সৈয়দ মুহাম্মদ জাকির : মায়া বস্তু বিস্ময় ও নব্য ব্যাকরণ

শিল্পী সৈয়দ মুহাম্মদ জাকিরের একক চিত্র-প্রদর্শনী ‘মায়া’ চলেছে গত ২২শে জুলাই থেকে ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত রাজধানীর ধানমণ্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে।

ব্যতিক্রমী এই প্রদর্শনী নিয়ে বেঙ্গল আর্টস প্রোগ্রাম আয়োজন করে ‘সৈয়দ মুহাম্মদ জাকির : মায়া বস্তু বিস্ময় ও নব্য ব্যাকরণ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানের। এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্পী ও শিল্প-সমালোচক মোস্তফা জামান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ও শিল্পী নাসিমুল খবির এবং লেখক-গবেষক পারসা সানজানা সাজিদ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।

নাসিমুল খবির বলেন, জাকির ইমন শুরু থেকেই বস্তু বা ম্যাটেরিয়াল নিয়ে কাজ করছেন। স্কাল্পচারের এলিমেন্ট হিসেবে ম্যাটেরিয়াল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। ইমন প্রথম থেকেই ম্যাটেরিয়াল নিয়ে নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পারফরম্যান্স আর্ট ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা শুরু করেন।

তিনি বলেন, ইমন পরিবেশের উপাদান নিয়েও নানা রকম কাজ (শিল্পকর্ম) করেছেন। বেঙ্গলের ওপেন স্পেসে কাজ করতে গিয়ে ইমন একটা গল্প বেছে নিয়েছেন। সেই গল্পটাকে তিনি এমনভাবে সাজিয়েছেন যেন প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান থেকে পাওয়া গেছে একটি ভবিষ্যতের নগর। এর মাধ্যমে নিজের মতো করে একটি গল্পের মধ্য দিয়ে যাত্রা করেছেন তিনি। কিন্তু যদি আমরা তাঁর মতো করে না দেখে আমাদের মতো করে দেখি তবে দেখতে পাই, তিনি বিভিন্ন বস্তুকে একটি স্থানে জড়ো করে একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত করে প্রতিনিয়ত একটি বার্তা যেন আমাদের কাছে পাঠাতে থাকেন। এর মধ্য দিয়ে বলা যায় ইমন নব্য ব্যাকরণ ব্যবহার করে তঁাঁর কাজকে তুলে ধরেছেন। নব্য ব্যাকরণ বলতে এখানে একটি নতুন প্রসেস বা প্রক্রিয়াকে ধরা যেতে পারে। এ-ছাড়া অন্য জায়গা থেকে যদি বলা যায়, তিনি যেসব বস্তু এখানে জড়ো করেছেন সেগুলি বিভিন্ন ইতিহাসের অংশ  আমাদের সামনে তুলে ধরে। সেক্ষেত্রে তাঁর কাজ সমসাময়িক ও পরিবেশবান্ধব বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি এক অর্থে পরিবেশ সম্পর্কে চিন্তা করতে আমাদের উদ্দীপিত করেন।

পারসা সানজানা সাজিদ বলেন, সৈয়দ মুহাম্মদ জাকিরের কাজে মেটা আর্টের প্রসেস বর্তমান। তিনি বিভিন্ন ফেলে দেওয়া বস্তু ব্যবহার করে এসব শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন।

তিনি আরো বলেন, এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের মানুষ হিসেবে চিন্তা না করে মহাবিশে^র প্রেক্ষাপটে অন্যান্য অবজেক্ট (বস্তু)-এর মধ্যে আমাদের অবস্থান চিন্তা করতে পারি। মুহাম্মদ জাকির আমাদের সেই ভাবনাটাকে উস্কে দেন।

মোস্তফা জামান বলেন, সৈয়দ মুহাম্মদ জাকির আর্টের বাইরে চলে যেতে চান। তিনি আর্টের (শিল্পের) ব্যাকরণ ভেঙে নতুন ব্যাকরণ তৈরি করতে চান।

