মায়া

আনোয়ারা সৈয়দ হক

লোকটার নাম বুড়ো আর মহিলার নাম বুড়ি। বয়সেও তারা বর্তমানে বুড়ো ও বুড়ি। একজনের বয়স পঁচাত্তর, আরেকজনের সত্তর। জাগতিক জীবনের সব কাজ মোটামুটি তাদের সারা হলেও তাদের মনে কোনো স্বস্তি নেই। সেই হিসাবে শান্তিরও কিছু অভাব। এর প্রতিফলন ঘটে ভোরবেলায়। যখন তারা দুজনে নামাজ পড়ার জন্যে ভোরে বিছানা ছাড়ে। নামাজ পড়া তো একটু পরেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তাদের তখন শুরু হয়ে যায় বচসা। অথচ বাড়ির অন্য সকলে ভোরের নামাজ পড়া শেষ হবার পরে আরেকটু গড়িয়ে নেয় বিছানায়। কিন্তু এই বুড়ো-বুড়ির চোখে ঘুম নেই। একবার সেই ভোরে নামাজ

পড়ার জন্যে ঘুম ভাঙলো কি সেই ঘুম আবার তাদের  আসবে দিনশেষের রাতে।

সুতরাং ভোরে ঘুম ভেঙে নামাজ সেরে তারা বুড়ো-বুড়ি সংসারের খুঁটিনাটি নিয়ে তর্ক করতে থাকে। তবে সব বিষয় ছেড়ে এখন যে মূল বিষয়টা নিয়ে তারা তর্ক করে সেটা হলো তাদের জমি ও ঘরবাড়ি। বুড়ো-বুড়ি আধুনিক যুগের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে বসবাস করে। তাদের ছেলেমেয়েরা সব বড় হয়ে লেখাপড়া শেষ করে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে। বছরে-দুবছরে বাবা-মায়ের কাছে তারা আসে। মেয়ে থাকে আমেরিকার এক প্রান্তে, ছেলে আরেক প্রান্তে। দুই ভাইবোনের ভেতরে         মিল-মহববত থাকলেও জায়গার দূরত্ব ধীরে ধীরে ছাপ ফেলতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। তাই আগের মতো ভাইবোনের অতটা দেখা-সাক্ষাৎ নেই, তবে মোবাইলে সর্বক্ষণই কথাবার্তা হচ্ছে। বাবা-মায়ের সঙ্গেও কথাবার্তা হচ্ছে। তার ভেতরে বেশিরভাগ কথা হলো, বাবা-মাকে দেশের সহায়-সম্পত্তি বিক্রিবাটা করে বাংলাদেশ ছেড়ে তাদের কাছে চলে যেতে বলা। কারণ তারা আর পোড়ার মাতৃভূমিতে ফিরে আসবে না। কারণ এদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই!

ভবিষ্যৎ যে নেই তা বুড়ো-বুড়িও জানে, কিন্তু তাই বলে দেশের সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে বা বিক্রি করে চলে যাওয়া এটা বুড়ো মনে মনে নিলেও বুড়ি কেন জানি মানতে পারে না। বুড়ো মাঝে মাঝে বুড়িকে বলে, বুঝলি বুড়ি, তুই যদি এখন ভালোয় ভালোয় সম্পত্তি বিক্রি করে না দিস, হঠাৎ করে মরে গেলে কিন্তু তোর সব সম্পত্তি ভাইবোনেরা লুটেপুটে খাবে!

ভাগ্যের ফেরে বুড়োর চেয়ে বুড়ির সম্পত্তির পরিমাণ বেশি।  এবং তার ভাইবোনের সংখ্যাও বেশি। তবে তারা নিজেদের যা কিছু আছে তাই নিয়েই খুশি। বুড়ো এদিকে তার চাকরি জীবনে যত কিছু সম্পত্তির অধিকারী হয়েছে সব তার বুড়ির নামে করেছে। এদিক থেকে বুড়ি ভাগ্যবান, বলতেই হবে।

