সম্মানীয়া বারাঙ্গনা

ইংরেজি অনুবাদ : কিটি ব্ল্যাক

বাংলা রূপান্তর : সুব্রত বড়ুয়া

চরিত্রগুচ্ছ

লিজি

নিগ্রো

ফ্রেড

জন

জেমস

সিনেটর

শহরবাসীগণ

দৃশ্য প্রথম

[দক্ষিণের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত হোয়াইট ওয়ালস্ শহরের একটি বাড়ির একটি কক্ষ। কক্ষটিতে রয়েছে একটি ডিভানশয্যা। ডানদিকে একটি জানালা। বাঁয়ে স্নানকক্ষে যাওয়ার দরজা। পেছনে সামনের দরজায় যাওয়ার পথে একটি ছোট ঘর। পর্দা ওঠার আগে, ঝড়ের মতো একটি শব্দ শোনা যেতে থাকবে মঞ্চে। পর্দা ওঠার পর দেখা যাবে লিজি একা বসে আছে ঘরটিতে। লিজির পরনে একটি স্কার্ট ও গায়ে একটি ব্লাউজের মতো জামা। লিজি কাজে ব্যস্ত একটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার হাতে। দরজার বেল বেজে ওঠে। লিজি একটু ইতস্তত করে, স্নানকক্ষের দরজার দিকে তাকায়। দরজার বেলটি আবার বেজে ওঠে। সে হুভারটি থামায় এবং স্নানকক্ষের দরজার কাছে গিয়ে সেটি সামান্য একটু খোলে।]

লিজি [মৃদুস্বরে] : দরজায় কেউ যেন এসেছে। এখন বাইরে এসো না। [সে বাইরের দরজা খোলে। নিগ্রো লোকটি দরজা জুড়ে এসে দাঁড়ায়। খুব লম্বা লোকটি, বেশ হৃষ্টপুষ্ট। মাথার চুল সাদা। জড়োসড়োভাবে দাঁড়িয়ে থাকে লোকটি।] কী ব্যাপার? তুমি ভুল জায়গায় এসেছো। [একটু থেমে] ঠিক আছে। কী চাও তুমি? কথা বলছ না কেন?

নিগ্রো : [বিনীত ভঙ্গিতে] প্লিজ, ম্যাম, প্লিজ, ম্যাম।

লিজি : প্লিজ, কেন? [সে আরো মনোযোগ দিয়ে নিগ্রোটির দিকে তাকায়।] এক মিনিট। তুমি ট্রেনে ছিলে না? পালিয়েছো তাহলে! আমার ঠিকানা কোথায় পেলে?

নিগ্রো : আমি খুঁজেছি, ম্যাম। সব জায়গায় আমি তা খুঁজেছি। [সে এক কদম এগিয়ে আসে।] প্লিজ, ম্যাম।

লিজি : ভেতরে আসবে না। এখানে অন্য কেউ আছে। কি চাও তুমি?

নিগ্রো : কিছু না।

লিজি : সেটা কী? কী সেটা? তুমি কি টাকা চাও?

 নিগ্রো [একটু থেমে] : প্লিজ, ম্যাম, ওঁকে বলে দিন – আমি কিছুই করিনি।

লিজি : কাকে বলব?

নিগ্রো : জজ সাহেবকে। ওনাকে বলে দিন, প্লিজ, ম্যাম, জজ সাহেবকে বলে দিন, আমি কিছু করিনি।

লিজি : দেখো, আমি ওনাকে কিছুই বলব না। আমার নিজেরই অনেক ঝামেলা যাচ্ছে এখন, অন্য কারো ব্যাপারে নাক না গলিয়েই। তুমি চলে যাও এখন।

নিগ্রো : আপনি জানেন, আমি কিছুই করিনি।

লিজি : অবশ্যই, তুমি কিছু করোনি। কিন্তু আমি কোনো বিচারকের কাছে যাব না। বিচারক আর পুলিশ – ওরা আমাকে ঝামেলায় ফেলবে – যন্ত্রণা দিয়ে মারবে।

নিগ্রো : আমার একটা বউ আছে, বাচ্চাও আছে কয়েকটা…। আমি সারা রাত ধরে হাঁটছিলাম। এখন হাঁটার শক্তিও নেই।

লিজি : এই শহর থেকে বেরিয়ে যাও।

নিগ্রো : ওরা রেলপথগুলিতে পাহারা বসিয়েছে।

লিজি : কারা পাহারা বসিয়েছে?

নিগ্রো : সাদা লোকেরা।

লিজি : কোন সাদা লোকেরা?

নিগ্রো : সব সাদা লোকেরাই। আজ সকালে আপনি বাইরে যাননি?

লিজি : না, আমি যাইনি।

নিগ্রো : রাস্তাগুলিতে কত লোক! অল্পবয়সী আর বুড়োরা; ওরা সবাই জড়ো হয়ে কথা বলছে।

লিজি : কী বলতে চাইছো তুমি?

নিগ্রো : আমি বলছি, আমি কেবল পালাতে থাকবো, পালাতেই থাকবো, ওরা আমাকে ধরে না ফেলা পর্যন্ত। সাদা লোকেরা যখন অপরিচিত লোকদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে, তখন কিছু কালো লোক তো মারা যাবেই। [একটু থেমে] ওদের বলে দিন, ম্যাম, আমি কিছু করিনি। জজ সাহেবকেও বলেন। খবরের কাগজের লোকদেরও বলুন। আপনি যা বলবেন ওরা হয়তো তা ছাপতে পারে। ওদের বলুন, ম্যাম, বলুন দয়া করে, বলুন ওদের।

লিজি : চিৎকার করবে না। আমি তো বলেছি তোমাকে – ওখানে একজন আছে। [একটু থেমে] পত্রিকাগুলিকে বলে দাও – তোমার ওপর যেন হামলা না হয়। ঠিক এই সময়ে আমি কোনো খবরের বিষয় হতে চাই না। [একটু থেমে] ওরা যদি একজন সাক্ষী হিসেবে ডাকে, তাহলে, আমি প্রতিজ্ঞা করছি – সত্যিটাই আমি বলব।

নিগ্রো : আপনি ওদের বলবেন যে, আমি কিছু করিনি।

লিজি : আমি ওদের বলবো।

নিগ্রো : প্রভুর দোহাই! আপনি ওদের বলবেন, ম্যাম?

লিজি : হ্যাঁ, হ্যাঁ।

নিগ্রো : প্রভুর দোহাই! আপনি ওদের সত্যিই বলবেন তো?

লিজি : ওহ্! গোল্লায় যাও। আমি তো বলেছি – বলবো ওদের। আর কী চাও? [একটু থেমে] এবার যাও, বেরিয়ে যাও।

নিগ্রো [আকস্মিকভাবে] : প্লিজ, ম্যাম, আমাকে একটু লুকিয়ে রাখুন।

লিজি : তোমাকে লুকিয়ে রাখবো?

নিগ্রো : রাখবেন না, প্লিজ?

লিজি : লুকিয়ে রাখবো! আমি? সেটা কি সম্ভব? [নিগ্রোটির মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয় সে।] ভাগো। অনেক ঝামেলা গেছে আমার ওপর দিয়ে। [সে স্নানকক্ষের দিকে ফেরে।] তুমি বেরিয়ে আসতে পারো এখন। [স্নানকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে ফ্রেড। পরনে তার শুধু প্যান্ট-শার্ট, গলায় কোনো টাইও নেই।]

ফ্রেড :  লোকটা কে?

লিজি : কেউ না।

ফ্রেড : আমি ভেবেছিলাম পুলিশ।

লিজি : পুলিশ? এই, তোমার কি পুলিশের সঙ্গে কোনো সমস্যা আছে?

ফ্রেড : আমার? না। আমি ভেবেছিলাম তোমার হয়তো আছে।

লিজি [আহতস্বরে] : ঠিক আছে। আমি কখনো কারো কাছ থেকে এক পয়সাও চুরি করিনি।

ফ্রেড : পুলিশের সঙ্গে তোমার কখনো কোনো ঝামেলা হয়নি?

লিজি : চুরির জন্য নয় কখনো। [সে এবার হুভার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হুভারের শব্দ কান ঝালাপালা করে দেয়।]

ফ্রেড [শব্দে বিরক্ত] : এই, কী করছো?

লিজি [ওর কথা যাতে শোনা যায় সেরকম চিৎকার করে।] : কী হয়েছে, সোনা?

ফ্রেড [চিৎকার করে] : তোমার হুভারের শব্দে আমার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে।

লিজি [চিৎকার করে] : এই শেষ হয়ে এসেছে। [একটু পর] আমি ওরকমই।

ফ্রেড [চিৎকার করে] : কী-রকম?

লিজি [চিৎকার করে] : ওরকম। পরদিন সকালে আমাকে গোসল করতে হয় আর হুভার দিয়ে কার্পেট ঘষতে হয়। [সে হুভার বন্ধ করে।]

ফ্রেড [বিছানার দিকে নির্দেশ করে] : যখন বিছানায় শুয়ে পড়তে যাও তখন একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দেবে।

লিজি : কী?

ফ্রেড : বিছানা। বলেছি, ওটা ঢেকে রাখবে। ওখান থেকে পাপের দুর্গন্ধ বের হয়।

লিজি : পাপ? শব্দটা তুমি কোথায় শিখেছ? তুমি নিশ্চয় পাদ্রীসাহেব নও, নাকি তুমি পাদ্রীসাহেব?

ফ্রেড : না, নই। কেন?

লিজি : তুমি ওদের মতো করে কথা বলছ। [ফ্রেডের দিকে তাকায় সে।] না, তুমি পাদ্রীসাহেব নও, তুমি অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন। দেখি, তোমার আংটিটা দেখি। [বিস্ফারিত চোখে] ওরে বাব্বা! তুমি তো বেশ বড়লোক দেখছি।

ফ্রেড : হ্যাঁ।

লিজি : অনেক বড়লোক?

ফ্রেড : অনেক।

লিজি : খুব ভালো। [সে বাহু দিয়ে ফ্রেডের গলা জড়িয়ে ধরে এবং ঠোঁট এগিয়ে দেয়।] আমার মনে হয়, একজন পুরুষ মানুষের বড়লোক হওয়াটাই অনেক ভালো। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। [ফ্রেড ওকে চুমু খায় না এবং এক মুহূর্ত পর মুখটা ঘুরিয়ে নেয়।]

ফ্রেড : বিছানাটা ঢেকে দাও।

লিজি : ঠিক আছে। ঠিক আছে। ঢেকে দিচ্ছি। [বিছানা ঢেকে দেয় সে। তারপর হঠাৎ হাসতে শুরু করে।] ‘পাপের দুর্গন্ধ বের হয়।’ আমার মাথায় কখনো এমন চিন্তা আসেনি। তুমি জানো, মহাশয়, এটা তোমার পাপ। [ফ্রেড একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায়।] হ্যাঁ, আমি জানি, এটা আমারও পাপ। কিন্তু আমি জানি, আমার বিবেকের গায়ে কত যে পাপ আছে …। [বিছানার ওপর বসে পড়ে সে এবং ফ্রেডকেও টেনে বসায় পাশে।] এসো এখানে। এসে বসো। অন্যদিকে চেয়ে থেকো না। আমি কি তোমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছি? [ফ্রেড হঠাৎ জোরে চেপে ধরে ওকে বুকের মধ্যে।] ব্যথা দিচ্ছো তুমি আমাকে। [ফ্রেড ছেড়ে দেয় ওকে।] হাঃ! হাঃ! বেশ মজার লোক তুমি! [একটু পর] এই, কী নাম তোমার? বলো! তোমার নাম না-জানাটা আমার পছন্দ নয়। ওরা কদাচিৎ ওদের পদবিটা আমাকে বলে। আমি সেটা বুঝতে পারি। কিন্তু ওদের নামের প্রথম অংশটা! আমি যদি তোমাদের নাম না জানি, তাহলে কী করে বলবো আমি তোমরা কে বা কারা? বলো, সোনা, বলে ফেলো দেখি!