তিনি বলেন,  জাকির প্রি-কোলাজ করতে চান। প্রি-কোলাজ হচ্ছে বিভিন্ন বস্তু যোগ করে করে যেটা দাঁড়ায় সেটা। কোলাজে একটি নির্দিষ্ট চিত্র থাকে, কিন্তু প্রি-কোলাজে তেমনটা থাকে না। এটা অনেকটাই প্রসেস ওরিয়েন্টেড (প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল)। এই শিল্পীও অনেকটা প্রসেস ওরিয়েন্টেড। তিনি চিত্র থেকে দূরে।

মোস্তফা জামান আরো বলেন, মুহাম্মদ জাকিরের যে ভাষা নির্মাণ, সেটা মূলত একটি প্রসেস (প্রক্রিয়া) নির্মাণ। জিনিসগুলি (ভাস্কর্যগুলি) অনেক বিচ্ছিন্ন মনে হলেও তিনি গল্পের মধ্য দিয়ে এগুলির মধ্যে একটি ঐক্য তৈরি করতে চাইছেন। 

সৈয়দ মুহাম্মদ জাকিরকে ‘সামাজিক শিল্পী’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, জাকিরের মতো শিল্পীরা মনের কথা বলতে চান না। তাঁরা নিজস্ব একটি ভাষ্য তৈরি করতে চান। তাঁরা এস্টাবলিশড আর্ট থেকে বেরিয়ে আসতে চান, আবার আর্টও করতে চান – মানে একটি দ্বন্দ্ব সবসময়ই কাজ করে। এটাই আসলে নব্য ব্যাকরণ। মানে ব্যাকরণ থেকে বের হয়ে আসাটাই নব্য ব্যাকরণ।

আলোচনা-পরবর্তীকালে সৈয়দ মুহাম্মদ জাকির তাঁর প্রদর্শনী ও শিল্পকর্ম নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তিনি বিবৃত করেন কী চিন্তা ও দর্শন থেকে এমন কাজে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। শিল্পীর কাছে দর্শকদের প্রশ্নোত্তর পালার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে।

বেঙ্গল শিল্পালয়ের লেভেল ৪-এ গত ২২শে জুলাই শুরু হয় সৈয়দ মুহাম্মদ জাকিরের ‘মায়া’ শীর্ষক প্রদর্শনী। তাঁর শিল্পসৃষ্টিতে কোনো পরিকল্পনা নেই, বরং হঠাৎ-পাওয়া উপকরণ বা ভাবনা তাঁকে উদ্দীপিত করে। নগরবাসীর চোখে ‘জঞ্জাল’ – এমনসব ফেলে দেওয়া, কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুর সঙ্গে রেখাচিত্র ও ড্রইংয়ের সমন্বয়ে তিনি নির্মাণ করেন কল্পনা ও বাস্তবতার মিশেলে এক কাল্পনিক শহর – ‘বাঘরেব’। যে শহরের অস্তিত্ব বর্তমান সময়ে নেই, আবার আছেও, কারণ এই শহর হয়তো বর্তমান কোনো শহরেরই দূর-ভবিষ্যতের অবয়ব।

সৈয়দ মুহাম্মদ জাকির আধ্যাত্মিকতা এবং জৈবিক জীবনের ছন্দ মিলিয়ে দেখাতে চান যে, এই বিশ^ব্রহ্মাণ্ডে প্রতিনিয়ত রূপান্তর ঘটে চলেছে, প্রতিটি বস্তুতে, অবস্তুতে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে একধরনের অব্যক্ত আবেশে জড়িয়ে আছে সবকিছু। এর সঙ্গে পরিবেশ-সচেতন শিল্পী তুলে এনেছেন দূর-ভবিষ্যতের শহর। সেখানে সবকিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত, রূপান্তরের কারণে বিপর্যস্ত। এমন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ‘মায়া’ আমাদের এক ধরনের আবেগে মথিত করে।