এই সময় কলকাতায় শীত জাঁকিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। এখানে এই জেটির সামনে বসে যতদূর দেখা যায়, শান্ত সমুদ্রের সঙ্গে নীল আকাশের মাখামাখি। বেলা গড়িয়ে এলো। সমুদ্রের জলকাচে বিভিন্ন রঙের মাছের আনাগোনা। পোর্ট ব্লেয়ার শহরটা অনির্বাণের খুব সুন্দর লাগে। শান্ত, সমাহিত। ইংরেজি নতুন বছরের গোড়ায় টুরিস্টের ছড়াছড়ি। রাস্তাঘাটে কান পাতলেই কলকাতার বাবু-বিবিদের কথা ধরা পড়ে। তবু এখানে আসার আগে মোনার বাবা সুবীরবাবু বললেন, ‘ওই আন্দামান! কালাপানি, জাড়োয়া। না, না, আমার মেয়েকে তোমার হাতে দিতে পারি না। জীবনে শেষ পর্যন্ত দ্বীপান্তরে পাঠাব মেয়েটাকে? অসম্ভব!’ মোনাও দোটানায় পড়ে গিয়েছিল। বাবার মুখের ওপর কথা বলার সাহস দেখাতে পারেনি। আর ওর বড়দিদি শম্পাদি, মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিলেন। অনির্বাণ মুখ নিচু করে বেরিয়ে এসেছিল। মোনার ছোট বোন রুম্পা অনির্বাণের হাত ধরে বলেছিল, ‘অনির্বাণদা, সব ঠিক হয়ে যাবে, ভেবো না।’

তারপর দেখতে দেখতে প্রায় এক বছর কেটে গেছে। অনির্বাণ একটি মাল্টিন্যাশনাল সংস্থায় ম্যানেজার, ইনফরমেশন টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। জেটির চারদিকে আলোর রোশনাই জ্বলে উঠলো। ভিড় বাড়ছে। সামনের নেতাজী স্টেডিয়ামের মঞ্চে আস্তে আস্তে ঘোষকের কণ্ঠ শোনা গেলো। টুরিজম ফেস্টিভাল শুরু হয়েছে। পায়ে পায়ে অনির্বাণ স্টেডিয়ামে গিয়ে একটা চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। ছুটির দিনে ওর সময় কাটতে চায় না। একটু পরেই অনুষ্ঠান শুরু হবে। আন্দামান অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের উদ্যোগেই এই অনুষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্পীরা এসেছেন। ঘোষণা শোনা গেলো, প্রথম অনুষ্ঠান, ‘বন্দে মাতরম’ নৃত্যানুষ্ঠান। পরিবেশনায় কলকাতার একটি গ্রুপ। কিন্তু তারপরের ঘটনার জন্য অনির্বাণ একদম প্রস্তুত ছিল না। অনির্বাণ সামনের সারিতে বসেছিলো। মঞ্চে আলো জ্বলে উঠতেই দেখা গেলো, সংগীত পরিচালনায় মোনার বড়দিদি শম্পাদি এবং শিল্পীদের মধ্যে মোনাও আছে। অনুষ্ঠান কীরকম হলো, অনির্বাণের কিছুই মনে নেই। অনুষ্ঠানশেষে মঞ্চ থেকে শম্পাদি নেমে এসে বললেন, ‘হোয়াট অ্যা সারপ্রাইস! কী খবর, কেমন আছো?’ ‘বেঁচে আছি’, অনির্বাণের উত্তর। মোনার মুখে কোনো কথা নেই। শম্পাদি বললেন, ‘বাপিও সঙ্গে এসেছেন, আমরা মেগাপোড্‌ নেস্ট হোটেলে উঠেছি। তোমার নাম্বারটা দাও। হোটেলে এসো। এই সপ্তাহটা সেলুলার জেল, করবিন্‌স্কো বিচ, হ্যাভলক আর কী কী লোকাল সাইট সিইং আছে, সেগুলি কভার করবো। চলো না, সঙ্গে যাবে?’ অনির্বাণ মাথা নেড়ে বললো, ‘এখন ইয়ার এন্ড, ছুটি পাওয়া যাবে না। তাছাড়া সামনের সপ্তাহে নিকোবর সেইলিং আছে, অফিসের কাজে, এমভি হর্ষবর্ধনে।’

‘কী অদ্ভুত, আমরাও তো যাচ্ছি, একই জাহাজে, কার নিকোবরে।’

