রবীন্দ্রকাব্যে রেনেসাঁস চেতনা

ইতালীয় রেনেসাঁসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মানুষের দৃষ্টিকে অপার্থিব বা দৈব প্রভাব থেকে মুক্ত করে জাগতিক ও মানবিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করা। মধ্যযুগে মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল পরলোক, ধর্মসাধনা ও অন্ধবিশ^াসের প্রতি; জাগতিক ও মানবিক চিন্তাধারা তখন উপেক্ষিত হয়েছে, প্রাধান্য পেয়েছে বিষয়বৈরাগ্য ও সন্ন্যাস। রেনেসাঁস এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে দেয়। জাগতিক ও মানবমুখিনতার প্রতি নবজাগ্রত এই আগ্রহ ইতিহাসে ‘Humanism’ নামে অভিহিত হয়েছে। ইতালীয় রেনেসাঁসের স্মরণীয় প্রবর্তক পেত্রার্কাকে বলা হয়েছে ‘First of the humanists’। Humanism বা মানবমুখিনতার প্রতি প্রবল আগ্রহ রবীন্দ্রনাথ বরাবরই পোষণ করে এসেছেন। নবজাগরণের গভীর উপলব্ধি ও অঙ্গীকারকে চেতনায় ধারণ করে তিনি মানুষকে সবকিছুর কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন। তাঁর সৌন্দর্যচেতনা, মর্ত্যপ্রেম ও ধর্মবিশ^াস মানবমুখী। ‘প্রভাত-উৎসব’ কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছিলেন –

হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি!

জগৎ আসি হেথা করিছে কোলাকুলি!

ধরায় আছে যত, মানুষ শত শত

আসিছে প্রাণে মোর, হাসিছে গলাগলি।

‘কড়ি ও কোমলে’র যুগে কবির উপলব্ধি –

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,

মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।

জীবন ও জগতের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই অনুরাগ পরবর্তীকালে গভীরতর হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’-এর কবি, তিনি ‘বসুন্ধরা’র কবি। ‘মায়াবাদ’ ও ‘বৈরাগ্যসাধন’ কখনো তাঁর চিন্তালোকে ঠাঁই পায়নি –

বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়

… ইন্দ্রিয়ের দ্বার

রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার।

যে কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে

তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।

মানবমুখিনতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অসামান্য অঙ্গীকারের পরিচয় রয়েছে সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় –

মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল। তাদের জন্য চিন্তা করেছি, কাজ করেছি, কর্তব্যের নানা সংকল্প বেঁধে তুলেছি, সেই সংকল্পের সূত্র আজও ছিন্ন হয়নি আমার চিন্তায়। সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হল আমার জীবনে। আমার বুদ্ধি এবং কল্পনা এবং ইচ্ছাকে উন্মুখ করে তুলেছিল এই সময়কার প্রবর্তনা – বিশ^প্রকৃতি এবং মানবলোকের মধ্যে নিত্যসচল অভিজ্ঞতার প্রবর্তনা।

‘ধর্মমোহ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের মানবধর্মপ্রীতি সুস্পষ্ট। ধর্মমোহ থেকে তিনি মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই মুক্তি মানুষকে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে অবারিত মানবজমিনে আহ্বান করে। এই মুক্তি সমস্ত বৈষম্য ও বিরোধের অবসান ঘটায়। এখানে বিচ্ছেদের বদলে তৈরি হয় মিলনের সেতু যেখানে নাস্তিক অবাধ প্রবেশাধিকার পায়। বিধাতার আশীর্বাদপুষ্ট হয় নাস্তিক কারণ সে মানুষের কল্যাণকে সর্বাগ্রে বিবেচনা করে –

ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে

অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।

নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,

ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।

শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,

শাস্ত্র মানে না, মানে মানুষের ভালো।

রবীন্দ্রনাথের চিন্তাজগতে বাউল সম্প্রদায়ের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, বাংলার বাউল সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে নেই কোনো মন্দির, নেই কোনো মূর্তি, নেই কোনো শাস্ত্র বা অনুষ্ঠান। মানুষই তাদের কাছে দেবতা, মানুষে মানুষে প্রেমই তাদের ধর্মের মূলকথা। বাউল সাধকদের এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি রবীন্দ্রনাথ আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর বহু কবিতায়, গীতিকবিতায় এই দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে। গীতাঞ্জলির কবি মন্দিরে আগত পুণ্যার্থীর উদ্দেশে বলেছেন –

অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে

কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে,

নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে

দেবতা নাই ঘরে।

মধ্যযুগে যারা ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ধর্মের যথার্থ বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁদের আদর্শের প্রতি রবীন্দ্রনাথ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে প্রাচীর গেঁথে দেয়াল তুলে ঈশ্বরকে যাঁরা অচলায়তনে বন্দি করেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে ছিল এই মহাপুরুষদের সংগ্রাম। এই সংগ্রামে মন্ত্রবর্জিত, নিপীড়িত মানুষের কাছ থেকেই ধর্মের প্রকৃত পাঠ গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা। পত্রপুট কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক উপলব্ধি Ñ

