গল্পের রূপ-বৈচিত্র্য

আমরা এতো বেশি গল্পের ভেতর নিত্যদিন বসবাস করি যে গল্পের অভাব নেই আমাদের জীবনে।

আমাদের ডানে গল্প, বাঁয়ে গল্প, মাথার ওপর দিয়ে অ্যারোপ্লেনের মতো উড়ে-চলা গল্প, পায়ের নিচে পিষ্ট হওয়া শুকনো কিংবা ভেজা ঘাসের মতো শত-সহস্র গল্পের উপাদান।

তবু আমাদের জীবনে আজকাল খুব যেন একটা জমছে না। বিজ্ঞান আর বিশ^াসের ভেতর গড়াগড়ি খেতে-খেতে কেবল খেই হারিয়ে ফেলছে সবকিছু।

কথকের কলম কিংবা মুখে বলা গল্প শুরু হলেই টিভি-মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকা পাঠকের সারি থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, ‘গল্প ছাড়েন ভাই। জীবনে নেমে আসেন। গল্প বলে-লিখে কিছু হবে না। হয়নি কোনোদিন।’ জীবনে পাঁচটি বই না পড়েও উত্তর দেন পত্রিকাসেবী বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাজ্ঞ পাঠক!

বেচারা গল্পকার! শুরুতেই মাস্তানের মতো পাঠক তাঁকে থামিয়ে দিতে চাইছে, মিথ্যেবাদী বানিয়ে দিচ্ছে যখন-তখন।

কিন্তু গল্পকার দমবার পাত্র নন মোটে। তাঁর ভেতর গল্পগুলি হাঁড়িতে ভাতের বলক তুলছে নিরন্তর। তিনি গল্প বলে ছাড়বেনই। পাঠক শুনতে চাইছেন না, তবু।

তবে গল্পকার এ-ও জানেন, পাঠক তৈরি করতে হয় লেখককেই। গল্প-স্বভাব অনুসারে এক-একজন লেখক এক-এক ধারার পাঠক তৈরি করেন নিজের জন্য। যে-পাঠক শহীদুল জহির পড়ে মুগ্ধতা বোধ করেন তিনি কেন হুমায়ূন আহমেদ কিংবা ইমদাদুল হক মিলনে কুপোকাৎ হবেন? যাঁর-যাঁর পাঠক তাঁর-তাঁর। তবে এ-ও সত্য যে, গল্পকারকে তৃতীয় শ্রেণির অধৈর্য, অহংকারী, ভেকসম্পন্ন উড়ুক্কু মেজাজের পাঠকের বেড়াজাল ছিন্ন করেই প্রকৃত ও মননশীল পাঠকের দিকে এগোতে হয়। এজন্য তাঁকে হতে হয় পরিশ্রমী ও ধৈর্যশীল। সাহিত্য-রচনা তো বাজারের ফল নয় যে, পকেটে টাকা থাকলে কিনে নিয়ে আসা যাবে। একজন গল্পলেখককে বহুবিধ প্রস্তুতি নিয়ে কলম চালাতে হয়, এখানে কোনোরূপ লেনদেন চলে না। আর চললেও সময় ঠিকই তা নির্মমভাবে আটকে দেবে।

হবু গল্পকার কদিন ও’হেনরি পড়লেন। মোপাসাঁও বাদ যাননি। রবীন্দ্রনাথ তো সারাক্ষণ সঙ্গেই রয়েছেন। গল্পের শুরু ও সমাপ্তির ভেতর যে চমক তা তাঁকে এতোটাই আকৃষ্ট করে যে তিনি দেরি না করে লিখতে বসে গেলেন। কিন্তু লিখতে গিয়ে বুঝলেন যে সবকিছু কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রথম বাক্যটি খুব ঢং করে লিখলেন, ‘সুস্মিতা আজ চলে গেল।’

নিজেই নিজের পিঠে চাপড় দিয়ে বলে উঠলেন, ‘বহুত আচ্ছা।’ কিন্তু দ্বিতীয় বাক্যটি লিখতে গিয়ে হবু গল্পকার পড়ে গেলেন সংকটে। একবার মনে হলো লিখবেন, ‘কারণ, ওর বিয়ে হয়ে গেছে।’ কিন্তু দুটো বাক্য পাশাপাশি রাখার পর মনে হতে থাকে, প্রথম বাক্যটি রহস্যাবৃত লাগছে, দ্বিতীয় বাক্যটি একেবারেই সাদামাটা ও পানসে এবং দুটো বাক্য পাশাপাশি রাখার পর মনে হলো, গল্পটির সমাপ্তি বুঝি এখানেই।

কিন্তু সুস্মিতাকে নিয়ে গল্পকারের তো অনেক কিছু বলার বাকি। ওর সম্পর্কে জানানোর মতো অনেক কথা মাথায় ঘুরছে। কিন্তু সেরকম জুতসই হয়ে ধরা দিচ্ছে না কলমে। যেরকম মুন্সিয়ানার সঙ্গে শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, হাসান আজিজুল হক, রাহাত খান, মাহমুদুল হক, হুমায়ূন আহমেদ বা ইমদাদুল হক মিলনের কলম এগিয়ে যায়, তা ওঁর বেলায় ঘটছে না। কলমের পায়ে যেন বেড়ি পরানো, হাঁটতে পারছে না, হোঁচট খাচ্ছে বারবার। আবেগগুলি কেবলি জট পাকাচ্ছে, কিছুতেই মাধুুর্যময় কথা হয়ে বের হতে চাইছে না কলম থেকে কাগজে!

এজন্যে নানা জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করেছেন তিনি। প্রচুর বইপত্র পড়েছেন। কারো কারো সঙ্গে কথাও হয়েছে ঢের। নোট নিয়ে ডায়েরির পাতা ভরিয়ে ফেলেছেন। প্রখ্যাত এক

কথাসাহিত্যিককে কোনো এক আড্ডায় পেয়ে দুম করে জিজ্ঞাসাও করে বসলেন, ‘গল্প লিখতে চাই, কীভাবে লিখবো?’

‘যেভাবে বন্ধুকে গল্প বলেন। যেভাবে গার্লফ্রেন্ডের কাছে মিথ্যা কথার ফুলঝুরি সাজিয়ে নিজেকে জাহির করেন, যেভাবে অফিসের বসকে মুগ্ধ করার চেষ্টা চালান। অবিকল সেভাবে গল্পটাও বলার চেষ্টা করেন। মোদ্দা কথা, সরস করে কথা বলে বলে গল্পবাজ হতে হয়। হাহাহা।’ হাসিটা বেঢপ মনে হলো হবু গল্পকারের কাছে। এরকম একটা জটিল বিষয় এমন হালকা করে বলতে হয়?

‘আর কিছু কি বলবেন?’ মনে-মনে বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করেন গল্পকার।

‘শব্দ আর বাক্য ব্যবহারে খুব মনোযোগী হতে হবে। যেমন মুন্সিয়ানার স্পর্শ থাকবে প্রতিটি বাক্য গঠনে, তেমনি প্রতিটি বাক্যকে হতে হবে সরস। পুরনো বাক্য-নমুনা ছেড়ে শব্দের নতুন প্রয়োগ ও ভাবার্থের তারতম্য ঘটিয়ে চমক তৈরির অভ্যাস করতে হবে নিয়মিত। পাঠক খানিকক্ষণ পড়েই যেন আপনমনে বলে ওঠেন, বাঃ, বেশ তো। মনে রাখবেন আপনি কিন্তু মনোরঞ্জনকারী, ব্যাকরণের রসকষহীন অধ্যাপক নন।’

‘বাঃ, আর কিছু?’ একটুখানি ভালো লাগছে তাঁর। তাই প্রশ্নটা না করে পারলেন না।

‘তীক্ষè পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা থাকতে হবে। যা দেখলাম তা কেবল উগড়ে দিলেই হবে না। চারপাশের সবকিছু আত্মস্থ করার মতো হজমশক্তি লাগবে। কোনটা রাখবেন আর কোনটা ছাড়বেন তা জানা ও বোঝার মতো পরিপাকতন্ত্রের ক্ষমতাটুকু অর্জন করতে হয় আগেভাগে। পরিমিতিবোধ না থাকলে কোনো রান্নাই ভালো লাগে না। আবার গলা কাঁপালেই রাগাশ্রয়ী গান মার্গীয় রূপ পায় না। আরেকটা কথা। কড়াইয়ে মাছভাজার মতো আপনার চরিত্রগুলিও উল্টেপাল্টে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। মনে রাখবেন, একজন সফল লেখক আকছার মিথ্যে বলে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কাজটি তিনি এতোই বিশ^স্ততা নিয়ে সম্পন্ন করেন যে, উৎকৃষ্ট জাদুশিল্পীর মতো মনেই হবে না তিনি মিথ্যে কিছু বলছেন। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি চরিত্র ও তার মানসিক অবস্থা এবং পরিপাশের্^র বর্ণনার ভেতর তিনি নিজেকে মেলে ধরেন। নিত্যনতুন কথা দিয়ে, যা কি না শব্দ আর বাক্যের ধারালো রূপ ছাড়া অন্য কিছু নয়, গল্পের জগৎটি তিনি তৈরি করেন, যা একান্তই তাঁর নিজস্ব।’

হবু গল্পকার চুপ করে শুনলেন মুরুব্বি লেখকের কথা। কথা প্রসঙ্গে তিনি বাংলা সাহিত্যের অনেক সফল গল্পকারের নাম করলেন। মানিক বেেন্দ্যাপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল কর, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মতি নন্দী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, আলাউদ্দীন আল আজাদ, রাহাত খান প্রমুখ।

যাঁদের নাম করলেন তাঁদের সবার গল্পই কমবেশ পাঠ-তালিকায় রয়েছে গল্পকারের। সুবোধ ঘোষের ‘ফসিল’, ‘পরশুরামের কুঠার’, ‘জতুগৃহ’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অতসী মামী’, ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘সমুদ্রের স্বাদ’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আখরাইর দিঘি’, ‘জলসাঘর’, ‘নারী ও নাগিনী’, বিমল করের ‘ইঁদুরকল’, ‘আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘খরা’, ‘গরম ভাত ও নিছক ভূতের গল্প’, হাসান আজিজুল হকের ‘শকুন’, ‘রেপ’, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, রাহাত খানের ‘আমাদের বিষবৃক্ষ’, ‘চুড়ি’, ‘রক্তপাত’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘জলেশ্বরীর গল্প’ – এরকম হাজারটা গল্প পাঠ করেছেন তিনি। কটা আর মনে থাকে আর কটাই বা বলা যায়?

প্রতিটি গল্পই পড়তে ভালো লাগে এবং সমালোচনাও করা যায় যেমন খুশি তেমনি। কিন্তু নিজে লিখতে গেলেই সবকিছু ঢাকার যানজটের ভেতর আটকে যায় কেন, তা তিনি বুঝতে পারেন না।

সুস্মিতা নামের এক নারীকে আঁকবেন বলে তিনি কতই না কষ্ট আর শ্রম দিয়েছেন। মেয়েটি অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার। গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিল প্রেমিকের হাত ধরে, কিন্তু বিয়ে হলো অন্য এক পুরুষের সঙ্গে। প্রেমিক রেগেমেগে অ্যাসিড ছুড়ে দিয়ে প্রতিশোধ নিল ব্যর্থ প্রেমের। পত্রিকায় এই খবরটি জেনে তিনি মেয়েটির বাসায় গেলেন। স্বামীর সঙ্গে কথা বললেন। জেল-কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি নিয়ে প্রেমিকপ্রবরের সাক্ষাৎকার ধারণ করলেন টেপ-রেকর্ডারে। প্রত্যক্ষভাবে শোনা ও দেখা কাহিনিকে কিভাবে গল্প বানাবেন, তা নিয়ে চলল তোড়জোড়। মাথার ভেতর ঘুণপোকা, সারাক্ষণ উপন্যাসতুল্য এই জীবনালেখ্যকে কীভাবে গল্পের ছাঁদে ফেলা যায়, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা।

শেষে মনে হলো, প্রেমিকের বয়ানের ভেতর দিয়েই গল্পটি সাকার করে তুলবেন তিনি। এর ভেতর চমকে দেওয়ার মতো করে ইশারা, প্রতীক, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প দিয়ে এক-একটি চরিত্র ও মানসিক টানাপড়েনকে মূর্ত করে তুলবেন। পাঠক যতো এগোবে চরিত্রগুলি ততো কথা বলবে। ঘটনা ও চরিত্র এমনভাবে মিলেমিশে একটি আবহ তৈরি করবে যে, গল্পটি শেষ হওয়ার পর বলতেই হবে, শেষ হয়ে হইল না শেষ! কিন্তু গল্প-ভাবনা আর গল্প-বাস্তবতা যে মোটেই একাট্টা হয়ে কাজ করতে চায় না, তা আর কেউ না বুঝুক, গল্পকার নিজে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন খুব। এ যেন সাধ আর সাধ্যের ভেতর দুস্তর তফাতের দিকে তর্জনী দেখাচ্ছে – অল্প-বিস্তর সক্ষমতা নিয়ে এই এক সমস্যা!

এসময় তাঁর ‘ম্যাজিক্যাল রিয়েলিজমে’র কথা মনে পড়ল। বাংলায় আদর করে এর নাম রাখা হয়েছে জাদুবাস্তবতা। সালমান রুশদীর হারন অ্যান্ড দি সি অফ স্টোরিস গ্রন্থটি তিনি পাঠ করেছেন। এরকম অদ্ভুত অথচ বাস্তবানুগ গল্পের ফর্ম বেছে নেবেন এই বইটির জন্যে?

এরকম গল্পে নায়ক চাইলে ভূগোলকে অস্বীকার করে আকাশের আড়ালে আরেক ভূগোলে চলে যেতে পারেন, কোনো অসুবিধা নেই। যখন চাঁদ পৃথিবীর খুব কাছে ছিল তখন সুস্মিতা দেখতে পায় রতনকে – এরকম শুরু দিয়ে জাদুবাস্তব গল্প তৈরি হতে পারে। এর সঙ্গে জলপাইয়ের আচারের মতো খানিকটা ইতিহাস বা রাজনীতি মিশিয়ে নিলে মন্দ হয় না। পাঠক একবার ইতিহাস-রাজনীতি, অন্যবার অবাস্তব ঘোড়ায় চড়ে গল্পপাঠের মজা নেবেন। মন্দ কি?

 ঠাট্টা-বিদ্রƒপ আর খণ্ড খণ্ড অস্পষ্ট-অর্ধস্পষ্ট কল্পকাহিনির ভেতর দিয়ে উত্তর আধুনিক লেখকবৃন্দ যেভাবে বারবার করে যে-কথা বলতে চান সেভাবেই কি তিনি তাঁর সুস্মিতার গল্পটি এগিয়ে নিয়ে যাবেন? তাঁরা যা বলতে চান সেগুলি ভালোই বোঝেন গল্পকার মহোদয়। তাঁরা বিশ^াস করেন, ভাগ্যকে মেনে চলার দিন শেষ, এখনকার পৃথিবীতে পরম সত্য বলে কিছু নেই, কালকের মূল্যবোধ আর বিশ^াস আজ অচল; তাই যতো পারো উল্টেপাল্টে দেখো জীবনকে, প্রথাগত চাকচিক্য মুছে দাও, ভাষা বলো, আখ্যান বলো সব নিয়ে নিরন্তর নিরীক্ষা চালাও, যতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ততো আধুনিক। ঠিক সেভাবেই কি গল্পকার তাঁর গল্পটি সাজাবেন?

এখানে ও’হেনরির ‘কেরানী’, ‘পাদ্রি’ কিংবা সাধারণ মানুষগুলির স্বাভাবিক উচ্ছল ও স্বতঃস্ফূর্ত চলাফেরা-কথাবার্তার মানে নেই, শুধু শুধু এসবের ছক আঁকতে হবে না গল্পে। রূপকথা, ইতিহাস, রাজনীতি, যৌনতা সব মিলিয়ে এমন এক মণ্ড তৈরি হোক, যেখানে একটিমাত্র বিশ^াস বা সত্য শুধু নয়, তোমার-আমার সবকিছুই দেখাবে তমসাচ্ছন্ন, রহস্যাবৃত। একটিমাত্র সত্য নয়, হরেকরকম সত্যের ভেতর যে সংঘর্ষ তাকেই চূড়ান্ত সত্য হিসেবে মানতে হবে।

তবে এ-কথাও সত্য যে, যদি উত্তর-আধুনিক ঘরানার এ-ধরনের জাদুবাস্তব, পরাবাস্তব, বিমূর্ত, অতিপ্রাকৃত প্রকরণের গল্পটি উত্তীর্ণ না হয় তাহলে পাঠক আর ফিরেও তাকাবে না সেদিকে। যে রাগ-রাগিণীর সূক্ষ্ম ‘হরকত’ গায়কের গলায় ধরা দেয় না, তা নিয়ে অকারণ লোক-দেখানো আহ-উঁহু করতে কতক্ষণ আর ভালো লাগে? অনেকের শিরঃপীড়ার কারণ হতে পারে সেসব।

ও’হেনরির এক-একটি গল্প ভীষণ নাটুকে আর প্রাণোচ্ছল, শেষের চমকের জন্যে বসে থাকতে হয় গিঁট ধরে। এরকম গল্পের দেহকাণ্ডের কোথাও একটুখানি আঁচড় পড়লেও পাঠক টের পেয়ে যান গল্পটি এ-জায়গায় কিঞ্চিৎ ঝুলে গেছে। মজা করতে করতে শেষ পর্যন্ত জীবনের এক বড় দর্শনকে পাঠকের সামনে নিয়ে আসার অসামান্য উদাহরণ রয়েছে সুনীল গঙ্গোপধ্যায়ের ‘খরা’ গল্পে। আবার বাংলা সাহিত্যের মহান গল্পকার জ্যোতিরীন্দ্রনাথ নন্দীর ‘গিরগিটি’কে নিঃসন্দেহে পরাবাস্তব কিংবা ভাববিলাসী (Abstract) গল্পের তকমা না পরিয়ে দুটোকে মিলিয়ে-মিশিয়ে জাদুবাস্তবতা ঘরানার দিকেও ঠেলে দেওয়া যায়!

সুস্মিতাকে নিয়ে গল্পকার কোনদিকে যাবেন বুঝতে পারছেন না। ‘সুস্মিতা আজ চলে গেল’ বলে শুরু করা গেলেও যতোটুকু দ্রুততার সঙ্গে তিনি আশা করেছিলেন গল্পটা এগোবে, মোটেই ততো যাচ্ছে না। তিনি হোঁচট খাচ্ছেন বারবার। ক্রিয়াপদ-সর্বনামের মতো সাধারণ বিষয়গুলিও বেঢপ হয়ে ওঁকে বড়ো জ¦ালাচ্ছে। বারবার একই ক্রিয়াপদ ব্যবহারের ফলে বাক্যগুলি কেমন যেন রসকষহীন লাগছে। তরতরে-ঝরঝরে হচ্ছে না। গল্পের প্রাঞ্জলতা বলতে যা বোঝায় তা বজায় না থেকে বাক্যগুলি হয়ে পড়ছে কাঠখোট্টা। গল্পের ছত্রে-ছত্রে যদি রসই মূর্ত না হলো তো পাঠক সেই গল্প কেন পড়বেন? আদি, হাস্য, বীরত্ব, করুণ, রুদ্র, ভয়ংকর, বীভৎস, অদ্ভুত, শান্ত, বাৎসল্য – সব রসের যথার্থ মিশ্রণই এক-একটি গল্পকে তরতাজা করে তোলে। সেগুলির খামতি মানেই তো গল্পটির পুষ্টিহীনতা ঘটবে। পাঠকের কী এমন দায় ঠেকেছে যে এরকম পুষ্টিহীন দুর্বল গল্প জোর করে পাঠ করবেন? যুদ্ধে নেমে হাতের তরবারির ওপর সৈনিক নিয়ন্ত্রণ হারালে যে করুণ ও মর্মান্তিক অবস্থা দাঁড়ায়, গল্পকারও তেমনি নিজের গল্প-রচনার ওপর ঠাকুরালি প্রতিষ্ঠা করতে না পেরে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে পড়ছেন। কেউ কথা শুনতে চাইছে না – ঘটনা, চরিত্র, ভাষা, শব্দ যে যার মতো চলছে। তাহলে গল্প হবে কি করে?

