মনজুরে মওলার নষ্ট নীড় ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

শ্রদ্ধেয় অমিয় দেব সম্প্রতি (‘গুরুচণ্ডালি’, ২০২১) দান্তে ও শঙ্খ ঘোষ সম্পর্কে এক নিবন্ধে লিখেছেন : ‘কী লেখেন কবি? শব্দ। কী থাকে সেই শব্দে? বোধ। আর বোধ জুড়ে জুড়ে যা হয় তা-ই সত্য। আর তার জন্য তাকে জীবন বাঁধা রাখতে হয়। তার একমাত্র দেনা সত্যের কাছে।’ কী অর্থপূর্ণ কথা। শব্দ-বোধ-সত্য নিয়ে এই আলোচনা মূলত শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে হলেও আমি এই বক্তব্যকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি আরেক গুরুত্বপূর্ণ কবির কাছে, যাঁর কাছে শব্দ আর ঈশ্বর সমার্থক ছিলেন, তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি ছিলেন শব্দের পূজারি। সত্যের কাছে তাঁর যে দেনা, তা শব্দ দিয়েই তো পূরণযোগ্য; এবং আজীবন তিনি তা পূরণ করে গেছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ তন্বীর প্রথম শব্দবন্ধ ‘অধুনা-আনীত’ থেকে শেষ কবিতা ‘নষ্ট নীড়’-এর শেষ শব্দ ‘অমা’ তাঁর আজীবন কাব্যসাধনার সারাৎসারকে জানান দিয়ে যায়। এমনকি তাঁর আপাত-দুর্বোধ্য গদ্যরচনার মধ্যেও অনেকেই খুঁজে পেয়েছেন কাব্যের অনুপ্রবেশ তথা কবিমনস্কতা। রবীন্দ্রনাথের কোনো এক লেখায় যেন পড়েছিলাম, গান ও কবিতায় তিনি কখনো অসত্যের আশ্রয় নেননি।

ওই ঘরানার আরেকজন কবি, বুদ্ধদেব বসু, লিখেছেন : ‘কবিতার আত্মা বলতে আমরা যা বুঝি, যা যুক্তিহীন ও যুক্তিবিরোধী, বুদ্ধির শ্রেষ্ঠ ফসল ব’লেই বুদ্ধির অতীত, যাকে আর তৌল করা যায় না, শুধু ধ্যান করা যায়।’ এই কথাগুলো বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন তাঁর কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের ভূমিকায়, সংস্কৃত কবিতার শক্ত বাঁধন, যুক্তিনির্ভরতা  ও আপাতদৃষ্টিতে কাব্যময়তার অনুপস্থিতি উল্লেখ করতে গিয়ে। ধ্যান, শুধুই ধ্যান করার কথা বলেছেন বুদ্ধদেব বসু। বস্তুত কবিতা আসলেই এক ধ্যানের সামগ্রী, যিনি লেখেন তাঁর জন্যও, যিনি পড়েন তিনিও কি বাদ থাকেন এই কুহক থেকে। কবিতা একবার তাঁর স্রষ্টার কলম থেকে বের হয়ে পড়লে এমনকি কবিমহলেও তার ব্যাখ্যা হতে পারে  বহুধা। আর কবি যদি হন লোকান্তরিত, তাহলে তার পরিমাণ বাড়ে : কবিরাসহ সাধারণ পাঠক সবাই যাঁর যাঁর নিজ অর্থ খোঁজন; এবং উপমা, উৎপ্রেক্ষা, কবিপ্রসিদ্ধি প্রভৃতি উৎরিয়ে যা মেলে, তা এক এক ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হওয়া অবধারিত। সুধীন্দ্রনাথ দত্তও এই ব্যাসকূটপ্রবণতার বাইরে নন : সর্বত্রই ওই শব্দ নিয়ে ধ্যান আর পরিমার্জনা; হয়তো তুলনামূলকভাবে একটু বেশিই।

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্য নিয়ে প্রয়াত সুসাহিত্যিক মনজুরে মওলা-লিখিত বই নষ্ট নীড়১ এ-চিন্তাটিকেই সামনে এনেছে। বইটির নামে যদিও মনে হবে এটি শুধু  ‘নষ্ট নীড়’ নিয়ে লেখা, যা ঘটনাক্রমে সুধীন দত্তের শেষ কাব্যগ্রন্থ দশমীর শেষ কবিতা, কিন্তু এ-লেখায় পুরো বইটির আলোচনাই এসেছে; এবং অত্যন্ত চুলচেরা ও কষ্টসাধ্য বিশ্লেষণে। আরো এসেছে একই সঙ্গে ‘উটপাখী’, ‘সংবর্ত’, ও ‘যযাতি’ নামের কবিতার উল্লেখ ও আলোচনা, যে-তিনটিকে তিনি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কবিতা বলে অভিহিত করেছেন। দশমীকে ‘ঘটনাক্রমে শেষ কাব্য’ বললাম এজন্যই যে, এটা সুবিদিত যে, বইটির প্রথম সংস্করণেই লেখা ছিল, কবির এই বইটির পুনর্মুদ্রণ হবে না এবং এই দশটি কবিতা তাঁর পরবর্তী রচনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন আকারে বের হবে। কিন্তু তার আগেই কবি পরলোকগমন করেন।  

শুরুতে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দশমীর বিভিন্ন কবিতা নিয়ে বিভিন্ন উৎস থেকে কিছু মতামত নিয়ে আসতে পারি আমাদের মূল আলোচনার প্রয়োজনে। ড. শুদ্ধসত্ত্ব বসুর লেখা ‘সুধীন্দ্রনাথের কাব্যবিচার’-এ তিনি দশমী সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন, তা এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে : ‘বুদ্ধদেব বসু প্রতিটি শব্দ ব্যবহারের কারণসহ এই কবিতার একটি ব্যাখ্যা দান করেছেন। সবশেষে তিনি বলেছেন যে, ‘কবির অন্তর্জীবনের একটি নাটক এটি।’ – ‘নৌকাডুবি’তে এমন একজনের কথা বলা হয়েছে যে কোনো আকস্মিক প্রেরণার বশবর্তী হয়ে কিছুদিনের জন্য সৃষ্টিকর্মে (সম্ভবত কবিতা লেখায়) সাবলীলভাবে ব্যাপৃত ছিলো; কিন্তু যখন বেলা পড়ে এলো তখন সে দেখলে যে ‘কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নেই আর।’ তার অনুভূতি হলো, যেন পায়ের তলা থেকে মাটি স’রে যাচ্ছে; এই জন্যেই প্রান্তর হলো সমুদ্র, পান্থ নৌজীবী, আর তরণীটিও মজ্জমান, কেননা বিশ্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পরাজয় অনিবার্য।’২ ড. শুদ্ধসত্ত্ব বসু ওপরের ‘নৌকাডুবি’ বাদেও ‘প্রতীক্ষা’, ‘অগ্রহায়ণ’, ‘ভ্রষ্টতরী’, ‘তীর্থপরিক্রমা’, ‘ভূমা’, ‘উপস্থাপন’, ‘প্রত্যুত্তর’, ‘অসংগতি’ এবং সবশেষে ‘নষ্ট নীড়’ সম্পর্কে মূল্যবান সব মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, দশমী সুধীন দত্তের ‘দুর্বোধ্যতম বই’ এবং তার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, কবিতাগুলি লেখায় ‘প্রায় বিমূর্তভাব’কে অবলম্বন করা। ওপরে বর্ণিত বুদ্ধদেব বসুর কবিতা-পরিচয় কাগজের লেখা এবং ড. শুদ্ধসত্ত্ব বসুর এবং নিচে প্রদত্ত অমিয় দেবের তুলনামূক দীর্ঘ উদ্ধৃতিসহ এই আলোচনার পাশাপাশি মনজুরে মওলার বইটি মিলিয়ে পড়লে বর্ণিত দুর্বোধ্যতা বহুল পরিমাণে কেটে যাবে, বা অন্তত একটা সর্বস্বীকৃত ও সর্ব-অনুসৃত পাঠে পৌঁছা যাবে, এ-ধারণা করা যেতেই পারে। কিন্তু এটা কি আসলেই সম্ভব? দুর্বোধ্যতম বইয়ের জট কে খুলবেন? কবিরা তা চেষ্টা করে দেখতে পারেন, কিন্তু তাঁরা কি সর্ববাদীসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন? মনজুরে মওলাও তো সবার সঙ্গে একমত হননি; কিন্তু তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি; কবিতাচর্চায় একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেছে।

