সাক্ষাৎকারে কবি আল মাহমুদের সাহিত্যচিন্তা

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ। একাধারে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে করেছেন সমৃদ্ধ। এছাড়া বিভিন্ন

পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে অনেক সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকারগুলিতে নানাবিধ বিষয়ের সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে তিনি তাঁর চিন্তা-ভাবনার কথা বলেছেন। সেসবের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী তুলে ধরা হলো।

সাধারণ্যে এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, আধুনিক কবিতা দুর্বোধ্য। আপনি এ-ধারণাকে কীভাবে খণ্ডন করবেন – এমন একটি প্রশ্নে সাহিত্য পত্রিকা কবির জন্য দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (মে ১৯৮৬) আল মাহমুদ বলেন, ‘একজন পাঠক হিসেবে আমার কাছে আধুনিক কবিতা দুর্বোধ্য নয়। একেবারেই বুঝতে পারি না – এমন রচনার সংখ্যা খুবই কম। প্রচলিত আঙ্গিক ও উপমা ইত্যাদি পরিত্যক্ত হলেই এক ধরনের অসহিষ্ণু পাঠক আছেন যারা কবিতা দুর্বোধ্য বলে পরিহাস করতে চান। সুযোগ পেলেই তারা সমকালীন কবিদের বিদ্রƒপ করেন এবং আবেগভরে রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করতে থাকেন। আধুনিক কবি ও দৈনন্দিন শিল্পচেতনা এদের মুখাপেক্ষী নয়। যে জাতি নগর গড়ে তোলে এবং এর গঠনশৈলী সম্বন্ধে সচেতন, যারা চিত্রকলা ও সংগীতের স্বাদ গ্রহণে পরাক্সমুখ নয়, যারা অ্যাবসার্ড নাটকের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কাটে, টেলিভিশনে ‘ডাইনেস্টি’ কিংবা ‘ডালাস’ দেখে উল্লসিত হয়, বর্ণবাদবিরোধী কবি বেঞ্জামিন মলয়েসেকে ফাঁসির দণ্ড দিলে যে জাতি আতঙ্কগ্রস্ত হয়, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে যে জাতি তৃতীয় বিশ্বের জাতিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে সতর্ক তারা কেন আধুনিক কবিতাকে দুর্বোধ্য বলবে তা আমার জানা নেই।’

প্রশ্ন করা হয় ‘ছন্দ’ বিষয়ে। প্রচলিত ‘পয়ার’ বা ‘অক্ষরবৃত্ত’ নয় – আমাদের প্রাণছন্দকে খুঁজতে হবে বাংলাদেশেরই লোকছন্দে – এ-ব্যাপারে তাঁর অভিমত জানতে চাওয়া হলে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমার ধারণা শুধু ছন্দগত আঙ্গিক পরিবর্তনে কবিতাকে প্রচলিত চক্ষুগ্রাহ্য ধরন-ধারণ থেকে অন্যদিকে মোড় ফেরানো যায় না। প্রচলিত পয়ার বা অক্ষরবৃত্ত আমারও আর ভালো লাগে না। এর হাত থেকে মুক্তি দরকার। তবে এই মুক্তি গদ্যছন্দে প্রতিষ্ঠা করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। লোকছন্দও একটু দীর্ঘ লয়যুক্ত। মনে হবে যেন জোর করে প্রান্ত মিলে পৌঁছা গেল। লোকছন্দের বাঁধুনিতে দার্ঢ্য আনা সম্ভব হলে তা অবশ্যই বাংলা কবিতার প্রাণছন্দ হয়ে উঠতে পারে। বিষয়টা ভেবে দেখতে হবে। তবে আমি মনে করি, সমকালীন কবিতার প্রচলিত বাঁধুনি থেকে বেরিয়ে পড়তে চাইলে বিষয় চিন্তার সামগ্রিক ধারণাটিই পাল্টে ফেলতে হবে। মানবজাতির প্রগতিশীলতার প্রচলিত ধ্যান-ধারণা সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলতে হবে। … নারীকে জবরদখলেও যে প্রেমের পরিচয়  – ওইসব রক্তারক্তি ও হিংসাবৃত্তিকেও প্রেমের কবিতা অভিধায় চিহ্নিত করার সাহস কবিকে অর্জন করতে হবে। ত্যাগ, প্রেম, বিরহ ও আত্মদানের মহিমায় সতেজ মহাকাব্য হয়ে উঠতে পারে। হয়ে উঠতে পারে অতীতের মহাকাব্যগুলির সগোত্র। প্রতিহিংসা ও মানবিকতায় অবিনশ্বর।’

কবিতাকর্ম এবং গদ্যকর্মের মধ্য দিয়ে আপনার মূল অনুসন্ধান কী – এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অদৃশ্য ও অব্যক্তকে অনুভব করতে চাই। যেসব মহৎ কবি আমার আগে পৃথিবীতে বাস করে গেছেন তাঁদের সর্বশেষ অনুসন্ধান ছিল তাঁদের আত্মার পরবর্তী বিচরণভূমি। এঁরা সকলেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছেন। আমাকেও করতে হবে। জীবন তখনই অর্থবহ মনে হয় যখন ভাবি আমার প্রিয়জনকে আবার  কোথাও ফিরে পাবো। কোনো মেঘস্তরের আড়ালে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে এমন কোনো আনন্দ যা আমি আমার মানবিক কল্পনার মধ্যে আনতে পারিনি। আমার কবিতা সেই সুন্দরের জন্য অপেক্ষা করছে।’