ওরা অন্ত্যজ, ওরা মন্ত্রবর্জিত

          দেবালয়ের মন্দিরদ্বারে

                   পূজা-ব্যবসায়ী ওদের ঠেকিয়ে রাখে।

ওরা দেবতাকে খুঁজে বেড়ায় তাঁর আপন স্থানে

          সকল বেড়ার বাইরে

                   সহজ ভক্তির আলোকে,

          নক্ষত্রখচিত আকাশে,

                   পুষ্পখচিত বনস্থলীতে,

          দোসর-জনার মিলন-বিরহের

                   গহন বেদনায়।

          যে দেখা বানিয়ে-দেখা বাঁধা ছাঁচে,

          প্রাচীর ঘিরে, দুয়ার তুলে

          সে দেখার উপায় নেই ওদের হাতে।

অন্তর্চক্ষু দিয়ে দেবতার প্রকৃত অধিষ্ঠান দেখতে পায় না বলেই সংকীর্ণ ধর্মাচারীরা বিভেদ তৈরির মাধ্যমে মনুষ্যত্বকে পদদলিত করে। ব্রাহ্মণ রামানন্দ এই ভেদবুদ্ধির অনুসারী ছিলেন। দেবতা যখন অপ্রসন্ন হলেন তখন রামানন্দ লোকাচারের অজুহাত দেখালেন। দেবতা ক্ষুব্ধ হলেন। ‘শুচি’ নামক অবিস্মরণীয় কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন –

লোকস্থিতি রক্ষা করতে হবে যে প্রভু –

          বলে গুরু চেয়ে রইলেন ঠাকুরের মুখের দিকে।

ঠাকুরের চক্ষু দীপ্ত হয়ে উঠল; বললেন –

                   যে লোকসৃষ্টি স্বয়ং আমার,

                   যার প্রাঙ্গণে সকল মানুষের নিমন্ত্রণ,

তার মধ্যে তোমার লোকস্থিতির বেড়া তুলে

                   আমার অধিকারে সীমা দিতে চাও

                             এতো বড়ো স্পর্ধা।

রামানন্দের ভুল ভাঙলো। তিনি বেরিয়ে পড়লেন দেবতাকে প্রসন্ন করতে। নাভা চরুালকে, মুসলমান জোলা কবীরকে, রবিদাস চামারকে আলিঙ্গন করে আসল শুচিতা লাভ করলেন তিনি। তাঁর আপন ধর্ম-সম্প্রদায় তাঁকে তিরস্কার করলেও তিনি সেদিন ‘সকলের চেয়ে বড় জাতিতে উঠেছিলেন যে জাতি নিখিল মানুষের।’ প্রকৃত ধর্মবোধের অধিকারী হয়ে রামানন্দ বললেন –

আমার ঠাকুরকে একদিন যেখানে হারিয়েছিলুম,

আজ তাঁকে সেখানে পেয়েছি খুঁজে।

সূর্য উঠল আকাশে

আলো এসে পড়ল গুরুর আনন্দিত মুখে।

রামানন্দ এখানেই থেমে থাকেননি। যে ‘রবিদাস চামার ঝাঁট দেয় ধুলো’, পথিকেরা যার স্পর্শ বাঁচিয়ে চলে, সেই রবিদাসকেও আলিঙ্গন করলেন তিনি।

ধর্মের ধ্বজাধারীরা কৃত্রিম শুচিতা নিয়ে মাতামাতি করে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কৃত্রিম শুচিতা ধারণ করেন না। তিনি সকল সৃষ্টির মাঝে বিস্তৃত হয়ে আছেন। কোনো কাজ ছোট নয় তাঁর কাছে। কর্মমুখর তিনি, কর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম তাঁর কাছে। ‘ধুলামন্দির’ কবিতায় কবি বলেছেন –

তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে করছে চাষা চাষ –

পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ, খাটছে বারো মাস।

রৌদ্রে জলে আছেন সবার মাঝে,

ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে;

তাঁরি মতন শুচি বসন ছাড়ি

আয়রে ধুলার ’পরে।

…        …        …

রাখো রে ধ্যান থাক্ রে ফুলের ডালি,

          ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুক ধুলাবালি

কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে

ঘর্ম পড়ুক ঝরে।

প্রাণহীন শুষ্ক আচার মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করে। বিভেদ থেকেই বিদ্বেষ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হয়। মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ বরাবরই এমন উগ্রবাদী মানসিকতার বিরোধিতা করেছেন। ‘পত্রপুট’-এর কবিতায় ঘোষণা করলেন, ‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন’। অসামান্য তাঁর উচ্চারণ –