কিন্তু এখন এই বয়সে সম্পত্তি হয়েছে তাদের মাথাব্যথার কারণ। এসব তারা মরে গেলে দেখবে কে? নিজের        আত্মীয়-স্বজন না হলেও বাইরের মানুষজনই তো লুটেপুটে খাবে। বাসাবাড়ি থেকে ভাড়াটিয়া তোলাও মুশকিল হয়ে যাবে। হয়তো ভাড়া না দিয়েই মাসের মাস থেকে যাবে। তাছাড়া   বুড়ো-বুড়ির কোনো একজন মারা গেলে একা বুড়ো বা বুড়ি বেঁচে থাকলে তারা কি সব সামাল দিতে পারবে? বুড়ো-বুড়ির ছেলেমেয়ে তো বলেই দিয়েছে ঝামেলা সব মিটিয়ে ফেলতে! যা কিছু সম্পত্তি বাংলাদেশে আছে সব বিক্রি করে দিয়ে শুধু মোহাম্মদপুরের ফ্ল্যাটগুলো রেখে দিতে। কারণ রাজধানীতে একটা আশ্রয় দরকার। পরে কোনো এক সময় এগুলোও বিক্রি করে দেবে তারা। তবে হয়তো বাবা-মা বেঁচে থাকাকালীন বিক্রি করবে না। একটা চক্ষুলজ্জা আছে। তাছাড়া মোহাম্মদপুরের এই জমি কিনতে বুড়োর তিন হাত জিভ বেরিয়ে পড়েছিল। বাড়ি তৈরি করার সময় হাউস বিল্ডিং লোন নিতে হয়েছিল। সেই লোনও সব শোধ করতে হয়েছিল। সেসব বড় কষ্টের দিন ছিল  বৈকি। তবু ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এতসব কষ্ট করেছিল তারা। এখন কেন জানি বুড়োর মনে হয় এতসব কষ্ট না করলেও চলত। জীবনের শুরুতেই ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেদের দাম্পত্য জীবনকে যেন বঞ্চিত না করাই উচিত ছিল।

কিন্তু সেসব এখন হাত ফসকে অনেক দূর চলে গেছে। এখন গতস্য শোচনা নাস্তি।

তবে সব সমস্যার সমাধান এখন হয়ে গেছে। এখন শুধু নির্মলভাবে দিনযাপন। কিন্তু সেটাও কি হয় উঠছে আজকাল?

ছেলেমেয়েরা তো তাদের যা কিছু আছে তাই নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আমেরিকায় তার মেয়ের দু-দুটো বাড়ি। একটা ফ্ল্যাটও আছে নিউইয়র্কে। জামাই-মেয়ে দুজনেই চাকরি করে। সন্তান মাত্র একটি। ছেলেটির বউ চাকরি না করলেও বুড়ো-বুড়ির ছেলে ম্যাসাচুসেটসে খুব ভালো একটা চাকরি করে। তাদেরও নিজের বাড়িঘর হয়ে গেছে। তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক যা কিছু হতে হয় সবকিছু মোটামুটি হয়ে গেছে। মোটকথা, আর্থিক অসচ্ছলতা ছেলেমেয়ে কারোরই নেই।

অবশ্য অর্থ জীবনে কার না প্রয়োজন? কিন্তু তারও তো একটা সীমা আছে। তাছাড়া বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কিছু শারীরিক ক্লান্তিও আছে। সুতরাং এ-বয়সে মানুষ একটু শান্তি চায়। ছেলেমেয়ের কাছে কাছে জীবন কাটাতে চায়। ছেলেমেয়ে অবশ্য বুদ্ধি করে তাদের বাবা-মায়ের গ্রিন কার্ড করে ফেলেছে। সেই হিসাবে বুড়ো-বুড়ি আমেরিকা গেলে দিব্যি ভালোভাবে থাকতে পারবে। বয়সজনিত কারণে সরকারি ভাতাও পাবে দুজনে। তার পরিমাণও কম নয়।

কিন্তু বুড়ি তার ছেলেমেয়ের কাছে চলে যাবে এ-কথা মুখে বললেও আসলে মন থেকে তার যাবার ইচ্ছে নেই। আমেরিকার মতো বিশাল এক দেশে যেখানে ওপরে মুখ তুললে আকাশের পরিমাণ এতই বেশি চোখে দেখা যায় যে, মনের ভেতরে কেমন যেন শূন্য লাগে, তখন তার মনে হয়, পৃথিবীর কোনো কিছুই যেন তার আয়ত্তের ভেতরে নেই। সবকিছু বিশাল দিগন্তহীন আকাশের গহবরে মিলিয়ে গেছে!

না, বুড়ির তখন আর বিদেশে থাকে ভালো লাগে না!