অথচ গল্পকার লক্ষ করেছেন, বেশিরভাগ কথাসাহিত্যিকের কথা বলার ভঙ্গিটি মিলে যায় তাঁর গল্পভাষাটির সঙ্গে। সফল লেখক যেভাবে কথা বলেন অন্যদের সঙ্গে, গল্পও ঠিক ওভাবেই লেখেন। কিঞ্চিৎ মনোযোগী হলেই এই সাযুজ্যটুকু চোখে পড়ে। সৈয়দ শামসুল হক যেরকম শব্দের কারসাজি দিয়ে গল্প তৈরি করেন, তাঁর কথা বলার ভঙ্গিটিও কি অনেকটা সেরকম নয়? আসলে লেখক কিভাবে গল্পটা বলবেন, লেখকই তা স্থির করবেন। কোনো বাঁধাধরা গঁৎ দিয়ে তা বাঁধা যায় না। তবু লেখকের প্রাথমিক কাজ নিয়ে ভিন্ন লেখকের ভিন্ন-ভিন্ন ধারণা। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত লেখিকা মণিকা আলীর একটি মনোগ্রাহী মন্তব্য রয়েছে, যা গল্পকারের মূল কাজটিকে সহজে ধরিয়ে দিতে পারে, ‘I said before, gift of literature is an ability to walk in another person’s shoes. That’s what the writer does, and that’s what literature can give you when it’s really doing the best job that it can do. That is its heart, that is its moral purpose. To see the world 8 from another point of view. That is something that drive me to write. That is what fires me up.’

এখানে স্মর্তব্য যে, অন্যের জুতোয় নিজের পা ঢোকানো অতো সহজ কাজ নয়। নিজের অভিজ্ঞতায় জারিত করে অন্য একটি জীবনকে পাঠকের সামনে বিশ্বস্তভাবে উপস্থাপন করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই নানারকম প্রকরণের আশ্রয় নিতে হয়। এই প্রকরণগুলি যে মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারেন, তিনি ততো সফল গল্পকার। নইলে গল্পে বলার উপাদান বা চরিত্রগুলি স্পষ্ট হবে না, সেটি কুকুর, বিড়াল, ঝড়-বৃষ্টি, সমুদ্র-নদী-পাহাড়-নীলাকাশ, মানুষ ও তার আবেগ-অনুভূতি কিংবা মনুষ্যবসতি – যা-ই হোক না কেন। বড় লেখক ততো অল্পায়াসে গল্পে এসবের আবেশ ফুটিয়ে তুলতে পারেন।

গল্পকার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের শরণ নিলেন। `All of a sudden she noticed that her beauty had fallen apart on her, that it had begun to pain her physically like a tumor or a cancer.‘

অথবা অন্য একটি গল্প তিনি শুরু করলেন এভাবে, ‘Eva Is Inside Her Cat.’

আসলে, গার্সিয়া মার্কেজ কিংবা কাফকা বলে নয়, খ্যাতনামা গল্পকারদের বেলায় গল্পের প্রারম্ভটুকুতে একরকমের চমক মিশে থাকে, এ তাঁদের নিজস্ব ভঙ্গিও বটে। ছোটগল্পের শরীরে মেদের আধিক্য কোনোভাবেই সহনীয় নয়। শরৎচন্দ্র একদা বলেছিলেন – কথা বলবার চেয়ে না বলা আরো কঠিন। তাই গল্পকারের মাত্রাবোধ, রসবোধ ইত্যাদি কোনোটির খামতি হলে গল্পটি জলো হয়ে পড়ে। একটি-দুটি ঘটনার ভেতর দিয়ে জীবনের বিম্বিত রূপটি ধারণ করা সত্যি কঠিন এক কাজ। গল্পকার এই কাজটি করতে পারেন বলেই তিনি গল্পকার। কারণ তিনি বোঝেন কোথায় এর শেষ এবং কোথায় এর সমাপ্তি ঘটবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি গল্প ‘খরা’। পুরো গল্পই চলল মাতালের মাতলামি দিয়ে। কিন্তু গল্পটি যেখানে শেষ হলো, সেখানে পাঠক দেখতে পেলেন, খরা-উপদ্রুত অঞ্চলের কিছু চিমসানো নারী দাঁড়িয়ে রয়েছেন, যাদের শুকনো স্তনের মতো পুরো অঞ্চলটি জলহীন বিরান পড়ে রয়েছে চোখের সামনে। বাংলা সাহিত্যের বেশিরভাগ উত্তীর্ণ গল্পগুলি এই সুরে বাঁধা। এগুলি পড়তে গিয়ে গোগলের ‘ওভারকোট’, আন্তন চেখভের ‘স্টেপি’, সমারসেট মমের ‘দ্য কলোনেলস লেডি’ কিংবা আলবার্তো মোরাভিয়ার ‘টু উইমেন’-এর কথা মনে হবে।

এ-ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ‘ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা ছোটো ছোটো দুঃখ-কথা’ বলে গল্পের যে ব্যাখ্যা দিয়ে রেখেছেন, বাংলা সাহিত্যের বহুপঠিত জনপ্রিয় গল্পগুলির বেশিরভাগ এর ভেতর পড়ে। যে কজন এ-অর্গল ভেঙে সফলভাবে গল্পের ভিন্ন স্বরূপ উদ্ঘাটিত করতে চেয়েছেন, তাঁরা বোদ্ধা পাঠককে তাঁদের আচানক ভাষাশৈলী বা বিষয়-নির্বাচন তথা গল্প-ব্যবচ্ছেদের নানারকম বৈচিত্র্য দিয়ে চমকে দিতে পারলেও এর পরিসর খুব বিস্তৃত নয়। কমলকুমার মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, অমিয়ভূষণ মজুমদার – এ তিনজন গল্পকারের নাম নিতে হয় এজন্য যে, এঁরা সবাই আলাদা একটি গল্পজগৎ তৈরি করতে পেরেছেন। সন্দীপনের ভাষা বড়ই চিত্রল, কাব্যানুরাগে অনুরক্ত। মাঝে মাঝে ‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’, ‘কুইনি’, ‘হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর’, ‘বিজনের রক্তমাংস’, ‘নিদ্রিত রাজমোহন’, ‘অংশু সম্পর্কে ২টা-১টা কথা যা আমি জানি’ গল্পগুলি বেপরোয়া, দুঃসাহসী ও অকপট বাক্যালাপে নিদারুণ সৎ ও নিষ্ঠ। কী যৌনতা, কী বিষয় আর ঘটনার আচমকা ধাক্কা, বর্ণনার চিত্রময়তা – রবীন্দ্রবলয়ের ভেতর নিশ^াস ফেলা পাঠক মাত্রই শ্রান্ত হবেন, তা গল্পকার সহজেই অনুধাবন করতে পারেন। ‘কিছু নদী আছে, যাতে জোয়ার-ভাটা খেলে না। হেমাঙ্গের মুখ সে জাতীয়।’ বাক্য দুটির সরল গঠন লক্ষ করে কারো মনে হতাশা জাগলেও চরিত্রকে উন্মোচিত করার এমন চটজলদি কৌশল অতো সহজে মেলে না সাহিত্যের ভাণ্ডারে। ‘গেল বছর আমরা একটাও চুমু খাইনি অথচ যৌনাঙ্গদুটি ব্যবহার করে গেছি, এই আমাদের প্রবলেম, তাহলে?’ (‘নিদ্রিত রাজমোহন’) কিংবা ‘আজকাল স্বপ্নে জীবিতদের চেয়ে মৃতদের আনাগোনাই বেশি। তাদের সঙ্গেই দেখা হয়।’ (‘টেলিফোন’) – দুটি গল্পের ছেঁড়া বাক্যকটি সহজ মনে হলেও চরিত্রভাব ও গল্পের ভিন্নতর প্রকাশভঙ্গি সুস্পষ্ট করে তুলতে কথাগুলি বন্দুকের গুলির মতো মনে হলো গল্পকারের কাছে। কমলকুমার মজুমদারও পাঠকবান্ধব লেখক নন। সাধুরীতি ও লোকায়ত বৈশিষ্ট্যসংবলিত তাঁর বাক্যবিধি আগে কেউ কখনো পাঠ করেননি। হেঁয়ালিপূর্ণ এ-বাগভঙ্গি ‘সুহাসিনী পমেটম’ বা ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’ গল্পে যতো প্রচ্ছন্ন ততো ‘নিম-অন্নপূর্ণা’, ‘মতিলাল পাদরী’ বা ‘লাল জুতো’য় প্রকট নয়। ‘সাঁওতাল রমণীর প্রসব যন্ত্রণার নাম গীর্জা এবং কাল বর্ষণক্লান্ত আষাঢ়ের রাত্রি রমণীর মানবপুত্র যীশুর দ্যোতনা নিয়ে পাদরির কাছে আশ্রয় পেল। বীণা পাদরিকে বলেছিল, ‘লাও পাদরী, ঘরকে দেবতা আনলাম’ (‘মতিলাল পাদরী’) – যার মধ্য দিয়ে কমলকুমার মজুমদার ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের জনমনে খ্রিষ্টান ধর্মের তীব্র প্রভাবকে বাক্সময় করে তুলেছেন। অপরদিকে ক্ষুধার তীব্র রূপটি প্রকট করে তুলতে চেয়েছেন ‘নিম অন্নপূর্ণা’ গল্পে। ‘একদা মায়াবিনী প্রীতিলতার কণ্ঠস্বরে ক্রমাগত বালি ঝরার ভয়াবহতা’ বা ‘আমার ইচ্ছা করে গলায় দড়ি দিতে, না লেখা না পড়া খালি খাই খাই’ (‘নিম অন্নপূর্ণা’) – উৎকলিত উদ্ধৃতিগুলি ক্ষুধার গদ্যময় মরুপ্রান্তরকেই চিত্রময় করতে চেয়েছে ভিন্ন রকমের ইশারাময় ভাষায়। অমিয়ভূষণ মজুমদারের গল্পেও রয়েছে অসাধারণ সব চমক ও দ্যুতি। ‘তাঁতীবউ’ গল্পটি তিনি যেরকম মুখরা দিয়ে সাজালেন তা রীতিমতো চমকপ্রদ – ‘সব দেশের একটা যুগ আছে যাকে বলা হয় অন্ধকার-যুগ, আর একটা আছে যাকে বলা হয় আলোকের যুগ। বাঙলাদেশে অধিকন্তু একটা আছে যা আনাড়ির তোলা ফটোগ্রাফের মতো গভীর অন্ধকার ও উজ্জ্বল আলোকের আকাক্সক্ষাহীন মিলনের যুগ। সেই যুগের গল্প একটা বলছি’ – এ-বলায় নাটকীয়তার সঙ্গে মিশে রয়েছে সাহিত্যের আভিজাত্য। এটি আনাড়ি গল্পকারের হাতে পড়লে হয়ে উঠত স্থূলতা ও নির্বুদ্ধিতায় পূর্ণ একটি প্রাক-কথনের নমুনা।

