মালিবাগ মোড়ের গল্প

আপনি কে? আমার পিছনে পিছনে হাঁটছেন কেন? বিরক্তির সঙ্গে প্রশ্ন করে কেশবতী। আমি লক্ষ করেছি কয়েকদিন ধরে আপনি আমার পিছু নিচ্ছেন। কেন? চেনেন আমাকে?

হঠাৎ একসঙ্গে এতো প্রশ্নের মুখোমুখি হবে, বুঝতে পারেনি সৈকত হালিম। বিব্রত মুখে একবার কেশবতীর চোখের দিকে আর একবার মাটির দিকে দৃষ্টি রাখে। গলি পার হয়ে চৌরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। আকাশে মেঘের আনাগোনা

থাকলেও চারদিকে গরম। কেশবতীর মাথার ওপর ছোট একটা ছাতা। পেছনে তাকিয়ে সৈকতকে দেখে হাতের ছাতা নামিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায়। গত কয়েকদিন ধরে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল কেশবতী, লোকটাকে মুখোমুখি প্রশ্ন করবে।

আমার প্রশ্নের জবাব দিন, একটু কড়া গলায় সে বলল, কেন বিরক্ত করছেন? আমাকে দেখলে কী স্কুল-কলেজের ছাত্রী মনে হয়? আমি দুই বাচ্চার মা। আমার বড় মেয়ে এবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে।

আমি আসলে আপনাকে ডিসটার্ব করতে চাইনি। কেবল আপনাকে একটু দেখতে চাই – যথাসম্ভব গলা নরম করে জবাব দেয় সৈকত হালিম।

দেখতে চাই মানে কী? অসহয় বোধ করে কেশবতী।

দেখুন আপনার মতো আমারও সংসার আছে। গ্রামের বাড়িতে আমার স্ত্রী আর দুটি ছেলে আছে।  ঢাকায় আমি চাকরি করি। আমার সুখের সংসার, নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করে সৈকত হালিম। কিন্তু কয়েকদিন আগে –

কয়েক দিন আগে কী? তাড়াতাড়ি বলুন, আমি প্রাইভেট ব্যাংকে জব করি। দেরি হলে নোট খাবো। বলুন –

বৃষ্টির দিন ছিল, আমিও অফিসে যাওয়ার জন্য গলির মোড়ে দোকানে একটা রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ দেখি আপনি হেঁটে আসছেন উল্টো দিকের গলি থেকে। আপনার পরনে ছিল আকাশ রঙের সালোয়ার-কামিজ, হালকা বাতাসে আপনার বব চুল উড়ছিল – আপনার মুখটায় স্নিগ্ধ একটা সুন্দরের ঢেউ খেলে যাচ্ছিল, আমার মনে হলো জীবনে আমি এমন সুন্দর দেখিনি।

তাই আমার পিছু নিলেন? কেশবতীর ঠোঁটে হাসি ফোটে।

একটু সাহস পায় সৈকত হালিম, জি। আপনাকে দেখার পর আমার জীবন পাল্টে যায়। আমি যেদিকে তাকাই কেবল আপনাকেই দেখতে পাই। জানেন, আমার স্ত্রী সুনীতা কিন্তু দারুণ সুন্দরী। যদিও দুটি ছেলের মা কিন্তু এখনো সুনীতাকে অন্যরকম সুন্দর লাগে। কিন্তু আপনাকে দেখার পর সবকিছু পাল্টে গেছে আমার।  জানি আমি ঠিক করছি না, অন্যায় করছি কিন্তু কোনোভাবে নিজেকে সামলাতে পারি না।

কিন্তু আপনাকে সামলাতে হবে, আপনি স্বামী এবং বাবা। আমারও সংসার আছে – আমার স্বামী ভয়ানক একরোখা টাইপের মানুষ। রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। আমি আপনার ভালোর জন্য বলছি, আপনি আপনার মতো থাকুন, আমাকে শান্তিতে থাকতে দিন। ঠিক আছে?