একজন তুলনামূলক নবীনের কথা দিয়ে শুরু করছি : সুব্রত সিনহা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ওপর যিনি পিএইচ.ডি গবেষণা করেছেন, তাঁর বইতে লিখেছেন৩ : ‘সুধীন্দ্রনাথের কবিমননকে ‘হিন্দু পুনরুন্নয়নের’ স্মৃতিবাহী ‘নিশ্চিন্ত বৈদান্তিকতা’র পৈতৃক বিশ্বাসের জগতে ঠেলে না দিয়েও ‘দশমী’র ভিন্নতর পাঠ হয়তো সম্ভব। কবিতার – একই সঙ্গে ভাষার ও ভাষ্যের, নতুন কোনো পথের এই সুধীন্দ্রিয় অনুসন্ধানকে হয়তো বা দেখতে চাওয়া যায় আধুনিকতার কাব্যদর্শনের মধ্যেই, সপ্রশ্ন বিবেকের অনিবার্য তাড়নায় যে-কাব্যতত্ত্বও আসলে নিত্য জায়মান। …  কিন্তু শেষ কথা কে বলবে? বস্তুত শেষ কথা যে নেই, ঐকান্তিক পরাবিশ্বাসের বিপ্রতীপ এই বোধেই তো আমাদের পৌঁছে দেয় ‘দশমী’-ও! অনেকান্ততার যে-কাব্যদর্শনে সুস্থিত হতে চেয়েছেন সুধীন্দ্রনাথ তাঁর কবিপ্রতিভার প্রায় উন্মেষপর্ব থেকেই, কবিজীবনের শেষতম উচ্চারণে পাঠককেও কি তিনি পৌঁছে দিয়ে গেলেন সাহিত্যবীক্ষার সেই অনেকান্ততায়?’

সুব্রত সিনহার এই কথাগুলির অনেক আগে, কবির জন্মশতবর্ষে, তুলনামূলক সাহিত্যের দিকপাল অমিয় দেব লিখেছিলেন ‘সুধীন্দ্রনাথের শেষ কবিতা’ নামের আলোচনা অলফা নামের পত্রিকায়, পরে অন্তর্ভুক্ত হয় তাঁর বইতে৪। একটু দীর্ঘ হলেও উদ্ধৃতিটি প্রয়োজনীয় আমাদের বর্তমান অলোচনায় :

‘দশমী’র শেষ কবিতার শেষ যতি প্রশ্নচিহ্নে। আমি কোনো সংবাদ দিচ্ছি না, বাংলা কবিতার পাঠকমাত্রেই তা জানেন। … আমি কথা বলতে চাই সুধীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে যাকে ‘দি ভ্যাগ্রেন্ট’ বলেছেন, সেই অনিকেতকে নিয়ে, সেই প্রশ্নচিহ্নের সমীপবর্তী হয়ে যা তাঁর শেষ কবিতার অন্তিম যতি। …

প্রশ্নচিহ্ন সংবলিত শেষ বাক্যটি হল : ‘তাহলে কেন বিরহী শুক নিরুদ্দেশে ঘোরে,/ মজায় কাকে অনাত্মীয় অমা?’ ‘তাহলে’ শব্দটির  তাৎপর্য এখানে ঢের, ‘কেন’র বিধায়ক। আর শুক ও অমার বৈপরীত্য বিপুল। শুকের বিশেষণ ‘বিরহী’, অমার বিশেষণ ‘অনাত্মীয়’। কর্তারূপী শুকের ক্রিয়া ‘ঘোরে’ এবং ক্রিয়াবিশেষণ ‘নিরুদ্দেশে’। অমার ক্রিয়া ‘মজায়’ আর তার কর্ম ‘কাকে’। প্রশ্নচিহ্ন। শুক বিরহী, কারণ সে অনিকেত। শুক নিরুদ্দেশে ঘুরছে, কারণ নিকেতনের আর তার আশা নেই। অথচ ঘুরতে তাকে হবেই, কারণ সে অস্তিত্ববান, সে সৎ। অমার অনাত্মীয়তা অন্তত প্রাথমিভাবে উপলব্ধি করছে শুকই, কারণ এই নিরুদ্দেশ চংক্রমণ নিয়ে অমার কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। শুকের অস্তিত্ব বিষয়েই বোধ করি অমার কোনো কৌতূহল নেই, অর্থাৎ শুক আছে কি নেই, তাতে অমার কিছু এসে যায় না। তা যদি হয়, তাহলে কাকে মজাচ্ছে অমা? কাউকে যে মজাচ্ছে এই ধারণাও তো শুকেরই প্রেক্ষিত থেকে উদ্ভূত। অমার প্রেক্ষিতের কোনো নাগাল কি আছে এখানে? নেই, তবে অমার উত্থানের সঙ্গে নক্ষত্রপুঞ্জের উৎসরণের যোগ আছে। অন্ধকার উঠে এসো, তারারা ফুটছে – এ তো নিজস্ব সন্নিপাত নয়, এতে আছে এক সত্যের আভাস, যে-সত্যে শুকের কোনো অধিকার নেই। … 

অমা অসম্ভূত, দ্রাঘিমার অতীত। কিন্তু কৃষ্ণচূড়া দ্রাঘিমাভুক্ত। চৈত্রশেষের হাওয়ায় তার বিপুল আন্দোলনে শুক প্রতিহত। কিন্তু শুক কুলায়প্রত্যাশী, সূর্যের অধোগতি তথা পরিচিত আহ্নিকতার আপাতনির্বাপণ আর দূরাগত সব নিবিদসম ধ্বনি তাকে কুলায়ের দিকে ঠেলছে। অথচ এই এলোমেলো হাওয়ার উজান ঠেলে সে কিছুতেই কৃষ্ণচূড়ার লাল-সবুজে পৌঁছতে পারছে না। তাকে কেবল উড়ে যেতেই হবে। যদি শুককে বলি আমরা সত্তা আর কৃষ্ণচূড়াকে ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ জীবন, তাহলে সত্তার জীবনতৃষ্ণা এবং জীবনের সত্তা ব্যতিরেকী স্বয়ংসম্পূর্ণতাই হয়ে উঠছে প্রতিভাত। সত্তাকে তবু জীবনমুখী হয়েই থাকতে হবে যদিও জীবন মানেই সত্তার অনুুপস্থিতি। এই স্বভাব-অভাবের যুগ্মতাই এখানে ধ্রুব। অথচ এমন তো বলা হচ্ছে না যে, শুক এবার তার পক্ষসঞ্চালন বন্ধ করবে, অর্থাৎ ধ্রুব মৃত্যুই। মৃত্যু নয়, সত্তার এই সশঙ্ক অন্বেষাই ধ্রুব।

