স্বপ্নসুখের কথকতা

পা ফেলতে ফেলতে থমকে দাঁড়ায় হরনাথ। কী এক মায়াবী আকর্ষণে বারবার পেছনে ফিরে তাকায় বুড়ো হরনাথ। আকাশের দক্ষিণ-পূর্বদিককার আগুনের গনগনে আভা হরনাথকে ভীষণভাবে চমকে দেয়।

কার ডাকে-পদশব্দে সম্বিৎ ফিরে পায় হরনাথ। জয়নাল-মাইজপাড়ার তাজু বেপারির পড়ুয়া ছেলে – এখন মুক্তিবাহিনীর জাঁদরেল কমান্ডার। তাকে ইশারায় তাড়া দেয় জয়নাল – ‘একটু পা চালিয়ে হাঁটো কাকা, রাত পড়ে আসছে।’

শেষরাতের আকাশ। সারা আকাশজুড়ে এক ধরনের আলো-আঁধারি জোছনা। একরাশ ছোপ ছোপ অন্ধকার এই মø­ান জোছনার সঙ্গে যেন এলোমেলোভাবে মিশে আছে। চারদিকে ঝিরঝিরে খোলামেলা বাতাস।

এই খোলা জনমানবহীন আকাশের নিচে পথ চলতেও কেন জানি ওদের বড়ো একটা একা লাগে না। মুক্তিযোদ্ধা জয়নালের দিকে একটু আড়চোখে তাকিয়ে বুড়ো শরীরের অথর্ব পা দুটো থপাথপ্ অগোছালোভাবে ফেলে এগিয়ে যায় হরনাথ। পালিয়ে-ছোটা লোকজনের দলটি এরই মধ্যে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে।

পালাচ্ছে ওরা। দিকচিহ্নহীনভাবে ছুটছে। কোথায় – কেউ তা জানে না। সবার মুখে শুধু এক কথা। কাল ভোরে ভোরে গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারি আসবে। লোকমুখের খবর, মিলিটারি এখন ঘাটকূল পর্যন্ত এসে গেছে। এই ঘাটকূল থেকে আমানতগঞ্জের বড় রাস্তা ধরে তাদের সোমপুর গ্রামে আসতে বড়জোর ঘণ্টাতিনেক সময় লাগার কথা। এরই মধ্যে সবাই হিসাব করে দেখেছে রাত্রে না হলেও ভোরে আমানতগঞ্জের রাস্তা ধরে এগোলে সকাল নাগাদ নিশ্চিতভাবে সোমপুরে এসে পৌঁছাবে মিলিটারিরা। তার পরের বীভৎস হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ, লেলিয়ে দেওয়া বিহারি-রাজাকারদের সম্ভ্রমহানি-তাণ্ডব এগুলো কে সামাল দেবে? তাই এই শেষরাতে চারদিকে এক শব্দ – গ্রাম ছাড়ো-গ্রাম ছাড়ো, পালাও-পালাও মিলিটারি আসছে।

পাকিস্তানি মিলিটারি ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের হামলার মুখে এই সোমপুরের মাথা-মুরুব্বিরা কিন্তু বসে ছিল না। মণ্ডলবাড়ির আফাজউল্লা, মাইজপাড়ার মফজল সারাং, হাইস্কুলের আফতাব মাস্টার, পালপাড়ার গগন মিত্তির, ধরবাড়ির বিনোদ ধর সবাই দফায় দফায় শলাপরামর্শ করেও মিলিটারিদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার কোনো উপায় খুঁজে বের করতে না পেরে চুপসে গেছে সকলে।

শেষ পর্যন্ত সবাই বিবেক-আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান চোরা রেশন ডিলার ইনু মিয়ার কাছেও ধরনা দিলো। ইনু মিয়া পান-দোক্তা খাওয়া মুখে ওদের শুধু একটা কথাই বলল, ‘তা মিয়ারা আমি হইলাম গিয়া পিচ্ কমিটির চেয়ারম্যান, মুখ্য-সুখ্য মানুষ। আপনারা হইলেন গাঁয়ের মাথা-মানতি। আমি আপনাগো কী বুদ্ধি দিমু? তয় আমার একটা কতা হইল – লোকজন গাঁ না ছাইড়লে মনে হয় ভালা হয়। সদরের ক্যাম্পে মেজর সাহেবের কানে কতাডা পৌঁছলে সাহেব খুব খুশি হইত।’

