সম্পাদকীয়

স্মরণ, কৃতজ্ঞতা, প্রত্যয় : ১৯তম বছরে কালি ও কলম

একসময়, যখন দৃশ্যমাধ্যম বলতে ছিল চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন, এবং সেগুলোর দর্শকও ছিল সীমিত, বাংলাদেশে উঁচুমানের কিছু সাহিত্যজার্নাল প্রকাশিত হতো, যেমন সমকাল, কণ্ঠস্বর, পরিক্রমা এবং সুন্দরম। এর বাইরে ছিল ছোটকাগজ, যেগুলো বেরুতো সারাদেশ থেকে, এবং দু-এক পত্রিকার সাহিত্যসাময়িকী। দৃশ্যমাধ্যমের আগ্রাসন প্রবল হওয়ার কারণে হোক, উদ্যমী সম্পাদক-প্রকাশকের অভাব দেখা দেওয়ার জন্য হোক, এসব জার্নাল-পত্রিকা আয়ু স্বল্পতায় ভুগছে।

এই শূন্যস্থানটি আঠারো বছর ধরে পূরণ করে যাচ্ছে একটি সাহিত্য-জার্নাল, কালি ও কলম, যার শুরুটা হয়েছিল বাংলা সংস্কৃতিতে, সীমিত পরিসরে হলেও, শুদ্ধচিন্তার এবং নান্দনিকবোধের সমাবেশ ঘটানোর একটা অভিপ্রায় থেকে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামনের নেতৃত্বে একটি সম্পাদকমণ্ডলী এর দায়িত্বে ছিলেন, সম্পাদক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল যশস্বী সম্পাদক আবুল হাসনাতকে, যিনি দীর্ঘদিন দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতার সম্পাদক হিসেবে সম্পাদনাকে একটি শিল্পের মর্যাদায় তুলে এনেছিলেন। কালি ও কলমের আত্মপ্রকাশের পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখেন এর প্রকাশক আবুল খায়ের লিটু, যাঁর সমর্থন ও অনুপ্রেরণায় বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের একটি মাসিক পত্রিকা হিসেবে কালি ও কলম ছাপা হতে শুরু করল। এবং প্রথম সংখ্যা থেকেই পাঠক, লেখক, গবেষক ও বোদ্ধাদের নজর কাড়তে শুরু করল।

দীর্ঘ আঠারো বছর কালি ও কলম প্রতিমাসে প্রতিটি সংখ্যাতে ইনিয়ে আসছে এক সমৃদ্ধসূচি। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান লেখক-কবি-প্রাবন্ধিকরা এতে তাঁদের পছন্দের বিষয় নিয়ে নিয়মিত লিখছেন, বলা যায় এটি তাঁদের প্রথম পছন্দ। এক বিস্তৃত পাঠক শ্রেণি ও একে নিরন্তর সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বছরে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হয় কালি ও কলমের, তাছাড়া একটি গল্পসংখ্যাও প্রকাশিত হয়, যা ঈদের মৌসুমে পাঠকদের জন্য একটি বাড়তি আকর্ষণ নিয়ে আসে। এর বাইরে কালি ও কলমের নানা সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ-নজরুলসহ বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের অনেক বিখ্যাত লেখক, জাতীয় জীবনের উল্লেখযোগ্য দিন ও অর্জনকে স্মরণ করা হয়, সাহিত্যের পাশাপাশি চিত্রকলা, চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির বিভিন্ন অঞ্চলে অনুসন্ধানী আলো ফেলা হয়।

শুরু থেকেই কালি ও কলম কয়েকটি উদ্দেশ্যকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে-এর একটি হচ্ছে সৃজন ও মননশীল চর্চার উৎকর্ষ বাড়ানো। আরেকটি, তারুণ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, এবং তৃতীয় একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে সংস্কৃতির পরিশীলিত চর্চাকে উৎসাহিত করা। প্রবীণ ও তরুণ লেখক-কবিদের জন্য কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার প্রতিবছর এই তিনটি উদ্দেশ্যকে ধারণ করেই দেওয়া হয়।

প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ অতিমারি আমাদের জীবনে প্রচুর বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু কোভিডকালেই কালি ও কলম পেয়েছে এর আঠারো বছরের জীবনের সবচেয়ে বড় দুই আঘাত ১৪ই মে ২০২০-এ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও ১লা নভেম্বর ২০২০-এ আবুল হাসনাতের প্রয়াণ। পত্রিকার এ দুই কাণ্ডারী চলে যাওয়ায় রীতিমতো দুর্বিপাকে পড়তে হলো একে। তবে এ-অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এগিয়ে এলেন সুব্রত বড়ুয়া। তিনি সম্পাদনার দায়িত্ব নিলেন। সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব নিতে আমাকে অনুরোধ করা হলে রাজি হলাম, যদিও জানি, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের শূন্য আসনটিতে বসার মতো যোগ্যতা আমার নেই, হয়তো খুব কম মানুষেরই আছে।

কালি ও কলম উনিশ বছরে পা রাখল। এইদিনে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও আবুল হাসনাতকে আমরা গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। আমরা ধন্যবাদ জানাই আমাদের পাঠকদের, যাঁদের সমর্থন আমাদের প্রেরণা জোগায়। আমরা কৃতজ্ঞ সেসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি যাঁরা বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পথচলাটি কিছুটা হলেও মসৃণ করেছে।

এই বছরে আমাদের প্রত্যয়, শিল্প-সাহিত্যের অঞ্চলকেআমাদের সাধ্যমতো কিছুটা সমৃদ্ধ করতে আমাদের প্রচেষ্টা বেগবান থাকবে।

কালি ও কলম পরিবার ও

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম