সালমান রুশদির ‘মধ্যরাতের সন্তানেরা’ বুকারপ্রাপ্তির চার দশক

সালমান রুশদির (১৯৪৭) বিখ্যাত উপন্যাস মিডনাইটস চিলড্রেন তথা ‘মধ্যরাতের সন্তানেরা’ প্রকাশের চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে বিলেতে। সে-বছরই উপন্যাসটি ব্রিটেনের সাহিত্যাঙ্গনের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার বুকার লাভ করে; রুশদি পান তারকাখ্যাতি। ‘আমি নিদ্রা হতে উত্থিত হয়ে দেখলাম আমার নাম ছড়িয়েছে দেশজুড়ে।’ রোমান্টিক যুগের ইংরেজি কবি বায়রনের (১৭৮৮-১৮২৪) মতো রুশদিও এমনটি বলতে পারতেন পুরস্কারপ্রাপ্তিতে। তরুণ রুশদি তখন কেমব্রিজ বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইতিহাসের পাঠ চুকিয়ে লন্ডনে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কর্মরত। ‘মধ্যরাতের সন্তানেরা’ তাঁকে রাতারাতি করে তোলে বিখ্যাত ও বিত্তশালী। ফলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর লেখকে পরিণত হওয়ার সাহস তিনি পান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উপন্যাসটি ১৯৯৩ ও ২০০৮ সালে আরো দুবার বিশেষ বুকার পুরস্কার লাভ করে। 

কী আছে তিনবার বুকারপ্রাপ্ত বিশাল ব্যাপ্তির এ-উপন্যাসে? ১৯১৫ থেকে শুরু করে ১৯৭৮ সাল অবধি ষাট দশকের পথপরিক্রমার মহাকাব্যিক এ-উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে সেলিম সিনাই নামের এক কাশ্মিরি মুসলমান, অনেকটা আরব্য-রজনীর শেহেরজাদের মতো আত্মকথনের ভঙ্গিতে যে বলে চলেছে তার ঘটনাসংকুল জীবনের এক-একটি গল্প। রুশদির মতো সেলিমেরও জন্ম ১৯৪৭ সালে; রুশদির মতোই সেলিমের পরিবার কাশ্মিরি মুসলমান। তাই পাঠকের মনে হতেই পারে যে, এ-উপন্যাস যেন রুশদি পরিবারেরই তিন পুরুষের আখ্যান; ঠিক যেমনিভাবে উপন্যাসটি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ – এই তিন দেশের জন্ম ও বিস্তারের আখ্যান। সংগত কারণেই এ-উপন্যাসে এসেছে গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহ, মুজিব ও ভুট্টোর মতো উপমহাদেশের নামজাদা সব নেতার উল্লেখ। ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও ভারতের জনজীবনে তার প্রভাব, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও সেলিমের পরিবারের অকালবিলুপ্তি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর সহিংসতা, ১৯৭৭-এ ইন্দিরা গান্ধী সরকার কর্তৃক ভারতজুড়ে নিপীড়নমূলক জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও জনগণের ওপর জুলুমের কাহিনি রুশদির এ-উপন্যাসটিকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। কথক সেলিম এ-উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ কারণ তার ব্যক্তিজীবনে বিধৃত হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের ভাঙাগড়ার গল্প। কোনো প্রথাগত সরলরৈখিক বর্ণন-পদ্ধতি এখানে অনুসৃত হয়নি, বরং পাঠককে দাঁড় করানো হয়েছে শত-সহস্র গল্পরাশির সম্মুখে, যার সম্মিলিত ওঙ্কার ভারতীয় উপমহাদেশের

জনারণ্যেরই প্রতিনিধিত্বশীল।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র