মাথা নাড়ে সৈকত, ঠিক আছে।

বন্ধ ছাতাটা খুলে মাথার ওপর ধরে হালকা বৃষ্টির মধ্যে চৌরাস্তা পার হয়ে একটা রিকশা নিয়ে চলে যায় কেশবতী। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে সৈকত হালিম। স্বপ্ন, আশা আর কামনার যে সৌধ বুকের মধ্যে আকাশের রঙে গড়ে উঠেছিল, সেই আকাশটা ভেঙে পড়ছে মাটিতে টুকরো টুকরো হয়ে। নিঃসীম বেদনায় নিশ্চুপ চোখে দাঁড়িয়ে দেখে কেশবতীর চলে যাওয়া।

কেশবতী ভেবেছিল, লোকটা আর বিরক্ত করবে না। কিন্তু কয়েকদিন পর পেছনে পেছনে সৈকত হালিমকে আসতে দেখে। লোকটা নির্লজ্জ বেহায়াপনায় আবারো পিছু নিয়েছে? কিন্তু কাছে আসছে না, দূরত্ব বজায় রেখে হেঁটে আসছে, চোখ রাখছে কেশবতীর ওপর। একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে নিঃশব্দে অনুসরণ করছে, তাও নারীর বিপরীতে পুরুষ – মনের মধ্যে এক ধরনের বিষ তৈরি করে। না যায় কাউকে বলা, না যায় সহ্য করা। লোকটাকে নিয়ে কী করবো? নিজের মনে প্রশ্ন করে কেশবতী। রাস্তার ধারের পুলিশদের বলবো? বললে যদি উল্টো প্রশ্ন করে, কী হয় আপনার? একটা কিছু না হলে আপনার পিছু ঘুরবে কেন?

না, পুলিশের কাছে যাওয়া যাবে না। জীবনে এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে সে পড়েনি কখনো। সুন্দরী একটু হয়তো, কলেজে-বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে প্রচুর প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে কেশবতী। কিন্তু ওর মধ্যে কোনো আগ্রহ জন্মায়নি। পড়াশোনা শেষ করে মা-বাবার ঠিক করা পাত্রের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে এবং সুখে আছে। স্বামী-সংসার-ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারলে কেন উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নেবে? এসব কেশবতীর রুচিরও বিরুদ্ধে। অথচ কোথাকার একটা লোক শিয়ালের মতো পিছু নিয়ে হাঁটছে … অসহ্য। মালিবাগ চৌরাস্তায় এসে দ্রুতবেগে রাস্তা পার হয়ে রিকশায় উঠে বসে। রিকশা চলতে শুরু করলে কেশবতী ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়, রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখছে সৈকত হালিম! চোখের মধ্যে ভীষণ ব্যাকুলতা।

এই যে মিস্টার!

ঘাড়ের ওপর হঠাৎ হাতের ছোঁয়া পেয়ে ফিরে তাকায় সৈকত হালিম। সামনে দাঁড়িয়ে এক দশাসই মানুষ। সৈকত হালিম হালকা-পাতলা গড়নের আর সামনে দাঁড়ানো মানুষটা তালগাছের কাঠিন্যে শক্তিশালী। মাথায় অনেক চুল। চোখ দুটো নাকের দুই পাশে ভেসে আছে। গোলগাল মুখের ওপর নাকটা আকারে বেশ বড়। তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৈকতের দিকে।

আমাকে কিছু বলবেন?

ঘাড়ের ওপর নেমে আসা চুলের ওপর হাত বোলায়, সামনের ওই ভদ্রমহিলার আমি হাজব্যান্ড। আমার নাম বেলায়েত হোসেন। আমি একসময়ে ক্যারাটে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছিলাম।  তো আপনার সমস্যা কী? কেন আমার স্ত্রীকে ডিসটার্ব করছেন?

বেলায়েত হোসেনকে দেখেই সৈকত হালিমের শরীরে ভয় ধরে। এই লোক যদি মার শুরু করে, মার খেতে খেতে মরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

উত্তর দিচ্ছেন না কেন? বেলায়েত হোসেনের গলা চড়া।

সৈকত হালিম তাকায় পেছনের ফুটপাতের দিকে। হেঁটে অনেক দূরে চলে গিয়ে ফুটপাতের জনস্রোতে মিশে গেছে কেশবতী। কিন্তু কয়েকদিনের অভিজ্ঞ চোখে ঠিকই জনস্রোতের মধ্যে বিজলি চমকের মতো তাকে দেখতে পেয়েছে, চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকের সকালে রাস্তাঘাটে অনেক ভিড়। সাধারণত এই এলাকায় ভিড় থাকে না। ভিড়টা আমাকে কেন্দ্র করে? নিজের মনে প্রশ্ন ছোড়ে সৈকত হালিম।

এই যে মিস্টার! বেলায়েতের গলা বেয়াড়া হয়ে ওঠে, উত্তর দিচ্ছেন না কেন?

