শান্তিপুর থেকে ইসমাইল এসেছে জন্মাষ্টমী মেলায় নবদ্বীপে।

‘এক হাজার একটা মন্দিরের শহর’ নামে খ্যাত শ্রী চৈতন্যদেবের আশ্রয় এই নবদ্বীপ। গুপ্তযুগে বাংলায় বৈষ্ণব-শৈব-শাক্ত

প্রভৃতি পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মমত প্রচলিত, বৈষ্ণব সহজিয়ারা তেত্রিশ কোটি দেবতায় বিশ্বাস করে না এবং প্রতিমা পুজোও করে না। শ্রী চৈতন্যদেবের অনুসারীরা একেশ্বরবাদী ধর্মের লোক অর্থাৎ বৈষ্ণব সহজিয়ারা এক ঈশ্বরের গুণকীর্তন করে। এই বৈষ্ণবধর্ম প্রবর্তক শচী-নন্দন নিমাই বা গৌরাঙ্গ হলেন চৈতন্যদেব।

জন্মাষ্টমীতে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের হাট বসে নবদ্বীপে। ভারতবর্ষের বৈষ্ণব মতাবলম্বীরা ভাদ্রের এই চিত্রা নক্ষত্রযুক্ত পূর্ণিমাকে সামনে রেখে এখানে এসে পুণ্য লাভ করে। পরম করুণাময়ীর বন্দনায় নবদ্বীপের মায়াপুরী মঠের চারধারে মেলা বা উৎসব জমে ওঠে।

ঘরছাড়া বাউল ডাকে, কে যাবি রে আয়/ নবদ্বীপে হাট বসেছে/ আছে যে নিমাই – বাউলের সেই ডাক শুনে কে না এসে পারে? সবাই ছুটে আসে দলে দলে নদীয়ার নবদ্বীপের এই গঙ্গাপাড়ে।

মায়াপুরী মঠকে ঘিরে প্রতিবছর বিশাল

আয়োজন হয়, মায়াপুরী নামেই যার পরিচয়। মায়া-মমতা আর ভালোবাসার স্নিগ্ধতায় গড়া এই মায়াপুরী। গেরুয়া থান পরে ভক্তরা একেশ্বরের আরাধনা করছে আধো চোখ বুঁজে, ঈশ্বর যেন মিশে যান ভক্তের জীবাত্মায়। পরমাত্মা আর জীবাত্মা কখন যে একাকার হয়ে সমস্ত মিথ্যা-লোভ-লালসাকে ভেঙে মিশে যায়। বিক্ষুব্ধ গঙ্গা স্তব্ধ হয়ে যায় সেই পরম ভালোবাসায়। ভালোবাসাও যে নিখুঁত আর সৌন্দর্যে ভরা হয়, তা মায়াপুরী মঠে না এলে অজানা রয়ে যায়।

ইসমাইল প্রতিবছর এ-মেলায় দোকান দেয়। পসরা সাজিয়ে বসে গঙ্গার কোলঘেঁষে বড় রাস্তার মুখোমুখি। শান্তিপুর থেকে আরো এসেছে নন্দলাল-কার্তিক পাল-ইনাম আলী-পরিমল বাগদী-ফকির জান। ইসমাইল শুধু কৃষ্ণনগরের মাটির খেলনা আর গণেশ-কালী-শিব-কৃষ্ণ প্রতিমা নিয়ে বসেছে দোকান খুলে। জমকালো দোকান না হলেও কৃষ্ণনগরের মাটির জিনিসের আলাদা একটা গৌরব আছে বইকি। ফুলিয়া থেকে নদের চাঁদের ছোট বেটা অনুপ চাঁদ এবার প্রথম এসেছে খই-মুড়ি-খাগড়ায়-গজা-বাতাসা-চিনির তৈরি হাতি-ঘোড়া-বানর-দেবদেবীসহ নানা রকমারি খাবার নিয়ে। ইসমাইলের বড় কষ্ট লাগে নদের চাঁদের জন্য। লোকটা গতবারই বলেছিল, আসছে বার আর হয়তো আসতে পারবো না রে বাপ –

ইসমাইল উত্তরে শুধু জানিয়েছিল, কেন গো কাকা, কোথাও বেড়াতে-টেড়াতে যাবে নাকি?

ঠোঁটে মলিন হাসি টেনে নদের চাঁদ জানায়, না রে বাপ, আর পারিনে, শরীর আর কতই বা চলবে, এবার বুঝি দেহত্যাগের সময় হলো!

ইসমাইল ভাবে, মানুষ কখনো-সখনো বড় বেশি রহস্যময় হয়ে ওঠে। ভবিষ্যতের কথা তখন বলে যেতে পারে কী চমৎকারভাবে। আজ নদের চাঁদ নেই, কিন্তু মানুষটার স্মৃতি আর ভালোবাসা ভুলে যাওয়ার জো নেই তার।

কালনার বনমালি লোকটা বেশ রঙের বলা যায়। এ-বয়সেও রস যেন উছলে পড়ছে। মুম্বাই-কলকাতার সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের বড় বড় ছবি কী সুন্দর করে চারদিকে বাঁশ পুঁতে তিনদিকে লম্বা দড়ি বেঁধে তাতে আটকে দিয়েছে খোলা আকাশের নিচে। আর সবুজ ঘাসের ওপর খেজুরের পাটি বিছিয়ে, তার ওপর পুরনো ছেঁড়া আলোয়ান পেতে, তাতে শিব-কালী-গণেশ-রাধাকৃষ্ণ জোড়া বাঁধানো ছবি, ধর্মপুস্তিকা, আরো কত কী নিয়ে বসেছে। বৃষ্টিও বড় দয়া করে লোকটাকে। সে আবার বলে, সবই ঠাকুরের আশীর্বাদ … ঠাকুরের আর্শীবাদ …

