নব্বইয়ের গিরা

কী রাঁধবে না রাঁধবে ভাবতে ভাবতে আঙিনা ঝাঁট দিচ্ছিল সালমা। ঘরে চাল আছে। ডাল আছে। আলু আছে। বড়ি আছে। ঘরের চালে কুমড়ো আছে। কান্টার মাচায় পুঁইশাক আছে। সজনে গাছে সজনে শাক আছে। ওল আছে। এসব তো রোজই থাকে। গেরস্তবাড়ি বলে কথা! কিন্তু ওই একই জিনিস রোজ রোজ আর কত খাবে? মুখে ছালি পড়ে গেল! স্বামীটাও এমন কঞ্জুসের কঞ্জুস যে, না একটু মাছ – না একটু গোস্ত কিনবে। বাড়ির হাঁস-মুরগির আণ্ডাগুলো পর্যন্ত খেতে দেবে না। বললে বলবে, ‘মুখকে বারণ করতে শিখ্ – শরীর ভালো থাকবে। সংসারেরও উন্নতি হবে। কী ছিল হামার? পদ্মার ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে মায়ের হাত ধরে এসে উঠেছিলাম এই গাঁয়ে। এখানকার রহমান হাজির দিলে রহম ছিল তাই ঠাঁই দিয়াছিল। মা করত হাজির ঘর-গেরস্থালির কাম আর হামি করতাম রাখালি। হাজি ঠাঁই দিলে না, থাকতে জায়গাও দিলে। শুধু কি জায়গা, জয়নাল ঘরামিকে দিয়ে খলপার টাটির ঘর করে দিলে।’

পাড়ার মোড়ে পান-বিড়ির ঢপে যেভাবে সর্বক্ষণ ক্যাসেট বাজে সেভাবেই রোজ রাতে এসব শুনিয়ে যায় মরদ আলিম। বিবি সালমার এসব শুনতে ভালো লাগে না। সে বিরক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।  

হঠাৎ বাইরে রাস্তায় নিরঞ্জনের হাঁক শোনা যায়। সালমা শুনতে পায়, ‘মাছ ব্যাচ্চো মাছ।’ গোলাপনগরের নিরঞ্জন তাদের পাড়ায় রোজ মাছ বিক্রি করতে আসে। আজকেও এসেছে। কিন্তু সেই মাছ কিনতে পারবে না সে। স্বামী আলিমের বারণ আছে। ভালোমন্দ খেয়ে পয়সা নষ্ট করার বিরোধী তার স্বামী। অথচ পড়শি স্বপন কামারের বাড়ি থেকে একটু পরেই মাছ ভাজার গন্ধ ভেসে  আসবে সালমার নাকে।

হাতের ঝাঁটা ফেলে পাল্লা খুলে দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় সালমা। মাছ কেনা না হয় বারণ, দেখতে তো বারণ নেই। নিরঞ্জন মাছ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে স্বপন কামারের বাড়ির দরজায়। এরপর কী কী হবে সব জানে সালমা। স্বপনের বউ আরতি বেরিয়ে আসবে আঁচলে ভেজা হাত মুছতে মুছতে। জিজ্ঞেস করবে, ‘কী মাছ এন্যাছিস ভাই নিরু?’ নিরু ওরফে নিরঞ্জন বলবে, ‘আইজ ভালো ভালো মাছ আছে দিদি। পদ্মার বাঁশ পাবদা, বালাগাছি বিলের শোল, লাখদহ বিলের বোয়াল। … ’ আরো কত রকম মাছের নাম বলবে নিরঞ্জন। সালমা সেসব মাছের নাম মনে রাখতে পারবে না। আর মনে রেখেই বা কী লাভ? যখন খেতেই পাবে না! ওদিকে যেদিন যে-মাছ আনবে সেদিন সে-মাছের নাম বলবে নিরঞ্জন। আরতি নিরঞ্জনের সাইকেলের পেছনে বাঁধা হাঁড়ি থেকে নিজের হাতে তুলে দেখবে সেই মাছ। পছন্দ করবে। তারপর সেই পছন্দের মাছ ওজন করে কিনবে।

