারি, একজন আত্মসচেতন কবির অহংকার, তাঁর নিজস্ব গর্ব। সমালোচকের কেরামতির এই ব্যর্থতাকে অনেকটা একই ধরনে কিন্তু খানিকটা ভিন্নভাবে কবি-সমালোচক অডেন (ড. W. H. Auden : 1907–73) বিবৃত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘The interests of a writer and the interests of his readers are never the same and if, on occasion, they happen to coincide, this is a lucky accident.’ বুদ্ধদেব যাকে বলেছেন কবিতার ‘আসল অংশ’, সেটিই অডেনের কাছে মনে হয়েছে ‘lucky accident’।

ছয়

এই ভাবনাটা খুবই ভুল হবে, যদি কেউ ভেবে থাকেন যে, বুদ্ধদেব বসু সমালোচক ও তাঁর সমালোচনাকে তাচ্ছিল্য করেছেন। বাস্তবে মোটেও সেটি সত্যি নয়। বরং তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ‘সমালোচনার একটি সুদৃঢ় উজ্জ্বল আদর্শ পরিণত সাহিত্যের একটি প্রধান লক্ষণ।’ বাংলা সাহিত্যে সেই উজ্জ্বল আদর্শের নিদারুণ দারিদ্র্য বুদ্ধদেবকে সবসময়ই আহত, আশাহত করেছে। কেননা, সাহিত্য-সমালোচনা যদি সাবালকত্ব অর্জন করতে না-পারে, তবে সেটি ‘সাহিত্যের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের পক্ষে … একটা অন্তরায়’, বুদ্ধদেব বসু তা বিশ্বাস করতেন। সমালোচনার তাত্ত্বিক কাঠামোর কথা মনে রেখেই তিনি বলেছিলেন, ‘যাকে আমরা মতামত বলি সে-জিনিসটা অত্যন্ত অস্থির। তার উপর নির্ভর করতে ভয় হয়।’ তাহলে এর প্রতিকার কী? এর প্রতিকার হচ্ছে, সমালোচনাকেই সাহিত্য করে তুলতে পারা। বুদ্ধদেব বসু মনে করতেন, ‘সমালোচনাকেই সাহিত্য করে তুলতে পারলে মস্ত একটা সুবিধা এই যে পরবর্তী যুগে মতামতগুলো সর্বাংশে গ্রাহ্য যদি না-ও হয়, সাহিত্যরসের প্রলোভনেই পাঠক সেখানে আকর্ষিত হবে, তার মধ্যে সত্য প্রচ্ছন্ন থেকে মনকে নাড়া দেবে সুন্দর, তাই কোনোকালেই তা ব্যর্থ হবে না।’ এর উদাহরণ আমরা বুদ্ধদেবের নিজের সমালোচনাকর্মের মধ্যেও দেখতে পাই। অমিয় চক্রবর্তীর খসড়া কাব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘বিস্ময়কর বই : খুলে পড়তে বসলে পাতায়-পাতায় মন চমকে ওঠে; বাংলা কবিতার পাঠকের কানের ও মনের যতগুলো অভ্যেস আছে, তার একটাও প্রশ্রয় পায় না, বরং প্রহৃত হয়। কিছুরই সঙ্গে এ-কাব্য মেলে না; সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বা বিষ্ণু দে-র মতো ‘দুরূহ’ কবির পাঠ্যাভাসও বিশেষ কাজে লাগে না এখানে।’ তারপর তিনি বলছেন, ‘বিস্মিত মন সানন্দে স্বীকার করে যে এখানে প্রকৃত কবিত্বশক্তির সাক্ষাৎ পেলুম।’ এভাবে লিখতে পারাটা একমাত্র বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রেই সম্ভব ছিল। তার কারণ হচ্ছে, তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘সাহিত্যের একটা পটভূমিকায় আলোচ্যকে আলোকিত করে এবং নিজের উৎসুক চিত্তকে প্রকাশ করে, পাঠকের উদাসীন মনকে জাগ্রত করেন সমালোচক।’ আর সেই সূত্র ধরেই তাঁর মনে হয়েছে, ‘এ-কাজে উত্তাপ চাই, উৎসাহ চাই, নিন্দার ঠাণ্ডা সংকীর্ণতা দিয়ে তা সাধিত হতে পারে না।’ এ-বিশ্বাস একজন সমালোচকের জন্যে খুবই জরুরি।

সাত

সাহিত্যের প্রতি, নিজের লেখালেখির প্রতি বুদ্ধদেব বসুর ভালোবাসা ছিল অনেকটা কিংবদন্তির মতো। কোনো অবস্থাতেই তিনি লেখার কলমকে ত্যাগ করেননি। তিনি এটিও বিশ্বাস করতেন যে, ‘যদি কখনো মনে হয় যে কবিতার উৎস আছে শুকিয়ে, তার জন্যে ঘটনার ঘনঘটাকে কেন দায়ী করবো – তার কারণ খুঁজতে হবে নিজেরই মধ্যে।’ পাশাপাশি এটিও তিনি আমৃত্যু মনে রেখেছিলেন ‘যে-কোনো সময়ে, কবিকে জয়ী হতে হবে মানুষের উপর, নয়তো কবিতা সম্ভব হবে না।’ কবিকে তিনি মনে করতেন, ‘মরমী, ভাবুক, ঈশ্বরের জন্যে সতৃষ্ণ।’ আজকের দিনের কবি হলেন ‘জটিল চঞ্চল বিক্ষুব্ধ জগতের কেন্দ্রবাসী এক নিঃসঙ্গ মানুষ।’ কবি অ্যাডোনিস (Adonis : 1930) নিজের লেখালেখির বিষয়ে বলতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘When I don’t write, I feel as if I don’t exist. Through writing I find out who I am, I learn to discover and disclose myself.’

বুদ্ধদেবের ভাবনাও অ্যাডোনিসের এই ভাবনার চেয়ে আলাদা কিছু ছিল না। সেজন্যেই তিনি একান্তভাবে লেখালেখির মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করতে পেরেছিলেন। এটি শুধু তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল না, সেইসঙ্গে এর মধ্যে দিয়ে তিনি ব্যক্তিগত মোক্ষের সন্ধানও করে গিয়েছিলেন।

আট

নিজের সাহিত্যরুচির কথা অকপটে পাঠকদের জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মানতে বাধ্য, সাহিত্যে আমার রুচি অত্যন্ত বেশি সূক্ষ্ম নয়। আমি রক্ত-মাংস রস চাই, চাই স্পর্শ, ঘ্রাণ, বাস্তবের তথ্য … কবিতায় চাই চিত্রকল্প, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা, সান্দ্রতা, সেই আর্দ্র ও ঈষৎ-অন্ধকার বাতাস, যা প্রাণের জীবাণুর পক্ষে অনুকূল।’ বুদ্ধদেবের কবিতা ও তাঁর কাব্যভাবনা, যা কি না একাধারে ‘অনাবৃত, অকুণ্ঠিত, নির্জর, নিস্পৃহ’, সেই অনুকূল পরিবেশেই নানাভাবে পাঠক-সমালোচকের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এখানেই তিনি একক এবং অনন্য।