অমিয় দেবের আলোচনায় দশমীর বাকি কবিতাগুলি সম্পর্কেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। সুব্রত সিনহার বইটির ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন অমিয় দেব, সেখানে আছে তাঁর এই কথা : ‘দশমীর দশটি কবিতাই তো স্বয়ংসম্পূর্ণ’ (পৃ ১৬)। এর পাশাপাশি পড়তে পারি দশমী সম্পর্কে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের৫ বক্তব্য : ‘প্রাতিস্বিক একাকিত্বের চর্যাবিলাসের বদলে সুধীন্দ্রনাথের লক্ষ্যই এখানে আত্ম-আবিষ্ক্রিয়া।’ এসব কথার পরে  ‘নষ্ট নীড়’ নিয়ে মনজুরে মওলার বইতে যা আমরা পাচ্ছি, তাকে ওপরের সব উদ্ধৃতির পাশে বসিয়ে বিবেচনা প্রয়োজনীয়।

আরো কিছু বক্তব্য দেখা যাক। বিজয় দেব লিখেছেন : ‘সুধীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রপরবর্তী যুগে এক ব্যতিক্রমী দ্রষ্টা। বিষয়ে, শব্দে, ছন্দে, প্রতীকে নিজস্ব তপোবনে তিনি সৌন্দর্যের এক উপাসক। অপার সৌন্দর্যকে তিনি অনুভব করেছিলেন নিজের শুদ্ধ চেতনায়। তাই সুধীন্দ্রনাথকে অনায়াসে চিহ্নিত করা যেতে পারে চিরায়ত সৌন্দর্যের রূপকার হিসেবে।’৬ গৌতম ভট্টাচার্য লিখেছেন : ‘‘দশমী’ কাব্যগ্রন্থে জীবনের প্রতি আকর্ষণের চিহ্ন একদিকে। আর তার বৃত্তক্রম থেকে উত্তরণে, কবি চৈতন্যের দ্বারা অধিকৃত হয়ে এক অনিকেত মেরুতে নির্বাসিত হচ্ছেন … মৌল জিজ্ঞাসার মখোমুখি হয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পেতে চাইছেন।’৭

আবার ফিরে আসি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ‘কবির আলো প্রবন্ধে’৮ :  ‘পরিশেষে অন্ধকারকে তিনি ‘অনাত্মীয়’ বলে যখন অভিযুক্ত করেন, আঁচ করতে পারি, সেটি আয়ুর সদর্থক সৌন্দর্যেও প্রসাদগুণেরই অনন্য কাব্যরূপ। এই অনন্যতাকে তিনি লোমশ মুনির আকস্মিক চরিত্রায়ণে ইচ্ছাক্রমেই  জটিল করে রেখেছেন : কোন লোমশ? যিনি সংশয়ী ভূপর্যটক, নাকি যিনি পিশাচদের গতি রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন? নাকি তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তুলসীদাসের ভূষণ্ডী গেয়ে উঠেছিল, ‘মেরুশিখর বটছায়া মুনি লোমশ আসীন!’

কেকা ঘটক তাঁর ‘সুধীন্দ্র কাব্য পরিক্রমা : প্রসঙ্গ দর্শন’ প্রবন্ধে৯ ‘নষ্ট নীড়’ সম্পর্কে বলেছেন : ‘‘দশমী’র শেষ কবিতা ‘নষ্ট নীড়’। জীবনানুভূতি ও জীবনাভিজ্ঞতার রসায়ন সম্ভূত এই কবিতা – যা উজ্জ্বল ‘হীরকখণ্ড রূপ’। প্রথমে “কৃষ্ণচূড়া নিষেধে মাথা নাড়ে/ কুলায় খোঁজে শুক;” এই বিহ্বলতা, অসহায়তা, নিরাশ্রয়ী আবহ সৃষ্টির পর মাত্র ষোলটি অন্তর্বর্তী পঙ্ক্তিবিশেষে উপসংহার : ‘তাহলে কেন বিরহী শুক নিরুদ্দেশে ঘোরে,/ মজায় কাকে অনাত্মীয় অমা?’ … সংসারবিবিক্তি শিকড়হীন মানবাত্মাকে আর আশ্রয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়াতে হবে না; বহির্নিরপেক্ষ-আত্মবোধ যে নিশ্চিত জ্ঞান লব্ধ, তাকে কি আর কোনো হতাশা-জিজ্ঞাসা-অজ্ঞানান্ধকার আবিষ্ট করতে পারে? এই সদর্থক প্রত্যয় নিয়েই আমরা কাব্যসংগ্রহের শেষ কবিতাপাঠ সমাপ্ত করি।’

শুধুুই দশমী কেন, সুধীন দত্তের সব রচনাই অর্থবিশিষ্ট।  ক্রন্দসী কাব্যগ্রন্থ বা তার দু-একটি কবিতা নিয়ে নানান জনের নানান মত। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : কালো সূর্যের নীচে বহ্ন্যুৎসব১০ গ্রন্থে ক্রন্দসী কাব্যগ্রন্থের ‘সিনেমায়’ কবিতাটিকে প্রেমিকের ‘অন্তরাখ্যান’ বলে অভিহিত করেছেন। পক্ষাস্তরে সমর সেনের বক্তব্য দৃশ্যতই আলাদা। তিনি ক্রন্দসী প্রকাশের পরে-পরেই পরিচয় পত্রিকায় এক আলোচনায় দৃঢ়তার সঙ্গে লিখেছিলেন : ‘তথাকথিত প্রেমের কবিতা ‘ক্রন্দসী’তে একটিও নেই।  এ-ব্যাপারটি উল্লেখযোগ্য।’১১ দুজন খ্যাতনামা কবির একই গ্রন্থ নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তা। প্রশ্ন উঠতে পারে সংবর্তের ‘১৯৪৫’ কবিতাটির ‘তুমি’ কে, তা নিয়ে। ‘শুদ্ধতম কবি’ জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ নামের কবিতা কাকে উদ্দিষ্ট, তা নিয়ে বাংলা কবিতার গুরুভার পাঠকেরা অনেক ভাগে বিভক্ত।

দুই

আমাদের বর্তমান লক্ষ্য ২০১০ সালে বাংলা একাডেমি, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত কবি মনজুরে মওলা-লিখিত ১২২ পৃষ্ঠার বই নষ্ট নীড় ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দশমী কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতাটি। এই বইতে দশমীর প্রতিটি কবিতারই, অর্থাৎ ‘নষ্ট নীড়’ বাদে বাকি নয়টিরও, বিশদ ব্যাখ্যা ও অভিধান ধরে ধরে শব্দার্থের বয়ান ও টীকা-টিপ্পনী যুক্ত করা হয়েছে। বুদ্ধদেব বসু এ-ধরনের কাজ করেছিলেন অনেক আগে, কবিতা-পরিচয়ে। এরপরে পাই ড. শুদ্ধসত্ত্ব বসুর সুধীন্দ্রনাথের কাব্যবিচার গ্রন্থে১২। তবে একটি বিশেষ কবিতাকে কেন্দ্র করে বাকিগুলোর দিকে দৃষ্টিক্ষেপণ ও ব্যাখ্যাপ্রদান তথা একটি পুরো বইয়ের পরিসরে কেবল একটি কাব্যের, তাও আবার আকারে সংক্ষিপ্ত, তার বিচার-বিশ্লেষণ করে কবি মনজুরে মওলা নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর অসাধারণ পরিশ্রমের পরিচয় মেলে বইটির মধ্যে বর্ণিত দুর্লভ পুস্তকাদির তালিকা থেকে। এ-কাজটির মধ্য দিয়ে মনজুরে মওলা কবিতা-পাঠকদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন।

 সাহিত্যের সাধক মনজুরে মওলার বক্তব্যগুলি এবং তার দেওয়া বুদ্ধিদীপ্ত উপসংহারগুলি পাঠকের সীমাহীন মনোযোগের দাবিদার। এদেশে শুধু আবদুল মান্নান সৈয়দ বাদে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে ভালো কাজ করেছেন সিদ্দিকা মাহমুদ। তাঁর সুধীন্দ্রনাথ : কবি ও কাব্য১৩ সুধীন্দ্রনাথ-উৎসাহীদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয়। পিএইচ.ডি গবেষণার ওপর নির্ভর করে লেখা বইটি তথ্য ও তত্ত্বসমৃদ্ধ। মনজুরে মওলা তাঁর আলোচনায় এ-বইটির বরাত টেনেছেন। মনজুরে মওলার বইটি অভিনিবেশ নিয়ে পড়লে অনেক বড় প্রশ্নের যেমন এটি সমাধান করে দেয়, তেমনি রেখে যায় দু-চারটি ছোট, অগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও।