সপ্তাহে অন্তত চারদিন আরতির এমন মাছ কেনা দেখে সালমা। আর নিজের ভাগ্যকে দোষ দেয়। আসলে তার অন্তর জ্বলেপুড়ে যায়। আর রোববার দিন তো তার মনে দাউদাউ আগুন জ্বলে ওঠে। কিছুতেই নেভাতে পারে না। খালেক বিশ্বাসের পোল্ট্রি ফার্ম থেকে গোটা মুরগি কিনে নিয়ে আসে স্বপন। সব দেখতে পায় সালমা। শুধু দেখতে পায় না, আরতির রান্নাঘরে আর কী কী রান্না হয় সবকিছুর গন্ধ পায় পর্যন্ত। তার মন খারাপ করে।

নিজের জন্য এতকিছু হয় না সালমার, হয় তার ছেলে দুটির জন্য। বাপের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জোতে খাটে রহিম-সহিম। অথচ খাবার বেলায় ভালোমন্দ কিছুই জোটে না। ভাগ্যিস বছরে দুটি পরব হয়। তাই কোনো পরবে একটু লুচি-পায়েস আর এক পরবে ভাগ্যে কুরবানির গোস্ত জোটে। তাও তার স্বামী কুরবানির পরবে কুরবানি দেয় না। দশের গোস্ত যেটুকু ভাগে পায়, তা দিয়ে সালমা তার সারাবছরের মনের সাধ পূরণ করে।

বিয়ে-শাদি কিংবা খতনায় কেউ জিয়াফত করলেও যাবে না তার স্বামী। কাউকে যেতেও দেবে না। যাওয়ার কথা বললে বলবে, ‘এমনি কি আর জিয়াফত কর‌্যাছে? কাঁসার বাসনপত্র দান লিবে জে! হামি অত বোকা লয়। যে-টাকায় দান কিনব সে-টাকা ঘরে থাকলে একদিন রহমান হাজির ছোট পুতের তিন কিয়ারি ভুঁইটা হামার হবে।’

ওই ভুঁই কেনার নেশায় জোয়ান দুই বেটার বিয়ের কোথাও ভুলে আছে আলিম। এত বড় গেরস্থালি একা হাতে সামলাতে গিয়ে পদে পদে সমস্যায় পড়তে হয় সালমাকে; কিন্তু স্বামীকে কিছু বলতে পারে না। একবার-দুবার বলে বলে খিস্তি-খেউড় শুনেছে। তাই এখন আর কিছু বলে না। বলা ছেড়ে দিয়েছে। 

অন্যদিকে স্বপন কামারের ভিটেটুকু ছাড়া আর কিছুই নেই। তাও খুব ছোট। একটা ঝুপড়ি ঘর। আর একটা কামারশালা। সেটা খুব গোছানো। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত তার কামারশালা খোলা থাকে। কার হেঁসো, কার পাসনি, কার লাঙলের ফাল ধারালো করতে হবে, সে সদা প্রস্তুত। এই করে তার দৈনিক যা রোজগার হয়, দিব্যি হেসেখেলে তাদের দিন কেটে যায়। একটিই মেয়ে। নাম পার্বতী। বাহাদুরপুর এম.এস.কে-র ছাত্রী। দু-বছর পরীক্ষা না দিয়ে এ-বছর ক্লাস এইটের ছাত্রী। এবার নাকি সে কন্যাশ্রীর টাকা পাবে! এই তো কদিন হলো স্কুলের হেডমাস্টার কাউসার আলী বাড়ি এসে ফরম ফিলাপ করে নিয়ে গেল। স্বপন কামার কিংবা আরতির সেসব নিয়ে চিন্তা নেই। ‘দিন দিয়াছেন যিনি, সব সামলাবেন তিনি।’ এই প্রবাদবাক্য মেনে জীবন কাটায় তারা।

চোখের সামনে এসব দেখে সালমার সহ্য হয় না। তবু চুপ করে থাকে। স্বামীকে কিছু বলে না। কাউকেই বলে না। শুধু দেখে। যেমন এখন নিজের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছে আরতির মাছ কেনা।

আরতি : আজ কী মাছ এন্যাছিস ভাই নিরু? 

নিরঞ্জন : দিদি আজ খয়রা পেয়েছি।

আরতি : ইলিশ পাইসনি ভাই!