ইনু মিয়ার প্যাঁচানো কথা শুনে ওরা আর সেখানে দাঁড়ায়নি। পরে ওরা ধরে বসল মাইজপাড়ার বেপারিবাড়ির ছেলে জয়নালকে। জয়নাল এখন এ-তল্লাটের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। এদিককার মুক্তিবাহিনীর যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পুরোধা।

জয়নাল পরিষ্কার বলল, ‘মিলিটারি যে এদিকে আসছে তা নিশ্চিত কথা – তার খবরাখবর আমাদের কাছে আছে। তাই সবাইকে বৈষয়িক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেই গ্রাম ছেড়ে সরে পড়তে হবে। তাতে আর যা হোক না হোক অন্তত প্রাণ-মান-সম্ভ্রমটা বাঁচানো যাবে। কোলাকান্দির হাইকমান্ড এটাও ভেবে দেখেছে – যদি মিলিটারিরা এদিকে এসে যায় তবে সন্তোষপুর-মনখোলা ব্রিজ দুটো মাইন বসিয়ে উড়িয়ে দিয়ে ত্বরিত ফিরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে পূর্ব-পশ্চিম দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ করে ওদের একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া যাবে।’ তাই জয়নালের কথায় ক্ষতি হলেও সবাই এক বাক্যে মেনে নিয়ে সোমপুরের লোকজন এই মাঝরাত থেকেই ঘর ছাড়ছে। সবার লক্ষ্য বর্ডার ক্রস করে কোনোরকমে শরণার্থী শিবির পর্যন্ত পৌঁছা।

চলতে চলতে একসময় অনেক কিছুই মনে পড়ে যায় হরনাথের। দেশে তো এখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা দেশের স্বাধীনতার জন্য হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দালাল-তাঁবেদারদের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে চলেছে।

হরনাথ ভাবে, কিন্তু এ কী ধরনের যুদ্ধ! সেই ব্রিটিশ আমলের বোমা ফেলা যুদ্ধ তো সে নিজেও দেখেছে। নেতাজির আজাদ হিন্দ্ ফৌজে তাদের অনেক চেনাজানা লোক নাম লিখিয়ে দেশকে ব্রিটিশের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধও করেছে। তখন হানাহানি তো কম হয়নি। কিন্তু সেই ব্রিটিশ সৈন্যরা তো আজকের পাকিস্তানি সৈন্যদের মতো শহর-গ্রামে জ্বালাও-পোড়াও, মা-বোনের সম্ভ্রম লুট, গণহত্যা করেনি।

অত্যাচার-অনাচারের জন্য রাজাকার-বিহারিদের মতো কাউকে লেলিয়ে দেয়নি। অথচ পাকিস্তানিরা আজ যুদ্ধের নাম দিয়ে কী যে পৈশাচিকতা-হত্যাযজ্ঞ করে যাচ্ছে? শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান পাকিস্তানি-মিলিটারিদের গ্রামে গ্রামে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে। মিলিটারিরা সারা গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করছে – বসতবাড়ির মালামাল ভাগাভাগি করে লুটে নিচ্ছে। দেশ-গ্রামে আর লোকজন থাকার কি উপায় আছে? চারদিকে কী ভয়াবহ আতঙ্ক।

সঙ্গে পালিয়ে ছোটা বীরেনের কথায় ঘোর কেটে যায় হরনাথের। ‘কাকা রাস্তা দ্যান এট্টু। একজন মাইয়া যাচ্ছে।’ বীরেনের কথায় চকিতে সরে গিয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয় হরনাথ। হরনাথ তার ছানিপড়া আবছা দৃষ্টিতে দেখে লালচে ছোপ ছোপ আকাশি ছাপার শাড়ি পরা একটি মেয়ে দ্রুত তাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল। মেয়েটির হাঁটাচলা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরনাথ।

রাস্তাঘাটে এসময়কার চলাচল নিরাপত্তার জন্য শাড়ি পরেছে কিশোরী মেয়েটা। পায়ে পায়ে এখনো কাপড় জড়াজড়ি লেগে যাচ্ছে। মেয়েটির মুখের আদল ভারি চমৎকার। নাকে একটি নোলকও পরেছে। আহারে – আহ্লাদী মেয়ে। নিজেদের ঠাঁই ফেলে – কোথাকার একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য উ™£ান্তের মতো ছুটে যাচ্ছে অবুঝ মেয়েটি। বেশ কজন বুড়ো-বুড়ি ও একদল নানা বয়সের লোকজন এই দলে। সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। শুধু একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য।