হে চিরকালের মানুষ, হে সকল মানুষের মানুষ,

          পরিত্রাণ করো

          ভেদচিহ্নের-তিলক-পরা

          সংকীর্ণতার ঔদ্ধত্য থেকে।

হে মহান পুরুষ, ধন্য আমি, দেখেছি তোমাকে।

ব্রাত্য, অন্ত্যজ ও শোষিত মানুষের পক্ষে চিরকাল সোচ্চার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মনুষ্যত্বের দীপ্তিতে ভাস্বর ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতাটি। বঞ্চিতজনের প্রতি কবির মমত্ববোধ স্পষ্ট –

ওই যে দাঁড়ায়ে নত শির

মূক সবে, মøানমুখে লেখা শত শতাব্দীর

বেদনার করুণ কাহিনী …

শুধু সহানুভূতি ঝরেনি কবির কণ্ঠে, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বানও জানাচ্ছেন তিনি –

মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে,

যার ভয়ে ভীত তুমি, সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে

যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে।

মানুষে মানুষে বিভেদকে বরাবরই ঘৃণা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। অসহায়ের আর্তি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মর্মভেদী রূপ ধারণ করেছে। অত্যাচারী জমিদারের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রƒপ বর্ষিত হয়েছে –

এ-জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি

রাজার হস্ত ক’রে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।

সমাজের উচ্চবর্গের মানুষের পেষণে যারা প্রতিনিয়ত অপমানিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে তাদের প্রতি আন্তরিক দরদ অনুভব করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাদের মর্মজ¦ালা অনুভব করে ধনাঢ্য শ্রেণির প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন তিনি –

তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে

সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলা।

চরণে দলিত হয়ে

ধুলায় সে যায় বয়ে

সে নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ।

অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান।

যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে

পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।

অজ্ঞানের অন্ধকারে

আড়ালে ঢাকিছ যারে

তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।

অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

সাম্প্রদায়িকতার নখরাঘাতে জর্জরিত ভারতবর্ষে ঐক্যের সাধনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। উগ্র জাতীয়তাবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। অনন্যসাধারণ পঙ্ক্তিমালার মধ্য দিয়ে তিনি ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারাকে উপস্থাপন করেছেন ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় –

কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা

দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হারা।

হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন –

শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।

পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে

                                                    উপহার,

দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে –

এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।

ভারতীয়ত্ব ও হিন্দুত্ব সমার্থক – এমন অবৈজ্ঞানিক ও উগ্র মতবাদের বিরোধী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। উগ্রবাদের বিরুদ্ধে মানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা সর্বাগ্রে জরুরি। এক্ষেত্রে সমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য তথা সমন্বয়সাধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন –

এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান –

এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান।

এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার।

এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমানভার।

মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা, মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা

সবার-পরশে-পবিত্র-করা তীর্থনীড়ে –

আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।

কাহিনী কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘সতী’ রবীন্দ্রনাথের এক অসামান্য সৃষ্টি। সাম্প্রদায়িক ধর্মের চেয়ে হৃদয়ধর্মের স্থান যে অনেক উঁচুতে এর জীবন্ত উদাহরণ ‘সতী’। বিনায়ক রাওয়ের মেয়ে অমাবাইয়ের সঙ্গে জীবাজির বিয়ে হওয়ার কথা। জীবাজি বিয়ের জন্য যাত্রা করে এবং যাত্রাপথে বিজাপুর রাজ্যের মুসলমান সভাসদ কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে বন্দি হয়। সেই মুসলিম সভাসদ বর সেজে কনে অমাবাইকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে যায়। বন্দি জীবাজি ছাড়া পেয়ে বিনায়কের কাছে এসে সমস্ত ঘটনা বলে। তারা দুজনই এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এই প্রস্তুতিপর্বের মধ্যেই অমাবাই সেই মুসলমান অপহরণকারীকে ভালোবেসে বিয়ে করে সন্তানের জন্ম দেয়।

দুই পক্ষের মধ্যে এক ঘোরতর যুদ্ধে জীবাজি প্রাণ হারায় এবং মুসলমানরা পরাজিত হয়। বিনায়ক প্রচণ্ড ক্রোধে অমাবাইয়ের স্বামীকে হত্যা করেন। তিনি কন্যাকে উদ্ধার করে এনে মুসলমান-সংসারে এতদিন থাকার অপরাধে প্রায়শ্চিত্ত করতে বলেন। নদীর তীরে বসবাস এবং প্রতিদিন গঙ্গাস্নান করে শিবনাম জপ করতে বলা হয় অমাবাইকে। প্রচলিত সমাজরীতির বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হিসেবে কাহিনিতে আবির্ভাব ঘটে বিনায়কের স্ত্রী রমাবাইয়ের। নিজের মেয়ের সতীত্ব রক্ষার তাগিদে তিনি মেয়েকে আদেশ দেন বাগদত্ত স্বামী জীবাজির সঙ্গে একই চিতায় সহমরণে যেতে। অমাবাই এ-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলে যে, সে নিজের জননীর মতোই সতী। অমাবাইয়ের এ ‘অন্যায় ভাষ্য’ বিনায়কও সমর্থন করেননি। তাকে বন্দি করতে সৈন্যদের আদেশ দেয় রমাবাই এবং নিজের মেয়ে অমাবাইকে জীবাজির চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে।

