রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ : শ্রেষ্ঠ বন্ডগার্ল

কেউ জগতের রানিই হোন আর পীর-পয়গম্বর কিংবা সাধারণ মানুষই হোন। মৃত্যুই যে ধ্রুব আমরা তা জানি। তবু আমার বিলেতের জীবনের অভ্যস্ততায় বড় অদ্ভুত লাগছে যে, ব্রিটেন ও বাকিংহাম প্যালেসের রাজপ্রাসাদ আছে কিন্তু সেখানে রানী নেই। এ যেন পাখির বাসায় মা পাখি নেই। আরো ভাবতে পারি না এতো দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ৭৩ বছর বয়সে অবশেষে প্রিন্স অব ওয়েলস চার্লস এখন ইংল্যান্ডের রাজা! দ্য কিং চার্লস দ্য থার্ড। কী সব ইতিহাস আমি দেখলাম!

রানী এলিজাবেথ যখন বিলেতের রানী হয়েছিলেন তার মাত্র কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে আমার জন্ম হয়েছে। সিলেটি কন্যা বিধায় আমার সঙ্গে তাঁর দেশের প্রাণ বাঁধা, সেটা বোধশক্তি হওয়ার পরপরই টের পেয়েছি। সে সময় থেকে একে একে আমার তিন মামা ও এক চাচা বিলেতবাসী হয়েছেন। আমার এক দাদা ও চাচা লন্ডন ঘুরে এসেছেন। এই চাচা এক পাবের মালিক ছিলেন। তিনি এক শ্বেতাঙ্গ রমণীর প্রেমে পড়েন, তাঁকে বিয়ে ও সংসার করেন। সে অনেক লম্বা গল্প। যাক সেই সব। নানান ধারাবাহিকতায় আমিও একদিন বিলেতে পড়াতে এসে হয়েছি বিলেতবাসী। সেও হয়ে গেছে তিন দশকের বেশি।

১৯৫২ সালে সেই যে তিনি রানী হলেন তারপর কত জল বয়ে গেল টেমস ও সুরমায়! তাঁর রাজকর্ম, পরিবার জীবনের বিস্তৃতি, পৃথিবীর নানান যুদ্ধবিগ্রহ সামলানো, পনেরো প্রধানমন্ত্রীর আসা-যাওয়া, কমনওয়েলথ জোট থেকে একে একে দেউটি নিভে যাওয়া, হবু রাজপুত্রবধূর অপ্রত্যাশিত মৃত্যু … আর কত বলব? সত্তর বছরের এতো উল্লেখযোগ্য ঘটনা কি করে এখানে এ অল্প পরিসরে বলি? তাঁর সঙ্গের ওই সমান্তরাল সময়ে আমিও আমার জীবনচক্রে বহুবিধ ঘটনা ঘুরে ঘুরে একাত্তর বয়সী হয়েছি। কাজেই রানী নেই তা অস্বাভাবিক লাগছে বইকি।

টানা দশ দিন জাতীয় শোক যাপনের পর তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। আবার লন্ডন ব্রিজের দুয়ার খুলে জাহাজ আসা-যাওয়া করছে। স্কটল্যান্ডে তাঁর ভালোবাসার বালমোরাল প্রাসাদের চূড়ায় আবার পতপত করে উড়ছে পতাকা। এই তো আমার ব্যালকনি থেকে দেখা যাচ্ছে ২০১২-এর অলিম্পিকের শেখর কাপুরের লৌহ ভাস্কর্য। ওখানেই না রানী সারাদেশ এমনকি নিজের পরিবারকেও হতবাক করে জেমস বন্ডের (ড্যানিয়েল ক্রেগ) সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে উড়ে এসে মাঠে নেমে খেলার উদ্বোধন করেছিলেন! আহ্, কত কথা পুষ্প প্রায় বিকশি উঠিছে গো প্রিয় পাঠক!