নিরঞ্জন : ইলিশ পদ্মায় তেমন উঠছে না। বাহির থেক্যাও আমদানি নাই। একটা, দুইটা বাজারে যা আসছে দাম মেলা!

আরতি : বাপরে বাপ এত টাকা দাম! দরকার নাই। তুই ভাই হামাকে এক পোয়া খয়রাই দে। 

বলে আরতি নিজেই নিরঞ্জনের সাইকেলের পেছনে বাঁধা হাঁড়ি থেকে বেছে বেছে খয়রা বের করে। আরতির হাতে ধরা খয়রা এমনই ঝিলিক মেরে ওঠে, সালমার চোখ ঝলসে যায়। তা বলে সে চোখে অন্ধকার দেখে না। কেননা, সে নিজেও পদ্মাপাড়ের মেয়ে। আর তার বাপ ছিল ঝানু মাছ ব্যবসায়ী। খান্দুয়ার পদ্মায় যে একশ-দেড়শো নৌকা সন্ধ্যা থেকে সকাল এবং সকাল থেকে সন্ধ্যা মাছের খোঁজে ছুটে বেড়াত, সবার মাছের পাইকার ছিল তার বাপ মনসুর মহালদার। তার বাপ সব মাছ কিনে ঘোড়াগাড়ি করে চালান দিত লালগোলার মাছের আড়তে। আর তাদের বাড়িতে মাছ ছাড়া ভাতের পাত পড়ত না।

এখন সালমার সেসব স্বপ্ন মনে হয়। সেই দিন নাই, দুনিয়াও নাই। বাপ-মা তার কবেই মরে গেছে। গাঁ-ঘর পদ্মা গিলে খেয়েছে তার পরপরই।  

ঠিক তখনই শুনতে পায় আরতির কণ্ঠ, খয়রার কত দাম ভাই নিরু?

– পঞ্চাশ টাকা পোয়া। নিরঞ্জন বলে।

আরতি নিরঞ্জনকে বলে, এক পোয়া ওজন কর ভাই তাহলে। হামি ঘর থেকে টাকা লিয়ে আসি।

পঞ্চাশ টাকার মাছ! কপাল বটে আরতির। নিজের দুয়ারে দাঁড়িয়ে নিজের কপালের কথা ভেবে আফসোস হয় সালমার। না, সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকে না সে, বাড়ির ভেতরে চলে আসে। দুই বেটা রহিম-সহিমকে নিয়ে স্বামী আলিম আটকিয়ারির মাঠে গেছে সেই কোন ভোরবেলা। শর্ষে বুনতে। শর্ষের তেলের যা দাম! চাল-ডালের পর তেলের ব্যবস্থা করে রাখা দরকার। বাপ-বেটারা মিলে গেল রাতে খেতে বসে সেসব নিয়ে আলোচনা করছিল। এখন মনে পড়ল সে-কথা। ওদের জন্য এখন মাঠে লাহারি পাঠাতে হবে। লাহারি বলতে, নুন-ছাতু আর পেঁয়াজ-লংকা। সঙ্গে এক কলসি পানি। নিয়ে যাবে বাড়ির রাখাল সুবেদ। কিন্তু ছোড়া কই?

‘সুবেদ’-‘সুবেদ’ করে দুবার হাঁক ছাড়ে সালমা।

এতক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে, হঠাৎ সালমার সামনে টপকে পড়ে। জিজ্ঞেস করে, ‘কী হইল চাছি? ডাকছো কেনে?’

– এতক্ষণ কুণ্ঠে ছিলি তুই?

– ভুসির ঘরে।

– কী করছিলি?

– গরুর শানি কাটছিনু।

– ঠিক আছে। জলদি কলসিতে পানি ভর। তোর চাছা আর ভাইদের লাহারি লিয়ে যাবি মাঠে।

সালমা তিনজনের জন্য পরিমাণমতো গামলায় ছাতু, কাগজের পুরিয়ায় লবণ আর কটা পেঁয়াজ-কাঁচা লংকা পুঁটলি করে বেঁধে দেয় একটা গামছায়। সুবেদের কলসিতে পানি ভরা হয়ে গিয়েছিল, সেটা মাথায় নিয়ে তার সালমা চাচির কাছ থেকে লাহারির পুঁটলিটা নিয়ে হাতে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে আটকিয়ারি মাঠের উদ্দেশে। 