মানবধর্মের জাজ্জ্বল্যমান প্রতিনিধি অমাবাই। মুসলমান স্বামীকে সে ঘৃণা করেনি, ভালোবেসে নিজের কর্তব্য পালন করেছে। পিতা-মাতা যখন তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে বলেছে তখন সে রাজি হয়নি। প্রচলিত লোকাচারকে সে প্রত্যাখ্যান করেছে মানবতাবাদী চেতনায় দীপ্ত হয়ে। সমাজ ধর্মের যূপকাষ্ঠে বলি হওয়া অমাবাই জীবাজির চিতাকে পরপুরুষের চিতা হিসেবে গণ্য করেছে এবং বিধাতার কাছে সত্যের উদ্বোধন কামনা করেছে। মা রমাবাইয়ের তিরস্কারের জবাব দেয় সে দৃঢ়কণ্ঠে –

উচ্চ বিপ্রকুলে জন্মি তবুও যবনে

ঘৃণা করি নাই আমি, কায়বাক্যে মনে

পূজিয়াছি পতি বলি; মোরে করে ঘৃণা

এমন কে সতী আছে? নহি আমি হীনা

জননী তোমার চেয়ে – হবে মোর গতি

সতীস্বর্গলোকে।

তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা থেকে কন্যার অপহরণকারীকে হত্যা করেন বিনায়ক রাও। কিন্তু ধর্ম রক্ষার জন্য জীবাজির চিতার আগুনে মেয়েকে জ্বলতে দিতে তিনি রাজি হননি। কন্যার দৃঢ়োচিত মানবতাবোধ তাঁর মনকে বিগলিত করেছে। সমাজের বিধি, ভয়কে উপেক্ষা করে কন্যাকে বলেছেন –

আয় বৎসে! বৃথা আচার বিচার

পুত্রে লয়ে মোর সাথে আয় মোর মেয়ে

আমার আপন ধন। সমাজের চেয়ে

হৃদয়ের নিত্যধর্ম সত্য চিরদিন।

পিতৃস্নেহ নির্বিচার বিকারবিহীন

দেবতার বৃষ্টিসম, আমার কন্যারে

সেই শুভ স্নেহ হতে কে বঞ্চিতে পারে –

কোন্ শাস্ত্র, কোন্ লোক, কোন্ সমাজের

মিথ্যা বিধি, তুচ্ছ ভয়?

স্ত্রীর ধর্মান্ধতা ও উগ্রবাদের বিরোধিতা করেছেন বিনায়ক। কন্যাকে তিনি রক্ষা করতে পারেননি, কিন্তু তাঁর উপলব্ধি ও অমাবাইয়ের নির্ভীকতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মানবধর্মেরই জয় ঘোষণা করেছেন।

ধর্মমোহে আচ্ছন্ন শক্তির কারণে যুগে যুগে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটেছে। মানবতার এমন চরম অবমাননার কঠোর সমালোচক রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কবিতায়, গীতিকবিতায় বারবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে মনুষ্যত্ববোধের উচ্চকণ্ঠ। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কালো থাবা থেকে তিনি স্বদেশের মুক্তি কামনা করেছেন। ধর্মীয় উগ্রবাদ তথা রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিরোধ করার জন্য তিনি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছেন। ‘ধর্মমোহ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের আহ্বান যেন রেনেসাঁস চেতনারই বলিষ্ঠ প্রকাশ –

যে পূজার বেদি রক্তে গিয়েছে ভেসে

ভাঙো ভাঙো, আজি ভাঙো তারে নিঃশেষে –

ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো,

এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক জ্বালো।

রেনেসাঁসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি সশ্রদ্ধ অবলোকন। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটেছিল ইতালীয় রেনেসাঁসে। তখন ইতালি প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন সংস্কৃতির নিবিড় চর্চায় নিয়োজিত ছিল। রামমোহন বেদান্ত ও উপনিষদ অনুবাদের মধ্য দিয়ে যার সূচনা করছিলেন বিদ্যাসাগর, মাইকেল ও বঙ্কিম তাঁদের অনুবাদমূলক ও সৃজনশীল গদ্য-পদ্য চর্চার মধ্য দিয়ে যে বিস্মৃতপ্রায় প্রাচীন মনন ও সৌন্দর্যচর্চাকে পুনর্জীবিত করতে চেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ একে পরিপূর্ণতা দান করেছেন তাঁর জীবনব্যাপী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সাধনার মাধ্যমে। পেত্রার্কা বলেছিলেন – ‘আমি যদি লিভির যুগে জন্ম নিতাম কী ভালোই না হতো।’ প্রায় একই সুরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন –

আমি যদি জন্ম নিতেম

কালিদাসের কালে

দৈবে হতেম দশম রত্ন

নবরত্নের মালে।

প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি বরাবরই অনুরাগ ছিল রবীন্দ্রনাথের। কাব্যে, নাটকে, উপন্যাসে ও প্রবন্ধে প্রাচীন ভারতকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে জীবন্ত করে তুলেছেন তা অতুলনীয়। ‘হে অতীত তুমি হৃদয়ে আমার/ কথা কও, কথা কও -’ এটি শুধু কথার কথা নয়, রবীন্দ্রনাথের একান্ত উপলব্ধি। প্রাচীন সভ্যতা ও ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগের জন্যই রবীন্দ্রনাথের মানসজগৎকে প্রভাবিত করেছিল বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত ও কবি কালিদাস। বৈদিক মন্ত্রকে আশ্রয় করে রবীন্দ্রনাথ রেনেসাঁসের নির্যাসকে ধারণ করেছেন। প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার মধ্যে তিনি অন্বেষণ করেছেন কূপমণ্ডূকতা ও সংকীর্ণতা থেকে মুক্তির মন্ত্র। এ মন্ত্র জীবনবাদী ও আনন্দমুখর। ‘নৈবেদ্য’ কাব্যে কবির আকুতি –

আরবার এ ভারতে কে দিবে

গো আনি

সে মহা আনন্দমন্ত্র,

সে উদাত্তবাণী সঞ্জীবনী,

স্বর্গে মর্ত্যে সেই মৃত্যুঞ্জয় পরম ঘোষণা,

সেই একান্ত নির্ভর অনন্ত অমৃত বার্তা।

সংস্কৃত সাহিত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কালিদাস, ভবভূতি, বানভট্টের সৃষ্টিসম্ভার রবীন্দ্রনাথের ভাবজগৎকে আলোড়িত করেছিল। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন কালিদাস। ইতালির রেনেসাঁসে দান্তে যেমন ভার্জিলকে অবলম্বন করেছিলেন, বাংলার রেনেসাঁসে রবীন্দ্রনাথ তেমনিভাবে কালিদাসকে অবলম্বন করেছিলেন। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে নাড়া দিয়েছিল এর উদাহরণ রয়েছে নানা কবিতা ও রচনায়। কালিদাস-কল্পিত সৌন্দর্যলোকে গন্তব্য খুঁজে পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যতৃষ্ণা –

দূরে বহুদূরে

স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে

খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রা নদী পারে

মোর পূর্বজনমের প্রথম প্রিয়ারে

মুখে তার লোধ্র রেণু, লীলাপদ্ম হাতে।

রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যভাবনা যেমন ‘মেঘদূত’ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল তেমনি প্রেমভাবনা সঞ্জীবিত হয়েছিল ‘কুমারসম্ভব’ ও ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ দ্বারা। এই প্রেম নিষ্কাম নয়। ‘বিজয়িনী’ কবিতায় নগ্নিকা নারীর স্নানের প্রস্তুতিপর্বের শৈল্পিক বর্ণনা দেন –

লুটায় মেখলাখানি ত্যাজি কটিদেশ

মৌন অপমানে; নুপূর রয়েছে পড়ি;

বক্ষের নিটোল বাস যায় গড়াগড়ি

ত্যাজিয়া যুগল স্বর্গ কঠিন পাষাণে।

… পরক্ষণে ভূমি – ’পরে

জানু পাতি বসি, নির্বাক বিস্ময়ভরে,

নতশিরে, পুষ্পধনু পুষ্পশরভার

সমর্পিল পদপ্রান্তে পূজা-উপচার

তূণ শূন্য করি। নিরস্ত্র মদন-পানে

চাহিলা সুন্দরী শান্ত প্রসন্ন বয়ানে।

‘বিজয়িনী’ কবিতায় নারীর শরীরী হিল্লোলের অপূর্ব চিত্রায়ণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ইতালির রেনেসাঁস শিল্পীদের অসামান্য শিল্পকর্মের উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে ছিল অনাবৃত নারী-সৌন্দর্যের নিটোল রূপ। বতিচেল্লির ‘ভেনাস’ বা জর্জিনোর ‘নিদ্রারত ভেনাস’ মুগ্ধতা ছড়ানো নগ্নতা নিয়ে শিল্পরসিকের সৌন্দর্যতৃষ্ণা পূরণ করে। ভার্জিন, ম্যাডোনার মতো চিত্রকর্ম ও পতিপুণ্যের অতীত নগ্ন সৌন্দর্যের প্রতীক। ‘বিজয়িনী’ কবিতায় রেনেসাঁসের সৌন্দর্যচেতনাকেই উন্মোচিত করেন রবীন্দ্রনাথ –

