সাঈদ আহমদের নাটক তৃষ্ণায় রূপসজ্জা ও পোশাক-পরিকল্পনায় অভিনব মুক্তি

সাঈদ আহমদ (১৯৩১-২০১০) বাংলাদেশের নাট্যজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি এদেশীয় নাট্যধারায় অভিনব আঙ্গিক সংযোজন করে স্বীয় স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন। সাঈদ আহমদের নাট্যরচনার কৌশল সামুদ্রিক। আর তাঁর নাটকগুলোকে ঘিরে বর্তমান প্রবন্ধের বিচরণ প্রকৃতপক্ষে অপরিপক্বতায় আক্রান্ত হবার শামিল। তাঁর সাতরঙা জীবনের মহিমাকীর্তন নয়, বরং তাঁর তৃষ্ণায় নাটকটির বিশ্লেষণ এবং এই নাটকের রূপসজ্জা ও পোশাক-পরিকল্পনার মূল্য নিরূপণের উদ্দেশ্যে রচিত বর্তমান প্রবন্ধ এবং শেষ পর্যন্ত মতামত প্রতিষ্ঠাও বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। বরং অন্য মত বা চিন্তা সৃষ্টিতে অনুঘটকালির মতো দুঃসাহসিক ক্রিয়া এর উদ্দেশ্য।

সাঈদ আহমদের বহুমুখী চর্চার মধ্যে নাটক রচনার ক্ষেত্রটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কীভাবে তিনি বাংলাদেশের নাট্যচর্চার মূল সিংহাসনটি দখল করে বসেছেন এর সন্ধান করতে গেলে হাসনাত আব্দুল হাই-সম্পাদিত সাঈদ আহমদ রচনাবলীর দ্বারস্থ হতে হয়। অত্যন্ত সংস্কৃতমনা পরিবারে জন্ম তাঁর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বীয় অভিপ্রায়। তাঁর রচিত পাঁচটি নাটকের মধ্যে তৃষ্ণায় নাটকটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদুল কবিরের নির্দেশনায় ২০১১ সালের ১৩ থেকে ১৫ মে মঞ্চস্থ হয়। প্রযোজনাটির নৈতিক শক্তির তাৎপর্য উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তাই বর্তমান প্রবন্ধের প্রাণস্পন্দন। মূলত একটি টেক্সটের ব্যাখ্যা, তা সে তাত্ত্বিক বা প্রায়োগিক, যেভাবেই দেওয়া হোক না কেন, কখনো শেষ হয়ে যায় না। তবে বর্তমান প্রবন্ধের মূল অনুসন্ধানের বিষয় হলো, মূল লক্ষ্যে বা সুপার অবজেক্টিভে পৌঁছার পথটি নাট্যকার সাঈদ আহমদ কীভাবে নির্মাণ করেছেন আর একজন পরিকল্পক কীভাবে টেক্সটের সঙ্গে নিজ পরিকল্পনার মোকাবিলা করেছেন তা নিরূপণ।

সাঈদ আহমদের তৃতীয় নাটক তৃষ্ণায় ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সালে লেখা। বাংলার পাশাপাশি নাটকটি ইংরেজি ভাষায় সাপ্তাহিক হলিডেতে ছাপা হয়। তৃষ্ণায়-এর কাহিনি বাংলাদেশের একটি অতিপরিচিত লোককাহিনি। এই লোককাহিনির অঙ্গে নাট্যকার সমসাময়িক সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটের চিত্র এঁকেছেন। নাটকটি রূপকধর্মী। নাটকটির চরিত্র সৃষ্টিতেও নাট্যকার কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। নাটকের কাহিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন বাঘ, কুমির, শেয়াল, গাধা, কুকুরের মাধ্যমে। সমগ্র নাটকটি তিনটি অঙ্কে বিন্যস্ত, কোনো দৃশ্যবিভাজন নেই। চরিত্রসংখ্যা ১২। নাটকটিতে ডারউইনের Survival of the fittest – এই চিন্তার রূপায়ণ দেখা যায়। অর্থাৎ যোগ্যরাই পৃথিবীতে তাদের উত্তরাধিকারী রেখে যেতে পারবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যারা নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে বা যাদের অভিযোজন অব্যাহত আছে বা ভবিষ্যতেও থাকবে তারাই পৃথিবীতে টিকে থাকবে। নাটকটি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লেখা।  কোনো  মানুষ  নায়ক  হবার  বদলে  নাটকের  নায়ক  হয়েছে প্রকৃতি। এখানে প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে শেয়াল ও কুমিরের সেই সুপরিচিত গল্পটি। গল্পে দেখা যায়, মা কুমির তার সাত ছানাকে শিক্ষিত করার অভিপ্রায় নিয়ে ধূর্ত শেয়ালের কাছে পাঠায়। আর শেয়ালও সেই কচি, অতি সুস্বাদু মাংসের লোভ ছাড়তে পারেনি। একে একে খেয়ে ফেলে ছয়টি ছানাকে। সেই পুরনো কাহিনির ওপর ভিত্তি করে সাঈদ আহমদ তৈরি করলেন নতুন এক গল্প। যার লক্ষ্যই ছিল মূলত পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরোধিতা। নাটকটিতে নিবিড়ভাবে মনোনিবেশ করলে দেখা যায় ‘প্রথম অঙ্কে উন্মোচন’, ‘দ্বিতীয় অঙ্কে প্রবৃদ্ধি’ ও ‘তৃতীয় অঙ্কে সমাপ্তি রচিত হয়েছে’। বাংলার লোককাহিনির ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে নাট্যকার তাঁর জ্ঞানের কাঠামোকে রূপায়িত করেছেন। তবে এ-নাটক যে কেবল পাকিস্তানি শাসকের জন্য সমকালীন তা নয়, এটি চিরকালীন। প্রতাপশালীর ক্ষুধার শেষ খুঁজতে গিয়ে নাট্যকার আমাদের প্রবেশ করান অস্তিত্বের টিকে থাকার বিশেষ প্রশ্নের মধ্যে। একটি দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে গিয়ে নাট্যকার আশ্রয় নিয়েছেন রূপকের। নাটকটিতে দেখা যায় নাটকের চরিত্রগুলো (বাঘ, শেয়াল,  কুমির,  কুকুর,  গাধা)  উপকথার  পশুপাখিদের অ্যানথ্রোপোমোরফিক অর্থাৎ যে-পশুরা মানুষের মতো আচরণ করে। তবে এই অ্যানথ্রোপোমোরফিক ধারা আমাদের সংস্কৃতিতে নতুন নয়। নাট্যকার পরিচিত একটি রূপকের মাধ্যমে একই সঙ্গে জাতিতাত্ত্বিক বিরোধ ও ক্ষমতাচর্চার ধরনের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন এবং একটি চিরন্তন মানবিক আবেদন সৃষ্টিতেও তৎপর হয়েছেন।