সালমা নিশ্চিন্ত হয়। এখন সে ধীরেসুস্থে দুপুরের রান্নায় মন দেবে। কিন্তু রাঁধবে কী? আবার ভাবনাটা ফিরে আসে। সেই ভাবনা ভাবতে ভাবতে খিড়কির দরজা খোলে। কান্টার দিকে এগিয়ে যায়। মাচায় পুঁইশাক আছে। গাছে সজনে আছে। গাছে শাক। মাটির নিচে ওল আছে। কান্টার চালে চালকুমড়ো আছে। সব তার চোখের সামনে ভাসছে। কিন্তু রান্না কী করবে, বুঝতে পারছে না। শুধু আরতির খয়রা মাছ কেনার কথা মনে পড়ছে। এতক্ষণে নিশ্চয় আরতির খয়রা মাছ বাছা হয়ে গেছে। তেল-নুন-হলুদ মাখিয়ে উনুনে চড়িয়েছে। হ্যাঁ, ওই তো গন্ধ ভেসে আসছে। খয়রা মাছের গন্ধ নাকি ডালে ফোঁড়নের গন্ধ!

বুঝতে পারে না সালমা। তার খুব রাগ হয়। কান্টা ছেড়ে বাড়ির ভেতরে আসে। সিদ্ধান্ত নেয়, আলুর ঘ্যাঁট, ডাল আর ভাত ছাড়া কিছুই রাঁধবে না আজ।

দুপুর গড়িয়ে আটকিয়ারি মাঠে সর্ষে বুনে দুই বেটা রহিম-সহিমকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো আলিম। সুবেদ আগে থেকেই প্রস্তুত করে রেখেছিল আলিমের দু-জোড়া বলদের শানি। দুই নাদের গোড়ায় গরু জোড়াকে বেঁধে দেয় রহিম-সহিম।

আগেই আলিম বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিল সালমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে। কিন্তু সালমার কোনো সাড়াশব্দ নেই। কী হলো? বাড়ি ঢুকলেই সালমা তার জন্য লেবুপানি এগিয়ে ধরে। আজ তাহলে কোথায় গেল?

এ-ঘর, সে-ঘর, রান্নাঘর, কোথাও নেই সালমা। মনে খটকা দানা বাঁধে আলিমের। তার মধ্যে হঠাৎ সে দেখে খিড়কির দরজা খোলা। তৎক্ষণাৎ সেদিকে ছুটে গেল সে। আর দেখল কান্টায় একটা সজনেগাছের নিচে বসে সালমা কাঁদছে।

আলিম চমকে উঠল। কী এমন ঘটল? এখানে বসে সালমা কাঁদছে কেন?

ধীর পায়ে সালমার কাছে এগিয়ে গেল আলিম। সালমার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হইল? তুই কাঁদছিস ক্যানে?’

স্বামীর হাতের ছোঁয়ায় সালমা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, তা বলে আগ্নেয়গিরি হয়ে ফেটে পড়ল না, বরং বরফের মতো গলতে গলতে বলে উঠল, ‘কাঁদবো না তো কী করবো? তুমি কি হামাকে স্ত্রীর সন্মান দ্যাও? হামি তো তুমার বাড়ির ঝি। তাও ঝিয়ের মান-সন্মান থাকে। হামার কী আছে?’

সালমার মুখে হঠাৎ এমন কথা কেন? বুঝতে পারে না আলিম। তাই সে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কী হইল আগে বুলবি তো?’

‘কী বুলবো? তুমি দেখতে পাও না নাকি? পাশের বাড়ির স্বপনের হাঁড়িতে রোজ মাছ-গোস্ত হয়। হামাদের হাঁড়িতে হয় না ক্যানে?’

অন্য কোনোদিন হলে আলিম হয়তো এতক্ষণে মেজাজ হারিয়ে ফেলত। আজ মেজাজ হারাল না। সালমাকে দেখে তার মায়া হলো। স্বপন তার প্রতিবেশী। দিলখোলা মানুষ। ‘কেমন আছিস স্বপন?’ জিজ্ঞেস করলেই বলে, ‘দিন আনি দিন খাই দাদা। তুমাদের আশীর্বাদে আর কী চাই! ভালো আছি।’ সালমা ভুল বলেনি কিছু। স্বপনের হাঁড়িতে সত্যিই রোজ ভালোমন্দ রান্না হয়। তার নাকেও গন্ধ ভেসে আসে। যাই হোক, সালমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসে সে।

রাতে বিছানায় গিয়ে আলিম সালমাকে বলে, ‘তোর খুব কষ্ট, লয়?’