মেয়েটির কথা ভাবতে ভাবতে হরনাথের এসময় তার মেয়ে কুসুমের কথা মনে পড়ে যায়। কুসুমরা এখন কতদূর এগিয়েছে? তাদের পাড়ার অনন্ত চান, সদানন্দ, হরিশ, ধনাকা, ধীরবালার মা – ওদের সঙ্গে কুসুমকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে। হরনাথ হিসেব করে দেখেছেন – নিজে একে তো বুড়ো-অথর্ব। তাও আবার রাস্তাঘাটও নিরাপদ নয়, তাই এই সময় সোমত্ত মেয়ে নিয়ে পথ চলায় না জানি কী বিপত্তি ঘটে, তাই হরনাথ কুসুমকে আগেভাগে পাঠিয়ে দিয়েছে।

তা ছেলে বলদেব থাকলে এমন দুশ্চিন্তা হতো না হরনাথের। কী যে হলো বলদেবের। সেই যে ফিশারি থেকে মাছ আনতে শহরে গেল – আজ তিনদিন। যেখানে ঘণ্টা চারেকের মধ্যে শহর থেকে ফেরার কথা, সেখানে তিন দিন পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ বলদেবের আজো ঘরে ফেরার কোনো নাম নেই – এ কেমন কথা! দুর্ভাবনা তো বটেই। শহরে  নানা জায়গায় মিলিটারিরা যেভাবে চেকপোস্ট বসিয়ে নিরপরাধ লোকজনকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলছে তাতে হরনাথের মনে একটা শংকা যেন দেখা দেয়। তবে কি কোনো বিপদ হলো বলদেবের?

অথচ বলদেবের যাওয়ার দুদিন পরে সুলাল, অমূল্য, বিভূতি ওরা শহরে ফিশারিতে গিয়ে মাছ নিয়ে ঠিকই ফিরে এসেছে। ওরা আড়তের বিলবাবুর খাতায় দেখে এসেছে বলদেব ঠিক ঠিক টিপসই দিয়ে আড়ত থেকে মাছ নিয়ে এসেছে। কিন্তু বাড়ি ফিরে এলো না কেন? সবার এই প্রশ্ন।

আশপাশে অনেক খোঁজখবর নিয়ে শহরে মিলিটারিদের উৎপাত-আনাগোনা-চেকপোস্টসমূহে লোক বাছাই করে আটকানো সর্বোপরি বেঁধে নিয়ে গিয়ে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার কথা মনে করে সবাই একমত হলো যে, বলদেব আর বেঁচে নেই। কোথাও হয়তো মিলিটারির হাতে আটকা পড়ে প্রাণ দিয়েছে।

অনেক হা-হুতাশ-কান্নাকাটি করে – বলদেব ফিরবে না – এমন ধরনের একটি দুর্ভাবনাময় দুঃখ-কষ্ট হরনাথের জীবনের পথচলতির সঙ্গে জড়াজড়ি হয়ে মিশে গেছে। হরনাথ আজ এই দুর্ভাগ্য-অসহায়তার কথা কাকে বোঝাবে। কার কাছে এই পুত্রহত্যার বিচার চাইবে অসহায় হরনাথ?

অথচ কী না নিরিবিলি জীবনযাপন ছিল হরনাথের। সোমপুরে মাথা গোঁজার মতো ঠাঁইও একটুখানি ছিল। জমিও ছিল এক চিলতে। হাড় জিরজিরে দুটি গরুও ছিল। ওই অতটুকু জমি চাষ করে ধান-ফসল কিছু পেতও হরনাথ। আবার পরের জমিতে মুনিষও খাটতো। ছেলে বলদেবের মহাজনের দাদনের টাকায় মাছের কারবার ছিল। আর ছিল মেয়ে কুসুমবালা। বলদেবের মা শরমনি কুসুমকে তো সেই আট বছর বয়সে রেখে ওলাওঠায় মারা গেল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বলদেব-কুসুমকে নিয়ে তার যে সুখ-দুঃখের বসবাস – আজ আবার কপাল ভাঙল হরনাথের।