সোপানে-সোপানে, তীরে উঠিলা রূপসী –

স্রস্ত কেশভার পৃষ্ঠে পড়ি গেল খসি।

অঙ্গে অঙ্গে যৌবনের তরঙ্গ উচ্ছল

লাবণ্যের মায়ামন্ত্রে স্থির অচঞ্চল

বন্দী হয়ে আছে; তারি শিখরে-শিখরে

পড়িল মধ্যাহ্ন রৌদ্র ললাটে, অধরে,

ঊরু ’পরে, কটিতটে, স্তনাগ্রচূড়ায়,

বাহুযুগে, সিক্তদেহে রেখায় রেখায়

ঝলকে ঝলকে।

রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’ কবিতার উর্বশী প্রাচ্যপুরাণের সুরসুন্দরীর মতো দ্যুতিময়। তার ‘কুন্দশুভ্র নগ্নকান্তি’ কবিকে মুগ্ধ করেছে। উর্বশী যেন ইতালীয় রেনেসাঁসের অন্যতম দান ভেনাস বা আফ্রোদিতির পুনর্নির্মাণ। তার অনাবৃত সৌন্দর্য বিশ^প্রকৃতিতে চাঞ্চল্য ও বাসনা তৈরি করেছে –

মুক্তবেণী বিবসনে, বিকশিত বিশ^বাসনার

অরবিন্দ মাঝখানে পাদপদ্ম রেখেছ তোমার

অতি লঘুভার।

অখিল মানসস্বর্গে অনন্তরঙ্গিনী

হে স্বপ্নসঙ্গিনী

‘বিবসনা’ কবিতাটিও নিরাভরণ সৌন্দর্যের বর্ণনায় মুখর –

ফেলো গো বসন ফেলো, ঘুচাও অঞ্চল

পরো শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ

সুরবালিকার বেশ কিরণবসন।

রেনেসাঁসের শিল্পীদের সৌন্দর্যচেতনার ধারক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বতিচেল্লি, ভিঞ্চি, রাফায়েল, জোত্তো, জর্জিনো, টিশিয়ানের মতো চিত্রশিল্পী তাঁদের অসামান্য তুলিতে অনাবৃত নারীর সৌন্দর্যের দ্যুতি উপস্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যেন তাঁদের মতোই চিত্রকর হয়ে উঠেছেন ‘মানসসুন্দরী’ কবিতায় –

স্খলিতবসন তব শুভ্র রূপখানি

নগ্ন বিদ্যুতের আলো নয়নেতে হানি

চকিতে চমকি চলি যায়।

রেনেসাঁসের অন্যতম দান বিজ্ঞানমনস্কতা। কুসংস্কার ও অলৌকিকতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানচেতনা ও যুক্তিবাদের জয় ঘোষণা করে রেনেসাঁস। উনিশ শতকের শেষ পর্বে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ‘সবকিছু ব্যাদে (বেদে) আছে’ – এমন একটি ধারণা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে হিন্দুত্ববাদী শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে। এই অবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিরুদ্ধে সবসময় দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। যথার্থ রেনেসাঁসম্যান হিসেবেই ধর্মান্ধতাকে বিদ্রƒপবাণে বিদ্ধ করেছেন তিনি –

কহেন বোঝায়ে, কথাটি সোজা এ,

হিন্দুধর্ম সত্য –

মূলে আছে তার কেমেস্ট্রি আর

শুধু পদার্থতত্ত্ব।

টিকিটা যে রাখা, ওতে আছে ঢাকা

ম্যাগ্নেটিজম শক্তি,

তিলকরেখায় বৈদ্যুত ধায়

তাই জেগে ওঠে ভক্তি।

বিজ্ঞানচেতনা রবীন্দ্রনাথকে মুক্তচিন্তার অধিকারী করেছিল। মুক্তবুদ্ধির সাধক ছিলেন তিনি। জ্ঞানকে মুক্তধারার মতো অবারিত করার পক্ষপাতী রবীন্দ্রনাথ। ‘নৈবেদ্য’ কাব্যে বলেছেন – ‘চিরদিন জ্ঞান যেন থাকে মুক্ত, শৃঙ্খলবিহীন।’

অসংখ্য কবিতা ও গীতিকবিতায় প্রাণের উদ্ভব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানমনস্ক ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলা কবিতায় বিজ্ঞানচেতনার অনন্যসাধারণ প্রবর্তক তিনি। সৃষ্টিরহস্যের প্রতি কবির কৌতূহলের অসামান্য প্রকাশ ঘটেছে ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় –

সম্মুখে মেলিয়া মুগ্ধ আঁখি

সর্ব অঙ্গে সর্ব মনে অনুভব করি

তোমার মৃত্তিকা মাঝে কেমনে শিহরি

উঠিতেছে তৃণাঙ্কুর।

গ্রহ, নক্ষত্র ও সূর্য নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ রবীন্দ্রনাথ পেয়ে যান তাঁর পিতার কাছে। এ-বিষয়ে কবির নিজের কথা –

বয়স তখন হয়ত বারো হবে, পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ডালহৌসি পাহাড়ে। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে গিরিশৃঙ্গের বেড়া দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিষয় জানিয়ে দিতেন।

বত্রিশ বছর বয়সে রচিত সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থে তিনি লিখলেন –