আমি তো আপনার স্ত্রীকে ডিসটার্ব করছি না, নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে সৈকত হালিম। ভেতরে ভেতরে ভয়ে, নিষিদ্ধ অনুশোচনায় কাঁপছে।

কেশবতী আমাকে মিথ্যা বলছে? আপনাকে দেখিয়েছে নিজে। এই শহরে রাস্তায় অসংখ্য মানুষ আসা-যাওয়া করছে, কাউকে তো দেখালো না। আপনাকে দেখালো কেন? কী চান আপনি?

বিপন্ন বোধ করে সৈকত, কেশবতীর স্বামী দশাসই বেলায়েত হোসেনকে কী উত্তর দেবে? আপনার স্ত্রীকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমি জানি, কেশবতীর সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে, ও কখনো আমার দিকে তাকায়নি … প্রকৃতপক্ষে ওর কোনো দোষ নেই। আমারও কি কোনো দোষ আছে?  ঢাকা শহরের রাস্তায় ফুটপাতে প্রতিদিন কত নারী-পুরুষ হাঁটে – দেখি চোখের আয়তদৃষ্টিতে; কিন্তু কেউ তো আমাকে এমন করে সর্বনাশের ষোলোকলায় পূর্ণ করেনি। করেছে কেবল আপনার স্ত্রী – কেশবতী। আপনিই বলুন, কেশবতী কি খুব রূপসী? হয়তো একসময়ে ছিল যখন আপনি বিয়ে করেছিলেন, আজ থেকে বারো-তেরো বছর আগে। দুটি সন্তানের মা এখন কেশবতী। সেই রূপ কি এখনো আপনাকে ঝলসে দেয়? ঠিক জানি না, কী উত্তর আপনি দেবেন। আবার মনে করার কোনো কারণ নেই, আমি কেশবতীর সুন্দরের প্রেমে পড়েছি। আমি পড়েছি ওর লাবণ্যের প্রেমে। দেখেছেন ওর চোখের তারায় বৃষ্টি নামে। যখন হাসে ঠোঁটের কোণে লাটিম নৃত্য করে। হাঁটলে মনে হয়, হাজার হাজার বছর পর উর্বশী নেমে এসেছে মাটিতে। বলার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার ওপর ফেলে … ভাবতেই পারে না সৈকত হালিম। সত্যি তো কেশবতীকে ভালো লাগে। ওকে ভেবে দিন-রাত কাটে। কত-সহস্রবার কেশবতীকে সঙ্গে নিয়ে নিঝুম দ্বীপে গেছে অভিসারে। মনের মধ্যে জমে থাকা কত গল্প শুনিয়েছে, আদর করেছে! আদরে আলিঙ্গনে পাহাড় ডিঙিয়েছে … সেসব কী কেশবতীর স্বামী বেলায়েত হোসেনকে বলা যায়?

আরে বেলায়েত ভাই, কী করছেন? কেমন আছেন – ফুটপাত দিয়ে যেতে যেতে একজন দাঁড়িয়ে যায়।

মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বিনয়ী হাসিতে জবাব দেয় বেলায়েত হোসেন, আমার পরিচিত বন্ধু। অনেকদিন পর দেখা তো, একটু আলাপ করছি।

ও তাই? ঠিক আছে – বলে লোকটা চলে যায়। লোকটা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো একজন আসে, বেলায়েত ভাই, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা ছিল। আমি আপনার বাসায়ই যাচ্ছি। লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ে।

জসিম, আমি দশ মিনিট পরে আসছি, তুমি বাসায় অপেক্ষা করো। সৈকতকে  দেখিয়ে, আমার বন্ধু। অনেক দূর থেকে এসেছে, জরুরি কয়েকটা কথা সেরে আসছি।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও জসিম রাজি হয়, ঠিক আছে। কিন্তু বেশি দেরি কইরেন না বেলায়েত ভাই।