আধুনিকতা বলতেই সাধারণ্যে বোঝানো হয় নাগরিক শব্দাবলি এবং এর বহিরাঙ্গিক শোভামুগ্ধতা – যা নাকি আদতেই আধুনিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। আধুনিকতা বলতে আপনি কি বোঝাতে চান – এমন প্রশ্নে আল মাহমুদের উত্তর, ‘আমি আধুনিকতা বলতে একটি জাতির বিশ্ববীক্ষা ও মানসিক অবস্থাকে বুঝি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সহবর্তী হয়ে আমাদের বেঁচে থাকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লড়াইটাও আধুনিক মানস গঠনে আমাদের জনগণকে সহায়তা করে। তবে সাহিত্যে আধুনিকতা হলো ব্যক্তির অস্তিত্বের স্বাধীনতাকে উপলব্ধি ও কার্যকর করা। মানসিক সম্বন্ধসূত্রগুলো আবিষ্কার করতে গিয়ে মানুষে মানুষে যে সংঘাতের জন্ম হয় কিংবা মিলনের ক্ষেত্র তৈরি হয় তার ব্যাখ্যা দেওয়াও হলো এক ধরনের আধুনিকতা।’

গদ্যকবিতার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গদ্য কবিতার ভবিষ্যৎ ছন্দের কবিতার ভবিষ্যতের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছন্দের কাছ থেকে ক্ষণমুক্তির জন্যেই আমার প্রবহমান গদ্যের দিকে আসা, যা মিশ্রবৃত্তের আত্মীয়তাকে শোষণ করে নিতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি ছন্দের কবিতারই সমর্থক। তবে ছন্দের বাহুল্যকে অতিক্রম করার মতো বিষয় থাকলে গদ্য কবিতাও দিগি¦জয়ী হতে পারে বলে আমার আস্থা আছে। এটা সর্বতোভাবেই কবির প্রতিভার ওপর নির্ভরশীল।’

অদ্যাবধি বাংলাদেশে কোনো কাব্যান্দোলন সংঘটিত হয়নি। এই আন্দোলনহীনতা কি আমাদের চিন্তা-ভাবনার মৌলিকত্বের অভাবজনিত কারণেই নয় – এমন প্রশ্নে আল মাহমুদ বলেন, ‘একেবারেই কোনো কাব্যান্দোলন দানা বাঁধেনি একথা বোধ হয় সঠিক নয়। পঞ্চাশ দশকে তো কাব্যের একটি আন্দোলন তরঙ্গ সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছিল। বলতে পারেন সেই আন্দোলনকে সমালোচনায় ও সমকালীন সাহিত্যের ইতিহাসে ঠিকমতো উপস্থাপন করার মতো যোগ্য লোক আমাদের একজনও ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গিও এ ব্যাপারে নিস্পৃহ ছিল। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এটা মৌলিকত্বেরই অভাব।’১

শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলমে (নভেম্বর ২০০৫) প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদকে প্রশ্ন করা হয়, কবিতায় যা লেখা যায় না, গদ্যে সেটা বিশদভাবে লেখা সম্ভব। সেই গদ্যে রয়েছে আপনার অসাধারণ দক্ষতা। আপনার গদ্য সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। উত্তরে আল মাহমুদ বলেন, ‘গদ্য লেখা কবিতার মতো কঠিন নয়। বসলেই গদ্য লেখা যায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। তবে এটাও ঠিক, এখানে অভিজ্ঞতা দিয়ে চরিত্র সৃষ্টি, আঙ্গিক নির্মাণ এবং উপস্থাপনার মুনশিয়ানা থাকতে হয়। আমি আমার কবিতাগুলিই আমাদের এখানে বেশি আলোচিত হতে দেখি। কিন্তু আমি আমার গদ্য নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী। সেখানেও আমি যথেষ্ট ভালো কাজ করার চেষ্টা করেছি। আমার কিছু গল্প পরবর্তীকালে বড় গল্পসমগ্র হিসেবে বের হয়েছে। এতে আমার বেশকিছু অন্যরকম কাজ আছে।’

তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, আপনার গদ্য এমন যে, এতে কবিতার কাজ দেখা যায়, এটা কীভাবে হয়? আল মাহমুদের উত্তর : ‘আমার সব লেখায় কবিতার কারুকাজ ঢুকে যায়। আমি প্রথমত একজন কবি। কবিতাই আমার ধ্যান-জ্ঞান, এর প্রভাব তো গদ্যে থাকবে। আমি যখন কোনো কিছুর বর্ণনা দিই, তখন একজন কবির অন্তর্দৃষ্টি কাজ করে।’

প্রশ্ন ছিল, উপন্যাসেও এনেছেন বিষয়বৈচিত্র্য – এ-বিষয়ে কিছু জানতে চাই। আল মাহমুদের উত্তর : ‘‘আগুনের মেয়ে’র গল্পটি জাদুবাস্তবতা নিয়ে। একটি জিন, সে মানুষের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। সে মনে করে আমি বড় সুন্দর, আগুনের মেয়ে আমি অনেক রূপসী। আর নায়ক কেন ওরকম কুৎসিত একটি মেয়ের প্রেমে পড়ছে। এই যে দ্বন্দ্ব, এটা আমি এ গল্পে এনেছি। অ্যারাবিয়ান নাইটস এখনো সারা পৃথিবীকে মাতিয়ে রেখেছে। এরকম জাদুবাস্তবতাকে এখনো কেউ ছাপিয়ে যেতে পারেনি। আবার গ্রিকদের এরকম ‘সোনার গাধা’ গল্পও আছে। এটা আমি আমাদের সাহিত্যে রাখতে চেষ্টা করেছি।

আরেকটি বিষয় আমার ‘মরু-মূষিকের উপত্যকা’ গল্পে আমি একটি ভিন্ন কাজ করেছি। এই যে প্রযুক্তির যুগ, কত কিছু কম্পিউটারে বিস্তারিত করছে, এতে মানুষ মজাও পাচ্ছে। আমি এই অ্যানিমেশনের কাজ সাহিত্যে করেছি। যখন কোনো কথা আমার পাত্রপাত্রী দিয়ে বলাতে পারছি না, তখন আমি সেটা পশুর মুখ দিয়ে বলিয়েছি। দেখা গেল যে, একটি গরু শিং নেড়ে হাম্বা রব তুলে মানুষের ভাষা বলছে। এই স্টাইলটা আমি আমাদের আদি পুঁথি থেকে নিয়েছি। মনসার ভাষা থেকে এর পরিবেশ বর্ণনার কায়দাটা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এখানে আমি এটা আধুনিকভাবে উপস্থাপন করেছি।’২

