বৃষ্টি শোনার রাত

এমন একটা ঘটনার মধ্যে পড়তে হবে, আমাদের কল্পনায়ও ছিল না।

আমি আর সোনালি চট্টগ্রাম যাছি। রেলভ্রমণ বরাবরই আমার প্রিয়। আর রাতের ট্রেন হলে তো কথাই নেই। দূরের হোক আর কাছের হোক, দুদিনের জন্য বা দু-সপ্তাহের জন্য হোক, বেশি কাপড়চোপড় সঙ্গে নেওয়া আমার পছন্দ নয়। সোনালিরও তা-ই। কোনো রকম চালিয়ে নিতে পারলেই হয়। বাড়তি কাপড়চোপড়ের বোঝা বেড়ানোর আনন্দ মাটি করে দেয়, তেমন অভিজ্ঞতা আমাদের দুজনেরই আছে।

আমি যাচ্ছি অফিসের কাজে। আর সোনালি থাকবে ওর মা-বাবা, ভাই-বোনদের সঙ্গে। মাঝে একদিন সাগরসৈকতে দেখা হতে পারে। ফেরার টিকিটও কনফার্ম করা, সেটাও রাতের ট্রেন।

ঢাকা থেকে রাত দশটায় ট্রেন ছেড়েছে। যথাসময়ে ট্রেন ছাড়া, আজকাল, এমনটা সচরাচর হয় না। বড়দের কাছে গল্প শুনেছি, একসময় ট্রেনের আসা-যাওয়া দেখে আগপিছ হওয়া ঘড়ির সময় মেলানো হতো। সময় ভেঙে ট্রেন চলাচল তো এখন প্রায় রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি প্রচলিত গল্প – ঠিক ঘড়ি ধরে ট্রেন এসেছে। অন্য ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ দুজন কথা বলছেন, ‘আরে, আজকাল দেখি সময়মতোই ট্রেন চলছে।’ পাশের জন হাসতে বললেন, ‘কী বলেন ভাই, এটা তো গতকালের ট্রেন, চব্বিশ ঘণ্টা লেট।’

সোনালিকে বেশ উচ্ছ্বসিত লাগছে। রেলপথে নিজেদের কোনো বাতি থাকে না। প্রয়োজনও নেই। ইঞ্জিনের আলোতে দিব্যি চলা যায়। শহর এলাকা পেরিয়ে এসেছি। চারপাশের একচ্ছত্র অন্ধকার  চিরে ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ সময় সোনালি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে সে কী এমন দেখছে? জিজ্ঞেসও করলাম। সোনালি নির্বিকার। প্রায়-শান্ত জলস্থানের মৃদু ঢেউয়ের মতো ছোট্ট কণ্ঠে বলল, ‘অন্ধকারেরও আলো থাকে। সেই মিহি আলোয় কিছু দেখা অথবা না-দেখাটা সবসময়ই অভূতপূর্ব।’

বিরল কোনো দৃশ্য, নতুন কোনো প্রাণী দেখে ছোটদের চোখে যেমন পলক পড়তে চায় না, সোনালির চোখও মুগ্ধ, বিহ্বল, সন্ধানী।

সময় মন্দ কাটছে না। একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার এলাকায় আমাদের ট্রেনটা গতি হারিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এমন হতেই পারে, হয়ও। সামনে হয়তো পুরনো কোনো সেতুর মেরামত চলছে অথবা রেললাইনের সিøপার বদলানো হচ্ছে। এমন হলে ট্রেন পিঁপড়ের পায়ে চলে। তবে আজকের মতো একেবারে থেমে থাকা, তা-ও আধা ঘণ্টা হয়ে গেল! যাত্রীদের কেউ কেউ অসহিষ্ণু ও উৎসাহী হয়ে নানা খবর নিয়ে ফিরছে। শেষ পর্যন্ত আসল খবর জানা গেল, অদূরে একটা মালগাড়ির বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। সকালে উদ্ধারকারী ট্রেন আসবে। সব ঠিকঠাক হলে তবেই আমাদের ট্রেন ছাড়বে। ততোক্ষণ ট্রেনের কামরাতেই বসে থাকতে হবে। একথা শুনে আমি যথেষ্ট বিপন্ন বোধ করছি, ভাবনাগুলি জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সোনালির মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই, যেন কোথাও কিছু হয়নি।