‘সর্বনাশ, আপনার বাবাও তো আছেন আবার। ধাক্কা দিয়ে না টেন ডিগ্রি চ্যানেলে ফেলে দেন’, হাসতে হাসতে অনির্বাণের উত্তর। ‘টেন ডিগ্রি চ্যানেলটা কী?’ শম্পাদির প্রশ্ন। ‘ওই কার নিকোবর যেতে একটা খাঁড়ি পার হতে হয়। প্রচণ্ড আন্ডার কারেন্ট। আগেকার দিনে ওই জায়গাটা পার হওয়ার সময় লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে দেওয়া হতো। এখন অবশ্য বড় জাহাজ, কোনো ভয় নেই। এখানে মেরিন অ্যাকোয়ারিয়ামটা দেখে নেবেন’, অনির্বাণ বলে যায়। এরপর প্রশ্ন করে, ‘ওই যে সমুদ্রের মাঝখানে দেখা যাচ্ছে, রস আইল্যান্ড, ওটা দেখা হয়েছে?’ ‘না, এ-সপ্তাহে সব দেখা হবে’, শম্পাদি বলেন। মোনা মাঝে মাঝে আড়চোখে কিছুটা বিষণ্ন মুখে তাকাচ্ছিলো আর মেকআপ দেওয়া মুখের ওপর থেকে ঘর্মাক্ত কুন্তলরাশি সরিয়ে দিচ্ছিলো।

রাতে ঘরে ফিরতে ফিরতে অনির্বাণের অনেক কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু যে-আশা করতে নেই, তা মন থেকে সরিয়ে দিচ্ছিলো। পরদিন অফিসে কাজে মন বসছিলো না। সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্দেশে রওনা হলো। পোর্ট ব্লেয়ারের রামকৃষ্ণ মিশনে এলে মনে হয়, বেলুর মঠের ছোট্ট সংস্করণ। গুরুগম্ভীর স্বরে যখন ‘খণ্ডন ভব বন্ধন জগ বন্দন বন্দি তোমায় …’ আরতি-স্তব শুরু হয়, অনির্বাণের সমস্ত মানসিক ক্ষোভ মিলিয়ে যায়। স্তব-সংকীর্তনের শেষে কথামৃত পাঠ শুনে একেবারে হোটেলে খেয়ে ঘরে ফিরলো। রান্নাবান্নার কথায় ওর খিদে চলে যায়। পরদিন অফিসে একবার শম্পাদির ফোন এসেছিল, ‘যাচ্ছ তো?’ ‘অফিসের কাজ, না গিয়ে উপায় নেই। জাড়োয়া দেখেছেন?’ অনির্বাণের জিজ্ঞাসা। ‘তাদের কীভাবে দেখা যায়?’ শম্পাদির কথায় অনির্বাণ বললো, ‘আপনাদের ট্র্যাভেল এজেন্টকে বলবেন, রঙ্গত যাওয়ার পাশের জোগাড় করতে। একদিন রঙ্গতে স্টে করবেন। পথে জাড়োয়াদের দেখতে পাবেন।’ ‘দেখি বাপিকে বলি’, শম্পাদির উত্তর।

 এমভি হর্ষবর্ধনের সেই আগের মতো চাকচিক্য আর নেই। অনির্বাণের ডিলাক্স কেবিনের সঙ্গের ভদ্রলোক বাঙালি। ‘আপনাদের অফিসে ক্ষমা মল্লিক আছে না? ছলদাড়ির মেয়ে। ওকে আমার নাম বলবেন। আমার আবার কার নিকোবরে পোস্টিং হয়েছে। কালেক‌টরের অফিসে। আপনার বাড়ি কলকাতায়?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন। অনির্বাণ হুঁ-হাঁ করে সময় কাটাচ্ছিলো। এঁরা বাংলাদেশের সেট‌লারস। আন্দামানে প্রচুর সেটলারস আছেন। ‘কেবিন প্যাসেঞ্জারস আর রিকোয়ে‌স্টেড টু টেক দেয়ার ডিনার ফ্রম সেভেন টু সেভেন থার্টি, অ্যাট দ্য ডাইনিং হল’, কেবিনের মাইক্রোফোনে ঘোষণা শোনা গেল। এত তাড়াতাড়ি খিদে পায়নি, তাও অনির্বাণকে উঠতে হলো। ডাইনিং হলে মোনা ওরা একদিকে বসে ছিল।  অনির্বাণ  কিছুটা  দূরে  বসে