মাসিক পি ঢাকা ডাইজেস্ট-এর এক সাক্ষাৎকারে (ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬) প্রশ্ন ছিল, আপনার কবিতায় কিংবা গদ্যে আঞ্চলিক শব্দের সুনিপুণ বুনন অনেককে মুগ্ধ করে আবার কেউ কেউ একে ‘ম্যানারিজম’ আখ্যা দেয়। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি বহুবার বহু আলোচনায় এবং প্রবন্ধাদিতে বলেছি যে, আধুনিক বাংলা কবিতার জন্য একটি উপযোগী ভাষার দরকার। রবীন্দ্রনাথ-প্রতিষ্ঠিত আধুনিক বাংলা ভাষা বহু কবির বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গেছে। তিরিশ, চল্লিশ থেকে শুরু করে সত্তর দশক পর্যন্ত কবিরা যে শব্দরাজি তাঁদের কাব্যে ব্যবহার করে এসেছেন তা মূলত রবীন্দ্রনাথেরই। জীবনানন্দ দাশ সমস্যাটা উপলব্ধি করে কিছু আঞ্চলিক শব্দে তাঁর কবিতার শরীর নির্মাণ করলেও এ ব্যাপারে তাঁর খুব বেশি কোনো সচেতন প্রয়াস ছিল না। আমি বাংলা একাডেমি-প্রকাশিত আঞ্চলিক ভাষার বৃহদাকার দু’খানি অভিধান দেখে প্রথমে অভিভূত হয়েছিলাম। কারণ আঞ্চলিক ভাষা মানেই হলো জীবন্ত ভাষা। আমি ভেবেছিলাম, যদি আধুনিক বাংলা ভাষার স্ট্রাকচারের মধ্যে প্রচুর আঞ্চলিক শব্দ উপযুক্ত মর্যাদায় ব্যবহার করা যায় তাতে আমাদের সাহিত্য গতিময় হয়ে উঠবে। আমি ঠকিনি। যারা আমার এ প্রচেষ্টাকে ম্যানারিজম বলছেন তাদের জানা উচিত যে, আধুনিক বাংলা ভাষাও সাধু ভাষার জীর্ণাবস্থায় আঞ্চলিক ভাষারূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এ প্রচেষ্টার জন্য টেকচাঁদ ঠাকুর থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরীকেও বহু গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে।’

প্রশ্ন ছিল, আপনার সাম্প্রতিকতম কিছু কবিতায় অনাড়ম্বর পদ্যভঙ্গির প্রয়াস লক্ষ করা গেছে এবং এতে কবিতার শরীরের দৈর্ঘ্য সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে না কি? কবি উত্তরে বলেন, ‘সমিল, গীতিধর্মী কবিতাই আমার এতদিনের ফসল। পয়ারে, মাত্রাবৃত্তে আমি প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি। অন্যকেও চালাতে উৎসাহ দিয়েছি। সম্প্রতি আমি নিরাভরণ গদ্যে বক্তব্যকে প্রাধান্য দিয়ে কিছু কবিতা লিখতে চাইছি। এতে উপমা প্রায় কাহিনীর চুম্বক নিয়ে উপস্থাপিত হচ্ছে। যুদ্ধোত্তর গদ্য কবিতা আর আমার দীর্ঘ কবিতার মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক আছে। এ ধরনের পরীক্ষা সার্থক হলে ভালো, না হলেও কিছু আসে যায় না। বড়ো কবিতা লেখার আমার বড়ো সাধ ছিল।’৩

কবিতাপত্র কিছুধ্বনি (নভেম্বর ১৯৯৩) এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন রাখে, একটা সময়ে – রবীন্দ্র পরবর্তীকালে – অনুবাদ চর্চার মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের একটি সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সঙ্গে এই যোগাযোগকে অনেকেই আধুনিকতার নির্ণায়ক প্রান্ত বলে চিহ্নিত করে থাকেন। প্রশ্নটা হলো, আজকের এই সময়েও বাংলাদেশের তরুণ-প্রবীণ অনেকেই অনুবাদ করছেন বিদেশি সাহিত্য, কিন্তু তবু আমাদের কবিতা ও সাহিত্যের দীনতা দিন দিন বাড়ছে কেন? অনুবাদ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক শিল্প সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগও ব্যাপক। তবু সাহিত্য আমাদের আধুনিক হচ্ছে না কেন?

আল মাহমুদের উত্তর : ‘রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং বিষ্ণু দের কবি কীর্তির একটা প্রধান দিক হলো বিদেশি কবিদের কবিতার অনুবাদ। শুধু কবিতার অনুবাদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সঙ্গে ব্যাপক যোগ স্থাপিত হয় না। জানি না কারা একথা বলেন। কেবল কবিতার মাধ্যমে কি করে বিশ্বের আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গে যোগ স্থাপন সম্ভব? তবে তিরিশের কবিরা আন্তর্জাতিক কাব্যভাণ্ডার থেকে অনুবাদের মাধ্যমে তাঁদের নিজস্ব রুচি অনুযায়ী কিছু কবিতা অনুবাদ করে বাংলা কবিতার রুচি বদলে খানিকটা সাহায্য করেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে একে ‘আধুনিকতা নির্ণায়ক প্রান্ত’ বলে চিহ্নিত করা যাবে কি না তা সন্দেহ। কই তাঁরা তো সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যের কোনো মহৎ উপন্যাস, নতুন দর্শন ও সৌন্দর্যতত্ত্বের উদ্গাতা কোনো চিন্তানায়কের একটি অখণ্ড গ্রন্থও বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা ভাষার পাঠকের চিন্তার দুয়ার খুলে দিতে এগিয়ে আসেননি! বরং কবিতা অনুবাদ করে তাঁরা আন্তর্জাতিক কাব্যালয়ে তাঁদের কৃতিত্বপূর্ণ বিচরণের স্বাক্ষর রাখতে চেয়েছিলেন। তা তাঁরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই করেছিলেন। এতে আধুনিকতার একটা আভাসমাত্র পাওয়া সম্ভব হয়েছিল বটে। তবে আন্তর্জাতিক মানববুদ্ধির আধুনিকতম বিকাশধারা এখনো আমাদের বাংলা ভাষার জন্য অপেক্ষমাণ। এ কেবল কবিতার অনুবাদ দ্বারা সম্ভবপর বলে আমি ভাবি না। বাংলাদেশে যাঁরা বিদেশি সাহিত্য অনুবাদে নিষ্ঠা নিয়ে হাত দিয়েছেন তাঁদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। অনেকেই অনুবাদ করেছেন কথাটা বোধ হয় সঠিক নয়। আর হয়ে থাকলেও আমার বিদ্যার দৌড় অতিশয় অল্প বলে আমি সেসবের নাগাল পাইনি। সাহিত্যের দীনতা কেবল বিদেশি সাহিত্য পড়ে কিংবা অনুবাদ করে কোনো জাতি দূর করতে পারেনি। এর জন্য দরকার নিজস্ব কল্পনাশক্তি, দেশপ্রেম, পরিচ্ছন্ন ইতিহাস জ্ঞান, ঐতিহ্য চেতনা এবং জাতিগত বীরত্ববোধ। কেবল আন্তর্জাতিক সাহিত্য পড়ে এবং অনুবাদ করে এতগুলো অভাব পূরণ করা যায় না।’

