রবীন্দ্রনাথ ও এজরা পাউন্ড : সম্পর্কের সূত্র-সন্ধান

‘ঠাকুর সন্ধ্যা’। ৭ জুলাই, ১৯১২। লন্ডনের হ্যামস্টেডে রথেনস্টাইনের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সম্মানে এক ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে অতিথি লন্ডনের সাহিত্যজগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস তাঁর সুরেলা কণ্ঠে কবিতাগুলি পড়ছেন। তরুণ কবিরা বসে কবিতা শুনছেন, আর্নেস্ট রিস, অ্যালিস মেইনেল, হেনরি নেভিসন, এজরা পাউন্ড, মে সিনক্লেয়ার, চার্লস ট্র্যাভেলিয়ানসহ আরো অনেকে। (রথীন্দ্রনাথ, On the Edges of Times পৃ ১০১)

এজরা পাউন্ডও সেদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা শুনছিলেন। সেই সময়ে লন্ডনে কবিদের মধ্যে প্রভাবশালী একজন আমেরিকান কবি, সমালোচক, সংগঠক ছিলেন পাউন্ড। তিনি কবিতায় আধুনিকতাবাদের রূপদানকারীদের মধ্যে অন্যতম, যিনি মুক্তছন্দে কবিতা লেখার সমর্থক ছিলেন। দক্ষতার সঙ্গে কোলাজ এবং অভিব্যক্তির কৌশল অনুশীলন করে অভিনবত্ব ও প্রথাগত ধারার ওপর পরীক্ষা চালিয়ে কবিতার একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন পাউন্ড। তাঁর সময়ের প্রভাবশালী লেখকের সঙ্গে তাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।

পাউন্ডকে অনেক কাছ থেকে দেখে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ অন দি এজেস অব টাইমসে পাউন্ড সম্পর্কে লেখেন, তিনি ছিলেন অনন্য, ভিন্ন এক জাতের। কবিতাকে তিনি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন, তাঁর কবিতা নিয়ে তিনি ছিলেন গর্বিত এবং সচেতন, তিনি সফলভাবে অন্য সহযোগীদের ফেলে অনেক এগিয়ে গিয়েছিলেন। লোকটাকে পছন্দ না করে কোনো উপায় ছিল না। আমেরিকান হিসেবে তিনি গর্ব করতেন না, বরং ছিলেন অমায়িক, সাধারণ এবং উষ্ণ হৃদয়। তিনি পিতার প্রতি নিবেদিত ছিলেন এবং তাঁকে গুরু মানতেন। (পৃ ১০৫)

পাউন্ডের জন্ম আমেরিকার পেনসিলভানিয়ায় ১৮৮৫ সালে। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে শেখেন গ্রিক এবং ল্যাটিন ভাষা। ইন্ডিয়ানা রাজ্যের ওয়াবাশ কলেজে রোমান্স ঘরানার উপন্যাসের ভাষাবিষয়ক প্রভাষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯০৮ সালে চলে আসেন ইউরোপে। এই সময় আগ্রহী হয়ে ওঠেন চীনা আর জাপানি ভাষার কবিতায়। কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস (যিনি তাঁর চেয়ে ২০ বছরের বড় ছিলেন) এবং টি এস এলিয়টের সঙ্গে গড়ে তোলেন বন্ধুত্ব। জেমস জয়েসসহ আরো অনেক কবিকে জনপ্রিয় করতেও তাঁর অবদান রয়েছে। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত পোয়েট্রি পত্রিকার বৈদেশিক সংবাদদাতা নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি লন্ডনে। কানাডার চিত্রশিল্পী উইন্ডহ্যাম লুইসের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশ করেন BLAST  সাহিত্য সাময়িকী। ১৯১৭ সালে হন The Little Review পত্রিকার লন্ডনের সম্পাদক। তাঁর সৃষ্টিশীল কাজের সংখ্যা প্রচুর।