গুপ্তিপাড়ার মাধব মিষ্টির দোকান খুলে বসেছে, তিনদিকে দরমার বেড়া আর মাথার ওপর পুরনো টিনের চাল। জংধরা টিনে ছোট-ছোট ছিদ্র। শোকেসে সাজানো থরে থরে নানান পদের মিষ্টি। বলিহারি লোকটার ক্ষমতা। প্রতিবছর যত মেলা-উৎসব হবে, এই মানুষটা আসবেই আসবে। সেটা রাসোৎসব হোক, নবান্ন উৎসব বা চৈত্র সংক্রান্তি হোক, গাজন মেলা-দোলযাত্রা আর জন্মাষ্টমীই হোক অথবা অন্য যে-কোনো উৎসব হোক না কেন, এই মানুষটা নবদ্বীপে আসবেই। যেন বা ওর একটা নেশা ধরে গেছে এই নবদ্বীপের বাতাসে।

ইসমাইলকে লোকটা কিন্তু বেশ ভালোবাসে। মাধবের সঙ্গে গুপ্তিপাড়াতেই ইসমাইলের পরিচয়, ওখানে স্থায়ী একটা মিষ্টির দোকান আছে, স্টেশনের প্লাটফর্মের ধারে। ওর দু-ছেলে দোকানটা সামলায়। ইসমাইল তারকেশ্বরের দিকে কিছুদিন তাঁতের কাজ করেছে। সপ্তাহান্তে বাড়ি যেত গুপ্তিপাড়া দিয়ে। সে-সময়ই মাধবের সঙ্গে পরিচয়। লোকটার পেটমোটা কালো কুচকুচে চেহারার স্বাস্থ্য দেখলে বড্ড হাসি পেতো একসময় তার। কিন্তু মনটা অনেক বড়। শান্তিপুরে একবার কী একটা কাজে গিয়েছিল। ইসমাইলের সঙ্গে দেখা হয় তখন। ইসমাইল নাছোড়বান্দা, ধরে-বেঁধে বাড়ি নিয়ে এসে বেশ আপ্যায়ন করে। লোকটারও মন ইয়া বড়, যাওয়ার সময় আস্ত একটা একশ টাকার নোট দেয় ছেলেটার হাতে। তারপর আরো কবার এসেছিল তার বাড়ি। গাদাগাদা মিঠাই-মণ্ডা ছেলেটার জন্যে, জামা-কাপড় ছাড়াও টাকা দিয়ে গেছে সেলামি হিসেবে। ইসমাইলের সঙ্গে গাটবাঁধা একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় সেই থেকেই। এখনো কোনো ঝুট-ঝামেলা হলে তো ওই মাধবই ছাতার মতো মাথার ওপর এসে দাঁড়ায় তার।

ওদিকের সড়কের ধারে দরমার বেড়া দিয়ে কয়েকটা দোকান সারি সারি, রানাঘাট-বানপুর-নাদনঘাট-গেইদের দিককার লোকেরাই ওসব দোকানের মালিক। একটু বদরাগী স্বভাবের কেউ-কেউ, কথায়-কথায় খিস্তি-খেউড় জুড়ে দেয়। অনেকে আবার ঝগড়াও করে কদাচিৎ।

মাধব বলে, ও ব্যাটারা চাষা, উদ্বাস্তু রে, উদ্বাস্তু –

ইসমাইল প্রশ্ন করে, উদ্বাস্তু আবার কী জিনিস?

মাধব মাথায় হাত দিয়ে বলে ওঠে, আরে মরণ আমার, উদ্বাস্তু কী জানিস না রে বেয়াক্কেল! ওরা ওপার থেকে তাড়া খেয়ে এপারে এসেছে। এপারের মানুষদের বলে-কয়ে সহানুভূতি নিতে চায়। আসলে শালারা ধাপ্পাবাজ, মিনমিনে শয়তান একেকটা।

একটু খটকা লাগে ইসমাইলের মনে, তার মানে রিফিউজিদের উদ্বাস্তু বলে, শান্তিপুরে বাঙাল বলে এদের। এ-ব্যাটাদের অত্যাচার যেমন, খোঁচা মারা কথাও বেশ ঝাঁঝালো, ওপার থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে গুষ্টিবেঁধে এদিকে এসে সিনা ফুলিয়ে হাঁটে। বড় বড় কথাও বলে আবার। সে-বার এক বাঙালকে দুই ঘুসি মেরেই দিয়েছিল ইসমাইল। হারামজাদা বলে কি না গরু খাওয়া মেøচ্ছদের পাছায় লাথি মেরে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে। সতীশ মিত্ত বলেছিল, জানিস ইসমাইল, এসব উল্লুক মার্কা শয়তান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়ায়, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় টেনে এনে এসব জারজ চুলকে ঘা করার মতো আমাদের এতোকালের বন্ধুত্ব আর ভালোবাসায় ফাটল ধরাতে চায়।

ইসমাইল জানে, এরা ওপার থেকে আসা পঙ্গপাল। সুযোগ পেলেই সাবাড় করে দেবে ক্ষেতের ফসলের মতো সাজানো-গোছানো ঝলমলে এই সমাজটাকে। মাধবের কথা শুনে বাঙালদের সেই চোর-চোট্টা মার্কা ছবিগুলি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ইসমাইল এদের বেশ চেনে।

বনমালী বলে ওঠে, এসব খচ্চরের সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলতে হবে। মাধবের কথার সঙ্গে বনমালীর কথারও চমৎকার মিল দেখে ইসমাইলের হাসি পায়।