শিল্পের প্রতীকী ভুবন নির্মাণে সাঈদ আহমদের তৃষ্ণায় নাটকটি সার্থক। এই সার্থকতাকে আরো উচ্চতর সোপানে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছে নাটকটির প্রযোজনা। এক্ষেত্রে কাজটি আরো এক ধাপ এগিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছেন নাটকটির পোশাক ও রূপসজ্জা পরিকল্পক। যে-কোনো পরিকল্পনার মূলে থাকে কাজটি সার্থকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়। তাঁদের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে অভিনেতার শরীরে। একজন চিত্রশিল্পীর যেমন আছে কাগজ, রং-তুলি তেমনি নাটকের ক্ষেত্রে পোশাক ও রূপসজ্জা পরিকল্পকের আছে অভিনেতার শরীর। প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল, সময় ও কষ্টসাপেক্ষ। কারণ প্রয়োগটি যেহেতু জীবন্ত মানবদেহে করা হচ্ছে তাই প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন সতর্ক পদচারণা। পোশাক ও রূপসজ্জা পরিকল্পক উভয়ে চান সুন্দরকে উপস্থাপন করতে। বিশ্রী তালাচাবির খোঁজ কেউ করেন না।

তৃষ্ণায় সাঈদ আহমদের একটি রূপকধর্মী নাটক। একটি প্রচলিত লোককাহিনির আশ্রয়ে মানবসত্তার অস্তিত্বের সংকট এবং জীবন সংগ্রামে জয়ী হবার প্রচেষ্টা এই নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে। ইউরোপীয় নাট্যকৌশলের প্রতি আগ্রহী নাট্যকারের তৃষ্ণায় নাটকের বহিরঙ্গ তিনটি অঙ্কে বিভক্ত। সমকাল সম্পর্কে সচেতন শিল্পী হিসেবে তিনি নাটকটি সম্পর্কে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন এর ভূমিকাপর্বে। নির্মাণ ও প্রয়োগের আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছে এই প্রযোজনায়; আর আছে পরিচালকের সচেতনতা এবং ঈর্ষণীয় মাত্রাজ্ঞান। উপকথা, শাস্ত্রকথা, রাষ্ট্রযন্ত্রের যান্ত্রিকতা প্রভৃতির সমন্বয় সাধনকালে সেই পরিমিতির উচ্চকিত রূপ পরিদৃষ্ট হয় নাটকটির প্রযোজনায়।

সাত সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষায় উচ্চাভিলাষী কুমির-মা সন্তানদের পড়তে পাঠায় অত্যন্ত বিজ্ঞ শেয়াল পণ্ডিতের কাছে। অতি সাধারণ এই বৃত্তান্ত তিন অঙ্কসীমার মধ্যে অনন্য কুশলতায় উপস্থাপন করেছেন নাট্যকার সাঈদ আহমদ। কিন্তু এতে পুঞ্জীভূত হয়েছে অসংখ্য কথা। সন্তানহারা একজন মায়ের বেদনার ঊরুতে শায়িত অনুভূতি পলকে পলকে নৃত্য করে আর এরই মাঝে আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো ঝলসে ওঠে বিজ্ঞ শিক্ষকের শিক্ষা। জীবনের অজস্র আয়োজন, মানবিকতা ও অমানবিকতার বোধ এবং তার বহিঃপ্রকাশ নাটকটির মধ্য দিয়ে অবিস্মরণীয় রূপ পরিগ্রহ করেছে। এখানে ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত মানবচিত্তের বিপরীতে উজ্জ্বল আলোক বিকীর্ণকারী আত্মার সঙ্গে পরিচয় ঘটে দর্শক-পাঠকের। নাটকে জন্তুর আচরণে মানবের হার্দিক সহানুভূতির প্রকাশ তাকে মানুষের সমপর্যায়ে উন্নীত করেছে। তৃষ্ণায়-এর প্রতীতি শিল্পীর যাপিত জীবনাভিজ্ঞতা। জীবন অনন্ত বলেই এ-গল্পের ব্যাপ্তি অন্তহীন। নাটকের শেষে শেয়াল ও তার ছাত্রের সঙ্গে যে আত্মিক, সুস্নাত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তা পুনর্বার নবদিগন্ত উন্মোচন করে। জীবিত কুমির ছানা বোঝাতে সমর্থ হয় তার মৃত ছয় ভাই কখনো এই পৃথিবীতে ফিরে আসবে না – চাইবে না খাদ্য ও সজ্জা গ্রহণের অধিকার। আসবে না অন্য কোনো অধিকারের দাবিতে। বিষয়টিকে নাট্যকার নানা অভিজ্ঞতা এবং সংস্কারের মিশ্রণে উপস্থাপন করেছেন।