পাউন্ড ও রবীন্দ্রনাথের হৃদ্যতা  

১৯১২ সালে আমেরিকায় কবিতা-সাময়িকী পোয়েট্রি সবে বের হয়েছে। সম্পাদক হ্যারিয়েট মনরো। লন্ডনে রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনার পর অন্য কোনো সাময়িকী যাতে পোয়েট্রির আগে তাঁর লেখা না পায় সে-বিষয়ে পাউন্ড উদ্বিগ্ন ছিলেন। মিস মনরোকে ১৯১২ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করে লিখলেন –

… আমি খুব বড় একজন বাঙালি কবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু কবিতা পাওয়ার চেষ্টা করছি। এগুলি পোয়েট্রির শীতকালীন সংখ্যার জন্য খুবই আকর্ষণীয় হবে … লেখক নিজেই এগুলি চমৎকারভাবে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।The letters of Ezra Pound (1007-1941), letter no. 6, page 44  

কিছুদিন পর কবিতাগুলি হাতে পেয়ে পাউন্ড আবার মিস মনরোকে লিখলেন, তিনি পোয়েট্রির পরের সংখ্যার জন্য রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কবিতা পেয়েছেন এবং অনুভব করছেন ভারতীয় কবির কবিতা ইংল্যান্ড এবং আমেরিকাতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন। তিনি লিখলেন –

এগুলি ংপড়ড়ঢ় (অর্থাৎ প্রথম তাঁরই হস্তগত হলো)। ঠাকুরের জন্য পরবর্তী সংখ্যাতে স্থান সংরক্ষণ করুন। বাঙালি জাতি তাঁর গান গায় এবং তাঁর কবিতাগুলির ইংরেজি সংস্করণ খুব চমৎকার। আমরা আমেরিকান কপিরাইটটি ধরে রাখছি। আমি কয়েক সপ্তাহ থেকে ভাবছি এগুলি শীতকালীন সংখ্যার জন্য একটি বিশাল ঘটনা। … আমরা পোয়েট্রির জন্য ছয়টি কবিতা পেয়েছি যা এখানে আর কেউ পায়নি ... Harriet Monroe, A Poet‘s Life (New York, 1938), p. 262

পোয়েট্রি ম্যাগাজিনের ১৯১২ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের ছয়টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁকে নিয়ে লেখা পাউন্ডের একটি নিবন্ধ। এই কবিতাগুলি ছিল ইন্ডিয়া সোসাইটি প্রকাশিত গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ থেকে নেওয়া। পাউন্ড এবং মনরো ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলেন কারণ এইগুলিই ছিল ভারতের বাইরে, পশ্চিমে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের প্রথম কবিতা। মনরোকে লেখা পাউন্ডের অন্য চিঠি থেকে জানা যায়, তিনি রবীন্দ্রনাথকে লেখার সম্মানী বাবদ ৩০ ডলার পাঠিয়ে দিয়েছেন। The Letters of Ezra Pound (১৯০৭-১৯৪১), পত্র নং ১০, পৃ ৪৭।

কয়েক মাস পরে ১৯১৩ সালের মার্চে সেই সময়ের নামকরা সাহিত্য সাময়িকী ফোর্টনাইলি রিভিউতে একটি প্রবন্ধে পাউন্ড রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ইতালির কবি দার্শনিক দান্তে এবং কবি-লেখক জিওভান্নি বোকাচ্চিওর সঙ্গে তুলনা করেন।

