প্রবাল রঙের বিকাল

সূর্য ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে শীতের অবসন্ন দিন শেষে অফিস শেষ করে রাস্তায় হাঁটছি। দিন সাতেক হলো রাজবাড়ীতে বদলি হয়ে এসেছি। নতুন জায়গা, অনেক কিছুই চিনি না, জানি না। তবে আমার পুরনো অভ্যাসটাকে বজায় রাখার জন্য পত্রপত্রিকার দোকানগুলি খুঁজে বের করেছি। এসব দোকানে দাঁড়িয়ে পত্রিকার পাতা ওল্টানো, কখনো কোনো বই ভালো লাগলে সেটা কিনে ফেলা আমার বহুদিনের অভ্যাস। ওটা নেশার মতো হয়ে পড়েছে। ছাপোষা মানুষ হিসেবে বিনোদনের কিছুই নেই আমার জীবনে। পত্রিকা পড়লে অনেক কিছু জানা যায়, আবার বিনোদনের কাজটাও হয়ে যায়।

জেলা শহর হলেও মানুষের কমতি নেই কোথাও। অপ্রশস্ত ফুটপাতে হাঁটতে গেলে ধাক্কা লাগে। এসব শহরের ফুটপাতেও বেচাকেনার দোকান বসে। রিকশাজট হয়। বিকালে দাঁড়িয়েছিলাম এক পত্রিকার দোকানের সামনের রাস্তায়। লোকজন ছুটছে হেঁটে, কেউ রিকশায়। একটু দূরেই মানুষের জটলা। কখনো রাস্তার আশেপাশে জটলা দেখলে দাঁড়িয়ে পড়া আমার অভ্যাস। আর পাঁচজন বাঙালির মতো আমারও এ-ব্যাপারে কৌতূহলটা একটু বেশি। মাঝে মাঝে এসব জটলার মধ্যেও বিনোদনের বিষয় পেয়ে যাই। অফিসের ক্লান্তির পর একটু আনন্দ জোগাড় করে নিই নিজেই। পত্রিকার দোকানটার পাশেই যে-স্কুল, ওটার সামনের সবুজ মাঠে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। চলে গেলাম সেদিকে। গিয়ে দেখি চারপাশে উৎসুক দর্শক, মাঝখানে একজন লোক উচ্চস্বরে কিছু বলছে। ভাবভঙ্গিতে অভিনয় করছে বলেই মনে হলো, পথনাটক হবে হয়তো। এই মাসটাতে মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য শিল্পীরা পথে নামেন। ভিড়ে গেলাম দর্শকদের মধ্যে। লোকটার বয়স সত্তরের একটু কম অথবা বেশি হবে। গায়ের রং শ্যামলা। মাথার সাদা চুল লতিয়ে পড়েছে ঘাড়ের ওপর। কপালের ওপর থেকে পেছন দিকটাতে লাল কাপড়ের ফেটি বাঁধা। বেশ শক্ত-সমর্থ শরীর। গলার স্বরও বেশ ভারি। পরনে ময়লা ফুল প্যান্ট, গায়ে একটা পুরনো কালো কোট চাপানো। লোকটার কাছে আনাড়ি হাতের তৈরি একটা কাঠের রাইফেল। দুটো লাল চোখ নাচিয়ে লোকটা চিৎকার করে সংলাপ বলছেন। আমি দ্রুত ভিড়ের ভেতরে দর্শক হিসেবে আমার অবস্থানটা পাকাপোক্ত করলাম। দেখি কী করে লোকটা!

