বেলশুঁঠ

এক

এই উত্তীর্ণ দুপুরের তেজহীন রৌদ্রে বালকটি দৌড়ে হাঁপিয়ে উঠছে। হাতে মাটির ঢেলা। ফোঁস ফোঁস আওয়াজ তুলে নিশ্বাস ছাড়ছে আর দৌড়াচ্ছে। ধবলীকে ধরতেই হবে। হাতের ঢেলা ছুড়ে আহত করতে চায় ওকে। মাঝে মাঝে নিশানা লেগেও যায়। ক্যাঁয় ক্যাঁয় করে ওঠে ধবলী। ব্যথায় দেহটা খানিকটা বেঁকেও যায়। মুখ থেকে ছিটকে পড়ে বালকের আকাঙ্ক্ষিত বেলশুঁঠ। এই অদ্ভুত দেখতে জিনিসটা হস্তগত করতেই বালকের এমন প্রাণান্ত চেষ্টা। ধবলীও দমবার পাত্র নয়। বালকটি কাছে আসার আগেই আবার দাঁতের পাটিতে লুফে নেয় বেলশুঁঠ, অতঃপর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ধবলীর পিছে ছুটে বালক; বালকের আগ্রহের বস্তু নিয়ে অগ্রগামী হয় ধবলী। এভাবেই বেলা পড়ে সন্ধ্যার মুখোমুখি হয়। বটগাছের নিচে বসে হাঁপাতে থাকে ধবলী আর বালক। বালকের হাতে বেলশুঁঠ।

এমন অদ্ভুত জিনিস আগে কখনো দেখেনি ছেলেটা। এই কলোনির কিশোর বালক আর তার বন্ধু মিলে ক্রিকেট খেলায় মগ্ন ছিল শিউলিদের বাসার পেছনের পরিত্যক্ত খোলা জায়গায়। ধবলী দূরে আপনমনে মাটি খুঁড়তে ব্যস্ত। এদিকটা ঝোপঝাড়ে ভর্তি। মানুষজন খুব একটা আসে না। ওদের ক্লাসের শিউলিদের বাসা তিনতলায়। ভিনদেশি শিউলির বাবা বাজারে যে সরকারি ব্যাংকটা আছে সেটার ম্যানেজার। এই বাড়িটাও ওই ব্যাংকের। লোকে বলে ব্যাংক কলোনি। শহরতলি হওয়ায় গ্রাম এবং শহরের মিশ্রণ আছে এখানে। এই যেমন দু-চার মিনিট হাঁটলেই পুরোদস্তুর গ্রামে পৌঁছে যাওয়া যায়। বালকের বাড়ি ওখানেই। তবে শিউলিকে দেখতে এদিকে প্রায়ই ক্রিকেট খেলতে আসে বালক। ক্রিকেটের চেয়ে তিনতলার জানালার দিকেই মনোযোগ থাকে বেশি। ধবলীরও জায়গাটা বেশ পছন্দ। যেখানে খুশি, যখন খুশি তিড়িং-বিড়িং লাফাতে পারে। ছেলেটার আদরিণী সারমেয় ধবলী।

বন্ধুর করা বল একটু ব্যাট উঁচিয়ে মারতেই হাওয়া গায়ে লাগিয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে পড়ে। ধবলী ঠিক সেখানেই তার ডিগার দাঁতে মাটি ডিগিং করছে। কেউ বোধহয় পুকুর খননের কন্ট্রাক্ট দিয়েছে ওকে। বালক ছুটে যায় বলের আশায়। তিনতলায় কেউ কি দেখেছে ও যে এত চমৎকারভাবে ব্যাট ঘুরিয়েছে? পিছন ফিরে তিনতলায় দৃকপাত করে। শিউলি ঠোঁটের কোণে হাসি এনে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। বালক পৌঁছে যায় বলের কাছে। ধবলী যে পুকুর খুঁড়েছে তার কিনারে আটকে আছে বল। বল নিতে গিয়ে কী যেন দেখতে পায় বালক। নারকেলের মালাসদৃশ এমন বস্তু আগে দেখেনি সে। হাতে নিতেই পেছনে দাঁড়ানো বন্ধু ইয়াক্ ইয়াক্ করে ওঠে, ‘ছুড়ে ফ্যাল, ছুড়ে ফ্যাল, পচা বেলশুঁঠ ওটা।’ বালক নেড়েচেড়ে দেখে; কেমন অদ্ভুত দেখতে! বালকের বিস্ময়াতুর চোখ ঘিরে রেখেছে সদ্যপ্রাপ্ত ঈষৎ গোলাকার কিন্তু মাঝবরাবর দেবে যাওয়া বস্তুটাকে। অস্পষ্টস্বরে বলে, ‘বেলশুঁঠ কী রে?’