হবু গল্পকার গল্পের কুশীলবের বাক্যালাপ কিংবা সংলাপ-বিনিময় নিয়েও রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। গল্পের চরিত্রগুলি তো নিজেদের ভেতর কথা বলবেই। কথা বলে-বলে ঘটনাটি স্পষ্ট করে তুলবে কিংবা পাঠকের মনে রহস্যময় ধোঁয়াশা তৈরি করে কৌতূহল বাড়াবে। কিন্তু সেই আলাপচারিতা যদি অর্থহীন হয়? যদি বোদ্ধা পাঠকের চটজলদি মনে হয়, এসব আলাপচারিতা মোটেই গল্পবান্ধব হয়নি, অর্থহীন ও অপ্রাসঙ্গিক, তাহলে? কারণ সংলাপ সফল গল্পের প্রাণশক্তি। এটি চরিত্র ও এর চারপাশকে চেনায়। পাঠকের মনে যে-ছবি তৈরি হয় তা অনেকখানি এই সংলাপনির্ভরতা থেকে উঠে আসে। কিন্তু ছেলে-মেয়ে-খালা-দাদু-মা-বাবা-বন্ধু-প্রেমিক-প্রেমিকার সংলাপ যদি শ্রেণিভেদে একইরকম মনে হয়? একজন ইংরেজি-পড়ুয়া কিশোরী কিংবা একজন সহজ-সরল মধ্যবিত্ত গৃহবধূর সংলাপ কখনোই এক হওয়ার কথা নয়। একইভাবে একজন কৃষক, টেম্পোচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রথিতযশা শিক্ষক কিংবা একজন নব্য কোটিপতির শ্রেণি-চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন। এদের চিন্তা-চেতনার জায়গাটিও ভিন্ন। তাই এদের কথাবার্তার ধরন-ধারণ একইরকম হওয়ার কথা নয়। মোপাসাঁ যাকে আখ্যা দিয়েছেন ‘ইলিউশন অব রিয়েলিটি’, একটি আধুনিক গল্পে সেই মায়া ছড়িয়ে দেওয়া লেখকের কাজ। বাস্তবের মা আর সাহিত্যের মায়ের কান্না কখনো এক হবে না – বাংলা সহিত্যের প্রখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদার সুনির্দিষ্ট করে একথা বলেন। গার্সিয়া মার্কেজের একটি জাদুবাস্তব গল্প রয়েছে ‘এ ভেরি ওল্ডম্যান উইথ এনরমাস উইংস’ শিরোনামে, যেখানে কোনো সংলাপ নেই। সেখানে তিনি দেবদূতের দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার পর যে-বর্ণনা দিয়েছেন তা মনুষ্যসমাজের বাস্তবতার সঙ্গে মিশে যায় বলেই পাঠক চরিত্রটির প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ বোধ করেন। অলৌকিকতা কিংবা অতিপ্রাকৃত উপাদান বা ফ্যান্টাসি যখন-তখন গল্পে ব্যবহৃত হতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই এর। এগুলি কখনো জাদুবাস্তব, কখনো অতিবাস্তব বা কখনো পরাবাস্তব গল্প হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। এক-একজন লেখক এক-একভাবে এসব ফ্যাক্ট ও ফ্যান্টাসির চর্চা করে গেছেন তাঁদের গল্পে। তবে প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, লেখক কীভাবে আপন সমাজ ও সংস্কৃতির বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে গল্পকে নিরেট অবাস্তব থেকে তুলে বাস্তবের গল্প হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন, সেখানেই নিহিত রয়েছে লেখকের সৃজনী-শক্তি। যে গল্প পাঠকের নিজস্ব বাস্তবতায় সাড়া জাগায় না, তা সেই পাঠকের জন্য অগল্প। লেখক পাঠক তৈরি করেন – একথা সত্যি। কিন্তু পাঠকের রুচি, বিশ^াস ও পাঠ-সক্ষমতার স্তর কোন সমাজে কতটুকু, তার ওপর নির্ভর করেই তাঁকে এগোতে হয়।

গল্পকে বাস্তবানুগ হিসেবে গড়ে তুলতে সংলাপ মাঝে মাঝে জরুরি ভূমিকা পালন করে। ইঙ্গিতময়তার ইন্দ্রজাল সংলাপ ব্যবহারের মধ্য দিয়েও এগিয়ে নেওয়া যায়, লেখক তা পারেন। রবীন্দ্রনাথের গল্প ‘শাস্তি’ সংলাপ-ব্যবহারের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। উদাহরণ টানা যায় এভাবে –

জেলখানায় ফাঁসির পূর্বে দয়ালু সিভিল সার্জন চন্দরাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কাহাকেও দেখিতে ইচ্ছা কর?’

চন্দরা কহিল, ‘একবার আমার মাকে দেখিতে চাই।’

ডাক্তার কহিল, ‘তোমার স্বামী তোমাকে দেখিতে চায়, তাহাকে কি ডাকিয়া আনিব?’

চন্দরা কহিল, ‘মরণ! -’

গল্পের সমাপ্তিপর্বে এই যে লেখকের ‘মরণ’ বলে ইঙ্গিতময়তা তৈরির প্রয়াস – এটাই গল্পের প্রাণভোমরা। দুখিরাম রুই আর ছিদাম রুইর পুরুষালি শঠতার শিকার অসহায় বধূ চন্দরার মন জুড়ে কী চলছে তা পাঠককে ভাবার সুযোগ করে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভিন্নভাবে বারবার বিশ্লেষণ করেও পাঠক এর হদিস পাবেন কি না সন্দেহ। আর এখানেই ঘটে উতরে যাওয়া এক-একটি গল্পের সার্থকতা।

আন্তন চেখভের গল্প প্রধানত সংলাপপ্রধান হয়ে থাকে। ‘লেডিস’ শিরোনামের একটি গল্পের উদাহরণ টানা যায় এখানে। গলা খারাপ হয়ে যাওয়ায় স্কুলশিক্ষক ভ্রিমেনেস্কিকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে তাঁর কাজ থেকে। স্কুল-কর্তৃপক্ষের ভেতর একজন পরিচালক ছিলেন, ফিয়োডর পেট্রোভিচ, সদাশয় ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ। তাঁর মন সায় দিচ্ছিল না এভাবে ভ্রিমেনেস্কিকে বিদায় জানাতে। ইতোমধ্যে চৌদ্দটি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন এ-পেশায়। এখন এভাবে নির্দয়ের মতো খালি হাতে তাঁকে বিদায় জানাতে পরিচালকের বিবেকে খুব বাধছে। কারণ এসময় চাকরি থেকে অব্যাহতি নিলে স্কুলশিক্ষকের যা বয়স তাতে তিনি অবসরকালীন সুবিধাপ্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত হবেন। পরিচালক মহোদয় তাঁর কাছে গলার এমন করুণ অবস্থার কারণ জানতে চাইলেন। স্কুলশিক্ষক জানালেন, তিনি ঘেমে গেলে ঠান্ডা বিয়ার পান করতেন নিয়মিত। হয়তো এজন্য গলা খারাপ হয়েছে। এসময় পেট্রোভিচের হঠাৎ করেই মনে হলো, কদিনের ভেতর তাঁর অফিসে সেক্রেটারির পদটি খালি হবে। আনন্দে তিনি সেক্রেটারির পদটি স্কুলশিক্ষককে দিতে চাইলেন। তিনিও সানন্দে রাজি হলেন প্রস্তাবে। কিন্তু বাদ সাধলেন পলজুহিন নামে এক তরুণ খেলোয়াড়। পেট্রোভিচের স্ত্রীসহ গভর্নরের স্ত্রী পর্যন্ত সবার পক্ষ থেকে লোকটির জন্য সেক্রেটারি পদে তাকে নেওয়ার সুপারিশ আসতে শুরু করে। অথচ পেট্রোভিচের লোকটিকে পছন্দ নয়। পলজুহিনের প্রচুর পৈতৃক সম্পদ রয়েছে। সে চাকরিটি শুধুই লোক দেখানোর জন্য করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই পেট্রোভিচের মনে। তিনি মহাবিরক্ত হলেও কিছুই করার নেই। কথা দিয়েও তিনি চাকরি হারানো স্কুলশিক্ষককে চাকরিটি দিতে পারছেন না। এই অপারগতা তাঁকে কুরে-কুরে খাচ্ছে দিনরাত। কথামতো নির্দিষ্ট দিনে স্কুলশিক্ষক এলেন পেট্রোভিচের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর অফিসে ভ্রিমেনেস্কি অধীর আগ্রহে বসে রয়েছেন চাকরির আশায়। অথচ পেট্রোভিচের হাত-পা বাঁধা। কিছুই করার নেই। সহসা মানুষটা ফেটে পড়লেন প্রচণ্ড রাগে, ‘I have no post for you! I have not, and that’s all about it! Leave me in peace, don’t worry me! Be good as to leave me alone!’ And he walked out of the office.’ গল্প এখানেই শেষ।

