আরণ্যক : এক প্রকৃতিমুগ্ধ ও ইতিহাস-অনুভবী মানুষের ডায়েরি

আজ থেকে ৮০ বছরেরও আগে, ১৯৩৯ সালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আরণ্যক উপন্যাসটি লিখেছিলেন। উপন্যাসের শুরুতে বিভূতিভূষণ একটি দু-পাতার ভূমিকা বা প্রস্তাবনা লিখেছেন, তারপর মূল উপন্যাসটি ১৮টি পরিচ্ছেদে লেখা হয়েছে।

শুরুতে দেখা যায় এই উপন্যাসের কথক সত্যচরণ (যিনি আসলে বিভূতিভূষণ নিজেই) বেকার। কলকাতা শহরে সে কাজ খুঁজছে। এরপর সে এক বন্ধুর মাধ্যমে চাকরি পায় একটি জমিদারি ব্যবসায়, ঝাড়খণ্ডের একটি জঙ্গল এলাকায়। কাজটি হলো, এক জমিদারের অধীন জঙ্গলে প্রজা জোগাড় করে তাদের জমি বিক্রি, ইজারা দেওয়া ইত্যাদি। প্রথমে অচেনা পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে নিঃসঙ্গতা অনুভব করলেও শহুরে সত্যচরণের ক্রমশ জঙ্গল ভালো লাগতে লাগল।

তিনি লেখেন, ‘দিন যতই যাইতে লাগিল, জঙ্গলের মোহ ততই আমাকে ক্রমে পাইয়া বসিল।’ কলকাতার মতো আধুনিক শহরে কাটানো একজন মানুষ জঙ্গল সম্বন্ধে লেখেন, ‘জীবনের বেশিরভাগ সময় কলিকাতায় কাটাইয়াছি। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গ, লাইব্রেরী, থিয়েটার, সিনেমা, গানের আড্ডা, এসব ভিন্ন জীবন কল্পনা করতে পারি না। এই অবস্থায় চাকরির কয়েকটি টাকার খাতিরে যেখানে আসিয়া পড়িলাম, এত নির্জন স্থানের কল্পনা কোনদিন করি নাই।’

প্রথম যখন এই নির্জন স্থানে এলেন তখন পাঠক তার বর্ণনা পেলেন এভাবে – ‘রেল লাইনের দু-ধারে মটর-ক্ষেত। শীতল সান্ধ্য-বাতাসে তাজা মটর শাকের স্নিগ্ধ সুগন্ধে কেমন মনে হইল যে-জীবন আরম্ভ করিতে যাইতেছি তাহা বড় নির্জন হইবে। এই শীতের সন্ধ্যা যেমন নির্জন, যেমন এই উদার প্রান্তর ও ওই দূরের নীল বর্ণ বনশ্রেণী’।

দুই

‘আরণ্যক’ ভ্রমণকাহিনি বা ঠিক ডায়েরি নয়। কিন্তু উপন্যাসটির স্থানে স্থানে কখনো সেরকমই লাগে। 

উপন্যাসের চরিত্রবিন্যাস প্রথাগত কাঠামোর মতো। চরিত্রগুলি নাটকের মঞ্চে আসে যেন অরণ্যজীবনের কোনো খবর বা ঘটনা বলতে ও লেখকও ক্রমশ সেই ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে পড়েন, যা উপন্যাসে রং ভরে দেয় ও জঙ্গলের রহস্যময় পরিবেশের মধ্যে বৈচিত্র্য তৈরি করে। বিভূতিভূষণের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সরলতা। জীবনের সহজ-সাধারণ অভিজ্ঞতার সহজ-সরল কথক তিনি।