বিগত সাত দশক ধরে বিভিন্ন রথি-মহারথি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ অবধি কত সংখ্যক লোকের সঙ্গে যে তিনি করমর্দন করেছেন তার পরিসংখ্যান দেওয়া অসম্ভব। বিভিন্ন আনন্দ-উদ্যোগ বা অনুষ্ঠানে অথবা অকস্মাৎ সরাসরি কথাই বলেছেন হাজার হাজার মানুষ। দেশে ও বিদেশে তাঁকে দূর বা কাছে থেকে নিজ চর্মচক্ষুতে দেখেছেন লাখ লাখ মানুষ। আর টিভি ও সংবাদে বিশ্বজুড়ে দেখেছেন কোটি কোটি জনগণ। ছিয়ানব্বই বছর বয়সী রানীর এই সত্তর বছরের রাজত্বকালে বিলেতের নাগরিকদের মধ্যে যাঁরাই শততম জন্মদিনে পা দিয়েছেন তাঁরা সকলেই পেয়েছেন রানীর শুভেচ্ছা বার্তা। বাকিংহাম প্যালেস থেকে রানীর স্বীকৃতিবাণী পেয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও গুণে শেষ করা যাবে না।

বলছিলাম আমার কথা। তো ছোটবেলা আমরা যখন নারায়ণগঞ্জে ছিলাম আমার বয়স পাঁচ বা ছয় হবে। পাকিস্তান আমলে বিলেতের চিঠি আসতো হালকা নীল রঙের এনভেলাপ বা অ্যারোগ্রামে করে। বড় সুন্দরভাবে তার ধারে বর্ণিল দাগ কাটা থাকতো। একদিন দুপুরবেলা ডাকে এলো রানী ও প্রিন্স ফিলিপ এবং রাজকুমারী অ্যান ও রাজপুত্র চার্লসের সাদাকালো ছবিওয়ালা পোস্টকার্ড। উলটো দিকে রানীর মুকুটপরা ছবির টিকিট ও আমাদের ঠিকানা লেখার জায়গাটুকু বাদ দিলে অতি অল্প একটু জায়গা আছে চিঠি লেখার। তাতেই মনিমামা কোনোক্রমে আমাদের চার ভাইবোনের নাম উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘তোমাদের জন্য বিলেতের রাজপরিবারের ছবি পাঠালাম।’ জীবনে প্রথম সত্যিকারের রানী দেখলাম। তাও ঠাকুরমার ঝুলির ভারতীয় রানী না। ধবধবে সাদা মেমরানী! সবাই সে কি টানাটানি! ভাত খাওয়ার পর আমি একা দেখার সুযোগ পেলে সেই ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। রানিকে অপূর্ব লাগল। তার চেয়ে অপূর্ব লাগল তাঁর মুকুট।

আব্বা বললেন, ‘ওইসব হীরা, চুনি, পান্না সব ভারত থেকে চুরি করা।’ আমি তার কিছুই বুঝলাম না। রানী এত ধনী, তিনি কেন চুরি করবেন? আমি মন দিয়ে অ্যান ও চার্লসের সাদা মোজা, অ্যানেরটায় লেস মার্কা মোজা, জুতো, ফ্রকের কুচি … দেখতে দেখতে আব্বাকে জিজ্ঞেস করে বয়স মিলিয়ে দেখলাম একজন আমার বুজানের সমান, আরেকজন ভাইয়ার। বাহ্! আচ্ছা ওরা কী খায়? ওরা কি আমাদের মতো ওদের রানীমাকে জড়িয়ে ধরে? রানী কি তাঁদের চুমু দেন, নাকি ধমকাধমকি করেন? ওরা আসলে করেটা কী? সেই কোন সাত সাগর আর তেরো নদীর পাড়ে ওরা থাকে। তখন ভাবিনি আমি কোনোদিন বিলেত যাবো। এমনকি সত্যি সত্যি একদিন রানীর সান্নিধ্যও পাবো।

১৯৮৩ সালে রানী বাংলাদেশের এক আদর্শ গ্রাম দেখতে এলেন। উঠলেন বেইলি রোডের গণভবনে। আমি তখন তরুণী মা। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিকতা করি আর ঢাকা কলেজে পড়াই। ঈশিতার বয়স পাঁচ বা ছয় হবে। প্রতি রোববার আর্ট কলেজে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে ছবি আঁকতে নিয়ে যাই। হলি ক্রস স্কুলে পড়ে। ঢাকায় ‘রানী এসেছেন … রানী এসেছেন’ এমন খবরে বিটিভি প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে। একদিন কাকডাকা দুপুরে বাচ্চাদের খাইয়ে-দাইয়ে অফিস যাচ্ছি, সে দৌড়ে এসে বল্ললো, ‘মা এই যে আমি রানীর ছবি এঁকেছি। এটা ওকে দিয়ে দিও।’ বলে কী মেয়ে? এটা একটা কথা হলো? এই শিশুহাতের আঁকা এক হলুদবর্ণা রানীর ছবি আমি কী করে দেব? কাকে দেব?