যুদ্ধে তছনছ হয়ে গেল তার ছোটখাটো সংসার – অনেক স্বপ্ন-প্রত্যাশা। ধ্বংসের মুখোমুখি ঘরবাড়ি, বলদেব নিখোঁজ, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। হরনাথের এখন আর বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বনই থাকল না।

নেই। হরনাথের আজ কিছুই নেই। সর্বস্বান্ত হয়ে পথেই নেমেছে হরনাথ। ভারি তেষ্টা পেয়েছে তার। যদি এক আঁজলা পানি পাওয়া যেত, তাদের রান্নাঘরের সেই কালো কলসের কথা মনে পড়ে হরনাথের। ওই কলসের জল মুখে দিলেই যেন মনে হয়, বুকে হিমশীতল বরফের ফোয়ারা ছুটে যাচ্ছে।

ঘর-সংসারের টুকরো সম্বলপাতির কথাও মনে পড়ে হরনাথের। পালিয়ে আসার সময় কিছুই তো আনতে পারেনি। আনবেই বা কেমন করে? তারা ঘর ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো ছোলেমান রাজাকার লুটপাটের জন্য এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঢুকে পড়ছে। তার হাড় জিরজিরে গরু দুটির রশি ধরে আছে নোয়াব আলি-মোকসেদ রাজাকার। এতো লোকের সামনে তাদের সে কী হইহই কাণ্ড। যেন এখনই জবাই করে বসে গরু দুটিকে। কত বছরের পুরনো হালের গরু। অসহায়ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কী মনে করে – অনেক সাহস দেখিয়ে গরু দুটির দিকে এগিয়েও গিয়েছিল হরনাথ। কিন্তু মোরশেদ রাজাকারের তাড়া খেয়ে আর পিছু ফিরে তাকানোর সাহস হয়নি তার। ততক্ষণে ভিটের পশ্চিমে খড়গাদায় আগুন দিয়েছে ওরা। তারপর কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা।

হরনাথ ভাবে, তার জীবনযাপন বেঁচে থাকার ঐশ্বর্য বলতে আর কিছুই  থাকল না। তার স্বপ্ন-সাধ-আকাক্সক্ষা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। হরনাথ কিছুই খুঁজে পায় না আজ – না করার, না ভাবার। এই পৃথিবীতে সহায়-সম্বলহীন এভাবে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ খুঁজে পায় না হরনাথ। হরনাথ ভাবে, এখানে কিসের স্থিতি আছে? কী জীবনের – কী জীবনযাপনের? এ-ধরনের দুর্বোধ্য চিন্তা-চেতনা দ্রুত হরনাথকে আরেক মেরুর দিকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে যায়। হরনাথ সে ডাক – অতিকষ্টে শুনে – হৃদয়ঙ্গম করে এবং অনেকটা প্রত্যাশী হয়ে পথ-চলতিতে ত্রস্ততা অনুভব করে।

‘কাকা ও কাকা – ঘুমালে বুঝি?’ মোহগ্রস্ত হরনাথ তড়িঘড়ি সে-ডাক শুনে মাথা ঝাঁকিয়ে ওঠে। ডাকে – কে যেন তাকে ডাকে। আজকাল কানেও ভালো শুনতে পায় না হরনাথ। চোখে তো ছানি পড়ে গেছে। তবু ঝাঁকি মেরে কান পেতে – ছানিপড়া চোখের হলুদ দৃষ্টিতে আবছায়া দেখে জয়নালের দীর্ঘকায় শরীরের কাঠিন্য – রুদ্ররোষের পদশব্দ – ঠিক ঠিক অনুভব করে হরনাথ।

‘কাকা আমি জয়নাল। ঝিমুচ্ছ কাকা। উঠো উঠো, চলো এগোই। নলখোলা ক্যাম্পে যেতে যে আরো মাইল তিনেক পথ হাঁটা লাগবে। পা না চালালে যে ক্যাম্পে পৌঁছতে ভরদুপুর হয়ে যাবে। তোমাদের ওখানে পৌঁছে দিয়ে আমাকে যে কলসডেঙা ক্যাম্পে অপারেশন ব্রিফিং করতে হবে। চলো চলো কাকা – পা চালাও।’ জয়নাল তাড়া দেয়।

বাঁকানো লাঠিতে ভর করে অতিকষ্টে উঠে দাঁড়ায় হরনাথ। হরনাথ ভুলে যেতে বসে এতক্ষণকার টুকরো টুকরো ভাবনা – প্রসঙ্গকথা।