জায়গাটা গ্রামের একটি বাজার। এ এলাকার তাঁতের কাপড় বিখ্যাত। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে কারবারিরা আসে, ট্রাকবোঝাই কাপড় চলে যায় নানা স্থানে। 

ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম, শ্রমিকদের হাঁকডাকে সপ্তাহের দু-তিনদিন বাজার এলাকা বেশ সরগরম থাকে। বাকি দিনগুলো থাকে প্রায় জনশূন্য।

গাড়ির কামরা থেকে নেমে, ভাবলাম, পরিস্থিতিটা একটু দেখি। বিদ্যুৎ নেই। আরো অনেক যাত্রী নেমেছে। অধিকাংশই খাবারের সন্ধান করছে। দু-একটি খুপরি দোকানে কুপি জ্বলছে। এরই খুচরো আলোয় দৃশ্য ঠাহর করা যায়। সামান্য রুটি-বিস্কুট-কলা কাড়াকাড়িতে শেষ। ধূমপানে আসক্তরাও হতাশ। এক শলা সিগারেটও পাওয়া যাচ্ছে না।

হঠাৎ ছুটে আসা বাতাসের মতো একটা উঠতি বয়সী লোক এসে আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। পরনে লুঙ্গি-গেঞ্জি, মাথায় গামছা বাঁধা। আমার বুকের মধ্যে ধুকপুক শব্দ, আসন্ন কোনো বিপদের কথা ভেবে শরীরের লোম কাঁটা দিয়ে উঠেছে। খেয়াল করতে চাইলাম লোকটার হাতে বা কোমরে ছুরি-দা জাতীয় কিছু আছে কি না। না তেমন কিছু দেখলাম না। ধড়ে পানি এলো। লোকটা আমার কানে কানে বলল, ‘স্যার হোটেলে থাকবেন?’

‘হোটেল! এখানে আবার হোটেল আছে নাকি?’

আমার এমন সন্দেহভরা কথায় ওই লোকটা জানাল, বড় বড় কারবারি অনেক টাকাপয়সা নিয়ে এই বাজারে মাল কিনতে আসে। তাদের থাকার বিষয়টা মাথায় রেখে এখানে কয়েকটা হোটেল গড়ে উঠেছে। তবে সেগুলো মাসওয়ারি বুকিং থাকে। এবার সে অধিক নিচু কণ্ঠে বলল, ওর খোঁজে একটা ভালো রুম খালি আছে, চাইলে এক রাতের জন্য দেওয়া যাবে। কয়েক কদম দূরেই সেই হোটেল। দেখে অপছন্দ হয়নি। রাতের বাকি কয়েকটা ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যাবে। হোটেলের একজন জানাল, বিকেলের ঝড়ে বিদ্যুৎ গেছে, এখনো আসেনি। তাই ফ্যান চলবে না।

‘না, সমস্যা নেই। গরমও তো কম।’

মনে মনে বলি, শোবার মতো একটা রুম জুটেছে, এটাই তো শত পুণ্যের ফল।

আমি আর সোনালি হোটেল-রুমে উঠে এলাম। নিশ্চিত ছিলাম, হোটেল, হোটেলের রুম দেখে সোনালির মেজাজ খিঁচড়ে যাবে। বকাঝকার ভাঙা রেকর্ড আজ আর থামবে না।

না, তেমন কিছুই হলো না। রুম যেমন-তেমন, লাগোয়া বারান্দাটা সোনালির খুব পছন্দ হয়েছে। বাইরে যতদূর চোখ যায়, অন্ধকারমাখা অনেক গাছ। বারান্দায় দুটো মোড়া পাতা। কয়েকটা টব। একটা টবে সাদা পাপড়ির ফুল ফুটে আছে, কী যেন নাম?

