হেঁসেল থেকে হৃদয় : বাঙালির স্বাদ আর সাধের মেলবন্ধন

প্রখ্যাত লেখক শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর লেখায় নিজের জীবনের দুটি মাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন – ‘খাই আর শুই’। সাহস করে কিংবা লজ্জা ভেঙে মুখে না বললেও শিবরাম চক্রবর্তীর মতো ‘খাই আর শুই’ লক্ষ্য নিয়ে চলা বাঙালির সংখ্যা নেহায়েত কম হবে বলে বোধ করি না। আমরা খেতে বসে ‘ভাতঘুম’ দেওয়ার কল্পনায় উদ্বেলিত হই আবার ‘ভাতঘুম’ দিয়ে উঠে কী খেতে পারি সেই ভাবনাও মন থেকে সরে না। ভালো ভালো খাবারের কল্পনাতে শিবরাম যেমন বলেছেন, ‘মনে পড়লে এখনও জিভে জল আসে। নিজেকে সজিভ বোধ করি’, ঠিক তেমনি বাঙালি মাত্রই ‘সজিভ’ বোধ করে ‘সজীব’ থাকতে ভালোবাসে। 

‘পেটে খেলে পিঠে সয়’ বাঙালির কাছে খাবার কেবল জৈবিক উদরপূর্তির চাহিদা নয়। আর তাই বাঙালির কাছে বৈদিক সংস্কৃত অনুসারে ‘ভোজন’ শব্দের অর্থে সুখানুভূতি এবং খাদ্য দুটোই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আমাদের খেয়ে সুখ, খাইয়ে সুখ, খাবার কথা ভেবে সুখ, খাবার কথা বলে সুখ আবার কে কত বেশি খেতে পারি কিংবা খাওয়াতে পারি তার প্রচ্ছন্ন কিংবা অপ্রছন্ন তুল্যমূল্য বিচারে নেমেও সুখ। ‘ভোজন’-এর আনন্দযাপনে যোগ্যতার বিচারে কেউ আমরা ‘ভোজনবিলাসী’, কেউ বা ‘ভোজনরসিক’, কিংবা ‘ভোজনপটু’, কেউ বা ‘ভোজন বিশারদ’। প্রখ্যাত কথাসাহিতিক সৈয়দ মুজতবা আলী কিন্তু এ-ব্যাপারে তাঁর সুস্পষ্ট মতামত জানিয়ে গেছেন। তাঁর মতে, খাদ্যের হাজার রকমফের থাকলেও মোটাদাগে খাদক দু-প্রকার – ভোজনবিলাসী আর ভোজনপটু। ভোজনবিলাসীরা হাজার খাবারের ভিড়েও তাঁদের মন-মর্জি অনুযায়ী, তাঁদের রসনার ধার মাথায় রেখে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাবার উপভোগ করেন, সব খাবার তাঁদের রুচিতে না-ই সইতে পারে। অন্যদিকে ভোজনপটুদের খাবারে কোনো বাছবিচার নেই। পেটে জায়গা না থাকলেও তাঁদের মনের আর চোখের খিদে মরে না কখনো, কোনো অবস্থাতেই। খাবার হলেই হলো, তা সে যে-খাবারই হোক না কেন! খাবার হজমে তাঁদের পটুত্ব অবিসংবাদিত। তো সে আপনি ভোজনবিলাসীই হন কিংবা ভোজনপটু, বাঙালি মাত্রই ভোজনরসিক আর কেউ বা আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ভোজনবিশারদ। তাই বাঙালির সুখের বা আনন্দের উদযাপনে খাবারদাবারের বেশ এক যোগ আছে, সকলকে আয়োজন করে খাওয়ানোর চল আছে; আবার গভীর দুঃখের কিংবা শোকের আবহতেও বিশেষ খাবার বা বিশেষ করে খাবার ও খাওয়ানোর প্রথা চলে আসছে যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, সীমান্তের এপারে-ওপারে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। ‘ভজন’-এর চেয়ে ‘ভোজন’-এই বাঙালির আগ্রহ বেশি বরাবর।

বাঙালির এই বরাবরের ভোজনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে বাংলা ভাষার আদিপর্বে লেখা চর্যাপদে। প্রাকৃত-পৈঙ্গল কবি মাত্র চার পঙ্ক্তিতে ‘পুণ্যবান বাঙালি’র একটি কিংবা দুটি মাত্র নয়, চার-চারটি লক্ষণ তথা নিদর্শন বাতলে দিয়েছেন। দু-চারটে ভালো খাবার খেয়েই যে পুণ্যবান হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব, সে বাঙালি ছাড়া কে-ই বা কবে ভাবতে পেরেছে?