ফুকরো : … নির্মল চিত্তে অপেক্ষা করো।

কোটি কোটি জীবজন্তু, রাত আর

দিন, শীত-গ্রীষ্মের অপেক্ষা করো।

… এসো, ধৈর্য, বিনয় আর অনুভূতির

অধিকারী হই।

শিল্পশাস্ত্র এবং মানবস্বভাব ও সৃজনক্ষমতার স্বাতন্ত্র্য অনস্বীকার্য। তার পরিপ্রেক্ষিতে একথাও অবশ্য স্বীকার্য যে, জীবনদৃষ্টি, শিল্পাভিজ্ঞতা, সৃজনকৌশল দুজন শিল্পীকে স্বতন্ত্র রূপে গড়ে তোলে। প্রত্যেক শিল্পীর সৃষ্টি তাঁরই নিজস্বতার বিশ্বস্ত এবং সুন্দরতম প্রকাশ। স্পষ্টতই উপলব্ধি করা যায় স্রষ্টার ভিন্নতায় তৃষ্ণায় নাটকটি ভিন্নমাত্রা লাভ করলেও মাত্রাজ্ঞান হারায়নি। আর কঠিন কাজে নিñিদ্র দেয়ালটির প্রণেতা হলেন এর পোশাক ও রূপসজ্জা পরিকল্পক। বলা যায়, নাট্য-প্রযোজনার আধুনিক অভিধানটি অনেকাংশে নির্ভরশীল রূপসজ্জা ও পোশাক পরিকল্পকের ওপর। মঞ্চে একজন পরিকল্পককে প্রথমেই যে-বিষয়টির মোকাবিলা করতে হয় তা হলো – তার সৃষ্ট পরিকল্পনাটি যেন বিশ্বাসযোগ্য এবং পুরোপুরি সততার সঙ্গে মঞ্চে উপস্থাপিত হয়। একজন পরিকল্পককে এক্ষেত্রে প্রতিটি চরিত্রের জন্য সঠিকভাবে পরিকল্পনা করতে হয়। আর এর মাধ্যমেই প্রকাশিত হয় চরিত্রের জাতীয়তা, নৈতিকতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বয়স, লিঙ্গ, যৌন আবেদন – এমনকি ভৌগোলিক অবস্থা, আবহাওয়া, পেশা, বৈবাহিক অবস্থা, ব্যক্তিত্ব, আদর্শ প্রভৃতি। প্রথমেই নাটকটিতে পোশাক পরিকল্পনার প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক। বর্তমান প্রবন্ধে অনুসন্ধান করা হবে তৃষ্ণায় নাটকের পোশাক পরিকল্পক কোন ধারণা থেকে পোশাকের পরিকল্পনা করেছেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, পোশাক পরিকল্পনার উপস্থাপনায় এর অর্থ এবং symbol (সংকেত) খুঁজে বের করা। এ-আলোচনায় পোশাক পরিকল্পনা অংশে নিম্নোক্ত প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে প্রয়াসী হবো।

১. ডিজাইনের উপাদান (Elements) তৃষ্ণায় নাটকের পোশাক পরিকল্পনায় কিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে?

২. পোশাক পরিকল্পনার প্রক্রিয়াটি কী?

৩. তৃষ্ণায় নাটকটির পোশাক পরিকল্পনায় বর্তমান প্রবন্ধকারের অভিপ্রায়।

এই লক্ষ্যে প্রথমত সাঈদ আহমদের তৃষ্ণায় নাটকটির Text-টি অত্যন্ত সূক্ষ্মরূপে পর্যবেক্ষণ করে নির্দেশকের নির্দেশনার কৌশল ও সংলাপগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, নাটকটির চরিত্রগুলোর জীবনযাপন, ভৌগোলিক অবস্থান পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, পর্যবেক্ষণ করা হবে কী রূপে পোশাক পরিকল্পক তাঁর সৃষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন। চতুর্থত, এর (তৃষ্ণায় নাটকের) সাহিত্যমূল্য বিচার করে নাটকটির পোশাক সম্বন্ধীয় স্কেচেস (Sketches) উপস্থাপন করার দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা চালানো হবে।

Costume is part of the actor’s apparatus. It helps them to create their characters. Every item of clothing sends signals of one kind or another to the audience. As soon as the actors appear, even before they speak, the audience will have gleaned a great deal of information.

একজন দক্ষ পোশাক পরিকল্পনাকারী প্রথমেই নাট্যকারের সৃষ্ট চরিত্রকে দৃশ্যমান করে তোলেন। এক্ষেত্রে তিনি চরিত্রকে ব্যাখ্যা করেন –

১. ক. ঐতিহাসিকতার ভিত্তিতে

   খ. ভৌগোলিক কিংবা কাল্পনিক স্থান-কালের ভিত্তিতে।

উল্লিখিত দুটো বিভাজনের মধ্যে তৃষ্ণায় নাটকটির পোশাক পরিকল্পনা ১.(খ)-কে সমর্থন করে। স্পষ্টতই উপলব্ধি করা যায়, যেহেতু নাটকটির প্লট উপকাহিনির ওপর ভিত্তি করে রচিত তাই বাস্তবিকভাবে ভৌগোলিক স্থানের অন্বেষণ না করে পোশাক পরিকল্পক স্থান-কালের ওপর তাঁর ছবিটি অঙ্কন করেছেন। তবু যে- কোনো নাটকে স্থান, কাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চীনের কোনো মানুষের কানের কাছে খুব চেঁচিয়ে সরস্বতীর স্তোত্র পাঠ করলেও সে বুঝবে না; কিন্তু তা যদি স্পষ্ট করে এঁকে তার সামনে পরিবেশন করা হয় তবেই বোধগম্য হবে। নাটক যদিও দৃশ্যকাব্য তবু তা যখন সাহিত্য হিসেবে পড়া হয় তখন পাঠকের শ্রবণেন্দ্রিয় মনের সহায়তা নিয়ে এগিয়ে চলে। কিন্তু যখন তা পরিবেশিত হয় তখন কান ও মনের পাশাপাশি চলে আসে অতীত-অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত বিষয়। তৃষ্ণায় নাটকটির একদম শুরুতে নাট্যকার স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন ‘স্থান একটি জঙ্গল’ অর্থাৎ নাট্যঘটনার স্থান সম্পর্কে ভৌগোলিক মানচিত্রে সঠিক কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু নাট্যকার সাঈদ আহমদের জ্ঞান-বিশ্বাসমতে স্থানটির সত্যতা আছে। যেখানে বনের কিছু পশু একত্র হয়েছে বিপন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য।