থাকাকালে কিংস কলেজের ফেলো প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ই এম ফর্স্টারের (১৮৭৯-১৯৭০) সঙ্গে রুশদির আলাপ হয়েছিল। ফর্স্টারের এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া (১৯২৪) ছিল রুশদির প্রিয় উপন্যাসগুলির একটি। বর্ষীয়ান সাহিত্যিককে সে-কথা জানিয়েছিলেন রুশদি; সেই সঙ্গে এটিও বলেছিলেন যে, ভবিষ্যতে তিনি লেখক হতে চান। তবে ‘মধ্যরাতের সন্তানেরা’ লিখতে গিয়ে রুশদি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ফর্স্টারের গোছালো গদ্যে তিনি ভারতবর্ষের আখ্যান লিখতে পারবেন না। কারণ ভারত তো ফর্স্টারের ইংরেজি গদ্যের মতো পরিপাটি নয়। বরং ভারত, রুশদির মতে, ‘অগোছালো, শব্দবহুল, গন্ধময়, লোকপরিপূর্ণ ও বাহুল্যে ভরপুর’। বৈচিত্র্যময় উপমহাদেশকে কি ভাবে তুলে আনা যেতে পারে উপন্যাসের পাতায়? কি-ই বা হবে তার ভাষা? রুশদি বলছেন, ‘মধ্যরাতের সন্তানেরা’ লেখার মাধ্যমে তিনি এমন একটি ভাষা নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন যা ধারণ করবে ভারতের শব্দময়, উষ্ণ, গন্ধপূর্ণ, ভিড়াক্রান্ত রূপটিকে। ফলে, লোকে-লোকারণ্য রুশদির এ-উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে একটি জনবহুল ভারতীয় বাজারের মতো। বহু মানুষের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে মূল গল্পটিকে এখানে সামনে এগোতে হয়েছে।

উপন্যাসের শুরুতে, ১৯১৫ সালে, আমাদের দেখা মেলে সেলিমের পিতামহ আদম আজিজের সঙ্গে। সদ্য জার্মান-ফেরত তরুণ ডাক্তার আদম আজিজ জন্মভূমি কাশ্মিরের রূপ দেখে আর মোহিত হতে পারলেন না। ইউরোপের মুক্ত বাতাসে তাঁর জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়েছে যেন। পর্বতবেষ্টিত কাশ্মিরে বারবার তাই তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসে। ইউরোপীয় জ্ঞানদীক্ষিত ও যুক্তিতাড়িত আদম আজিজ অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের আর বলি হতে চাইলেন না। এক শুষ্ক-শীতল কাশ্মিরি সকালে তিনি হয়ে উঠলেন সংশয়বাদী। অবশ্য বিবাহ-পরবর্তী জীবনে এর শাস্তিও তিনি পেলেন, নিজ স্ত্রীর হাতে। গৃহশিক্ষক তাঁর সন্তানদের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নানা কথা শেখানোর কারণে তাকে বরখাস্ত করে বসেন আজিজ। ফলে তাঁর জন্যে বন্ধ হয়ে যায় স্ত্রী নাসিমের হেঁসেলের দরজা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী রুশদি এভাবেই বহু ধর্মের ভারতে ধর্মীয় সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তার গল্পটি বলার চেষ্টা করেছেন।