মাছি তাড়ানোর মতো হাতটা ওঠায়, আরে না না, আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।

লোকটা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেলায়েত হোসেন প্রস্তাব করে, এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলা আসলে কঠিন। আমার এলাকা তো, লোকজন আসবেই। চলুন, সাম্পান রেস্টুরেন্টের দোতলায় বসি। বেশিক্ষণ না, আপনার সঙ্গে আমি পাঁচ মিনিটে কথা শেষ করবো।

বেলায়েত হোসেন রেস্টুরেন্টের দিকে হাঁটা শুরু করে। সৈকত হালিম কী করবে? যাবে কি যাবে না, ভাবনার মধ্যে বেলায়েত হোসেনকে অনুসরণ করে দোতলায় উঠে যায়। দুজনে বসে একটা টেবিলে। একজন ওয়েটার ছুটে আসে,  স্যার? কী দিমু?

তেমন কিছু না, তুই দুই কাপ চা দে।

আইচ্ছা, ওয়েটার দ্রুত চলে যায়।

বেলায়েত হোসেন তাকায় সামনে বসা গোবেচারা টাইপের মানুষটা দিকে। নিরীহ। দেখে মনে হচ্ছে, ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারে না। অথচ লোকটা আমার বউয়ের পেছনে পেছনে হাঁটে! চিৎকার-চেঁচামেচিও করতে পারছে না, এলাকার মানুষ জেনে গেলে ইজ্জত থাকবে না। সামনে কিছু না বললেও পিছনে শিয়ালের মতো দাঁত বের করে হাসবে আর বলবে, বেলায়েত ভাইয়ের বউয়ের পেছনে প্রেমিক লেগেছে! ইচ্ছে করে লোকটারে ধরে চানাচুরের সঙ্গে চিবিয়ে-চিবিয়ে খায়। অথচ বসতে হচ্ছে মুখোমুখি, মেজাজ ঠান্ডা রেখে।

সরাসরি সৈকতের চোখে চোখ রাখে বেলায়েত হোসেন, আপনি আমার স্ত্রীর কাছে কী চান? কেশবতী কী আপনার কাছে এসেছে? না আপনি …

না না, আপনার স্ত্রী কখনোই আমার কাছে আসে নাই। আমিই গিয়েছি। বরং আমাকে তিনি নিষেধ করেছেন, বুঝিয়েছেন। বলেছেন – আমার স্বামী-সংসার-সস্তান আছে, আমি সুখে জীবনযাপন করছি। আমার কোনো অভাব আমার স্বামী রাখেনি। আপনি আর আমাকে বিরক্ত করবেন না।

এতো কিছু বলার পরও আপনি কেন কেশবতীর পেছনে হাঁটেন? কেন বিরক্ত করেন?

সৈকত হালিম একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়, কী বলবে কেশবতীর স্বামীকে? বলবে, আপনার স্ত্রীকে আমি ভালোবাসি। আমি চোখ বন্ধ করলেও কেশবতীকে চোখের তারায় দেখি, চোখ খোলা থাকলে তো দেখিই …। আপনার স্ত্রীর কোনো ভূমিকা নেই; কিন্তু তিনি কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। যদিও জানি, গোটা ব্যাপারটা অপরাধের, অন্যায্য, কিন্তু আমি আমার কাছে বড় অসহায়।

গড়গড় করে বেলায়েত হোসেনের রাগী গলা, আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন? আপনি জানেন না, আমি আপনাকে কী করতে পারি! কেবল এলাকার মানুষজনের জন্য কিছু বলতে পারছি না। বদনাম হবে, আমার হোক সমস্যা নেই, কিন্তু কেশবতীর বদনাম সহ্য করা কঠিন হবে আমার জন্য। বলুন, কেন আপনি বিরক্ত করছেন ওকে?