আল মাহমুদের কাছে আরো প্রশ্ন ছিল, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে বোঝা যায় সাম্প্রতিক কাব্যভাষা দূষিত, এর উপমাপরম্পরা পুনরাবৃত্ত ও তাৎপর্য প্রকাশে ব্যর্থ, এবং এখনকার কবিতায়, সরল অর্থে যাকে প্রেরণা বলে, তা নেই। এইরকম পরিস্থিতিতে বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ কি?

আল মাহমুদের উত্তর : ‘এটি একটি অতিশয় অযথার্থ প্রশ্ন। একটু পাণ্ডিত্যপূর্ণ। আপনি যাদের বিশেষজ্ঞ বলছেন তারা যদি কাব্যভাষা দূষিত বলে মন্তব্য করে থাকেন তবে আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিতে হবে সমাজে উচ্চারিত সমগ্র ভাষা ও ইঙ্গিতসমূহই দূষিত। এর একটা অর্থ কিন্তু ভাষায় উচ্চারিত শব্দসমষ্টি প্রকৃতপক্ষে আর কোনো প্রচলিত অর্থই ব্যক্ত করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এটা ভাষা বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ বিরোধী বক্তব্য। একই উপমা পুনরাবৃত্ত হলে ধরে নিতে হবে এই ভাষায় এখন আর নতুন উদ্ভাবনাপ্রবণ প্রতিভাবান কবি নেই। আর প্রেরণা সম্বন্ধে আমার ধারণা, কল্পনাশক্তি ও জ্ঞানের ব্যাপকতার সংমিশ্রণের নামই হলো প্রেরণা। সব মানুষের মধ্যে কল্পনাশক্তির প্রাবল্য থাকে না। তারা বাস্তবের অসহনীয়তাকে স্বপ্নে রূপান্তরিত করতে পারে না। যারা পারেন তারা জন্মগতভাবেই পারেন। তাদেরই আমরা সমাজ সংসারের অন্যান্য বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ থেকে একটু আলাদা করে কবি বলে সম্বোধন করি। বাংলাদেশে এ ধরনের কল্পনাপ্রবণ, স্বপ্নসঞ্চারী মানুষের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম ধরে নিলেও একেবারে আকাল ঘটেনি। কোনো পরিস্থিতির জন্যই ভাষার নির্যাস নিংড়ানোর কাজটা বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে হয় না। বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ আধুনিক আন্তর্জাতিক মানবভাষার উত্থান-পতনের তরঙ্গের সঙ্গেই জড়িত। অতো হতাশা ব্যক্ত করার মতো এখনো কিছু ঘটেনি। আপনার বর্ণিত অনুরূপ পরিস্থিতিতে অন্যান্য ভাষার কবিতার ইতিহাসে যা ঘটেছে আমাদেরও তাই ঘটবে। অর্থাৎ কবিতা বিদ্বানদের যাতনার হাত থেকে নিজেকে বাঁচার জন্য কবিকে বন্য হবার দিকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকবে। ফরাসি কবিতার পুনঃপৌনিকতা যেমন র্যাঁবোকে বিরক্ত ও বন্য হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এমন কি যে স্বেচ্ছাবৃত্তির টানে ভেরলেনের মতো প্রাজ্ঞ এবং হিসেবি মানুষও ভেসে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রবলয়ে ঘুরপাক খাওয়া পুনঃপৌনিকতা ভাঙার জন্য একজন বন্য বিদ্রোহীর আবির্ভাবের কথা আমাদের সকলেরই জানা। নজরুলের আবির্ভাব না ঘটলে তিরিশের আধুনিক কাব্যভাষা কী করে দানা বাঁধতো? নজরুল বাংলা ভাষার বুকে সাহস সঞ্চারে সহায়ক হয়েছিলেন।’

আরো প্রশ্ন : নতুন কবিদের প্রতি গত দু-দশক ধরে একটাই উপদেশ বর্ষিত হচ্ছে। ছন্দে ফেরা দরকার, ছন্দোবদ্ধ কবিতা লেখা দরকার। সেই পরামর্শ মেনে অনেকেই ছন্দে লিখছেন; কিন্তু তবু কোনো স্মরণীয় সৃষ্টি আজ পর্যন্ত ফলেনি, এর কারণ কী?