বইটিতে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক একটা বিপুল বিশ্বপরিসর টেনে এনেছেন : কোপার্নিকাস, শেকসপিয়র, কান্ট, শ্রোডিঙ্গার, মালার্মে, এলিয়ট, হকিং সবাইকে নিয়ে যেমন কথা বলেছেন, তেমনি উল্লেখ আছে লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ, আবু সয়ীদ আইয়ুব, অবনীভূষণ চট্টোপাধ্যায়, অরুণ কুমার ঘোষ, দীপ্তি ত্রিপাঠী, আবুল আহসান চৌধুরী, সিদ্দিকা মাহমুদ প্রমুখের। তিনি যেসব উৎস ব্যবহার করেছেন তাতে আছে, দিল্লি থেকে প্রকাশিত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ, পুরাণ-সংক্রান্ত অভিধান পৌরাণিক অভিধান, সংকলক সুধীরচন্দ্র সরকার (কলকাতা,  ১৪০৬) ইত্যাদি। চার পৃষ্ঠার প্রথম অধ্যায়ে আছে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-সম্পর্কিত কিছু প্রাথমিক কথাবার্তা এবং অবশ্যই বুদ্ধদেব বসুর ভূমিকাসংবলিত কাব্যসংগ্রহের উল্লেখ, যা যে-কোনো বাংলাভাষী সাহিত্যপ্রেমিকের জন্য এক অনিবার্য সঙ্গী। দ্বিতীয় অধ্যায়ে শুধু পুরো ‘নষ্ট নীড়’ কবিতাটি তুলে দিয়ে পাঠকের কষ্ট লাঘবের জন্য তিনি এক নতুন রীতি তৈরি করেছেন। তিন নম্বর অধ্যায়ে আছে ‘নষ্ট নীড়’ লেখার পেছনের প্রেরণা, সুধীন দত্তের চল্লিশের দশকের কম লেখা বা না-লেখার উল্লেখ, সিদ্দিকা মাহমুদের সুধীন্দ্রনাথ : কবি ও কাব্য বইয়ের বরাতে। অবশ্য এর কারণ গ্রন্থকার যা বলেছেন, যথা প্রেরণার অভাব, সে-বিষয়ে ভিন্ন গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে অনেকেই মনে করতে পারেন।

প্রায় পঞ্চাশ পৃষ্ঠার (২০-৬৮) চতুর্থ অধ্যায়টিকে ধরে নেওয়া যেতে পারে এই বইটির প্রাণ, তথা  সবচেয়ে প্রধান অংশ, যেখানে বাকি নয়টি কবিতার সঙ্গে ‘নষ্ট নীড়’-এর সম্পর্ক লেখক খুঁজে বের করেছেন। অনেক শব্দ বা শব্দবন্ধ সম্পর্কে তিনি নিজ মনোভাব ব্যক্ত করেছেন; এবং প্রতিটি প্রকাশভঙ্গিকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। অধ্যায়ের শেষে তাঁর উপসংহার সবারই মনে ধরবে : ‘… আমার  মনে হয়েছে যে নষ্ট নীড় লিখতে সুধীন দত্তকে অনেক পথ পেরিয়ে আসতে হয়েছিল, এবং নষ্ট নীড়, এক দিক থেকে, অন্য সব কবিতার মতো, হঠাৎ করে লেখা হলেও, অন্য দিক থেকে, হঠাৎ করে লেখা নয়।’ এই বাক্যের শেষাংষের অর্থ হয়তোবা অগ্রহণযোগ্য, অন্তত সুধীন্দ্রনাথের কাব্যালোচনার প্রেক্ষাপটে, কিন্তু প্রথমাংশে বলা ‘অনেক পথ পেরিয়ে আসতে হয়েছিল’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পুরো কাব্যসাধনার যাত্রাকথাই এতে বলা হয়েছে। সুধীন দত্ত ‘যযাতি’ কবিতাটি লিখতে সময় নিয়েছিলেন চার মাস। দশমীর শেষ কবিতা ‘নষ্ট নীড়’-এর রচনা ৩১শে মার্চ ১৯৫৬; আর তার আগেরটি অর্থাৎ নয় নম্বরের ‘অসংগতি’র রচনা একই মাসের ১৮ই মার্চ : স্পষ্টতই প্রায় দু-সপ্তাহ সময় তাঁর হাতে ছিল ‘নষ্ট নীড়’-এর জন্য। নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই সময়ের, বা এই তেরো দিনের লেখার সময়ের পুরোটাই তিনি ব্যবহার করেছিলেন এটি ধারণাবদ্ধ করতে ও পরে কাগজে লিপিবদ্ধ করতে। তিনি হঠাৎ লেখার মানুষ নন; হয়ে থাকতে পারে ধারণাটি হঠাৎ করেই মনে এসেছে; তা অবশ্য সব কবির প্রায় সব কবিতা সম্পর্কেই খাটে, কিন্তু সঠিক বা ঈপ্সিত রূপকল্প বা ফর্মে পৌঁছাতে সময়ের দরকার পড়ে।

ঘুরে আসতে পারি অর্কেস্ট্রা কাব্যের দ্বিতীয় সংস্করণের১৪  বহুপঠিত ভূমিকা থেকে, যেখানে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পরিষ্কার বলছেন, ‘… প্রেরণাতে অলৌকিকের আভাস আছে বলে সাহিত্য-সৃষ্টির উক্ত উপকরণ আমি সাধ্যপক্ষে মানতে চাইনি, তার বদলে আঁকড়ে ধরেছিলুম অভিজ্ঞতাকে। অবশ্য বর্তমানে, লেখনীর পক্ষাঘাত সত্ত্বেও, স্বপ্নচারী পথিককে যেমন, অনুপ্রাণিত কবিকে আমি তেমনিই ডরাই; …” একই প্রসঙ্গে অন্য সময়ে বিষ্ণু দে-র সঙ্গে ‘প্রেরণা’ নিয়ে তাঁর পত্রচালাচালি স্মরণীয়। সুধীন দত্ত যে-প্রেরণার ভূমিকা কাব্যরচনার ক্ষেত্রে মানতে চাইতেন না, মনজুরে মওলা-উত্থাপিত প্রেরণাবিষয়ক প্রশ্নটির সেভাবেই সমাধান হওয়া উচিত। তবে সব কবি সম্পর্কে সুধীন দত্ত-বর্ণিত চিন্তা খাটানো না-ও যেতে পারে; এবং অন্য কোথাও থাকুক বা না থাকুক, বৃহত্তর বঙ্গের গ্রামাঞ্চলে কবিগানের লড়াই তো চিরায়ত ঐতিহ্যের অংশই হয়ে আছে; আর তা সম্ভবত তাৎক্ষণিক প্রেরণাসম্ভূত।