লেখক হিসেবে রুশদির রাজনৈতিক মতাদর্শটি এক্ষেত্রে বোঝা জরুরি। ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলতে গিয়ে সর্বধর্মসম্ভবের কথা বলা হয়েছে, যা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর (১৮৮৯-১৯৬৪) মতাদর্শেরই প্রতিফলক। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা নেহরুর উদার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির ভারতে বিশ্বাসী রুশদি। যে-কারণে সেলিম সিনাইয়ের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট রাত ১২টায়, ঠিক যে-মুহূর্তে নেহরু ভারতের পার্লামেন্টে তাঁর সুবিখ্যাত ভাষণ প্রদান করছেন : ‘বহু বছর আগে নিয়তির সঙ্গে আমরা একটি চুক্তি করে ছিলাম। আজ সময় এসেছে তার বাস্তবায়নের। ঘড়ির কাঁটাতে যখন রাত ১২টা বেজেছে, যখন সমস্ত পৃথিবী নিদ্রায় মগ্ন, ভারত জেগে উঠেছে প্রাণ-প্রাচুর্যে ও স্বাধীনতায়।’ মধ্যরাতের সেই শুভমুহূর্তে সারা ভারতজুড়ে জন্ম নেয় এক হাজার একটি শিশু। সেলিম তাদেরই একজন। প্রত্যেকেরই রয়েছে নানা জাদুকরি ক্ষমতা। কারো শ্রবণশক্তি অসাধারণ, কেউ বা হাঁটতে পারে দেয়াল ভেদ করে, কেউ একই সঙ্গে নারী ও পুরুষ, কেউ নিজের শারীরিক আকৃতি বদলায় অবলীলায়, কারো ধারাল জিহ্বা-উচ্চারিত শব্দ জখম করে মানুষের গা-হাত-পা, কেউ চক্ষু মুদলেই উড়াল দিতে পারে অন্তরীক্ষে, কেউ অঙ্গুলি হেলনে জলাশয় ভরে দিতে পারে অজস্র মাছে, কেউ কখনো ভোলে না কিছু, কেউ সময়ের রথে সওয়ারি হয়ে বলতে পারে ভবিষ্যৎ, কারো দুটি মস্তক দিয়ে অবিরাম নির্গত হচ্ছে ভারতবর্ষের নানান ভাষা, নারী ও পুরুষ কণ্ঠে। উপন্যাসের নায়ক সেলিমের রয়েছে সর্বপ্রকার গন্ধ শুঁকতে পারা প্রকাণ্ড একটি নাসিকা ও টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা, যার সহায়তায় সে অনায়াসে মধ্যরাতের অন্য সন্তানদের ডাকতে পারে যে-কোনো গুপ্ত সম্মেলনে, এমনকি ঢুকে পড়তে পারে অপরের চিন্তার দুনিয়ায়। জাদুবাস্তবতার পৃথিবীতে কি না সম্ভব! কিন্তু সেলিম জানে না, যাদের সে পিতা-মাতা ভেবেছে, সেই আহমেদ ও আমিনা সিনাই তার প্রকৃত বাবা-মা নন। সে আসলে সন্তান জন্মদানকালে মৃত, গ্রামের গরিব মেয়ে ভানিতা আর
বুড়ো-হাবড়া, পয়সাওয়ালা ইংরেজ উইলিয়াম মেথল্ডের জারজ সন্তান। জন্মের সময় বলিউড ছবির আদলে বাচ্চা অদলবদল হওয়াতে এই দশা। গরিব ভানিতার ছেলে সেলিম হয়ে ওঠে সিনাই পরিবারের সদস্য; ধনী পরিবারের ছেলে শিব, যে কিনা সিনাই পরিবারের প্রকৃত সন্তান, স্থান পায় রাস্তায়, যেহেতু স্বাধীন ভারতে গরিবের ছেলেকে ধনী বানাতে হবে, আর ধনীপুত্রের স্থান হবে আঁস্তাকুড়ে, নইলে শোষণের পুরনো কাঠামো বদলানো যাবে না – এমনটিই চেয়েছিল বাচ্চাবদলকারী খ্রিষ্টান নার্স মেরি পেরেইরার বিপ্লবী ছেলেবন্ধু জোসেফ। সেলিমের জন্মের সময়কার এত কাণ্ড সত্ত্বেও ভারতকে এ-উপন্যাসে দেখা হয়েছে অমিত সম্ভাবনার এক দেশ হিসেবে। ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক ভারত যেন একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন। অন্যদিকে পোকায়-খাওয়া ধর্মভিত্তিক জিন্নাহর পাকিস্তান দুঃস্বপ্নের অপর নাম। রুশদি বলছেন, পূর্ব ও পশ্চিম সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তান হলো দু-ডানাওয়ালা একটি অতিকায় পাখি, যার দেহ গেছে খোয়া। রুশদির মতে, পাকিস্তান নামটিও বেজায় বিসদৃশ। এ-নামের ভেতরে দেখা মেলে পাঞ্জাব, আফগানিস্তান, কাশ্মির, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের; কেবল পূর্ব বাংলা ছাড়া। বাঙালিরা তা বুঝতে পেরেছিল দ্রুত, তাই পাকিস্তানের মতো একটি হাঁসজারু রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যেতে তারা দ্বিধা বোধ করেনি। তবে রুশদি যে আদতে ভারতবর্ষের বিভক্তি চাননি তা বোঝা যায় রাজনীতিবিদ মিঞা আব্দুল্লাহর চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে। সেলিমের নানা আদম আজিজ পাকিস্তান নামক মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের ধারণায় বিশ্বাস করতেন না। সে-কারণে দেশভাগের আগে মিঞা আব্দুল্লাহকে তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন। মিঞা আব্দুল্লাহ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও অখণ্ড ভারত চেয়েছিলেন, পাকিস্তান চাননি; যে-কারণে আততায়ীর হাতে তাঁকে প্রাণ দিতে হলো; অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। দেশভাগের পরে আদম আজিজের জামাতা এবং সেলিমের বাবা আহমেদ সিনাই শ্বশুরের পদাঙ্কই অনুসরণ করলেন। তিনি জিন্নাহর পাকিস্তানে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারলেন না, তাই স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে ভারতের বোম্বেতে থেকে গেলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভারত সরকার কর্তৃক মুসলমান নাগরিকদের ব্যাংকে গচ্ছিত সম্পদ সাময়িক বাজেয়াপ্ত করাতে ক্রমান্বয়ে তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হয়। অনেকটা রুশদির বাবার মতোই বোম্বে ছেড়ে তিনি করাচি চলে যান এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