এটা-ওটা মুখে দিয়ে উঠে এলো। কেবিনে ফিরতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। জাহাজটা দুলছিলো। কেবিনের ভদ্রলোক শুয়ে ছিলেন, বললেন, ‘না, আর উঠলাম না।  উঠলেই আমার বমি হয়ে যাবে।’

জাহাজটা কীরকম দুলছে। কেবিনের টয়লেটের দরজাটা বন্ধ হয় না। সারারাত জাহাজের দুলুনির সঙ্গে ঘটাঘট শব্দ করতে লাগলো, আর তার মধ্যে পাশের ভদ্রলোক নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। অনির্বাণের ঘুম আসছিল না। বিকেলে জাহাজের ডেকে সুবীরবাবু গ্রুপের সবাইকে নিয়ে বসেছিলেন। মোনা অল্প সময়ের জন্য বসে কেবিনে চলে গিয়েছিলো। পড়ন্ত বিকেলে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে তামাটে বলটা আস্তে আস্তে সমুদ্রের জলে তলিয়ে গেলো। জাহাজটা এগোচ্ছে, কালো জল কেটে দুপাশে বরফসাদা জলের ফোয়ারা ছিটিয়ে। যে-পথে এগোচ্ছে, বহুদূর পর্যন্ত তার চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। দিগন্তে চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিলো। শম্পাদি একবার অনির্বাণকে তাদের সঙ্গে বসতে বলছিলেন। কিন্তু সুবীরবাবুর গম্ভীর মুখ দেখে অনির্বাণের আর সাহস হয়নি।

‘প্যাসেঞ্জারস ফর কার নিকোবর আর রিকোয়েস্টেড টু বি রেডি উইদিন হাফ অ্যান আওয়ার’, কেবিনের মাইক্রোফোন অনির্বাণের ঘুম ভাঙালো। পাশের ভদ্রলোক ধড়মড়িয়ে উঠলেন। ‘টেন ডিগ্রি চ্যানেলটা কখন পার হলো? আপনার ভালো ঘুম হলো? উঠুন, উঠুন, কার নিকোবর এসে গেছে’, ভদ্রলোক বললেন। লোয়ার ডেকে এসে দেখা গেলো, সবাই ছোট বোটের জন্য অপেক্ষা করছে। নিকোবর জেটিতে বড় জাহাজ যেতে পারে না। অগভীর জল, তাই প্রায় আধঘণ্টা হর্ষবর্ধন মাঝসমুদ্রে দাঁড়িয়ে রইলো। ছোট বোট হর্ষবর্ধনের গায়ে লাগার পর, সবাই হুড়মুড়িয়ে হর্ষবর্ধনের সিঁড়ি বেয়ে লাফ দিয়ে বোটে উঠছিল। জেটিতে অফিসের সুমোটাকে সুবীরবাবুদের জন্য ছেড়ে দিয়ে অনির্বাণ নিজে একটা অটোতে পিডব্লিউডি গেস্ট হাউসে পৌঁছলো।

কার নিকোবর ছোট্ট, সুন্দর, সমতল জায়গা। রাস্তাঘাট পোর্ট ব্লেয়ারের মতো চড়াই-উতরাই নয়। গেস্ট হাউসটা খুব সুন্দর, এসি, ফ্রিজ, কেবল লাইন সবই আছে। সারাদিন অফিসের কাজেই অনির্বাণ ব্যস্ত থাকলো। রাতে ডিনারের পর বাইরে একটু ঘুরতে বেরোল। মোনাদের সঙ্গে দেখা। সুবীরবাবু একটু দূরত্বে হাঁটছিলেন। ‘এখানে তো বিশেষ কিছুই দেখছি না। চলো না, কাল একসঙ্গে দূরের কোনো আদিবাসীদের গ্রামে যাওয়া যাক’, শম্পাদি বললেন। সুবীরবাবুর দিকে ইঙ্গিত করে অনির্বাণ বললো, ‘সেটা কি ভালো হবে? এভাবে, একসঙ্গে ঘোরাঘুরি।’ ‘সে আমরা ম্যানেজ করবো। তাহলে যেমন কথা হলো, কাল একসঙ্গে’, শম্পাদি আস্তে আস্তে বললেন। গেস্ট হাউসের সামনেই ঘন লম্বা গাছের সারি পেরিয়ে সমুদ্রের বালুচর। অনির্বাণ সেদিকে এগোতেই পেছন থেকে সেই ভদ্রলোক হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। ‘যাবেন না, যাবেন না। ওখানে ওই গাছে অনেকে আত্মহত্যা করেছে। রাতে প্রেতাত্মা আসে। কেউ যায় না ওদিকে।’ অনির্বাণ এগোতেই পেছন থেকে মোনার কণ্ঠস্বর, ‘নাই বা গেলে, যখন বলছেন।’ ‘আমার আর কিই বা হবে!’ এই কথা বলে অনির্বাণ গাছের সারি ভেদ করে অন্ধকারে সমুদ্রের তীরে গিয়ে দাঁড়ালো। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ, নিচের সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস দেখে যেন হাসছে। দুধারে ধুধু করছে বালির চর। গা-ছমছম করা নিস্তব্ধতা, শুধু শোঁ শোঁ বাতাসের আওয়াজ আর জলের কলধ্বনি।