‘আমাগো দ্যাশে বেল শুকাইয়া গেলে কয় বেলশুঁঠ; তুই জানস না বুঝি!’ – মিত্রের অজ্ঞতায় অবাক হয় বালকের বন্ধু।

আনমনে না-সূচক মাথা নাড়ে বালক। এদিক-ওদিক উলটিয়ে দেখে; কোনোভাবেই একে বেলশুঁঠ মনে হচ্ছে না ওর। দু-হাতের চাপে ভাঙতেও চায়। এমন কঠিন বস্তু নাদান হাতের ছোঁয়ায় কি আর ভঙ্গুর হয়? তবে খুব কাজের জিনিস পেয়ে গেল বালক; অনায়াসে কাঁচা আম কাটার কাজে লাগানো যাবে। সেবার আমের দিনে আকখি মামা ঝিনুকের খোলস দিয়ে কীভাবে ম্যাংগো কাটার বানাতে হয় শিখিয়েছিল। খুব ধারালো হয়। অসাবধানতায় হাতও কেটে যেতে পারে। আসছে বছর আমের সিজনে এই অদ্ভুত বেলশুঁঠসদৃশ বস্তুটাকে মেঝেতে সামান্য ঘষে বানাতে পারবে এক অসাধারণ ম্যাংগো কাটার। ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই পকেটস্থ করার অভিপ্রায়ে যেই না চেষ্টা করল ধবলী ছোঁ মেরে নিয়ে ছুটল। এরপর সন্ধ্যা হয়ে এলে দুজন হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ে বটগাছের তলায়।

দুই

পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়; যে-কোনো সময় আগুন জ্বলে উঠবে গ্রামে। তারই সংবাদ নিয়ে দৌড়ে এলো সুবাস। মতিয়ার আড়ালে থেকে দলের সদস্যদের পরবর্তী করণীয় বুঝিয়ে দেয়। সবার চোখে বারুদ ঝলসে ওঠে। কিছু একটা করতেই হবে। শিবলু পলাশ, বারেককে সঙ্গে নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে নেওয়া শেষে শিস দিয়ে ইশারা করলো। সবাই পরিকল্পনামতো যার যার পজিশনে চলে যায়। রাতের অন্ধকার গ্রাস করে রেখেছে সবকিছু। গ্রামের মানুষের মনের ভিতরে কিংবা আকাশে এক ফোঁটা আলোও অবশিষ্ট নেই। একাব্বরউদ্দীন সব আলো শুষে নিয়েছে দুদিন আগে। জাহেলিয়াত প্রতিষ্ঠা করেছে সে। তাই বোধহয় দূর থেকেও ওর হাতের টর্চ এত বেশি আলো দেয়। একাব্বর একা নেই, সঙ্গে দুজন বডিগার্ড সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসছে। নিচে লুঙ্গি, ওপরে খাকিরঙা কুর্তা পরনে পাঠান দেহরক্ষী দুটোর পেছনে পাইপগান ঝোলানো। সদর্পে পা চালিয়ে আসে ওরা তিনজন। সতর্ক মতিয়ার; এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। আলো ফেরত নিতেই হবে আজ।

এগিয়ে আসে আলো। ইশারা পেয়ে কিছু আগুন ছুটে যায় একাব্বরের দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দুই বডিগার্ড। ঝনঝন করে ঝরে পড়ে একাব্বরের হাতে  থাকা টর্চের আলো। শিবলু দৃপ্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, ‘জয় বাংলা।’ রাইফেল হাতে লাশের কাছে এগিয়ে আসে সুবাস, মতিয়ার, শিবলু, পলাশ, বারেক। টর্চের আলো অন্ধকারে ডুব দিয়েছে। টার্গেট ফেইল! হাহাকার করে ওঠে বারেক, পলাশ! ‘শালার কই মাছ! ফসকে গেছে!’ একাব্বর কোথাও নেই!