‘মধ্যরাতের সন্তানেরা’ উপন্যাসটির প্রায় অর্ধেকটি জুড়ে আছে বালক সেলিমের চোখ দিয়ে দেখা ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী বছরসমূহ। ভারতের ইতিহাসের উত্থান-পতনের সঙ্গে, দেশ-জাতি-রাজনীতির টানাপড়েনের সঙ্গে রুশদি মিলিয়ে-মিশিয়ে দিয়েছেন ব্যক্তি সেলিম ও তার পরিবারের একান্ত ইতিহাস। এর কারণ, ব্যক্তির ইতিহাসকে রুশদি জাতীয় ইতিহাসের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি। তাঁর কাছে জাতীয় ইতিহাসের মতো ব্যক্তির ইতিহাসও সমান মর্যাদার দাবিদার। মহাত্মা গান্ধী যখন ১৯৪৮ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন, তখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সেলিমের পরিবারে। পরে যখন জানা যায়, কোনো মুসলমান নয়, বরং গান্ধীকে প্রাণ দিতে হয়েছে হিন্দু উগ্র জাতীয়তাবাদী নাথুরাম গডসের হাতে, স্বস্তির নিশ^াস ফেলেন তাঁরা। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে মুসলমান সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার কাহিনি এভাবেই বলেছেন রুশদি। এখানে উল্লেখ্য, ভারতের নানা সমস্যা সত্ত্বেও পাকিস্তানকেই রুশদি একটি পচনশীল রাষ্ট্র হিসেবে দেখেছেন; ভারতকে নয়। পাকিস্তানের পচনশীলতার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টিপর্বে, যার বিস্তর বিবরণ রুশদির এ-উপন্যাসটিকে বাংলাদেশি পাঠকের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

ভারতের পাট চুকিয়ে একসময় সেলিমের পরিবার যাত্রা করে পাকিস্তানে। সেখানে সেলিমের বোন জামিলা বোরকা-আবৃতা উর্দু গানের মহা এক গায়িকায় পরিণত হয়, যার কণ্ঠের মধুতে বুঁদ হয়ে পড়েন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং আইয়ুব খান। সেলিমের খালু পাকিস্তান আর্মির জাঁদরেল জুলফিকার, যার কলকাঠিতে অবশেষে সেলিমের ঠাঁই হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ফলে ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার প্রত্যক্ষদর্শী হয় সেলিম। রুশদি লিখছেন, ‘২৫ মার্চ ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার সঙ্গে সংলাপ ভেস্তে গেলে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন শেখ মুজিব।’ সে-রাতেই ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসে হাজার পাকিস্তানি সেনা। শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ। সেলিম সিনাই দেখে, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নেওয়া হচ্ছে ঢাকা বিমানবন্দরে। প্রত্যক্ষ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়েছে সৈন্যরা, নির্বিচারে হত্যা করছে ছাত্র-শিক্ষকদের, ছাত্রী হলে হামলা চালিয়ে মেয়েদের সম্ভ্রমহানি করছে, তারপর তাদের বেয়নেট চালিয়ে, গুলি করে মারছে। জ্বলছে ঢাকা, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সংবাদপত্রের অফিস, রাস্তা ভেসে যাচ্ছে রক্তে। লেখক, কবি, অধ্যাপক কাউকেই ছাড় দেওয়া হলো না। কারণ এরা পাকিস্তানের শত্রু। অচ্ছুৎ। ঘটনাচক্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তিন জওয়ানের সঙ্গে সেলিম পথ হারিয়ে আটকা পড়ে সুন্দরবনের গহিন অরণ্যে। বাংলাদেশের জল-হাওয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের নাজেহাল অবস্থার চিত্র আঁকেন রুশদি।