কিন্তু ঈশিতাকে কিছু বললাম না। বিচিত্রা অফিসে এসে ছোট্ট একটা চিঠি লিখে মনিরের কাছ থেকে একটা বড় বাদামি খামে ভরে মুখটা সেঁটে রেখে দিলাম। বাড়ির পথে ধানমন্ডি যেতে পথেই গণভবন পড়ে। আমি তার গেট হাউসে সই করে রেখে ফিরলাম। অন্তত মেয়ের কাছে তো মান রইলো। রানী তাঁর সফর শেষে ফিরে গেছেন। ঈশিতা কদিন রানীর চিঠির অপেক্ষা করে একসময় ভুলে গেল। আর তখনই আমাদের লেটার বক্সে সত্যি সত্যি সেই সুদূর ইংল্যান্ড থেকে, রানীর বাড়ি থেকে চিঠি এলো। তাতে রানীর হাউসহোল্ড থেকে রানির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও ভালোবাসা জানানো হয়েছে। এমনকি ঈশিতার ছবি রানী পছন্দ করেছেন – এও লেখা! এবার মেয়ের খুশি যেমন তেমন, মায়ের খুশি চারগুণ। সেদিন বিচিত্রার শাহরিয়ার কবীর, শাহাদত চৌধুরী, চন্দন সরকার, মুনির কেউ বাদ গেল না এই খবর থেকে। শাহাদত চৌধুরী বলল্লেন, ‘মাজীকে বলো চিঠির ছবি নিতে আর তুমি ‘এখানে সেখানে’তে ছেপে দাও।’ দিলাম। এবার জেনে গেল ঈশিতার সারা স্কুল ও আমার আত্মীয়রাও।

বিচিত্রা ছেড়ে এলাম নতুন দেশে – ইংল্যান্ডে। ১৯৯০ সালের কথা। লন্ডনের মূলধারার স্কুলে পড়াই আর দিন-রাত কবি হওয়ার চেষ্টায় থাকি, লেখক হওয়ার চেষ্টায় থাকি, সুযোগ পেলেই দেশে লিখি। সুযোগ করে এদেশে লেখক হওয়ার নানান কলকব্জার প্রশিক্ষণ নিই। বিলেতকেই পুঁজি করে ‘বিলেতের কথা’ শিরোনামে ভোরের কাগজে, পরে ‘বিলেতের স্ন্যাপশট’ নামে প্রথম আলোয় নিয়মিত কলাম লিখে জনপ্রিয় হয়ে উঠি। তখন লক্ষ করেছি, আমাদের দেশের মানুষের রাজতন্ত্র নয়, রাজবাড়ির গল্প নিয়ে অনেক আগ্রহ। আর হবেই না কেন, সেখানে তো একটার পর একটা নাটক ঘটেই চলেছে।

এরকম সময় রানীর বাড়ির গার্ডেন পার্টিতে নিমন্ত্রণ পেলাম। এখন আমি রাজবাড়ির খাম চিনি। চিনি দুধসাদা খামের ওপর অ্যামবোশ করা রুপালি রাজমুকুট। তো নির্দিষ্ট দিনে বাংলাদেশের সিল্ক শাড়ি ও জামদানি ব্লাউস পরে গেলাম। সে হবে ১৯৯৯ সাল। ঠিক মনে নেই। মনে না থাকার কারণ আছে। গিয়ে দেখি এ এক মহাগণ ব্যাপার। হাজার মানুষ, শত শত দল, একদিকে দেয়ালঘেঁষে সাধারণ চা-বিস্কুট। এ কি! বাকিংহাম প্যালেসেও চেনা বিস্কুট! আর লনে শত মানুষের সঙ্গে দূরে দেখলাম অ্যানকে। রানী আমার দিকের লাইনে এলেনও না। তাঁকে দেখলাম সংবাদের মতো। ছবি তোলাও নিষেধ। এখন কী করে আমার বাচ্চাদের প্রমাণ দেব যে আমি সত্যি রানির বাড়ি গেছি? ধুত্তোর! পেপার ন্যাপকিনের দিকে চোখ গেলে দেখি সেখানে মুকুটের ছাপ। ব্যাস, একখানা উঠিয়ে নিলাম হ্যান্ডব্যাগে।