সালমা কিছু বলে না।

আলিম বলে, ‘স্বপন-আরতির খাওয়া দেখে তোর এত রাগ?’

সালমা বলে, ‘রাগ হবে ক্যানে? অরা ভালোমুন্দ খায়। দেখে ভালোই লাগে। তা হামরা গেরস্ত হুই হামরা খায় না ক্যানে?’

আলিম বলে, ‘বুঝছি। এক কাম কর তাহলে।’

– কী কাম?

– হামি কটা জিনিস দিছি, স্বপনের কামারশালের পাতনায় ফেলে আয়।

– কী জিনিস?

– দিছি, দাঁড়া।

বলে আলিম বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে প্যাটরা থেকে ন-টা দশ টাকার কয়েন বের করে এনে সালমার হাতে দেয়। বলে, ‘যা, এগলা ফেলে আয়। দেখিস কেহু য্যানে আবার তোকে দেখে না ফেলে।’ 

সালমা জিজ্ঞেস করে, ‘অ্যা আবার কী কাম যি?’

– তুই আগে ফেলে আয় তো! তারপর মজা দেখবি।

স্বপন-আরতির বাড়ির কোনো দরজা নেই। সালমা অনায়াসে স্বপনের কামারশালে গিয়ে স্বামীর আদেশ পালন করে ফিরে আসে।

স্বপন সকালে ঘুম থেকে উঠে কামারশালে গিয়ে কাজ শুরু করতেই পাতনায় হাত দিতেই দশ টাকার কয়েনের ছোঁয়া পায়। মাত্র একটা কয়েন! কে ফেললে? সে আবার পাতনার জলে হাত চোবায়, আবার একটি কয়েন তার হাতে উঠে আসে। দুটি কয়েন। তার মানে কুড়ি টাকা। আর একটা কয়েন পেলে তিরিশ টাকা হবে। স্বপন আবার পাতনায় হাত চোবায়। আশ্চর্য! আবার একটি কয়েন উঠে আসে। এভাবেই পরপর ন-টা কয়েন পায় সে। ভাবে দশটা পাবে, কিংবা তারও বেশি, কিন্তু পায় না। মন খারাপ হয়ে যায় তার। মুখের হাসি হারিয়ে যায়। আপন মনে কাজ শুরু করে।

বউ আরতি এসে বলল, ‘কই খালেক বিশ্বাস তো আইজ এখনো মাংস পাঠালে না? তুমি ফোন করোনি নাকি?’

স্বপন বলল, ‘ঘরে যা আছে তাই রাঁধ। রোজ রোজ অত মাছ-গোস্ত খেতে হবে না।’

এমন ভাবে বলল যে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পেল না আরতি। ভাবল কোনো কারণে হয়তো স্বপনের মন ভালো নেই। 

এক সপ্তাহ কেটে গেছে। নাকি এক মাস! আলিম একদিন সালমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আরতি আজ কী রেঁধ্যাছি রে?’

সালমা বলল, ‘কদিন কী রাঁধছে না রাঁধছে কিছুই টের পেছি না। আইজ-কাইল নিরঞ্জনের কাছে মাছও কিনছে না। খালেক বিশ্বাসের ফার্ম থেক্যা মুরগির গোস্তও আসছে না। কী হইল কে জানে!’

তৃপ্তির হাসি হেসে আলিম বলল, ‘একেই বলে নব্বইয়ের গিরার রোগ। যাকে ধরে জীবনভর ছাড়ে না। যেমুন হামাকে ছাড়েনি! বুঝলি কিছু? সেদিন স্বপনের কামারশালের পাতনায় তোর ফেলে আসা নব্বই টাকাকে স্বপন এখন একশো টাকা করতে চাহিছে। এরপর একশোকে দুশো করতে চাহিবে। তারপর দুশোকে হাজার। হাজারকে লাখ। লাখকে কোটি। ভালোমুন্দো খাওয়ার কথা তার আর মুনে থাকবে না …’