ওগ্গর ভত্তা রম্ভা পত্তা

কলাপাতায় গরমাগরম ভাত

গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সযুক্তা

গাওয়া ঘি, তার সঙ্গে দুধ

মোইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা

মৌরলা মাছ আর নালতে শাক

দিজ্জই কান্তা খাই পুনবন্তা।

নিত্য এসব পরিবেশনকারী গৃহিণীর কর্তাই পুণ্যবান বাঙালি।

গৃহস্থ পুণ্যবান বাঙালির খাদ্যতালিকায় প্রথমেই আছে ‘দুধ-ভাত’। চর্যাপদের কবির ভাবনার প্রতিফলনে সেই অষ্টাদশ শতকের মহাকবি ভারতচন্দ্র যে-অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন, শত শত বছর ধরে ছাপোষা বাঙালি কিন্তু মনেপ্রাণে দিবারাত্রি তার বংশধরদের শুভ আর কল্যাণ কামনায় সেই ‘দুধ-ভাত’কেই যাচনা করে এসেছে – ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। নিজে পুণ্যবান হয়ে ওঠার অভিলিপ্সা থেকে সন্তানের মঙ্গলের অভিপ্রায় – সবেতেই বাঙালি ভোজ্যের চিন্তা করে। এমন জাতের ভজনেও তাই ‘ভোজন’ জায়গা করে নেয় সহজে। যে-নামেই তাঁকে ডাকি না কেন – সৃষ্টিকর্তাকে তুষ্ট করতে ফলমূল থেকে শিন্নি কিংবা সন্দেশ, জিলিপি থেকে শুরু করে জোড়া পাঁঠা কিংবা ছাগল পর্যন্ত মানত করি প্রার্থনার তালিকায় চাহিদার ওজন বুঝে। আমাদের এই আন্তরিক ‘উৎসর্গ’ (পড়ুন ‘উৎকোচ’) প্রয়াসের মধ্যমণিতেও কিন্তু ভোজ্যতালিকা। আটপৌরে বাঙালির মতো বাঙালির পরম করুণাময়ও তাই ভোগে তুষ্ট হন। আর এভাবেই আমাদের বাঙালিদের ‘ভজন’-এর সমাপন আর উদ্যাপন হয় ‘ভোজন’-এ এসে।

বাঙালিয়ানার মর্মমূলের এই যে ভোজনপ্রিয়তা, তা থেকে নদীয়ার ছেলে খাস বাঙালি কৃত্তিবাসই বা বাদ পড়বেন কেন!  রামায়ণই লিখুন আর যা-ই হোক না কেন, ভুলে গেলে চলবে কেন তিনি নিজে যেমন বাঙালি, তেমনি তাঁর রামায়ণ তো বাঙালির জন্যই লেখা, তা নয় কি? তবে তাতে শুধু রামের নাম ‘ভজন’ থাকলে কী আর চলে, ভোজ্য আর ভোজন ছাড়া বাঙালির রামায়ণও কী আর পূর্ণতা পায় না কী! তাই কৃত্তিবাসী রামায়ণের আদিকাণ্ডে রাজা জনক তাঁর মেয়ের বিয়েতে অভ্যাগত অতিথিদের জন্য যে বিশাল আয়োজন করেছিলেন তার এক সবিশেষ বর্ণনা জুড়ে গেল। আর সেই ভোজ্য বা ভোজনের বর্ণনাতে প্রয়োগকৃত শব্দবন্ধসমূহ উৎসবের বিশালতা, রাজার সম্পদের প্রাচুর্য এমনকি তৎকালীন সমাজের প্রথা, রীতি-আচার সব কী স্পষ্ট করেই না প্রকাশ করে। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে কৃত্তিবাসী রামায়ণের সময়কে ছাড়িয়ে এসে হালের একুশ শতক অবধি ধর্ম-বর্ণ-আঞ্চলিকতার সীমানা ছাড়িয়ে সকল বাঙালির কাছেই দুধ আর ঘি প্রাচুর্য আর সম্পদের নিদর্শন, শুভ আর কল্যাণের প্রতীক। তাই বাঙালির স্বর্গের বর্ণনাতে ‘দুধের নহর’ বয় আর তার গৃহকোণে সন্তান রয় দুধে আর ভাতে। তবে কৃত্তিবাসী রামায়ণে দুধের সরোবর বইয়ে ছেড়েছেন।

… ঘৃত দুগ্ধে জনক করিলা সরোবর।

স্থানে স্থানে ভাণ্ডার করিলা মনোহর।।

রাশি রাশি তন্ডুল মিষ্টান্ন কাঁড়ি কাঁড়ি।

স্থানে স্থানে রাখে রাজা লক্ষ লক্ষ হাঁড়ি।।

…   …   …

ভারে-ভারে দধি দুগ্ধ ভারে-ভারে কলা।

ভারে-ভারে ক্ষীর ঘৃত শর্করা উজলা।।

সন্দেশের ভার লয়ে গেল ভারিগণ।

অধিবাস করিবারে চলেন ব্রাহ্মণ।।

দুধ, কলা আর সন্দেশের এই কৃত্তিবাসী বর্ণনা পড়তে গিয়ে আমি নিশ্চিত যে-কোনো বাঙালিরই মনে পড়ে যাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাঁচা বয়সে লেখা এই চারখানি ছত্র, যার পরতে পরতে স্বাদ, গন্ধ আর অনুভূতির মিশেলে ত্রিমাত্রিক চিত্রকল্প আঁকা হয়ে রয়েছে। বয়সখানা হোক না কাঁচা, তবে বাঙালির ছেলে রবি ঠাকুর সেই বয়সেই তাঁর ভোজনপটুত্বে বেশ সড়গড় ছিলেন তা কিন্তু একেবারে স্পষ্ট।