তারপর দিন যায় বিলেতে আর কথা লিখি বাংলাদেশে। কাজ করেছি ২০১২-তে অলিম্পিক গেম ঘিরে। পরের বছর সকালবেলা বাসার ডাকবাক্স খুলে বিস্ময়ে আমার মুখে আর কথা সরে না। রাজমুকুট জলছাপে আমার নামে রানীর চিঠি! উত্তেজিত হাতে খুলে দেখি লেখা আছে, ‘দি মাস্টার অব দি হাউশোল্ড হ্যাজ রিসিভড হার ম্যাজিস্ট্রেস কমান্ড টু ইনভাইট মিসেস শামীম আজাদ টু অ্যা কমনওয়েলথ রিসেপশন টু বি গিভেন অ্যাট বাকিংহ্যাম প্যালেস বাই দি কুইন অ্যান্ড ডিউক অব অ্যাডিনবরা।’ নির্বাচিত মানুষের মধ্যে আমার নিমন্ত্রণ এসেছে বাংলাদেশি ব্রিটিশলেখক হিসেবে। চিঠি হাতে নিয়ে আমার তো মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। এখন কী করি, কী পরি? এদিকে আমার হাঁটুজোড়া অত্যন্ত নাজুক। অস্ত্রোপচার করতে হবে। এ অবস্থায় আমার কালো জামদানির সঙ্গে হিল জুতো না পরলে কী করে হবে! ঠিক করলাম যা আছে কপালে যাবো উবারে আর প্রাসাদ অভ্যন্তরে কিছুটা সময় কোনো রকম কাটিয়ে পাতাল রেলে না হয় জুতো খুলে খালি পায়েই ফিরলাম। গলায় পরলাম কালো চৌকার। তারপর কিন্তু সেদিন খোঁড়া পায়েই বাজিমাত করেছি, মানে রানীকে কী বলে যে হাসিয়েছি তাই বলছি। দেখলাম একদম ফেইস টু ফেইস। আমি বুঝতেই পারছিলাম না এত কাছে তাঁদের দেখব, আর দেখলে কী বলব!

আমি লাইন ধরে দাঁড়ালাম। এক লেজওয়ালা কালো কোটপরা প্যালেস কর্মচারী পাশের ঘরে দাঁড়ানো রানী, তাঁর স্বামী, চার্লস ও ক্যামিলার কাছে উচ্চস্বরে ঘোষণা দিচ্ছিল। হঠাৎ শুনি ‘বাংলাদেশি অথার শামীম আজাদ।’ আমি কেঁপে উঠেই সামলে নিয়ে পাশের কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখি প্রথমে রানি। বাও করে আমি তো হতবাক। নরম মায়াময়ী অবয়বের ফিরোজা লেসের জামা পরা এই নারী যে প্রায় আমার মতোই ছোটখাটো! এতদিন তাঁকে আমার কি বিশালই না মনে হতো। করমর্দনের পর চারদিকে তাকিয়ে মনে মনে বলি, শামীম এই জীবনের সুযোগ, তোমার যা মনে লয় বলো। ভাবা মাত্রই আমার না সব ছাপিয়ে অলিম্পিকের ওপেনিংয়ের কথা মনে হলো। আর কুশল বিনিময়ের পর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলাম, ‘ইয়োর ম্যাজিস্ট্রি, ইউ আর দি বেস্ট বন্ড গার্ল উই এভার হেড!’ রানি প্রায় ফিক করে তাঁর সেই বিখ্যাত হাসিটি দিয়ে দিলেন। মৃদু শব্দে অপেক্ষমাণ রাজাও সচকিত হয়ে তাকালেন। আর আমি দেখলাম তাঁর দাঁত। বড় সুন্দর। মৃদুস্বরে বলি, আমি ভাবতে পারছি না ব্রিটেন ও কমনওয়েলথের রানীর সঙ্গে আমার করের মর্দন চলছে। তিনি হাস্যমুখে মৃদুলয়ে হাতখানা দোলাতে দোলাতেই বলেন, ‘ইট ইস হ্যাপেনিং … ইট ইজ হ্যাপেনিং …।’ এবার আমার পরের ব্যক্তিত্বকে সুযোগ করে দিয়ে আমি পরপর কিং কনসোর্ট ফিলিপ, প্রিন্স চার্লস ও হবু কুইন কনসোর্ট ক্যামিলার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কক্ষ ত্যাগ করলাম। দেখি ঘেমে গেছি। কিন্তু পায়ের ব্যথা ভুলে গেছি। সেদিন ক্যামিলার সঙ্গেও আমার কথোপকথন হয়েছিল। আর তুমুল বৃষ্টির মধ্যে খালি পায়ে কোমরে শাড়ি গুঁজে, হাতে রাজবাড়ির ক্লোক্রুমের প্লাস্টিক সাদা ব্যাগ ঝুলিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে করে বাড়ি ফিরি। সে-গল্প আরেকদিন বলব। আজ শুধু তাঁরই কথা।