আহত বাঘের চেয়ে ভয়ংকর আর কী হতে পারে। হামলার পর থেকে আরো যেন হিংস্র হয়ে উঠেছে একাব্বর। প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাড়ির আলো ছিনিয়ে তাণ্ডব পুঁথি পড়ছে ও। ব্যর্থতায় আত্মবিশ্বাসও কমতে থাকে যুবক প্রাণগুলোর। তবু স্বপ্ন দেখে নতুন ভোরের। নতুন আলোর। শিবলুর সেদিনের স্লোগান কানে পৌঁছেছিল একাব্বরের। অন্ধকারে ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে বুঝেছিল কাদের এমন সাহস যে তাকে হত্যা করে। কৌশল বদলে যায় একাব্বরের। তবে জাত শিকারির দল জানতো বাঘ যখন পিছপা হয়, তখন সে দ্বিগুণবেগে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। নিজেদের আরো সতর্ক করে মতিয়ার। একটা ভুলের মাশুল দিতে অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে রাজি নয় সে।

তিন

বালক তার বেলশুঁট নিয়ে গোধূলির পথ মাড়িয়ে ঘরে আসে। মা তার চুলোর পাড়ে বাবার জন্য সান্ধ্য জল-খাবার  তৈরিতে মগ্ন। বাবা পরিশ্রান্ত দেহখানা এলিয়ে রেখেছেন বিছানার তুলতুলে বালিশে। টিভিতে চলছে মেয়েলি গেম শো। অনড় দৃষ্টিতে তাই দেখছেন তিনি। দেয়ালে ঝুলে আছে বাবা-জ্যাঠার পুরনো বাঁধাই করা ছবি। বালক টিপটিপ পায়ে এগিয়ে যায়। পকেটের বেলশুঁঠ সন্তর্পণে বের করে রাখে টেবিলে।

মায়ের ডাকে রসুই ঘরে দৌড়ে যায় বালক। বাহারি পিঠা বানিয়েছে মা। সুদূরে তুলসীতলায় মোমবাতি জ¦লছে। ধূপকাঠি দুটি রোজ সংগত করে সঙ্গে। গ্রামে এই দৃশ্য প্রায় প্রতিটি ঘরের। মায়ের দেওয়া পিঠা রসে ডুবিয়ে যেই আয়েশ করে মুখ তুলতে যাবে, বাবার তীক্ষè চিৎকারে নিজের নাম শুনতে পেয়ে ভোঁ-দৌড় দেয় বালক। ধবলীও উঠানে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। উৎকণ্ঠায় পিছন পিছন ছোটে মা।

বালকের পড়ার ঘরে সমবেত পিতা-পুত্র-জননী। বাবার হাতে কুড়িয়ে আনা ম্যাংগো কাটার। থরথর করে কাঁপছে পিতার হাত, দুরুদুরু তার গলায় কণ্ঠনালির স্পষ্ট চিত্রিত রেখা। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে দেয়ালে টানানো ছবির দিকে। কোনো এক অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর খোঁজার নেশা লেগেছে সেই দৃষ্টিতে। ভয়ে শঙ্কিত হয়ে ওঠে বালকহৃদয়। পা দুটো স্থির হয়ে আছে মেঝেতে। কেউ যেন ফেভিকল দিয়ে আটকে দিয়েছে ওগুলো। মা বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাপারখানা। স্বামীর হাতে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠে দু-পা পিছিয়ে যায় যেন। মাথাটা টলছে কি না তাও বুঝতে পারছে না। বালক বুঝতে পারে না সামান্য বেলশুঁঠ দেখে
বাবা-মা এমন করছে কেন!

জিজ্ঞাসু পিতার অপেক্ষা দীর্ঘায়িত না করে সবিস্তারে বলে বালক – বেলশুঁঠপ্রাপ্তির কথা। শুধু বলে না শিউলির কথা। বলে না কেনই বা এত জায়গা ছেড়ে ওই কলোনির পরিত্যক্ত জায়গায় ক্রিকেট খেলতে যায় বালক। বাবার আর আয়েশ করে পিঠা খাওয়া হলো না। বালকের ম্যাংগো কাটার ব্যাগে ভরে উদ্ভ্রান্তের মতো কোথায় যেন বের হয়ে গেল। মা সেই যে নিথর হলো এখনো তাই আছেন। চোখদুটোয় মহাপ্লাবন হবে বুঝি। বালক কাছে গিয়ে ডাকে, ‘মা, মা …’ সন্তানের ডাকে অস্থির হলো মা। বুকে জড়িয়ে হাউমাউ কেঁদে নিলেন একচোট। বালক বুঝতে পারে না রহস্য। সে অপেক্ষায় থাকে বাবার। কবে ফিরবে বাবা?