পঞ্চম অধ্যায়ে ‘নষ্ট নীড়’ কবিতায় ব্যবহৃত কিছু শব্দ নিয়ে যে-বিশদ আলোচনা হয়েছে, তার ভালো-মন্দ কাব্যরসিকেরা ভেবে দেখতে পারেন। বিশেষত, কৃষ্ণচূড়া, নিবিদ বা পবন, হবন, যবন ইত্যাদি শব্দ নিয়ে যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন মনজুরে মওলা। ‘নিবিদ’ শব্দটিতে ‘জাতিগত বিদ্বেষে’র আভাস এবং যবন নিয়ে ‘সাম্প্রদায়িক’ মানসিকতার উল্লেখ হয়তো অতিরিক্ত ব্যাখ্যাপ্রদানের দাবিদার; এবং কবিতায় যেখানে অন্ত্যমিলের প্রয়োজনে শব্দের ব্যবহার, সেখানে অসুবিধাই বা কোথায়, এ-প্রশ্নটিও জিজ্ঞাস্য। ক্ষেত্রবিশেষে অন্ত্যমিলের সঙ্গে কবিতার অস্তিত্ব তো অচ্ছেদ্য; নইলে আমরা কি ধরেই নিচ্ছি গদ্য-পদ্য একাকার হয়ে গেছে?  কবি অরুণকুমার সরকারের ‘নষ্ট নীড়’ নিয়ে আলোচনায় তিনি সম্মত হননি (পৃষ্ঠা ৭০-৭১), যেহেতু বর্ণনা মোতাবেক সরকার কবিতাটিকে ‘আপাতগ্রাহ্য’ ও ‘সরল’ বলে মানতে চেয়েছেন। তেমনি মানেননি দীপ্তি ত্রিপাঠী-উদ্ধৃত সুধীন দত্তের নিজের ব্যাখ্যা, যেখানে সুধীন দত্ত এক চিঠিতে অবণীভূষণ চট্টোপাধ্যায়কে জানিয়েছিলেন, কৃষ্ণচূড়া ও শুককে যথাক্রমে বস্তুগত জীবনের প্রতীক ও ‘উন্ডিং সেল্ফ’ বা আত্মঘাতী সত্তা বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মনজুরে মওলা চিঠিটিকে ‘দাবি-করা’ বলে অভিহিত করেছেন। ‘দাবি-করা’ হবে কেন; অবণীভূষণ সুধীন দত্তের বন্ধুস্থানীয় এবং দশমী কাব্যগ্রন্থ তাঁকেই উৎসর্গ করা। সুতরাং, তাঁকে ইংরেজিতে লেখা চিঠিতে উৎসর্গকারী ব্যক্তি-কর্তৃক কবিতা সম্পর্কে দু-চারটি কথা বলা খুবই স্বাভাবিক। তবে কবি মনজুরে মওলার এই বক্তব্য অবশ্যমান্য বলে মনে করি : ‘প্রত্যেক পাঠকেরই অধিকার আছে যে-কোনও কবিতাকে তাঁর নিজের মতো করে দেখার, নিজের মতো করে বোঝার, এবং তেমন করে তিনি দেখেনও, বোঝেনও’ (পৃ ৭৩)। এটাই  হয়তো এই কবিতা-সম্পর্কে সারকথা; এবং তাতেই সব বিতর্কের অবসান ঘটে।

‘নষ্ট নীড়ে’র দ্বিতীয় স্তবক নিয়ে অধ্যায় ছয় শুরু এবং মহাভারতের বাণপর্বে বর্ণিত লোমশ মুনির (পৌরাণিক অভিধান, সংলক সুধীরচন্দ্র সরকার, কলকাতা, ১৪০৬) প্রসঙ্গের সঙ্গে মিলিয়ে পড়েছেন এ-স্তবকের এ-পঙ্ক্তিটি : ‘মৌনে পড়ে তীর্থামৃত লোমশও’; এবং অন্ত্যমিলের প্রযোজনেই মহাকাব্যের এই রকম গুরুত্বপূর্ণ মুনিকে আনা হয়েছে কি না সে-প্রশ্নটি করছেন। অধ্যায়টি শেষ করছেন এ-প্রশ্নটি করে : ‘নষ্ট নীড়কে কি শেষ পর্যন্ত একাকিত্বের কবিতা বলে পড়তে হবে? আর কিছুর নয়?’

সাত নম্বর অধ্যায়ে মনজুরে মওলার উপসংহারমূলক বক্তব্য দশ পৃষ্ঠার অধিক। তিনি শুরু করেছেন তাঁর পছন্দের সুধীন্দ্রনাথ দত্তের তিনটি সেরা কবিতার উল্লেখ করে – ‘উটপাখী’ (ক্রন্দসী), সংবর্ত কাব্যগ্রন্থের নামকবিতা ও ‘যযাতি’ (সংবর্ত) দিয়ে। তিনি শেষ করেছেন এই বক্তব্য দিয়ে : ‘নষ্ট নীড়-এ যে-নৈরাজ্য দেখা দেয় – ভাবনা যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে না, যুক্তির সঙ্গে আবেগের যোগ রচিত হয় না, আবেগ ধোঁয়াটে ও অনির্দেশ্য থেকে যায়, একে নৈরাজ্য ছাড়া আর কী বলা যাবে? সুধীন দত্ত ‘মালার্মে-প্রবর্তিত কাব্যাদর্শ’ প্রতষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বলেই কি তা দেখা দেয়?’ তিনি তা মনে করতেই পারেন। মনজুরে মওলার কথাতেই বলছি, ‘তাঁকেই বা কে বাধা দেবে?’ (পৃ ১০৯)

মনজুরে মওলার বইটিতে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সংবর্ত কাব্যের এক বৃহদংশের ওপর আলোকপাত আছে, বিশেষভাবে সংবর্ত কাব্যের  নামকবিতা ও ‘যযাতি’ নিয়ে। তাঁর নিজস্ব বিষয় যেহেতু ইংরেজি সাহিত্য, তাই বিভিন্ন মন্তব্য দেওয়ার আগে ইরেজি ভাষার অনেক লেখককে তিনি টেনে এনেছেন এই আলোচনায়, যেমন – এলিয়ট, ইয়েটস, শেকসপিয়র। দশমীর দশটি কবিতার প্রায় প্রতিটির ব্যাখ্যাপ্রদান এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভাষা-প্রয়োগ বা শব্দ-ব্যবহার নিয়ে দ্বিমত কিংবা প্রশংসা সাত অধ্যায় ও দশমীর নয়টি কবিতা-সংবলিত পরিশিষ্টসমেত এক বিরল পুস্তকালোচনার জন্ম দিয়েছে। বইটি সুধীন্দ্র-চর্চায় এক মূল্যবান সংযোজন।

তিন

কয়েকটি ছোট বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা চলে মনজুরে মওলার বইটি সম্পর্কে : প্রথমত, সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে এক জায়গায় সাম্প্রদায়িক বলা; দুই, অসম্ভূত অমা নিয়ে কথা বলা; তিন, চিত্তরঞ্জন কোথায় তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং চার, ‘সংবর্ত’ কবিতার ব্রিয়াঁ সম্পর্কে নিজের অজানার কথা প্রকাশ করা। এছাড়া তাঁর বেশ কিছু অভিমত প্রশ্ন তুলবে।

‘নষ্ট নীড়’ কবিতার কবিকৃত একটি ইংরেজি অনুবাদ আছে ‘দি ভ্যাগ্রেন্ট’১৫ নামে; আছে ‘সংবর্ত’ ও ‘উটপাখী’ কবিতারও যথাক্রমে ‘সাইক্লোন’ ও ‘ক্যামেল বার্ড’ নামের ভাষান্তর।  মূল বাংলার সঙ্গে এগুলি মিলিয়ে পড়লে অনেক ধোঁয়াশা দূর হয়। সুধীন দত্তের বাংলা গদ্য সম্পর্কেও একই ধরনের কথা আমি বলবো : কেতকী কুশারী ডাইসন, এডওয়ার্ড ডিমক ও আনিসুজ্জামানের অনুবাদ করা সুধীন্দ্রনাথের সাতটি বাংলা প্রবন্ধের ইংরেজি ভাষ্য মূল বাংলার সঙ্গে মিলিয়ে পড়ে আমি উপকৃত হয়েছি। আমার ধারণা, অন্য পাঠকেরাও একই অভিমত পোষণ করবেন।