প্রমত্তা গঙ্গা কুলকুলিয়ে নাকি ধেই ধেই করে ধেয়ে যাচ্ছে কোন সুদূরে। মা গঙ্গাভক্ত সন্তানরা স্নান করছে এখন। দু-হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করে কেউ কেউ। মায়াপুরী মঠের সুউচ্চ মিনার দাঁড়িয়ে কেউ দেখছে নবদ্বীপ। এক হাজার একটা মন্দিরের শহর মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণধাম নবদ্বীপ। এই দেখার মধ্যে কোনো ফাঁক নেই। ভালোবাসা বুকে নিয়ে দেখছে সমগ্র পৃথিবী, দেখছে ভূপ্রকৃতি-মানুষ – মৌর্য-গুপ্ত-পাল-সেন যুগের অনেক নিদর্শন নদীয়া জেলার বিভিন্ন অংশে পাওয়া যায়। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের সঙ্গে আগন্তুক শাসককুল কর্তৃক প্রবর্তিত পশ্চিম এশীয় ধারার স্থাপত্যের সংমিশ্রণে বাংলায় চালা শৈলীর যে অভিনব ও সম্পূর্ণ স্থানীয় স্থাপত্যের উদ্ভব হয়, তার বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় এই নবদ্বীপে। শ্রীচৈতন্যদেব-কর্তৃক প্রচারিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে বঙ্গের সমাজজীবনে যে-আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব চালা স্থাপত্যেও অনুভূত হয়। লোকায়ত ভাবধারায় সৃষ্ট ও লালিত এই স্থাপত্যশৈলীর অঙ্গসজ্জার বিষয়বস্তু রূপে মূলত কৃষ্ণলীলাকেই স্থান দেওয়া হয়। রামায়ণের কাহিনি, বিশেষ করে লঙ্কাযুদ্ধকেও, স্থান দেওয়া হয়েছে কারুকার্যের মধ্যে। আবার মন্দিরে পূজিত দেবতার সম্প্রদায়গত চরিত্র মন্দিরগাত্রে বৈষ্ণব-শৈব ও শাক্ত দেবদেবীর সহাবস্থানে বাধা হয়নি। রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে নবদ্বীপ ছিল প্রধান নগরী। তখন থেকেই নবদ্বীপ মন্দির প্রসিদ্ধ স্থান বলে বিবেচিত। সে-ধারা অক্ষুণ্ন রেখেই নবদ্বীপ এখন সনাতন ধর্মের অনুসারীদের তীর্থস্থান হলেও বৈষ্ণবদের আধিপত্য একটু বেশি। মধ্যযুগে ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমন এবং শাসনের ফলেও মন্দিরের এতোটুকু ক্ষতিসাধন হয়নি। বরং তাদের উদার মনোভাব আর সহিষ্ণু নীতির কারণে উত্তরোত্তর উৎকর্ষ ও আধুনিকতার চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়।

ইসমাইল মানুষের মধ্যে যেমন কোনো ব্যবধান দেখে না কখনো, তেমনি মন্দির-মসজিদের মধ্যেও পার্থক্য দেখতে পায় না। তার কাছে মনে হয়, সমস্ত ধর্মেই শান্তি আছে।

পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই যুগে যুগে মহামানবরা এসেছেন। তাঁদের পদচারণায় পৃথিবী ধন্য হয়েছে আর মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য ও মৈত্রীর সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে। ধর্ম মনকে পবিত্র করে, লোভ-হিংসা-লালসা-রিপুসহ সমস্ত পাপাচার থেকে গিনি সোনার মতো পুড়িয়ে পুড়িয়ে খাঁটি করে। সে-কারণে ধর্মের ছায়াতলে এসে মানুষ উদার হয়, মহান হয়, পবিত্র হয়। তার মনের ভেতর শান্তি নামের প্রজাপতি ওড়াউড়ি করে। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ ধর্ম দিয়ে মানুষকে ভিন্ন করে রেখেছে, এরা মানুষ নয়, মোনাফেক। ইসমাইল জানে, পৃথিবীতে মানুষের দুটো জাত আছে, একটা লুটেরা – ধনীক শ্রেণি, যারা পরের মুখের গ্রাস কেড়ে খায় – এরা ধান্ধাবাজ, শয়তান। আরেকটা মানুষের জাত আছে, এরা নিঃস্ব-গরিব, প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার জন্য। এরা আমৃত্যু মানুষের মধ্যে খুঁজে ফেরে মানুষকে। মাধব আর বনমালী যেমন মানুষের মধ্যে সেরা মানুষ। মনে কোনো পাপ নেই, আছে অগাধ ভালোবাসা আর ভালোবাসা। কারো সাতে-পাঁচে নেই, অন্যায় সহ্য করতে পারে না কখনো। এমন মানুষ দেশে আজকাল আর বেশি নেই, হারিয়ে যাচ্ছে সব কোথায়!

হঠাৎ লক্ষ করে ইসমাইল, একদল হিজড়া লাইন ধরে যাচ্ছে। একসময় তার দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় তারা। একজন অল্পবয়সী পরিচিত হিজড়া শরীর দুলিয়ে জানান দেয়, কী গো গোসাই, কেষ্টনগরের মাটির পুতুল হয়ে বসে থাকবে নাকি গো …

ইসমাইল অনুরূপ শরীর দুলিয়ে রসিকতা ঝরিয়ে একটা চোখ মেরে জানায়, না রে রাধা, বসে থাকবো কেন রে, তোর সঙ্গে কেষ্টনগরে ঝুলনে যাবো।

– আহা কথার ছিরি দেখো, মাইরি যাবি নাকি …

– যাবো যাবো, আগে বল এদ্দিন ছিলি কোথায়?

– বেশ তো আমার রসের নাগর, ফটফটিয়ে কথা বলে যে, তালে চল বৃন্দাবন।

– শুধু বৃন্দাবন কেন, যেতে পারি তোমার সনে অযোদ্ধা কিংবা মথুরা

নগরে সখী …

– আহা হেব্বি মাল একখান, পোষা কাকাতুয়া, খাঁচায় ধরে রাখবো, কলা-ছোলা দেবো আর

– নেবে তো নাও না, ময়না যে উড়ে যাবে, আঁচলে বেঁধে রাখো।

অমনি দলের মধ্যের আরো দু-একজন কলকলিয়ে হেসে ওঠে। আরেকজন হিজড়া বলে ওঠে, শান্তিপুরের কেষ্টকে না নিয়ে কি পারি গো!