ফ্রেড : না।

লিজি : ঠিক আছে। তুমিই হবে সেই লোক যার কোনো নাম নেই। [সে উঠে দাঁড়ায়।] দাঁড়াও, আমি ঘরটা ঠিকঠাক করে নিই। [ঘরের দু-একটা আসবাব এদিক-ওদিক সরিয়ে রাখে] ওখানে। ওখানে। এবার সবকিছু আবার ঠিক হয়েছে। টেবিলের চারপাশের চেয়ারগুলি – সবকিছু বেশ ঠিকঠাক মনে হচ্ছে আবার। বলো, ছবি রাখার জন্য জায়গা কোথায় পাবো আমি! আমি কয়েকটা ছবি কিনতে চাই। আমার বাক্সের ভেতরও একটা আছে, খুব সুন্দর। ছবিটিতে একটা নাম দেওয়া আছে – ‘ভাঙা কলসি’। এটি একটি বাচ্চা মেয়ের ছবি। ওর কলসিটা ভাঙা। খুব সামান্য একটি জিনিস। এটি একটি ফরাসি ছবি।

ফ্রেড : কি রকম কলসি?

লিজি : আমি জানি না : ওর কলসি। আমার মনে হয়, মেয়েটির একটি কলসি ছিল। আমি এমন একটা ছবি পছন্দ করব যেখানে বুড়ি ঠাকুরমা ওর উল্টোদিকে যাচ্ছে। বুড়ি কোনো ঠাকুরমা কাপড় সেলাই করছে অথবা নাতি-নাতনিদের গল্প শোনাচ্ছে। আহ্, আমি ব্লাইন্ডগুলো টেনে দিয়ে জানালাটা খুলে দিতে যাচ্ছি। [সে তেমনটা করে।] আহ্, কী সুন্দর সকাল! একটি সম্পূর্ণ নতুন দিন শুরু হতে যাচ্ছে। [হাত দুটো দুদিকে ছড়িয়ে মুহূর্তটা উপভোগ করার চেষ্টা করে সে।] ওহ্! কী যে ভালো লাগছে আমার! চমৎকার একটি সকাল। বেশ আরাম করে স্নান করেছি আমি। আর কাল রাতে বিছানায় কী মজার সঙ্গেই না মিলিত হয়েছি আমরা! আমার বেশ ভালো লাগছে, সত্যিই খুব ভালো লাগছে। এসো। দেখো আমার চোখ দুটো কী দেখছে। এসো, এসো – দেখো। একটা চমৎকার দৃশ্য দেখছি আমি। আমি সত্যিই ভাগ্যবতী। আজ আমার প্রথম দিন আর আমি শহরের ধনী লোকদের এলাকায় একটি ঘর পেয়ে গেছি। তুমি আসবে না এখানে? তুমি কি তোমার শহরটা দেখতে চাও না?

ফ্রেড : হ্যাঁ, দেখতে চাই, তবে আমার নিজের জানালা থেকে।

লিজি : [হঠাৎ] এটা নিশ্চয়ই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার নয়, তাই না? যদি সকালে প্রথম যে লোকটিকে তুমি দেখো সে একটা নিগ্রো হয়, কালো মানুষ!

ফ্রেড : কেন? লিজি : আমি … আমি তেমন একজনকে দেখতে পাচ্ছি পাশের দেয়ালে।

ফ্রেড : নিগারদের দেখতে পাওয়া সবসময় একটা দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। নিগাররা হচ্ছে শয়তান, [একটু পর] জানালা বন্ধ করে দাও।

লিজি : ঘরটায় একটু বাতাস আসুক – তুমি কি তা চাও না?

ফ্রেড : আমি তোমাকে জানালাটা বন্ধ করতে বলেছি। এক্ষুনি বন্ধ করো। এক্ষুনি ব্লাইন্ডটা টেনে দাও। আলোটা জ্বালিয়ে দাও।

লিজি : কেন? নিগ্রোদের কারণে নাকি? বাইরের রোদের আলোটা সত্যিই খুব সুন্দর।

ফ্রেড : ঘরের ভেতরে রোদের আলোর দরকার নেই। তোমার ঘরটা আমি দেখতে চাই রাতে যেমনটা ছিল তেমনি। এখন, জানালাটা বন্ধ করে দাও। আমি তো বলেছি। বাইরে গেলে রোদের যে-আলো আমি চাই তার সবটাই পাবো। [সে উঠে দাঁড়ায়, লিজির দিকে এগিয়ে যায় এবং ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।]

লিজি [কিছুই বুঝতে না পেরে] : কী ব্যাপার?

ফ্রেড : কিছু না। আমার টাইটা দাও।

লিজি : ঠিক আছে। ওটা বাথরুমে। [সে বেরিয়ে যায়। ফ্রেড দ্রুত টেবিলের ড্রয়ারগুলি খুলে খুলে দেখে। লিজি টাই হাতে আবার ঘরে আসে।] এই নাও। কাছে এসো। আমিই পরিয়ে দিচ্ছি। এই তো হয়ে গেল। [সে টাইয়ের নট ঠিক করে দেয়।] তুমি জানো, নতুন নতুন মুখ আমার ভালো লাগে না। এতে শুধু নতুন নতুন মানুষই আসে। আমি চাই শুধু নিয়মিত তিন কি চারজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে। একজন মঙ্গলবার। একজন বৃহস্পতিবার। আর একজন উইক-এন্ডে। আমি শুধু সেটাই তোমাকে বলছি। তোমার বয়স একটু কম, তবে তুমি সিরিয়াস ধরনের। আইডিয়াটা তুমি হয়তো পছন্দ করবে। ওহ্, আমি আর কিছু বলব না। তুমি এটা নিয়ে ভাবতে পারো। এই তো, এই তো বেশ দেখাচ্ছে। তোমার চেহারা সুন্দর। চুমু দাও আমাকে। ওহে সুন্দর, চুমু খাও আমাকে। [ফ্রেড আলতো চুম্বন করে লিজিকে। এরপর ওকে ঠেলে সরিয়ে দেয়।] উহ্!

ফ্রেড : তুমি হলে একটা শয়তান।

লিজি : এখনো একজন পাদ্রীসাহেবের মতোই কথা বলছো। কী হয়েছে তোমার?

ফ্রেড : কিছু না। আমি নিজের ওপরই বিরক্ত।

লিজি : বেশ অদ্ভুতভাবেই সেটা তুমি দেখাতে পারো। [একটু থেমে] খুশি হয়েছো তুমি?

ফ্রেড : খুশি? কীজন্য খুশি?

লিজি [ফ্রেডকে অনুকরণ করে, মুখে হাসি ফুটিয়ে] : কীজন্য খুশি?  কেমন মজার একটা ছোট মেয়ে তুমি।

ফ্রেড : ওহ্। ওহ্ হ্যাঁ … খুব মজা পেয়েছি। খুব তৃপ্তি পেয়েছি। কত দেব তোমাকে?

লিজি : টাকার কথা তোমাকে কে বলছে? আমি জানতে চেয়েছি, তুমি তৃপ্ত হয়েছো কি না। আরো ভদ্রভাবে উত্তরটা দিতে পারতে তুমি। কি ব্যাপার? আমাকে পছন্দ হয়নি তোমার? বলো না, আমাকে পছন্দ করোনি তুমি?

ফ্রেড : চুপ করো।

লিজি : দু-হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে তুমি। খুব জোরে বুকে চেপে ধরেছিলে আমাকে। তারপর খুব কোমল স্বরে বলেছিলে – আমাকে ভালোবাসো তুমি।

ফ্রেড : তুমি বেশ শক্ত হয়ে ছিলে।

লিজি : না, আমি শক্ত হয়ে ছিলাম না।

ফ্রেড : আমি বলছি, তুমি শক্ত হয়ে ছিলে।

লিজি : আমি তোমাকে বলছি, আমি ছিলাম না।

ফ্রেড : ঠিক আছে, আমিই ছিলাম। আমার কিছুই মনে নেই।

লিজি : কী দুঃখের কথা! আমি বাথরুমে ঢুকে আমার জামাকাপড় খুলে ফেলেছিলাম। তারপর যখন ফিরে এলাম তখন লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল তোমার মুখ। তোমার মনে পড়ছে না? তোমার কি মনে পড়ছে না আমি তোমাকে বলেছিলাম – আমার ছোট গলদা-চিংড়ি। তুমি আলো নিভিয়ে দিয়েছিলে, তারপর সেই অন্ধকারের মধ্যেই আমার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলে। আমি ভেবেছিলাম, সেটাই খুব ভালো এবং সম্মানজনক। মনে পড়ছে না তোমার?

ফ্রেড : না।

লিজি : আর আমরা যখন এমন ভান করছিলাম যেন আমরা দুজন একই দোলনায় শুয়ে-থাকা দুটি নবজাত শিশু? তোমার মনে আছে, সেটা?

ফ্রেড : আমি বলেছি তোমাকে চুপ করে থাকতে। একজন মানুষ রাতে যা করে সেটা রাতের ব্যাপার। সকালে তুমি সেগুলি নিয়ে কোনো কথাই বলবে না।

লিজি [অবাধ্যতার সুরে] : আর আমার যদি সেসব কথা বলতে ভালো লাগে? আমি নিজে অনেক আনন্দ পেয়েছিলাম, তুমি তো জানোই।

ফ্রেড : ওহ্, তাহলে তুমি বেশ আনন্দ পেয়েছিলে। [সে উঠে দাঁড়িয়ে লিজির দিকে এগিয়ে যায়, ওর কাঁধ দুটোয় আস্তে আস্তে আদর করে। তারপর হাত দুটো দিয়ে ওর গলা পেঁচিয়ে ধরে।] তুমি কি সবসময় এমন আনন্দ পাও যখন তোমার মনে হয় যে, একটা লোককে তুমি বোকা বানাতে পেরেছো? [একটু থেমে] কাল রাতে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলাম সেটা। আমার নাইট ক্লাবের কথা মনে আছে। শুধু সেটাই। এরপর, কেবল তুমিই সেটা মনে করতে পারছ। শুধু তুমিই। [সে লিজির গলায় হাতের চাপ বাড়ায়।]

লিজি : কী করছো তুমি?

ফ্রেড : আমি তোমার গলা চেপে ধরছি।

লিজি : আমার লাগছে।

ফ্রেড : কেবল একজন। আমি যদি আরেকটু জোরে চাপ দিই, তাহলে কাল রাতের কথা মনে রাখার আর কেউ এই দুনিয়ায় থাকবে না। [লিজিকে ছেড়ে দেয় সে।] কত চাও তুমি?

লিজি : তুমি যদি ভুলে গিয়ে থাকো, তার কারণ আমি বেশি ভালো ছিলাম না। যে-জিনিস খুব ভালো ছিল না তার জন্য আমি টাকা নিতে চাই না।

ফ্রেড : বকাবকানি থামাও। কত?

লিজি : শোনো। আমি কেবল পরশু এ-শহরে এসেছি। তুমিই আমার প্রথম কাস্টমার। প্রথম জনের কাছ থেকে আমি কোনো টাকা নেব না। ওটা গুড লাক!

ফ্রেড : আমি মনে করি, তোমার কাছ থেকে উপহার নেওয়ার প্রয়োজন আমার নেই। [টেবিলের ওপর একটা দশ ডলারের নোট রাখে।]

লিজি : তোমার টাকা আমি চাই না। তবে আমি দেখতে চাই, তোমার চোখে আমার মূল্য কত। দাঁড়াও, আমাকে অনুমান করতে দাও। [সে নোটটি তুলে নেয় এবং চোখ বন্ধ করে।] চল্লিশ ডলার? না। সেটা অনেক বেশি। তাহলে দুটি নোট হবে? বিশ ডলার? আরো বেশি? তাহলে অবশ্যই চল্লিশ ডলারের বেশি হতে হবে। পঞ্চাশ? একশ? [এই সময়ের মধ্যে ফ্রেড তার দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখে নীরব হাসি।] ওহ্, ঠিক আছে। আমি আমার চোখ খুলব এবার। [সে নোটটি দেখে।] তুমি ভুল করোনি তো?

ফ্রেড : আমার তা মনে হয় না।

লিজি : তুমি জানো কত টাকা আমাকে তুমি দিয়েছো?

ফ্রেড : হ্যাঁ।

লিজি : এটা নিয়ে যাও। এক্ষুনি এটা নিয়ে যাও। [ফ্রেড এমন ভাব করে যেন সে লিজির কথাটা প্রত্যাখ্যান করছে।] দশ ডলার! দশ ডলার! আমার মতো একটি মেয়ে। দশ ডলার নিতে হলে নরকেই তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হবে আমার। আমার পা-দুটো দেখেছো? [সে তার পা-দুটো দেখায়।] আর আমার বুক? সেগুলো দেখেছো? সেগুলো কি দশ ডলারের বুক? আমার মেজাজ খারাপ হওয়ার আগে তোমার ওই নোংরা নোটটা নিয়ে কেটে পড়ো এখান থেকে। দশ ডলার! তুমি আমার সারা শরীরে চুমু খেয়েছো আর বারবার তা করতে চেয়েছো। তুমি আমার জীবনের কথা জানতে চেয়েছো; আর এই সকালে মেজাজ দেখিয়েছো আমাকে। যেন পুরো একটা মাসের জন্য টাকা দিয়েছো। আর এসবের জন্য কত টাকা? চল্লিশ নয়, ত্রিশ নয়, এমনকি বিশও নয়, মাত্র দশ ডলার!