বড় বড় কবি ও রূপদক্ষ নট ও পট রচয়িতা তাদের কথা ছেড়ে দেই,  যে  লোকটা  ছেলে  খেলানোর  পুতুল  গড়ছে – বাঘ ভালুক সাহেব মেম পশুপক্ষী হাঁড়িকুঁড়ি কত কি – সেই যে পুতুলওয়ালা সে তো যথেচ্ছা গড়ছে না, ছেলে ভোলে কিসে এ তার স্মরণে রয়েছে অথচ তাকে নতুন নতুন রূপ দিতে হচ্ছে নিজের মতে।

এখানেই একজন পোশাক পরিকল্পনাকারীর মোকাবিলা (great challenge) – কীভাবে তিনি কল্পনাকে বাস্তবতায় রূপ দেবেন, আবার তা হতে হবে দর্শকের বিশ্বাসযোগ্য। পোশাক পরিকল্পনার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশের পরিকল্পনাকারীরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নানা ভাবে ও মতে তাঁদের ধারণাগুলো উপস্থাপন করেছেন। এক্ষেত্রে নাটকটির theme সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখার পাশাপাশি এর গঠন (form) কিংবা রীতি (style) সম্পর্কেও দিবালোকের মতো স্পষ্ট জ্ঞান থাকা জরুরি। তৃষ্ণায় নাটকটিতে দেখা যায় মানবের চিরকালীন অস্তিত্বগত সমস্যার পাশাপাশি নাটক রচনাকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরাক্রমশালীর দমন অর্থাৎ শৃগাল নামধারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে কুমির নামের বাঙালি সন্তানদের দ্বিজাতিতাত্ত্বিক বিভাজনের প্রক্রিয়ায় সমর্পণের মাধ্যমে মুক্তির আকাক্সক্ষার মর্মান্তিক প্রয়াস। তৃষ্ণায় নাটকে একজন দক্ষ পোশাক পরিকল্পনাকারী প্রথমেই সহায়তা নিয়েছেন খরহব (রেখা)-এর। অর্থাৎ তাঁর নকশাকৃত পোশাকটি কোন কোন রেখার সমন্বয়ে পরিকল্পিত তা অনেকটাই নাটকটির সাফল্যের দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। এই  রেখার মাধ্যমে নাটকের কলাকুশলীদের শারীরিক ও মানসিক গঠন স্পষ্ট করে বোঝাতে সমর্থ হয়েছেন। নাটকটিতে নিম্নোক্ত  রেখার প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয় –

এই রেখার (Line) মাধ্যমে পরিকল্পনাকারী –

২. i. Path

   ii. Thickness

  iii. Continuity

  iv. Sharpness

  v. Contour

  vi. Consistency

 vii. Length

    viii. Direction-এর সমন্বয় ঘটিয়েছেন। এছাড়াও পোশাকে Line-এর মাধ্যমে চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থারও সামঞ্জস্য বিধান করা হয়েছে।

নাটকটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক বিষয়টি হলো এর পোশাকের রং-নির্বাচন। রং মানবজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্ণহীন বিশ্বপ্রকৃতি কল্পনাতীত। রঙের রয়েছে সর্বকালীন ও সর্বজনীন আবেদন। প্রতিটি রঙেরই এক একটি স্বতন্ত্র গুণগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই গুণগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কোনোটি উষ্ণ আবার কোনোটি শীতল। আলোচ্য তৃষ্ণায় নাটকটিতে প্রতিটি চরিত্রের পোশাকের গঠন ও রং একই রকম (same)। অর্থাৎ color scheme-এর দিক থেকে এখানে monochromatic রং ব্যবহার করা হয়েছে। ‘সাদার মত কালোও বিশেষ কোন রঙের পর্যায়ভুক্ত নয়।’ বর্ণালি সব রঙের অনুপস্থিতির ফল হলো কালো। এই রঙের মাধ্যমে নাটকটিতে শূন্যতা, অবসাদগ্রস্ততা, উদ্যমহীনতা, অন্ধকার, অরাজকতা, কর্কশতা, প্রচণ্ডতা প্রভৃতির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে যৌক্তিকভাবে। নাটকটির পরিকল্পনায় সফলতার পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর কাপড়ের বুনন।

Even the simplest of costume will benefit by careful consideration of the surface textures of the fabric. Any garment must be thought about in terms of the messages that the audience will read through the texture of its cloth. …you can say great deal by choosing fabrics for your costume whose textures underline character traits

কাপড়ের বুনন কেমন হবে তা নির্ভর করে কাপড়টির –

৩. i. Fiber

   ii. Yarn

   iii. Construction

      iv. Finish-এর ওপর।

এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তৃষ্ণায় নাটকটির (physical effect of texture) পোশাকের বাহ্যিক গঠন হচ্ছে smooth (মসৃণ)। অর্থাৎ কাপড়টি পরিধানে আরামদায়ক এবং চরিত্রের ভাব প্রকাশে সহায়ক।