– টইটুম্বর রসের নাগর, রসিক যে গো তুমি গোপাল।

– যার মনে রস আছে সেই তো রসিক, আর রসিক প্রেমিকরাই তো রসের নাগর।

– মা গো মা, কী কথা বললে গোসাই – তোমার চরণে জীবন দিতে সাধ জাগে মোর/ তুমি আমায় কেটে দাও সকল আঁধার ভোর।

ইসমাইল বলে, এটা কী হলো, মুখে-মুখে গান বেঁধে ফেললে যে –

– গান – গান তো মোদের প্রাণ সখা, মুখে কেন, প্রাণের ভেতরেও তো ওই গানই তোলপাড় করে।

তারপর কিছুক্ষণ সবাই গণেশ-কালী-শ্রীকৃষ্ণ যুগল-শিবমূর্তি এবং খেলনাগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে, কয়েকজন দু-একটা কেনে। একসময় তারা চলে যায় বেদেনীদের মতো চওড়া মাজা দুলিয়ে আর লাউডগার মতো লকলকে শরীরখানা নাড়িয়ে হাসতে হাসতে। এক মিনিট যেতে না যেতেই পাশের এক মাঝবয়সী দোকানি চাপা চিৎকার করে জানায়, পাগল হইয়া যাইবো গা, কলিজায় আর চাবুক মারোস না স্বপ্ন কা সুন্দরী, বুক যে ফালাফালা হইয়া যাইতাছে গা …

কালো মতো মাঝবয়সী হিজড়া একটা বিচ্ছিরি খিস্তি ছুড়ে দেয়। তার সঙ্গে আরেকজন হিজড়া বলে ওঠে, স্বপ্ন কা সুন্দরী না রে দামড়া, আমি তোর … নিচে আগুন লেগেছে …

ইসমাইলের কানে বড় খারাপ লাগে শুনতে, এসব বাঙালের কোনো কাণ্ডজ্ঞান আর হবে না। শুধু-শুধু ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করার কী দরকার। এরা কবে যে মানুষ হবে আল্লাহই জানেন! একসময় ইসমাইলের কানে ভেসে আসে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের ঘরছাড়া মরমি গান। এ-গান তো শুধু গান নয়, পথভোলা পথিকের অন্যরকম আবেদন, পথ ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বানও হতে পারে। ইসমাইল মুহূর্তে তন্ময় হয়ে যায়। কোথায় পেল এ-সুর, এ-সুরে এতো মায়া-ভালোবাসা কার জন্য, জানে না সে। দুরন্ত গঙ্গার স্রোত ছুটে যাচ্ছে দুষ্টু কিশোরীর মতো চোখের পলকে। সেই সঙ্গে ইসমাইলের মনটা কোথায় হারিয়ে যায় – ঘুরে এলাম, দেখে এলাম/ আবার এই নবদ্বীপে/ শান্তি নামের বান ডেকেছে/ গঙ্গা নদীর মায়াপুরে …

অকস্মাৎ সেই বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী একেবারে ইসমাইলের দোকানের সামনে হাজির হয়। আবার দুজনের মায়াবী কণ্ঠে খেলে গান – নন্দের গোপাল রে তুই/ জানিস বড় ছলচাতুরী/ মন করে হাঁচড়পাঁচড়/ আমি বল কী আর পারি …। বড় চেনা-চেনা লাগে ইসমাইলের, আগে কোথায় দেখেছে, বড় আপন মনে হচ্ছে বৈষ্ণবকে, গেরুয়া আলখেল্ল­া পা অবধি ঢেকে রেখেছে পরিচয়, তারপর আবার কপালে চন্দন মাটির তিলক।

মাথায় জড়ানো লম্বা পাগড়ি, ঘাড়ে ঝুলি আর হাতে দোতারা, সঙ্গে এক মাঝবয়সী বৈষ্ণবী, ওর মুখেও কি এক মায়ার জাদু।

ইসমাইল তাকিয়ে থাকে দুজনের মুখের দিকে। কোনোভাবে আঁচ করতে পারছে না; কিন্তু বড় চেনা এ-মুখ, অনুমান করেও কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। অমনি একচিলতে হাসি ফুটিয়ে বৈষ্ণব বলে, আমাকে চিনতে পারছিস না বুঝি?

ইসমাইল কিছু বলার আগেই আবার জানালো, ওরে হতভাগা আমি তোর সামন্ত কাকা রে, ওই যে ঢাকিপাড়ার দিকের মাটি ফেলা কাঁচা রাস্তা।

আচমকা ইসমাইলের মনে পড়ে যায় বাল্যকালের স্মৃতি। বাপের হাত ধরে কতদিন গঙ্গার ধারে বেড়াতে গেছে আর তখনই সামন্ত কাকাকে দেখতো সে। মানুষটা বরাবরই ও-রকমের। একদিন ইসমাইলের বাপ মরে গেল। তারপর এই সামন্ত কাকাই তাদের সংসারে ছায়ার মতো এসে দাঁড়ায়। কতরকম সাহায্য-সহযোগিতা করেছে মানুষটা, কত বছর সে বুক দিয়ে সংসারটাকে আগলে রেখেছে; কিন্তু বেশিদিন সেই সুখ সইল না কপালে। সমাজ-সংসারের স্বার্থবাদী মানুষেরা কখনো কারো ভালো বা সুখ-আনন্দ সহ্য করতে পারে না।