উপন্যাসটি জুড়ে আছে অরণ্যজীবনের অভিজ্ঞতাকে ঘিরে এক মুগ্ধতা। একজন শহুরে মানুষ হলেও সহজভাবে বিশ্বাস করেন এই অঞ্চলের মানুষের লৌকিক ও অলৌকিক গল্পগুলিকে। অনেক জায়গায় এই মুগ্ধতা অলৌকিকতা তৈরি করে। খানিকটা উপন্যাসের খাতিরে পাঠকের কথা মাথায় রেখে তিনি তাকে গল্পের অংশ করে নেন। যেমন বন্য মহিষের দেবতা ‘টাড়বাড়ো’র কথা, একজন মহিলার রূপ বদলে কখনো ‘ককুর’-এ পরিণত হওয়ার কথা বা রাতে জঙ্গলের মধ্যে হ্রদ ‘সরস্বতী কূণ্ডী’র কাছে পরীদের স্নান করার ঘটনা ইত্যাদি।

এ সম্বন্ধে তিনি অষ্টম পরিচ্ছেদে লেখেন, ‘সেদিন আমার সত্যই মনে হইয়াছিল এখানে মায়াবিনী বনদেবীরা গভীর রাত্রে জ্যোৎস্নাস্নাত হ্রদের জলে জলকেলি করিতে নামে। চারিধারে নীরব নিস্তব্ধ – পূর্বতীরের ঘন বনে কেবল শৃগালের ডাক শোনা যাইতেছিল।’

তাই তিনি এমন ঘটনা বা ‘চরিত্র’ নিয়ে আসেন যারা প্রকৃতি ও উপন্যাসের সঙ্গে মিশে থাকে ও আরণ্যক পরিবেশের সঙ্গে মানানসই হয়ে যায়।

এরকম একটি ‘চরিত্র’ হলো ‘যুগলপ্রসাদ’। যুগলপ্রসাদ সম্বন্ধে তিনি লেখেন, ‘লোকটার উদ্দেশ্য বুঝিয়া তাহার উপর আমার শ্রদ্ধা হইল। লোকটা সম্পূর্ণ বিনাস্বার্থে একটা বিস্তৃত বন্যভূমির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করিবার জন্য নিজের পয়সা ও সময় ব্যয় করিতেছে, যে বনে তাহার নিজের ভূস্বত্ব কিছুই নাই – কি অদ্ভুত লোকটা।’

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদে তিনি এ-সম্বন্ধে লেখেন ‘এই অপূর্ব নিভৃত সৌন্দর্যভূমি যুগলপ্রসাদের স্বহস্তে রোপিত নানা জাতীয় বন্য ফুলে ও লতায় সজ্জিত হইয়া আরও সুন্দর হইয়া উঠিয়াছে। সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে স্বরস্বতী হ্রদ ও তাহার তীরবর্তী বনানীর মত সৌন্দর্যভূমি খুব বেশি নাই – এ নিঃসন্দেহে বলিতে পারি।’

তিন

বিভূতিভূষণের সৌন্দর্য-মুগ্ধতার উদাহরণ ছড়িয়ে আছে এই উপন্যাসের বিভিন্ন স্থানে।

উপন্যাসটির পঞ্চম পরিচ্ছেদে আছে একবার ফাল্গুন মাসে হোলির সময় সত্যচরণকে কাছারিবাড়ি থেকে প্রায় দশ ক্রোশ দূরে একটি গ্রামে যেতে হয়। সেই গ্রামে একটি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামে যাওয়ার পথে একটি জঙ্গল ও জনশূন্য জায়গা পড়ে। মেলা দেখে আসার পথে বেলা পড়ে আসে। কিন্তু সত্যচরণ কাছারিবাড়ি ফেরার জন্য উদ্যমী হয়। তখন তাকে রাতে জঙ্গলপথ ধরে ফেরার আসন্ন বিপদ সম্বন্ধে সবাই সাবধান করে। কিন্তু সে তা না মেনে চলে আসে।

জঙ্গলের রাতের সৌন্দর্যের হাতছানি সে উপেক্ষা করতে পারে না।

এ সম্বন্ধে বিভূতিভূষণ লেখেন, ‘এ বাসন্তী পূর্ণিমার পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নারাত্রে জনহীন পাহাড়-জঙ্গলের পথে একা ঘোড়ায় চড়িয়া যাওয়ার প্রলোভন আমার কাছে দুর্দমনীয় হইয়া উঠিল।’