আমসত্ত্ব দুধে ফেলি,         তাহাতে কদলী দলি,

সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে –

হাপুস হুপুস শব্দ          চারিদিক নিস্তব্ধ,

পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।

জীবনের উত্তরকালে রবি ঠাকুর হেমন্তবালা দেবীর মেয়ে বাসন্তীকে লিখেছেন – ‘আমাকে পেটুক বলে যদি কল্পনা কর তাহলে ভুল করবে। আমি যতটা খাই তার চেয়ে গুণ গাই বেশি।’ আর ঠিক এখানটাতেই গুরুদেব একেবারে বাঙালিয়ানার মোদ্দা কথাটা বলে দিয়েছেন, ‘যতটা খাই তার চেয়ে গুণ গাই বেশি’। পেটুক থেকে পেটরোগা সকল বাঙালিই যতটা খায় তাঁর চেয়ে খাবারের গুণকীর্তন করেন বহুগুণ বেশি। বাঙালির মনের হালচাল রবি ঠাকুরের চেয়ে কে-ই বা কবে বেশি বুঝেছেন। তাই তো তাঁর সহজ পাঠের প্রথম ভাগেই খাবারের ছড়াছড়ি –  ‘হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ/ বসে খায় ক্ষীর খই’, কিংবা ‘বাটি হাতে এ ঐ/ হাঁক দেয় দে দৈ’, অথবা ‘ডাক পাড়ে ও ঔ/ ভাত আনো বড় বৌ’, আবার আছে ‘ত থ দ ধ বলে, ভাই/ আম পাড়ি চল যাই’। এছাড়াও প্রথম পাঠে আছে – ‘পাতু পাল আনে চাল’, ‘খুদিরাম পাড়ে জাম’, ‘দীননাথ রাঁধে ভাত’ – এমনসব উদাহরণ। দ্বিতীয় ভাগে আছে এলাহী আয়োজনের স্বাদে আর গন্ধে মাখামাখি দারুণ চিত্রকল্প।

থালা ভরা কৈ মাছ, বাটা মাছ। সরা ভরা চিনি ছানা। গাড়ি গাড়ি আসে শাক লাউ আলু কলা। ভারী আনে ঘড়া ঘড়া জল। মুটে আনে সরা খুরি কলাপাতা। রাতে হবে আলো। লাল বাতি। নীল বাতি। কত লোক খাবে।

আর তৃতীয় পাঠের বর্ণনাতে চাল, ডাল, আটা থেকে শুরু করে একদিকে শাক, অন্যদিকে আতা, আখ, জাম কী নেই! আরো আছে খাজা, গজা আর ছানার উল্লেখ। সহজ পাঠের সমস্তটা জুড়ে দেখা মেলে রাজসিক ভোজনের বর্ণনা থেকে মাটির দাওয়ায় বসে খাবার এমনতর বর্ণনা – এ যেন সত্যিকার অর্থেই পড়তে পড়তে খাওয়া। ‘উচ্ছে বেগুন পটল মূলো’, ‘সর্ষে ছোলা ময়দা আটা’, ‘কলসি-ভরা এখো গুড়ে’, ‘আস্ত কাতলা মাছ’, ‘বস্তা থেকে গুন্তি ক’রে ত্রিশটা আলু’ – এই যে সহজ পাঠ জুড়ে এতো ভোজ্য জিনিসের উল্লেখ করেছেন, বিবরণ দিয়েছেন রবি ঠাকুর; তার পেছনেও আমার ধারণা সেই বাঙালির খাদ্যপ্রিয়তা বা খাদ্যরসিকতা তো বটেই, তার চেয়ে বড় ‘যতটা খাই তার চেয়ে গুণ গাই বেশি’ মানসিকতাকে তিনি মাথায় রেখেছেন। বই পড়তে পড়তে মনের খিদে, পেটের খিদে দুই-ই চাগিয়ে উঠলে তবেই না বাঙালির পঠন আর পাঠে আনন্দ আসবে। আমাদের শিক্ষায় আনন্দের অনুপস্থিতি তাঁকে বরাবর ভাবিত করেছে, উদ্বিগ্ন করেছে।

… হাওয়া খাইলে পেট ভরে না, আহার করিলে পেট ভরে; কিন্তু আহারটি রীতিমত হজম করিবার জন্য হাওয়া খাওয়া দরকার। … আনন্দের সহিত পড়িতে পড়িতে শক্তি অলক্ষিতভাবে বৃদ্ধি পাইতে থাকে; গ্রহণশক্তি, ধারণাশক্তি, চিন্তাশক্তি বেশ সহজে এবং স্বাভাবিক নিয়মে বললাভ করে।