ইসমাইলের মায়ের সঙ্গে সামন্ত কাকাকে জড়িয়ে একবার এলাকার কুচক্রী মানুষগুলো কী একটা বিচ্ছিরি বদনাম রটিয়ে দেয়। এর কয়েকদিন পরই ইসমাইলের মা কড়িবর্গায় দড়ি লাগিয়ে ঝুলে মরে। সেই থেকেই এতিম সে। তারপরও ইসমাইল শুনেছে, সামন্ত কাকা গ্রামের কাকে যেন ভালোবেসেছিল; কিন্তু সেই মেয়ের একদিন বিয়ে হয়ে যায়। ভিনগাঁয়ে মেয়েটি চলে যায় পরের ঘরের বউ হয়ে। সেই থেকেই সামন্ত কাকা নিরুদ্দেশ। মাঝে একবার নাকি দেশে ফিরে এসেছিল। কদিন থেকে আবার জঙ্গলের বাঘ জঙ্গলে পালিয়ে যায়। তাও অনেক বছর আগে। ইসমাইলের সঙ্গে সেবার দেখা হয়নি, তবে সব খবর পেয়েছে তার। রক্তের সম্পর্কের চেয়েও মনের সম্পর্ক যে অনেক বড়, ইসমাইলের তাই মনে হয়। তারপর গঙ্গার জল কোথায় গিয়ে কোথায় মিশেছে, কেউ তার খবর রাখেনি। মানুষ ভারি বিচিত্র মানুষের সমাজে – এখানে কেউ কারো নয়, সবাই ছুটছে নিজেকে নিয়ে, কেউ কারো খোঁজখবর রাখার প্রয়োজন মনে করে না।

হঠাৎ সামন্ত কাকা আবার বলে ওঠে, কি গোপাল চিনতে পারলি? তোর মুখখানা দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল, দেশের সবাই ভালো আছে তো?

 – হ্যাঁ হ্যাঁ, সবাই আছে একরকম।

– আর কী, আচ্ছা জামাত আলী এখন কেমন আছে, লক্ষ্মণের বাবার হাঁপানি কি কমেছে, রহমত গায়েনের মুখ দিয়ে রক্ত বেরুতো, আমি কিছু টাকা পাঠিয়েছিলাম, ওষুধপথ্য করতে। ও আচ্ছা, পচার বোনটার কি বিয়ে হয়েছে আর …

ইসমাইল অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে মানুষটার দিকে, কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায় না।  এতো মানুষের নাম মনে রেখেছে; কিন্তু জানে না এরা কেউই এখন পৃথিবীকে বেঁচে নেই। জামাত আলী মুন্সী বছরখানেক আগে মারা গেছে, লক্ষ্মণের বাবা তারও কয়েক মাস আগে ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে চলে গেছে পরপারে। লক্ষ্মণটা আর মানুষ হলো না – বলে বড় দুঃখ করতো মানুষজনের কাছে। রাজনীতি করে বেড়াতো, বাপের কষ্ট বোঝার সাধ্য হলো না ছেলেটার। একদিন তো সে-ই লাশ হয়ে শান্ত ছেলের মতো বাড়ি ফিরলো। এ-শোক বাপ সহ্য করতে পারেনি। রহমত গায়েন রাজরোগের রোগী, মুখ দিয়ে রক্ত বেরুতে বেরুতে একদিন মাটির সঙ্গে মিশে গেল, সাতদিনের মাথায় প্রাণপাখি ফাঁকি দিয়ে উড়ে গেল নিরুদ্দেশে। একটি মাত্র মেয়ে ছিল গায়েনের, মেয়েটাকে একদিন সুযোগ বুঝে গ্রামের কিছু লাফাঙ্গা-ইতর ছেলে-ছোকরা ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে। পরদিনই মেয়েটা কুলগাছে দড়ি বেঁধে ঝুলে থাকলো। পচার বোন পদ্ম, দ্বিতীয় বিয়েও সইলো না কপালে, যৌতুকের বলি হয়েছে সে। ইসমাইল ভেবে পায় না, যার সংসার-সমাজের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই, সে ঠিকই এতো মানুষের খবর রেখেছে, এ এক আশ্চর্যের বিষয়! কিন্তু দেশে তো আরো অনেক ঘটনা ঘটে গেছে এর মধ্যে। যেমন ইসলাম চাচা ছেলেপুলে নিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে, বেশ পেরেশানে ছিল মানুষটা, ওপারের হিন্দুরা প্রায়ই ঝামেলা করতো। বিশ্বনাথ খুড়ো একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগল এখন আর মতির মায়ের দুঃখ-কষ্ট ঘোচাবে কে? সেই যে মানুষটা চিরকালের জন্য নিঃসঙ্গ হলো, আজো বেঁচে আছে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে চেয়েচিন্তে খায়, শরীর খারাপ থাকলে অনাহারে থাকে দিনের পর দিন।

অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে একসময় ইসমাইল বলে, কাকা তুমি আর দেশে যাবে না গো?

সামন্ত কাকা মুখ শুকনো করে থাকে, কোনো কথা বলতে চায় না যেন। ইসমাইল জানায়, এভাবে পথে পথে ঘুরে কী যে শান্তি পাও তোমরা, আমি বুঝি না বাপু!

মানুষ দলে দলে যাচ্ছে মায়াপুরী মঠের দিকে। বিশাল সদর দরজার সামনে জড়ো হয়ে আছে একদল বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী আর তাদের ঘিরে সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ ভক্তরা। দলের একজনের গানের গলা বেশ শুনতে, গান গাওয়া ওদের পেশা, পেশা বললে গানকে অপমান করা হয়, তাই নেশা বলা যায়। সামন্ত কাকা  বললো, বাপ আমার, আজো তুই সেই ছোট্টটি রয়ে গেছিস রে …

– তা তুমি, কোথায় থাকো?

– আমাদের আর থাকা না থাকা, সবই সমান রে বাপ, ভগবানের দুনিয়ায় সব জায়গায় যে ঘর রে …

– তা কি হয়, এটা কি জীবন হলো কাকা, তা তোমার সঙ্গের জনকে কোথায় পেলে?

– ও আচ্ছা, পরিচয় করিয়ে দিইনি তোকে, একে আমি কুড়িয়ে পেয়েছি। সেবার চন্দননগরের রাসের মেলা থেকে।

– বিয়ে করেছো তাহলে?