তাঁর উত্তর : ‘ছন্দবদ্ধ বাক্যই যে কবিতা নয় তা যেমন সত্য, তেমনি গদ্যকে কবিতা করে তোলাও অত্যন্ত দুরূহ কাজ। কারো পরামর্শে কিছু হয় না। তবুও বলবো ছন্দ ও মিল কবির বাক্য ও উপমাকে দীর্ঘস্থায়ী মহিমা দিতে পারে। রিলকে এক তরুণ কবিকে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, আগে ভাবুন আপনি শেষ পর্যন্ত কবিতাই লিখবেন কি-না। যদি আপনার প্রতিজ্ঞা হয় আপনি কবিতাই লিখবেন, তাহলে ওইসব ছন্দ পরিহার করুন যে ছন্দে আপনার পূর্ববর্তী কবিদের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলি লেখা হয়ে গেছে। রিলকে প্রচলিত ছন্দ পরিহারের পরামর্শ দিলেও নিজে সনেট আঙ্গিক পরিহার করেননি। বরং বৈচিত্র্য সৃষ্টির চেষ্টায় সনেট আঙ্গিকের সম্ভাবনাকে বহুদূর বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমি নিজে ছন্দে লিখতে চাই। এখনো মনে করি কবিতার জন্য গদ্যের বিপরীত ভাষা দরকার। তরঙ্গময় শব্দের অনুপ্রাস দরকার। ব্যাকরণের বেড়াজাল সদাসর্বদা যার নাগাল পায় না তেমন ঢেউ গদ্যের বুকে যদি কারো তোলার কবিত্বশক্তি থাকে তবে তিনি গদ্যেই লিখুন। স্মরণীয় সৃষ্টির জন্য এখন দরকার কবিত্বশক্তির। কিছুই হচ্ছে না এমন তো মনে হয় না।’

আরেক প্রশ্ন ছিল, কবিতার ক্ষেত্রে নিরীক্ষা বলতে আপনি কী বোঝেন? কবির উত্তর ছিল : ‘তেমন সাংঘাতিক কিছু তো বুঝি না। কবিতাটি সার্থক হলে বলি কবির রচনাটি চমৎকার; কিভাবে চমৎকারিত্ব সাধিত হলো সে খোঁজ নিয়ে কী হবে। নিরীক্ষার নামে অকবিতাকে কেউ আজ পর্যন্ত গ্রাহ্য করাতে পারেননি।’৪

গল্পপত্রিকা রূপম (মার্চ ১৯৯৩) এক সাক্ষাৎকারে কবিকে প্রশ্ন করে : যাকে আমরা ছোট অর্থে নিরীক্ষা বলি, তা আপনি করেননি কখনো। গল্পেও নয় কবিতায় নয়; তবু আপনার লেখা সজীব, সপ্রাণ, নিজ; গল্পের ক্ষেত্রে আমরা দেখি আপনি ‘পানকৌড়ির রক্ত’ কিংবা ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’ পর্যায়ে ভাষাগত মৌলিক প্রতাপ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তাছাড়া কোথায় যেন আপনি বলেছেন, ‘কবিরা ভাষা শিক্ষক’ – গল্প লিখতে গেলেন কি এই শিক্ষকতার অভিপ্রায়ে – এমনকি দিন দিন আপনার কথাসাহিত্যিক অভিলাষ বেড়েই চলেছে লক্ষ করছি।

কবির উত্তর : ‘এই শব্দটি অর্থাৎ আপনারা যাকে গালভরা নাম দিয়েছেন নিরীক্ষা, আমি এসবে বিশ্বাস করি না। সাহিত্যে অসার্থকতার নামই হলো নিরীক্ষাধর্মী রচনা। সাহিত্যে নিরীক্ষা জিনিসটা কী – তা আজ পর্যন্ত আমাকে স্পষ্টভাবে কেউ বুঝিয়ে দিতে পারেনি। কবিতা বা কথাসাহিত্যে কারো যদি নতুন কোনো উদ্ভাবনা থাকে আর সেটা যদি হয় পাঠকের কাছে চিন্তনীয় বিষয় এবং পাঠকের অন্তরে সায় পাওয়ার মতো রসযুক্ত, তদুপরি লেখকের রচনার মৌলিকতা যদি মুহূর্তের মধ্যেই অন্যের হৃদয়ে সঞ্চারিত হওয়ার মতো উপাদানে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ থাকে, তবে সেই লেখাটিকে আমি সার্থক গল্প-কবিতা বলে চিহ্নিত করি। আমি কবিতা, গল্প উভয় ক্ষেত্রেই চেষ্টা করেছি নিজস্ব উদ্ভাবনাশক্তির পরিচয় দিতে। হ্যাঁ, আমি একবার বলেছিলাম বটে কবিরাই ভাষার শিক্ষক। তবে একথায় এটা বোঝাতে চাইনি যে, কবিরা ভাষাটাকে উত্তমরূপে জানেন বলে কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও পণ্ডিতি ফলাতে গিয়ে  ভাষাটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন। আমি বলতে চেয়েছি, কবিরা ভাষার স্বভাবটা অন্যান্য মানুষের চেয়ে অধিক উপলব্ধি করেন। না, গল্প লিখতে গিয়ে আমি মাস্টারি ফলানোর পক্ষপাতি নই। আমার কথাসাহিত্যিক হওয়ার অভিলাষ বাড়ছে কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। বরং বলুন আমি গল্প-উপন্যাসও লিখতে চাইছি। আমি তো আগেই বলেছি, এটা কবিদেরই গদ্য লেখার যুগ।’

প্রশ্ন করা হয়, আপনি বলেছিলেন গদ্যভাষার সহজতা সৃষ্টি হলেও তাতে জীবনবোধ সঞ্চারিত হয়নি। কারণ এর নানা গল্প ও উপন্যাস রচয়িতাদের জীবনের বহু তরঙ্গভঙ্গে আছাড়িপিছাড়ি খেতে হয়। এসব কথার পর প্রায় একযুগ কেটে গেছে। আমাদের কথাশিল্পীরা জীবনশিল্পী হয়ে উঠেছেন তো?