পরদিন ভোরে সুমোতে ড্রাইভারের পাশে অনির্বাণ আর সুবীরবাবু একদম শেষের দিকের সিটে। লোকাল ড্রাইভার সব বোঝাতে বোঝাতে যাচ্ছিল। এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ব্রেক ওয়াটার ড্যামের কাজ দেখা গেল। নিকোবরে তখন নতুন জেটি হচ্ছিলো। সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে বোল্ডার ফেলে ফেলে ঢেউয়ের বিষদাঁত ভাঙা হচ্ছিলো। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। একপাশে সমুদ্রের ঢেউগুলি এসে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বোল্ডারগুলির ওপর পড়ছে, আর একপাশে শান্ত সমুদ্র, যেখানে জেটিতে জাহাজ এসে দাঁড়াবে। আর এক জায়গায় রাস্তার ধারে দেখা গেল একই নারকেল গাছের আগা দুভাগ হয়ে দুটো নারকেল গাছ উঠেছে। দুটো গাছেই ফল। চারদিকে রাস্তার দুপাশে শুধু নারকেলগাছ। নারকেল পড়ছে, তার থেকে আবার একটা নারকেল গাছ উঠছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গাছের রোপণ করা হয় না। মাঝে মাঝে দেখা যায় কেড়ুই ফলের গাছ। অনেকটা বড় আনারসের মতো দেখতে। নিকোবরিরা এই ফলের ভেতরের অংশ ভাঁপিয়ে শিশুদের খাওয়ায়। অনেকটা সেরেলাকের মতো কাজ করে। নিকোবরিদের প্রধান খাদ্য নারকেল আর শুয়োরের মাংস। ড্রাইভার ছেলেটা আধা হিন্দিতে সব বলে যাচ্ছিলো, আর সবাই নিঃশব্দে শুনছিল। আস্তে আস্তে সভ্য জগতের হাওয়ায় ভাত, চা ইত্যাদির প্রয়োজন বাড়ছে।

অনেকটা রাস্তা পরপর কখনো দেখা যায়, একটা বন্যপ্রাণীর কাটা মাথা বাঁশের সঙ্গে জঙ্গলে পোঁতা। অর্থাৎ ওই পর্যন্ত একটা গ্রামের জমির সীমানা। জমির মালিকানা গ্রামভিত্তিক হয়। ব্যক্তিগত জমির মালিকানা নেই বললেই চলে। সুমো এসে একটা গ্রামের সামনে দাঁড়ালো। ড্রাইভার ভিলেজ ক্যাপ্টেনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। সমগ্র নিকোবর দ্বীপের সমাজব্যবস্থা চলে দ্বীপের চিফ‌ ক্যাপ্টেনের নির্দেশে। চিফ ক্যাপ্টেনের নিচে রয়েছে ফার্স্ট ক্যাপ্টেন, সেকেন্ড ক্যাপ্টেন, ভিলেজ ক্যাপ্টেন ইত্যাদি। সমগ্র ব্যবস্থা নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ক্যাপ্টেন আমাদের হলঘরে নিয়ে গেলেন। যেখানে পরিবারের সদস্যরা নিদ্রাযাপন করেন। এখানে পরিবার বলতে শুধু স্বামী, স্ত্রী, সন্তান বোঝায় না। পরিবার বলতে বোঝায় একই বংশের সব বংশধর। যেমন বাবা, মা, দাদু, দিদিমা, ঠাকুরদা, ঠাকুমা, নাতি, নাতনি ইত্যদি সবাই একসঙ্গে এক জায়গায় বসবাস করে। সবাই কমন ডাইনিংরুমে কমন রান্নাঘরে রান্না করা খাবার খায়। সবাই একসঙ্গে হলঘরে নিদ্রাযাপন করে।