ইসমাইলের কথা শুনে হো হো করে হাসতে থাকে সামন্ত কাকা। বিয়ে করবো কাকে রে বোকারাম, তুই একটা ইয়ে …

– কেন, ওকে তুমি বিয়ে করোনি।

– দূর দূর বোকা, আমি তো পণ করেছি বিয়ে করবো না এ-জন্মে আর ও তো বিধবা রে।

– বিধবা …

– হ্যাঁ রে বিধবা ও। বাপ-মাও নেই। থাকতো কোনো এক দূরসম্পর্কের মামার কাছে খুন্তিপাড়া নাকি তারকেশ্বরের দিকে। মামাটা মরে যাওয়ার পর ওরা তাড়িয়ে দেয়। তখন থেকেই পথেঘাটে।

– ও আচ্ছা, তাহলে তোমার বৈষ্ণবী, মানে বষ্টমী।

– কেন রে ঘেঁটু, তুই একটা নিবি নাকি, শুনেছি এখনো সংসারধর্ম করিসনি। কী ব্যাপার কাউকে মন-টন দিয়ে ছ্যাঁকা-ট্যাকা খেয়েছিস নাকি রে?

সামন্ত কাকার খোঁচায় ইসমাইলের মনটা কোথায় যেন বা হারিয়ে যায়। পেছনের টুকরো স্মৃতিগুলি চোখের সামনে হাজির হয় মুহূর্তে। ভালো সে বেসেছিল একজনকে, সেও কি কখনো ভালোবাসতো তাকে। হয়তো ভালোবাসতো, অথবা শুধুই অভিনয়। পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে সবাই প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত শুধু অভিনয় করেই যায়। বৈকুণ্ঠ সাহার ছোট মেয়েটা ইসমাইলের বয়সী, একসঙ্গে বেড়ে ওঠে ওরা। এভাবেই তাদের মধ্যে একটু-আধটু ভালোবাসার শেকড়-বাকড় ডালপালা বিস্তার করে। আগুনের আঁচে জ্বাল দিতে দিতে যেমন দুধের ওপর পুরো সর হয়, তেমনি একে অপরের কাছাকাছি আসাতে ভালোবাসা মজবুত হয়, ভালোবাসা ঘন হয়। অরুণিমা কখন যে তার হৃদয়ের মধ্যে বাসা করে ফেলে, ইসমাইল তা বুঝতে পারেনি। সে জানতে পারেনি, একটা মেয়ে তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে, তাড়া করে বেড়ায় দিবানিশি, একসময় মনে হয়, অরুণিমা বাতাসে চুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়ে গেছে, তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে বিরাজ করছে একটা মেয়ে। যেন সে শুধু একা নয়, আরেকজন ছায়ার ভেতর কায়া হয়ে মিশে আছে। সেই দুজনের ভালোবাসা অন্য কেউ জানতে পারেনি। তবে পাখি-বৃক্ষ-নদী-মাটি-আকাশ-বাতাস – এরা সবাই জানতো তাদের ভালোবাসার কথা, ভালোবাসার গল্প।

আকাশের নক্ষত্র-জ্যোৎস্নাভরা রাত জেনেছিল দুজন দুজনকে কাছে পেতে চায়, ভালোবাসার পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে সাজিয়ে তুলতে চায় বিশ্বসংসার, পরমাত্মার মাঝে বিলীন হয়ে মানবাত্মা সার্থকতা চায়, পৃথিবীকে ভরিয়ে দিতে চায় ফুল-ফল-সৌন্দর্যে। কিন্তু তার আগেই অরুণিমা সাতপাকে বাঁধা পড়ে চলে যায় স্বামীর বাড়ি সুদূর মেদিনীপুর। ইসমাইল বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে আকাশ দেখেছে, নির্বোধ জানোয়ার সে তখন। তার বুকের ভেতরে যে হৃৎপিণ্ড আছে, তার ভাষা কে বোঝে? কার কী যায়-আসে তাতে। অরুণিমা স্বামীর বাড়ি গিয়ে চারদিনের মাথায় বিশ্বসংসারকে মিথ্যা করে চলে গেল পরমাত্মার ধ্যানে। জমিতে ছিটানো কীটনাশক খেয়ে জীবনের জ্বালা মিটিয়ে গেল, এমন জেদি মেয়ে অরুণিমা!  এমনটা কখনো ভাবেনি ইসমাইল, কিন্তু সে পারেনি অমন একটা কাজ করতে। মনের ভাষাকে মনের ফ্রেমেই লটকে রেখেছে সে আজো। অরুণিমার মৃত্যুর কারণ সবাই জানার চেষ্টা করেছে, ওর এক বান্ধবী ভারতী একদিন জানায়, বিয়ের আগে ও নাকি বলেছিল, বাবা আমার বিয়ে দিলে আমি কিন্তু … এ-শরীর এ-জীবন যে শুধু ওই একজনের …

আস্তে আস্তে জেনে যায় সবাই। ইসমাইলের ভালোবাসাকে সে সম্মান দিয়ে পরপারে পাড়ি দিয়েছে হাসতে হাসতে। বাবাকে কলঙ্ক থেকে মুক্ত করেছে, আবার নিজের ভালোবাসাকে সত্য-সুন্দর করে গেছে সে। মাঝে একদিন বৈকুণ্ঠ সাহা কাঁদতে-কাঁদতে জানিয়েছিল, ওরে হারামজাদা, আমার ওই পুতুলের মতো মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলিনে রে … কেমন তোদের ভালোবাসা ছিল –

বাঁচাতে সে পারতো ঠিকই, কিন্তু পারেনি। এই না-পারা কার অপরাধ, সে জানে না। আজো জানে না। আজো কখনো-সখনো অথবা গভীর রাতে, স্বপ্নের মধ্যে অরুণিমা তার কাছে আসে, কথা বলে চলে যায়। চলে যাওয়ার পর একটা সুবাস ছড়িয়ে দিয়ে যায়, সে-সুবাস ভালোবাসার সুবাস। তখন শুধু কানের কাছে ভেসে আসে বৈকুণ্ঠ খুড়োর সেই কথা, মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলিনে রে, কেমন তো-দে-র …। ইসমাইল ভাবে মানুষকে বাঁচানোই কঠিন কাজ, মেরে ফেলাটা কাপুরুষের কাজ, কাপুরুষের লক্ষ্মণ।