জামাকাপড় কী আর বদলাব, কয়েক ঘণ্টা পরই হয়তো ট্রেনে চড়তে হবে। সোনালি সামান্য শিথিল হয়ে বারান্দায় একটা মোড়া টেনে বসল। আমি তখনো রুমে। সোনালির মধ্যকণ্ঠের ডাকাডাকি, ‘জলদি এসো।’

‘কোনো সমস্যা?’

‘আরে এসো না, অনেক বড় সমস্যা।’

সোনালি যখন ‘অনেক বড় সমস্যা’ শব্দটি টেনে টেনে বলে, আমি বুঝে যাই, সমস্যা কিছু নয়, ওর মাথায় নতুন কোনো ভাবনা এসেছে। 

‘শোনো, আমি না সুবাসটা পাচ্ছি।’ সোনালির ঠোঁটে একটা চাপা হাসি ফুটে আছে।

‘কোন সুবাসটা?’

‘বৃষ্টির সুবাস। খুব দ্রুত ঘন হচ্ছে। দেখো, একটু পরেই বৃষ্টি নামবে।’

সত্যি সত্যি কিছু সময়ের মধ্যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।

রাতের বৃষ্টি। কেমন একটা আবেশ ছড়ানো। পৃথিবীর দুঃখ কমে যায়। সোনালি এখন বারান্দার গ্রিলের ফাঁকে হাত গলিয়ে যে বৃষ্টি ছুঁইছে, তা শহরের কার্নিশ-চুয়ানো বৃষ্টির মতো মনমরা নয়। আকাশের শূন্যতা ধরে নেমে আসা বৃষ্টি অন্যরকম। গাছের পাতা ভিজিয়ে নেমেছে, কেমন সবুজ সবুজ গন্ধ। এ বৃষ্টি যেন জন্মান্তরের মাঠ পেরিয়ে এসেছে এই জন্মের মাঠে। আমাদের বুঁদ হয়ে থাকা ভাবনাগুলো দশ দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে, সরল-সহজ। কারণ নেই, মানে নেই, তবু কী এক ভেজা হাহাকার আমাকে ডুবিয়ে রাখছে, ‘এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে।’

দুই

বৃষ্টি নিয়ে সোনালি আগাম যত কথা বলে, এর অধিকাংশই ফলে যায়। বিষয়টা কাকতালীয়। ওকে এ-কথা বলি না, মন খারাপ হবে। একবার গরমের কাল। আকাশ পরিষ্কার, রোদ-ঝলমলে। সেদিন বিকেল করে আমরা পার্কে গেলাম। গাছের ছায়ায়, ঘাসে-বেঞ্চে মানুষের জটলা – যদি একটু প্রশান্তি মেলে! রিকশায় যেতে যেতে সোনালি বলল, ‘আজ কিন্তু বৃষ্টি হবে, আমি সুবাস পাচ্ছি।’ বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে, তাপ তখনো সূর্যপোড়া দুপুরের মতো। আর সোনালি বলছে, বৃষ্টি হবে!

ভাগ্যক্রমে একটা ফাঁকা বেঞ্চ পেয়ে বসেছি। পার্কে বাতাস দুলছে বটে, কিন্তু মনে হয় ওরা উনুন থেকে উঠে আসছে। মিনিট পনেরো গেছে, দেখি দক্ষিণ আকাশ কালো হয়ে উঠেছে। আমি ধরে নিয়েছি, এ-মেঘ আকাশেই মিলিয়ে যাবে। যাত্রামঞ্চে দলবেঁধে আসা রাজকন্যা আর সখিদের নাচের ছন্দের মতো হঠাৎ ঝমাঝম বৃষ্টি এসে গেল। মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে। পার্কের মধ্যেও কিছু আশ্রয় আছে। ওদিকেই যেতে হবে। সোনালির মধ্যে কোনো তাড়া নেই। মাঝবয়সী একটা গাছে ঠেস দিয়ে ভিজছে, ভিজেই যাচ্ছে। আমি বলি, ‘অসুখ বাঁধবে যে, অন্তত আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে রাখো।’ সে উল্টো আঁচল ছড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে। বলছে, ‘বৃষ্টিতে একা ভিজে কোনো আনন্দ নেই। এসো।’