বরং এখানেই আত্মীয়-স্বজনদের ভেতরে সে আর বুড়ো থেকে যাবে বলে মনে মনে চিন্তা করছে ইদানীং। দেশ থেকে দূরসম্পর্কের কোনো একটা নাতি বা নাতনিকেও নিয়ে আসার চিন্তাভাবনা করছে। যদিও এসব চিন্তা সে বুড়োকে এখনো বলেনি।

আর বিদেশে সে যাবেই বা কী করে? তাদের দুজনেরই দেশে বাড়িঘর আছে না? মোহাম্মদপুরে নিজস্ব জমির ওপর চারটে ফ্ল্যাট আছে। দুই ছেলেমেয়ের জন্যে সমান ভাগ করা। সাভারে জমি আছে তিন বিঘা। সরকারি চাকরি করার সময় এই জমিটা বুড়ো কিনেছিল অনেক কষ্ট করে। সেখানে গরিব এক আত্মীয়কে বসানো হয়েছে জমি দেখভাল করার জন্যে। দেশের বাড়িতে বুড়ি নিজেই তারা বাবার কাছ থেকে বেশ বড় একটা জমি পেয়েছে। জমিটা খুলনা শহরের একেবারে মাঝখানে। তার দাম দিন দিনই বাড়ছে। সেই জমির ওপর বুড়ির ছোট ভাই এক ছুতোর মিস্ত্রিকে বসিয়েছে পাহারা দেবার জন্যে। ছুতোর মিস্ত্রির নাম সুবোধ। তারা স্বামী-স্ত্রী একটা ছেলে নিয়ে সেখানে থাকে। ভাড়াটাড়া কিচ্ছু দেয় না। আর দেবার প্রয়োজনও নেই।

এখন রোজ সকালে বুড়ো-বুড়ির ঝগড়া এই জমিজমা নিয়ে। বুড়ো বলে, শোন বুড়ি, যদি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন না হতে চাস তাহলে তোর দেশের জমিটা বিক্রি করে দে। ঢাকার ফ্ল্যাটগুলো শুধু রাখ।

তার কথা শুনে বুড়ি মুখ গম্ভীর করে বলে, তোমার দেশের জমিটা আগে বিক্রি করে দাও না কেন? শহরে হতো, তা না হয় কোনো কাজে দিত, গ্রামে তোমার জমি রেখে লাভ কী। সব তো তোমার ভাইবোনেরা লুটেপুটে খাচ্ছে।

বুড়ির কথা শুনে বুড়ো তিড়বিড় করে উঠে বলে, আমার ভাইয়েরা গরিব, যদি সেখানে ধান-তিসি-সরষে বুনে একটু সচ্ছল হয়, তোর তাতে হিংসে কেন রে?

বুড়ি তখন বিদ্রূপের হাসি হেসে বলে, ওহ্, নিজের বেলা অাঁটিশুঁটি, পরের বেলা চিমটি কাটি, তাই না গো? আমার ভাইবোনেরা বড়লোক বলে তারা বুঝি আর আমার জমিতে ফলফুলারি বুনতে পারবে না, না? তাহলে তোমার সাভারের তিন বিঘা জমি বিক্রি করে দাও? সবটাকা  ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখো আমাদের দুজনের নামে, সেটা তো একটা ভালো কাজ হয়।

বুড়ো এই কথায় রাগ করে বলে, তোর কপালে দুর্ভোগ আছে বুঝলি? দুশো মাইল দূরের জমি আগে বিক্রি না করে ঢাকা থেকে তিরিশ মাইল দূরের জমি আগে বিক্রি করবি। এমন গাধা আজকাল চোখে দেখা যায় না, বুঝলি। এই জমির দাম রাতারাতি বাড়ছে, তুই জানিস?

বুড়ি অভিমান করে বলে, জানি, জানি। আচ্ছা, তাহলে তাই সই, তুমি খুলনে যাও, গিয়ে দেখেশুনে বিক্রি করে দিয়ে আসো। আমি নাজমুলকে গত সপ্তাহেই বলে রেখেছি, বলেছি, নাজমুল, তোর দুলাভাইকে খুলনার জমিটা বিক্রি করে দিতে বলে দিয়েছি। কাগজপত্র সব সঙ্গে থাকবে। দরকার হলে দু-চারদিন থেকে আসবে। জমি বিক্রি করে দিয়ে তবে আসবে। নাজমুল বলেছে, কোনো সমস্যা নেই। এখন জমির দাম ভালো যাচ্ছে। জমিটা অনেকদিন ধরে পড়ে আছে বলে তার কাছে দু-চারজন এর ভেতরেই বলে রেখেছে, জমিটা তারা কিনতে চায়। তাছাড়া এখন নাকি খুলনার জমির দামও বেড়েছে। নানারকম দোকানপাট মাল্টিস্টোরি তৈরি শুরু হয়েছে।