ধীরে যেন উঠে ভেসে

মøানচ্ছবি ধরণীর নয়ন নিমিষে

কত যুগ যুগান্তর অতীত আভাস,

কত জীব-জীবনের জীর্ণ ইতিহাস

যেন মনে পড়ে সেই বাল্য নীহারিকা,

তারপরে প্রজ্বলন্ত যৌবনের শিখা

তারপরে স্নিগ্ধ শ্বাস অন্নপুণ্যালয়ে

জীবনদাত্রী জননীর কাজ বক্ষে লয়ে

লক্ষ কোটি জীব-কত যুদ্ধ,

কত মৃত্যু নাহি তার শেষ।

নীহারিকায় গ্যাস ধূলি প্রতিনিয়তই উত্তপ্ত হয়। আকর্ষণে-বিকর্ষণে চক্রগতি লাভ করে। ঘনীভূত হয়ে বাষ্প তেজসহ সূর্য তারকায় উদ্ভাসিত হয়। নভোবিজ্ঞানের এই সত্যে বিস্ময়-বিমূঢ় কবি গেয়ে ওঠেন –

আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ

তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার প্রাণ।

বিশ্বের যাবতীয় বস্তুর ব্যাখ্যা পরমাণু তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। পরমাণু বিজ্ঞান বিষয়েও কবির কৌতূহল কত গভীর ছিল, তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন নৈবেদ্য থেকে শুরু করে উৎসর্গ, গীতাঞ্জলির বহু কবিতা ও গানে। ‘নৈবেদ্য’-তে লেখেন –

এই স্তব্ধতায়

শুনিতেছি তৃণে তৃণে ধুলায় ধুলায়

মোর অঙ্গে রোমে রোমে লোক-লোকান্তরে।

গ্রহ সূর্য তারকায় নিত্যকাল ধরে।

অণু-পরমাণুদের নৃত্য কলরোল।

নীহারিকা চক্র থেকে নির্গত হয়ে এ বিশ্বের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে কবি নিমগ্ন থেকেছেন। এই বিষয়ে বৈজ্ঞানিকদের পরীক্ষিত ধারণার নির্যাস তিনি উৎসর্গের একটি কবিতায় ব্যক্ত করেছেন –

আকাশ সিন্ধুর মাঝে এক ঠাঁই

কিসের বাতাস লেগেছে

জগৎ ঘূর্ণি জেগেছে

ঝলকি উঠেছে রবি-শশাঙ্ক

ঝলকি উঠেছে তারা

অযুত চক্র ঘুরিয়া উঠেছে

অবিরাম মাতোয়ারা।

কবি গভীরভাবে মহাকাশপ্রেমী। এর অপূর্ব নিদর্শন তাঁর বলাকা কাব্যগ্রন্থের ‘ছবি’ কবিতাটি। এই কবিতার শুরুতে বিগতা কোনো মানবীর প্রতিকৃতির নীরবতা নিয়ে কবির প্রশ্ন ‘তুমি কি কেবলই ছবি’। এই ছবি ধারণার বিপরীত দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে তিনি জীবনের চারপাশের উপমা নিলেন না, উপমা খুঁজে পেতে তিনি পাড়ি দিলেন মহাকাশে অর্থাৎ তাঁর মনন চলে গেল আকাশ ছাড়িয়ে মহাকাশে। ‘ছবি’ কবিতাটিতে উপমা প্রয়োগ করে তিনি লিখেছেন –

ওই যে সুদূর নীহারিকা

যারা করে আছে ভিড়

আকাশের নীড়

ওই যারা দিনরাত্রি

আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী

গ্রহ তারা রবি

তুমি কি তাদের মতো সত্য নও?

সৃষ্টির আদিম ইতিহাস থেকে সৃষ্টিশীল মানুষের আগমনের কাহিনী বিজ্ঞান যেভাবে সাজিয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের পাতায়, রবীন্দ্রনাথ তাকে আত্মস্থ করে রূপায়িত করেছেন তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিমালায়। প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশের বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিলেন তিনি। বিশ^জগৎ সৃষ্টির কোনো অলৌকিক ব্যাখ্যায় কবির আস্থা নেই। জন্মদিনে কাব্যগ্রন্থের ২০-সংখ্যক কবিতায় সম্পূর্ণ বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি পৃথিবী সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিয়েছেন –