পরে, সেদিনের বৃষ্টির গল্প যখন উঠল, সোনালি হাসতে বলেছে, ‘সেদিন আমার ব্যাগে কিন্তু ছাতা ছিল, ইচ্ছাকৃত ভুলে সেটা খুলিনি।’

বৃষ্টি নিয়ে সোনালির পাগলামির শেষ নেই। একদিন হুট করে বলে বসল, ‘আবার যেদিন আসবে, সঙ্গে কিছু বৃষ্টি নিয়ে এসো।’

আমি তো থ। বৃষ্টি আনব কী করে! বৃষ্টি কি বাজারে বিকোয়? ধার করা যায়? ভালো বিপদে না পড়া গেল। মনে নানা কথার দীর্ঘশ্বাস জমছে। সোনালি কি আমাকে এড়িয়ে থাকার নতুন কোনো কৌশল করছে? জীবনানন্দের ‘প্রেম ধীরে মুছে যায়’ আবার আমাদের মধ্যে এসে দাঁড়াল না তো! শিবলীকে একদিন দেখলাম সোনালির পাশে, রিকশায় কোথাও যাচ্ছে। ওরা আমাকে দেখেনি। সাব্বিরের সঙ্গে সোনালির  মেশামেশি ইদানীং বেড়েছে। অবশ্য এসব নিয়ে  আমরা কোনো কথা বলি না। বন্ধুত্ব, একে অন্যকে ‘অনুভব’ করা – এমন সম্পর্ক তো থাকতেই পারে। তারপরও মনের মধ্যে একটা খচখচানি।

এক ছুটির দিনে, সোনালিদের বাসায় এসেছি। সে বসার ঘরেই ছিল। রবীন্দ্রনাথের গান শুনছিল। সোনালি সবসময় ওর ঠোঁটে একটা হাসি সাজিয়ে রাখে। আজ হাসিটার সাজগোজ একটু বেশিই মনে হচ্ছে।

সোনালিদের বসার ঘরের বারান্দাটা বেশ বড়ো। সাধারণত ওখানেই আমরা গল্পের ঝাঁপি খুলে বসি। আজো তা-ই হলো। বাগানের কোনো কোনো গাছের শাখা চলে এসেছে বারান্দার কোমরের কাছে। সোনালি ইচ্ছে হলে পাতা ছুঁয়ে দেখে।

মৃদু নয়। ঝড়োও নয়। বাতাস চলাচল করছে। অদূরে একটা গাছ, ঝাঁকড়া পাতা। গাছের পাতা সাধারণত ডানে-বাঁয়ে দোলে। মায়ের কোলে বাচ্চাদের ঝাঁপাঝাঁপির মতো পাতা এখন ওপরে-নিচে দুলছে। একটা ঘুঘু-দম্পতি, সোনালি দেখাল, ওদের পাতা মোড়ানো ঘরে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। বাড়ির পাঁচিলে একটা কাক, জড়োসড়ো। একটু পরপর ভাঙা স্বরে ডেকে উঠছে – ‘ক্ক’।

এসব দেখে সোনালি বেশ উচ্ছ্বসিত।  আমি এসবের কিছুই বুঝিনি, চুপচাপ আছি। সোনালি বলছে, ‘ওই যে কাকটা দেখছ না, ওর সঙ্গীটি শিগগিরই এসে পড়বে।’ হলোও তাই। দুজন ঠোঁটে ঠোঁট ঘষলো। পাখার ঝাপটার সোহাগ বিনিময় করল। পরে আবার এক উড়ালে চলে গেল গাছগাছালির গভীরে।