ফ্রেড : ইয়া! একবারের জন্য যথেষ্ট!

লিজি : চোপ! চোপ! তুমি কি জিনিস, সেটা আমি জানতে চাই। কোন মায়ের ছেলে তুমি যে একজন মহিলাকে কীভাবে সম্মান দেখাতে হয় তিনি তাও তোমাকে শেখাননি?

ফ্রেড : মুখ বন্ধ করো!

লিজি : কুত্তির বাচ্চা! তুই একটা কুত্তির বাচ্চা!

ফ্রেড [অস্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠে] : শোনো, আমার প্রিয়তমা! আমাদের ছেলেদের সঙ্গে ওদের মায়েদের নিয়ে বেশি কথা বলতে যেও না, তাহলে তোমার ঘাড় মটকে যাবে।

লিজি [ফ্রেড-এর দিকে ছুটে গিয়ে] : ঠিক আছে। দেখাও দেখি।

ফ্রেড [পেছনে সরে গিয়ে] : ওহ্, চোপরাও! [লিজি টেবিল থেকে একটা ফ্লাওয়ার ভাস তুলে নেয় দৃশ্যত ফ্রেডের মাথায় আঘাত হানার জন্য।] এখানে আরো দশ ডলার রাখছি, তবে চুপ করো। চুপ করো, না হলে আমি তোমাকে জেলে ঢুকিয়ে দেবো।

লিজি : তুমি আমাকে জেলখানায় ঢোকাবে?

ফ্রেড : হ্যাঁ : ঢোকাব।

লিজি : তুমি ঢোকাবে?

ফ্রেড : হ্যাঁ! আমিই ঢোকাব।

লিজি : ওটা দিও না আমাকে!

ফ্রেড [হঠাৎ খুব রাগের সঙ্গে] : আমি উইলসন ক্লার্কের ছেলে।

লিজি : কে?

ফ্রেড : সিনেটর ক্লার্কের ছেলে।

লিজি : ইয়াহ্। আমি ট্রুম্যানের মেয়ে।

ফ্রেড : তুমি পত্রিকায় সিনেটরের ছবি দেখেছ?

লিজি : তাতে কী হয়েছে?

ফ্রেড : এখানে দেখো। [সে লিজিকে একটা ছবি দেখায়।] আমি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আছি। ওনার হাত আমার কাঁধে।

লিজি [হঠাৎ শান্ত হয়ে] : তাহলে ওই লোকটি তোমার বাবা? তুমি বলছো! [ফ্রেড ছবিটি তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়।]

ফ্রেড : অনেক হয়েছে।

লিজি : উনি দেখতে বেশ সুন্দর, তাই না? খুব চমৎকার দেখতে, জ্ঞানী লোক নিশ্চয়ই। [ফ্রেড কোনো উত্তর দেয় না।] ওটা কি তোমাদের বাগান?

ফ্রেড : হ্যাঁ।

লিজি : আর ওই বাচ্চা মেয়েগুলি, ওরা কি তোমার বোন? [ফ্রেড কোনো উত্তর দেয় না।] তোমাদের বাড়ি কি পাহাড়ের ওপর?

ফ্রেড : হ্যাঁ।

লিজি : তাহলে তো সকালবেলায় নাস্তা করতে বসে তোমরা তোমাদের বাড়ির জানালা দিয়ে পুরো শহরটাকে দেখতে পাও।

ফ্রেড : হ্যাঁ।

লিজি : খাবার ঘরে আসার জন্য তোমাদের বাসায় কি ঘণ্টা বাজানো হয়?

ফ্রেড : হ্যাঁ, আমাদের বাসায় একটা ঘণ্টা আছে।

লিজি [উৎফুল্ল স্বরে] : ঘণ্টা! আমি তোমাকে বুঝতে পারছি না। আমার যদি এমন একটা পরিবার থাকত, এমন একটা বাড়ি থাকত, তাহলে সেখান থেকে পিছলে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে টাকা দিতে হতো তোমাকে। [একটু থেমে] আমি দুঃখিত, তোমার মায়ের সম্পর্কে অমন একটা কথা বলার জন্য। আমি তখন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। উনিও কি ওই ছবিতে আছেন?

ফ্রেড : আমি তোমাকে বলেছি ওনার ব্যাপারে কিছু না বলার জন্য।

লিজি : ঠিক আছে, ঠিক আছে। [একটু থেমে] একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি তোমাকে? [ফ্রেড কোনো উত্তর দেয় না] তুমি যদি দৈহিক মিলন পছন্দ না করো, তাহলে আমার সঙ্গে এখানে এসেছিলে কেন? [ফ্রেড এবারও কোনো উত্তর দেয় না। লিজি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।] ওহ্, ঠিক আছে। তুমি যদি এভাবে বোকা হয়ে থাকতে চাও, তাহলে, আমার মনে হয়, আমাকে তোমার ব্যাপারে ওতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে।

[সামান্য বিরতি। ফ্রেড আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ায়।]

ফ্রেড : তুমি উত্তর থেকে আসছ ?

লিজি : হ্যাঁ।

ফ্রেড : নিউইয়র্ক থেকে?

লিজি : তাতে তোমার কী আসে-যায়?

ফ্রেড : গত রাতে তুমি নিউইয়র্কের কথা বলেছিলে।

লিজি : যে কেউ নিউইয়র্কের কথা বলতে পারে। এ থেকে কিছুই প্রমাণ হয় না।

ফ্রেড : তুমি সেখানে থাকলে না কেন?

লিজি : আমার অসহ্য লাগছিল সেখানে।

ফ্রেড : কোনো ঝামেলা হয়েছিল?

লিজি : স্বাভাবিক ব্যাপার। ঝামেলা সবসময় আমার পিছু নেয়। কিছু মানুষ এরকমই। এই সাপটা দেখছ? [সে ফ্রেডকে একটি ব্রেসলেট দেখায়।] এসব এর জন্যই। এটাই আমার দুর্ভাগ্যের কারণ।

ফ্রেড : তাহলে ওটা পরে আছো কেন?

লিজি : এটা আমার কাছে যতদিন থাকবে ততদিন পরতে হবে। লোকে বলে, এই সাপটা যে দুর্ভাগ্য নিয়ে আসে তা সত্যিই খারাপ।

ফ্রেড : তুমিই কি সেই মেয়ে যাকে নিগ্রোটি ধর্ষণ করতে চেয়েছিল?

লিজি : কী?

ফ্রেড : তুমি কাল সকালে ছয়টার ট্রেনে এখানে এসেছিলে?

লিজি : আ, হ্যাঁ।

ফ্রেড : তাহলে সেই মেয়ে হলে তুমি।

লিজি : কেউ আমাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেনি। [সে তিক্তভাবে হাসে।] আমাকে রেপ করবে! আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছ?

ফ্রেড : তুমিই ওই মেয়ে। ওয়েবস্টার কাল রাতে ক্লাবে আমাকে বলেছিল।

লিজি [একটু পর] : তাহলে ওই কথাই। এজন্যই চোখগুলি জ্বলজ্বল করছিল। সেটি তোমাকে উত্তেজিত করে তুলেছিল, তাই না? ওই রকম ভালো একজন পিতার পুত্র হওয়া সত্ত্বেও!

ফ্রেড [সামান্য বিরতি দিয়ে] : যদি আমি সত্যিই ভাবতাম তুমি একটা কালো নিগ্রোর সঙ্গে শুয়েছিলে …।

লিজি : তাহলে?

ফ্রেড : আমার পাঁচটা কালো চাকর আছে। আমার কাছে যখন কোনো ফোন আসে এবং ওদের কেউ ফোনটা তোলে, তাহলে আমার হাতে দেওয়ার আগে ফোনটা সে মুছে দেয়।

লিজি [শ্রদ্ধা মেশানো শিস দিয়ে] : কী দারুণ!

ফ্রেড [নরম গলায়] : নিগারদের আমরা এখানে খুব একটা পছন্দ করি না। ওদের সঙ্গে যারা শোয় সেই সাদা মেয়েদেরও।

লিজি : সেটা ঠিক আছে। ওদের বিরুদ্ধে আমার বলার কিছু নেই, তবে ওরা আমাকে স্পর্শ করুক সেটা আমি চাই না।

ফ্রেড :  আমি কি করে জানব? তুমি হচ্ছো একটা ডেভিল, নিগাররাও ডেভিল …। [আকস্মিকভাবে] ও, আচ্ছা! সে তোমাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল?

লিজি : তাতে তোমার কী?

ফ্রেড : ওদের দুজন তোমার কম্পার্টমেন্টে ঢুকে পড়েছিল। একটু পরেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওরা তোমার ওপর। তুমি সাহায্যের জন্য চিৎকার করেছিলে এবং কয়েকজন সাদা মানুষ এসে গিয়েছিল তোমাকে সাহায্য করতে। কালোদের একজন একটা ক্ষুর বের করেছিল আর একজন সাদা মানুষ রিভলভার থেকে তাকে গুলি করেছিল। অন্য কালো লোকটি পালিয়ে গিয়েছিল … এটাই তো ঘটেছিল?

লিজি : অবশ্যই নয়। নিগ্রো লোক দুটি শান্ত হয়ে বসেছিল, নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। ওরা এমনকি আমার দিকে তাকায়ওনি। এরপর চারটি সাদা ছেলে ওঠে; ওদের মধ্যে দুজন আমার দিকে খারাপ ইঙ্গিত করে। মাত্রই একটা ফুটবল খেলায় জিতে এসেছে ওরা; উত্তেজনায় টগবগ করছিল। তারা বলেছিল, জায়গাটা কালোদের গন্ধে দূষিত হয়ে গেছে; তারপর ওরা ওই কালো লোক দুটিকে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল। কালো লোকগুলি নিজেদের রক্ষার জন্য যা কিছু সম্ভব তা করেছিল। এবং সবশেষে সাদা ছেলেদের একজন চোখে আঘাত পেয়েছিল। তখন সে একটা পিস্তল বের করে গুলি করেছিল। এটাই ঘটেছিল। ট্রেন স্টেশনে ঢুকতেই অপর নিগ্রোটি লাফ দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পালিয়েছিল।

ফ্রেড : আমরা ওকে চিনি। লুকিয়ে থেকে বাঁচবে না সে। [একটু থেমে] বিচারকের সামনে গিয়ে এটাই কি বলবে তুমি?

লিজি : কিন্তু এর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী?

ফ্রেড : আমার কথার জবাব দাও।

লিজি : আমি কোনো বিচারকের সামনে যাব না। আমি বলছি তোমাকে – এসব ঝামেলা আমি পছন্দ করি না।

ফ্রেড : কিছু আসে-যায় না। তোমাকে তো যেতে হবেই।

লিজি : আমি যাব না। পুলিশ-টুলিশের ব্যাপারে আমি মোটেই থাকতে চাই না।

ফ্রেড : ওরা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।

লিজি : তাহলে আমি যা দেখেছি তা ওদের বলব।

ফ্রেড : তুমি বুঝতে চেষ্টা করো, কী তুমি করবে।

লিজি : করব?

ফ্রেড : তুমি একজন সাদা মানুষের বিরুদ্ধে একটা কালো মানুষের পক্ষে বলবে?

লিজি : কিন্তু সাদা মানুষটাই তো দোষী।

ফ্রেড : সে দোষী নয়।

লিজি : ও একটা লোককে গুলি করেছিল। অবশ্যই দোষী।

ফ্রেড : কিসের জন্য দোষী?

লিজি : খুনের জন্য।

ফ্রেড : ও তো শুধু একটা নিগ্রোকে গুলি করেছিল।

লিজি : তাই?

ফ্রেড : যদি একজন নিগারকে মারার জন্য প্রত্যেকবার একজন দোষী সাব্যস্ত হয় …

লিজি : তার কোনো অধিকার ছিল না।

ফ্রেড : কোন অধিকার?