একজন পোশাক পরিকল্পনাকারীর অবস্থান অভিনেতাদের খুব কাছে। তিনি অভিনেতাদের শরীরের খুঁত ঢেকে দিতে পারেন তাঁর পোশাক পরিকল্পনার মাধ্যমে। আবার অভিনেতার শরীরের শক্তিশালী দিকও চিহ্নিত করতে পারেন। আর এর মাধ্যমেই তিনি করেন সৌন্দর্যের সন্ধান। জীবের মনস্তত্ত্ব যেমন জটিল, যেমন অপার সুন্দর ও তেমনি বিচিত্র, তেমনি অপরিমেয়। ধনী ব্যক্তি তার ধন আগলানোর জন্য অন্বেষণ করেন সুন্দর তালাচাবির। অসুন্দরের তালাশ কেউ করে না। স্পষ্টতই উপলব্ধি করা যায়, একই নাটকের পোশাক পরিকল্পনার প্রক্রিয়া এক হলেও তার প্রয়োগ ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনাকারীর কাছে ভিন্ন হবে। অভিজ্ঞতা ও সৃজনকৌশলও দুটি শিল্পকর্মের কাছে আলাদা। পোশাক পরিকল্পনার প্রক্রিয়া ও প্রয়োগ সঠিক না হলে তাকে মনে হয় স্নেহময়ী জননীর অনাদরে লালিত সবল বাউন্ডুলে সন্তান। সর্বদিক বিবেচনায় তৃষ্ণায় নাটকটিতে পোশাক পরিকল্পনার প্রক্রিয়াটি সঠিক বলে তা সার্থক প্রযোজনায় রূপ নিয়েছে।

নৈসর্গিক এই পৃথিবীতে Design করার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে একজন পরিকল্পকের প্রথম কাজ হচ্ছে চরিত্রকে দর্শকের কাছে দৃশ্যমান করা এবং পোশাকের সঙ্গে চরিত্রের সম্পর্ক স্থাপন। প্রবন্ধের এই অংশে তৃষ্ণায় নাটকের প্রতিটি চরিত্র অনুযায়ী পোশাক Design (নকশা) করার একটি দুঃসাহসিক প্রক্রিয়া চালানো হবে। কুমির, বাঘ, শেয়াল, গাধা – এই sketch-গুলো নাটকের চরিত্রগুলোর শারীরিক গঠনবৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ রেখে করা এবং এরই সঙ্গে লক্ষ রাখা হয়েছে বর্তমান সময়ে fashion-এর মাত্রাজ্ঞান। এই পোশাক পরিকল্পনা realistic style-কে সামনে রেখে করা হয়েছে। বর্তমান পরিকল্পনায় পোশাকগুলো decorated, এবং অনেক বেশি বাস্তবিক যে-কোনো পশুচরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতার ক্ষেত্রে।

প্রকৃতপক্ষে যে-কোনো পরিকল্পকের ক্ষেত্রেই নাটকের text-এর চরিত্রকে বাস্তবিক রূপদান করা দুরূহ কাজ। নাট্যকলায় সাঈদ আহমদের নাটকের পোশাক নিয়ে গবেষণা এই প্রথম। আশা করা যায় তৃষ্ণায় নাটকের পোশাকের ক্ষেত্রে বর্তমান প্রবন্ধের দেখানো পথ আশার আলো জাগাতে সমর্থ হবে।

এবার প্রযোজনাটির রূপসজ্জা (Makeup) প্রসঙ্গে আলোকপাত করা যাক। নাটকে চরিত্রের অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষেত্রে Makeup হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে মুখমণ্ডলের সীমারেখা (contour) নির্ধারণ করে এর গঠন অনুযায়ী চোখ, ভ্রু, নাক, ঠোঁট সর্বোপরি মুখমণ্ডল চরিত্রের প্রয়োজন অনুযায়ী অঙ্কিত করা সম্ভব। এক্ষেত্রেও একজন পরিকল্পনাকারীকে করতে হয় সৌন্দর্যের সন্ধান। বাস্তবিক জীবনের আলোকে বলা যায়, মেকআপের উদ্দেশ্য কিছু মাত্রায় হলেও নিজেকে অন্যের সামনে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরা এবং এটি করা হয় মুখমণ্ডলের ত্রুটি ঢাকার উদ্দেশ্যে। মঞ্চ কিংবা বাস্তবিক জীবন – যেখানেই মেকআপের ব্যবহার হোক না কেন এর প্রয়োগের মাধ্যমে কিছু মাত্রায় হলেও প্রকৃত বৈশিষ্ট্য ঢাকা পড়ে অন্য এক বেশ উপস্থিত হয়। মানবজীবনে প্রসাধনীর ব্যবহার হাজার বছরের পুরনো। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ‘মিশরীয় বা ফারাওরা ছিল আধুনিক মেকআপ সামগ্রীর আবিষ্কারক। মিশরীয় নারী-পুরুষ উভয়েই তাদের মুখে মেকআপ ব্যবহার করত। ফারাওরা নিজেদের অতি ক্ষমতাধর বলে মনে করত তাই তারা তাদের মুখে নানা রকম নকশা আঁকত যেগুলো তারা পবিত্র আত্মার প্রতীক অথবা বিশেষ ক্ষমতার প্রতীক বলে মনে করত।’ মানবজীবনে তো বটেই, মঞ্চেও প্রসাধনীর ব্যবহার অপরিহার্য। থিয়েটারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ‘নাট্যিক মায়া সৃষ্টিতে’১০ মুখোশের ব্যবহার করা হতো। অবশ্য এ-উপাদানটি বাস্তবধর্মী ছিল না। বিপুল দর্শকের সামনে তাদের অভিনয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশের সুবিধার্থে এর ব্যবহার হতো। পরবর্তীকালে ‘রোমান থিয়েটারে’ মুখোশ ও পরিচ্ছদ গ্রিক ধারাকেই অনুসরণ করেছে। প্রাচ্যের ভারতীয় থিয়েটারেও অভিনয়ে পাত্র-পাত্রীর সাজসজ্জাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘রূপসজ্জার মাধ্যমে কোন চরিত্রকে যথাযথভাবে উপস্থিত করা আহার্য অভিনয়ের মূলকথা।’১১ নাটকে অভিনয়ের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্বের প্রবর্তক স্তানিসøাভস্কিও নাটকে পোশাক ও মেকআপ ব্যবহারের পক্ষপাতি ছিলেন। অবশ্য এই মতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গ্রটস্কি। কোনো কোনো উপাদান ছাড়াও থিয়েটার হয় – এ-ধরনের অনুসন্ধানে ব্রত হয়ে গ্রটস্কি কিছু প্রশ্ন জড়ো করেছেন এবং এর উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন। যেমন : পোশাক এবং সেট ছাড়া কি থিয়েটারের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়? হ্যাঁ, পারা যায়।১২