এইরকম অনেক আলাদা বংশধর একই জায়গায়, একই গ্রামে বহুদিন ধরে বসবাস করে। এই গ্রামগুলোকে বলে ‘টুহেট’। এ এক অদ্ভুত অনাবিল ব্যবস্থা। যে-কোনো আর্থ-সামাজিক সিদ্ধান্ত ক্যাপ্টেনের অনুমতি ছাড়া নেওয়া হয় না। সম্প্রদায়ের উৎপাদিত দ্রব্য কো-অপারেটিভ ব্যবস্থার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার কিনে নেয়। সুবীরবাবু মন দিয়ে সব শুনছিলেন, আর বারবার বিড়বিড় করছিলেন, ‘টুহেট, টুহেট, বাহ্, চমৎকার।’ তখনই ঘটনাটা ঘটলো। মোনা ক্যামেরাতে চারদিক ধরে রাখছিলো। হঠাৎ একটি নিকোবরি মেয়ে ওদের ভাষায় কী বলতে বলতে মোনার হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে অনির্বাণকে মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিলো। তারপর সবাইকে গোল করে দাঁড় করিয়ে, ফটাফট ক্যামেরার শাটার টিপে দিলো। সুবীরবাবুর মুখের দিকে অনির্বাণ ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখলো, সুবীরবাবু মৃদু মৃদু হাসছেন।

পরদিন সকালে আবার হর্ষবর্ধনে ফেরা। অনির্বাণ গেস্ট হাউসের সামনের বালুচরের ওপর দাঁড়িয়ে দূরে সমুদ্রের মাঝে হর্ষবর্ধনের চূড়া দেখতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গে গেস্ট হাউসে এসে সবাইকে রওনা হতে বললো। ওই ভদ্রলোক খুব বিষণ্ন মুখে অনির্বাণকে বললেন, ‘পোর্ট ব্লেয়ারে ছুটিতে গেলে দেখা করবো। আপনারা তো চললেন, আমার এখন এখানে একা একা থাকতে হবে।’ অনির্বাণের খুব খারাপ লাগছিল। সত্যি, দুদিনের পরিচয়ে ভদ্রলোককে বড় আপনার লাগছিল। জেটিতে ডি.সি. মিস্টার রামচন্দ্রন হাত নাড়তেই স্টিমার মাঝসমুদ্রের হর্ষবর্ধনের দিকে যাত্রা শুরু করলো। জাহাজের ক্যাপ্টেন, সেলারস‌রা অনির্বাণদের সাগ্রহে আপ্যায়ন করলেন। সেলারস‌দের জীবন চেনা মুখ বড় একটা দেখতে পায় না। জলে জলে ঘুরতে হয়। ব্রেকফাস্ট বেশ জব্বর হলো। ডাবল ডিম সেদ্ধ, ইডলি, বড়া, কর্নফ্লেক্স, দুধ, শেষে ফ্রুটস। আপার ডেকে মোনা, শম্পাদি এবং অন্যান্য মেয়ে বসে হইহুল্লোড় করছিল। সুবীরবাবু পায়চারি করছিলেন আর কিছু একটা সমাধান করার চেষ্টা করছিলেন ঘন ঘন সিগারেটের সঙ্গে। মেয়েরা অনির্বাণকে বারবার দলে ডাকছিলো, কিন্তু অনির্বাণ এড়িয়ে যাচ্ছিলো। ‘রঞ্জনদা, রুম্পা এলো না কেন?’ অনির্বাণ জিজ্ঞেস করলো। ‘রঞ্জনদার এইসব শিল্পকলায় মন নেই, শুধু অফিস আর ইউনিয়ন নিয়েই আছে। আর রুম্পা মামণির সঙ্গে রয়ে গেল’, শম্পাদি উত্তর দেন। ‘জাড়োয়া কেমন দেখলেন?’ ‘না গেলেই ভালো হতো, লজ্জা করছিল, বাপির সঙ্গে ওই নগ্ন, অসহায় লোকগুলিকে দেখতে। মানুষ কী দেখতে যে যায়!’ শম্পাদি বললেন। ‘আমার তো ভাবলে খুবই কষ্ট হয় লোকগুলির জন্য। তাই কোনোদিনই ওদের আর দেখতে যাব না’, অনির্বাণ বলে।