আল মাহমুদের উত্তর ছিল, ‘আমি সহজতার কথা বলেছিলাম এই ভেবে যে আগে আমাদের লেখকগণ কলকাত্তাইয়া গদ্য ঢংটাকেই বাংলা গদ্যের পরাকাষ্ঠা ধরে নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখতেন। এ ঢং বা স্টাইলে যে ভালো লেখা হয়নি এমনও নয়। কিন্তু কবিতা ও নাটকে যখন বাংলাদেশের কথ্য স্টাইলটা নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়তে লাগলো তখন এর সংক্রাম স্বাভাবিকভাবেই গল্প-উপন্যাস লেখকদের মধ্যেও সহজেই সঞ্চারিত হলো। যেমন ধরুন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘দোজখের ওম’ গল্পটি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, সেলিনা হোসেনের সৃজনশীল রচনার গদ্যভাষার সঙ্গে শওকত ওসমানের গদ্যভাষায় যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে সেটাই আমি আপনাকে ধরিয়ে দিতে চাইছি। ধরিয়ে দিতে চাইছি শাহেদ আলীর ‘জিবরাইলের ডানা’র সঙ্গে শওকত ওসমানের ‘পিঁজরাপোলে’র গল্পগুলোর উপস্থাপন কৌশলের পার্থক্য। মনে রাখতে হবে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ইউরোপীয় সাজসজ্জার নিচে পূর্ববঙ্গীয় কিষান আত্মাটি বেশ সতেজভাবেই ধুকপুক করতো। আর অভিজ্ঞতার ইঙ্গিতটা দিয়েছিলাম আমাদের লেখকদের জীবনযাপন, ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের উত্থানপতনে তাদের নিরাপত্তাহীনতা ও জীবিকার অনিশ্চয়তার কথা ভেবে। আমি মনে করি আঙ্গিকগত দুর্বলতার দিকটা অতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার না করলে আমাদের কথাশিল্পীরা নিঃসন্দেহে জীবন শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি আয়ত্ত করেছেন। এদের সকলেরই রাজনৈতিক আদর্শ আছে। আছে সামাজিক কমিটমেন্ট। যে কমিটমেন্ট বা আদর্শের সাথে আমার গুরুতর মতপার্থক্যের কথা আজকাল সকলেরই প্রায় জানা হয়ে গেছে। তবুও রচনারীতি ও সাহিত্যিক আন্তরিকতায় যে রচনা উত্তীর্ণ হয় সেটা স্বীকার করে নিতে আমার বাধে না।’৫

সাপ্তাহিক বিচিত্রা কবি আল মাহমুদের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে (৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫)। এতে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, এতোকাল আমরা দেখেছি, লোকজ বাংলার লোকভাষা অবলীলায় ব্যবহার করে আধুনিক বাংলা কবিতায় যে গণধারা নির্মাণ করেছিলেন, এ পর্যায়ে এসে তা ধর্মাধর্মবোধ, ঐতিহ্যানুসরণ, পৌরাণিকীর ব্যবহারে প্রাণ পাচ্ছে। লোক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে পৌরাণিক জীবনাচরণের দৃষ্টিস্নাত ধারা কেমন করে মিথস্ক্রিয়া করছে?

উত্তরে আল মাহমুদ বলেন, ‘আমার কাব্যে ব্যাপক লোক-অভ্যেস, পরিশীলিত ভাষার দ্বারা অননুমোদিত লোকজ শব্দ, গ্রাম্য বাকভঙ্গির চারণসুলভ গোয়ার্তুমি আছে বলে আমার সমসাময়িক আধুনিক কবিরা বলতেন। এখন এই সব বদ-অভ্যেসগুলোকে আমি কিভাবে আমার এখনকার কবিতায় মিলিয়ে দিতে পারছি কিংবা আদৌ পারছি কিনা! এখানে একটা কথা জানিয়ে দেয়া ভালো যে আমার সমসাময়িক যে সব কবিবন্ধু ঢাকায় বসে ‘আরবান’ কবিতা লিখতেন কিংবা নিজেদের আধুনিক কবি বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন, এদের কেউ কেউ ছিলেন বাংলাদেশের গ্রাম না-দেখা গ্রাম্যলোক। এদের এক আধজন এদেশের শহরেই জন্মেছিলেন, কিন্তু ধার করা আধুনিকতা তাদের রচনাকে আধুনিক করেনি। আমি এ-ব্যাপারে বেশি বলতে চাই না। অন্যের কবিতার দ্বারা প্রাণিত হয়ে কবিতা লেখাটা এ যুগের প্রেরণার একটি উৎস। এই উৎসের সার্থক ব্যবহার তারাই করতে পারেন যারা প্রকৃত কবি। কিন্তু যারা অন্যের কবিতার নিছক অনুবাদকে নিজের কবিতা বলে চালিয়ে দেন, কেবল দরিদ্র জাতির সাহিত্যই এদের কবি বলে স্বীকার করে নেয়। আধুনিক বাংলা কবিতার তিরিশ দশকও এই ভিক্ষা গৌরব থেকে মুক্ত নয়। যাহোক, এবার আমার রচনার মাত্রাজ্ঞান সম্বন্ধে কিছু বলি। আমার ধারার মাত্রাটি বিচার করতে হবে টেক্সট বা আধেয় দিয়ে। আমার কবিতার আধেয় বা বিষয় হলো রহস্য সৃষ্টি। শেষ পর্যন্ত সুন্দর শব্দের নিগূঢ় রহস্য নির্মাণই আমার কবিতা। এ স্বভাব বলা বাহুল্য লোককবি গাঁথা রচয়িতাদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি এবং আয়ত্ত করেছি। আমি লোকভাষা উত্তমরূপে না জানলেও এর ইঙ্গিতময় ভঙ্গি ও রহস্যময় শব্দরাজি আধুনিক বাংলা ভাষার তৈরি করা জমিতে অবলীলায় বুনে দিয়ে মজা দেখতে চেয়েছিলাম। ফল মন্দ হয়নি। তবে চাষাগিরি এখন আর ভালো লাগছে না। এখন আমার হাতে শব্দের যে শংকর বীজ জমা হয়েছে তা অন্য উদ্দেশ্যে বুনতে চাই। সে ফসলের নাম হোক রহস্যময় বিশ্বাসের শস্য। এই বীজ বুনতে কোনো তৈরি জমি লাগে না। আকাশে, বাতাসে, নদীতে, সমুদ্রে যেখানে খুশি এই রহস্যের বীজ উপ্ত হতে পারে। সোজা কথায় লৌকিক রহস্যকে অলৌকিকতায় মিশিয়ে দিতে চাই।’৬

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা পরিলেখ (১৯৯৭) প্রশ্ন করে, কমার্শিয়াল লিটারেচারের যে-ধারা – এটাকে বাংলাদেশে দুইভাবে দেখা হচ্ছে। এক, যারা সৃজনশীল সাহিত্যে বিশ^াসী, তারা এটাকে পাত্তা দিতে চাচ্ছে না। আরেকদল আছে যারা এটাকে মনে করেছে, তারা অন্তত একট কাজ করছে, বাংলাদেশে বই ব্যবসায়ে যে সাম্রাজ্যবাদ – এটাকে ঠেকানোর একটা কাজ তারা করছে। আপনার বক্তব্য কী?