এবার পাঠক ভাববে পেট্রোভিচের অসহায়তার কথা। কত আগেকার গল্প; গল্প বলার ফর্মটাকেও অনেকে পুরনো বলে মুখাবয়ব গম্ভীর ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ করে তুলতে পারেন; কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জীবনবোধে গল্পটি এখনো সমসাময়িক! এ-প্রসঙ্গে মতি নন্দীর গল্প ‘একটি সাধারণ ব্যাপার’-এর উদাহরণ টানা যেতে পারে। মেয়েটির বিয়ে হচ্ছে না। বয়স বাড়ছে। রূপ নেই, অর্থ নেই – একেবারেই সাধারণ পরিবারের মেয়ে সে। বিয়ের প্রস্তাব এলেও কারোরই মেয়েটিকে পছন্দ হচ্ছে না। এসময় পাড়ার এক বৌদি পত্রিকার বিজ্ঞাপন এনে মেয়েটিকে দেখালো।

যথারীতি চিঠি দিলো বিজ্ঞাপনদাতা ছেলের কাছে। ছেলেটি নিজের পরিচয় গোপন করে কলকাতার কোনো এক রাস্তার মোড়ে মেয়েটিকে দাঁড়াতে বললো। ছেলেটি সেখানেই মেয়েটিকে একঝলক দেখবে। পছন্দ হলে বিয়ের প্রস্তাব এগোবে, নইলে নয়। শুনে শিহরিত হলো মেয়েটি। ওর চোখে ভেসে উঠল সুঠামদেহী হাসিখুশি এক পুরুষের চেহারা। মেয়েটি ছেলেটির জন্যে সেজেগুজে নির্দিষ্ট রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে অতি সরল মেয়েটি এক নারীলোভীর খপ্পরে পড়ে নির্জন এক বাসায় চলে এলো। মেয়েটির চোখে তখনো স্বপ্নের ঘোর। যখন নারী-মাংসলোভী লোকটি মেয়েটিকে ভোগ করতে এগোচ্ছে তখনো মেয়েটির ঘোর কাটছে না; তাই মেয়েটির অন্তিম এক সংলাপ, ‘আমাকে পছন্দ হয়েছে তো আপনার?’ এভাবেই লেখক একধরনের মর্মন্তুদ আবহ তৈরি করে এক-একটি জীবন্ত রক্ত-মাংসের চরিত্র সৃষ্টি করেন। পাশাপাশি একই লেখকের ‘বয়সোচিত’ গল্পটির কথা ধরা যাক। গল্পের প্রধান চরিত্র একজন বয়স্ক চাকরিজীবী। কিন্তু তাঁর যে বয়স হয়ে গেছে তা মানতে রাজি নন। তাই অফিসের স্পোর্টসে হাঁটার প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন। এর ঠিক পরদিন অফিস থেকে স্ত্রীকে তিনি জানালেন, অফিস আর আমাকে অবসরে পাঠাতে পারবে না। কেননা আমি নিজেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। এখানেও সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গল্পের প্রধান চরিত্রের জটিল মনোজগৎকে লেখক সংলাপের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছেন পাঠক-মনে। প্রখ্যাত কথাকার ইমদাদুল হক মিলনের ‘রেশমি’ সংলাপনির্ভর ছোটগল্পের এক উদাহরণ। সংলাপের ভেতর দিয়ে লেখক গল্পটির প্রধান চরিত্র রেশমির মনোবৈকল্যকে উন্মোচিত করতে চেয়েছেন। গল্পে মোট তিনটি চরিত্র – ডাক্তার, রোগিনী ও তার স্বামী। মৃতবৎসার লক্ষণ রেশমির মাঝে; একটি সন্তান মৃত প্রসব করে সে; সন্তানটির ছায়া সে নিয়মিত দেখতে পায় ফ্ল্যাটের চারপাশে। মাঝরাতে বিড়বিড় করে কথা বলে সন্তানের সঙ্গে। লেখক সংলাপ ব্যবহার করে সেই সত্যিটা বের করে আনেন সামনে। সেখানে গল্পকারের প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে সংলাপ এবং সংলাপ।

এজন্য একজন শক্তিশালী গল্পকার অতি সতর্কতার সঙ্গে সংলাপের ব্যবহার করে থাকেন গল্পে। কখনো গল্পের পুরো মেজাজটাই অর্থবহ সংলাপের ভেতর লুকিয়ে রাখেন লেখক। ‘ফাদার’ নামের চেখভের অন্য একটি গল্পের উদাহরণ টানা যেতে পারে। এ-গল্পে একজন পিতার পুরো মানসিকতা সংলাপ দিয়ে আঁকতে চেয়েছেন লেখক। আবার একটিও সংলাপ না দিয়ে শুধু আকর্ষণীয় বর্ণনার মোড়কে গল্পকে সাজাতে পারেন লেখক। তবে কুশলী সংলাপ লেখকের ভাবনা ও অভিজ্ঞতাকেই তুলে ধরে। আনাড়ি লেখক যেখানে সংলাপের গুরুত্ব অনুধাবন না করেই যেখানে-সেখানে এর ব্যবহার ঘটিয়ে গল্পের মেজাজ লঘু করে ফেলেন, সেখানে একজন অভিজ্ঞ লেখক যত্ন ও কুশলতা দিয়ে সংলাপ ব্যবহার করে নিজের গল্পটির ওজন ও গুরুত্ব কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেন। একসময় গল্পের চরিত্রগুলি সরাসরি বিশেষণ দিয়ে সাজাতেন লেখক, তারপর ঘটনার সন্নিবেশ ঘটিয়ে এর বিশ^স্ততা প্রমাণ করতেন। পাঠক আগেভাগেই বুঝে যেতেন চরিত্রগুলির স্বভাব, নিজেকে আর কষ্ট করতে হতো না। কিন্তু এখন সংলাপ ও ঘটনা দিয়ে লেখক চরিত্র আঁকেন। এমন কী, নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখা সূক্ষ্ম জীবনবোধের দর্শনটুকুও একজন পাকা লেখক সরাসরি বিশেষণের আশ্রয় না নিয়ে সংলাপ ও ঘটনার ভেতর লুকিয়ে রাখেন। পাঠককে সেগুলি বুঝে নিতে হয়, এজন্য পাঠকের সক্ষমতা কাম্য। তাই যিনি পাকা গল্পকার তিনি পাঠককে এমন এক আবহের ভেতর সেঁধিয়ে দিতে সক্ষম যে কুশীলবের নাম না জেনেও বলে দেওয়া যাবে – এটি কোনো মধ্যবিত্ত নারী কিংবা কোনো উচ্চবিত্ত রাশভারী পুরুষের কণ্ঠস্বর।

কল্পনা, পর্যবেক্ষণ, পঠনপাঠন আর নিয়মিত চর্চা গল্পলেখক হওয়ার প্রাথমিক স্তর। শুদ্ধভাষায় একটি নিটোল গল্প যিনি লিখতে সক্ষম তিনি পরবর্তীকালে নিজস্ব গল্পজগৎ তৈরি করেও ফেলতে পারেন। কিন্তু যাঁরা শুরুতেই জটিল সব গল্পের ধারা অনুকরণ করে নিজের সাবলীল গল্প বলার ক্ষমতাকে ঢাকতে চান, তাঁরা যতোই বিজ্ঞাপিত হোন, মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়তে পারেন। পাঠক চমকিত হতে, মনোরঞ্জিত হতে গল্প পাঠ করেন। যে-লেখক ঘটনার নতুনত্বে, বর্ণনার কুশলতায়, চরিত্রের বিশ্লেষণে ও পারিপাশির্^ক সচেতনতায় সেই আবহ গল্পে নির্মাণ করতে পারেন, পাঠক তাঁকেই আঁকড়ে ধরেন। যে-ফর্মেই লেখা হোক গল্প, নতুন কিংবা পুরনো, তা যদি লেখকের ভাবনাস্রোতকে অবয়ব দিতে পারে পাঠকের অন্তরে, তবে তাই হবে সার্থক গল্পের উদাহরণ। কাজটি যিনি যতো সহজে করতে পারেন তিনি ততো গ্রহণীয় পাঠকের দরবারে। এজন্য লেখককে সুস্থির-সুশৃঙ্খল ও নির্মোহ হয়ে এগোতে হয়।

 গল্পকার বড়ই পেরেশান গল্পশৈলী নিয়ে। নানারকম উৎপাতে তাঁর গল্পজীবন বিপর্যস্ত। গল্প লেখা শুরুর আগে তিনি তা মোটেই ভাবেননি। প্রথমেই তিনি গল্পটি কোন পুরুষে লিখবেন তা নিয়ে পড়লেন বিপাকে। বাংলায় তিন প্রকারের পুরুষ রয়েছে – উত্তম, মধ্যম আর নামপুরুষ। তিনি ভেবেছিলেন, গল্পটি উত্তম পুরুষে লিখবেন। সর্বনামগুলি সেভাবেই আসবে। কিন্তু গল্প শুরু করতে গিয়ে তিনি দ্বিধান্বিত চিত্তে ভাবছেন, যে পুরুষ তিনি বেছে নিয়েছেন তা ভাবনা প্রকাশের অনুকূল নয়। তিনি শুরু করতে চেয়েছিলেন এভাবে – ‘সুস্মিতা আজ চলে গেল; হয়তো চিতার আগুনে জ¦লে খাক হচ্ছে এখন’ – বলার পরপর প্রেমিকপ্রবর সবাইকে চমকে দিয়ে পাঠকের সামনে এসে দাঁড়াবেন। পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে তিনি একে-একে সুস্মিতা সম্পর্কে অজানা সব কথা পাঠককে বলবে। কিন্তু শুরু করতে গিয়ে লক্ষ করলেন, সব যেন কেমন জলো শোনাচ্ছে। চমক দিয়ে গল্প শুরু করলেও একে ধরে রাখতে পারছেন না। বাক্যের চমক, ঘটনার চমক, চরিত্রের চমক কোথাও স্পষ্ট হচ্ছে না। অথচ

মাথার ভেতর কিলবিল করছে গল্প। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে চাইছে কলমের ডগায়। কিন্তু আছড়ে পড়ার পর মনে হচ্ছে, কোথায় ঢেউ? সৃজনশীলতার যে স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও পরিশীলিত প্রকাশ তা তো পরিস্ফুট হচ্ছে না তাতে!