দর্শকদের বেশিরভাই সিরিয়াসলি লোকটার অভিনয় দেখছিল। মাঝে মাঝে অতি উচ্ছ্বাসের কারণে হাততালি দিচ্ছিল। এটা-ওটা মন্তব্য কানে আসতে লাগল। আমার দৃষ্টি তখন লোকটার ওপর নিবদ্ধ। দ্রুত তিনি সংলাপ আওড়াচ্ছিলেন। কখনো শুদ্ধ ভাষায়, কখনো এই জেলার আঞ্চলিক ভাষায়। আচমকা লোকটা ভিড়ের ভেতর থেকে একজন প্রৌঢ়কে টেনে নিয়ে সামনে দাঁড় করালেন। প্রৌঢ় লোকটা আমার মতোই কৌতূহলী দর্শক, তবে খুবই গরিব, পরনে পাতলা লুঙ্গি আর গায়ে একটা ছেঁড়া চাদর জড়ানো। তিনি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন লোকটার সামনে। লোকটা একটু পিছিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড চিৎকারে কমান্ড করলেন – ‘প্যারেড!’ চমকে উঠলেন সবাই। চারপাশে তাকালেন লোকটা। অনুসন্ধিৎসু চোখ নিয়ে দেখলেন একবার। নিঃশব্দ সবাই। এবার ‘অ্যাটেনশন’ বলেই তিনি তাঁর বাঁ পায়ের পাশে থপাস করে ডান পায়ের পাতাটা ফেলে সটান দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর বুকটা উঁচু, টানটান। ভাস্কর্যের মতো স্থির। ঘাড়ের ওপর কাঠের রাইফেল। গম্ভীর গলায় আবার বললেন – ‘অ্যাটেনশন, পরবর্তী নির্দেশ আসছে সবাই সাবধান, মা-র্চ-টা-ই-ম, লেফট রাইট, লেফট রাইট।’ সামরিক কায়দায় তিনি ওই জায়গাটুকুর মধ্যে বুক ফুলিয়ে ঘুরতে লাগলেন। মাটি কাঁপানো তাঁর পায়ের শব্দ থপ্ থপ্ থপ্ থপ্। লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ় কাঁচুমাঁচু করছিলেন। তিনি কিছু বলার জন্য ছটফট করতে লাগলেন। মার্চ করা থামিয়ে এবার লোকটা তার রাইফেলটা প্রৌঢ় লোকটার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা শক্ত করে ধরো।’ প্রৌঢ় বোকার মতো রাইফেলটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে

থাকলেন লোকটার দিকে। লোকটা এবার কাছে গিয়ে রাইফেলের বাঁটে হাত দিয়ে প্রৌঢ়ের একটা হাত টেনে বাঁটের ওপর রাখলেন, তারপর বললেন – ‘আমার সাথে বলো – বাঁট, মাঝখানের অংশটা বডি, বডির ওপর সরু নল এটাকে বলে ব্যারেল। বাঁটটা কাঠের, বডিটা ইস্পাতের এর মধ্যেই সব কলকব্জা। আর এই যে ব্যারেল এটাও ইস্পাতের তৈরি, এর ভিতর দিয়েই ঠাঠা শব্দে গুলি বেরিয়ে গিয়ে শত্রুর বুক ফুটো করে দেয়, বুঝতে পারছ?’ দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ় কিছুই বুঝলেন না, তিনি রাইফেলটা হাতে নিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘কী জ্বালায় পল্লাম কনতো দেহি, আমি আইছি আমার পরিবারের শাড়ি-কাপড় কিনতি, তার শাড়ি ছিঁইড়ে ত্যানা ত্যানা হয়্যা গেছে, আর আমারে শেহাচ্ছে লাইফল চালাইনে।’ প্রৌঢ়ের কথা শুনে হুংকার ছাড়লেন লোকটা – ‘কথায় কথায় কান্না, কাপুরুষ, চোখের পানিতে বুক ভাসালে কিছু হবে না। কেউ সাহায্য করবে না। সবাই নিজেরটা নিয়ে ব্যস্ত। সোজা হয়ে দাঁড়াও। বুক টান টান করে দাঁড়াও। বলো, বাঁট, বডি, ব্যারেল।’ রাইফেলটার তিন অংশে হাত রেখে ওটা চিনিয়ে দিচ্ছিলেন প্রৌঢ়কে। প্রৌঢ় এবার লোকটার সামনে রাইফেলটা এগিয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন – ‘এইডে দরেন বাই, আপনের জিনিস আপনে নেন, আমি হারাদিন পোরেত খাটিছি, এ্যাট্টা শাড়ি কিইনে নিয়ে ভ্যানগাড়ি ধরবো, ছাওয়ালের মা আর কতোদিন ত্যানা জড়ায়ে থাকপি, লাইত হলি বিপদ হবেনে, নাস্তাঘাত ভালো না।’ প্রৌঢ়ের এই আবেদনে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না লোকটার। তিনি নির্বিকারচিত্তে প্রৌঢ়কে জিজ্ঞাসা করলেন –

‘কী নাম তোমার?’

‘দলিল মণ্ডল।’

‘থাকো কোথায়?’