লিজি : তার কোনো অধিকার ছিল না।

ফ্রেড : ওটা ইয়াংকিদের কথা। [একটু থেমে] দোষী হোক বা না হোক, ওর মতো একটা ছেলেকে তুমি দায়ী বলতে পারো না।

লিজি : দেখো, আমি কাউকে দায়ী বলতে যাচ্ছি না। ওরা যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কী দেখেছি, তাহলে ওদেরকে আমি সেটাই বলব। [ফ্রেড দ্রুতপায়ে লিজির দিকে এগিয়ে যায়।]

ফ্রেড : ওই নিগ্রোটার সঙ্গে তোমার কিসের সম্পর্ক? কেন তুমি ওকে রক্ষা করতে চেষ্টা করছ?

লিজি : আমি তো ওকে এমনকি চিনিও না।

ফ্রেড : তাহলে?

লিজি : আমাকে অবশ্যই সত্যটা বলতে হবে।

ফ্রেড : সত্য? দশ ডলারের একটা বেশ্যা বলবে সত্য! এখানে সত্য বলে কিছু নেই; আছে কেবল সাদা মানুষ আর কালো মানুষ। এবং সেটাই সবকিছু। সতেরো হাজার সাদা মানুষ, বিশ হাজার কালো মানুষ। এটা নিউইয়র্ক নয়; বোকামি করে বেড়ানোর কোনো অধিকার আমাদের নেই। [একটু থেমে] টম আমার কাজিন।

লিজি : কে?

ফ্রেড : টম। যে-ছেলেটার হাতে পিস্তল ছিল। ও আমার কাজিন।

লিজি [বুঝতে পেরে] : ওহ্!

ফ্রেড : ও একটা খুব ভালো পরিবারের ছেলে। সেটা বোধহয় তোমার কাছে কিছুই না। কিন্তু ও একটা খুব ভালো পরিবারের ছেলে।

লিজি : খুব ভালো পরিবারের একটা ছেলে, যে আমাকে চেপে ধরে এবং আমার স্কার্টটা তুলতে চায়। তেমন একটা ভালো পরিবার ছাড়াই আমার চলবে। তুমি যে ওদের আত্মীয় এতে আমি মোটেই বিস্মিত হচ্ছি না।

ফ্রেড [আঘাত করার জন্য হাত তুলে, তারপর নিজেকে সংবরণ করে] : তুমি একটা শয়তানি। যাদের সঙ্গে তোমার দেখা হয় তাদের সবাইকে তুমি শয়তান বানিয়ে ছাড়।

লিজি : আমাকে যেতে দাও।

ফ্রেড : সে তোমার সঙ্গে অসভ্যতা করতে চেয়েছিল – একটা নিগারকে গুলি করেছিল – এতে কী এমন হয়। এসব কাজ মানুষ কোনো চিন্তা না করেই করে ফেলে। এগুলি নিয়ে ভাবেই না ওরা। টম আজন্ম-নেতা, সেটাই আসল কথা।

লিজি : হয়তো। কিন্তু নিগ্রোটা কিছুই করেনি।

ফ্রেড : একটা নিগ্রো সবসময় কিছু করেছে।

লিজি : আমি কোনো মানুষকে কোনো পুলিশের হাতে তুলে দেব না।

ফ্রেড : হয় টম অথবা সেই নিগ্রো; এদের মধ্যে একজনকে তো ছাড়তেই হবে। কাকে ছাড়বে সেটা তোমার ব্যাপার।

লিজি : তাহলে ব্যাপারটা হচ্ছে এই। এবারে আমি গলা পর্যন্ত ডুবে গেছি, ওতে আর কোনো ভুল নেই। [ব্রেসলেটটির দিকে তাকিয়ে] মরার অভিশপ্ত ব্রেসলেট আমার, সবসময় এমনটাই করো তুমি আমার সঙ্গে! [ব্রেসলেটটি খুলে বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলে।]

ফ্রেড : কত টাকা চাও তুমি?

লিজি : আমি এক পয়সাও চাই না।

ফ্রেড : পাঁচশো ডলার।

লিজি : একটা লাল পয়সাও নয়।

ফ্রেড : পাঁচশো ডলার কামাই করতে তোমার এক রাতের চেয়ে অনেক বেশি দিন লাগবে।

লিজি : বিশেষভাবে আমি যদি কেবল তোমার মতো কঞ্জুস লোকেদের হাতেই পড়ি। [একটু থেমে] তাহলে এজন্যই কাল রাতে তুমি আমাকে খুঁজে নিয়েছিলে, তুমি ভেবেছিলে : এটিই হচ্ছে সেই মেয়ে। আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাব আর বলটা গড়াতে শুরু করবে। তাহলে এটাই ছিল তোমার চিন্তা! আমার পুরো শরীর হাতড়ে বেড়াচ্ছিলে তুমি, কিন্তু নিজে ছিলে বরফের মতো ঠান্ডা আর ভাবছিলে – কীভাবে ওকে পথে আনা যায়! [একটু থেমে] কিন্তু এক মিনিট … শুধু এক মিনিট, ছোট্ট খোকা … কিন্তু তুমি যদি এই প্রস্তাবটা দিতেই শুধু এসেছিলে, তাহলে আমার সঙ্গে শোবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এই! তুমি আমার সঙ্গে শুয়েছিলে কেন? বেজন্মা কোথাকার? কেন তুমি আমার সঙ্গে শুয়েছিলে?

ফ্রেড : আমি যদি জানতাম, তাহলে ঈশ্বরের অভিশাপ নেমে আসুক আমার মাথায়। পাঁচশো ডলার। চ্যাঁচানি থামাও। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান! পাঁচশো ডলার। চ্যাঁচানি থামাও। আবার বলছি, চ্যাঁচানি থামাও। শোনো, লিজি! লিজি সোনা! মুক্তির পথে এসো। পাঁচশো ডলার!

লিজি [অস্পষ্ট কান্নাজড়িত কণ্ঠে] : আমি তোমার ওই মুক্তির পথে যাব না! তোমার পাঁচশো ডলার আমি চাই না, বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলব না আমি। নিউইয়র্কে ফিরে যেতে চাই আমি, এখান থেকে চলে যেতে চাই। [দরজার বেল বেজে ওঠে। হঠাৎই থেমে যায় লিজি। আবার বেল বাজে।] দরজা আমি খুলব না। [দরজায় অধৈর্য করাঘাতের শব্দ]

একটি কণ্ঠস্বর [বাইরে] : দরজা খুলুন। পুলিশ।

লিজি [নরম স্বরে] : পুলিশ। আমি বোধহয় জানতাম। [ব্রেসলেটটির দিকে আঙুল দেখায় সে। শরীর বাঁকিয়ে সেটি তুলে কব্জিতে পরে নেয়।] যাও। বাথরুমে গিয়ে লুকিয়ে পড়ো। [দরজায় আরো করাঘাতের শব্দ]

কণ্ঠস্বর : পুলিশ!

[ফ্রেড নড়ে না। লিজি তার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে ঠেলা দেয়।]

কণ্ঠস্বর : আপনি কি ওখানে আছেন, ক্লার্ক? ক্লার্ক? আপনি কি ওখানে আছেন?

ফ্রেড : আমি এখানে আছি। [সে ঠেলা দিয়ে লিজিকে দূরে সরিয়ে দেয়। লিজি বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।]

লিজি : তাহলে এটাই!

[ফ্রেড দরজা খুলে দেয়। জন ও জেমস ঘরের ভেতর প্রবেশ করে, সামনের দরজাটি খোলা রেখে।]

জন : তুমি লিজি ম্যাক্কে?

লিজি [জনের কথা শোনার বদলে ফ্রেডের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে] : তাহলে এটাই ছিল ব্যাপার! জন [লিজিকে কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে] : যখন তোমাকে কিছু বলা হবে তখন তার জবাব দেবে।

লিজি [নিজেকে ফিরে পেয়ে, তিক্তস্বরে] : আমার অ্যাপার্টমেন্টে আপনারা কী করছেন? [জন তার ব্যাজ দেখায়।] যে কেউ একটা ব্যাজ রাখতে পারে। তোমরা এই লোকটার কাছের বন্ধু এবং তোমরা এসেছো আমাকে নিয়ে যেতে। [জন ওর নাকের সামনে একটা কার্ড তুলে ধরে]

জন : চিনতে পারছ এটা কি?

লিজি [জেমসকে দেখিয়ে] : এই লোকটা কে?

জন [জেমসকে] : তোমার কার্ডটা দেখাও [জেমস কার্ড বের করে দেখায়। লিজি সেটি দেখে, কোনো কথা না বলে টেবিলের দিকে যায়, কিছু কাগজপত্র তুলে নেয় সেখান থেকে এবং সেগুলি জনের হাতে দেয়।]

জন [ফ্রেডকে দেখিয়ে] : কাল রাতে তুমি ওকে ঘরে নিয়ে এসেছিলে? তুমি কি জান না, এই অঙ্গরাজ্যে বেশ্যাবৃত্তি একটা ফৌজদারি অপরাধ?

লিজি : আপনারা কি নিশ্চিতভাবে জানেন যে, আপনারা চাইলেই কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই যে-কারো ঘরে ঢুকে পড়তে পারেন? ব্যাপারটা নিয়ে আমি যে আপনাদের বিরুদ্ধে কিছু একটা করতে পারি সে-ব্যাপারে আপনাদের কোনো ভয় নেই?

জন : আমাদের নিয়ে চিন্তা করবে না। [একটু থেমে] আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি কাল রাতে এই লোকটাকে তুমি তোমার ঘরে নিয়ে এসেছিলে কি না?

[পুলিশ অফিসারদের আসার পর লিজির মনোভাব কিছুটা বদলে গিয়েছে। তার চেহারা আরো কঠোর হয়েছে এবং আচরণ আরো বেশি অমার্জিত।]

লিজি : তোমাদের শার্ট খুলবে না। অবশ্যই, আমি ওকে আমার ঘরে নিয়ে এসেছি। কিছু না নিয়েই ওর সঙ্গে আমি শুয়েছি। সেটাই তোমাদের ভাবতে হবে, তাই না?

ফ্রেড : দুটো দশ ডলারের নোট টেবিলের ওপর আছে। ওগুলো আমার।

লিজি : প্রমাণ করো।

ফ্রেড [লিজির দিকে না তাকিয়ে, অন্য দুজনকে] : আমি কাল সকালে ওগুলি ব্যাংক থেকে পেয়েছি। সঙ্গে আরো আটাশটি নোট ছিল একই সিরিয়াল নম্বরের। আপনারা ব্যাংক থেকে নম্বরগুলির সিরিয়াল মিলিয়ে দেখতে পারেন।

লিজি : আমি ওগুলি নিচ্ছি না। আমি ওর নোংরা টাকা নেব না। ওগুলি আমি ওর মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলেছি।

জন : তুমি যদি সেগুলি না নাও, তাহলে সেগুলি টেবিলের ওপর আছে কেন?

লিজি [কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর] : তোমরা আমাকে পেয়ে গেছ। তোমরা আমাকে পেয়ে গেছ। [সে স্তম্ভিত ভাব নিয়ে ফ্রেডের দিকে তাকায়, এরপর প্রায় শান্তস্বরে বলে] তাহলে এজন্যই এত সব? [অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে] বেশ! তোমরা আমাকে কী করতে বলছ?

জন : বসো। [ফ্রেডকে] তুমি কি ওকে বলেছ? [ফ্রেড সম্মতিসূচকভাবে মাথা ঝাঁকায়।] আমি তোমাকে বসতে বলেছি। [সে জোর করে লিজিকে একটা চেয়ারে বসায়।] এখন, বিচারক টমকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছেন, যদি তুমি লিখিতভাবে তোমার সাক্ষ্য দাও। আমরা সেটা লিখেই এনেছি তোমার জন্য। তোমাকে কেবল সই করতে হবে। আগামীকাল, অফিসিয়ালি প্রশ্ন করা হবে তোমাকে। তুমি পড়তে পার? [লিজি কাঁধ ঝাঁকায়; জন একটি কাগজ এগিয়ে দেয় লিজির দিকে।] এটা পড়ে দেখো, তারপর সই করো।

লিজি : এটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মিথ্যা।

জন : তাকে কি?