গল্পকার রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হলেন। গল্পগুচ্ছের প্রথম গল্প ‘ঘাটের কথা’ মনে পড়ল। পড়তে পড়তে কখনো হাসি পাচ্ছে, কখনো কান্না পাচ্ছে। ঘাটের মতো এমন নীরস বিষয় নিয়েও যে গল্প লেখা সম্ভব এবং তা দিয়ে পাঠকের আবেগকে নাড়াচাড়া দেওয়া যায়, তা প্রথমত রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কে পেরেছেন এই বাংলা সাহিত্যে! গল্পগুচ্ছ হচ্ছে বাংলা কথাসাহিত্যের উৎসমুখ, একে ছাড়া চলে না। তারপর তো বুদ্ধদেব বসু এসে ভাষাটিকে আরো চাঁচাছোলা ও আধুনিক করে গড়ে তুললেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তদের ক্ষুরধার গল্পভাষা কি ভোলা যায়?

হবু গল্পকার কাকে পড়েননি? সমরেশ বসুর নির্মোহ জীবনঘনিষ্ঠতা, সমরেশ মজুমদারের উত্তরবঙ্গ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা বুদ্ধদেব গুহর জঙ্গল-প্রণয়, মহাশ্বেতা দেবীর আদিবাসী কড়চা, কমলকুমার মজুমদার বা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের অন্যরকম কিছু সবই তো তিনি পাঠ করেছেন। তবু লিখতে গিয়ে এমন নাকাল হচ্ছেন কেন?

একটি ঘটনা বলার পর আরেকটি ঘটনা বলতে পারছেন না। দুটো যেন মিলছে না। অথচ বড় লেখকদের ঘটনাগুলি যেন একটির সঙ্গে অন্যটি মিলেমিশে একাকার, ঝরনাধারার মতো সদা বহমান। কিছুদূর এগোলেই চোখের সামনে চিত্র ভেসে উঠছে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘স্নোজ অব কিলিমানজারো’র বিপদগ্রস্ত লেখকের মৃত্যুভাবনার কথা মনে পড়ছে। কী যে স্পষ্ট ও সাবলীল সেই বর্ণনা, ভাবা যায়? ফ্রান্জ কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ পাঠ করে গার্সিয়া মার্কেজ বুঝতে পেরেছিলেন, ‘That it was possible to write in a different way.’ গল্পে গ্রেগর সামসা পোকায় পরিণত হওয়ার পরও তার বেলায় মানুষের বোধবুদ্ধি কাজ করেছে। তার শরীর বদলে গেলেও মানুষের মতোই অনুভূতির প্রকাশ করে বাস্তবতার মায়া তৈরি করে চলেছেন পাঠকের হৃদয়ে। সন্ধ্যার পাতলা অন্ধকারের মতো এই অর্ধস্ফুট বাস্তবতা-জ্ঞানই পাঠককে এক নতুন গল্প-পাঠের স্বাদ এনে দেয় ষাটের দশক থেকে।

সবই বোঝেন তবু হবু গল্পকারের গল্পটি এগোচ্ছে না। একটি সাংঘাতিক গল্প লিখবেন বলে তিনি কদিন থেকে ডাঙায় তোলা তাজা মাছের মতো তড়পাচ্ছেন। তিনি বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করেছেন। একটি দেশে, অন্যটি চাকরিসূত্রে বিদেশের বড়ো কোনো বিশ^বিদ্যালয়ে। যদিও পেশায় একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যুরোক্র্যাট, তবু যে-কোনো দেশি বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার জন্য যথেষ্ট যোগ্য মানুষ তিনি। মাথায় গোলাকৃতি টাক। কেবল তিনদিকে ভারতের কাঁটাতারের বেড়ার মতো ক-গাছি চুল পুরো মাথাটিকে পাহারা দিয়ে চলেছে। চোখে পুরো লেন্সের চশমা।। রুমভর্তি অজস্র চোখ জুড়ানো অ্যান্টিক-অলংকার। টেবিলভর্তি ক্ষুধাবর্ধক খাদ্যসামগ্রী। তিনি গল্পটি লিখবেন ভেবে স্ত্রী তাঁকে একাকী রেখে গেছেন এই সোনার চাবিওলা ঘরে।

অথচ গল্পটি এগোচ্ছে না।

আঙুলের ফাঁকে পাঁচ হাজার টাকা দামের ব্র্যান্ডেড কলম। কাগজ একেবারে বকের পাখনা। মুখে মাঝে মাঝে তুলে নিচ্ছেন একটি-দুটি টসটসে কালো আঙুর। এসির সুশীতল বাতাস ও কক্ষের নীরবতা একধরনের মগ্নতা তৈরি করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু যে-কাজটির জন্য হবু গল্পকারের ভেতর এতো হাহাকার, সেই ধামাকা গল্পটাই ধরা দিচ্ছে না। সহজ, সাবলীল ও নির্মোহ একটি গল্প।

তিনি চেষ্টা করছেন।

দুই

গল্প কে না বলতে চায়?

মনুষ্যজীবনে গল্পের সমাপ্তি মানে মৃত্যুর নামান্তর। গল্প শেষ তো জীবনও শেষ।

কেউ এভারেস্ট জয় করে ফিরেছেন, তো আমরা তাঁর পায়ের কাছে বসে গালে হাত দিয়ে বিজয়ের গল্পটা শুনতে চাই। কেউ মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো এক সেক্টরে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে গিয়ে পানিতে ডুবে থাকা পাটক্ষেতের জোঁকের ক্রমাগত কামড় খেয়ে বাঁ-পা হারিয়েছেন – আমরা এ-গল্পটাও শোনার অধীর আগ্রহ প্রকাশ করি। গল্প বলায় কথক যতো পারঙ্গম ততো গল্প শোনার অমিয় সুখ আহরণ করে পাঠক। পাঠক হিসেবে কখনো শিহরিত হই, কখনো দুঃখে মন গলে আবার কখনো আনন্দে ভেতরটা শীতের রোদের মতো ঝিকমিক করে।

আগ্রহের এ-জায়গাটা তৈরি করেন কথক বা গল্পকার নিজে। বাঙালির হাসির গল্প, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার বিদূষক গোপাল ভাঁড়ের গল্প, সম্রাট আকবরের রাজসভার নবরত্নের একজন ওয়াজির-ই-আজম বীরবলের গল্প, তুর্কিদেশের সুফি দার্শনিক নাসিরুদ্দীন হোজ্জার গল্প – সব আমাদের আদি ও অকৃত্রিম গল্প শোনার আগ্রহকে প্রশমিত করে। সোমদেব-বর্ণিত এগারো শতকের

কথাসরিৎসাগর-এর কথা না বলে পারা যায় না। কত রকমের অভিযান, পরীদের গল্প আর নানারকম লোককাহিনি রয়েছে এই গ্রন্থে। কাশ্মিরের রাজা অনন্তদেবের রানি সুরমতির মনে আনন্দ জোগাতে গল্পগুলি যূথবদ্ধ করা হয়। জাহিলিয়া যুগের কবি দানশীল হাতেম তাইয়ের গল্প নিয়ে রচিত ‘আরব্য-রজনী’র সঙ্গে এর মিল রয়েছে। এদেরও বহু আগে পশুপাখির গল্প নিয়ে সংস্কৃত সাহিত্যে রয়েছে পঞ্চতন্ত্র। এসবই আমাদের গল্প শোনার ক্ষুধা মেটায়। আমরা যুগের পর যুগ ধরে এদের শুনছি; তবু নতুন লাগে। গাঙপাড়ের ভাটিয়ালি গানের মতো বছরের পর বছর পাঠকের কল্পনাশক্তিকে উসকে দিচ্ছে এসব বহুশ্রুত গল্পধারা।

বহুশ্রুত গল্পগুলি মানুষের আবেগকে নাড়া দিয়েছে শত-শত বছর ধরে। মানুষের নিত্যদিনের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে গল্প-চরিত্রগুলি মিশে যাওয়ায় এর আয়ুষ্কাল এতো দীর্ঘ যে মা-দাদির মুখে শোনা কোন গল্পটার উৎস কোথায় তা বলা মুশকিল। এদের ভেতর উপদেশ যেমন রয়েছে তেমনি আছে আনন্দ আর বিষাদে মাখা জীবনের জলছবি। ঈশপের গল্প কেবল গল্প নয়, এগুলির ভেতর দিয়ে জীবনের নানামুখী রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। এজন্যই নদীর ধারার মতো যুগের পর যুগ ধরে বাহিত হতে থাকে গল্পগুলি, এক পরম্পরা থেকে অন্য পরম্পরায়, এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে, হয়তো খানিকটা অন্যরকম চেহারা নিয়ে গল্পগুলি পলির মতো একাত্ম হয়ে মিশে যায় অন্য পরিবেশে।

গল্পের এই যে চিরায়ত রূপ তা অস্বীকার করার নয়। একে ধারণ করেই একজন গল্পকারকে আজকের সময়ে গল্প লিখতে হয়।

হবু গল্পকার ভাবছেন কিভাবে একটি গল্প মানুষের মনের কাছাকাছি এসে যায়। এ প্রসঙ্গে গী দ্য মোপাসাঁর বিখ্যাত গল্প ‘A piece of string-’-এর কথা মনে পড়ে। একজন নিরীহ সৎ মানুষ কীভাবে ঘটনাচক্রে অপরাধী বনে যায়, তার উপাখ্যান এটি। পাঠকের সমবেদনা শুরু থেকেই মানুষটির সঙ্গে ছিল এবং পাঠক গল্পটি পাঠ করে খুব স্বাভাবিক কারণেই বিষণ্নভাবে বলে ওঠেন, আহা বেচারা!!

