নিত্যতা নিয়ে ‘নৈমিত্তিক’

শিল্পচর্চার নৈমিত্তিকতাতেই শিল্পী সৃষ্টি করতে পারেন একটি পরিপূর্ণ শিল্পযাত্রা। এই শিল্পযাত্রাই তাঁর শিল্পী পরিচয়কে তুলে ধরে। তাই নৈমিত্তিক যে-চর্চা শিল্পী করেন তা যেন তাঁর গাঁথতে থাকা মালার মুক্তোবিশেষ।

লালমাটিয়ায় অবস্থিত শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে সাতজন শিল্পীর চিত্রকর্ম নিয়ে গত ১৯শে আগস্ট থেকে ২রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আয়োজিত হয়েছিল যূথবদ্ধ এক চিত্র-প্রদর্শনীর, নাম ‘নৈমিত্তিক’। 

শিল্পী তরুণ ঘোষ, অনুকূল চন্দ্র মজুমদার, মাহমুদুর রহমান দিপন, ইমরান হোসেন পিপলু, এ এইচ ঢালী তমাল, সুলেখা চৌধুরী ও ফারজানা রহমান ববি এর আগে ২০২২ সালে ‘মন মন্থন’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। ‘নৈমিত্তিক’ তাঁদের দ্বিতীয় প্রদর্শনী। এই আয়োজনের শিল্পীরা তাঁদের স্বকীয় স্টাইলে নিয়মিত শিল্পচর্চা করে চলেছেন। বয়সের ভিন্নতা এবং প্রকাশের নানান ঢং সত্ত্বেও নিয়মিত শিল্পচর্চা তাঁদের একসঙ্গে প্রদর্শনী উপস্থাপনের করার প্রেরণা জুগিয়েছে।

তরুণ ঘোষের নৈমিত্তিক চিন্তার কাব্যিক প্রকাশ ঘটেছে তাঁর চিত্রকর্মে। কিছুটা আছে কিছুটা নেই, কখনো কখনো কোনো কোনো আকারের অস্পষ্ট উপস্থিতি আর রঙের শান্ত ছন্দময় ব্যবহার চিন্তার খোরাক জোগায়। কাব্যিক এই ছবিগুলি তরুণ ঘোষ এঁকেছেন ক্যানভাস কাগজে তেলরং ব্যবহার করে। শুধু একটি চিত্রকর্ম আছে মিশ্র মাধ্যমে, তাতে তেলরঙের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন প্যাস্টেল এবং কালি।

শিল্পী মাহমুদুর রহমান দীপন অ্যাক্রিলিকে এঁকেছেন প্রতীকনির্ভর ছবি। যা দেখা যাচ্ছে শুধু তাই নয়, এর বাইরেও যেন একটি গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। সুররিয়ালিজমকে বেছে নিয়েছেন শিল্পী তাঁর নৈমিত্তিক চর্চায়। ক্যানভাস ছাড়াও কাগজে এঁকেছেন চারকোল রঙের বিড়াল। বিড়ালগুলিকে মিলিয়েছেন দুঃখের সঙ্গে। বাড়ির বিড়ালগুলি বারবার তাড়িয়ে দিলেও যেমন ফিরে আসে, তেমনি যাপিত জীবনে দুঃখগুলি রয়ে যায়।

শিল্পী অনুকূলচন্দ্র মজুমদার তাঁর নিজস্ব ঢংয়ে নদী, আকাশ, মা ও সন্তানের মমতা, পারস্পরিকতাসহ নানা বিষয় ফুটিয়ে তুলেছেন চারকোল মাধ্যমে আঁকা ছবিগুলিতে। যখন শিল্পীর তৈরি করা আবহে দর্শকের ভাবনা গতি পায়, তখনই চমৎকার স্পেসের ব্যবহার সেই ভাবনাগুলিকে গল্পের মতো গাঁথার অবকাশ দেয়। সব মিলিয়ে চিত্রকর্মগুলি অত্যন্ত উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

এই প্রদর্শনীতে ইমরান হোসেন পিপলুর থাকা শিল্পকর্ম দুটি ক্যানভাসে আঁকা ড্রয়িং। ‘লাক্সারি ইন লকডাউন’ নামে চিত্রগুলি বারবার মনে করিয়ে দেয়, বারবার কোভিড অতিমারিকালে ক্ষুদ্র গণ্ডিতে মানুষ বেঁচে ছিল নিজের মতো করে। নানা আশঙ্কার মাঝেও যেন এক প্রকার প্রশান্তি ছিল স্থিরতায়। তারই চিত্র প্রকাশের জন্য শিল্পী বেছে নিয়েছেন শিল্পচর্চার নৈমিত্তিক কৌশল পেনসিল ড্রয়িং।

শিল্পী এ এইচ তমাল তাঁর শিল্পচর্চায় নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পছন্দ করেন। চারকোলে আঁকা প্রকৃতির ছবি অথবা নানান টেক্সচার তৈরি করে আঁকা ছাপচিত্রগুলোতে তাঁর নিয়মিত চর্চাকে প্রকাশ করেছেন এই প্রদর্শনীতে থাকা চিত্রগুলোতে।

প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচার ডাক দিয়েছেন শিল্পী সুলেখা চৌধুরী। সবুজ রঙের ব্যবহারে ক্যানভাসে আঁকা ছবিগুলিতে নিজেকে প্রকৃতির মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার বক্তব্যই প্রধান হয়ে ওঠে। তাতেই যেন মুক্তির পথ লেখা আছে। সাদা কাগজে কালো কালির ড্রয়িংয়ে শিল্পী তাঁর যাপিত জীবনকে তুলে ধরেছেন, যেখানে কখনো তাঁর নারীসত্তার আকুতি, কখনো পশু হত্যার প্রতিবাদ, কখনো প্রকৃতিতে মিলিয়ে যাওয়ার আহ্বান প্রকাশ পেয়েছে।

প্রকৃতি ও শিকড়ের গল্প বলেছেন শিল্পী ফারজানা রহমান ববি। তাঁর মিশ্রমাধ্যমের চিত্রগুলিতে কাগজের ওপর ছাপ, চারকোল, জল, রং-পেনসিল ইত্যাদির ব্যবহার দেখা যায়। রঙের সাবলীল ব্যবহার ও রেখার মাধুর্যে শিল্পী তাঁর শিকড় খোঁজার নিত্যচর্চার দৃষ্টিনন্দন চিত্রসমূহ উপস্থাপন করেছেন প্রদর্শিত চিত্রগুলোতে।

‘নৈমিত্তিক’-এ শিল্পীদের নিত্যচিন্তাগুলো তাঁদের শৈল্পিকতায় মিশে নতুন মাত্রা পেয়েছে, তৈরি করেছে অনিন্দ্য চিত্ররূপ। নিয়মিত চর্চার মধ্য দিয়ে নিজের চিন্তা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীদের নানা ধরনের চিত্রকর্ম একসঙ্গে বেশকিছু শৈল্পিক রীতি এবং দর্শনের সঙ্গে সংযোগ ঘটার উপায় তৈরি করে দেয়।