সেই সত্তর বছর আগে তিনি যখন রানী হয়েছিলেন সে ছিল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। একে তাঁর হওয়ার কথা ছিল না। অল্প বয়সে বাবার মৃত্যুতে বড় কন্যা বলে তাঁকে হতে হয়। সেকালে বিশ্বের কোনো দেশে নারী প্রধান হবেন সে-ভাবনা দূরে থাক কোনো বড় বাণিজ্য বা সামাজিক সংগঠনের প্রধান নারী ছিলেন বলে জানি না। সে-জায়গায় তিনি একই সঙ্গে যেমন নেতৃত্ব দিয়েছেন তেমনি পরপর চার সন্তান জন্মদান করে পারিবারিক জীবনও পালন করে গেছেন। সকল দেশের সুখে-দুঃখে রানীই ছিলেন স্থির-অচঞ্চল। এমনকি প্যান্ডামিকের সময় যখন মানুষের মড়কে মরছিলাম আমরা – হাজারে হাজার, তিনি এসে দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন – ‘আমাদের আবার দেখা হবে।’ সেই আশার বাণী ফলেছে, তাঁকে সামনে রেখে আবর্তিত হয়েছে যুক্তরাজ্যের দুনিয়া। ৯৬ বছর বয়সে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অব্যাহত রেখে তবে প্রস্থান করেছেন।

আমার তিন দশক কালের বিলেতবাসে একবার, শুধু একবার তাঁকে বিচলিত ও জনতার দ্বারা মৃদু সমালোচিত হতে দেখেছি। সে ছিল রাজকুমারী ডায়ানার মৃত্যুর পর। সারা বিলেত যখন হাঁটু ভেঙে পড়ে হুহু করে কাঁদছে, প্রবোধ চাচ্ছে রানীর কাছে – তিনি ছিলেন আড়ালে। বাকিংহামের রাজপ্রাসাদ পতাকা করেনি নমিত, রানী আসেননি স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদ ছেড়ে। এসে দাঁড়াননি শোকাহত জনতার সামনে। সারাদেশ তখন মৃদু তপ্ত হয়ে উঠলে পরে তিনি এলেন, পতাকাও অর্ধনমিত হলো। রানী হতে পারেন কিন্তু তিনি পাথরের দেবতা নন। আবার নহে সামান্যা নারীও।

রানীকে শ্রদ্ধা হয় তাঁর ধীশক্তি ও এই পুরো পাল্টে যাওয়া বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর অসামান্য ক্ষমতার জন্য। তিনিই যে ব্রিটেনের সর্বকালের রাজপ্রতিনিধিদের মধ্যে একমাত্র রানী যিনি সবচেয়ে দীর্ঘ সময় কমনওয়েলথপ্রধান ও ব্রিটেনের শীর্ষস্থান অলংকৃত করে ছিলেন।

আমার শিশুকালের সে-বিলেত এমনকি সে-সরল পৃথিবীও আর নেই। এদেশে তেমন শীত নেই, শুধু সাদা মানুষের বসবাস নেই। অনেক বদলে গেছে সব। কিন্তু রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও প্রেমের প্রকাশ দেখেছি দশ দিন, তার তুলনা হবে না কোনোদিন। তিনি মরেও প্রমাণ করলেন, তিনি মরিবেন না।