লিজি : আমি সই করব না।

ফ্রেড : নিয়ে যাও ওকে। [লিজিকে] এটা হবে আঠারো মাসের।

লিজি : আঠারো মাস! ঠিক আছে। আঠারো পাস পর আমি যখন বেরিয়ে আসব তখন এর জন্য তোমার দফা-রফা করে ছাড়ব।

ফ্রেড : তা হবে না, যদি আমি সাহায্য করি। [লিজি ও ফ্রেড একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে।] তোমাদের নিউইয়র্কে টেলিগ্রাম করা উচিত; আমার মনে হয় সেখানেও কিছু ছোটখাটো ঝামেলা আছে ওর।

লিজি [প্রশংসার সুরে] : তুমি একটা মেয়ে মানুষের মতো নীচ। আমি ভাবতে পারি না, একটা মানুষ কি করে এতো নীচ হতে পারে।

জন : ভেবে নাও কী করবে তুমি। সই করবে, নাকি আদালতে নিয়ে যাব।

লিজি : নিয়ে যাও আমাকে। মিথ্যা আমি বলব না।

ফ্রেড : মিথ্যা তুমি বলবে না! আর সারারাত তুমি কি করেছ? তুমি যখন আমাকে ডার্লিং, আমার ভালোবাসা, সুইটহার্ট ইত্যাদি বলেছো, তখন কি তুমি মিথ্যা বলোনি? যখন তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে যে তুমি ভালোবাসো সে-কথা বিশ্বাস করতে বলেছো, তখন কি তুমি মিথ্যা বলছিলে না?

লিজি  [উদ্ধত স্বরে] : সেটা তোমার ভালো লাগত না? না, আমি তোমাকে মিথ্যা বলছিলাম না। [ওরা একে অপরের দিকে তাকায়, ফ্রেড তার চোখ নিচে নামিয়ে রাখে।]

ফ্রেড : ওসব বলাবলি বাদ দাও এখন। এই যে, কলমটা নাও। সই করো।

লিজি : গোল্লায় যাও তুমি। [সামান্য বিরতি। পুরুষ তিন জন লজ্জিত হওয়ার ভাব দেখায়।]

ফ্রেড : তাহলে এটাই হচ্ছে। সে হচ্ছে শহরের সবচেয়ে চমৎকার লোক, আর তার ভবিষ্যৎ থাকছে এই বেশ্যাটার হাতে। [সে পায়চারি করতে থাকে, তারপর হঠাৎ লিজির কাছে ফিরে আসে।] ওর দিকে চেয়ে দেখো। [সে লিজির দিকে একটি ছবি ছুড়ে দেয়।] তোমার নোংরা জীবনে কিছু মানুষ তুমি দেখেছ। ওর মতো মানুষ কি সেখানে অনেক আছে? চিন্তা করো না। দশ বছর পর ও যখন জেল থেকে বেরিয়ে আসবে, ওকে তখন বুড়ো মানুষের মতো দেখাবে। নিজের জন্য গর্ববোধ করতে পারো তুমি, দারুণ একটা কাজ করছ। এখন পর্যন্ত তুমি কেবল আমাদের পকেট থেকে টাকা নিয়েছো। এবার নিচ্ছ একতাড়া নোট আর চুরি করে নিচ্ছ ওর জীবন। বলতে পারছ না কিছু? তোমার কি হাড্ডি পর্যন্ত পচে গেছে? [সে লিজিকে জোর করে হাঁটু গেড়ে দাঁড় করায়।] হাঁটু গেড়ে দাঁড়াও, বেশ্যা মাগী কোথাকার!! [ওদের খুলে রাখা দরজা দিয়ে সিনেটর ক্লার্ক ঘরে আসেন।]

সিনেটর : ওকে যেতে দাও।

ফ্রেড :  বাবা, তুমি!

জন : হ্যাল্লো, সিনেটর!

সিনেটর : হ্যাল্লো, ছেলেরা সব। [লিজিকে] প্লিজ, উঠে দাঁড়াও।

জন [লিজিকে] : উনি সিনেটর ক্লার্ক।

সিনেটর [লিজিকে] : হ্যাল্লো, লিজি।

লিজি : হ্যাল্লো!

সিনেটর : এখন আমরা সবাই একে অপরকে চিনি। খুব ভালো। [তিনি লিজির দিকে তাকান।] এই তরুণী মেয়েটিকে দেখো একবার। ওকে দেখে মনে হচ্ছে হৃদয়টা ওর দয়ালু।

ফ্রেড : ও সই করবে না।

সিনেটর : একদম ঠিক করছে ও! কোনো রকম অনুমতি ছাড়াই তোমরা ওর অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছো। [জন প্রতিবাদ করার জন্য কিছু বলতে চায়। জোরের সঙ্গে] কোনোরকম অধিকার আর অনুমতি ছাড়াই। তোমরা ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছ আর নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে ওকে কথা বলাতে চাইছ। এটা আমেরিকানসুলভ ব্যবহার নয় মোটেই। মা আমার, নিগ্রোটা কি তোমাকে রেপ করেছিল?

লিজি : না।

সিনেটর : ভালো। এ-ব্যাপারে কোনো ভুল নেই। আমার দিকে তাকাও। [তিনি লিজির মুখের দিকে তাকান।] আমি নিশ্চিত, মেয়েটি মিথ্যা বলছে না। [একটু থেমে] হায় মেরী! [অন্যদের দিকে তাকিয়ে] তাহলে, ছেলেরা, আমাদের অবশ্যই ঠিকভাবে কাজ করতে হবে। এখানে আমাদের আর করার কিছু নেই। আমাদের অবশ্যই মিস ম্যাক্কের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

[ফ্রেড, জন ও জেমস বেরিয়ে যায়।]

লিজি : মেরী কে?

সিনেটর : মেরী? আমার বোন, হতভাগা টমাসের মা। খুব ভালো একটা মেয়ে। একেবারে ভেঙে পড়বে ও! ঠিক আছে, গুড বাই, বিদায়। মেয়ে আমার। [তিনি বাইরে যেতে উদ্যত হন।]

লিজি [ধরা গলায়] : সিনেটর! [তাঁর পেছন পেছন দৌড়ে যায়।]

সিনেটর : বলো, মা!

লিজি : আমি দুঃখিত।

সিনেটর : তুমি দুঃখিত হবে কেন? তুমি তো সত্যি কথাই বলছো।

লিজি : আমি দুঃখিত যে সত্য এমনটাই হবে … এমন!

সিনেটর : আমাদের দুজনের কারোরই এতে করার কিছু নেই এবং কারো অধিকার নেই তোমাকে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলার, [একটু থেমে] না। ওকে অন্য কিছু ভাবার সুযোগ দিও না।

লিজি : কাকে?

সিনেটর : আমার বোনকে। তুমি ওর জন্য চিন্তা করবে না, মোটেই না।

লিজি : অবশ্যই আমি করব।

সিনেটর : আমি তোমার ভেতরটা দেখতে পাচ্ছি, বাছা আমার। তুমি কি ভাবছ সে-কথা কি আমি তোমাকে বলব? [লিজিকে অনুকরণ করে] ‘যদি আমি সই করি, তাহলে সিনেটর তাঁর কাছে যাবেন, তিনি বলবেন : “লিজি ম্যাক্কে একটা ভালো মেয়ে, সে তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।” এবং তিনি ওর কান্নাভেজা মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলবেন : “লিজি ম্যাক্কে? আমি ওকে কখনো ভুলব না।” এবং এই আমি, যার কোনো পরিবার নেই, ভাগ্য যাকে সমাজের বাইরে ছুড়ে ফেলেছে, পাবে একজন বুড়ি মা, যিনি তাঁর ঘরে বসে বসে আমার কথা ভাববেন। তিনিই হবেন সেই আমেরিকান মা, যিনি আমাকে গ্রহণ করেছেন তাঁর হৃদয়ে।’ বাছা লিজি, ভুলে যাও এসব।

লিজি : ওঁর চুল কি সাদা?

সিনেটর : বরফের মতো সাদা। কিন্তু ওর মুখটা ছোট্ট মেয়ের মতো কোমল। তুমি যদি ওর মুখের হাসিটা দেখতে পেতে …। ও আর কখনো হাসবে না। গুড বাই।

লিজি : আপনি চলে যাচ্ছেন?

সিনেটর : কেন, হ্যাঁ; আমি ওর কাছে যাচ্ছি। আমি তাকে অবশ্যই বলব – আমাদের মধ্যে কি কথাবার্তা হয়েছে।

লিজি : উনি কি জানেন, আপনি এখানে এসেছেন?

সিনেটর : উনিই আমাকে আসতে বলেছিলেন।

লিজি : হায় ভগবান! উনি আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন? আর আপনি ওঁকে বলবেন, আমি সই করতে রাজি হইনি। উনি তো আমাকে ঘৃণা করবেন এজন্য।

সিনেটর [লিজির কাঁধে হাত রেখে] : বাছা আমার, তোমার অবস্থায় পড়তে চাই না আমি।

লিজি : কেমন একটা পরিস্থিতি। অবস্থা ও ঘটনা যেমনটা ছিল, নিগ্রোটা হয়তো আমাকে রেপ করতে পারত।

সিনেটর [কাতরস্বরে] : বাছা আমার!

লিজি [দুঃখজড়িত স্বরে] : ইয়াহ্, আপনারা খুশি হতেন এবং এটা আমার জন্য এত বড় ব্যাপারও হতো না।

সিনেটর : ধন্যবাদ তোমাকে! [একটু পর] আমি ভাবছি, আমি যদি তোমাকে সাহায্য করতে পারতাম। [একটু পর] কিন্তু সত্য তো সত্যই।

লিজি [কাতরস্বরে] : ইয়াহ্!

সিনেটর : এবং সত্য হচ্ছে নিগ্রোটি তোমাকে রেপ করেনি।

লিজি : ঠিক।

সিনেটর : হ্যাঁ। [একটু থেমে] স্বাভাবিকভাবেই, এটা হচ্ছে প্রকৃতই মৌলিক সত্যের ব্যাপারে একটি প্রশ্ন।

লিজি [বুঝতে না পেরে] : মৌলিক?

সিনেটর : হ্যাঁ। আমি বলতে চাইছি … প্রাথমিক সত্য।

লিজি : প্রাথমিক? এটা কি শুধু একটা সত্যই নয়?

সিনেটর : হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই এটা একটা সত্য। শুধু … সত্যের বেশ কয়েকটা মাত্রা আছে।

লিজি : আপনি কি মনে করেন, নিগ্রোটা আমাকে রেপ করেছে?

সিনেটর : না, না। সে তোমাকে রেপ করেনি। একটি দিক থেকে বিচার করলে সে তোমাকে মোটেই রেপ করেনি। কিন্তু দেখো, আমি একজন বয়স্ক মানুষ এবং আমি দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে আছি আর জীবনে অনেক ভুলও করেছি; কিন্তু গত কয়েক বছরে, আমি কম ভুল করেছি। এবং আমি এই ব্যাপারে তোমার চেয়ে ভিন্নভাবেই বরং ভাবছি।

লিজি : আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?

সিনেটর : কীভাবে আমি তা ব্যাখ্যা করতে পারি? শোনো। আমরা কল্পনা করতে পারি, আংকেল স্যাম হঠাৎ ওই দরজা দিয়ে এলেন। তিনি কি বলবেন বলে তুমি মনে করো?

লিজি [ভীতস্বরে] : ওহ্, আমার মনে হয় না আমাকে তিনি বেশি কিছু বলবেন।

সিনেটর : তুমি কি একজন কমিউনিস্ট?

লিজি : কী বলছেন আপনি? অবশ্যই না!

সিনেটর : তাহলে তোমাকে অনেক কথাই বলার থাকবে তাঁর। তিনি বলবেন : ‘লিজি, তোমাকে আমার দুই ছেলের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে। ওদের যে-কোনো একজনকে অবশ্যই অদৃশ্য হতে হবে। এই রকম ক্ষেত্রে একজন কি করে? দুটির মধ্যে যা বেশি ভালো সেটিই তুমি করবে। ঠিক আছে, চলো আমরা দেখি কোনটি বেশি ভালো। দেখব আমরা?