আচমকা সামন্ত কাকা বলে ওঠে, কী রে এতো কী ভাবছিস বুড়ো পণ্ডিতের মতো।

– ভাবছি চৈতন্যদেবের ধামে এলে মনটা কোথায় হারিয়ে যায় গো, সংসার-ধর্ম কিঙ্কুই আর ভালো লাগে না।

– বুঝেছি নিমাই, এ-বয়সে তোরে চৈতন্যে পেয়ে বসেছে; কিন্তু বাপ খবরদার ভুল করিসনে, জীবনে সবচেয়ে বড় ধর্ম ঘরসংসার স্বামী-স্ত্রী সন্তান-সন্ততি আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব …

ইসমাইল নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নিষ্পলক চোখদুটোতে কিসের এক মায়া খেলে যায়। ঘরের মায়া যেমন সামন্ত কাকাকে আর টানে না, তেমনি ইসমাইলকেও পথই এখন আপন করেছে। আর তাই জীবনটাকে নদীর মতো ভাবতে ভালো লাগে। নদী, হ্যাঁ এই প্রবহমান গঙ্গা, দু-পাড়ের জীবনযাপন, বিস্তারিত কত খেলা-স্বপ্ন – সবই দেখছে, কিন্তু থামার কোনো ইচ্ছে নেই তার। ছুটে চলে যাচ্ছে দূরে-বহুদূরে। আজো কদাচিৎ অরুণিমা এসে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। মেয়েটি যেন নদী, নদীর মতো পায়ে ওর নূপুর বাঁধা, রিনিঝিনি শব্দ তুলে আসে আবার রিনিঝিনি শব্দ উড়িয়ে চলে যায় ইচ্ছেমতো।

সামন্ত কাকা একসময় চলে যায়। মায়াপুরী মঠের ভেতর ওর কত সাথি-সঙ্গী-ভক্ত আছে, গানে-গানে ভরে যাবে আশ্রম, সে-গান তো গান নয়, পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের জয়গান, অপার সুখ। অন্তরীক্ষে হারিয়ে যাবে মনপাগলা আর আত্মা মিলবে অসীমের সঙ্গে, আকাশ আর পাতালের ব্যবধান ঘুচে যাবে সে-মুহূর্তে। ইসমাইল অনেক আগে শুনেছিল, সামন্ত কাকা সনাতন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে অর্থাৎ শৈবধর্মমত ছেড়ে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিয়েছে, অর্থাৎ বৈষ্ণব ধর্মমত তাকে আকৃষ্ট করেছে বলা যায়। এ-ধর্মে নাকি অপার শান্তি, শ্রীচৈতন্যদেব সেই মধ্যযুগে শান্তির বাণী ছড়িয়ে গেছে, মাটির গড়া মূর্তি নয়, প্রাণহীন প্রতিমার মধ্যে কোনো শক্তি বা ক্ষমতা নেই। পরম করুণাময় হলো একমাত্র অবলম্বন। তার নিরাকার উপাসনায় হলো ব্রাহ্মধর্মের বা বৈষ্ণব ধর্মমতের দীক্ষা। – সুখ নেই রে গয়া-কাশী/ সুখ হলো মনের পাখি/ তাকে যায় না ধরা নিমাই বলে/ সুখ হলো আজব চালাকি/ সুখ হলো মোহন বাঁশি …

ইসমাইল দূরমন্দিরের সুউচ্চ চূড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, শত-সহস্র কবুতর বাকবাকুম-বাকবাকুম ডাকছে আর একে-অপরকে ভালোবাসা নিবেদন করছে। উদাসী চোখ তার  মন্দির দেখে, নাকি মন্দিরের ভেতরের আরেক মন্দিরের হৃদয় দেখে, সেই মন্দির যেন অরুণিমার ভালোবাসা! কিছুক্ষণ পর পাশের দোকানদার লোকটা ওর কাছে আসে, লোকটার দিকে একটু তাকিয়ে বোঝে কিছু বলবে হয়তো।

লোকটা খানিক শরীর ঝাঁকিয়ে সামন্ত কাকার দিকে ইঙ্গিত করে জানায়, গুরু গুরু দেখতাছে ভি আজব কারখানা, মাগার বষ্টমিটা কি খাসা একখানা মাল মাইরি …

ইসমাইল কিছু বলে না, নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে, কী বলবে ভেবে পায় না। আবার বলে লোকটা, গুরু আহা পাগল হইয়া যামুগা … নবদ্বীপে হালায় ইয়ে করতাছি, ওদিকে সাতকালের বুড়ো সব দুই টাকা নয় আনা খরচা করে কচিকাঁচা বষ্টমি জুটিয়ে আনতাছে বৃন্দাবন থেকে।

বড় বেশি বেয়াদব লোকটা, গায়েপড়া এসব  দোপায়া প্রাণী থেকে বরাবরই নিজেকে আলগোছে সরিয়ে রাখে ইসমাইল। তবে অমন হ্যাংলামি দেখে চুপ করে থাকতেও পারে না সে, উচিত একখানা জবাব দিতে হবে, বেহায়া পেয়েছে কী! অকস্মাৎ লোকটা বলে, কী বয়সে কী ডাসা গোপী ধইরাছে, রাধার সখা হইবে মনে কইতাছে, শরীর জুড়ে হুদু যৌবনের বন্যা।

ইসমাইল ফস করে জ্বলে ওঠে, আপনার মা-বোন নেই।

– হ্যাঁ হ্যাঁ থাকবো না ক্যান … মা, বোন, মাসি, পিসি সবই আছে ভায়া, কিন্তু মা তো বাবার, বোন হলো বোনাইয়ের, মাসি আবার মেসোর আর পিসি, সে তো পেসো মশায়ের যে, আমার রইলো ক্যাঠা সোনা!