পথভ্রষ্ট সেনারা সুন্দরবন থেকে বেরুনোর পথ না পেয়ে হয়ে পড়ে পাগলপ্রায়। তাদের কাছে মনে হয়, বনের গাছপালা, পশুপাখি সকলে এক হয়ে গাইছে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই বিজনে এই গানের সুর তাদের উন্মাদ করে দেয়। দিন কাটে, আসে রাত; তারা বোঝে না কোনো ব্যবধান। তাদের মনে হয়, জঙ্গল তাদের গিলে খাচ্ছে ঠিক যেভাবে ব্যাঙ গিলে খায় মশককুল। সূর্য যেন পুবাকাশে আর কোনোদিন হবে না উদিত। পাকিস্তানি সেনা আয়ুব বালুচ ‘ভেঙে পড়ে কান্নায়। তার চোখ থেকে অবিরাম নির্গত হয় বর্ষার জলধারা।’ প্রবল পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয় তারা সকলে। মলদ্বার দিয়ে যেন বেরিয়ে আসে পেটের ঘোঁটপাকানো সব নাড়িভুঁড়ি। সেনা ফারুক বলে, ‘আমরা মারা পড়ব নির্ঘাত।’ সুন্দরবনে আটকেপড়া পাকিস্তানি সেনাদের একসময় মনে হয়, বাংলাদেশের পুরো প্রকৃতি যেন একাট্টা হয়েছে তাদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, সেলিম যখন পুনরায় ভারতে প্রত্যাবর্তন করার সুযোগ পায়, তার বন্ধুরা অপার বিস্ময়ে বলতে বাধ্য হয় : ‘পাকিস্তান তোমার যে কী হাল করেছে, তা খোদাই ভালো জানেন।’

ভারতের একটি উজ্জ্বল, প্রতিশ্রুতিময় সময়ে, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে, সেলিমের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু তার সন্তান আদম সিনাই জন্মাল ১৯৭৭ সালে, যখন নেহরুর ভারত তাঁরই কন্যা ইন্দিরার হাতে রাজনৈতিক অরাজকতা, বিরোধী নিপীড়ন ও সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের এক আপাত অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছে। বাক-স্বাধীনতা হরণের যুগে ভূমিষ্ঠ হওয়া সেলিমপুত্র আদম জন্ম-মূক, যেন তার জবান কেউ নিয়েছে কেড়ে, জন্মের প্রথম প্রহরে। উপন্যাসটিতে সেজন্যে কথা বলতে পারা, লিখতে পারা খুব জরুরি। কারণ এর সঙ্গে মানুষের বাক-স্বাধীনতার প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আরব্য রজনীর শেহেরজাদের মতো সেলিম লিখেই চলে, শত বিপত্তি সত্ত্বেও। তার হাতের কলম দিন-রাত সচল, যদিও তার নিচের কলম নিদারুণ অচল! সে ঝরে পড়ছে, খসে পড়ছে, ভেঙে পড়ছে; কিন্তু লেখা সে থামায় না। তার ভেতরে আঁকুপাঁকু করছে হাজার গল্প। তাকে জানতে হলে, বুঝতে হলে, পাঠককেও এই হাজার গল্প শুনতে হবে।

রুশদির উপন্যাসটি ভালো করে পড়লে বোঝা যায় কি ধরনের ভারত তিনি চেয়েছিলেন। ধর্মাক্রান্ত ভারত তিনি চাননি। তাই পাকিস্তান তাঁর না-পছন্দ। যে-ভারতে মানুষের স্বাধীনতা থাকবে কথা বলার, মত প্রকাশের – সে-ধরনের ভারতের তিনি পিয়াসী। নেহরুর প্রতি রুশদির শ্রদ্ধা, কিন্তু তাই বলে নেহরুকন্যা ইন্দিরাকে এ-উপন্যাসে সমালোচনা করতে ছাড়েননি রুশদি। পিতার সহিষ্ণুতার ভারতকে করদ রাজ্যে পরিণত করার দায় তিনি ইন্দিরার ঘাড়েই চাপিয়েছেন। বিশেষত ১৯৭৭ সালে ভারতজুড়ে ইন্দিরা সরকারের জরুরি অবস্থা ঘোষণা, ইন্দিরাপুত্র সঞ্জয়ের বস্তিতে সাধারণ নারী-পুরুষকে জোরপূর্বক নির্বীজন প্রকল্প, শহরের শ্রীবৃদ্ধির অজুহাতে বস্তি উচ্ছেদ – এ-সব কিছুরই শিকার হয় উপন্যাসটির ভাগ্যবিড়ম্বিত নায়ক সেলিম ও তার স্ত্রী পার্বতী। ইন্দিরা গান্ধী ক্ষুব্ধ হয়ে বিলেতের হাইকোর্টে রুশদির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন এবং রুশদি বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর উপন্যাস থেকে ইন্দিরাবিষয়ক একটি বাক্য প্রত্যাহারে। তবে উপন্যাসটি প্রকাশের তিন বছর পরে ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর শিখ দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হলে রুশদি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পত্রিকায় লিখেছিলেন : ‘আমরা যারা ভারতকে ভালোবাসি, তারা সকলেই আজ শোক পালন করছি।’