অনির্বাণ ডেক থেকে ধীরে ধীরে কেবিনে যাওয়ার রাস্তায় জাহাজের কিনারে হেলান দিয়ে ভাবছিলো গত কয়েকদিনের ঘটনাবলি। আকাশে ঘন মেঘ, বেশ জোরে বৃষ্টি আরম্ভ হলো। সুবীরবাবু মেয়েদের নিয়ে কেবিনের দিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর মোনা ফিরছিলো। জাহাজটা বোধহয় টেন ডিগ্রি চ্যানেল পার হচ্ছে। প্রচণ্ড দুলছে। অনির্বাণ পথ আগলে মোনাকে বললো, ‘একটু দাঁড়িয়ে যাও। কেমন আছ?’ ‘ওই এক রকম’, মোনার উত্তর। ‘বেশ তো ভুলে ছিলাম, কেন এলে? মেয়েরা বোধহয় সবকিছুই তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। নতুন করে ভবিষ্যতের ঘর বাঁধতে প্রস্তুত হয়। আমি আর পারছি না। বড় কষ্টে আছি’, অনির্বাণ বলে যায়। এই সময় জাহাজটা একটা প্রচণ্ড দুলুনি দেয়। মোনা পড়ে যাচ্ছিলো। অনির্বাণ ওকে ধরে ফেললো। মোনার কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘কিছুই কি করা যায় না? আর পারছি না, এখানে একা একা। আমার চোখের দিকে তাকাও।’ মোনা মুখে আঁচলচাপা দিয়ে ধরা গলায় বলে, ‘মেয়েদের মনের কথা ছেলেরা কোনোদিনই বোঝে না। পুরুষ জাতটাই এমন। ছাড়ো, বাপি চিন্তা করবেন। সাহস থাকলে কিছু একটা করে দেখাও।’ অনির্বাণের হাত ছাড়িয়ে মোনা কেবিনের দিকে চলে যায়। দূর থেকে বলে যায়, ‘কেবিনে গিয়ে তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছেড়ে ফেলো, বৃষ্টিতে একদম ভিজে গেছো। ঠান্ডা লেগে যাবে।’

পোর্ট ব্লেয়ারে পৌঁছে সুবীরবাবুরা তাদের হোটেলে চলে যান এবং অনির্বাণ নিজের অফিসের কোয়ার্টারে। রাতে অনির্বাণ বিছানায় শুধু এপাশ-ওপাশ করতে থাকে, ঘুমোতে পারে না। পরদিন সকালে উদ্‌ভ্রান্তের মতো এয়ারপোর্টে মোনাদের বিদায় জানাতে যায়। সুবীরবাবু অনির্বাণকে দেখেই এগিয়ে এলেন, ‘তাহলে আসা হলো। আমি তো ভাবলাম তুমি বোধহয় আর এলেই না। তোমার মা কেমন আছেন? মাকে রোজ ফোন করো? তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা খালি আছো কম্পিউটার, ই-মেইল আর ইন্টারনেট নিয়ে।’ অনির্বাণের উত্তরের অপেক্ষা না করে সুবীরবাবু একটানা বলে যাচ্ছিলেন, ‘দেখো তো আমার বড় জামাই রঞ্জন কত ভালো। রোজ এখানে পর্যন্ত খোঁজ নিয়েছে হোটেলে।’ যেন বিশাল কোনো অপরাধ করেছে, এই ভেবে গোবেচারার মতো মুখ কাঁচুমাঁচু করে অনির্বাণ সব শুনছিলো আর মেয়েরা মুখে হাতচাপা দিয়ে হাসছিলো। ‘আচ্ছা চলি, রাতে আমাকে একটু ফোন কোরো তো। মেয়েরা চলো, চলো, সময় হয়ে গেছে।’ সুবীরবাবু এগোলেন। অনির্বাণ ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়লো। ‘ফোন করতে বললেন কেন, কিছুই তো বুঝলাম না’, অনির্বাণ বিড়বিড় করে বলে। শম্পাদি কপট গাম্ভীর্য দেখিয়ে বললেন, ‘হয়তো ওই টুহেট সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞেস করবেন।’ মোনা পাশ থেকে হাসি চেপে বললো, ‘কী আর বুঝবে! একটা ঢ-এ য-ফলা আকার ড-এ শূন্য ড় দন্তস।’ এই  বলে  মোনা  গটগট  করে  এগিয়ে  গেলো। লাউঞ্জে ঘোষণা, ‘প্যাসেঞ্জারস Vortices  ফর আই-সি সেভেন-টু-এইট-সিক্স ফর কলকাতা আর রিকোয়েস্টেড টু প্রসিড টু সিকিউরিটি চেক।’