বুড়ির কথা শুনে বুড়ো মহাখুশি। এই একটা ব্যাপার তাদের দাম্পত্য জীবনে বুড়ো খেয়াল করে দেখেছে যে, বুড়োর কোনো সিদ্ধান্ত বুড়ি নাকচ করতে পারে না। একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হলেও বুড়োর কথা সে শোনে। তবে বুড়িকে চেনে বলেই না বুড়ো সাহস করে তার উপার্জিত সব ধন-সম্পত্তি বুড়ির নামে করেছে! তাছাড়া বাস্তব এই যে, কোনোদিন তাদের দুজনের একজন এ-দুনিয়ার পাট চুকিয়ে পাড়ি দেবে অন্য দেশে তখন এইসব টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, জমিজমা বুড়োর বুকের ওপর চেপে বসবে! আর বুড়ো আগে মরে গেলে তো কথাই নেই! বুড়ি তখন দুচোখে অন্ধকার দেখবে। জীবনে কোনোদিন একা একটা ফরম পর্যন্ত বুড়ি ফিলআপ করতে পারে না, বুড়োর সাহায্য ছাড়া। অথচ এতগুলো সম্পত্তির মালিক! এই যে এতবার বিদেশ পাড়ি দিয়েছে, বুড়ি সর্বক্ষণ বুড়োর সঙ্গে, কখনো একা নয়, এমনকি প্লেনে ওঠার পর থেকে বুড়োর পায়ে পায়ে। বুড়ির শুধু ভয় বিদেশে সে হারিয়ে যাবে!

কথাটা যতবার ভাবে, বুড়ো মনে মনে হাসে। বলে, তার সঙ্গে বিয়ে যদি না হতো তাহলে এই বুড়ির অবস্থা হতো কী? আসলে তার সঙ্গে তো বুড়ির বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না। বুড়ির বাপের বাড়ি সমৃদ্ধশালী, আর বুড়ো সাধারণ ঘরের। শুধুমাত্র বুড়োর লেখাপড়া আর মেধা দেখেই না বুড়ির বাবা বাড়ির সকলের মত উপেক্ষা করে তার সঙ্গে বুড়িকে বিয়ে দিয়েছিল। আর ভাগ্যের কি পরিহাস, বিয়ের রাতে বুড়ো যখন তার স্ত্রীকে নাম জিজ্ঞেস করল, সে বলল, আমার নাম না জেনেই আপনি কী রকম আমারে বিয়ে করলেন, বলেন দিনি? বুড়ির মুখে সেদিন খুলনার ভাষা শুনে বুড়ো খুব মজা পেয়েছিল।

পরে বুড়ি একটু হেসে বলেছিল, আপনার নাম যে বুড়ো, এডা তো আমি আগেই জানি। আর তাতিই না আমি এ-বিয়েতে আপত্তি করিনি!

কী রকম? বুড়ো তার সদ্য বিয়ে করা বউয়ের মুখে এরকম কথা শুনে অবাক।

বুড়ি বলেছিল, আপনার ডাক নাম বুড়ো। আর আমার ডাক নাম হলো গে বুড়ি। মা বলল, বুঝলিরে বুড়ি, বিয়েডা হলো গে আল্লার রহমত। তা না হলি তোর নাম বুড়ি আর ওর নাম বুড়ো হলো ক্যামোন কইরে? তখন আমি ভাবিলাম, তাই তো, কথাডা তো সত্যিই!

তো সেই তার জীবনের শুরু বুড়িকে সঙ্গে করে। আজ প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর তাদের বিয়ের বয়স। কম সময় তো নয়। এর ভেতরে জীবন ও জগতে কত ঘটনা, কত দুর্ঘটনা, কত বিপর্যয়, কত জয়।

 

বুড়ি সম্মতি দিতে বুড়ো দুদিন বাদে রওনা দিলো প্লেনে চড়ে যশোরের দিকে। যশোর এয়ারপোর্টে তার মেজ শ্যালক গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। মেজ শ্যালকের বয়স হয়েছে। তার ছেলেমেয়েরাও বড় বড়। কেউ দেশে, কেউ বিদেশে লেখাপড়া করছে। মেজ শ্যালক অনেকদিন বাদে দুলাভাইকে দেখে ঠাট্টা করে বলল, হঠাৎ করে আমাগের মনে পড়ল নাকি, দুলাভাই? বুনিরে আনলেন না ক্যান?