কাঁচা বয়সে যে-ছেলে দুধে সন্দেশ আর আমসত্ত্বের মাখামাখিতে পিঁপড়ার মনোবেদনা বুঝেছিলেন, আবার পাকা বয়সে এসে যিনি পাকা হাতে দামোদর শেঠকে তুষ্ট করতে মুড়কির মোয়া থেকে ভাজা ভেটকি আর কই মাছ সঙ্গে বোয়ালের পেট থেকে নিয়ে কাঁকড়ার ডিমের লম্বা ফর্দ বাতলে দিয়েছেন সুনিপুণভাবে; অন্তত তাঁর জন্য চিরচেনা আর মনপসন্দ খাবারের উল্লেখে যে ‘সজিভ’ বাঙালির মন আর মাথা দুই-ই সজীব হয় আর তাতে ‘গ্রহণশক্তি, ধারণাশক্তি, চিন্তাশক্তি বেশ সহজে এবং স্বাভাবিক নিয়মে বললাভ করে’ সে-বিষয়ে তো বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা সন্দেহ থাকার কথাই নয়। 

সৈয়দ মুজতবা আলীর বিধান অনুসারে, আমিষ আর নিরামিষ দুই-ই বাঙালির হেঁসেল আর হৃদয় জুড়ে আছে আদি অনন্তকাল। সেই প্রাচীনযুগে চর্যাপদের বর্ণনাতে যেমন ধোঁয়া-ওঠা গরম ভাতে ঘিয়ের সঙ্গে নালতা শাক আছে, আছে মৌরলা মাছও। আবার পঞ্চদশ শতকে মনসামঙ্গল কাব্যে বরিশালের বিজয় গুপ্ত দিয়েছেন বিশাল লম্বা ফিরিস্তি, যা নিরামিষে শুরু হয়ে আমিষে পৌঁছে শেষ হয় নাভিশ্বাসে!

রান্ধি নিরামিষ ব্যঞ্জন হলো হরষিত।

মেস্যর ব্যঞ্জন রান্ধে হয়ে সচকিত

মৎস্য মাংস কুটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।

রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলকাতার আগ

মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাচ গাচ

ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে খরসুল মাছ

ভিতরে মরিচ-গুঁড়া বাহিরে জড়ায় সূত।

তৈলে পাক করি রান্ধে চিঙড়ির মাথা

ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল।

বাঙালি বাস্তবিক অর্থেই ‘মাছে-ভাতে’ বাঙালি। প্রখ্যাত লেখক নীহাররঞ্জন রায় তার বাঙালির ইতিহাস বইতে লিখেছেন, ‘ইতিহাসের ঊষাকাল হইতেই ধান যে-দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন বস্তু, সে-দেশে প্রধান খাদ্যই হইবে ভাত তাহাতে আশ্চর্য হবার কিছু নাই।’ নদীঘেরা বঙ্গভূমির বাসিন্দাদের মৎস্যপ্রীতিও তাই খুব সহজাত, প্রকৃতিদত্ত অভিরুচি বলেই ধরে নেওয়া চলে। নীহাররঞ্জনও তেমনটাই লিখেছেন – ‘বারিবহুল, নদনদী-খালবিল বহুল, প্রশান্ত-সভ্যতাপ্রভাব … বাঙলায় মৎস্য অন্যতম প্রধান খাদ্যবস্তু রূপে পরিগণিত হইবে, ইহা কিছু আশ্চর্য নয়।’ বাঙালির মৎস্যপ্রেম তাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত, সীমানার এপারে ওপারে সমভাবে বিরাজমান। একদিকে রাঢ় দেশের প্রাচীন শাক্ত কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর বর্ণনাতে যেমন মেলে –

ঘৃতে ভাজাপলা কড়ি , উনটা শাকে ফুলবড়ি

চিংড়ি কাঁঠালবীচি দিয়া

অথবা, মসুরি মিশ্রিত মাস সূপ রাঁধে রস বাস

হিঙ্গ জীরা বাসে সুবাসিত।

ভাজে চিতলের কোল রোহিত মৎস্যের ঝোল

মান বড়ি মরিচে ভূষিত।

অন্যদিকে ময়মনসিংহের দ্বিজ বংশীদাস তাঁর মনসামঙ্গল-এ লিখেছেন –

বড় বড় কই মৎস্য, ঘন ঘন আঞ্জি

জিরা লঙ্গ মাখিয়া তুলি তৈলে ভাজি।

কাতলের কোল ভাজে, মাগুরের চাকি।

চিতলের কোল ভাজে রসবাস মাখি

ইলিশ তলিত করে, বাচা ও ভাঙ্গনা।

শউলের খণ্ড ভাজে আর শউল পোনা।।

শুধু কী আর প্রাচীন কবিরা, বুদ্ধদেব বসুর মতো আধুনিকতম বাঙালি কবিও ইলিশ নিয়ে আস্ত একটি কবিতা লিখেছেন Ñ

রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে

জলের উজ্জ্বল শষ্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,

নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।

তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে

ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার

সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।

এই যে ইলিশের কথা বলতেই ‘সরস সর্ষে’র প্রসঙ্গ এসে যায়, সৈয়দ মুজতবা আলীর বর্ণনায় ‘মাছের সঙ্গে সর্ষে, যেন রবীন্দ্রসংগীতে কথার সঙ্গে সুরের মিলন।’ তাই বলি, বাঙালি আর তার রবীন্দ্রসংগীত যদি এক অমোঘ প্রেমের সম্পর্কে বাঁধা থাকে, তবে অন্যদিকে বাঙালির আরেক অমর গভীর প্রেম তার মৎস্যপ্রীতি। আর তাই বাঙালির আকাশ থেকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি ঝরে। ‘ভাজা মাছ উলটে খেতে না জানা’ বাঙালি ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে’ জানে আর কেউ কেউ তো আবার ‘গভীর জলের মাছ’। বাঙালির মনুষ্য সমাজেও তাই ‘রাঘববোয়াল’ থেকে শুরু করে ‘চুনোপুঁটি’রা বাস করে খুব স্বাভাবিকভাবেই। আর সে-কারণেই ভোজনপটু বাঙালি রসিক জিহবার রসদের খোঁজে প্রাচ্য, প্রতীচ্য কিংবা পাশ্চাত্য যেখানেই যাক না কেন শেষমেশ সেই চিরচেনা মাছে-ভাতেই ভেতো বাঙালির মন ভরে। সেই যে সৈয়দ মুজতবা আলী যেমনটা লিখেছেন যে, জাহাজে মাসের পর মাস ঘুরে বেড়ানোর সময় হরেকরকম আহামরি খাবার আস্বাদনের সুযোগ পাওয়ার পরও তাঁর মনটা কাঁদছিল চারটে আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনামুগের ডাল, পটোল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য।  এই না হলে আর বাঙালি কিসে?

‘সজিভ’ বাঙালির জিহবা বড় সড়গড়ে। আর হবে না-ই বা কেন! তার হেঁসেলে নিত্য তৈরি হয় নানান রকম ভাজা, সেদ্ধ, পোড়া, বাটা, ভর্তা, তেতো, শুক্তো, ছেঁচকি, ডালনা, চচ্চড়ি, ঝাল, ঝোল, ঘণ্ট, রসা, পাতুরি, কালিয়া, রেজালা, মালাইকারি, দোলমা, অম্বল, টক, চাটনি – আরো কত কী! বাঙালির রসনাবিলাস নিয়ে লিখতে গিয়ে জলে ডাঙায় গ্রন্থে সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, ‘আমরা তেতো, নোনা, ঝাল, টক, মিষ্টি – এই পাঁচ রস দিয়ে ভোজন সমাপন করি।’ আর শংকর আরো একটু এগিয়ে পাঁচের জায়গায় বাঙালি রসনার সাধ মেটাতে ছ-রকম স্বাদের উদ্যাপনের কথা লিখেছেন – ‘ঝাল, নোনতা, মিষ্টি, তিক্ত, অমø­, কষায়’। আমরা নিরামিষ- আমিষ যা-ই খাই না কেন; রাজসিক ভোজই খাই অথবা সাধারণ ভাজা-ভর্তা-ঝাল-ঝোল-অম্বল, শেষ পাতে মিষ্টিমুখ না হলে বাঙালির তৃপ্তির ঢেঁকুর ওঠে না ঠিকমতো। মিষ্টি অন্তঃপ্রাণ বাঙালির আতিথেয়তায় মিষ্টি, সৌজন্য আর ভদ্রতা রক্ষায় মিষ্টি, জন্মের খবরে কিংবা বিয়েশাদির খবর থেকে পরীক্ষায় ভালো ফল তো চাকরিপ্রাপ্তিসহ সকল ভালো খবরে চাই মিষ্টি, আবার শ্রাদ্ধ বা কুলখানিতেও মিষ্টি না হলে চলে না।