পাউন্ড লিখেছেন – ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতার আবির্ভাব আমার মতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি কোনোভাবেই নিশ্চিত নই কীভাবে পাঠককে এর গুরুত্ব বোঝাতে পারি। প্রমাণ হিসেবে আমি তাঁকে নিঃশব্দে পড়তে বলব। তবে উচ্চস্বরে কোনো অসুবিধা নেই, এগুলি সেই সুরকারেরই ইংরেজিতে অনুবাদ করা, সুর সম্পর্কে যাঁর অনেক সূক্ষ্ম ধারণা আছে। আমি মাসখানেক আগে মিস্টার ইয়েটসের কক্ষে তাঁকে দেখেছি, ‘যিনি ছিলেন আমাদের সবার চেয়ে সেরা’ কোথা থেকে শুরু করব তা বলা সত্যই কঠিন। বাংলায় ৫ কোটি মানুষের বাস। ঠাকুর সেখানকার একজন জনপ্রিয় কবি, সুরকার ও গায়ক। আমি, ‘সোনার বাংলা’ গানটি শুনেছি, এটি পুরোপুরি পূর্বের, তবু এটিতে একটি কৌতূহলী শক্তি আছে, আছে জনতাকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা। গানটি আত্মবাদী, তবু এতে কর্মশক্তির সব বৈশিষ্ট্য আছে। প্রাচ্যে ফরাসি জাতীয় সংগীতের মতো কোনো সংগীত থাকলে তাঁর গানকেই বেছে নেওয়া হতো।’ (তখন থেকে প্রায় ৬০ বছর পর এই ‘সোনার বাংলা’ গানটি যে সত্যই একদিন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে তখন কেউ কি তা ভেবেছিল?) (‘Rabindranath Tagore’, Ezra Pound, Fortnightly Review, https://fortnightlyreview. co.uk/2013/04/rabindranath-tagore/)

এই প্রবন্ধে পাউন্ড রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘… বাংলা হলো ‘সংস্কৃত’ ভাষার ‘দুহিতা’, শুনতে যেন চমৎকার গ্রিক। ছন্দবিন্যাসগুলি ভিন্ন, চারটি শব্দের ছড়া, এগুলি এমন কিছু যা ‘লিওনিনের’ চেয়ে বেশি [লিওনিন – ফ্রান্সের গির্জায় গাওয়া একধরনের সংগীত]। এর সঙ্গে মুক্তছন্দ কবিতা যুক্ত করলে বাংলা কাব্যের একটি মোটামুটি ছবি পাওয়া যাবে। এই ভাষার প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে এবং রয়েছে সহজ ছড়ার ছন্দ। আপনি দুটি শব্দ একসঙ্গে বলতে পারেন যেমন গ্রিক বা জার্মান ভাষায় হয়। …’

গীতাঞ্জলির ১০০ কবিতা সম্পর্কে পাউন্ড বলেন, ‘সবগুলি কবিতাই গান গাওয়ার মতো। সুরগুলি এবং শব্দগুলি একসঙ্গে বোনা এবং একসঙ্গে তৈরি করা। প্রথমত এগুলি ভারমুক্ত এবং শব্দের মধ্যে একটি ঐকতান আছে। দ্বিতীয়ত এর রাগিণীর ধরনটা গ্রিকের মতো, যার মাঝে আছে মিলনের জাদু।’ (`Rabindranath Tagore’, Ezra Pound, Fortnightly Review, LXXXXIX, p 573, March, 1913)

রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঠিক কয়েকদিন আগে সাহিত্য পত্রিকা নিউ ফ্রিউইমেনের ১লা নভেম্বর, ১৯১৩ সংখ্যায় ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথের স্ব-অনূদিত দ্বিতীয় বই ঞযব এধৎফবহবৎ নিয়ে পাউন্ড আরেকটি মূল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ লেখেন।

প্রবন্ধটি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথের ‘এক গাঁয়ে’ কবিতা দিয়ে। The yellow bird sings in their tree

and makes my heart dance with gladness

We both live in the same village, and that is our

one piece of joy…     

তারপর আবার কথার ফাঁকে ফাঁকে কবিতার লাইন জুড়ে দিয়ে, বিশ্লেষণ করেন।

‘ইংল্যান্ডের মানুষ কবিকে সমাদর করতে পারছে না’ – এই সমালোচনা করে লেখেন, ‘এই দ্বীপের ভালো লোকেরা কেন একজন চমৎকার কবিকে সম্মান জানাতে পারছে না? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কোনোভাবেই ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে অথবা রহস্যময় প্রাচ্যের ধর্মপ্রচারকের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। আমি বলি, ঠাকুরের কবিতার সঙ্গে প্রকৃতির একটি আবেগময় যোগাযোগ আছে, আছে একটি অন্তর্দৃষ্টি যা আরো সুন্দর, তা প্রকাশের আছে একটি নিজস্ব উপায়, যা আমি এখন পর্যন্ত আর কোনো কবির কবিতায় খুঁজে পাইনি। গীতাঞ্জলিতে তিনি তাঁর পরিণত সময়ের গান আমাদের দিয়েছেন, আর দি গার্ডেনারে তিনি আমাদের দিয়েছেন তাঁর যৌবনের দিব্য-তান্ত্রিক সুখী জীবনের কথা।’ নমুনা হিসেবে উল্লেখ করেন রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি পর্বের কবিতা –

আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা।

নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই – লুকোচুরি খেলা ॥

Over the green and yellow rice fields sweep the

shadows of the autumn clouds,

followed by the swift-chasing sun.