আল মাহমুদ উত্তর দেন, ‘আমি ওটাকে বড় করে দেখছি না। আমি দেখছি যে আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ এসেছে যে সব পটভূমিকায়, প্রেম এসেছে, ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা প্রেম করছে। এই প্রেম, আবেগ, স্বপ্ন – এটাকে সে কাজে লাগিয়েছে। এটা একটা বড় কাজ বলে আমি মনে করি সাহিত্যে। এখন শরৎচন্দ্র কিন্তু কেউ পড়ে না। শরৎ তাঁর সময়ের বড় একটা দাবি পূরণ করেছেন। হুমায়ুন একটা কাজ করেছেন, যাতে আমাদের পাঠকরা পড়তে শিখেছে। এই বইগুলো পড়ে হঠাৎ যখন কাবিলের বোন, খোঁয়ারী বা এসব উপন্যাসে আসবে তখন একটা ধাক্কা খাবে। কিন্তু পাঠের অভ্যাস যদি আমি না গড়ে তুলি, তাহলে তারা পড়বে কিভাবে? ইন্টেলেকচুয়ালি তারা তৈরি হয়ে গেছে। তারা এখন হজম করতে শিখছে। এটা একটা বড় কাজ হয়েছে। আমি হুমায়ুনকে নিন্দা করি না। আমি এটা বলি না যে এটা কিছুই না। গদ্য লেখকদের অবশ্যই পপুলার লেখক হতে হবে। এটা কি কম কথা নাকি যে আমাদের দেশে একজন লেখককে এক লাখ টাকা অ্যাডভান্স করে দেয়? এটা কি কম? এটা কল্পনাতীত ব্যাপার। এটা হুমায়ুন করেছে। এটা নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। মুসলমান মধ্যবিত্তের মধ্যে একটা নতুন ব্যাপার।’

প্রশ্ন ছিল, গ্রামে পরিবর্তন আসছে। খুব ব্যাপক পরিবর্তন না হলেও, অনেকখানি পরিবর্তন হয়ে গেছে। নতুন এই যে পরিবর্তন, যারা গ্রাম নিয়ে গল্প লিখেছেন, তাতে কিছু নাই, সেই ৪০-৫০ বছর আগের প্রেক্ষাপট। এ-বিষয়ে কিছু বলুন।

আল মাহমুদ বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি এর ঘোর বিরোধী। আমি কবি জসীম উদ্দীনের কবিতা পরীক্ষা করে দেখেছি। জসীম উদ্্দীন যেসব কবিতা, যেমন নকসীকাঁথার মাঠ লিখেছেন, রাধিকা, রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-এর আদলে। কিন্তু যেহেতু তিনি চরের মানুষ এবং মুসলমান, চাষী পরিবার থেকে এসেছেন, হঠাৎ উনি কবিতা লিখলেন, গল্পের মতো – ‘রাত থমথম, স্তব্ধ নিঃঝুম, ঘন ঘোর আঁধিয়ার, নিঃশ^াস ফেলি তাও শোনা যায়, নাই কেউ সাড়া দেবার।’ এই যে মুসলিম চাষী পরিবারের পরিবেশ কিংবা … ‘ওরে মুখ পোড়া কোথায় গিয়েছিলি তুই এমনি একাই …।’ এটা কিন্তু বাঙালি মুসলমানের অবস্থার বর্ণনা। ‘ভাল করে দাও আল্লা রাসুল, ভাল করে দাও পীর’ – এই চিত্র প্রথম জসীম উদ্্দীনই নিয়ে এসেছেন এর আগে অন্য কোথাও এটা পাওয়া যাবে না।’৭

কালের কণ্ঠে (২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে জানতে চাওয়া হয়, এখন পর্যন্ত আপনার সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ বলে ধরা হয় সোনালী কাবিনকে। এটি স্নাতক পর্যায়েও পঠিত হচ্ছে। আপনি পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। তা হলো লিরিকধর্মিতা। যা আপনার কবিতাকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছে। এ বিষয়ে মন্তব্য কী? উত্তরে আল মাহমুদ বলেন, ‘আমি মনে করি যে মানুষের জীবন তো লিরিক্যাল, মানে গীতিময়তায় আচ্ছাদিত। সেখানে গীতিময়তার যে অভ্যাস বাংলা কবিতার ভেতরে রয়েছে, সেটা অব্যাহত থাকবে। কবিতার মধ্যে গীতপ্রবণতা, মিল, অন্ত্যমিল, অনুপ্রাস – এগুলো মানুষ পছন্দ করে। এটা হলো বাংলা কবিতার আধুনিক অবস্থান। এটাকে আরো পরিশ্রুত করে বইতে দেয়া উচিত। এতে বাংলা কবিতার উন্নতি হবে।’৮

বাংলা ট্রিবিউনের (১১ জুলাই ২০১৬) প্রশ্ন ছিল, উপন্যাসে আঙ্গিক ও ভাষার সঙ্গে এটাও জানতে চাই যে, বর্ণনা এবং বক্তব্যের যে সম্মিলন করা হয় এটা কতটা জরুরি বলে আপনি মনে করেন? এ বিষয়ে আল মাহমুদ বলেন, ‘উপন্যাস সৃষ্টি করতে হলে – আমি যেটা বলতে চাই – সেটা হয়তো অনেকেই মানবেন না। আমি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি লেখায় মানুষের সৃজন ক্ষমতাকে। এই জন্য একটা আঙ্গিক দরকার হয়। আমার উপন্যাসে আমি যে-আঙ্গিক ব্যবহার করেছি সেটা আধুনিকতম আঙ্গিক বলে আমি মনে করি। যেই আধুনিক কৌশল আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল সেই সময়ে আমি তাই ব্যবহার করেছি।’