‘এহেনতে ছয় মাইল দূরি, আসমানখালি।’

‘আসমানখালির মানুষ। হায়রে,

মাথার ওপরে যার নীল আসমান, সে কিনা রাইফেল দেখে এত ভয় পায়! ছি ছি ছি! কী করো তুমি?’

‘চাষ-বাস করি, চাষা।’

‘চাষা? লাঙল চষো? লোহার কঠিন ফালা মাটির নরম শরীরে ঢুকিয়ে দাও, মাটি ফুটো হয়ে চিরে যায়, তাই না?

মাথার ঘাম পায়ে ফেল, চাষ করে ভাত হয়?’

‘হারা বছর হয় না।’

‘কতদিন হয়? জোরে বলো, সব মানুষ শুনুক।’

‘ছয় মাস।’

‘বাকি ছয় মাস উপোস?’

‘না, মাইনষের বাড়ি বাড়ি পোরেত দিই, গরিবির দিন চইলি যায়।’

‘খবরদার। নিজেকে গরিব বলবে না, কিসের গরিব? গরিব হতে যাবে কোন দুঃখে? বলো ভালো মানুষ, সবাই দেশটাকে লুট করলেও তুমি করোনি। চাষারা গরিব না, চাষা হলো দুনিয়ার রাজা, সে পৃথ্বীরাজ, সে কি গরিব হয়?’

‘অয় বাই, অয় …’

‘খামোশ বেকুব …’

ছুটে এসে প্রৌঢ়ের হাত থেকে রাইফেলটা কেড়ে নিলেন লোকটা। রাইফলটা লাঠির মতো মাথার ওপর তুলে ধরে চিৎকার করে উঠলেন – ‘ইরফান আলীর সাথে তর্ক করো মূর্খ! সাহস তোমার কম না, তোমার মতো শত শত লোককে আমি শেখাতে পারি, জানো?’ কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আসমানখালির বুকের পাশে নদী নাই?’

‘আছে।’

‘কী নাম সেই নদীর?’

‘পদ্মা।’

‘তাহলে নদীর ধারেই বাস। পদ্মার পানি দেখেছো?’

‘দেকছি, ওই পানিতি মাছ ধরি, দ্যাকপোনা ক্যা?’

‘বলো, পদ্মার পানির রংটা কি?’

‘পানির আবার নঙ কি? নঙ নাই।’

‘কিন্তু আমি দেখেছি। পঞ্চাশ বছর আগে, পদ্মা মেঘনা যমুনার সব পানি লাল টকটকে, লাল পানির বহর মিশে যাচ্ছে সাগরে, তুমি দেখোনি?’

‘কি সব ইজিবিজি কইতিছেন?’

‘খবরদার মূর্খ কোথাকার আমি হাবিজাবি বলছি? জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব, বেইমানের দল, সব ভুলে গেছো, না! এত সহজেই সবকিছু ভুলে যাচ্ছো, অকৃতজ্ঞ?’

‘না, না, ভুলি নাই, আপনে কন (প্রৌঢ় ভীষণ ভয় পেয়ে যায়)।’

‘এবার বলো, পদ্মাপাড়ের মানুষের গায়ের রং কেমন?’

‘কী মুশকিল অইলো, খালি খালি নঙ নঙ করতিছেন ক্যান? আমি কি এইড্যা জানি?’

‘না জানলে হবে না, জানতেই হবে। নিজেকে চিনতে হবে, ঠিক আছে তুমি যখন জানো না, ইরফান আলীর দায়িত্ব তোমাকে চিনিয়ে দেওয়া।’ হঠাৎ লোকটা প্রৌঢ়ের সামনে এগিয়ে গিয়ে তার কোটের বোতামগুলো খুলে চিৎ হয়ে নুয়ে পড়লেন পিছন দিকে, আলগা বুকটা প্রৌঢ়ের সামনে তুলে ধরে বললেন – ‘কি রং বলো?’

‘কি মুশকিল এ-তা আমি কবো কেমনে? আরো মানুষ আছে তাগোরে কন।’

উৎসুক দর্শক লোকটার বুকটা দেখতে চায়। ‘দেখি, দেখি ভাই, একটু এদিকে আসেন, দেখি বুকের রংটা।’ লোকটা গোল বৃত্তের ভেতরে তার খালি বুকটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাচ্ছেন আর বলছেন – ‘বলেন, কী রং, বলেন কী রং?’ হঠাৎ প্রৌঢ় এবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন।

‘আমি কবো?’