কথাগুলি এজন্যই বলা যে, আমাদের আলাচ্য বইয়ের মূল কবিতা ‘নষ্ট নীড়’-এর যেহেতু কবিকৃত ইংরেজি ভাষ্য সুলভ, তাই যে-কোনো আলোচনায় তাই বিবেচ্য হওয়া উচিত। যেমন, এতে ব্যবহৃত ‘যবন’ শব্দটিকে ইংরেজিতে সুধীন দত্ত ‘ইনফিডেল’ লিখেছেন। বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনার দাবিদার এজন্যই যে, বহিরাগত যবনেরাই এদেশীয় ধর্মচারীদের ‘ইনফিডেল’ বলেন। পুরো পরিপ্রেক্ষিতই তাহলে বদলে যায়। ‘অকারী’ শব্দটিও মনিয়ের উইলিয়ামসের সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধানে আছে। পূর্ববর্ণিত কবিতা ‘১৯৪৫’-এ ‘ইংলন্ডেই সমাজতন্ত্র পাকা’ কথাটিকে সুধীন দত্ত ইংরেজিতে ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ লিখেছেন : প্রচলিত অর্থে সমাজতন্ত্র আর কল্যাণ রাষ্ট্র অনেকটাই দূরের, যতটা দূরের সুইডেন আর উত্তর কোরিয়ার সমাজব্যবস্থা।

একথাগুলি বলছি এজন্য যে, মনজুরে মওলা যেহেতু ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে পারঙ্গমতার অধিকারী, তাই আমাদের আলোচ্য বইয়ের শিরোনামের কবিতাটির ইংরেজি ভাষ্য অবশ্য-বিবেচ্য। মনজুরে মওলা ‘যযাতি’তে ‘উল্লিখিত গ্রামের সন্ধান পায়নি স্বয়ং র্যাঁবো’ নিয়ে এ-প্রশ্ন তোলেন যে, কোন গ্রাম এটি, অথচ এই গ্রাম মানে বিবিক্তি, নীরব স্থান, এ-ব্যাখ্যাই ধরে নেওয়া স্বাভাবিক : বুদ্ধদেব বসুর করা কবিতাটির ভাষান্তরেও ইংরেজিতে লেখা হয়েছে : ‘র্যাঁবো হিমসেল্ফ হ্যাড ফেইল্ড ইন দি লাস্ট সেন্্চুরি, টু ফাইন্ড দি কোয়াইট্ স্পট।’

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘প্রত্যুত্তর’ কবিতাটি লেখেন ১১ই মার্চ ১৯৫৬ তারিখে। তার সাতদিন পরে কলকাতায় বসে লেখেন ‘অসংগতি’। ‘প্রত্যুত্তর’-এর পাঁচদিন আগে ৬ই মার্চ ১৯৫৬ তারিখে সেই কলকাতায় বসেই লেখেন ‘উপস্থাপন’। সুতরাং ‘চিত্তরঞ্জন’ নামক স্থানে অবস্থান নিয়ে দিল্লির বাঙালি অঞ্চলের কাছের চিত্তরঞ্জন পার্ক বা অন্য কোনো জায়গা নিয়ে এতো গবেষণার প্রয়োজন নেই : তখনকার বিহার, এখনকার ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে অবস্থিত চিত্তরঞ্জন দামোদর নদীর কাছে ও অজয় নদীর পাড়ের রেলওয়ে লোকোমোটিভ তৈরির কারখানা-সংবলিত এক স্বাস্থ্যকর জনপদ; এ-শহরটির পরিচিতি গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকেই। সুধীন দত্ত এক সময়ে দামোদর ভ্যালি করপোরেশনে (১৯৪৯-৫৪) চাকরিও করেছেন। সুতরাং, মনোরম আবহাওয়া ও উঁচু মানের বায়ুর পরিচিত শহর চিত্তরঞ্জনে বেড়াতে যাওয়া ও সেখানে বসে কবিতা লেখা তার পক্ষে অসংগত নয়। এই নামটি না জানার কোনা কারণ নেই।

এটা মনজুরে মওলার বৈশিষ্ট্য যে, তিনি দশমীর কবিতাগুলি নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেক কিছুই টেনে এনেছেন; এনেছেন ‘উটপাখী’, ‘সংবর্ত’ ও ‘যযাতি’র প্রসঙ্গ। কিন্তু বিস্ময় জাগে যে, ‘সংবর্ত’ কবিতায় বর্ণিত স্ট্রেসেমান-ব্রিয়াঁর মধ্যে তিনি স্ট্রেসেমানের কথা জানেন, যিনি ছিলেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অথচ ব্রিয়াঁর কথা জানেন না, যিনি ছিলেন ফরাসি প্রধানমন্ত্রী : দুজনে কিন্তু ১৯২৬ সালে একত্রেই নোবেল পুরস্কার১৬ পেয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টার কারণে। যে-জিনিসটি নিয়ে সংশয় আছে, তা কেন সম্মুখে আনা?

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সংবর্ত কাব্যগ্রন্থে কিছু পুরনো কবিতার পরিমার্জনা ছাপিয়েছেন। তৃতীয় অধ্যায়ে মনজুরে মওলার এই বাক্যটি নিরর্থক এবং লেখকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি, যথা – ‘একটি কবিতা যদি ১৯৩১ সালে প্রথম লেখা হয় এবং ১৯৫৩ সালে পরিমার্জিত হয়ে চূড়ান্ত রূপ পায় – প্রদীপ কবিতাটি যেমন – তাহলে বলা কি যাবে যে এই কবিতাটি বাইশ বছর সময় ধরে লিখিত হয়ে আসছে?’ এ-ধরনের বক্তব্য কৌতুকের পর্যায়ে পড়ে, গুরুভার আলোচনা নয়। বিশেষ করে সুধীন দত্ত নিজেই যখন সংবর্ত কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় বলছেন : ‘আমার প্রথম বই ‘তন্বী’-প্রকাশে রবীন্দ্রনাথের অনুমতি ১৯৩০-এর আগে মেলেনি। সুতরাং সে-সংকলন থেকে আমার তরুণ বয়সের অনেক লেখা বাদ পড়েছিল; এবং বছর দুয়েক পূর্বে সমস্ত কবিতা একত্রে গাঁথার ইচ্ছায় পুরাতন খাতা-পত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে অনুমান করেছিলুম যে সে-সকল রচনা কেবল আমারই অপকীর্তি নয়, তখনকার আদর্শও বেশ খানিকটা অপরাধী।’১৭ একথা তিনি বলছেন ১৯৫১-র ৩১শে মে তারিখে, সংবর্ত-এ তরুণ বয়সের কিছু কবিতা পরিমার্জনা করে অন্তর্ভুক্ত করার সময়ে। ‘বাইশ বছর সময় ধরে লিখিত হয়ে’ আসার কথাাটি তাই লঘু চিন্তার ফল বলেই মনে হয়।