লিজি : অবশ্যই। চলুন আমরা দেখি।

সিনেটর : লিজি, এই যে নিগ্রোটাকে তুমি বাঁচাতে চাইছ, ওকে দিয়ে কার কি কাজ হবে? ঈশ্বর জানেন, কোথায় জন্ম হয়েছে তার। আমি তাকে খাইয়েছি আর প্রতিদানে আমার জন্য কী করছে সে? কিছুই না। কোনো কাজ করে না সে, সারাদিন কেবল খায় আর গান গায়। চটকদার জামাকাপড় আর রঙচঙে টাই কেনে। ও আমার ছেলে আর আমি ওকে ছেলের মতো ভালোবাসি। কিন্তু, আমি তোমার কাছে জানতে চাই, সে কি মানুষের জীবন যাপন করছে? ও মরে গেলেও আমার কিছু আসবে-যাবে না।

লিজি : আপনি একজন দারুণ বক্তা।

সিনেটর [আগের কথার রেশ টেনে] : আর দেখ, আরেকটি ছেলে, এই টমাস একটা নিগ্রোকে মেরে ফেলেছে। খুব খারাপ কাজ করেছে সে। কিন্তু ওকে আমার প্রয়োজন আছে। সে শতভাগ আমেরিকান, আমাদের এখানকার সবচেয়ে পুরনো পরিবারগুলির একটির ছেলে। সে হার্ভার্ডে গিয়েছিল। সে একজন অফিসার – এবং আমার অফিসারের প্রয়োজন আছে – তার কারখানায় দুই হাজার শ্রমিক কাজ করে – সে যদি মারা যায়, দুই হাজার মানুষ চাকরি হারাবে। সে একজন জননেতা, কমিউনিজম, ট্রেড ইউনিয়ন এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে একটা শক্ত দুর্গপ্রাচীর। তার কাজ হচ্ছে বেঁচে থাকা আর তোমার কাজ হচ্ছে তাকে বাঁচিয়ে রাখা। কেবল এটুকুই আমার তোমাকে বলার আছে। এখন তুমি কি করবে সেটা তোমার ব্যাপার।

লিজি : কী সুন্দরভাবেই না আপনি বলেন।

সিনেটর : এবার বেছে নাও তুমি।

লিজি [এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে] : কী? ওহ্, আচ্ছা … [একটু থেমে] আপনার কথা শুনে আমার মনের মধ্যে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেছে। আমি জানি না, আমি কোথায় আছি!

সিনেটর : আমার দিকে তাকাও, লিজি। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো?

লিজি : হ্যাঁ, সিনেটর।

সিনেটর : তুমি কি মনে করো, আমি তোমাকে কোনো অন্যায় করার জন্য বলব?

লিজি : না, সিনেটর।

সিনেটর : তাহলে সই করো। এই যে আমার কলম।

লিজি : আপনি কি মনে করেন, এতে উনি আমার ওপর খুশি হবেন?

সিনেটর : কে?

লিজি : আপনার বোন।

সিনেটর : সে তোমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসবে।

লিজি : হয়তো উনি আমাকে কিছু ফুলও পাঠাবেন।

সিনেটর : খুব সম্ভব।

লিজি : অথবা সই করা একটা ছবি?

সিনেটর : খুব সম্ভব।

লিজি : আমি সেটা দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখব। [একটু চুপ করে থাকার পর। সে পায়চারি করতে থাকে।] কী সব না ঘটে চলেছে! [সিনেটরের কাছে ফিরে এসে] আমি যদি সই করি, তাহলে নিগ্রোটাকে আপনারা কী করবেন?

সিনেটর : নিগ্রোটা? বাহ্! [তিনি লিজিকে দুই কাঁধে হাত দিয়ে ধরেন।] তুমি যদি কাগজটায় সই করো, তাহলে পুরো শহরটাই তোমাকে লুফে নেবে। পুরো শহরই। শহরের সব মায়েরা।

লিজি : কিন্তু …

সিনেটর : তুমি কি ভাবতে পারো পুরো শহরটাই ভুল করছে? একটি পুরো শহর, এর সব ধর্মযাজক আর মন্ত্রী, এর চিকিৎসকরা, এর আইনজীবীরা, খবরের কাগজওয়ালারা, এর মেয়ররা, টাউন কাউন্সিলররা এবং সব দাতব্য প্রতিষ্ঠান? তুমি কি সত্যিই তা ভাবছ?

লিজি : না, না, না।

[ফ্রেড, জন ও জেমস প্রবেশ করে। ওরা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।]

সিনেটর : তোমার হাতটা দাও। [তিনি ওকে সই করার জন্য জোর করতে থাকেন।] ওখানে, লিজি। আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমার বোন এবং আমার ভাগ্নের পক্ষ থেকে, আমাদের শহরের সতেরো হাজার সাদা মানুষের পক্ষ থেকে, আংকেল স্যাম এবং যে আমেরিকান জাতির আমি প্রতিনিধিত্ব করি তাদের পক্ষ থেকে। [তিনি ওর কপালে চুম্বন করেন।] গুড বাই, বাছা আমার। [লিজির দিকে তাকিয়ে] আমি আবার তোমার সঙ্গে দেখা করব; আমাদের একে অপরকে বলার মতো আরো কথা আছে। ছেলেরা, তোমরাও চলো। [তিনি বেরিয়ে যান।]

ফ্রেড : গুডবাই, লিজি।

লিজি : গুডবাই। [ওরা বেরিয়ে যায়। লিজি ভেঙে পড়ে, এরপর হঠাৎ দরজার দিকে দৌড়ে যায়।] সিনেটর! সিনেটর! ফিরে আসুন! ওই কাগজটা ছিঁড়ে ফেলুন। সিনেটর! [সে ঘরের ভেতর ফিরে আসে এবং যন্ত্রচালিতের মতো ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটি হাতে তুলে নেয়।] আংকেল স্যাম এবং আমেরিকান নেশান! [ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটির প্লাগ দেয়লে ঢুকিয়ে দেয়। এবার পাগলের মতো সেটি ওপর-নিচ করতে থাকে।]

দৃশ্য দ্বিতীয়

ঘরের দৃশ্য একই রকম। বারো ঘণ্টা পর। ঘরের বাতিগুলো জ্বলছে, জানালাগুলি খোলা, বাইরে অন্ধকার। বাইরে শোরগোলের শব্দ, যা ক্রমশ বাড়ছে। নিগ্রোটি জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়, তারপর সেটির ওপর উঠে পড়ে, এবং লাফিয়ে ঘরের মধ্যে নামে। মঞ্চের মাঝামাঝি উঠে দাঁড়ায় আর তখনই বেল বেজে ওঠে। একটি পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে সে। লিজি বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে, সামনের দরজার দিকে যায় এবং দরজাটি খোলে।

লিজি : ভেতরে আসুন। [সিনেটর ঘরে প্রবেশ করেন।] বলুন, কী খবর!

সিনেটর : টমাস ওর মায়ের কাছে আছে। আমি তোমাকে ওদের ধন্যবাদ পৌঁছে দিতে এসেছি।

লিজি : উনি খুশি হয়েছেন?

সিনেটর : পুরোপুরি খুশি।

লিজি : বসুন।

সিনেটর : ধন্যবাদ তোমাকে।

লিজি : উনি কি কেঁদেছিলেন?

সিনেটর : কান্না? কেন ও কাঁদবে? সে একজন সাহসী মহিলা।

লিজি : আপনি বলেছিলেন, উনি কাঁদছিলেন।

সিনেটর : ওটা একটা কথার কথা।

লিজি : তিনি এটা আশা করতে পারেননি, তাই না? উনি ভেবেছিলেন, আমি একটা খারাপ মেয়ে এবং আমি নিগ্রোটির পক্ষেই থাকব।

সিনেটর :  সে ঈশ্বরের ক্ষমাই চেয়েছিল।

লিজি : উনি আমার সম্পর্কে কি ভেবেছেন?

সিনেটর : সে তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে।

লিজি : উনি কি আপনার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আমি কেমন দেখতে?

সিনেটর : না।

লিজি : উনি কি মনে করেন, আমি ঠিক আচরণ করেছি?

সিনেটর : সে মনে করে, তুমি ঠিক কাজটিই করেছ।

লিজি : ইয়াহ্ …

সিনেটর : সে আশা করে, তুমি সবসময় ঠিক কাজটিই করবে।

লিজি : ইয়াহ্ …

সিনেটর : আমার দিকে তাকাও লিজি। [তিনি ওকে কাঁধ ধরে কাছে টেনে আনেন।] তুমি ঠিক কাজটিই করে যাবে, তাই না? তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না, আমি ওকে নিরাশ করি।

লিজি : চিন্তা করবেন না। আমি আমার কথা থেকে ফিরে যাব না, ওরা আমাকে একটা পানির মগের মধ্যে বসিয়ে দিয়েছে। [একটু থেমে] কীসের শোরগোল ওটা?

সিনেটর : কিছু না।

লিজি : আমি ওটা আর সহ্য করতে পারছি না। [সে জানালার কাছে যায়।] সিনেটর!

সিনেটর : বলো সোনা।

লিজি : আপনি কি নিশ্চিত যে আমরা কোনো ভুল করিনি? আমি কি ঠিক কাজটা করেছি?

সিনেটর : একেবারে নিশ্চিত।

[বাইরে শোরগোল আরো বেড়ে যায়।]

লিজি : আমি নিজেকে এখন আর চিনতে পারছি না; আপনি আমার মধ্যে সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে দিয়েছেন। আমার ভাবনার পক্ষে অনেক দ্রুত চিন্তা করেন আপনি। এখন সময় কত?

সিনেটর : এগারোটা।

লিজি : সকাল হতে আরো ছয় ঘণ্টা বাকি। এ-রাতে আমি আর ঘুমোতে পারব না। [একটু থেমে] দিনগুলির চেয়ে রাতগুলি বেশি গরম। [একটু থেমে] সেই নিগ্রোটার খবর কী?

সিনেটর : কোন নিগ্রো? ওহ্, ওহ্, হ্যাঁ। ওরা ওকে খুঁজছে।

লিজি : ধরতে পারলে ওকে নিয়ে কী করবে ওরা? [সিনেটর তাঁর কাঁধ ঝাঁকান। বাইরে শোরগোলের শব্দ আরো বাড়ে। লিজি জানালার কাছে এগিয়ে যায়।] ওই চিৎকার-চেঁচামেচি কিসের? ওখানে টর্চ আর কুকুর নিয়ে অনেক লোক। এটা কি একটি টর্চলাইট মিছিল? অথবা এটা কি … বলুন ওটা কি, সিনেটর। আমাকে বলুন ওরা ওখানে কী করছে!

সিনেটর [পকেট থেকে একটা খাম বের করেন] : আমার বোন তোমাকে এটা দিতে বলেছে।

লিজিং : উনি আমাকে চিঠি লিখেছেন?

[সে খামটি ছিঁড়ে সেখান থেকে একশো ডলারের একটি নোট বের করে, খামের ভেতরে খুঁজে দেখে কোনো চিঠি আছে কি না। সেখানে কোনো চিঠি দেখতে পায় না, খামটি দলা করে ছুড়ে ফেলে দেয়। ওর গলার স্কর বদলে যায়।] একশ ডলার! আপনি খুশি হবেন। আপনার ছেলে আমাকে পাঁচশো ডলার দেবে বলেছিল। আপনি অনেক টাকা বাঁচিয়ে ফেলেছেন!

সিনেটর : শোনো মেয়ে …

লিজি : আপনি আপনার বোনকে ধন্যবাদ জানাতে পারেন। ওঁকে বলবেন, আমি বরং একটি লিপস্টিক অথবা এক জোড়া নাইলনের মোজা যা তিনি কষ্ট করে পছন্দ করতেন, বেশি পছন্দ করতাম। [সে নোটটি ছুড়ে ফেলে দেয়।] কিন্তু ভাবনাটাই আসল, তাই না? [একটু থেমে] আপনি খুব সুন্দরভাবে আমাকে বোকা বানিয়েছেন।

[সামান্য বিরতি। দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সিনেটর লিজির দিকে এক পা এগিয়ে যান।]

সিনেটর : লিজি, চলো আমরা একটু শান্ত হয়ে বসে কথা বলি। তুমি একটি নৈতিক সংকটের মধ্যে আছো, এবং আমার সহায়তা প্রয়োজন তোমার।

লিজি : আমার যা প্রয়োজন তা হচ্ছে নির্জলা স্কচ। কিন্তু আমি আশা করি, আমরা একে অপরকে বুঝতে পারব – আপনি এবং আমি।

[সামান্য বিরতি]

সিনেটর : তুমি জানো, তোমার মধ্যে বেশ কিছুটা সহজাত আকর্ষণ আছে। তোমার মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যা তোমার যথেচ্ছাচারও শেষ করতে পারেনি। হ্যাঁ। হ্যাঁ, এসব একটা কিছু। [তিনি ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দেন। লিজি কোনো বাধা দেয় না, চুপ করে থাকে এবং ওর চোখেমুখে ঘৃণার ভাব ফুটে ওঠে।] আমি আবার আসব। বাইরে আমার সঙ্গে দেখা করতে যেও না।

[সিনেটর বেরিয়ে যান। লিজি অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। একশ ডলারের নোটটি আবার তুলে নেয়, দুমড়ে-মুচড়ে সেটি আবার ছুড়ে দেয়, এরপর একটি চেয়ারে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে। বাইরে শোরগোলের শব্দটা আরো কাছে আসতে থাকে। দূরে গুলির শব্দ শোনা যায়। নিগ্রোটি পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে, লিজির সামনে দাঁড়ায়। লিজি মুখ তুলে শব্দ করে কেঁদে ওঠে।]

লিজি : আহ্ [একটু থেমে] আমি ঠিক জানতাম, তুমি ফিরে আসবে। আমি ঠিক জানতাম। তুমি ভেতরে এসেছ কেমন করে?