প্রশ্ন ছিল :  আপনি একবার বলেছিলেন – ‘কবি হতে গেলে সারা জীবন উৎসর্গ করতে হয়’। এ-বিষয়ে আল মাহমুদ বলেন, ‘হ্যাঁ, একটা জীবন দিতে হয়। এটা কোনো পার্ট-টাইম জব নয়। একটা পুরো জীবন দিয়ে দিতে হয়। ফিরতে পারে না সে।’

প্রশ্ন ছিল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটা কথা বলেছিলেন, ওই যে প্রথম একটা লেখা মাথার ভিতর ঢুকে গেছে, এখন যতই চেষ্টা করি ওই পথ থেকে বের হয়ে আসবো তা আর হয়ে ওঠে না। এ-বিষয়ে আল মাহমুদ জানালেন, ‘হ্যাঁ, সে তো আমার বন্ধু। আমার ধারণা, যদি মাথার ভিতর একটা উদ্দীপনা বা প্রেরণা উত্থাপিত হয়ে যায় – যতক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে তা মাথা থেকে না নামানো যায় ততক্ষণ পর্যন্ত মুক্তি নাই। ওঃ রিষষ নঁৎহ ুড়ঁ. এটা তোমাকে পোড়াবে; তোমাকে জ্বালাবে, তোমাকে ক্ষতবিক্ষত করবে। যখন তুমি কলম নিয়ে বসবে সেটা গল্প হোক, কবিতা হোক কিংবা উপন্যাস হোক যখন তুমি লিখে ফেলবে তখন তুমি একটি সিগারেট জ্বালিয়ে নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে।’৯

কলকাতার কবিতা প্রতিমাসে (জুলাই ২০০৫) প্রশ্ন করেছিল, লেখককে পুরস্কার দেওয়ার ব্যাপারটি আপনি সমর্থন করেন? উত্তর ছিল : ‘অবশ্যই করি। তরুণ কবি তরুণ লেখকদের উৎসাহ দেবার জন্য পুরস্কারের অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। খুব কম বয়সে, যখন আমার মাত্র দুটি বই প্রকাশ হয়েছে, তখন আমাকে পুরস্কৃত করা হয়। যারা আমাকে পুরস্কারের জন্য বেছে নিয়েছিলেন তাঁদের কেউই ব্যক্তিগতভাবে আমাকে চিনতেন না। এই পুরস্কার অবশ্যই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।’

জানতে চাওয়া হয়, রবীন্দ্রনাথের পরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাননি কোনো বাঙালি লেখক। এই মুহূর্তে এমন কোনো বাঙালি লেখকের কথা আপনার মনে পড়ছে – যিনি এই পুরস্কার পাবার যোগ্য? আল মাহমুদের উত্তর : ‘বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পরে কেউ নোবেল পুরস্কার পাননি ঠিকই, তবে এই পুরস্কার পাবার যোগ্যতা ছিল অনেকেরই। কবিতার ক্ষেত্রে এই পুরস্কার পেতে পারতেন বিষ্ণু দে। অবশ্যই পেতে পারতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। পাঁচের দশকের কেউ কেউ পেতে পারতেন এই পুরস্কার। কিন্তু পাননি। এখনো বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টিশীল কাজে নিমগ্ন রয়েছেন এখন অনেকেই এই পুরস্কার পাবার যোগ্য। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে কোনো নাম উল্লেখ করতে চাইছি না আমি, হয়তো সমীচীনও হবে না।’১০

তথ্যসূত্র

১. আবিদ আজাদ, কবি (সাহিত্য পত্রিকা), মে ১৯৮৬, শিল্পতরু, ঢাকা।

২, শানু মোস্তাফিজ, কালি ও কলম, সম্পাদক আবুল হাসনাত, দ্বিতীয় বর্ষ, দশম সংখ্যা, নভেম্বর ২০০৫, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, ঢাকা।

৩. ঢাকা ডাইজেস্ট (মাসিক ম্যাগাজিন), সম্পাদক ওবায়দুর রহমান, তৃতীয় বর্ষ, ১১শ সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬, তোপখানা রোড, ঢাকা।

৪. কিছুধ্বনি (কবিতাপত্র), সম্পাদক আন্ওয়ার আহমদ, ২৯ বছর, ২য় সংখ্যা, নভেম্বর ১৯৯৩, অগ্রহায়ণ ১৪০০, রূপম প্রকাশনী, নিউ ইস্কাটন রোড, ঢাকা।

৫. সালাহউদ্দীন আইয়ুব, রূপম (গল্পপত্রিকা), সম্পাদক আন্ওয়ার আহমদ, ২৯ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, মার্চ ১৯৯৩।

৬. মাহবুব হাসান, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, ২৪ বর্ষ, ১৭ সংখ্যা, ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫, দৈনিক বাংলা ভবন, ঢাকা।

৭. সরদার আবদুর রহমান, নাজিব ওয়াদুদ ও আশরাফ উদ্দীন আহমদ, ৭ এপ্রিল ১৯৯৭। পরিলেখ (সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা), তৃতীয় সংখ্যা, মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্র, ১৪০৭।

৮. শ্যামল চন্দ্র নাথ, ৭ জুলাই ২০১৪, ‘শিলালিপি’, কালের কণ্ঠ, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।

৯. শ্যামল চন্দ্র নাথ, বাংলা ট্রিবিউন, ১১ জুলাই ২০১৬।

১০. মউলি মিশ্র, কবিতা প্রতিমাসে, সম্পাদক বীজেস সাহা (আল মাহমুদ সংখ্যা), প্রথম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, জুলাই ২০০৫, কলকাতা।