আমার সবচেয়ে আপত্তি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ব্যবহৃত ‘যবন’ শব্দটি নিয়ে মনজুরে মওলার ব্যাখ্যা (পৃ ৮৬-৮৭) : তিনি ‘নষ্ট নীড়’-এর কবির মনোভঙ্গিকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলতে চেয়েছেন এবং তাও ওই একটি শব্দ-ব্যবহারের কারণে। কবিতার শব্দ আর আইনশাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থের বাণীর গুরুত্বের মধ্যে ফারাকটা অনেক; সেটা আর যে-কেউ বুঝুক বা না-বুঝুক সবচেয়ে আগে কবিরা বোঝেন; এবং মনজুরে মওলা অবশ্যই একজন উঁচু সারির কবি। তিনি যেহেতু একই সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যও পড়েছেন, তাই তাঁর বোঝা উচিত ছিল সুধীন দত্ত ‘যবন’ শব্দটি দ্বারা রহভরফবষ বুঝিয়েছেন, যা আছে তাঁর একই কবিতার ইংরেজি ভাষ্যে।১৮ রহভরফবষ ধরলে পুরো পরিপ্রেক্ষিতই এখানে পালটে যায়। তাঁর উল্লিখিত ক্রন্দসী গ্রন্থের ‘কাল’ কবিতার কোনো ইংরেজি ভাষ্য হয়নি। হলে ভাষান্তরটা একই ধরনের হতো, তা বলাই বাহুল্য, যদি তা সুধীন দত্ত ‘নষ্ট নীড়’-এর মতোন নিজেই করতেন। সুধীন দত্তকে উন্নাসিক (ইংরেজিতে ‘স্নব’), অভিজাত বৃত্তে আবদ্ধ কিংবা, অনেকটা ভ্রান্তভাবেই, আজীবন সোনার চামচ নিয়ে দিন-কাটানো বলে অনেকেই বলে থাকেন, কিন্তু তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গির ধারক, একথা এই প্রথম শোনা গেল।

তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু দার্শনিক আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর কবিতা নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন, এবং তাঁর কিছু কথা অন্য সবার থেকে আলাদা, মূল্যবান। সুধীন দত্তের কবিতা সম্পর্কে আইয়ুবের ১৯৪৩ সালের মূল্যায়ন, যথা অন্য যে-কোনো কবির চেয়ে যুক্তি ও আবেগের অধিকতর ভারসাম্য অর্জন, সে-সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, মাত্র পাঁচটি কবিতা বাদে সংবর্তের সব কবিতাই তখন বেরিয়ে গেছে বিভিন্ন পত্রিকায়, এবং কিছুর ইংরেজি অনুবাদও হয়েছে১৯। মনজুরে মওলা আইয়ুবের এই মূল্যায়ন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। অবশ্য মনজুরে মওলার বক্তব্যের একটা অংশ সঠিক যে, পিতৃ-প্রভাব তাঁর মধ্যে অনেকাংশে আগাগোড়াই ছিল, কিন্তু পিতাও যেমন সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, তেমনি পরের প্রজন্মের সুধীন দত্ত অনেকাংশেই বেশি আধুনিক এবং পিতৃঋণ তিনি শুধেছেন তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট ‘হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ফাউন্ডেশন’কে অছিনামায় বিপুলভাবে দান করে, নিজ অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে কয়েকটি অধ্যায় জুড়ে পিতৃস্তুতি করে এবং সর্বোপরি সম্ভবত সংবর্ত কাব্যগ্রন্থের ‘১৯৪৫’ কবিতাটি লিখে। কিন্তু আইয়ুব  তো কোনোদিন এই ইঙ্গিত দেননি যে, সুধীন দত্তের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ছিল।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর কার্যত যিনি সম্পাদক, সেই এডওয়ার্ড শিলস লিখেছেন২০: ‘যদিও সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর সুগভীর অধ্যয়ন তাঁকে হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর প্রাণবন্ত কুটুম্বিতা জোরদার করে, তিনি বাঙালী হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে কোনো পক্ষপাতিত্ব করতেন না। হাসান শাহেদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। স্বধার্মিক হিন্দু উগ্রবাদীদের হাতে অগণিত নিরীহ মুসলিম হত্যার দৃশ্য তাঁকে তাঁর নিঃশর্ত ও সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে যে-বিদ্রƒপভরা দূরত্ব আগেই তৈরি হয়েছিল, তাকে আরো পাকাপোক্ত করে। … ইংরেজি, বাংলা, জার্মান ও ফরাসি ভাষার বই ও বিশ শতকের বঙ্গীয় চিত্রকলার প্রচুর-পরিমাণ সংগ্রহ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি তাঁর শহরস্থ জীবন কাটাচ্ছিলেন … হিন্দু ও মুসলিমদের সাথে তিনি সমানভাবে মিশতে পারতেন; দিল্লী ও বোম্বে থেকে আগত সব ভারতবর্ষীয়ের সাথে ছিল তাঁর সদ্ভাব। ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে আসা সকল বুদ্ধিজীবী তাঁর রাসেল স্ট্রিটের আস্তানায় আকৃষ্ট হতেন : এঁদের মধ্যে ছিলেন রেমণ্ড মোর্টিমার, স্টিফেন স্পেণ্ডার, ম্যালকাম মাগারিজ, নিকোলাস নভোকভ, এডওয়ার্ড ডিমক, শ্যাডব্রোন গিলপ্যাট্রিক, যাঁরা সবাই তাঁর আতিথেয়তার সুফলভোগী। সেখানে হয়তো তাঁরা দেখতে পেতেন বুদ্ধদেব বসু, সমর সেন, সুশীল দে, অবনী চ্যাটার্জী বা এম.এন. রায়কে। তরুণ বাঙালী কবিরা আসতেন তাঁর পরামর্শ বা উৎসাহের জন্য।’*

এই বর্ণনার একজন মানুষ কীভাবে সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গির হতে পারেন, তা চিন্তার বাইরে। তাঁর সারাজীবনের লেখা আর দীক্ষাকে কি আমরা কোনোদিনই হিসাবে নেবো না? এই সুধীন দত্তই তো তাঁর ১৯৫৭ সালে লেখা ‘ক্যালকাটা’ নামের ইংরেজি প্রবন্ধে ১৯৪৬ সালের ‘দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ সম্পর্কে বলেছিলেন : ‘.. কিন্তু নির্মমতা, অযোগ্যতা বা আত্মপ্রসাদে ১৯৪৬ সনের শুভাশুভের দ্বৈরথের বিস্ফোরণের ব্যাখ্যা মেলে না; এবং যাঁরা এই গণখুনে অংশ নেন, তাঁরা সংখ্যাতীত তথা ভারতবর্ষীয় সমাজের সকল শ্রেণী হতেই আগত। যাই হোক, অবশেষে এক ইংরেজ বন্ধুর মধ্যস্থতায় যখন আমি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে সক্ষম হই, প্রথমে যা শুনি, তা হলো কীভাবে ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন ছাত্র তাঁর প্রতিবেশী জনতাকে উত্তেজিত করে ডজনখানেক মুসলিম হকারকে শেষ করিয়েছে : এঁদের পচনরত মৃতদেহ পেরিয়েই আমাকে আসতে হয়েছিল; এবং আমার স্বদেশীরা সর্বতোভাবে দৈহিক বর্বরতার প্রতি বিরাগভাবাপন্ন এ-প্রমাণেচ্ছু পুস্তিকার যে-খসড়া আমি চুক্তিক্রমে প্রস্তুত করেছিলুম, সেদিন বাসায় ফিরেই আমি তা ধ্বংস করে ফেলি।’**২১ এই মানুষটি সাম্প্রদায়িক? এমন তত্ত্ব এই প্রথম ও শেষবার শোনা গেল; তাও আবার মনজুরে মওলার মতো একজন উঁচু মানের লেখকের কাছ থেকে। পাঠক হিসেবে আমি অবশ্যই বিস্মিত হয়েছি।