The bees forget to sip their honey; drunken with …

(Ezra Pound, `Rabindranath Tagore,Õ New

Freewoman, November 1, 1913]

পাউন্ড ও রবীন্দ্রনাথের দ্বন্দ্ব এবং তার কারণ

১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ইংল্যান্ডে আসেন তখন তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল গীতাঞ্জলি এবং দি গার্ডেনার বই দুটিকে পূর্ণাঙ্গ করা এবং প্রকাশনার ব্যবস্থা করা। তিনি তাঁর কবিতাগুলি সম্পাদনার জন্য একাধিক ব্যক্তির সাহায্য নেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি এজরা পাউন্ড।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে আমেরিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা আমেরিকায় প্রকাশ করতে আগ্রহী ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার বিশাল বইয়ের বাজারে বই বিক্রি করে তাঁর স্থাপিত বিদ্যালয় বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। আমেরিকায়  কবির লেখা পরিচিত করাতে পাউন্ড এবং ইয়েটসের সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশের জন্য অনেকেই তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে

রথেনস্টাইনকে কবি লেখেন, ‘….আমার কয়েকটি লেখার অনুবাদ আপনাকে পাঠালাম। এখানে আমার বন্ধুরা মনে করেন আমার কিছু লেখা আমেরিকান সাময়িকীতে প্রকাশ হওয়া উচিত, তাহলে আমেরিকার ক্রেতাদের আমার সম্পর্কে একটি আগ্রহ তৈরি হবে। শিকাগোর লুইস ইনস্টিটিউটের ডা. লুইস আমার ছেলেকে কিছু লেখা মি. পাউন্ড এবং মি. ইয়েটস-এর মাধ্যমে সম্পাদকদের কাছে পাঠাতে উপদেশ দিয়েছেন। তিনি মনে করেন যে, আমেরিকা হলো সেই জায়গা যেখানে সঠিকভাবে পরিচয় করানো হলে বইগুলির বিশাল বিক্রয় হবে। আমিও মনে করি সত্যই এটা আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি ভালো প্রচেষ্টা হবে। আমি এজরা পাউন্ডের কাছে কিছু অনুবাদ পাঠিয়ে দিয়েছি। …’ (Imperfect Encounter : Letters of William Rothenstein and Rabindranath Tagore 1911-1941, page 85, letter no 28)|  

আরো কিছু চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের লেখা বিভিন্ন সাময়িকীতে ছাপাতে পাউন্ড যে সাহায্য করেছিলেন তারও প্রমাণ পাওয়া যায়, যেমন, ১৯১৪ সালে পাউন্ডের মা (ইসাবেলা পাউন্ড) কারো জন্য সুপারিশ করলে তিনি তা করতে পারবেন না জানিয়ে উত্তরে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘ঠাকুরই তাঁকে কবিতাগুলি ছাপাতে খোঁচাচ্ছিলেন, কবিতার নির্বোধ নির্বাচকদের কাছে কবিতাগুলি ভাল বলতে বলেছিলেন।’ (Letters of Ezra Pound 1907-1941, page 68, letter no. 34)। পাউন্ডের সঙ্গে পোয়েট্রি সম্পাদকের সহযোগী এলিস করবিন হেনডারসনকে (Alice Corbin Henderson) লেখা চিঠি থেকে জানা যায় যে, পাউন্ড রবীন্দ্রনাথের কবিতা দি আটলান্টিক ম্যাগাজিনে ছাপতে পাঠিয়েছিলেন (Letters of Ezra Pound 1907-1941, page 49, letter no. 12) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘To the Watcher’ বস্টন থেকে প্রকাশিত দ্য আটলান্টিক মান্থলি-তে প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালের মে সংখ্যায়। ছাপা হলে ওই পত্রিকার সম্পাদক সম্মানী পাঠানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লিখে ঠিকানা জানতে চান। (রবিজীবনী, প্রশান্ত কুমার পাল, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ ৩৬৮)

রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালের ৫ই জানুয়ারি আরবানা থেকে পাউন্ডকে চিঠি লেখেন এবং সঙ্গে ২৫টি কবিতা পরিমার্জনের জন্য অনুরোধ করেন। সেই চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘এখানে করা কিছু অনুবাদ আপনাকে পাঠালাম। আমি মোটেও ইংরেজি ব্যাকরণে এত পাকা নই – যেখানে প্রয়োজন লেখাগুলি সেখানে সংশোধনে মোটেও কার্পণ্য করবেন না। তারপর আবার আমি অনেক ইংরেজি শব্দের অন্তর্গত প্রকৃত মানে জানি না। কিছু শব্দের জীবাত্মা হয়তো অতি ব্যবহারে জীর্ণ অথবা কিছু হয়তো এখনো তেমন সুযোগই পায়নি। সুতরাং আমার শব্দগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অনুপাত এবং যথাযথতার অভাব থাকতে পারে, যা বন্ধুত্বপূর্ণ হাতে সংশোধন করা যেতে পারে।’ (`Selected Letters of Rabindranath Tagore, Edited by Krishna Dutta and Andrew Robinsor, Cambridge University Press, 1997, page 103)

পাউন্ড তাঁর প্রেমিকা ও পরে তাঁর স্ত্রী ডরোথি শেকসপিয়রকে লন্ডন থেকে ২১শে জানুয়ারি, ১৯১৩ সালে এক চিঠিতে লেখেন, ‘শিকাগোর সংবাদপত্রগুলি ঠাকুরকে নিয়ে মাতামাতি করছে। তিনি আমাকে ২৫টি নতুন কবিতা পাঠিয়েছেন – এর থেকে কয়েকটা আমি বৃহস্পতিবার পড়বো – হাঁস নিয়ে আছে একটি সুন্দর কবিতা।’ (Letters, EP and Dorothy, p 183)

পাউন্ড এভাবেই আমেরিকার সাময়িকীতে কবিতা প্রকাশ এবং অনুবাদকে পরিশীলন করে কবিকে সাহায্য করেছিলেন আর তাই পাউন্ড আশা করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথকে তিনি ইচ্ছামতো পরিচালিত করতে পারবেন; কিন্তু বাস্তবে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ পাউন্ডকে আর তেমন গ্রাহ্য করছিলেন না এবং সারাবিশ্ব তাঁকে নিয়ে মেতে ওঠে, যা সম্ভবত পাউন্ডকে ব্যথিত করে। এটি স্পষ্ট যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনপ্রিয়তা এবং সাফল্যে পাউন্ডের মনোভাব বদলে যায়। ভারতীয় কবি যখন অজানা ছিলেন, পাউন্ড তখন তাঁর রক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন, ইংরেজরা ঠাকুরকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় তিনি এটা তাঁদের বোকামি বলে উল্লেখ করেছেন (Ezra Pound, ‘Rabindranath Tagore’, New Freewoman, Nov. 1, 1913)। কিন্তু যখন ইংরেজরা রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করে পাউন্ডের প্রশংসার শব্দগুলি ব্যবহার করতে লাগলো তখনই পাউন্ড নিজেকে বদলে ফেললেন। পাউন্ড আপাতদৃষ্টিতে স্তম্ভিত হয়ে নিজে দ্রুত তাঁর অবস্থান থেকে সরে এলেন।