বুড়ো গম্ভীর হয়ে বলল, জামাই যখন ইচ্ছে তখনই শ্বশুরবাড়ি যাবে, তার জন্যে বলে-কয়ে আসতে হবে নাকি? মনে নেই, আমার শাশুড়ি মা মরে যাওয়ার আগে বলেছিলেন, তুমি এ-বাড়ির জামাই না বাবা, তুমি আমার সবচেয়ে বড় ছেলে। তোমার যখন মন চায় চলে আসবা। কারো কথায় কান দিবা না। তো?

মেজ শ্যালক দুলাভাইয়ের কথা শুনে মুচকি হেসে বলল, কেন আসিছেন তা তো আমি জানি। আপনার শাশুড়ির দেওয়া জমি বিক্রি করে দিতি। তা দেন, আমি ক্রেতা ঠিক করে রাখিছি, আমাগের চাচাতো ভাই। এখন বিদেশে আছে। ইচ্ছে আছে দেশে ফিরে আমাগের কাছাকাছি থাকবে। দামও ভালো পাবেন।

তাই নাকি? বুড়ো তার কথা শুনে মহাখুশি। বলল, তাহলে তো ঝামেলা মিটে গেল। তুমি তো দেখি খুব ত্বরিতকর্মা, শালা।

খুলনায় ফিরে আসতে ঘণ্টা দেড়েক লাগল। শ্বশুরবাড়ির মানুষজনও তার প্রতীক্ষায় ছিল। বড় শালার স্ত্রী ঠাট্টা করে বলল, আমাগের ছেড়ে-ছুড়ে আমেরিকায় চলে যাবেন শুনতি পাইলাম, দুলাভাই। ক্যান, এই দেশে থাকতি আপনাগের অসুবিধে কী? বিদেশে ছেলেমেয়ের কাছে গেলি তারা কি আপনাগের দেখতি সুময় পাবেনে? শুনি ওই দেশে মানুষগের কাম করতি করতি সংসারের কোনো হুঁশজ্ঞান থাকে না!

তোমারে এইসব ফালতু কথা কে বলেছে? বুড়ো রাগ করে বলে ওঠে।

বড় শালার বউ ঠোঁট উল্টে বলে, আমি জানি তো সব। আমার বাপের বাড়ির অনেকে ওপি ভিসায় সে-দেশে গেছে না?

স্ত্রীর কথা শুনে বড় শালা চোখ রাঙিয়ে তাকে ধমক দেয়। বলে, তুমারে এইসব ফজুল কথা কিডা বলিছে? তুমার ছেলেও কি এদেশে থাকপেনে ভাবিছো? সেও দেখগে কানাডায় যাওয়ার জন্যি ঝুল ধরিছে। রাত-দিন এখানে দরখাস্ত, ওখেনে দরখাস্ত। দেশে এত রকমের কাজকাম, কিন্তু কোনোদিকে তার মন নেই।

বড় শালার কথা শুনে মন একটু ঠান্ডা হলো বুড়োর। হেসে বলল, শোনো, এখন এমন এক যুগ চলছে যে, দেশে কেউ থাকতে চায় না। দেশের রাজনীতি অস্থির, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি মন্দা, সামাজিকভাবেও নানা ধরনের উৎপাত, জনজীবনে গভীর সব সংকট, সন্ত্রাস-রাহাজানির কথা আর নাইবা বললাম। তবে আমরা এদেশ ছেড়ে ওভাবে তো আর যাব না। ছেলেমেয়ের জন্যেই যেতে হচ্ছে। তবে সত্যি বলতে, ছেলেমেয়েদের জন্যে যতটা, তার চেয়েও বেশি নাতি-নাতনির জন্যে। এ যে কী এক টান, তা তোমরা বুঝতে পারবে না। আগে তোমাদের        নাতি-নাতনি হোক, তখন দুলাভাইয়ের কথা বুঝতে পারবে।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মেজ শ্যালক বলল, দুলাভাই, এখন একটু বিশ্রাম নেন, বিকেলের দিকে জমি দেখতে যাবেন। সেখানে এক ছুতোর মিস্ত্রিকে থাকতে দিয়েছি। নাম সুবল। সে তার বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে। গরিব মানুষ। আমাদের বাড়িঘরের কাজকাম করে।  তো ঠিক আছে, থাক না। অন্যমনস্ক হয়ে বলল বুড়ো।