থিয়েটারে পোশাক এবং মেকআপের ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যৌক্তিক উত্তরের তালাশ করতে গেলে এর পক্ষে বা বিপক্ষে উভয় ক্ষেত্রেই মত আছে। আর এরই ধারাবাহিকতা তৃষ্ণায় নাট্য-প্রযোজনাটি পোশাক ও মেকআপের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। নাটকটির প্রযোজনায় দেখা যায় প্রতিটি চরিত্রকে এর রূপসজ্জা পরিকল্পক সাধারণ মঞ্চনাটকের মেকআপের পরিবর্তে painted makeup ব্যবহার করেছেন। বিষয়টি নতুন না হলেও এর ব্যবহার এদেশে কম। এর মাধ্যমে তিনি চরিত্রের মাঝে নিয়ে এসেছেন special effects ।

তৃষ্ণায় নাটকটির রূপসজ্জার বিষয়টি জটিল। অন্যান্য প্রায় সকল রীতির নাটক, যেমন – শেকসপিয়রের হ্যামলেট, ইউজিন আয়নেস্কোর লেসন, সৈয়দ শামসুল হকের চম্পাবতী, কিংবা সাঈদ আহমদের কালবেলা, মাইলপোস্ট, প্রতিদিন একদিন, শেষ নবাব প্রভৃতি নাটকের অঙ্গরচনার (makeup) বিষয়টি খুবই সরল প্রকৃতির। স্বল্প পরিমাণ মেকআপ ব্যবহারের মাধ্যমে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চেহারাকে দর্শকের দৃষ্টিতে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করে তোলাই এর উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে তাই সরল প্রকৃতির অঙ্গরচনার মাধ্যমে এই ব্যঞ্জনা প্রকাশে কোনো বাধা সৃষ্টি করে না। কিন্তু তৃষ্ণায় নাটকটির চরিত্রগুলো যেহেতু বাঘ, কুমির, শেয়াল, গাধা, কুকুর তাই এর অঙ্গরচনার ভূমিকাটিও হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে চরিত্র চিত্রণের বিষয়টিকে সামনে রেখে অঙ্গরচনা করা হলেও এর অঙ্গরচনা বাস্তবধর্মী নয়। বিচিত্র রং ও মেকআপের নানা উপাদানের সাহায্যে শিল্পীর মুখমণ্ডলে রূপকধর্মী রূপ চিত্রিত করেছেন পরিকল্পক। চরিত্র ও রসের ভিত্তিতে রং নির্বাচন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মেকআপ ডিজাইনের ক্ষেত্রে তিনটি উপাদানকে (elements) সামনে রেখে এর প্রয়োগ হয়েছে। এগুলো হলো Form, Color, Texture। এই তিন উপাদানের সমন্বয়ে মঞ্চে প্রদর্শিত হয়েছে চরিত্রগুলো। নিচে পর্যায়μমে উপাদানগুলোর প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো –

৪. ক. Form : মেকআপের ক্ষেত্রে Form হলো মুখমণ্ডলের গঠন। মানুষ ভেদে প্রত্যেকেরই মুখমণ্ডলের গঠন সমআকৃতির নয়। কারো শরীরের গঠন অনুযায়ী মুখমণ্ডলের গঠন ছোট বা বড় হয়। কারো মুখমণ্ডল গোলাকৃতির, কারো ডিম্বাকৃতির, কারো লম্বা, কারো অনেকটা চতুর্ভুজাকৃতির। একজন দক্ষ রূপসজ্জা পরিকল্পককে তাই দেহের আকৃতি অনুযায়ী কিংবা চরিত্রের প্রয়োজনে মুখমণ্ডলের আকৃতিকে (Shape) সঠিক অনুপাতে (Proportion) এঁকে নিতে হয়। এটি তিনি করেন আকৃতি এবং চোখ ও ভ্রুর অবস্থান নির্ণয়ের মাধ্যমে। সাধারণভাবে (Makeup) মেকআপের সুবিধার্থে মুখমণ্ডলকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে নেওয়া হয়। এগুলো হলো –

Fore-head (কপাল)

Eye (চোখ)

Nose (নাক)

Mouth and chin (মুখ ও চিবুক)

Gloss (কপোল)

প্রতি বিভাগ আবার বিভিন্ন অংশে বিভক্ত। প্রতিটি অংশেরই রয়েছে আলাদা আলাদা ভূমিকা। Bedrock of Kanebo’s১৩  মেকআপ তত্ত্ব (theory) অনুসারে এখানে P.P.D effect১৪-ও পরিলক্ষিত হয়।