হ্যাঁ, তাকেও যেতে হবে। কোথাও না কোথাও। কিন্তু কার জন্য? নিজের জন্য? কুসুম-বলদেবের জন্য? না দেশের জন্য? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না হরনাথ। এ প্রসঙ্গটা এক ধরনের তত্ত্বকথার মতো মনে হয় হরনাথের। দু-কদম এগিয়ে হঠাৎ থমকে যায় হরনাথ। মুক্তিযোদ্ধা জয়নালের কাঁধে ঝোলানো স্টেনের কালো কুচকুচে নল হরনাথকে এক অন্য ধরনের প্রত্যাশার মুখোমুখি করে তোলে, যা হরনাথ কাউকে বোঝাতে পারে না। কিন্তু ঠিকই উপলব্ধি করতে পারে – রগওঠা ফাটাপড়া চামড়ার দশটি আঙুল যেন পুরো রাইফেলটা চুমিয়ে নেয়। মুক্তিযোদ্ধা জয়নালের কঠিন চোয়াল, সতর্ক দৃষ্টি – বুড়ো হরনাথের অপ্রকাশ্য ফেটে পড়া অভিব্যক্তি – তার ক্ষয়ে যাওয়া রক্ত-অস্থি-মজ্জাতে জেগে থাকা সহজাত দৃঢ়তাকে আরো দৃঢ়তর করে তোলে।

জয়নাল যখন খুব কাছাকাছি এসে পড়ে, তখন ভারি মমতায় হরনাথ জয়নালের কাঁধে ঝোলানো স্টেনগানকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। কেমন যেন বারুদ পোড়া পোড়া ঘ্রাণ – স্টেনের অবয়বে। হাসে জয়নাল – হরনাথ কাকুর অবাক কাণ্ডে।

স্টেনের এই ঠান্ডা শীতল পরশ হরনাথকে আরো দুঃসাহসী করে তোলে। তখন বুড়ো হরনাথ মানুষটি কোথায় কোথায় হারিয়ে যেতে বসে। হরনাথের তখন এক ধরনের অদ্ভুত ইচ্ছে হয়। হরনাথের ভারি ইচ্ছে হয় মুক্তিযোদ্ধা জয়নালের মতো এমন একটা স্টেনের বুকফোলা অধীশ্বর হয়ে আমৃত্যু দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে এক অনাগত সুখী জীবনের জন্য নির্ঘুম জেগে থাকতে।

জয়নাল বুড়ো হরনাথের অতসব দেখে। দেখে আর দেখে। কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। কী বলতে চায় হরনাথ কাকা? কী করতে চায়? তবু জয়নাল এটা স্পষ্টত টের পায়, হরনাথ কাকার অস্থিচর্মসার অবকাঠামোর বোধ বিশ্বাসে টুকরো টুকরো স্বপ্নের কিছু খণ্ডিত অংশ দ্রুত দানা বাঁধতে শুরু করেছে।

আঁধারতাড়া আটপৌরে ভোর, দমকা হাওয়ায় চারদিকের পাখপাখালির ভয় পেয়ে ডানা ঝাপটানো, শরণার্থীদের ছোটখাট দলের ত্রস্তে ছুটে চলা দেখা এবং স্মৃতির নস্টালজিক মুহূর্তগুলি – এতসবের মাঝে আটকে থেকেও হরনাথ কাকার বিরলপ্রজ জেগে ওঠা ঠিক ঠিক আলাদা করে চিনে নেয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জয়নাল।

এতসব ভাবতে ভাবতে জয়নাল দীর্ঘক্ষণ হরনাথ কাকার দিকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। বুড়ো হরনাথও চেয়ে থাকে মুক্তিযোদ্ধা জয়নালের দিকে। আর এক প্রজšে§র মানুষ তার দ্বিধাহীন দৃঢ়তা, কালো কুচকুচে স্টেনের নল, আগুনভাটি চোখ, হরনাথের হৃদয়মন আরো আত্মবিশ্বাসে ভরে দেয়। অতঃপর বুড়ো হরনাথ মুক্তিযোদ্ধা জয়নালকে দু-হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে অনাগত দুঃখ-কষ্টকে নিদারুণ উপহাস করে অন্তহীন দিনরাত্রির পাশাপাশি আর এক ভিন্নতর সুখ-ঐশ্বর্যের স্বপ্নে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।