এরপর কিছু কথাবার্তা বলে বিশ্রামে গেল বুড়ো। তারপর পড়ন্ত বিকেলে ঘুম থেকে উঠে চা পান করার সময় দেখল গাড়ি দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

মেজ শালা বলল, চলেন আপনাকে জমিটা শেষবারের মতন দেখিয়ে আনি। সবচেয়ে সরেস জমিটা মা আমাদের বুবুকে দিয়েছিলেন। বুবু তার প্রথম সন্তান ছিলেন তো।

সে-প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বুড়ো তার মেজ শালার সঙ্গে রওনা দিলো। দশ মিনিট গাড়ি না চলতেই জমির কাছে এসে দাঁড়ালো গাড়ি। কিন্তু সরাসরি জমির ওপর নয়। গাড়ি যাবার রাস্তা নয় বলে গাড়িটা রাখতে হলো বড় রাস্তার মোড়ে। আর জমিটাও একটু ভেতরের দিকে। কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। একটা পড়ো মাঠ পার হয়ে তারা দুজনে জমির সামনে এসে দাঁড়াল। জমিটা অনেকদিন আগেই পাচিল তুলে ঘিরে ফেলা হয়েছে বুড়ির নির্দেশে। অন্য ভাইবোনদেরও কারো কারো জমি ঘেরাও করে ফেলা হয়েছে, কারো বা পড়ে আছে খোলামেলা। এইখানে বুড়ি আর তার সব ভাইবোনের জমি আছে। একটার সঙ্গে আরেকটা জমি গা মিশিয়ে আছে। যেন তারাও ভাইবোন।

মেজ শ্যালকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বুড়ো জমির সামনে এসে দাঁড়াল। দেখার অবশ্য কিছু নেই। একটা জংধরা টিনের গেট করা হয়েছে। তার ভেতরে জমিটা। টিনের গেট খোলার সময় ক্যাঁচ করে শব্দ হলো। আর সেই শব্দ শুনে সুবলের বউ বেরিয়ে এলো। সে আবার গর্ভবতী। তা তার শরীরের দিকে একপলক তাকিয়েই বুঝতে পারল বুড়ো। আর বুঝে তার চোখ ফিরিয়ে নিল। আর চোখ ফিরিয়ে সে জমিটার দিকে তাকাল। খুব বড় জমি না, বড়জোর পাঁচ কাঠার মতো হবে। কিন্তু জমির দিকে তাকিয়ে যেন হতভম্ব হয়ে গেল সে। সেই কতকাল আগে একটা ন্যাড়া রুক্ষ খেত দেখেছিল এখানে সে। সেই বিশ বছর আগে জমি ভাগাভাগি হবার সময়। আর এতদিন বাদে আবার। জমিতে অসংখ্য গাছ লাগানো হয়েছে। ফুল ও ফলের সব গাছ। সারি সারি পেঁপে গাছে পেঁপে ধরে আছে। আরেক সারি গাছে কলার সবুজ কাঁদি। একটু দূরে দুটো আমগাছ। আমগাছে বোল এসেছে। মাচার ওপরে লাউগাছে ঝুলে আছে ছোট ছোট সব লাউ।  আরেকটা মাচায় হলুদ কুমড়ো ফুলের সারি। একটা ছোট্ট বেগুন খেতে ছোট ছোট শাদা গোল বেগুন। একঝাঁক মরিচের গাছে ঝুলে আছে সবুজ কাঁচামরিচ। গেটের দুপাশে হলুদ করবী। কিছু ফুল মাটিতে পড়ে আছে আপন মনে। বাতাসে দুলছে মৃদু মৃদু। সবুজ ঘাসে পুরোটা জমি আবৃত। জমির দূরপ্রান্তে ছোট্ট একটা খড়ের দোচালা, যেখানে কাঠমিস্ত্রি সুবল তার পরিবার নিয়ে বাস করে। দোচালার বাইরেই সন্ধ্যামালতির ঝোপ। বেগুনি ফুলগুলো পাতা মুড়ে বসে ছিল এতক্ষণ। এখন ধীরে ধীরে তাদের পাতাগুলো খুলে যাচ্ছে। শসা ঝুলে আছে তার পাশের একটা মাচায়।