খ. Color : মেকআপে রং (Color) নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রতিটি রঙের সঙ্গে সংযোগ (combination) সঠিক পরিমাণে থাকা উচিত। এর মাধ্যমে একজন রূপসজ্জা পরিকল্পক তাঁর নিশ্চিত চরিত্রটি পেতে পারেন। এক্ষেত্রে রঙের (Color) hue, value ঠিক রাখা জরুরি। আর এজন্য প্রথমেই তাঁকে Color wheel অঙ্কন করে নিতে হবে।

যখন মেকআপ মুখমণ্ডলে প্রয়োগ করা হয় তখন রঙের (Combination) সংযোগ ও এর মাত্রা (Balance) ঠিক রাখা জরুরি। তৃষ্ণায় নাটকটিতে বাঘ চরিত্রটির রূপসজ্জায় হলুদের ওপর কালো রেখা ও বিন্দু অঙ্কন করা হয়েছে এবং ঠোঁটে লাল রং ব্যবহার করা হয়েছে। কুমির চরিত্র চিত্রণে সবুজের ওপর কালো রেখা, মুখ ও গলায় মূলত লাল রং ও এর সঙ্গে কালো ও সাদা রং ব্যবহার করে মুখগহ্বর ও দাঁতের অবস্থান বোঝানো হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য চরিত্র চিত্রণে সাদা, কালো ও লালের ব্যবহার করা হয়েছে। আর এ-রংগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে শক্তি, সতর্কতা, ক্ষমতা, একাগ্রতা, ভালোবাসা, ইচ্ছা, উৎফুল্লতা, উর্বরতা, সজীবতা, শুদ্ধতা, রহস্য প্রভৃতি বিষয় স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে।

প্রযোজনাটির দিকে দৃষ্টিপাত করলে স্পষ্টতই পরিলক্ষিত হয় এখানে worm color (উষ্ণ রং)-এর প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে। সাদা ও কালো – এ দুটো color theory অনুযায়ী neutral রং।

গ. Texture : মেকআপ কেবল রঙের খেলাই নয় বরং এটি প্রয়োগের দিক থেকে কোন ধরনের সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। এর Texture-এ বৈচিত্র্য এনে চরিত্রকে আরো অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব। সাধারণত তিন ধরনের (makeup) মেকআপ Texture-এ ব্যবহার হয়ে থাকে।

i. Matte

ii. Sheer

iii. Gloss

তৃষ্ণায় নাটকটির প্রতিটি চরিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় চরিত্রগুলো বহুল রঙে রঞ্জিত হবার পরও texture-এর দিক থেকে matte।

নাটকটির রূপসজ্জার এই জটিল ও সময়সাপেক্ষ কাজটি সম্পন্ন হয়েছে দুভাগে –

i. Foundation or base color.

ii. Lining color

আধুনিক নাট্য-প্রযোজনায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এই রূপসজ্জা নিয়ে বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। চরিত্রের external ও internal ভাব প্রকাশের বিষয়টি অভিনেতাদের ওপর নির্ভরশীল, আর এক্ষেত্রে একে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় রূপসজ্জা ও পোশাক। নানা স্থানের নানা জাতির মানুষের মুখে বিচিত্র ভাবের খেলা লীলায়িত করার জন্য প্রয়োজন যথার্থ রূপজ্জা। আর এই কাজে যথার্থভাবে সফল হয়েছেন তৃষ্ণায় নাটকের পরিকল্পকদ্বয় – ওয়াহীদা মল্লিক১৪ ও রহমত আলী১৫ এবং তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সাজু খাদেম। নাটকটির নির্মাণশৈলী কেন রূপকধর্মী এ-প্রশ্নের জবাবে নির্দেশক বলেছেন –

নাট্যশিল্প যদি জীবনের বিশ্লেষণী প্রতিরূপায়ণ হয় তবে এটি অবশ্যই জীবনের স্রেফ ‘অনুকরণ’ নয়। … শিল্প যদি জীবনকে কেবলই অনুকরণের দায় বহন করে তাহলে জীবন আর শিল্পের দুই কোঠার মাঝখানে ভেদ-বর্গ থাকে না। কারণ শিল্প ও জীবন নামক দুই বোনের ভিতরে বিভেদ না থাকলেও ভেদ অবশ্যই এক্সিস্ট করে। … শিল্পের এই প্রতীকী ভুবন নির্মাণের সূত্রে সাঈদ আহমদের তৃষ্ণায় নাটকটি কুশীলবদের সাথে আরো সখ্যতা জাগাতে ভেতরগত ভাবেই পারঙ্গম। …১৬

একজন রূপসজ্জা পরিকল্পক তখনই সার্থক হতে পারেন যখন তাঁর কাজের একটি পূর্বপরিকল্পনা থাকে। তাঁকে অবশ্যই মুখমণ্ডলের গঠনপ্রকৃতি জানতে হবে। যেখান থেকে তিনি non-makeup immage থেকে makeup immage-এ পৌঁছতে পারেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, তাঁর নান্দনিক জ্ঞান থাকা উচিত মেকআপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে। আর এক্ষেত্রে তৃষ্ণায় নাটকটির ক্ষেত্রে রূপসজ্জা পরিকল্পক সার্থক। কারণ প্রথমেই তিনি যে-প্রক্রিয়াটি প্রয়োগ করেছেন তা হলো, তিনি discriminate করতে পেরেছেন makeup এবং non-makeup immage-কে।

ওপরের পর্যবেক্ষণে পরিলক্ষিত হচ্ছে, রূপসজ্জা পরিকল্পক সার্থক হয়েছেন পাণ্ডুলিপির চরিত্রকে বাস্তবে রূপদান করার লক্ষ্যে। পর্যবেক্ষণে আরো দৃষ্ট হয়, একটি সাধারণ মুখমণ্ডলকে প্রাণীর অবয়ব দেওয়ার ক্ষেত্রটি অনেক বেশি challanging। এক্ষেত্রে তিনি heavy makeup ব্যবহার করেছেন। বর্তমান গবেষণায় রঙের ব্যবহারের দিকটিও অগ্রাহ্য করার মতো নয়। যেখানে তিনি worm color ব্যবহার করেছেন ঠিকই কিন্তু এর মাঝে রয়েছে ঈর্ষণীয় মাত্রাজ্ঞান এবং ভারসাম্য।