ঢোক গেলে সৈকত হালিম, চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় গ্রামের বাড়িতে থাকা স্ত্রী সামিয়ার স্নিগ্ধ মুখ। দুটি পুত্রের মুখ। বিপন্ন বোধ করে সৈকত – কী বলবো বুঝে উঠতে পারছি না ভাই। আমি এমন কেন করছি, আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আমি ভীষণ চেষ্টা করছি আপনার স্ত্রীকে  বিরক্ত না করতে। কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারি না। ভেতরের এক অমোঘ সত্তা আমাকে টেনে নিয়ে আসে …

শোনেন, আজকে মাসের আঠারো তারিখ। আপনাকে সময় দিলাম এই মাসের শেষদিন পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যাবেন। আর কখনো আমার স্ত্রীর পেছনে হাঁটবেন না। যদি হাঁটেন আপনিই খুঁজে পাবেন না আপনাকে। হাওয়ায় মিলিয়ে যাবেন। মনে থাকে যেন। বেলায়েত হোসেন দ্রুত পায়ে চলে যায়। একখণ্ড পাথরের মতো বসে থাকে সৈকত হালিম। সামনে দুই কাপ চা, কেউ চুমুক দেয়নি। বুকের ভেতরে নিঃসীম যন্ত্রণার একটা ঘুণপোকা রক্তকলিজার মধ্যে হাঁটতে থাকে।

কী বললে লোকটাকে?

রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে প্রসাধন সারতে সারতে আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে কেশবতী। পাশে বসে হিসাব দেখছে বেলায়েত হোসেন। সিমেন্টের দোকানের ম্যানেজার টাকা মারছে, বুঝতে পারছে; কিন্তু ধরতে পারছে না। ধরার জন্য পাতি পাতি করে ভাউচার-বিল দেখেছে, চেক করছে। স্ত্রী কেশবতীর প্রশ্নে চোখ তুলে তাকায়, কিছু বললে?

লোকটাকে কী বললে?

কোন লোকটাকে?

কেশবতী স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে স্বামীর দিকে। এতো বড় ঘটনা, আর মানুষটা ভুলে গেল? নাকি আমাকে পরীক্ষা করছে? মানুষটা এমনিতে সরল কিন্তু কোনো বিষয়ে একবার গেরো লাগলে শেষ দেখে ছাড়ে। আমাকে কী গেরোর মধ্যে ফেললো?

নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বেলায়েত হোসেনের মনে নানা কথা ঘুরপাক খেতে থাকে। অনেকদিন নিজের স্ত্রীর দিকে তাকানো হয়নি। সেই কবে আঠারো-উনিশ বছর আগে বিয়ে করে আনার পর মুগ্ধতার রেশ কাটতে সময় লেগেছিল। বউ ছেড়ে কোথাও যেতে মন চাইতো না। সবাই হাসাহাসি করতো। যৌবনের দুয়ারে দাঁড়ালে সবার মধ্যে এমন পাগলামির  মাতাল হাওয়া দেখা দেয়। একে একে দুটো বাচ্চার মা হলো কেশবতী, চাকরিতে জয়েন করলো, অনেকদিন ফিরে তাকানো হয়নি নিজের স্ত্রীর দিকে। মধ্যবয়সের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কেশবতী এখনো সেই প্রথমদিনের মতোই সুন্দর!

আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে না? বেলায়েত হোসেনের চোখ থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নাইটি পরা প্রজাপতি আয়না থেকে নিজেকে সরিয়ে বিছনায় বসে।

হ্যাঁ, বেলায়েত হোসেন নিজের মধ্যে ফিরে আসে, লোকটাকে শাসিয়ে দিয়েছি। ও আর তোমাকে ডিসটার্ব করবে না।

কী বলেছো?

মানে?

মানে লোকটাকে কী বলেছো?

কী বলেছি সেটা জেনে তুমি কী করবে?

আমি কিছুই করবো না, কেবল আমার কৌতূহল!

হাতের বিল-ভাউচারে চোখ রাখতে রাখতে বলে বেলায়েত হোসেন, অতো কৌতূহলের দরকার নেই। কোথাকার কোন আমড়াকাঠ, তার বিষয়ে আবার কৌতূহল!

হাসে কেশবতী, তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?

চোখ তুলে তাকায়, রাগলাম কই?

তোমার চোখের দৃষ্টি, গলার স্বর বলছে তুমি রেগে গেছো!

ওই বেজন্মা সম্পর্কে তোমার এতো কৌতূহল কেন?