সুবলের বউ তো বুড়োকে দেখে অবাক। আগেই সে জানত এই হচ্ছে তার ঢাকায় বসবাস করা এক ফুপুর স্বামী। বড় ফুপু। ফুপুর মেজভাই, তার পাতানো মেজ মামা আগেই তাকে বলে রেখেছিল যে, ফুপুর স্বামী যে-কোনোদিন জমি দেখতে আসবে।

বুড়োকে দেখে সুবলের বউ হইচই করে উঠল। বড় ফুপা আসিছেন? ও মা গো, তা আমারে এট্টু আগের থে জানাবেন  না, মেজ মামা? অনুযোগ করে বলে উঠল সুবলের বউ।

বুড়োর মেজ শালা ধমক দিয়ে উঠে বলল, তো তোরে আগে জানালি তুই কী করতিস?

বারে, আগে জানালি, আমি ফুপার ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্যি সব শাক-সবজি গুছায়ে রাখতাম। কালকেই তো গাছের বড় বাগুনগুলোন কেইটে নলা মাছের ঝোল কইরে ফেললাম! তো ফুপার ঢাকায় ফিরার দিন আবার সব কেইটে দিস। বলে উঠল মেজ শ্যালক।

তা দিবানে, এখুন ঘরে চলেন ফুপা, আপনারে চিনির শরবত করে দিই।

তার কথা শুনে বুড়ো হাত উঠিয়ে তাকে নিরন্ত করে বলল,  তুমুর বড় ফুপু, খুব কুমড়ো ফুলের বড়া খেতে ভালোবাসে। সামনের শনিবার আমি যেদিন ঢাকায় ফিরব, তুমি কিছু কুমড়ো ফুল দিয়ে দেবে আমার সঙ্গে। আমি প্লেনে করে নিয়ে যাব।

বুড়োর কথা শুনে সুবলের বউ হেসে কুটিকুটি। বুড়োর মেজ শ্যালকের দিকে তাকিয়ে বলল, ও মেজে মামা, বড় ফুপা কয় কী? শুধু কি কুমড়োর ফুল? এই লাউ, পেঁপে, বাগুন  আর কলার কাঁদি কুথায় যাবেনে? সব আমি ছালায় ভইরে ভালো করে মুখ বেন্ধে দিবানে ঢাকায় নিবার জন্যি। একবার প্লেনে উঠোলিই তো ভস্ কইরে ঢাকায়! কচি লাউশাকও দিয়ে দেবানে সঙ্গে। কুচো চিংড়ি দিয়ে খাতি খুব মজা লাগবেনে ফুপুর। নিজির জমিতে লাগানো লাউশাক, একি চাট্টিখানি কথা? ও বড় ফুপা, একবার বড় ফুপুরে চোখে দেখতি পাবো না? এইবার সঙ্গে করে আনলিই তো হয়ে যেত!

 

জমি দেখে ফেরার পথে মেজ শ্যালক বলল, এই জমিটা আমাগের চাচাত ভাই কিনে নেবেনে। তার স্ত্রীর নামে কেনবে। সে তো নিজে আসতি পারবে না নে এখন। আপনি সব কথাবার্তা পাকা করে যান, তারপর একদিন বুবুরে একবেলার জন্যি খুলনেয় নিয়ে আলিই হবে। কোর্ট খুলুলিই আমি সবকিছু ঠিকঠাক করে জানাবোনে আপনাদের।

আচ্ছা, বলে ঘাড় নাড়লো বুড়ো।

 

তিনদিনের মাথায় বুড়ো ফিলে এলো ঢাকায়। বুড়ি অভিযোগ করে বলল, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আমাকে ভুলে গেলে একেবারে, নাকি? একটা টেলিফোন পর্যন্ত করার নাম নেই!

বুড়ো বলল, ভালো ছিলাম বলেই তো করিনি। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কেউ কি খারাপ থাকে?

বুড়ি তির্যক দৃষ্টি ফেলে বলল, তাই তো মনে হচ্ছে। যাই হোক কাজ সব সেরে আসতে পেরেছো তো? আমি খুলনায় যাবো কবে? আমাকে তো দলিলে সাইন করতে হবে।

তা হবে। তবে –

কথা বলতে গিয়ে বুড়ো থেমে গেল। তারপর ঘরের ভেতরে একটা সোফায়               বসে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি অনেকদিন বাপের বাড়ি যাওনি। একবার গেলে হতো না?