নিগ্রো : জানালা দিয়ে।

লিজি : কী চাও তুমি?

নিগ্রো : আমাকে লুকিয়ে রাখুন।

লিজি : আমি তো বলেছিলাম, পারব না।

নিগ্রো : আপনি কি ওদের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন, ম্যাম?

লিজি : হ্যাঁ।

নিগ্রো : ওরা শিকার তাড়া করছে।

লিজি : কী শিকার?

নিগ্রো : মানুষ-শিকার।

লিজি : আহ্! [দীর্ঘক্ষণ পর] তুমি কি ঠিক জানো, ওরা তোমাকে দেখতে পায়নি?

নিগ্রো : অবশ্যই।

লিজি : ওরা যদি তোমাকে ধরতে পারে তাহলে কী করবে?

নিগ্রো : গ্যাসোলিন।

লিজি : কী?

নিগ্রো : গ্যাসোলিন। [সে গায়ে পেট্রোল ঢালার ভঙ্গি করে।] এরপর ওরা আগুন ধরিয়ে দেয়।

লিজি : এমনটা করে? বসো। [নিগ্রোটি ধপাস করে একটি চেয়ারে বসে পড়ে।] তোমাকে আমার কাছে আসতে হতো। আমি কি তোমার সঙ্গে ঠিক ব্যবহার করতাম না? [লিজি প্রায় ধমকের ভঙ্গিতে ওর দিকে এগিয়ে যায়।] আমি ঝামেলা পছন্দ করি না। বুঝেছ? [মেঝেয় পা ঠুকে] ঘৃণা করি! ঘৃণা করি! ঘৃণা করি!

নিগ্রো : ম্যাম, ওরা মনে করে আমি আপনার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছি।

লিজি : তাই?

নিগ্রো : ওরা আমাকে এখানে খুঁজতে আসবে না।

লিজি : তুমি কি জানো, ওরা কেন তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে?

নিগ্রো : কারণ আমি আপনার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছি।

লিজি : তুমি কি জানো – কে ওদের এ-কথা বলেছে?

নিগ্রো : না।

লিজি : আমি বলেছি। [অনেকক্ষণ চুপ থাকে। নিগ্রোটি লিজিকে দেখে।] তোমার কি মনে হয়?

নিগ্রো : আপনি কেন তা করেছেন, ম্যাম? উঃ! আপনি কেন তা করলেন?

লিজি : সেটা তো আমিও নিজেকে জিজ্ঞেস করছি!

নিগ্রো : ওরা মোটেই ক্ষমা করবে না, আমার চোখের ওপর চাবুক মারবে, ক্যান থেকে পেট্রোল ঢালবে আমার ওপর। আপনি কেন ওটা করলেন? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি!

লিজি : ওহ হ্যাঁ, তুমি করেছ। তোমার কোনো ধারণা নেই আমার কী ক্ষতি করেছ। [একটু থেমে] তুমি কি আমার ঘাড়টা ভাঙতে চাও না।

নিগ্রো : ওরা প্রায় সবসময় লোকদের এমন সব কথা বলতে বাধ্য করে যা তারা বলতে চায় না।

লিজি : হ্যাঁ। প্রায় সবসময়। আর যখন তারা তা করতে পারে না, তখন তারা তাদের ছোট ছোট গল্পগুলির সঙ্গে সেগুলিকে মিশিয়ে দেয়। [একটু থেমে] ঠিক আছে? তুমি কি আমার ঘাড়টা ভাঙতে চাও না? তুমি একজন ভালো মানুষ। [একটু থেমে] আমি তোমাকে আগামীকাল রাত পর্যন্ত লুকিয়ে রাখব। [একটু সরে দাঁড়ায় নিগ্রোটি।] আমাকে ছোঁবে না; আমি কালোদের পছন্দ করি না। [বাইরে চিৎকার আর গুলির শব্দগুলি আরো কাছে চলে আসে।] ওরা আরো কাছে চলে আসছে। [বাতিটা নিভিয়ে দেয়, জানালার কাছে যায়, পর্দাগুলি ভাগ করে দেয় এবং নিচে রাস্তার দিকে চেয়ে দেখে।] আমরা ধরা পড়ে গেছি।

নিগ্রো : ওরা কী করছে?

লিজি : ওরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাহারা বসিয়েছে এবং প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশি করছে। তোমার শুধু এখানে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না, তাই না? কেউ না কেউ অবশ্যই রাস্তায় তোমাকে দেখেছে। [সে আবার বাইরে তাকায়।] এখন ওরা এদিকেই আসছে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছে ওরা।

নিগ্রো : কতজন আছে ওরা?

লিজি : পাঁচ কি ছয় জন। বাকিরা নিচে দাঁড়িয়ে নজর রাখছে। [সে নিগ্রোটির কাছে ফিরে যায়।] ওভাবে কাঁপবে না! যিশুর নামে বলছি, ওভাবে কাঁপবে না। [একটু থেমে। ব্রেসলেটটি মেঝেয় ছুড়ে দেয় সে এবং সেটির ওপর পা ঠুকতে থাকে] তুমি এখানে এসে ঠিক করেছ। [নিগ্রোটি উঠে দাঁড়ায় এবং চলে যেতে উদ্যত হয়।] সোজা হয়ে বসে থাকো। তুমি যদি বাইরে যাও, তাহলে আমরা শেষ।

নিগ্রো : বাড়ির ছাদ।

লিজি : এই রকম চাঁদের আলোয়? চেষ্টা করে দেখতে পারো যদি পুরো শরীরটা বুলেটে ঝাঁঝরা করতে চাও। [একটু থেমে] দাঁড়াও। এখানে আসার আগে তাদের দুটি তলা খুঁজতে হবে। [দীর্ঘক্ষণ বিরতি।] সে পায়চারি করতে থাকে। নিগ্রোটি নিজেকে গুটিয়ে চেয়ারে বসে থাকে।] তোমার কাছে কি কোনো পিস্তল আছে?

নিগ্রো : ওহ্, না।

লিজি : ঠিক কাছে। [সে স্যুটকেসের কাছে গিয়ে তার ভেতর থেকে একটি রিভলভার বের করে।]

নিগ্রো : আপনি কি করতে যাচ্ছেন, ম্যাডাম?

লিজি : আমি দরজা খুলে ওদেরকে ভেতরে আসতে বলব। পঁচিশ বছর ধরে ওরা আমাকে বোকা বানিয়েছে। সাদা-চুল মায়েরা! জাতীয় বীরেরা! আংকেল স্যাম এবং আমেরিকান নেশান! এখন আমি বুঝতে পারছি। ওরা আবারও তা করতে পারবে না। আমি দরজা খুলব এবং ওদেরকে বলব : ‘সে এখানে আছে। এখানে আছে সে, তবে সে কিছু করেনি! আমাকে একটা মিথ্যা বিবৃতিতে সই করতে বাধ্য করা হয়েছিল। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি যে, সে কিছু করেনি।’

নিগ্রো : ওরা তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।

লিজি : হয়তো। হয়তো ওরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না; তখন তুমি বন্দুকটা ওদের দিকে তাক করবে এবং ওরা যদি চলে না যায়, তাহলে তুমি গুলি করবে।

নিগ্রোরা : অন্যরাও এসে যাবে।

লিজি : তোমাকে অবশ্যই ওদেরকেও গুলি করতে হবে। এবং তুমি যদি সিনেটরের ছেলেটাকে দেখতে পাও, তাহলে ওকে যাতে মিস না করো সে চেষ্টা করতে হবে; কারণ পুরো ব্যাপারটার পরিকল্পনা ওরই করা। আমাদের আর কোনো আশা নেই, আমি বলছি তোমাকে। ঘটনা যা-ই ঘটুক না কেন, আমাদের বাঁচার আর কোনো আশা নেই। আমি বলছি তোমাকে! ওরা যদি তোমাকে এখানে পায়, তাহলে আমার আর কিছু করার থাকবে না। অতএব, আমরা তাহলে মরতে পারব একে অপরের ভালো সঙ্গী হয়ে। [সে রিভলভারটা বাড়িয়ে দেয়।] নাও এটা। ধরো, আমি বলছি তোমাকে।

নিগ্রো : আমি পারব না, ম্যাম।

লিজি : কী?

নিগ্রো : আমি কোনো সাদা মানুষকে গুলি করতে পারব না।

লিজি : ওরা অতো নরম হবে না।

নিগ্রো : ওরা সাদা মানুষ, ম্যাম।

লিজি : তাতে কী? ওরা সাদা, শুধু এজন্যই কি তোমাদেরকে কুকুরের মতো গুলি করে মারার অধিকার আছে ওদের?

নিগ্রো : ওরা সাদা মানুষ।

লিজি : বাথরুমে লুকিয়ে পড়ো।

[নিগ্রোটি লিজির কথা শোনে। লিজি অপেক্ষা করে। বেল বাজার শব্দ হয়। সে পা আড়াআড়ি করে দাঁড়ায়, ব্রেসলেটটি তুলে নেয়। এরপর দরজা খোলে। বন্দুক হাতে বেশ কয়েকজন মানুষ সেখানে দাঁড়ানো।]

প্রথম ব্যক্তি : আমরা নিগ্রোটাকে খুঁজছি।

লিজি : কোন নিগ্রো?

প্রথম ব্যক্তি : যে-নিগ্রোটি ট্রেনে একটা সাদা মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল আর ক্ষুর দিয়ে সিনেটরের বোনের ছেলেকে আঘাত করেছিল।

লিজি : ওকে খোঁজার জন্য তোমাদের এখানে আসা উচিত হয়নি। [একটু থেমে] আমাকে চিনতে পারছ না তোমরা?

দ্বিতীয় ব্যক্তি : হ্যাঁ। আমি তোমাকে পরশু দিন ট্রেন থেকে নামতে দেখেছিলাম।

লিজি : আমিই সেই মেয়ে যাকে সেই লোকটি ধর্ষণ করেছিল। দেখছ না? [আগন্তুকদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা যায়। তারা এক ধরনের বিস্ময়, কামনা ও ভয়ের ভাব নিয়ে লিজিকে দেখে। একটু পিছিয়ে যায় ওরা। সামান্যক্ষণ পর। তারা হেসে ওঠে।]

একজন : আপনি কি ওকে ফাঁসিতে ঝোলানোটা দেখতে চান, বোন?

লিজি : ওকে ধরতে পারলে এসে আমাকে নিয়ে যেও।

লোকদের মধ্যে একজন : বেশি সময় লাগবে না, মিষ্টি আপা!

অপর একজন : আমরা জানি, সে রাস্তায় কোথাও লুকিয়ে আছে।

লিজি : সৌভাগ্য আপনাদের সহায় হোক। [ওরা সবাই বেরিয়ে যায়। লিজি দরজা বন্ধ করে। এরপর রিভলভারটি বিছানার ওপর রাখে।] তুমি বেরিয়ে আসতে পারো এখন। [নিগ্রোটি বেরিয়ে আসে, হাঁটু গেড়ে বসে লিজির জামার প্রান্তভাগ চুম্বন করে।] আমি তোমাকে বলেছি আমাকে না ছুঁতে। [সে নিগ্রোটির দিকে তাকায়।] তুমি নিশ্চয়ই একটা আজব জিনিস, যেজন্য সারা শহরের মানুষ তোমার পেছনে লেগেছে।

নিগ্রো : আমি কিছু করিনি, ম্যাম! আপনি জানেন সেটা।

লিজি : সবাই বলে, একটা নিগ্রো সবসময় কিছু না কিছু করেছে।

নিগ্রো : আমি কিছু করিনি।

লিজি [ব্যান্ডটা কপালের ওপর রাখে] : জানি না আমি কোথায় আছি। [একটু থেমে] একই ব্যাপার, পুরো একটা শহর, সবাই তো আর ভুল করতে পারে না। … [একটু থেমে] দুত্তোরি ছাই! আমি কিছুই আর বুঝতে পারছি না।

নিগ্রো : এটা এ-রকমই ম্যাম। সাদা লোকদের ব্যাপারে এটা সবসময় এরকম।

লিজি : তুমিও কি দোষী ভাবছ নিজেকে?