লক্ষ কোটি নক্ষত্রের

অগ্নি-নির্ঝরের যেথা নিঃশব্দ জ্যোতির বন্যাধারা

ছুটেছে অচিন্ত্য বেগে নিরুদ্দেশ শূন্যতা প্লাবিয়া

দিকে দিকে,

তমোঘন অন্তহীন সেই আকাশের বক্ষস্তলে

অকস্মাৎ করেছি উত্থান

অসীম সৃষ্টির যজ্ঞে মুহূর্তের স্ফুলিঙ্গের মতো

ধারাবাহী শতাব্দীর ইতিহাসে।

এরপর জ্যোতির্বাষ্পরূপ ত্যাগ করে একদিন পৃথিবী বর্তমান

আকৃতি ধারণ করেছে –

এসেছি সে পৃথিবীতে যেথা কল্প কল্প ধরি

প্রাণপঙ্ক সমুদ্রের গর্ভ হতে উঠি

জড়ের বিরাট অঙ্কতলে

উৎঘাটিল আপনার নিগূঢ় আশ্চর্য পরিচয়

শাখায়িত রূপে রূপান্তরে।

সৃষ্টির প্রথম ভাগে জল ও স্থল বিভাজনের পর যখন জীবলোকের আবির্ভাব ঘটেনি তখন –

যে প্রাণ নিস্তব্ধ ছিল মরুদুর্গতলে

প্রস্তরশৃঙ্খলে

কোটি কোটি যুগ যুগান্তরে।

যে প্রথম যুগে তুমি দেখা দিলে নির্জন প্রান্তরে,

রুদ্ধ অগ্নিতেজের উচ্ছ্বাস

উদ্ঘাটন করি দিলো ভবিষ্যের ইতিহাস –

সেই প্রাণের বার্তা নিয়ে বৃক্ষ এলো শাখা-পল্লবের বিজয়-বৈজয়ন্তী উড্ডীন করে। ‘মৃত্তিকার বীর সন্তান’ বৃক্ষের প্রতি কবির

বন্দনা –

তুমি, বনস্পতি

মোর জ্যোতি বন্দনায় জন্মপূর্ব প্রথম প্রণতি।

ক্রমে সমুদ্র থেকে ঘটল প্রাণের বিস্তার। মাটিতে প্রাণের বিস্তার হতে স্তন্যপায়ী জীব জন্মাতে আরো বহু কোটি বছর লেগেছে। বানর জাতীয় প্রাণীর বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে এখন থেকে আড়াই কোটি বছর আগে, মানুষের পূর্বপুরুষ দেড় কোটি বছর আগে। মানুষ এসেছে কয়েক লক্ষ বছর মাত্র। বিবর্তনের এই চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কয়েকটি ছত্রে –

অসম্পূর্ণ অস্তিত্বের মোহাবিষ্ট প্রদোষের ছায়া

আচ্ছন্ন করিয়া ছিল পশুলোক দীর্ঘযুগ ধরি;

কাহার একাগ্র প্রতীক্ষায়

অসংখ্য দিবসরাত্রি – অবসানে

মন্থরগমনে এল

মানুষ প্রাণের রঙ্গভূমে;

‘শেষ সপ্তক’-এর একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন –

অণু পরমাণু অসীম দেশে কালে

বানিয়েছে আপন নাচের চক্র

নাচছে সেই সীমায় সীমায়

গড়ে তুলছে অসংখ্য রূপ।

তার অন্তরে আছে বহ্নিতেজের দুর্দাম বোধ

সেই বোধ খুঁজছে আপন ব্যঞ্জনা

ঘাসের ফুল থেকে শুরু করে

আকাশের তারা পর্যন্ত।

সাধারণত দেখা যায়, শেষ জীবনে জরাপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনোজগৎ দৈবনির্ভর হয়ে ওঠে। যৌবনে প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণা পোষণ করলেও বার্ধক্যপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে পশ্চাৎপদ চিন্তা বিস্তারলাভ করে। বাঙালি মনীষীদের অনেকের মধ্যেই এই প্রবণতা দৃশ্যমান। আশ্চর্য ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ। আশি বছরে পদার্পণ করেও তাঁর মন যৌবনের দীপ্তিতে ভাস্বর। শারীরিক দুর্বলতা তাঁর মনকে দুর্বল করতে পারেনি। যে বিজ্ঞানচেতনাকে এতদিন ধারণ করেছেন জীবনের শেষ বছরেও তা অটুট –

জীবনের আশি বর্ষে প্রবেশিনু যবে

এ বিস্ময় মনে আজ জাগে –

লক্ষকোটি নক্ষত্রের

অগ্নিনির্ঝরের যেথা নিঃশব্দ জ্যোতির বন্যাধারা

ছুটেছে অচিন্ত্যবেগে নিরুদ্দেশ শূন্যতা প্লাবিয়া

দিকে দিকে,

তমোঘন অন্তহীন সেই আকাশের বক্ষস্থলে

অকস্মাৎ করেছি উত্থান

অসীম সৃষ্টির যজ্ঞে মুহূর্তের স্ফুলিঙ্গের মতো

ধারাবাহী শতাব্দীর ইতিহাস।

বিচিত্র দিকে রবীন্দ্রপ্রতিভার অসামান্য বিকাশ ঘটলেও তিনি মূলত কবি। বাংলা কবিতায় বিশ^জনীন দৃষ্টিভঙ্গির অসামান্য রূপকার তিনি। তাঁর রেনেসাঁস চেতনার অন্যতম ধারক তাঁর নিয়ত গতিশীল কাব্যপ্রবাহ। ‘বিশ^কবি’ অভিধাটি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় রেনেসাঁস ভাবনারই দ্যোতক। বিশে^র সঙ্গে স্বদেশের, বিশ^মানবের সঙ্গে বাঙালির সেতুবন্ধন গড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই সেতুবন্ধনের প্রেরণা রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছিলেন রেনেসাঁস থেকে।