এই যে সব ভালো খবরে বাঙালি শুধু মিষ্টি খেয়ে নয়, খাইয়েও তৃপ্ত হয়। এর মাঝেই বাঙালির প্রিয় ‘সন্দেশ’-এর মাজেজা নিহিত আছে। সংস্কৃত থেকে আসা ‘সন্দেশ’ শব্দের অর্থ সংবাদ বা খবর। আগেকার কালে ভালো খবর আত্মীয়বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য লোক পাঠানো হতো। আবার বিয়েশাদি, অন্নপ্রাশনসহ কোনো অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পত্র মারফত পাঠানোর চল ছিল না। নিমন্ত্রণকর্তাকে নিজে গিয়ে অতিথিকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে আসতে হতো। এর কোনোসময়েই খালি হাতে যাওয়ার বা লোক পাঠানোর নিয়ম ছিল না, সঙ্গে নিতে হতো কিংবা পাঠাতে হতো মিষ্টি। রসসিক্ত মিষ্টির ঝামেলা এড়াতে এসব ক্ষেত্রে রসবর্জিত মিষ্টিই পাঠানো হতো। শুভকর্মের সংবাদবাহী এই মিষ্টি, তাই এর নাম হলো সন্দেশ। এই আদিযুগের সন্দেশ কিন্তু ছানার নয়, বরং ছিল ক্ষীরের। এমনকি বৈষ্ণব সাহিত্যে যে সন্দেশের উল্লেখ আছে তাও ক্ষীরের সন্দেশ। সেকালে আবার কখনো সন্দেশ তৈরি হতো বেসন, নারিকেল আর মুগডালের সঙ্গে চিনিসহযোগে। এছাড়া কেবল চিনি দিয়ে তৈরি এক ধরনের চাক্তিকেও সে-সময় সন্দেশ বলা হতো। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস বইতে যে সন্দেশের বর্ণনা দিয়েছেন, তা চিড়া আর নারিকেল মিশিয়ে তৈরি ‘কোজাগর পূর্ণিমার রাতে আত্মীয়-বান্ধবদের চিপিটক বা চিঁড়া এবং নারিকেলের প্রস্তুত নানা প্রকার সন্দেশ পরিতৃপ্ত করিতে হইতো।’ তাঁর এ-বইয়ে বাঙালির মিষ্টিজাতীয় খাদ্যের বর্ণনাতে সংগত কারণেই কোনো ছানার মিষ্টির উল্লেখ মাত্র নেই।

বাঙালিরা ছানা তৈরি করতে শিখেছে অনেক পরে (ধারণা করা চলে পঞ্চদশ শতকে) পতুগিজদের কাছ থেকে। দুধ  থেকে ঘি এবং দুধ ঘন করে ক্ষীর বানানোর প্রণালি বাঙালি কারিগরের জানা ছিল আদিকাল থেকে। কিন্তু পতুগিজদের কাছ থেকে শিখে কোন বাঙালি কারিগর প্রথম ছানা বানিয়েছিলেন, তা কিন্তু জানা যায় না। আজ বাঙালির রসনা পরিতৃপ্তিতে ছানা দিয়ে তৈরি নানান রকমের মিষ্টির তালিকা খুব লম্বা হলেও ধর্মবিশ্বাস আর আচারের ঘোরপ্যাঁচে শুরুর দিকে ছানা আর ছানার মিষ্টি এক প্রকার ব্রাত্য-পরিত্যাজ্য হয়েই ছিল। এ প্রসঙ্গে ইতিহাসবেত্তা সুকুমার সেন তাঁর কলিকাতার কাহিনী বইতে লিখেছেন :

ক্ষীর-মাখন-ঘি-দই – এগুলো কাঁচা দুধের স্বাভাবিক পরিণাম, কৃত্রিম অথবা স্বাভাবিক। কিন্তু কোনোটিই দুধের বিকৃতি নয়। ‘ছানা’ কিন্তু ফোটানো দুধের কৃত্রিম বিকৃতি। বাঙালি অন্য দ্রব্য সংযোগ করে দুধ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, যাতে সারবস্তু ও জলীয় অংশ পৃথক হয়ে যায়। এভাবে দুধ ছিন্নভিন্ন করা হয় বলেই এর নাম হয়েছিল বাংলায় ‘ছেনা’, এখন বলা হয় ‘ছানা’। সংস্কৃত ভাষায় ছানার কোনো রকম উল্লেখ নেই। অন্য ভাষাতেও ছিল না। আগে অজ্ঞাত ছিল বলেই শাস্ত্রসম্মত দেবপূজায় ছানা দেওয়ার বিধান নেই।

চর্যাপদেও মিষ্টান্নের উল্লেখ আছে, দুধ-চাল সহযোগে পরমান্নের উল্লেখ আছে প্রাচীন আর মধ্যযুগীয় সাহিত্যে। ইতিহাসবিদদের মতে, মোতিচুর লাড্ডু নাকি দু-সহস্র বছরেরও বেশি পুরনো। সেদিক থেকে আধুনিক সন্দেশ আর রসগোল্লা বেশ নবীন, মাত্র দুশো-আড়াইশো বছর বয়সী। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে চিনির সঙ্গে ছানার সংযোগে একালের রসগোল্লা আর সন্দেশ উদ্ভাবন হলে ক্রমাগত এদের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, যা আজ পর্যন্ত অটুট আছে। আদিকালের সন্দেশের চেয়ে তুলনামূলকভাবে মিষ্টি কম বলে, প্রথম প্রথম ছানার সন্দেশকে লোকে ‘ফিকে সন্দেশ’ বলে সম্বোধন করতো। কিন্তু কালে কালে অভিজ্ঞ অনুসন্ধিৎসু বাঙালি ময়রারা কড়াপাক, নরমপাক, কাঁচাগোল্লা, প্রাণহরাসমেত নিত্যনতুন বহু রকমের সন্দেশ বানিয়ে বাঙালির রসনা তৃপ্ত করে চলেছেন আজ অবধি। সে-কারণেই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শংকর তাঁর বাঙালির খাওয়া দাওয়া বইয়ে লিখেছেন, ‘ছানা ও চিনি অনেকটা সাহিত্যের কাগজ ও কলমের মতো – রবীন্দ্রনাথের হাতে পড়লে এক রকম ফল, আর হরিদাস পালের হাতে পড়লে আরেক রকম।’ তাঁর কথায়, এই ময়রা তথা মিষ্টির কারিগরেরা ‘আমেরিকান বিজ্ঞানীদের মতো পাইকিরি হারে মিষ্টি শাস্ত্রে নোবেল জয়ী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।’ 