সত্যচরণ যখন রাতে জঙ্গলের পথ ধরে কাছারিবাড়ি ফিরছে সেই অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে পঞ্চম পরিচ্ছেদে পরে ঔপন্যাসিক লেখেন, ‘এই মুক্ত জ্যোৎস্নাশুভ্র বনপ্রান্তরের মধ্যে দিয়ে যাইতে যাইতে ভাবিতেছিলাম, এ এক আলাদা জীবন, যারা ঘরের দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকিতে ভালবাসে না, সংসার করা যাদের রক্তে নাই, সেই সব বারমুখো, খাপছাড়া প্রকৃতির মানুষের পক্ষে এমন জীবনই তো কাম্য। কলিকাতা হইতে প্রথম প্রথম আসিয়া এখানকার এই ভীষণ নির্জনতা ও সম্পূর্ণ জীবনযাত্রা কি অসহ্য হইয়াছিল, কিন্তু এখন আমার মনে হয় এ-ই ভাল।’

জঙ্গলের সৌন্দর্যের আলাদা আলাদা রূপ প্রত্যক্ষ করার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন উপন্যাসের বিভিন্ন জায়গায়।

তাই পঞ্চম পরিচ্ছেদে জঙ্গলে বৃষ্টির বর্ণনা দিচ্ছেন ও শেষে লিখছেন, ‘মাইলের পর মাইলব্যাপী কাশ ও ঝাউ বন বর্ষার জলে ভিজিতেছে, আমার আপিস ঘরের বারান্দায় চেয়ার পাতিয়া বসিয়া দেখিতাম, আমার সামনে কাশবনের মধ্যে একটা বনঝাউের ডালে একটা সঙ্গীহারা ঘুঘু বসিয়া অঝোরে ভিজিতেছে।’ তারপর লেখেন, ‘এমনদিনে আপিস-ঘরে বসিয়া দিন কাটানো আমার পক্ষে কিন্তু অসম্ভব হইয়া উঠিত। ঘোড়ার জিন কষিয়া বর্ষাতি চাপাইয়া বাহির হইয়া পড়িতাম। সে কি মুক্তি! কি উদ্দাম জীবনানন্দ!’

অষ্টম পরিচ্ছেদে তিনি আরেক রূপ সম্বন্ধে তাঁর উপলব্ধির কথা লিখছেন,  ‘গভীর রাত্রে ঘরের বাহিরে একা আসিয়া দাঁড়াইয়া দেখিয়াছি, অন্ধকার প্রান্তরের অথবা ছায়াহীন ধুধু জ্যোৎস্না-ভরা রাত্রির রূপ। তার সৌন্দর্যে পাগল হইতে হয় – একটুও বাড়াইয়া বলিতেছি না – আমার মনে হয় দুর্বলচিত্ত মানুষ যাহারা, তাহাদের পক্ষে সে-রূপ না দেখাই ভাল, সর্বনাশী রূপ সে, সকলের পক্ষে তার টাল সামলানো বড় কঠিন।’

এরপর একাদশ পরিচ্ছেদে আছে – ‘এক এক জায়গায় ফাঁকা জঙ্গলের দিকে বনের কি অনুপম শোভা! কি এক ধরনের থোকা থোকা সাদা ফুল সারা বনের মাথা আলো করিয়া ফুটিয়া আছে ছায়াগহন অপরাহ্ণের নীল আকাশের তলে। মানুষের চোখের আড়ালে সভ্য জগতের সীমা হইতে বহুদূরে এত সৌন্দর্য কার জন্য যে সাজানো।’