চার

গেরিলা আক্রমণের জন্য জোর প্রস্তুতি নেয় মতিয়ার বাহিনী। অস্থায়ী সাব-ক্যাম্পের কাছেই আস্তানা গেড়েছে ওরা। মিশন সফল হলে আলো ফিরে আসবে। তবে ভীষণ বিপজ্জনক এই পরিকল্পনা; মৃত্যু একেবারে তাল মিলিয়ে এগিয়ে আসবে ময়দানে। তবু জেদ চেপেছে ওদের মারবে, নয়তো মরবে। শাসক হতে না পারি তো শোষিতও হবো না। জিগীষু হৃদয়ে টগবগ করছে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি।

দিনক্ষণ ঠিক। লক্ষ্য স্থির। চূড়ান্ত পরিকল্পনা শেষ। একে একে মৃত্যুকূপে নেমে যুদ্ধ জয় করে আসবে ওরা। আলো ফেরাবে দেশে। ওরা নির্ভীক, ওরা সংঘবদ্ধ, ওরা সংকল্পবদ্ধ। ‘জয় বাংলা’ এই তো ওদের প্রেরণার মূলমন্ত্র।

দেখতে দেখতে চলে এলো সময়। মাথায় বিজয় নিশান। ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওরা। রক্তের হোলি আজ। সব রং লাল। সবার প্রথমে আলো ছিনলো একাব্বরের পিঞ্জর থেকে। জয় বাংলা, জয় বাংলা। এগিয়ে যায় মতিয়ার, শিবলু, পলাশ, সুবাস, বারেক। সন্ধ্যা এলো, পূর্ণিমায় কিছু আলোও এলো গ্রামে। শুধু এলো না পলাশ। কিছুদিন পর খবর এলো। পলাশ মৃত্যুর প্রার্থনা করছে মূল ক্যাম্পের টর্চার সেলে। জিজীবিষা হারিয়েছে সে। দু-পায়ের অস্বাভাবিক গরমিলে সেদিন সুবাসদের সঙ্গে ফিরতে পারেনি ছেলেটা। এরপর দেশ স্বাধীন হলো; ক্যাম্প উঠে গেল। বাজারে লাশের পাহাড় রেখে গেল জানোয়ারগুলো। কোথাও নেই পলাশ। ও হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবী থেকে।

পাঁচ

বালক অপেক্ষা করে বাবার। মাও অপেক্ষা করে। তুলসীতলার মোমবাতি নিভে গেছে কবে। শুধু ধূপের গন্ধের রেশ রয়ে গেছে কিছুটা। বাবা ছুটছেন এর বাসায় ওর বাসায়। যাকে পারছেন সঙ্গে নিয়ে ছুটছেন আরেকজনের বাসায়। শহরতলি তোলপাড়। রহস্য ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। পুলিশ এলো, এলো মেম্বার, এলো চেয়ারম্যান। রাত বাড়ছে। আলোয় আলোয় ভরে উঠেছে পরিত্যক্ত মাঠের চারপাশ। ধবলীর খোঁড়া মিনি পুকুর জুড়ে চলছে নতুন খোদাই। শাবল-কোদাল পড়ছে একের ওপর আরেক। শত শত চোখের বিস্ফারণ হচ্ছে। উঠে আসছে একের পর এক বেলশুঁঠ। টুকরো নিয়ে পাজল মেলায় পুলিশ।

খনন চলছে। উঠছে ইতিহাসের হারানো নায়ক। ধীরে ধীরে। এগিয়ে আসে তেজস্বী বৃদ্ধ মতিয়ার, সঙ্গে শিবলু; বারেক, সুবাস মরেছে বছর কয়েক। মতিয়ার তাকায় শিবলুর দিকে; ঝরছে কী যেন – রক্ত, নাকি অশ্রু! উঠে আসা অবয়বের দু-পায়ে ভীষণ গরমিল! শিবলু শিউরে উঠে বলে, পলাশ!

ডুকরে ওঠে মতিয়ার।

ডুকরে ওঠে বালকের পিতা – শিমুল। পলাশ যে তার খুব আপন। মা বলতেন জন্মের সময় পলাশের মাথায় আঘাত লেগে মাথার মাঝখানে বেশকিছুটা জায়গা দেবে যায়। বড় হলেও সেই ক্ষত আর সারেনি। পাজলের শেষ টুকরোটা শিমুলের হাতে।