নিগ্রো : হ্যাঁ, ম্যাম।

লিজি : এবং তুমি কিছুই করোনি!

নিগ্রো : না, ম্যাম।

লিজি : কিন্তু লোকজন ওদের পক্ষে কেন?

নিগ্রো : ওরা সাদা মানুষ।

লিজি : আমিও সাদা। [একটু থামে। বাইরে পদশব্দ শোনা যায়। সে সহজাত প্রবণতায় নিগ্রোটির দিকে যায়। নিগ্রোটি কাঁপতে থাকে, তবে তার বাহু দিয়ে লিজির কাঁধ জড়িয়ে ধরে। বাইরে পদশব্দ মিলিয়ে যায়। নীরবতা। এক ঝটকায় নিজেকে মুক্ত করে নেয় লিজি।] ছি! আমাদের নিশ্চয়ই একাকী দেখাচ্ছিল। এক জোড়া এতিমের মতো। [বেল বেজে ওঠে। ওরা নীরবে শোনে। আবার বেল বাজে।] বাথরুমে চলে যাও। [কেউ একজন দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে থাকে। নিগ্রোটি লুকিয়ে পড়ে। লিজি দরজা খোলে। দরজায় ফ্রেড।] তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? আমার দরজায় এভাবে আঘাত করছ কেন? না, তুমি ভেতরে আসবে না। [সে লিজিকে একপাশে ঠেলে দিয়ে ভেতরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে দেয়। দরজা বন্ধ  করে দেয় এবং লিজির কাঁধে হাত রাখে। দীর্ঘ নীরবতা।] কী ব্যাপার?

ফ্রেড : একটা নিগারকে ওরা ধরেছে। এটা অবশ্য সেই নিগারটা নয়। তবে ওরা ওকেই মেরে ফেলেছে।

লিজি : তাহলে?

ফ্রেড :  আমি ওদের সঙ্গেই ছিলাম। [লিজি শিস দিয়ে ওঠে।]

লিজি : ওহ্, তাই? [একটু থেমে] ওরা বলে যে এটা একটা দেখার মতো ব্যাপার – এই, একটা নিগ্রোকে কোনো বিচার ছাড়াই মেরে ফেলার ঘটনাটা দেখা।

ফ্রেড : আমি তোমাকে চাই।

লিজি : কী?

ফ্রেড : তুমি একটা মায়াবিনী। জাদু করেছ তুমি আমাকে। আমি ওদের মাঝখানেই ছিলাম। আমার রিভলভারটাও আমার পকেটে ছিল আর নিগারটা একটা গলিতে বেরিয়ে এসেছিল। আমি ওর দিকে তাকালাম আর তক্ষুনি আমার মনে হলো আমার তাকে চাই। এটা মোটেই স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়।

লিজি : আমাকে যেতে দাও। আমি বলছি, আমাকে যেতে দাও।

ফ্রেড : এর অর্থ কী? কি করেছ তুমি আমার, ডাইনি? আমি নিগ্রোটার দিকে তাকিয়েছিলাম আর তোমাকে দেখতে পেলাম। আগুনের শিখার ওপর দাঁড়িয়ে আছ তুমি। আমি গুলি করলাম।

লিজি : তুমি একটা বাস্টার্ড! আমাকে যেতে দাও! খুনি

কোথাকার!

ফ্রেড : আমাকে কী করেছ তুমি? আমার দাঁতের সঙ্গে মাড়ি যেভাবে আটকে আছে সেভাবে ঘিরে আছো তুমি আমাকে। [লিজিকে জোর করে বিছানায় নিয়ে যেতে চায়।] আমি সব জায়গায় তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার শরীর। তোমার ওই দুষ্ট শরীর। আমার দুই হাতের মাঝখানে তোমার উষ্ণতা অনুভব করি আমি; আমার নাকের ভেতরে তোমার শরীরের গন্ধ পাই আমি। আমি সমস্তটা পথ ছুটতে ছুটতে এখানে এসেছি। আমি জানতাম না – সেটা কি তোমাকে মেরে ফেলতে অথবা জোর করে তোমাকে অধিকার করতে। এখন আমি জানি। [সে হঠাৎ করে লিজিকে ছেড়ে দেয় এবং আবার ওর কাছে আসে।] আজ সকালে তুমি যা বলেছিলে, সেটা কি সত্যি?

লিজি : কী?

ফ্রেড : তুমি আমাকে পছন্দ করো।

লিজি : আমাকে একা থাকতে দাও।

ফ্রেড : শপথ করে বলো যে এটা সত্য। শপথ করো। [সে লিজির হাত মোচড়াতে থাকে। লিজি চিৎকার করে ওঠে। বাথরুমে একটা শব্দ হয়।] এটা কি? [সে কান খাড়া করে শোনে।] এখানে কেউ একজন আছে।

লিজি : তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওখানে কেউ নেই।

ফ্রেড : হ্যাঁ, আছে। বাথরুমে। [সে বাথরুমের দিকে যায়।]

লিজি : তুমি ওখানে যেতে পারবে না।

ফ্রেড : অবশ্যই সেখানে কেউ একজন আছে।

লিজি : আমার একজন ক্লায়েন্ট। ভুঁড়িওয়ালা লোক একজন।

ফ্রেড : ক্লায়েন্ট? তোমার আর কোনো ক্লায়েন্ট থাকবে না। কখনো না। তুমি আমার। [একটু থেমে] আমি ওই লোকটাকে দেখতে চাই। [চিৎকার করে বলে সে] ওখান থেকে বেরিয়ে এসো!

লিজি [চিৎকার করে] : বেরিয়ে আসবে না। এটা একটা ফাঁদ – ট্র্যাপ।

ফ্রেড : বেরিয়ে এসো ওখান থেকে। [সে খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে লিজিকে সরিয়ে দেয়, দরজার কাছে যায় এবং সেটি খুলে ফেলে। নিগ্রোটি বেেিয় আসে।] এই তোমার ক্লায়েন্ট?

লিজি : গুলি করবে না ওকে। তুমি জানো, সে নিরপরাধ।

[ফ্রেড তার রিভলভার বের করে। হঠাৎ নিগ্রোটি সামনের দিকে লাফ দেয়। ফ্রেডকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে দেয় এবং দৌড়ে পালিয়ে যায়। ফ্রেড ওর পেছন পেছন যায়। যে দরজা দিয়ে ওরা দুজন বেরিয়ে গেল লিজি সে দরজা পর্যন্ত যায় এবং চিৎকার করতে শুরু করে।]

লিজি : ও নির্দোষ, নির্দোষ। [গুলির দুটি শব্দ শোনা যায়। লিজি ফিরে আসে। ওর মুখ থমথমে এবং শক্ত। সে টেবিলের কাছে গিয়ে রিভলভারটি হাতে তুলে নেয়। ফ্রেড ফিরে আসে। লিজি ওর দিকে ফেরে, পেছনটা দর্শকদের দিকে, রিভলভারটা পেছনে হাতে ধরা। ফ্রেড রিভলভারটা টেবিলের ওপর ছুড়ে মারে।] তুমি কি ওকে ধরতে পেরেছিলে? [ফ্রেড কোনো উত্তর দেয় না।] চমৎকার। ঠিক আছে। এখন তোমার পালা। [লিজি রিভলভার ফ্রেডের দিকে তাক করে।]

ফ্রেড : লিজি! আমার মায়ের কথা একবার ভাবো।

লিজি : চুলোয় যাক তোমার মা! আমি এর মধ্যেই সে-পথটা ঘুরে এসেছি।

ফ্রেড [ধীরপায়ে লিজির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে] : প্রথম ক্লার্ক তাঁর নিজের হাতে বনজঙ্গল সাফ করেছেন; লুকোনো জায়গা থেকে গুলি খেয়ে মরার আগে তিনি নিজের হাতে ১৬ জন ইন্ডিয়ানকে গুলি করে মেরেছিলেন। তাঁর ছেলে এই শহরের প্রায় পুরোটাই নির্মাণ করেছিলেন; তিনি জর্জ ওয়াশিংটনের বন্ধু ছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে ইয়র্ক টাউনে মারা গিয়েছিলেন। আমার পরদাদা ছিলেন সানফ্রান্সিসকোতে একজন বীর যোদ্ধা। সেখানকার দাবানলের সময় তিনি পঁচিশজন মানুষকে বাঁচিয়েছিলেন। আমার দাদা এসেছিলেন এখানে বসবাস করতে। তিনি মিসিসিপি পর্যন্ত একটা খাল কাটিয়েছিলেন এবং এই অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ছিলেন। আমার পিতা একজন সিনেটর; তাঁর পর আমিও সিনেটর হবো; আমি তাঁর একমাত্র ছেলেসন্তান এবং আমার নামও ক্লার্ক। এই দেশটাকে তৈরি করেছি আমরা এবং এর কাহিনি হচ্ছে আমাদেরই কাহিনি। আলাস্কায়ও ক্লার্করা ছিলেন; ফিলিপাইন এবং নিউ মেক্সিকোতেও। পুরো আমেরিকাকে গুলি করতে চাও তুমি?

লিজি : তুমি যদি আরো কাছে আসো, তাহলে আমি গুলি করবো!

 ফ্রেড : গুলি করো! করো গুলি! দেখবে, তুমি পারছ না। তোমার মতো একটি মেয়ে আমার মতো একজন মানুষকে মারতে পারবে না। তুমি কে? কী করতে পারো তুমি? তুমি কি এমনকি তোমার দাদার নামটাও জানো? আমার বেঁচে থাকার অধিকার আছে : অনেক কাজ করার আছে আমার, সেগুলি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওই বন্দুকটা আমাকে দাও।

[লিজি রিভলভার ফ্রেডকে দেয়। সেটি সে পকেটে রেখে দেয়।]

ফ্রেড : নিগারটা অনেক বেশি জোরে দৌড়ে গেছে। আমি ওকে ধরতে পারিনি। [একটু থামে। দুই বাহু দিয়ে লিজির কাঁধ জড়িয়ে ধরে।] ওই পাহাড়টার ওপর আমি তোমাকে একটা বাড়ি কিনে দেবো, নদীর অপর দিকে, বাগানসহ চমৎকার একটা বাড়ি। তুমি বাগানে হেঁটে বেড়াতে পারবে, কিন্তু বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করছি আমি; আমি খুব হিংসুটে একজন মানুষ। সপ্তাহে তিন দিন সন্ধ্যায় আমি তোমার কাছে আসব। মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার এবং শনিবার। কালো চাদর-চাকরানী থাকবে তোমার এবং তোমাকে এত টাকা দেব আমি যা তুমি কখনো চিন্তাও করতে পারোনি। তবে তোমাকে অবশ্যই আমি যা চাই তা করতে হবে। এবং আমি অনেক কিছু চাই [লিজি ফ্রেডের বাহুতে নিজেকে একটুখানি সঁপে দেয়।] তোমার কি সত্যিই আমাকে ভালো লেগেছিল? বলো আমাকে। তোমার কি ভালো লেগেছিল?

লিজি [জড়িতস্বরে] : হ্যাঁ, লেগেছিল।

ফ্রেড [ওর চিবুকে আঙুলের টোকা দিয়ে আদর করে] : তাহলে সব ঠিক আছে। [একটু থেমে] তুমি আমাকে ফ্রেড বলে ডাকতে পারো।

[পর্দা নেমে আসে।]

নোবেলজয়ী ফরাসি লেখক জাঁ পল সার্ত্রের জন্ম ১৯০৫ সালের ২১শে জুন, ফ্রান্সের প্যারিসে। তিনি ছিলেন কুশলী কথাশিল্পী এবং একই সঙ্গে অস্তিত্ববাদের প্রবক্তা দার্শনিক। তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস এইজ অব রিজন, দি রিপ্রিভ এবং আয়রন ইন দি সোল-এর জন্য কথাশিল্পী হিসেবে তাঁর সমধিক প্রসিদ্ধি। তিনি বেশ কিছু নাটকও লিখেছেন যেগুলি প্রধানত ইঙ্গিতধর্মী এবং তাঁর দার্শনিক মতবাদের সহগামী। দি রেসপেক্টেবল প্রস্টিটিউট নাটকটির বক্তব্য বর্ণবাদ। মাত্র দুটি দৃশ্যের এই নাটকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে উঠে এসেছে শে^তাঙ্গ বর্ণবাদের চরিত্র ও বিমানবিক উগ্রতা। ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেও সে পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মৃত্যু ১৯৮০ সালে ৭৪ বছর বয়সে (১৫ই এপ্রিল)।