ছুটির ঘণ্টা পড়েছে। স্কুলের বাচ্চাদের আনন্দ যেন। সোনালির ঠোঁটে লেগে থাকা হাসিটা এখন আরো উচ্ছল।

‘খবর এসে গেছে, আজ বৃষ্টি হবে। তুমি তো ভারি কেজো মানুষ। আমি চেয়েছি, তাই সত্যি সত্যি সঙ্গে বৃষ্টি নিয়ে এলে!’ আমি সোনালির কথার ঢেউয়ে ভাসছি। ডুবছিও।

আকাশ থামছে না।

বৃষ্টির সময় গান-কবিতা সোনালিকে খুব পেয়ে বসে। এখন সে গাইছে রবীন্দ্রনাথ,

এমন দিনে তারে বলা যায়

এমন ঘনঘোর বরিষায়

এমন দিনে মন খোলা যায় …

এইটুকু গেয়ে সোনালি থেমে যায়। অন্যমনস্ক। আমাকে একটা কঠিন প্রশ্নের প্যাঁচে ফেলল। ‘বর্ষা’ প্রমথ চৌধুরীর একটি প্রবন্ধ। ওখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ গানটির প্রসঙ্গ আছে। প্রমথ বাবু বলেছেন – এমন দিনে তারে কী বলা যায়, তা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও বলে যাননি।

এ-বিষয়টি সোনালির মনে অনেক দিন থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছে। উত্তর মেলেনি।

তিন

বৃষ্টি ধরে এসেছে। আকাশ তখনো গুমোট। আবারো ঝমঝম শুরু হতে পারে। রুমে ছোট দুটি নড়বড়ে খাট, মাঝে বিঘৎ দুইয়ের মতো ফাঁক। বিছানায় পিঠ লাগানো দরকার। একটা বড় ধকল অপেক্ষা করছে। সোনালির এমনটা হয় – শুলেই চোখ বুঁজে আসে। আমার উল্টো। হোটেলে ওঠার পর থেকে একটা দুশ্চিন্তা আমাক পেয়ে বসেছে। ডাকাত-বদমাশের ভয়। হোটেলকক্ষে ডাকাতি-ধর্ষণ – এমন খবর তো সংবাদমাধ্যমে আসে। ডাকাত এলে না হয় সব দিয়ে দেব। যদি বদমাশরা আসে, সোনালিকে তুলে নিয়ে যায়। জনবিরল স্থান। আমাদের সাহায্যে তখন কে এগিয়ে আসবে? আমি আর ভাবতে পারছি না! সমুদ্রের ঢেউ-পাহাড় আছড়ে পড়ছে আমার বুকে। দেখি, চোখ বেঁধে আমাকে ফেলে রেখেছে তপ্ত অন্ধকারের মধ্যে। পাশে নারীকণ্ঠ। থেকে থেকে কষ্টস্বর।

রুমের দরজায় ধুপধাপ শব্দ। দরজা-ছিটকিনির যে-অবস্থা, জোরে বাতাস এলেই ভেঙে পড়বে। কান খাড়া করে রাখি। আবারো  শব্দ, আবারো…। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ডাকাত-বদমাশরা যদি দলে ভারী হয়? নিশ্চয়ই সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র আছে। জান কবুল। আমি বেঁচে থাকতে সোনালিকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

অন্ধকারের আলোয় দেখি, শিথিল বসন, সোনালি কাত হয়ে শুয়ে আছে।  ওর কাছে যাই। আমার বুকে আঁকড়ে ধরে রাখি। সোনালি মৃদু তাকাল। অতি ছোট্ট কণ্ঠে বলল, ‘তোমার কী হয়েছে? এমন কাঁপছ কেন?’