এরকম তিনি দ্বাদশ পরিচ্ছেদে রাত্রির বর্ণনা দিয়ে লিখছেন, ‘রাত্রি গভীর। একা প্রান্তর বাহিয়া আসিতেছি। জ্যোৎস্না অস্ত গিয়াছে। কোন দিকে আলো দেখা যায় না, এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা – এ যেন পৃথিবী হইতে জনহীন কোন অজানা গ্রহলোকে নির্বাসিত হইয়াছে – দিগন্তরেখায় জ¦লজ¦লে বৃশ্চিকরাশি উদিত হইতেছে, মাথার উপর অন্ধকার আকাশে অগণিত দ্যুতিলোক, নিম্নে লবটুলিয়া বইহারের নিস্তব্ধ অরণ্য, ক্ষীণ নক্ষত্রালোকে পাতলা অন্ধকারে বনঝাউয়ের শীর্ষ দেখা যাইতেছে – দূরে কোথায় শিয়ালের দল প্রহর ঘোষণা করিল – আরও দূরে মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের সীমারেখা অন্ধকারে দীর্ঘ কালোপাহাড়ের মত দেখাইতেছে – অন্য কোন শব্দ নাই, কেবল একধরনের পতঙ্গের একঘেয়ে একটানা কি-র-র-র শব্দ ছাড়া; কান পাতিয়া ভাল করিয়া শুনিলে ঐ শব্দের সঙ্গে মিশানো আরও দু-তিনটে পতঙ্গের আওয়াজ শোনা যাইবে। কি অদ্ভুত রোমান্স এই মুক্ত জীবনে, প্রকৃতির সহিত ঘনিষ্ঠ নিবিড় পরিচয়ের সে কি আনন্দ!’

চার

উপন্যাসে বিভূতিভূষণের সৌন্দর্য-মুগ্ধতার সঙ্গে তাঁর স্মৃতিকাতরতাও মিশে যায়, আর তার সঙ্গে জুড়ে যায় এক কল্পনার জগৎও।

অষ্টম পরিচ্ছেদে আছে, ‘এক-এক দিন বাংলা দেশে ফিরিবার জন্য মন হাঁপাইয়া উঠিত, বাংলা দেশের পল্লীর সে সুমধুর বসন্ত কল্পনায় দেখিতাম, মনে পড়িত বাঁধানো পুকুরঘাটে স্নানান্তে আর্দ্রবস্ত্রে গমনরতা কোন তরুণী বধূর ছবি। মাঠের ধারে ফতফোটা ঘেঁটুবন, বাতাবিলেবুর ফুলের সুগন্ধে মোহময় ঘনছায়া ভরা অপরাহ্ণ।’

সেরকম অষ্টম পরিচ্ছেদে এক জায়গায় লেখেন, ‘অনেকদিন পর যখন এই মুক্ত জীবন ত্যাগ করিয়া সংসারে প্রবেশ করি, তখন কলিকাতা শহরের ক্ষুদ্র গলির বাসাবাড়িতে বসিয়া স্ত্রীর সেলাইয়ের কল চালনার শব্দ শুনিতে শুনিতে অবসর-দিনের দুপুরে কতবার এই রাত্রির কথা, এই অপূর্ব আনন্দের কথা, এই জ্যোৎস্নামাখা রহস্যময় বনশ্রীর কথা, শেষ রাত্রের চাঁদ ডোবা অন্ধকার পাহাড়ের উপর শুভ্রকাণ্ড গলগোলি গাছের কথা, শুকনো কাশ-জঙ্গলের সোঁদা সোঁদা তাজা গন্ধের কথা ভাবিয়াছি। কতবার কল্পনায় আবার ঘোড়ায় চড়িয়া জ্যোৎস্নারাত্রে পূর্ণিয়া গিয়াছি।’