ইসমাইল লোকটার কথার কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। এসব কুরুচিপূর্ণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কটা একটু দূরে রাখাই ভালো। বনমালী ঠিক কথাই বলে, এরা মিনমিনে শয়তান, ওপরটা যতই চকচকে হউক না কেন আসলে এল্ল­তের পা ঝাড়া।

বিকেলের পরপর সন্ধের দিকে একদল বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী ইসমাইলের দোকানের সামনে ভিড় করে। জয় গুরু, জয় গৌড়ের নিতাই … ইসমাইল বাঁদিকে চোখ তুলে দেখে ভরাট কণ্ঠে উচ্চারণ করছে শশীভূষণ বৈষ্টম। বিচিত্র ধারার মানুষ বলা যায়। কী যে মায়ায় পড়ে আছে মায়াপুরী মঠে, কেউ জানে না সে-কথা। বুকভরা ভালোবাসা লোকটার। দিনে দু-একবার খবর নেয় সবার। ইসমাইলকে হয়তো একটু বেশিই ভালোবাসে। ঠোঁটের কোণে একটু হাসি মাখিয়ে শশীভূষণ চলে যায় আশ্রমের দিকে। অল্পবয়সী এক বৈষ্ণবী আড়চোখে ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে জানায়, ঠাকুর তোমার বাড়ি কোথায় গো …

সঙ্গের আরেক বৈষ্ণবী তৎক্ষণাৎ জানালো, শান্তিপুরে রে সতিন, শান্তিপুরে …

– বাব্বাহ্, বেশ তো খবর রাখিস।

– নন্দের নিমাই ঠাকুরের খোঁজ কে না রাখে, ও যে রসের নিমাই, শান্তিপুরের কেষ্ট যে।

– আহ্হা রে, কী শোনালি মোরে সখী, মরি মরি সইতে না-রি … চেহারা-সুরত দেখে ঝুলে পড়তে খায়েস জাগছে ভারি।

ইসমাইল হেসে বললো, তোমার বাড়ি কোথায় রাধে?

– পথই আমার বাড়ি ঠাকুর, পথই আমার ঠিকানা!

সঙ্গের বৈষ্টমী এক চোখ টিপে আরো রসিকতা ঝরিয়ে জানালো, কী গো নাগর, মনে ধরেছে, সঙ্গে নেবে নাকি একশ এক টাকা পাঁচ আনায় কিনে।

 – এত্তো টাকা কোথায় পাবো, ভালোই হলো অতো টাকাও নেই, গোপীকেও দরকার নেই। হরি বোল, জয় হরি, জয় নন্দের নন্দের জয় …

– কী গো, এখানে হরি ডাকছো যে বড়।

– হরি আছে সবখানে গো।

– ঠিক আছে একশ টাকা বাদ, তুমি এক টাকা পাঁচ আনাই দিও গোসাই।

ইসমাইল একভাবে তাকিয়ে থাকে অল্পবয়সী বৈষ্টমীর চোখের তারায়। চোখ তো নয় যেন জ্যোৎস্নারাতের নক্ষত্ররাজি। ওর চোখ দুটো ভারি সুন্দর, দামোদর নদীর মতো টলটল করে চোখের মণি। ঠোঁটের পাপড়ি মৃদু কাঁপছে। ইসমাইল নরম হাসি ছড়িয়ে বলে, পথকে বাড়ি করেছো, ঘরে মনটাকে বেঁধে রাখতে পারবে সখী।

– মন তো সোনার পাখি কেষ্ট, সোনার পাখিকে কি লোহার খাঁচায় বন্দি করা যায়, ভালোবাসার খাঁচায় বন্দি করে দেখো না গো …

– জয় গুরু নিতাই।

ইসমাইলের মুখের হাসিটুকু আরো গাঢ় হয়। সূর্যোদয়ের মতো একটু একটু ফুটে ওঠে, অরুণিমার মুখচ্ছবি বৈষ্টমীর মাঝে বিলীন হয়ে যায়। অনেক দূর থেকে আসা দর্শনার্থীরা দোকানে-দোকানে ভিড় করছে এখন। পুঁতির মালা কিনছে কেউ কেউ আর কেউ বা মজা দেখছে টিয়াপাখির ভাগ্যগণনা নিয়ে খেলার। অনেক দূর থেকে আগাল বাঁশের বাঁশির সুর ভেসে আসে কানে। একবার মনে হয়, আশপাশে কোথাও বাঁশরি বাজায় কোনো ঘরছাড়া উদাসী কৃষ্ণ। চারদিকে তাকিয়েও কাউকে পেল না। ইসমাইল আর কিছু বলে না, সব ভাষা যেন বা হারিয়ে গেছে তার। তার চোখে উদার আকাশ, মায়াবী জাল ছড়িয়ে বিশাল আকাশ তাকিয়ে আছে। বুকজুড়ে লক্ষ-কোটি ভালোবাসা জেগে উঠবে হয়তো। বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের দরাজ কণ্ঠের কীর্তন ভেসে আসছে এখন। অরুণিমাকে ভালোবাসার খাঁচায় বন্দি করেছিল সে, কিন্তু সে ভালোবাসার খাঁচা ভেঙে চলে গেছে কোন সুদূরে। এই বৈষ্ণবী তো নদীর জোয়ার, একে থামাবে কীভাবে, এর পায়ে যে ধেয়ে চলার নূপুর। মায়াপুরী মঠের মাধুর্যসিক্ত কণ্ঠের মূর্ছনায় আকাশ থেকে নেমে আসে শান্তির মেঘদূত। উড়ে-উড়ে বেড়ায় নতুন-নতুন প্রজাপতি আর ভালোবাসার কপোত-কপোতি বাকবাকুম-বাকবাকুম ডাক দেয় চারদিকে। মাঝি ভাটিয়ালি গান গায়, নৌকায় তার প্রাণ এসেছে, পালে হাওয়া খেলেছে বড়। ভাটিয়ালির ব্যাকুল সুর ঘরছাড়া করে প্রেমিক মন আর ইসমাইলকে।