কী বলতে চাও তুমি? শরীর স্থির করে তীব্র চোখে তাকায় কেশবতী।

একটা রাস্তার লোক খামোকা তোমার পেছনে হাঁটবে কেন, যদি তোমার কোনো আগ্রহ না থাকে? ঢাকার রাস্তাঘাটে প্রতিদিন হাজার হাজার মেয়ে চলাচল করে, কই কারো পিছনে ভিন্ন কোনো পুরুষকে হাঁটতে বা কথা বলতে শুনিনি। শুনলাম তোমার ব্যাপারে। এমনি এমনি লোকটা তোমার পিছু নিয়েছে? বেলায়েত হোসেনের স্বরে আর দৃষ্টিতে ক্রোধের প্রদীপ জ¦লছে।

তুমি বলতে চাও আমি ওই লোকটার সঙ্গে জড়িত?

আমি কিছুই বলতে চাই না, কিন্তু অন্য পাঁচজনে নিশ্চয়ই বলবে।

আমি অন্য পাঁচজনের সংসার করি না, সংসার করি তোমার। তুমি বলতে চাও আমি ওই অচেনা-অজানা লোকটার সঙ্গে কোনো সম্পর্কে জড়িত?

হাতের মুঠোয় ধরা হিসাবের কাগজপত্র ছুড়ে ফেলে দিয়ে দাঁড়ায় বেলায়েত – নিজের রুমে বসে নিরিবিলি একটু কাজ কারবো, তারও উপায় নেই। রুম থেকে চলে যায় সে। স্থির বসে থাকে কেশবতী। আগামীকাল সকালে ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। দুই মাসের মধ্যে একটা প্রমোশন পাওয়ার সম্ভাবনা আর বাসার মধ্যে রাস্তার একটা মানুষকে নিয়ে এমন বিশ্রী তিক্ত ঘটনা ঘটছে? রাত সাড়ে এগারোটা বাজে, ঘুমে চোখ বুঁজে আসছে, অথচ ঘুমুতে পারছে না কেশবতী? লোকটা গেল কই? বাসার মধ্যে ছেলেমেয়ে, শ^শুর-শাশুড়ি, ছোট ননদ এসেছে বেড়াতে। সঙ্গে নতুন জামাই। বেলায়েত হোসেন কখনো এমন ব্যবহার করেনি, করবে কেন, সুযোগই  তো ঘটেনি। কোথাকার কোন সৈকত হালিম আমার শান্ত সংসারে অশান্তির ঝড় নিয়ে এলো? আমি যে লোকটার জন্য জ¦লছি, সেই লোকটা নিশ্চয়ই আরামে ঘুমুচ্ছে? মানুষের সংসারে এমনটাই হয়, মানুষ আগুন জ¦ালায় অন্যকে পোড়ানোর জন্য।

কয়েকদিন পর আবারো সৈকত হালিম পিছু নেয় কেশবতীর। স্বামীর সঙ্গে লোকটাকে নিয়ে ঘোরতর সংকট তৈরি হতে হতে কোনোভাবে সামলে নিয়েছে। মনে হয়েছে, লোকটা আর আসবে না পিছু পিছু। একটা স্বস্তির নিশ^াস ফেলেছিল কেশবতী। কিন্তু সপ্তাহখানেক পর কেশবতী দেখে অফিসে যাওয়ার সময় আবার লোকটা পিছু নিয়েছে। মন-মেজাজ তীব্র ঘৃণায় কেবল বিষণ্ন না, বিপন্নও হয়ে যায়। ইচ্ছে করছে লোকটাকে নিজের হাতে খুন করে। লোকটা, সৈকত হালিম, আগের মতো কাছে আসে না, বেশ দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে। হোক না দূরত্বে হাঁটা কিন্তু উদ্দেশ্য তো কেশবতী।

অফিস থেকে ফিরে বেলায়েতকে জানায়, আমি চাকরিটা ছেড়ে দেবো।

কেন?

ওই লোকটা আবার এসেছে।

বেলায়েত হোসেন বিছানায় শুয়েছিলেন। একপলক তাকিয়ে উঠে বসলেন। ঝিম মেরে কয়েক সেকেন্ড বসে থাকলেন বিছানার ওপর। আবার তাকালেন স্ত্রীর দিকে। নেমে গেলেন বিছানা থেকে, সময় নিয়ে ধীরলয়ে। এই ধীরলয়টাই ভয় ধরিয়ে দেয় কেশবতীকে।

কোথায় যাচ্ছো?