‘ডাকাত-বদমাশরা আমাদের রুমের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।’ দুজনই চুপ। সোনালি শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে রাখে, আমি ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ টের পাচ্ছি। 

কিছু সময় পর দুজন উঠে বসি। সোনালি নিজেকে গোছাচ্ছে, হাসতে হাসতে বলছে, ‘তুমি খামোকাই ভয় পেয়েছ। কোনো রুমের দরজা হয়তো খোলা, ঝড়ের ঝাপটায় এরকম ধুপধাপ শব্দ হয়েছে। ডাকাত-বদমাশ হলে এতোক্ষণে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারতো। চলো বারান্দায় বসি।’

ঝড় নেই। তবে বৃষ্টি থামছে না। ‘ভোররাতের বৃষ্টি যথেষ্ট ছন্দময়। আমার ধারণা, জয়দেব, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি এঁদের বর্ষার বিখ্যাত কবিতা – সবই এমন ভোররাতের বৃষ্টির সময় লেখা।’ সোনালির কথাগুলো বেশ ঝরঝরে।

‘কালিদাসের মেঘদূত?’

‘সেটাও এক আষাঢ়ের প্রথম দিনের নবীন মেঘ থেকে উৎসারিত হয়েছিল। তখন অবশ্য ভোরের বৃষ্টি ছিল না।  প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে কালিদাস বৃষ্টিতে পড়েছিলেন। বাড়ি ফিরে  মেঘদূত লিখতে শুরু করেন। এর আগেই যক্ষের সঙ্গে কালিদাসের পরিচয়-আলাপ হয়েছিল, জেনেছিলেন রামগিরি পর্বতে তার নির্বাসনের কথা। অলকাপুরীতে নববিবাহিত স্ত্রী। কালিদাস যক্ষের বিরহকাতরতা গভীর সমবেদনায় অনুভব করেছিলেন।’

‘তুমি তো আবার বৃষ্টিবিশারদ।’

‘তোমার সন্দেহ আছে?’

‘মোটেও না। তবে জানার আগ্রহ আছে, বৃষ্টির আগাম সংবাদ তুমি কী করে পাও।’

‘খুব সহজ বিষয়। একটু চোখ-কান খোলা রাখলে তুমিও জানতে পারবে।’

সোনালি যে আমাকে বৃষ্টি নিয়ে আসার কথা বলেছিল; আমি তো এসেছি গরমে হাঁসফাঁস করা বিকেলে, তখন ঠাঠা আকাশ। সেদিন প্রকৃতি দ্রুত পাল্টে গিয়ে বৃষ্টি এসেছিল। সোনালি আগেভাগে জানল কী করে? আমার জিজ্ঞাসার জবাবে গাছের পাতার নাচ, ঘুঘু দম্পতি, নিঃসঙ্গ কাকের গল্প শোনাল। বৃষ্টির আগে, বাতাস খুব এলোমেলো থাকে, গাছের পাতাও সেইমতো দোলে। পাখিরা খাদ্যের সন্ধানে দূর-দূরান্তে যায়। ওরা যদি দেখে ওইসব আকাশে পাখির কোনো ওড়াউড়ি নেই, বুঝতে পারে অদূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে, তখন ওরা দ্রুত নীড়ে ফিরে আসে। আজকে কাকের ব্যাপারটা এমনি হতে পারে। দুজন দুদিকে গেছে। একজন বৃষ্টির আভাস পেয়ে ফিরে এসেছে। না-ফেরা অন্যটির অপেক্ষায় ফিরে আসা কাকটি  ‘ক্কা ক্কা’ স্বরে কেঁদেছে।

আমাদের গল্প চলছে – তখনো ঝমঝম।

হাসতে হাসতে সোনালি মোড়া থেকে প্রায় পড়ে যায়। ‘কাউকে রক্ষার জন্য এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখতে হয়? আর একটু বেশি হলে তো শ্বাস বন্ধ হয়ে মরেই যেতাম।’