বাঙালির একান্ত নিজস্ব আবিষ্কার সন্দেশ নিয়ে নিরীক্ষার যেমন শেষ নেই, শেষ নেই আদিখ্যেতারও।  কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাঙালিকে দু-ভাগ করলেও সন্দেশের প্রতি ভালোবাসায় ভাগ বসেনি কস্মিনকালেও। ক্ষীরের সন্দেশ, নারকেলের সন্দেশসহ নানান বৈচিত্র্যের সঙ্গে ছানার প্রকরণ যুক্ত হওয়ার পর সেই যে গুপো সন্দেশ দিয়ে যাত্রা শুরু হলো তাতে কালক্রমে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য অনন্য প্রকারভেদ – নরমপাক, কড়াপাক, জলভরা, পেড়া সন্দেশ, প্রাণহরা – যার কোনোটা চিনির, কোনোটা গুড়ের। গুড়ের কথা যখন এলোই, তখন নলেন গুড়ের সন্দেশের প্রতি বাঙালির দুর্বলতার কথা না উল্লেখ করলেই নয়। কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে শুরু করে চৈতন্য চরিত হয়ে রবিঠাকুরের ‘পেটে ও পিঠে’ পেরিয়ে আজ অবধি নানান আকারের, নানান পাকের, নানান স্বাদ-গন্ধ-নকশার সন্দেশে বাঙালির মন মজে আছে।

শুধু সন্দেশে বাঙালির রসিক মন ভরে কী!! মধ্যযুগ থেকেই বাঙালি হালুইকরেরা নিত্যনতুন মিষ্টি তৈরির যে নিরন্তর প্রয়াস শুরু করেছিলেন, একালেও দুই বাংলার আধুনিক ময়রারা তা অব্যাহত রেখেছেন। নানান সন্দেশ ছাড়াও ছানা দিয়ে তৈরি রসগোল্লা, চমচম, পানতুয়া, কালোজাম, লালমোহন বাঙালির চিরচেনা সব মিষ্টি। ওপার বাংলাতে নানান জেলার মধ্যে মিষ্টি নিয়ে বেশ এক ‘মিষ্টি’ প্রতিযোগিতাও আছে, আর তাতে আখেরে লাভ সব বাঙালিরই। সীমান্তের এদিকে যদি হয় বরিশালের গৌরনদীর রসগোল্লা, তো অন্যদিকে কলকাতার বাগবাজারের রসগোল্লা। একপারের টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কিংবা নাটোরের কাঁচাগোল্লা আর ক্ষীর তক্‌তি বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী, তো অন্যদিকে বর্ধমানের মিহিদানা আর সীতাভোগ, কৃষ্ণনগরের সরভাজা কিংবা জয়নগরের মোয়া। আবার কুমিল্লার রসমালাই, মুক্তাগাছার মণ্ডা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, ফরিদপুরের মালাই সর কিংবা যশোরের দানাদার খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে না তুলতেই মনে পড়বে হুগলীর মনোহরা বা শক্তিগড়ের ল্যাংচা বা নদীয়ার পানতুয়া কিংবা মুর্শিদাবাদের ছানাবড়া বা আলিপুরদুয়ারের কমলাভোগের নাম।

১৯০৬ সালে প্রকাশিত শুভবিবাহ গ্রন্থে লেখিকা শরৎকুমারী চৌধুরাণী ব্যাপারীবাড়ির একবেলার খাবার আয়োজনের শেষ পাতে যে মিষ্টির তালিকা দিয়েছেন তাতে আছে খাজা, গজা, দরবেশ মেঠাই, বরফি সন্দেশ, ক্ষীরের লাড্ডু, গুজিয়া, গোলাপজাম, পেরাগী। ‘ইহার ওপর ক্ষীর, দধি, রাবড়ি ও ছানার পায়েস।’ এই যদি হয় শেষ পাতে ‘মিষ্টিমুখ’-এর নমুনা তখন কল্পনার লাগামে খুব ছাড় না দিলেও ভোজনপর্বের শুরু বা মাঝের পর্বটুকু ভাবতে বেগ পেতে হয় না। কী নেই তাতে – লুচি, কচুরি, আলুর দম, রাধাবল্লভী, শিঙাড়া, বেগুনভাজা, পটোল ভাজা থেকে শুরু করে পোলাও, কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারি, মাছ দিয়ে ছোলার ডাল, রুই মাছের মুড়ো দিয়ে মুগডাল, মাছের চপ, চিংড়ির কাটলেট, ইলিশ ভাজা, কই মাছ অবধি পৌঁছে আছে চাটনি, পাঁপড় ভাজা। তাতেও শেষ নেই, আরো আছে – ‘একখানা খুরিতে আম, কামরাঙ্গা, তালশাঁস …।’ এসব সামলে তবে না শেষ পাতে মিষ্টিমুখ হবে – বাঙালির অতিপ্রিয় ‘মধুরেণ সমাপয়েতঃ’। সাধে কী শংকর লিখেছেন, ‘খেয়ে আর খাইয়েই তো বাঙালি ফতুরানন্দস্বামী হয়েছে চিরকাল’ (বাঙালির খাওয়া দাওয়া)! আমরা বাঙালিরা খেয়ে বাঁচি না শুধু, খাবার জন্যই বাঁচি। আর তাই তো মরার প্রসঙ্গেও খাবার কথাই মাথায় আসে বলে আমরা ‘খাবি খেয়ে’ মরি।