এই যে পাঠক ও গল্পকারের ভেতর সম্পর্ক তৈরি হওয়া, তা-ই উত্তীর্ণ গল্পের প্রথম ও প্রধান শর্ত। শরৎচন্দ্রের অবিনাশী ‘মহেশ’ গল্পটির কথা এ প্রসঙ্গে এসে পড়ে। পশুর প্রতি মানুষের যে অকৃত্রিম ভালোবাসা তা কি পাঠককে স্পর্শ না করে পারে?

মানবীয় যতো আবেগ মানুষকে আবহমান কাল থেকে আন্দোলিত-উদ্ভাসিত করে এসেছে, একজন গল্পকার তাঁর গল্পে সেগুলিকে সফলভাবে স্পর্শ করতে পারার লক্ষ্য নিয়ে গল্প লিখতে বসেন। তিনি যে-কোনোভাবে হোক পাঠককে ছুঁতে চান। পাঠকমনের অন্দরমহল কিংবা বৈঠকখানা, সব জায়গাতেই তাঁর অবাধ বিচরণের বাসনা। পাঠকের মনস্তত্ত্ব যে গল্পকারের যতো আয়ত্তাধীন থাকে, ততো তিনি সাফল্য অর্জন করার শক্তি অর্জন করেন। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি কিংবা রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ট্রেজার আইল্যান্ড দুটি পাঠকপ্রিয় গল্প। দীর্ঘসময় ধরে এই রূপকথা ও অভিযানের গল্পগুলি মানুষের মাঝে বেঁচে রয়েছে। কেননা প্রেম, ভালোবাসা, রোমাঞ্চ, অভিযান, রহস্যের মতো যে-কোনো উদ্দীপক বিষয়ই মনুষ্য-হৃদয়ের মতো প্রাচীন ও অকৃত্রিম। গল্পচর্চায় এগুলি অতীতের মতো বর্তমান ও ভবিষ্যৎকেও আকর্ষণ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বকীয়তা কিংবা নতুনত্ব নির্ভর করছে গল্পকারের ওপর। তিনি বিষয়টি কিভাবে পরিবেশন (Treatment) করবেন তা এক-একজন গল্পকার একেকভাবে সম্পন্ন করেন।

গল্পের প্রচলিত যে কাঠামো তা একটি নির্দিষ্ট ও একক পরিণতি (Single effect)-কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এডগার এলান পো’র ভয়ের গল্পগুলি পাঠ করলে সেই স্বাদ মেলে। কোনো অপ্রয়োজনীয় বিষয় নেই। পরিমিতিবোধ ও সংযমের ছোঁয়া সর্বত্র। সমাপ্তির দিকে যেতে যেতে একধরনের আনন্দ ও উত্তেজনাবোধ জন্ম নেয়। লিও টলস্টয়ের ‘থ্রি কোশ্চেনস’ গল্পটিও একই সূত্র ধরে এগোয়। এক বসায় শেষ হওয়ার মতো গল্প। শেষে পৌঁছানো না পর্যন্ত শান্তি নেই মনে। এক গভীর টান পাঠককে তাড়িত করে। আন্দোলিত হয় তার সমস্ত অন্তঃকরণ এবং শেষ পর্যন্ত এক অপার আনন্দের গহিনে অবগাহন করে পাঠক তার গল্প পাঠের তৃষ্ণা মেটায়। সার্থক গল্প সর্বকালে এভাবেই পঠিত হয়েছে।

হবু গল্পকারের কাছে গল্পের স্টক অফুরন্ত। তাঁর বয়স হয়েছে। আমলা থাকাকালে প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। রঙবেরঙ হরেকরকম সাফল্য রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। পড়াশোনার ব্যাপ্তিও কম নয়। তবু তাঁর গল্পটি তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ঠিকঠাক হয়ে উঠছে না।

গল্প শুরু করতে গেলেই কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখবেন তা নিয়ে দ্বন্দ্বের ভেতর ঘুরপাক খেতে শুরু করেন। চোখের সামনে একবার সুস্মিতার করুণ চেহারাটি ভাসে। পরক্ষণে প্রেমিকের প্রতিশোধস্পৃহায় জড়ানো এক কঠিন মুখ বারবার তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কার কথা কিভাবে কতটুকু লিখলে পাঠক তৃপ্তি পাবেন তা বুঝতে পারেন না। এ যেন রান্নায় ঠিকঠাক হলুদ-মরিচ-লবণ মেশানোর মতো এক জটিল কর্ম-সম্পাদন প্রক্রিয়া। কখন কতটুকু মেশালে তরকারি সুস্বাদু হয়ে উঠবে তা বুঝতে পারার খেলা যেন এটি।

প্রাথমিকভাবে গল্প বলার একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতি থাকে। শৃঙ্খলাটুকু যেমন ভাষাগত তেমনি আবেগ-নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। গল্প বলতে গিয়ে নানারকমের চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় লেখককে। গল্পের চরিত্র কটি হবে, গল্পটি কে বলবেন – সে, তুমি, নাকি আমি। কোন ধরনের পরিবেশ-পরিস্থিতির ভেতর থেকে ঘটনা ও চরিত্রগুলি বেড়ে উঠবে, গল্পের মূল প্রতিপাদ্য কী হবে, ক্লাইমেক্স বা চরম পরিণতি হয়ে কিভাবে সমাাপ্তির ‘শেষ হয়ে হইল না শেষের’ সূক্ষ্ম সুর তুলবে সেতারে – এসবই নির্ভর করছে গল্পটি কতটুকু সুচারু বিন্যাসের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে তার ওপর। পৃথিবীর সেরা গল্পগুলি এতোটাই অনায়াস সতর্কতার সঙ্গে লেখা হয়েছে যে, কোনো কোনো গল্পে একটি বাক্য কিংবা নিদেনপক্ষে একটি শব্দের হেরফের করলেও গল্পটির অঙ্গহানি ঘটে। উত্তীর্ণ ছোটগল্পের স্বল্পপরিসরে পাঠক এক পূর্ণ জীবনের তৃপ্তি খুঁজে পান। তাই যে গল্পকার যতো শক্তিশালী, তিনি ততো সরস করে তাঁর গল্পটি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন। বিষয়বস্তু কতটুকু ভাবগম্ভীর কিংবা কত মহান (Elevated Theme) তা নিয়ে গল্পকার কমই মাথা ঘামান। বরং একটি ছোট নৈমিত্তিক ঘটনার ধারাবর্ণনাও এমন প্রাঞ্জল, সরস ও বাস্তবানুগ হতে পারে যে পাঠক ঘটনাটিকে নিজের বলে ভাবেন এবং আনন্দ উপভোগ করেন।

হবু গল্পকারের মতো অনেক উঠতি গল্পকারের মনেও মহৎ কোনো বিষয় নিয়ে অহরহ গল্প বলার ইচ্ছা জাগে। নারী স্বাধীনতা, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের যাপিত জীবন, বস্তি-সমস্যা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও তাদের সমস্যা, গার্মেন্টস শিল্প, গ্রামীণ জীবনের নানাবিধ শোষণ ও বঞ্চনার গল্প, নগরায়ণের নিষ্ঠুর বাস্তবতা প্রভৃতি। স্বল্পপরিসরের ছোটগল্পে এসব নানাবিধ সমস্যা অন্তর্ভুক্ত করা সত্যি কঠিন এক কাজ। এজন্য এমন একটি ঘটনার আশ্রয় নিতে হয় যা সার্বিক ও এককভাবে একটি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সমস্যার দিকে পাঠকের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়। আবার কোনো মানবীয় অনুভূতি যেমন প্রেম, ভালোবাসা, আকাক্সক্ষার গল্পগুলিও এমন একটি বা দুটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে ঘিরে আবর্তিত হতে পারে, যা চূড়ান্ত পরিণতিতে সেই আবেগ বা মূল্যবোধেরই স্ফূরণ ঘটায়। এক্ষেত্রে গল্পকার যদি বোদ্ধা হন, তবে অতো ভেবে বা নোটনির্ভর হয়ে গল্প লিখতে বসেন না। নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে যেটুকু নোট সংগ্রহ করা প্রয়োজন তা তিনি আগেভাগেই সেরে ফেলেন। কেননা গল্পটি লেখার সময় গল্পের চরিত্র, ঘটনা, আবেগের ওপর লেখক তাঁর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাঁর পূর্বপ্রস্তুতিটুকু কাজে লাগে।