পাউন্ড এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক বর্ণনা করতে গিয়ে আমেরিকান লেখক অধ্যাপক হ্যারল্ড হারভিসের বলেন, ‘ঠাকুরের আধ্যাত্মিক ধারার কবিতার প্রতি পাউন্ড সহানুভূতিশীল ছিলেন। পাউন্ডও তাঁর প্রথম দিকের গ্রিক ইপিগ্রামে (সংক্ষিপ্ত কবিতা বিশেষ) ঈশ্বরকেই সকল সৌন্দর্য সৃষ্টির মূল বলেছিলেন, যে ভাবটি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পাওয়া যায়। পরে পাউন্ড আধ্যাত্মিকতা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন যা হয়তোবা ঠাকুর আর পাউন্ডের মধ্যে দ্বন্দ্বের কিছুটা ইন্ধন হয়ে থাকবে।’ (April 22, 1913) (Letters of Ezra Pound, p. 19)

১৯১৩ সালের নভেম্বরে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেলেন তখন পশ্চিমা বিশ্বে যেন একটি বোমা ফাটল। রবীন্দ্রনাথকে বিভিন্নভাবে আক্রমণ করা হতে লাগলো। পশ্চিমের পত্রিকাগুলিও হলো সমালোচনামুখর। (Rabindranath through Western Eyes by Dr. A Aronson, 1943, Chapter 1, Poetic Justice)

যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে পশ্চিমে পরিচিত করাতে ব্যস্ত ছিলেন তাঁরাই তাঁর তীব্র সমালোচনা করতে লাগলেন। কেউ কেউ বলতে লাগলেন, গীতাঞ্জলি কবির নিজের অনুবাদই নয়। ডব্লিউ বি ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ সম্পাদনা করে পাঠযোগ্য করেছেন। আরো যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করেছেন পাউন্ডও তাঁদের একজন।

১৯১৩ সালে নোবেলপ্রাপ্তির পর থেকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পাউন্ডের সম্পর্ক একেবারে ক্ষীণ হয়ে আসে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে চলেন। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন আবার আমেরিকায় আসেন তখনো তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের কোনো খবর পাওয়া যায় না। তবে রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তিতে পাউন্ড যে অন্যদের মতো ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন এবং তাঁর সেই ক্ষত যে মিলিয়ে যায়নি, তার প্রমাণ মেলে ১৯১৭ সালের জানুয়ারিতে আইরিস ব্যারিকে (যিনি ছিলেন একজন চলচ্চিত্র-সমালোচক এবং কিউরেটর। ১৯২০ সালে তিনি লন্ডন ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেন এবং ১৯৩৫ সালে নিউইয়র্ক সিটির মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের ফিল্ম বিভাগের প্রথম কিউরেটর ছিলেন) লেখা চিঠি থেকে। সেই চিঠিতে তিনি রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারকে একটি চক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি লেখেন, ‘ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, কারণ, আমাদের সময়ে সাহিত্যের পণ্ডিতগণ সর্বশক্তি দিয়ে ভীষণভাবে তাঁকে এগিয়ে দেন … তিনি ধার্মিক এবং আশাবাদীদের মধ্য সংযোগ স্থাপন করেন এবং তারাও একই কাজ করেন।’ সুইডিশ অ্যাকাডেমির সমালোচনা করে পাউন্ড বলেন, ‘তখন ইউরোপীয় লেখকদের মধ্যে টমাস হার্ডি অথবা হেনরি জয়েসকে বেছে নেওয়া সুইডিশ অ্যাকাডেমির জন্য দুরূহ ছিল … আর সুইডেন তো সুইডেনই।’

রবীন্দ্রনাথকে এগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করলেও পাউন্ড অবশ্যই জানতেন যে, এ-কাজে তিনি নিজেও অংশ নিয়েছিলেন এবং আরো অনেকের মধ্যে ইয়েটস, মে সিনক্লেয়ার এবং আর্নেস্ট রিস – ঠাকুরের প্রশংসায় আন্তরিক ছিলেন। পাউন্ডের উচিত ছিল, তিনিও যে তাদের একজন ছিলেন, মিস ব্যারির কাছে তা স্বীকার করা। সেই চিঠিতে পাউন্ড এতটুকু স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ‘ঠাকুর আধুনিক প্রাচ্য কবিদের মধ্যে অনন্য ছিলেন …।’ (Letters of Ezra Pound, p. 159-160, letter no. 118)