শরীর-সচেতন মানুষ যোগব্যায়াম করেন চোখ বন্ধ করে, শ্বাস-প্রশ্বাসকে শাসন করে; কিন্তু শিল্পসাধনার রূপটি একেবারে ভিন্ন। একজন শিল্পীকে চোখ খুলে রাখতে হয়, প্রাণকে সদাজাগ্রত রাখতে হয়, মনকে পিঞ্জরখোলা পাখির মতোই মুক্তি দিতে হয়। আরো করতে হয় কল্পলোক ও বাস্তবজগতের মাঝে সজাগ বিচরণ। প্রত্যেক শিল্পীকেই স্বপ্ন-ধরার জাল নিজের মতো করেই বুনে নিতে হয়। তারপর কেবল বসে বসে অপেক্ষা। সুতরাং এই শিল্পকে কেবল তত্ত্বজ্ঞান দিয়ে বিচার করা বাতুলতা মাত্র। শিল্পে অমৃত হয় এক ফোঁটা, তৃপ্তি দেয় অফুরন্ত। সৃষ্টিতে প্রাণের সন্ধান করতেই শিল্পী তৃপ্তি পান। মনের ফুল বনে গিয়ে ফুটল – এই তো একজন প্রকৃত শিল্পীর চাওয়া। শিল্পীর সজীব আত্মা সমঝদার পেলে একটু বেশি আনন্দ পায় একথা সত্য, কিন্তু এ তো উপরিপাওনা। শিল্পীর যথার্থ আনন্দ হচ্ছে ফোটার গৌরবে। একজন গায়ক যখন নিজের গলাটাকে যন্ত্রের সঙ্গে এমনভাবে বেঁধে ফেলে যে সে নিজেই একটা গ্রামোফোন হয়ে উঠল, তখন তাকে আর শিল্পী বলা চলে না। তাকে তখন বলা চলে technician। ক্রিয়া বা technic-কে ছাপিয়ে চলা হলো সুন্দর চলা। শিল্পের মূলমন্ত্রই হলো অকৃত্রিমতা। আবার এরকমও পরিলক্ষিত হয়, শিল্পী যা করে দর্শকের ওপর তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এমনতর হলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এ-আলোচনায় যে-দুজন পরিকল্পকের ফবংরমহ প্রক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে তাতে স্পষ্টতই উপলব্ধি করা যায়, নানা বর্ণ দিয়ে তাঁরা যে-রূপ ফোটাতে চেয়েছেন সেখানে তাঁরা সফল। আর এর মধ্য দিয়েই বন্ধ পিঞ্জর থেকে মুক্তি পেয়েছে নাটকের প্রতিটি চরিত্র। তাঁদের পরিকল্পিত প্রতিটি চরিত্র অনুভূতিক্রিয়াকে চিন্তাশীল রূপ দিতে সমর্থ হয়েছে। যেহেতু নাটক একটি শিল্প তাই এর গঠন কোনো পরিবর্তনহীন বিষয় নয়। এ-আলোচনায় এও স্পষ্ট হয়েছে যে, দুজন পরিকল্পকের পরিকল্পনার মধ্যেই রয়েছে অস্তিত্ববাদী দর্শনের ছোঁয়া। ক্ষুধার্ত শেয়াল আর কত খাবে, খেতে খেতে এক সময় সে ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে কুমির-মা নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে জন্ম দেবে হাজার হাজার সন্তান। ক্ষুদ্র নয়, পর্বতসম আশা নিয়ে এই চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে পুরো নাটকের পরিকল্পনায়। লৌহপিঞ্জরে আবদ্ধ হয়ে পড়া তাদের পরিকল্পনায় পেয়েছে অভিনব মুক্তি।

তথ্যসূত্র

১.   www.theatrewala.net/index.php?option=com

২.   www.theatrewala.net/index.php?option=com

৩. সাঈদ আহমদ, সাঈদ আহমদের তিনটি   নাটক,   বাংলা   একাডেমি, ১৯৭৬,  পৃ ১৪০।

৪.   Michael Holt, A Phaidon Theatre Manual COSTUME AND MAKE-UP, London, Phaidon Press Limited, 1988, p7.

.

৫.       সাঈদ আহমদ, সাঈদ আহমদের তিনটি   নাটক,   বাংলা   একাডেমি, ১৯৭৬,  পৃ ১০৫।

৬.       অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাগীশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমেটেডের পক্ষে ৪৫ বেনিয়াটোলা লেন, আগস্ট ১৯৯৯, পৃ ২৫০।

৭.       রঞ্জিত কুমার মিত্র, অঙ্গরচনা কলা, কলকাতা, কল্লোল প্রকাশনী, আশ্বিন ১৩৯৭, পৃ ৯১।

৮.  Michael Holt, A Phaidon Theatre Manual COSTUME AND MAKE-UP, London, Phaidon Press Limited, 1988, p 39.

৯.   www.hutumpecha.com

১০.      জিয়া হায়দার, থিয়েটারের কথা ১ম খণ্ড, পৃ ৩৬।

১১.      ওই, পৃ ৫৫।

১২.      ওই, পৃ ৭৭।

১৩.      থিয়েটারওয়ালা, সপ্তম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ ২০০৫, পৃ ৮৮।

১৪. https://studziib.net

১৫. https://stylecaster.com

১৬.      সহযোগী অধ্যাপক, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১৭. সহযোগী অধ্যাপক, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮.      তৃষ্ণায়, স্যুভেনির।