হবু গল্পকারের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি অবশ্যই প্রয়োজন। গল্পকার যে মানুষটির অবয়ব তাঁর গল্পে চিত্রিত করতে চান, তিনি যদি একজন উচ্চবিত্ত গার্মেন্টস-শিল্পের মালিক হয়ে থাকেন, তাহলে এ-শিল্প সম্পর্কে তাঁর বিশদ জ্ঞান থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। এমনকি, শিল্পপতির সঙ্গে তাঁর প্রিয় কুকুরটির কেমন সম্পর্ক তাও নখদর্পণে থাকতে হয়। শিল্পপতির কথা বলার ধরন, আচার-আচরণ-খাওয়া-দাওয়া-বেশভূষা-বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়-স্বজন-ভালো লাগা-মন্দ লাগাসহ প্রতিটি বিষয় একজন গল্পকার জানেন। অর্থাৎ একজন শিল্পপতির শ্রেণি সম্পর্কে বিশদ ধারণা না রেখে গল্প লিখতে যাওয়া আর নিজের মাথার চুল ছেঁড়া সমান কথা। প্রতি পদে বানিয়ে গল্প বলার দোষে দুষ্ট হতে পারে উদ্দীষ্ট গল্পখানা। ধরা যাক, ফাইভ-স্টার হোটেল বা বড়লোকদের গড়া ক্লাব-কার্যক্রম সম্পর্কে লেখকের বিশদ কোনো ধারণা নেই বা শুটিং বা আর্চারি ক্রীড়া-নৈপুণ্য সম্পর্কে তেমন কিছু না জানা সত্ত্বেও লেখক ভাসা-ভাসা জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে গল্প লিখে ফেললেন, সেক্ষেত্রে পুরো চেষ্টাটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। এ-ধরনের অজ্ঞানতাপ্রসূত গল্প পাঠকের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পাঠক অতি সহজেই অনুধাবন করতে পারেন লেখকের অভিজ্ঞতার দৈন্যদশা। ভার্সিটির প্রেমিক যুগল কফিশপে গিয়ে যদি ক্লাসের পাঠ নিয়ে আলাপ জুড়ে দেয় তো তা হবে এক অবিশ^স্ত গল্পের নমুনা। বোদ্ধা পাঠকের নিকট জীবনবোধরহিত এসব গল্প হবে হাস্যকর ও পীড়াদায়ক এক অভিজ্ঞতা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘রাণু ও ভানু’ গল্পটি লিখতে পারতেন না যদি তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ ভাগে ঘটে যাওয়া সম্পর্কটির শুলুকসন্ধান না করতেন। এখানে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নয়, প্রখর জীবনবোধ ও পড়াশোনা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এরকম সার্থক উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে আরো একখানা রয়েছে আর সেটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেলায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কখনো আফ্রিকার জঙ্গলে বেড়াতে যাননি; তবু আফ্রিকা নিয়ে কিশোরদের জন্য লিখেছিলেন এক চমৎকার অভিযানের গল্প (উপন্যাস) চাঁদের পাহাড়; এটি এমন এক রোমাঞ্চকর গল্প যে, এর আবেদন এখনো যে-কোনো কিশোরকে শিহরিত করতে পারে। এটি সম্ভব হয়েছে লেখকের আফ্রিকা সংক্রান্ত গভীর পড়াশোনা এবং জঙ্গলবিষয়ক বাস্তব জ্ঞানের কারণে। অতএব প্রত্যক্ষ জ্ঞান থাকলেই যে গল্পকার ভালো একটি গল্প লিখে ফেলবেন তা নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরোক্ষ অভিজ্ঞতাটুকুুও বড় গল্পের জন্ম দিতে পারে। অনেক অভিজ্ঞ লেখক মনে করেন – কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়তো দৈনিক পত্রিকার গল্প জন্ম দিতে পারে কিন্তু সাহিত্যের গল্প হতে হলে সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে নানাবিধ দার্শনিক, কাল্পনিক ও বাস্তবিক জীবনবোধের জারক রসে জারিত না হলে চলে না। কারণ গল্প কোনো প্রত্যক্ষ ঘটনার ছবি নয়, এ হচ্ছে প্রত্যক্ষ ঘটনার আদলে লেখকের জীবনবোধ ও দর্শনের বহিঃপ্রকাশ।

তবে যে ভাষাটিকে আশ্রয় করে একটি গল্প-কাঠামো তৈরি হয়, গল্পকারের এর ওপর দখল থাকা বাঞ্ছনীয় নয় শুধু, অপরিহার্য। বানান রীতি, বাক্যগঠন, শব্দের নানাবিধ ব্যবহার সম্পর্কে যেমন ধারণা থাকা উচিত তেমনি লক্ষ রাখা দরকার উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের মার্জিত ও সংযমী ব্যবহারের দিকে। গল্পের বাক্যবিন্যাস এ-যুগে এসে অহেতুক জটিল করার কোনো মানে হয় না। শব্দের ব্যবহারে ওজস্বী না হয়ে শ্রুতি-মাধুর্যের দিকে চোখ রাখলে গল্পকার সহজেই পাঠকের মনের কাছাকাছি চলে যেতে পারেন। ‘দীরং’ শব্দটি ব্যবহার করে হুমায়ূন আহমেদ যে আবহ তৈরি করেছিলেন তা কিছুতেই বিলম্ব দিয়ে সেই জায়গাটুকু দখল করা সম্ভব নয়। কারণ গল্পকার শব্দ ও বাক্য তৈরি করেন, ধার নেন না। তিনি তাঁর গল্প ও চরিত্রের প্রয়োজনে বাক্যগুলিকে সাজিয়ে থাকেন, শব্দকে ব্যবহার করেন চতুরালির সঙ্গে, যাতে দ্রুত গল্পকারের চরিত্রটি পাঠকের মনোজগতে উন্মোচিত হয়। তাই ভাষা ব্যবহারে শুধু গল্পকার নন, কোনো সৃজনশীল মানুষেরই অ্যাকাডেমিকদের মতো অনমনীয় মনোভাব বজায় রাখলে চলে না। তাঁরা মূল ভাষা-প্রকরণটি বুঝে-শুনে তারপর নিজের ইচ্ছানুযায়ী তা ব্যবহার করে থাকেন। এর সবচাইতে বড় উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নানাভাবে বাক্য ও শব্দকে নিজের মতো করে তৈরি করেছেন, যা বুদ্ধদেব বসুদের হাত ধরে বর্তমান চেহারায় এসে দাঁড়িয়েছে। হার্ট অব ডার্কনেস বা লর্ড জিম খ্যাত জোসেফ কনরাড ছিলেন একজন পোলিশ এবং বিশ বছর পর্যন্ত ইংরেজি ভাষার ‘অ-আ’ও জানতেন না। কিন্তু ইংরেজি ভাষাটি জানার পর তিনি কতটা বিখ্যাত হলেন তা সবারই জানা। এই ধরাতলে এমন কোনো ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ্যসূচি নেই যেখানে এই জোসেফ কনরাড পাঠ্য নয়। তাই ভাষার মালিকানা নিয়ে যাঁরা মাথা গরম করেন তাঁরা আর যাই হোক খুব বড় গল্পকার হতে পারেন কি না সে-বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থাকে। একজন গল্পকার তাঁর গল্পটি বলার জন্য একটি সুসংগঠিত আবেগের ভেলায় উঠে বসেন। তারপর সেটি চালিয়ে নিয়ে চলেন নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর দিকে। এই যাত্রাপথে যাদের সঙ্গে দেখা হয় তাদের স্বাভাবিক জীবনধারাকে রূপায়িত করতে গিয়ে নানাবিধ সরঞ্জামের প্রয়োজন পড়ে, এদের ভেতর ভাষা একটি। কারো ভাষাটি একেবারেই ব্যাকরণসম্মত কিন্তু চরিত্রগুলি নিষ্প্রাণ – হাসেও না, কথাও বলে না, নড়াচড়াও যেন বন্ধ। আবার কথা বললেও চৈতন্যের প্রগাঢ় স্পর্শ থাকে না। সেলিনা হোসেনের ‘আমিনা ও মদিনা’র গল্প পাঠ করার সময় কোনো পাঠক লেখকের ভাষার অনবদ্য সৌকর্যের দিকে যতোটুকু নজর দেন, সম্ভবত তার চেয়ে বেশি আপ্লুত বোধ করেন পাক হায়েনা কর্তৃক ধর্ষিত হতে গিয়ে এই দুই নারীর যে মনোবেদনা স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়, তাকে ঘিরে। হুমায়ূন আহমেদের ‘চোখ’ গল্পে কাঁটা দিয়ে এক চোরের চোখ তোলার গল্পটি মর্মন্তুদ ও নাটকীয়তার স্বাক্ষর বহন করে, তা শুধু ভাষাগত নির্ভুল প্রয়োগ ঘটিয়ে তৈরি করা কি সম্ভব? শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘বন্দুকবাজ’ গল্পটি যেভাবে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে পাঠককে তা কেবল ভাষার পারঙ্গমতা দিয়ে অর্জন করা যায়? মোদ্দাকথা, গল্পকথন এমন এক সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত কলা যা শুধু নিয়মিত চর্চা দ্বারা অর্জন করা কঠিন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য।

হবু গল্পকারকে তাই আগেভাগেই জানতে হবে তিনি ভালো কথক কি না। কেউ আছেন নিজের বানানো গল্পটাও বন্ধুবান্ধবের ভেতর চালিয়ে দিতে পারেন নির্দ্বিধায়, অথচ সত্যিকার গল্পটাও কেউ মজা করে, সরস করে সবাইকে বলতে পারেন না। বলতে গেলেই শ্রোতা অন্য কথায় সরে যান কিংবা হাই তোলেন প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে। এই যে মজা করে গল্প বলার ক্ষমতা, এটাই গল্পের শুরু। এর রকমফের রয়েছে, কিন্তু মূল সুর একটাই।

আমাদের হবু গল্পকারও গল্প বলার চেষ্টা চালিয়ে চলেছেন সুস্মিতাকে নিয়ে। পারবেন কি না তিনি নিজেও

জানেন না। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)