পাঁচ

উপন্যাসের কয়েক স্থানে সত্যচরণ বা বিভূতিভূষণের ইতিহাস-চেতনাও মিলে যায়।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদে আছে, ‘পূর্বদিকের পাহাড়ের গায়ে একটা প্রকাণ্ড গুহা। গুহার মুখে প্রাচীন ঝাঁপালো বটগাছ। দিনরাত শন শন করে। দুপুর রোদে নীল আকাশের তলায় এই জনহীন বন্য উপত্যকা ও গুহা বহু প্রাচীন যুগের ছবি মনে আনে, যে-যুগে আদিম জাতির রাজাদের হয়ত রাজপ্রাসাদ ছিল এই গুহাটা, যেমন রাজা দোবরু পান্নার পূর্বপুরুষদের আবাস-গুহা। গুহার দেওয়ালে একস্থানে কতকগুলো কি খোদাই করা ছিল, সম্ভবত কোন ছবি – এখন বড়ই অস্পষ্ট, ভালো বোঝা যায় না। কত বন্য আদিম নরনারীর হাস্য-কলধ্বনি, কত সুখদুঃখ-বর্বর সমাজের অত্যাচারের কত নয়নজলের অলিখিত ইতিহাস এই গুহার মাটিতে, বাতাসে, পাষাণ প্রাচীরের মধ্যে লেখা আছে – ভাবিতে বেশ লাগে।’

ষোড়শ পরিচ্ছেদে আছে, ‘যুগলপ্রসাদ বলিল – বাবুজী, একটা গুহা আছে পাহাড়ের মধ্যে জঙ্গলে – তার গায়ে সব ছবি আঁকা আছে – কতকাল কেউ জানে না, সেটাই খুঁজছি। হয়ত বা প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের হাতে আঁকা বা খোদাই করা ছবি গুহার কঠিন পাথরের গায়ে! পৃথিবীর ইতিহাসের লক্ষ্য লক্ষ্য বৎসরের যবনিকা এই মুহূর্তে অপসারিত হইয়া সময়ের উজানে কোথায় লইয়া গিয়া ফেলিবে আমাদের!’

এছাড়া একাদশ পরিচ্ছেদে সাঁওতাল রাজা দোবরু পান্নার পূর্বপুরুষদের সমাধিস্থান ও দুর্গপ্রাসাদ দেখে সত্যচরণের কি ঐতিহাসিক উপলব্ধি হয়েছিল তা পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে বাঙালি পাঠকেরা জেনেছেন উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর, এত বছর ধরে। এই অনুভবের গভীরতাই বিভূতিভূষণকে আলাদা করেছে তাঁর সমকালীন অন্য লেখকদের থেকে।

ছয়

উপন্যাসের শেষে দেখা যায় সত্যচরণকে এই জমিদারির অধীন জমিগুলি বিক্রির বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে, কিন্তু এই কাজটি তার মতো জঙ্গলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ মানুষের পক্ষে করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদে বিভূতিভূষণ এ-সমন্ধে লেখেন, ‘চাকুরীর খাতিরে মনিবের স্বার্থরক্ষার জন্য সব জমিতেই প্রজাবিলি করিয়াছি বটে কিন্তু যুগলপ্রসাদের হাতে সাজানো সরস্বতী-তীরের অপূর্ব বনকুঞ্জ কিছুতেই প্রাণ ধরিয়া বন্দোবস্ত করিতে পারি নাই। কতবার দলে দলে প্রজারা আসিয়াছে চাহিয়াছে, কারণ একে ঐ জমি খুব উর্বরা, তাহার উপর নিকটে জল থাকায় মকাই প্রভৃতি ফসল ভালো জন্মাইবে; কিন্তু আমি রাজী হই নাই।’

তবে তাঁকে যে সৌন্দর্যে ভরা বিস্তৃত অরণ্যের এই জমি শেষমেশ বন্দোবস্ত করতে হয়, তার জন্য তিনি অনুতপ্ত মনে লেখেন, ‘হে অরণ্যানীর আদিম দেবতারা, ক্ষমা করিও আমায়। বিস্মৃতপ্রায় অতীতের যে নাড়া ও লবটুলিয়ার অরণ্য-প্রান্তর আমার হাতেই নষ্ট হইয়াছিল, সরস্বতী হ্রদের সে অপূর্ব বনানী, তাহাদের স্মৃতি স্বপ্নের মত আসিয়া মাঝে মাঝে মনকে উদাস করে।’

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রকৃতিবাদী মানুষ। এক বিস্তৃত সৌন্দর্যে ভরা প্রকৃতির মধ্যে মানুষের বিচিত্র অবস্থান দেখানোই তাঁর এই উপন্যাসের মূল দর্শন।