আমাদের বারো মাসে তেরো পার্বণ চলে এসেছে আদিকাল থেকেই আর তার উদ্যাপনের অপরিহার্য অংশ হলো উদরপূর্তির আয়োজন। আমাদের খিদে পেলেও ‘পেট পুড়ে’, মন কাঁদলেও ‘পেট পুড়ে’। তাই উৎসবের আয়োজনে (এমনকী শোকগ্রস্ত বাড়িতেও) আমাদের অনুভূতির প্রকাশ ঘটাই আমরা খেয়ে আর খাইয়ে। ‘পেট ঠান্ডা তো মন আর মাথা ঠাণ্ডা’ – বাঙালি এই বারো মাসে তেরো পার্বণ ছাড়াও শুধু সুযোগ খোঁজে নিজে খাবার আর অন্যকে খাওয়ানোর। তাই তো তার আছে গরমকালে আম, কাঁঠাল কাঁচা থেকে পাকা হওয়ার নানান স্তরে তাদের ঘিরে নানা আয়োজন। কাঁচা আম পুড়িয়ে সরবত তো কেঁচে বা কেটে আচার বা চাটনি, আর পাকলে ফল হিসেবে তো খাওয়া চলেই সঙ্গে চলে আমের সরবত, লস্যি, দই থেকে সন্দেশ পর্যন্ত। এঁচোড় থেকে শুরু করে মিষ্টিমধুর পাকা কাঁঠাল ইস্তক আমাদের হেঁসেলে উদ্যাপিত হয়। একটু বৃষ্টি নামলো কী তো বাঙালির উনুনে খিচুড়ি চাপবেই। একটু শীত পড়লো তো নতুন গুড় আর চালের গুঁড়া সঙ্গে নিয়ে জমে যাবে পিঠেপুলির আয়োজন। আর যদি কোনো উপলক্ষ একান্ত না-ই থাকে, অন্তত এক পেয়ালা চা খাবার অছিলায় বাঙালি ‘চা’ আর ‘চায়ের সঙ্গে টা’ – শিঙারা, ডালপুরি, কচুরি, পেঁয়াজু, বেগুনি বা অন্য কোনো ‘তেলেভাজা’, নিমকি অথবা আর কিছু না হোক দু-খানা ‘বিস্কুট’ নিয়ে বসে দুর্দান্ত দুরন্ত আড্ডা দিয়ে পেটের খিদে, মনের খিদে সব মেটাতে পারি।

আজকের বৈশ্বিক বাঙালির যাপিত জীবনের দিনপঞ্জিতে যুক্ত হয়েছে তেরো পার্বণের বাইরে আরো নিত্যনতুন উপলক্ষ। বাঙালির রসনাবিলাসেও পড়েছে বৈশ্বিকতার ছাপ। রুটি, লুচি থেকে বেগেল বা পিঠা; ভাজা-ভর্তা-ঝোল-ভুনা থেকে গ্রিলড, ফ্রায়েড, বেকড, ম্যাশড; চচ্চরি থেকে স্টারফ্রায়েড, শিঙাড়া-চপ থেকে বার্গার-পিজ্জা; ভাত-পোলাউ থেকে পাস্তা-নুডলস – সব আছে আমাদের হেঁসেলে, আমাদের হৃদয়ে। স্বাদ আর সাধের মেলবন্ধনে আজ বাঙালি সত্যিকারের বৈশ্বিক। কথাসাহিত্যিক শংকরের উদ্ধৃতি টেনেই বলি, বাঙালির খাওয়াদাওয়ার ‘ইতিহাস আছে, ভূগোল আছে, দর্শন আছে, রসায়ন তো আছেই। সেইসব নিয়েই বাংলার রান্নাঘরে সৃষ্টিসুখের উল্লাস’ চলে নিরন্তর। তাই বাঙালির খাবার গল্প আর খাওয়ানোর গল্প ‘ফুরোয় না আর নটে গাছটিও মুড়োয় না।’