সোনালির এ-অভিযোগের সরাসরি কোনো জবাব দিইনি। ওকে ‘মহাভারতে’র একটি গল্প শোনালাম – ইন্দ্রসারথি মাতলী তার সুন্দরী কন্যা গুণকেশীর বিয়ে নিয়ে চিন্তিত। তিনি অনেক রাজ্য ঘুরে নাগরাজ্যের ভোগবতী পুরীতে পৌঁছান। নাগপ্রধান আর্যক। তার পৌত্র সুমুখ। কন্যার বর হিসেবে সুমুখকে মাতলীর খুব পছন্দ হলো। এ-কথা জানার পর নাগপ্রধান আর্যক খুশি হলেন বটে, যোগ্য পাত্রীর যোগ্য পাত্র। অন্যদিকে ব্যথিতও হলেন। আর্যক মাতলীকে জানালেন, তার পৌত্র সুমুখের আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। কদিন আগে ইন্দ্রের বাহন গড়ুর তার পুত্র চিকুরনাগকে হত্যা করেছে। এতেও নাগবৈরী গড়ুর তৃপ্ত হয়নি। সে ঘোষণা করেছে, এক মাসের মধ্যে তার পৌত্র সুমুখকেও হত্যা করবে।

গুণকেশী সব কথা অবগত হয়েছে। এক মাসের জন্য হলেও সে সুমুখকে বিয়ে করবে। একজন মৃত্যুপথযাত্রীর জীবনের শেষ দিনগুলি সে হাসি-আনন্দে ভরিয়ে রাখতে চায়।

গুণকেশী-সুুমুখের বিয়ে হয়ে গেল। গুণকেশীর প্রতিজ্ঞা, স্বামীকে সে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে; কিন্তু মহাশক্তিধর গড়ুরের সঙ্গে পেরে ওঠা গেল না।

এক মাসের মাথায় আকাশ কালো করে গড়ুরের আগমন ঘটল। সুমুখের জীবনের শেষ মুহূর্ত। গুণকেশী সুমুখের বুকে লুটিয়ে পড়ে। একে অন্যকে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে, যেন দুজন একাকার হয়ে এখন একটি মানুষ। গড়ুর আলাদা করে সুমুখের বুকে নখের আঘাত করার সুযোগ পেল না। চরম হতাশা নিয়ে সে সরে গেল।

‘মহাভারতে’র এই গল্প শুনে সোনালি হেসে বলল, ‘মা বিনতাকে দাস্যমুক্ত করার শর্ত হচ্ছে ‘অমৃত’। স্বর্গের সব দেবতাকে পরাস্ত করে গড়ুর সেই ‘অমৃত’ হরণ করেছে। আমাদের ডাকাত-বদমাশরা তো আর মাতৃভক্ত গড়ুর পাখি না। এরা এক কোপে দুজনকে টুকরো করে ফেলতো।’

‘মন্দ কী! কাউকে কারো মৃত্যু দেখতে হতো না!’

আমরা গল্পের গম্ভীর পথ অতিক্রম করছি – এখনো ঝমঝম।

আবেগ আর আনন্দ মেশানো এক আভা সোনালির চোখে-মুখে। এমনটি আগে কখনো দেখিনি। তর্জনীতে আঁচলের খুঁট প্যাঁচাতে-প্যাঁচাতে বলছে, ‘রবীন্দ্রনাথের ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ গানের একটি কলি নিয়ে প্রমথ চৌধুরী যে মন্তব্য করেছিলেন, এর উত্তর খুঁজেছি বছরের পর বছর, উত্তর পাইনি। আজ পেলাম। মাত্র কয়েক মিনিট। যখন আমাক আঁকড়ে ছিলে তোমার বুকে, আমিও তোমাকে; উত্তরটা ঝলকে মনে এসে গেল, রবীন্দ্রনাথ সেই গানেই বলেছেন –

যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে

সে কথা আজি যেন বলা যায় …

আমরা ‘সেই কথা’ আজ বলেছি – হাজার বছর বলেছি, এক মুহূর্ত বলেছি। হৃদয়ভাষায় বলেছি, শরীরীভাষায় বলেছি।’

আমি আর সোনালি এখন মন খুলে বৃষ্টি শুনছি।