উপন্যাসটির চল্লিশ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিলেত থেকে যে-সংস্করণটি প্রকাশিত হয় তার ভূমিকায় রুশদি লেখেন যে, যদিও আশির দশকে লিখিত এ-উপন্যাসে তিনি ইন্দিরা সরকারের ঘোষিত জরুরি অবস্থার ব্যাপক নিন্দা করেছিলেন, বর্তমানে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের হাতে যা ঘটছে তা ইন্দিরা সরকারের আমলের দুঃশাসনকে ছাড়িয়ে গেছে বহুগুণে এবং প্রকারান্তরে ভারতে নেহরু-প্রদর্শিত ধর্মনিরপেক্ষতার কবর রচিত হয়েছে। প্রত্যাবর্তন হয়েছে মধ্যরাতের কৃষ্ণগহ্বরের। নারীর ওপর সহিংসতা বেড়েছে, রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে কর্তৃত্ববাদী, ধর্মীয় মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, করা হচ্ছে ইতিহাসের পুনর্লিখন। যাঁরা চলমান এ-অবস্থার প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের ওপর নেমে আসছে খড়গ-কৃপাণ। রুশদি আরো বলেন যে, যখন তিনি উপন্যাসটি লেখেন তখন ‘লম্বা নাসিকা-বিশিষ্ট মুসলমান লেখক আত্মজীবনীকার সেলিম সিনাইকে’ তিনি তুলনা করতে পেরেছিলেন ‘সাহিত্যেরও পৃষ্ঠপোষক হস্তীশুঁড়সমৃদ্ধ হিন্দু দেবতা গণেশের সঙ্গে। সেলিম হিন্দু নয়, কিন্তু তার পরেও এ-উপমা বিসদৃশ ঠেকেনি।’ কারণ, রুশদি তখন বিশ্বাস করতেন, ‘পুরো ভারত-ই আমাদের সকলের, সব ধর্মাবলম্বী মানুষের।’ এখনো রুশদি তা-ই বিশ^াস করেন, কিন্তু ‘বর্তমানে যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা ভারতকে কেবল হিন্দুর বলেই দাবি করছে।’ তবু রুশদি আশা খুঁজে বেড়ান ‘সে-সকল অদম্য ছাত্র-ছাত্রী ও নারীদের মাঝে যাঁরা শত ঝঞ্ঝা সত্ত্বেও কাজ করে যাচ্ছেন ধর্মভিত্তিক ভেদাভেদ দূর করে আবারও যেন সেই আদি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে ফিরিয়ে আনা যায়; অবসান হয় চলমান অন্ধকারের।’ কাজটি কঠিন, কিন্তু রুশদি আশায় স্থাপন করেছেন বসতি। প্রথম প্রকাশের চল্লিশ বছর পরেও যে রুশদির উপন্যাসটি এখনো সারাবিশ্বে পঠিত ও আলোচিত হচ্ছে তা রুশদির ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাভাবনার প্রতি পাঠকের সমর্থনকেই জানান দেয়।

উৎসাহী বাঙালি পাঠককে মিডনাইটস চিলড্রেন পড়ার আহ্বান জানাই। বইটির একটি বাংলা অনুবাদ বাজারে পাওয়া যায়। কিন্তু মূল বইটি ইংরেজিতে পড়লে রুশদির ভাষার কারুকাজ, বিশেষত রুশদি ইংরেজের ইংরেজিকে ভেঙেচুরে যেখানে নিয়েছেন সেটি পাঠককে মুগ্ধ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।