‘হ্যাঁ বলো, তোমাকেই তো প্রথমে জিজ্ঞাসা করেছি।’

‘তামার পয়সার নাহাল।’

আনন্দে ঝলসে ওঠে লোকটার মুখ। বুক বন্ধ করে তিনি পিছিয়ে গিয়ে তুড়ি মেরে বলেন, ‘শাবাশ! চাষার বাচ্চা চাষা, ঠিক ধরেছো, পদ্মাপারের মানুষের রং তামার পয়সার নাহাল, তামাটে, তুমি ধরলে কী করে?’

‘একবার দেহেই চিনে ফেললাম।’

‘খুব খুশি লাগছে। এবার তোমাকে বলতে হবে, পদ্মাপারের মাটির নাম কি? যে মাটিতে তুমি সারাজীবন লাঙল চষেছো? ফসল উৎপাদন করেছো। এই মাটির নাম কী?’

‘কী মুশকিল, এ্যাটা কতি পারিছি দেহে কি সবই কতি পারবো? আরো মানুষ আছে তাগেরে কন?’

দর্শকদের দিকে তাকিয়ে লোকটা বললেন – ‘আপনারা বলতে পারেন কেউ এই মাটির নাম কী? বলেন কে কে বলবেন।’

একজন হাত তুলে বললেন, ‘আমি পারি, আমি বলবো।’

‘তাহলে বলেন।’

‘মাটির নাম বাঙলা।’ সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সমস্ত দর্শক জোরে বলে ওঠেন – ‘বাঙলা।’ হাততালি দেন সবাই উচ্ছ্বাসে।

‘বাঙলা, মাটির নাম বাঙলা। আহা নিজের মাটি …।’

এবার লোকটা নিচের দিকে তাকান, এই মাটি, তিনি সবুজ ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে বলেন – ‘শান্তি, শান্তি।’ অনেকক্ষণ লাফালাফি করে তিনি ভীষণ ক্লান্ত। হাঁপাচ্ছেন তিনি। দ্রুত শ্বাস নিচ্ছেন। লোকটা এবার উপুড় হয়ে শুয়ে পরম স্নেহে মাটির গায়ে হাত বুলান। দর্শকদের কৌতূহল বেড়ে গেল। তারা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। সবাই দেখতে চানন কী করছেন লোকটা। হঠাৎ তিনি লাফিয়ে উঠে, ভয়ংকর চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন, ‘হুঁশিয়ার সাবধান।’ দু-হাতে মাথার ওপরে তুলে ধরেন রাইফেলটি। তিনি বলে চলেছেন – ‘বাঙলা মাটির ওপর এখন নিমকহারামি চলছে, নিমকহারামের বাচ্চারা বাড়ছে হু-হু করে, এদের থামাও, তা না হলে এই রাইফেল গর্জন করে উঠবে।’ কাঠের রাইফেলটা বুকের ওপর বসিয়ে গুলি চালানোর ভঙ্গি করে বলেন, ‘ঠা-ঠা-ঠা-ঠা, বাঙলার মাটি বড়ো শক্ত ঘাঁটি …।’

পড়ন্ত বিকেলের শেষ সময়ে আমি অবাক হয়ে লোকটির অভিনয় দেখছিলাম। লোকটা বারবার মাটির কথা বলে চলেছেন। হঠাৎ করেই একজন যুবক এলো সেখানে। ভিড় ঠেলে ভেতরে গিয়ে লোকটার একটা হাত চেপে ধরল। লোকটা যুবকের দিকে তাকালেন। যুবক বলল, ‘কখন থেকে খুঁজছি, মা কাঁদছে, বাড়ি চলো।’ যুবকের কথা শুনে লোকটা যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। এতক্ষণ তিনি কী করছিলেন সব বুঝতে পারলেন। যুবক লোকটার হাত ধরে ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলো। রাইফেলটা কাঁধে নিয়ে ছোট্ট বালকের মতো যুবককে অনুসরণ করলেন লোকটা।

আমি অবাক হলাম। এটাই কি এ-নাটকের শেষ দৃশ্য! দ্রুত এগিয়ে যাওয়া যুবকের সামনে গিয়ে বললাম, ‘কী ব্যাপার, নাটক শেষ?’ যুবক আমার কথা বুঝতে পারল কি না জানি না, সে বলল, ‘আমার বাবা। ডিসেম্বর মাস এলেই আর ঘরে রাখা যায় না, উত্তেজনায় ছটফট করেন।’