সবচেয়ে বড় কথা, কবিতার শব্দ ব্যবহার নিয়ে এতোটা বিচার-বিশ্লেষণের দরকার নেই; অন্ত্যমিলের জন্য কিংবা অনুপ্রাসের অনিবার্য প্রয়োজনে অনেক সময়েই কবিরা এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করেন, যা কি না নিক্তির পাল্লায় মাপলে কানাগলিতে পথ হারানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়। বুদ্ধদেব বসুর কালিদাসের মেঘদূত বইতে২২ পূর্বমেঘের অনুবাদ অংশে প্রথম শ্লোকের প্রথম শব্দটি – ‘জনেক’ – সুধীন দত্তই পরামর্শ হিসেবে বলে দিয়েছিলেন, যাতে পরের শব্দ ‘যক্ষের’ সঙ্গে তার একটা অনুপ্রাস সৃষ্টি হয়। ক’জন বাংলা ভাষার লেখক ‘জনৈক’ অর্থে ‘জনেক’ ব্যবহার করেছেন এর পরে? এক কথায় কবিতায় শব্দ-ব্যবহার নিয়ে শুচিবাই থাকতেই পারে, কিন্তু তাদের অর্থ বা ঈপ্সিত দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে মূল রচয়িতা বাদে ভিন্নজনের মতামত বিশ্লেষণ বা নতুন অর্থসংযোগ কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, তা পাঠককুলই ঠিক করবেন। হয়তো এতেই কবিতার মূল আকর্ষণ; আর সেজন্যই গদ্য হতে তা ভিন্ন। মনজুরে মওলাই তো বলে দিচ্ছেন, পাঠকই যাঁর যাঁর মতো করে কবিতার অর্থ করবেন ও বুঝবেন; কে তাঁকে বাধা দেবে। 

এসবের পরেও বলবো, মনজুরে মওলার নষ্ট নীড় নামের এই আলোচনাগ্রন্থ সুধীন্দ্রনাথ-চর্চার ক্ষেত্রে একটি মূল্যবাদ সংযোজন। সমস্ত প্রাপ্ত সূত্র হাতে নিয়েই তিনি কাজটিতে নামেন; এবং এর নজির খুব একটা নেই। বিশেষ করে, অভিধান হাতে নিয়ে প্রতিটি হোঁচট-খাওয়া শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করতে তিনি যেভাবে ও যতোটা পথে পাড়ি দিয়েছেন, তার দৃষ্টান্ত মেলা ভার। তিনি সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় নৈরাজ্য তথা দুরূহতারও উল্লেখ করেছেন। তাঁর কবিতার দুরূহতার কথা উল্লেখ করে তুলনামূলক নবীন সুব্রত সিনহা সেই পুরনো কথা ধরিয়ে দিয়েছেন পাঠকদের তাঁর অভিসন্দর্ভে – ‘অনভ্যস্ত প্রতিক্রিয়া’য়। যে-দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে, আসলে সে সম্পর্কে সুধীন দত্ত বহু আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসু, অমিয় দেব প্রমুখ তা বিভিন্ন সময়ে খোলাসা করেছেন। মনজুরে মওলা কেন তা ওঠালেন, বলা দুষ্কর। বইটি লিখতে যে-তথ্যভাণ্ডার মনজুরে মওলা ব্যবহার করেছেন, তা প্রশংসনীয়। কিন্তু অনর্থক কিছু প্রশ্ন তুলে তিনি বইটির স্বচ্ছ প্রবাহকে স্থানবিশেষে আটকালেন কি না, সে-প্রশ্ন উঠতেই পারে।

মনজুরে মওলা এখন লোকান্তরিত। তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর মুখ থেকেই বা লেখা থেকে এসব কথার আরো বিশদ ব্যাখ্যা শুনতে পেতাম। তা যেহেতু এখন আর সম্ভব নয়, বর্তমান আলোচনা তাই এ-ব্যাপারে  প্রকৃত কবি বা সাহিত্যিককে আসল কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করলে সুধীন্দ্র-চর্চার ক্ষেত্রটি বিস্তৃত হবে।

[** চিহ্নিত অংশগুলো বর্তমান লেখকের অনুবাদ]

কৃতজ্ঞতা : প্রয়াত অধ্যাপক ভূঁইয়া ইকবাল তাঁর জীবদ্দশায় মনজুরে মওলার বইটি আমাকে পাঠান।

উৎস গ্রন্থপঞ্জি

১। মনজুরে মওলা, নষ্ট নীড়, বাংলা একাডেমি, ২০১০।

২। ড. শুদ্ধসত্ত্ব বসু, কবিতা-পরিচয় কাগজের চতুর্থ সংকলন, শ্রাবণ, ১৩৭৪।।

৩। সুব্রত সিনহা, আধুনিকতার কাব্যতত্ত্ব ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা, কলকাতা ২০১৯।

৪। অমিয় দেব, দুই তিরিশে অক্টোবর নভেম্বর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বুদ্ধদেব বসু; এবং মুশায়েরা, কলকাতা, ২০১২, পৃ ৬৭-৬৯।

৫। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, ‘কবিতার আলো’, সুধীন্দ্রনাথ পাঠের ভূমিকা, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়-সম্পাদিত, ভারত বুক এজেন্সি, কলকাতা, ২০০২, পৃ ৫১-৫৮।

৬। বিজয় দেব, ‘কবি সুধীন্দ্রনাথ : প্রতীকের দীপ্তি’, প্রাগুক্ত, পৃ ২০৩।

৭। গৌতম ভট্টাচার্য, দশমী, ধ্রুবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-সম্পাদিত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত জীবন ও সাহিত্য, পুস্তক বিপণি কলকাতা ২০০২, পৃ ৭৬৪-৭৬৭।

৮। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, ‘কবিতার আলো’, সুধীন্দ্রনাথ পাঠের ভূমিকা, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়-সম্পাদিত, ভারত বুক এজেন্সি, কলকাতা, ২০০২, পৃ ৫১-৫৮।

৯। কেকা ঘটক, ‘সুধীন্দ্র কাব্য পরিক্রমা : প্রসঙ্গ দর্শন’,  ধ্রুবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-সম্পাদিত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত জীবন ও সাহিত্য, পুস্তক বিপণি কলকাতা, ২০০২, পৃ ১৩২-১৪৪।

১০। আবদুল মান্নান সৈয়দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত: কালো সূর্যের নীচে বহ্ন্যুৎসব, পিয়াস মজিদ-সম্পাদিত, শুদ্ধস্বর, ঢাকা।

১১। সমর সেন, ‘ক্রন্দসী’, পরিচয় সুধীন্দ্রনাথ শতবর্ষ, কলকাতা, ২০০১, পৃ ২৩১।

১২। ড. শুদ্ধসত্ত্ব বসু, সুধীন্দ্রনাথের কাব্যবিচার, কলকাতা।

১৩। সিদ্দিকা মাহমুদ, সুধীন্দ্রনাথ : কবি ও কাব্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯২।

১৪। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যসংগ্রহ, ভূমিকা বুদ্ধদব বসু, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃ ২৯-৩৪।

১৫। সুধীন্দ্র্রনাথ দত্ত, The World of Twilight, Oxford University Press, 1970, p 292।

১৬। ওয়েব ঠিকানা : যঃঃঢ়ং://িি.িহড়নবষঢ়ৎরুব.ড়ৎম/ঢ়ৎরুবং/ঢ়বধপব/১৯২৬/

১৭। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যসংগ্রহ, ভূমিকা বুদ্ধদব বসু, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৯৭,  পৃ ১৯৩-৯৫।

১৮। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : https://www.nobelprize.org/prizes/ peace/1926/

১৯। অমিয় দেব, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি, ২০০১, পৃ ১০৬-১০৭।

২০। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, The World of Twilight, Oxford University Press, 1970, এডওয়ার্ড শিলসের ভূমিকা, p xx, xxi-xxii|

২১। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, The World of Twilight, Oxford University Press, 1970, Calcutta-শীর্ষক প্রবন্ধ, ঢ় ৮৫-৮৬।

২২। বুদ্ধদেব বসু, কালিদাসের মেঘদূত, এম সি সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রা. লি., কলকাতা, পৃ ৭২-৮১।

২৩। কমল মুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত প্রসঙ্গ : কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, শিলীন্ধ্র, কলকাতা, ২০০৭।*

* চিহ্নিত গ্রন্থে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-চর্চার বিস্তর সামগ্রীর নাম-তালিকা রয়েছে।