নিজেকে সামলে নেন বেলায়েত হোসেন, একটু বাইরে যাচ্ছি।

এই ভরসন্ধ্যায় বাইরে না গেলে হয় না?

যাবো আর আসবো, জরুরি একটা কাজ মনে পড়ে গেছে।

এই শুয়োরের বাচ্চা!

পরদিন সকালে কেশবতীর অফিসে যাওয়ার পথে পিছু নেয় সৈকত হালিম। সৈকতের পিছু নেয় মালিবাগ এলাকার বিশেষভাবে পরিচিত জিসান, মাকুন্দা, খালেক, মুরগি শামসু, নোমান খাসি। খাসির মাংস ছাড়া অন্য মাংস খায় না নোমান, সেই কারণে নাম নোমান খাসি।

পেছনে ফিরে তাকিয়ে সৈকত হালিম দেখতে পায় পাঁচজনের একটা দঙ্গলের মধ্যে আটকা পড়েছে। কাউকে চেনে না কিন্তু বুঝতে পারে, বিশেষ উদ্দেশ্যে এরা এসেছে। পাঁচজনের কাঁধ পার হয়ে তাকায় মালিবাগ চৌরাস্তার ওপর। পার হয়ে যাচ্ছে কেশবতী। হালকা হাওয়ায় মাথার চুল উড়ছে। চোখে কালো সানগ্লাস। কী যে অপরূপ ভঙ্গিমায় হেঁটে যাচ্ছে … এই ভঙ্গিমা কোনোদিন চোখের কিনারা থেকে মুছে যাওয়ার নয়। আহা! সৌন্দর্যের এই আলোছায়া কেউ দেখলো না!

তুই কে রে? জিসান মাথার চুলের ওপর ডান হাতে নাড়া দেয়।

নিজের মাথার চুলে হাত দেয় সৈকত, আপনারা কারা?

আমরা আপনার দুলাভাই!  হাসতে হাসতে শরীরের ওপর ঢলে পড়ে নোমান খাসি।

সৈকত হালিম বুঝে যায়, সহজে নিস্তার পাওয়া যাবে না এদের আক্রমণ থেকে। কী অপরাধ আমার? একজন নারীকে আমার ভালো লেগেছে। পরিস্থিতির কারণে বুঝতে পারি, এটা অনুচিত। অন্যায়। কিন্তু আমার ভেতরের প্রেমের সত্তা যে মানে না কোনো বাস্তবতা। আবেগ আর সুন্দরের স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সব জেনেশুনেই আমার আমাকে নিমজ্জিত করেছি কেশবতীর হিম সমুদ্রে। আমি কাউকে ডিসটার্ব করি না, বিরক্ত করি না। কেবল দুই চোখে দূর থেকে একটু দেখি কেশবতীকে। দেখাটুকুই আমার প্রেম। আমি তো হামলে পড়ছি না, কাউকে দখল করছি না, তাও সহ্য হচ্ছে না! আমাকে তো রক্ষা করতে হবে – রুখে দাঁড়ায় সৈকত হালিম।

কী করবেন আপনারা? কেন আসছেন আমার কাছে?

তোর পেটের ভুঁড়িটা নামিয়ে দেব হারামজাদা, মুরগি শামসু চাকু বের করে সৈকতের পেটের দিকে এগিয়ে যায় হাসিমুখে। সঙ্গে সঙ্গে মুরগি শামসুর হাতটা দু-হাতে ধরে ঝাঁকি দেয় সৈকত, আমাকে মারবেন কেন? কী করছি আমি?