রবীন্দ্রনাথের প্রতি পাউন্ডের প্রথমদিকের আদর্শবাদ যে একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল তার প্রমাণ পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি বিদ্রƒপাত্মক হাস্য-কৌতুকপূর্ণ লেখায়। পাউন্ড ১৯১৭ সালের মে সংখ্যা লিটল রিভিউ (The Little Review, Vol. IV, No. 1, May 1917; 12-18) ম্যাগাজিনে ‘যোধীন্দ্রনাথ মাওহওয়ারের পেশা’ (`Jodindranath MawhworÕs Occupation’) নামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর একটি আশ্চর্যজনক অপবাদমূলক ও ব্যঙ্গাত্মক রচনা প্রকাশ করেন। ভারতীয় পবিত্র পুরুষদের নিয়ে মজা করে তিনি একটি ব্যঙ্গাত্মক চরিত্র এঁকেছেন এবং তাঁদের ‘ভুয়া’ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, যেখানে ‘যোধীন্দ্রনাথ’ প্রাচ্যের সেই চরিত্র। প্রেমের অভিনয় করা ব্যতীত ‘যোধীন্দ্রনাথে’র কোনো পেশা নেই এবং তিনি শুধু শিষ্যদের পরামর্শ দেন। উৎস হিসেবে ভারতীয় পবিত্র গ্রন্থগুলি ব্যবহার করেন। এই রচনায় কাল্পনিক চরিত্র এবং বাস্তবের রবীন্দ্রনাথের সাধুতার মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়, পাউন্ড যা লুকাতে পারেননি। আরো উদাহরণ দেওয়া যায়, যেমন – নামগুলি ভারতীয় এবং রবীন্দ্রনাথের নামের মতো ‘যোধীন্দ্রনাথ’ একজন বাঙালি। ‘যোধীন্দ্রনাথ মাওহওয়ার’ ধার্মিক এবং রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁরও শিষ্য আছে। (The Little Review, Vol. IV, No. 1, May 1917; 12-18)

কিছু কিছু মানুষ সর্বদাই উজান বেয়ে চলে। পাউন্ড তেমনই একজন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ‘গৌডিয়ার-ব্রজেস্কা’ নিহত হলে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন। পাউন্ড কবি হিসেবে লন্ডনে প্রতিষ্ঠা পেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। একসময় লন্ডনের সাহিত্যসমাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ১৯২০ সালে স্ত্রীসহ চলে যান প্যারিস। সেখানে ক্লান্ত হয়ে ১৯২৪ সালে চলে যান ইতালিতে। বাকি জীবনটা তিনি সেখানেই কাটান। রোম রেডিওতে আমেরিকার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারের জন্য পাঠানো হয় আমেরিকায়। সেখানে তাঁকে মানসিকভাবে অসুস্থ ঘোষণা করে ১৯৪২ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ১২ বছর বন্দি হিসেবে রাখা হয় সেইন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে। ১৯৫৮ সালে পাউন্ড আবার ইতালিতে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালে ভেনিসে পাউন্ড শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।   

যদিও পাউন্ড রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন, তবে পাউন্ডের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব দেখা যায় না, শুধু ১৯১৫ সালে তাঁর কবিতার বই লুস্টাতে ‘ডান্স ফিগার’ কবিতায় যে রহস্যময় কৃষ্ণনয়না নারীকে তিনি খুঁজছেন, তার পটভূমি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

Dance Figure

Ezra Pound

DARK-EYED,

O woman of my dreams,

Ivory sandaled,

There is none like thee among the dancers,

None with swift feet.

I have not found thee in the tents,

In the broken darkness.

I have not found thee at the well-head

Among the women with pitchers

প্রবন্ধকারের করা অনুবাদ –

কৃষ্ণ-নয়না,

ও আমার স্বপ্নের নারী,

চন্দন সুবাস মাখা গজদন্ত মালায়

নর্তকীদের মাঝে তোমার মতো আর কেউ নেই

কেউ নেই দ্রুত পায়ে।

আমি তোমাকে তাঁবুতে পেলাম না,

ভাঙা অন্ধকারে।

তোমাকে পেলাম না আদি-উৎসে

কলসি কাঁখে মেয়েদের মাঝে।