বুড়োর মুখে এ-কথা শুনে যেন চমকে গেল বুড়ি। আগে বাপের বাড়িতে যেতে চাইলেই বুড়ো গাঁইগুঁই করত। যেমন অধিকাংশ স্বামী করে। আর আজ নিজেই সেধে বউকে বাপের বাড়ি যেতে বলছে। যখন বাপের বাড়িতে যেতে বুড়ির কোনো উৎসাহ নেই। এখন বয়স হয়েছে না? এখন তার মন পড়ে থাকে বিদেশের নাতি-নাতনির দিকে। বাড়ির টান কমে গেছে।

উত্তরে বুড়ি বলল, যেতে তো হবেই। যেদিন জমিটা বিক্রি করে দেবো, সেদিন তো যাবোই। ইচ্ছে হলে দু-চারদিন থেকেও আসবো। তা কত টাকায় সব ঠিক করেছো, কিছু তো এ-সম্পর্কে বলছো না। আমি কিন্তু সস্তায় জমি ছাড়বো না, তা আগে থেকে বলে দিলাম!

দাঁড়াও, বলছি। বুড়ো পানির গেলাস উপুড় করে পানি খেয়ে বসল।

তারপর বুড়ির চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে কিছুটা যেন ভয়ে ভয়ে বলে উঠল, বুড়ি, আমি জমি বিক্রি করতে পারিনি!

তার মানে?

বুড়ি রেগে গেল স্বামীর কথা শুনে।

আগে আমার কথা শোন, তারপর রাগ করিস। বুড়ো বলল।

কী তোমার কথা, শুনি?

বুড়ো বলল, বুড়ি রে, তুই যে জমি দেখিলি দশ বচ্ছর আগে, সে জমি দেখে তুই এখন আর চিনতি পারবি না নে!

বুড়ো যেন নিজের অজান্তেই বুড়ির দেশের মুখের বুলি তুলে নিল। বুড়ো তারপর বলল, এই জমির উপরে পা রাখলিই মনের ভেতরে য্যান শান্তি জড়ো হয়ে আসে। আমের গাছে বোল ধরিছে। গেটের দুপাশে হলুদ টগর ঝুইলে আছে। সবুজ ঘাস পায়ের নিচে। প্রজাপতিগুলোন একবার এখানে উড়ে এইসে  বসে, একবার ওখানে। তখন আর কিছু না শুধু জমির দিকে তাকায়ে থাকতি ইচ্ছে করে! বুড়ি রে, এত সুন্দর জমি কী করে বেচি, বলদিনি তুই? হলোই বা জমি তোর! কিন্তু আমিও তো ওই বাড়িরই জামাই। ছালা খুলে দ্যাখ রে বুড়ি, কত রকমের তরিতরকারি ভরে             দিয়েছে সুবলের বউ। তরতাজা কুমড়ো ফুল, লাউয়ের ডগা, কচি শসা, যা সব তুই ভালোবাসিস, এ-স-ব তোর জমিতে হয়েছে। সুবলের বউ বলেছে, বড় ফুপুরে সঙ্গে করে আনবেন এবার বড় ফুপা, তালি তারে আমি কচি বাগুন দিয়ে পুঁটি মাছের ঝোল রান্না করে খাওয়াবোনে! কত স্বাদ তখন বুঝতি              পারবেন নে।

তো আমি তারে কথা দিয়ে আসিছি তোরে নিয়ে শিগগির আবার যাবো।

বুড়ি তার বুড়োর মুখের দিকে এবার হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুড়ির মুখ ক্রমশ ভরে উঠে হাসিতে। কুঞ্চিত মুখে হাসিটা যেন ক্রমে ভাঙচুর হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মুখ ছাড়িয়ে বাইরে। বাইরের বাতাসে, ঘরের জানালায়, দরজার কপাটে, টেলিভিশনের পর্দায় যেন ছড়িয়ে পড়ে নকল দাঁতের সেই হাসি। বুড়ো আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগে বুড়ির মুখ।

বুড়ি হাসিতে মুখ ভরে নিয়ে বলে ওঠে, তুমি ঘরে ঢুকতিই তো তুমার চিহারা দেখে আমি বুঝে গিইলাম!