হাসে মাকুন্দা, দুলাভাই দেহি কিচ্ছু জানে না! পেছন থেকে ধাক্কা মারে সৈকতকে। তখন মুরগি শামুসর চাকুসমেত দুই জোড়া হাতের ওপর প্রবল চাপ পড়ে। চাকুটা যেন কীভাবে দিগ্ বদলে আমূল বিঁধে যায় শামসুর বুকের মধ্যে। মুহূর্ত মাত্র, মুমূর্ষু চিৎকারে চাকু ছেড়ে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মুরগি শামসু। রক্তমাখা চাকু থেকে যায় সৈকত হালিমের হাতে। আশেপাশে যারা মজা দেখার জন্য মোবাইলে ছবি বা ভিডিও করছিল, সেইসব ভিডিওতে সৈকত হালিম জীবন্ত খুনির লেটার মার্ক পেয়ে পাশ করে। মালিবাগের মোড়ে নিরাপদ দূরত্বে রাজধানী রেস্টুরেন্টের সামনে বসে আড্ডা দেওয়া পুলিশদের দৌড়ে এক পথচারী খবর দেয়, খুন কইরা হালাইচে …

খুনের খবরে পুলিশের টনক নড়ে। দৌড়ে আসে ঘটনাস্থলে। পুলিশদের তেমন কষ্ট করতে হয়নি। কারণ রক্তাক্ত চাকু হাতে সৈকত হালিমকে পেছন থেকে জাপটে ধরে রেখেছে খালেক আর জিসান। নোমান খাসি আর মাকুন্দা রক্তাক্ত মুরগি শামসুকে ধরে চিৎকার করছে, একটা অ্যাম্বুলেন্স … অ্যাম্বুলেন্স …। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে পুলিশের ফোনে। এদিকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায় সৈকত হালিমকে। দুপুরের আগে ঘটা ঘটনায় হত্যাচেষ্টার মামলা রুজু করে হাতেনাতে ধরা আসামিকে কোর্টে চালান করে দেয় পুলিশ। কোর্ট সব দেখেশুনেবুঝে আসামিকে জেলহাজতে পাঠান।

হাসপাতালে নেওয়া হলেও মুরগি শামসু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায়। খুনের মামলায় একমাত্র আসামি সৈকত হালিম। ঢাকা শহরের অন্যান্য মামলার চেয়ে এই মামলায় গতি ছিল অন্যরকম। যেহেতু একমাত্র আসামির পক্ষে জেলে থেকে কিছু করার ছিল না। গ্রাম থেকে স্ত্রী-সন্তান ও কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন এসে দেখা করেছে। স্ত্রী সামিয়া জেলের গরাদের ফাঁক দিয়ে আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কেন খুন করেছিলে? সবাই বলে, আদালত বলে, তুমি খুন করেছো, কিন্তু আমি জানি তুমি খুন করতেই পারো না। বলো, তুমি খুন করেছো?

কোনো উত্তর দেয়নি সৈকত হালিম, তাকিয়েছিল অন্যদিকে।

খুনের ছয় মাসের মাথায় সাক্ষী-প্রমাণ সরাসরি থাকায় কোর্ট রায় ঘোষণা করেন,  মুরগি শামসু হত্যাকাণ্ডের একমাত্র আসামি সৈকত হালিমের মৃত্যুদণ্ড।

পত্রিকায় পাতায়, টিভি চ্যানেলে ছড়িয়ে পড়ে রায় …। বাংলাদেশের অনেক নাগরিকের মতো জেনে যায় মালিবাগের বেলায়েত হোসেনের স্ত্রী কেশবতীও। শোনার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরটা অব্যক্ত বেদনায় কেউ খামচে ধরে। বিশুদ্ধ নগ্ন হাহাকারে বুকটা খা খা করতে থাকে … কেশবতীর মনে হলো, চারপাশে নেমে এসেছে শোকের মিছিল, হাহাকার, করুণ রোদন …।  এই প্রথম মুরগি শামসু হত্যামামলার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামি সৈকত হালিমের জন্য চোখ ফেটে কান্না আসে তার। অতল বিপুল কান্না। 

কেশবতী এখনো মালিবাগের ফুটপাত, মালিবাগের মোড় পার হয়ে অফিসে যায়। যেতে যেতে দেখতে পায় বা অনুভব করে কেউ একজন পিছু পিছু হেঁটে আসছে তার। খুব আগ্রহ নিয়ে ফিরে তাকায়, কিন্তু তাকালেই আর দেখতে পায় না। কেশবতী প্রাণের সকল বাসনা দিয়ে কামনা করে, মানুষটা যদি আসতো! অন্তত একবার …