আতিয়া ইসলামের ‘বয়ান’

এক

ষাটের দশকের প্রথমে জন্ম, তারপর আশির দশকে শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করে যাঁর শিল্পচর্চার শুরু, তাঁকে শিল্পী হিসেবে বেশ বয়োজ্যেষ্ঠই বলতে হয়। আতিয়া ইসলাম এ্যানি সেই বিবেচনায় একক শিল্প-প্রদর্শনী করেছেন কম, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে এ-বছরের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীটি তাঁর তৃতীয় একক।

বিরলপ্রজ তিনি নন, নিরলসভাবে চর্চিত তাঁর শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে দেশে-বিদেশে মাঝারি আর বড়মাপের প্রদর্শনীতে ১৯৭৭ থেকে ২০২৩ সালের সময়কালে। একক প্রদর্শনীর সংখ্যার স্বল্পতার প্রধান কারণ হয়তো এই যে, তিনি মাঝে মাঝে একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে ভাবেন এবং সেই বিষয়ের ওপর তাঁর শিল্পচিন্তা সম্প্রসারণের পর যথেষ্ট সংখ্যায় ক্যানভাসে প্রতিফলিত হলে উপলব্ধি হয় যে, বিষয়টি তিনি যেভাবে দেখেছেন এবং ভেবেছেন, সবার সামনে সেই ব্যাখ্যা নিয়ে উপস্থিত হওয়া যায়। বেশ যুক্তি আছে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, শিল্পী হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচায়কও এই কৌশল নিঃসন্দেহে। এমন বিশ্বাস ও বোধ নিয়ে যে-শিল্পী কাজ করেন তাঁর প্রতিটি একক প্রদর্শনী হয়ে ওঠে সম সময়ের দলিল, অভিজ্ঞ উপলব্ধির বলিষ্ঠ উচ্চারণ।

আতিয়া ইসলামের প্রথম একক শিল্প-প্রদর্শনীর বিষয় ছিল নারী ও সমাজ, যেখানে তিনি সমাজে নারীর অবস্থান দেখিয়েছেন রঙে ও রেখায়। দেশে-বিদেশে প্রায় প্রত্যেক নারী শিল্পীই এই প্রাণবন্ত বিষয় নিয়ে লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং এখনো যে শিল্পকর্মে বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করছে তার দ্বারা বোঝা যায় যে, নারীবাদী আন্দোলনের তিনটি ‘ঢেউ’ অতিক্রান্ত হলেও সমাজে নারীর বৈষম্যমূলক অবস্থানের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এই বাস্তবতা সত্ত্বেও আতিয়া ইসলাম বিষয়গতভাবে নিজের পুনরাবৃত্তি না করে তাঁর দ্বিতীয় একক প্রদর্শনীর ‘কালবেলা’ নাম দিয়ে বড় পরিসরে সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটের গভীরে নিয়ে গিয়েছেন তাঁর শিল্পকর্ম। একই দৃষ্টিভঙ্গির অনুসরণে তিনি তাঁর তৃতীয় একক প্রদর্শনীর বিষয় করেছেন ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ – সমকালের জীবন যাপন, যার মধ্যে রাজনীতি, অর্থনীতির অনুষঙ্গ থাকলেও প্রাধান্য পেয়েছে জীবনযাপনের সংস্কৃতি।

দুই

সমকালের সমাজ ও জীবন নিয়ে শিল্পচর্চার ঐতিহ্য অনেক পুরনো, বিষয় হিসেবে এখানে নতুনত্ব নেই। কিন্তু ‘সমকাল’ পরিবর্তনশীল এবং একই দৃশ্য বা ঘটনা মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তার মাধ্যমে চিহ্নিত হয় শিল্পীদের মধ্যে পার্থক্য। এই অর্থে ‘সমকাল’ শিল্পী-সাহিত্যিকের কাছে নিরবচ্ছিন্নভাবে আগ্রহ এবং পর্যালোচনার বিষয় হয়েই থাকবে। আতিয়া ইসলামের ‘সমকালের বয়ান’ তাঁর নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, বিশেষ করে প্রতিক্রিয়ার ফল। এর সঙ্গে অন্যের (শিল্পীর, দর্শকের) মিল থাকতে পারে, নাও পারে। কিন্তু যেখানে আতিয়া সমকালের বিভিন্ন ইস্যুর ওপর মন্তব্যে পৃথক এবং অনন্য হতে পারেন, তা হলো তাঁর প্রকাশভঙ্গিতে। বিষয় যেখানে সবার জন্য অভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা, সেক্ষেত্রে নিজস্ব পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার একমাত্র উপায় যে আঙ্গিক এবং কলাকৌশল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্তিম বিচারে তাই আতিয়া ইসলামের তৃতীয় একক প্রদর্শনীর সফলতা নির্ভর করছে বিষয়ের ওপর যতটা না, তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁর ছবির কম্পোজিশনে, ফর্মে এবং রঙের বিন্যাসে, অর্থাৎ প্রকাশভঙ্গিতে। এই তিনটিই যে-কোনো চিত্রকর্মের বিচারে মৌলিক মানদণ্ড, আতিয়া ইসলামের ‘সমকালের বয়ান’ শীর্ষক ছবিগুলির বিচারে এরাই প্রাধান্য পাবে অনিবার্যভাবে।

‘সমকাল’ এই মূল বিষয়কে কয়েকটি দৃশ্যে বিভক্ত করে আতিয়া উপস্থাপিত করেছেন তাঁর ছবিতে। ছবিগুলির শিরোনামের ভিত্তিতে এই বিভক্ত বিষয়গুলির বর্ণনা হতে পারে : (ক) প্রাত্যহিকের অভিজ্ঞতা, (খ) স্বার্থপরতা, (গ) আধুনিকতা বনাম রক্ষণশীলতা, (ঘ) মুক্তি, (ঙ) রোমান্টিসিজম, (চ) প্রতিবাদ, (ছ) রাজনীতির খেলা, (জ) প্রতিবাদ, (ঝ) কনজিউমার কালচার, (ঞ) সন্ত্রাস।

প্রথম শ্রেণির ছবি দুটির শিরোনাম ‘সুপ্রভাত’, যেখানে দেখা যাচ্ছে খুন-খারাবি এবং গুম হয়ে যাওয়া মানুষের খণ্ডিত,
চাদর-ঢাকা দেহ এবং প্রাতরাশের খাদ্য ও পানীয়। এখন দিনের শুরু হয় এই সব খবর দিয়ে, যা ক্রমেই বাসি এবং আটপৌরে হয়ে গিয়েছে, একথাই বলতে চেয়েছেন আতিয়া। তাঁর এই প্রতিক্রিয়ায় হতাশা আছে, সেই সঙ্গে ক্রোধ এবং বিবমিষা। যে ছবিতে এই বক্তব্য তার ফর্মের কম্পোজিশনে নাটকীয়তা যেমন আছে, তার চেয়ে বেশি আছে সামঞ্জস্যময়তা। ওপরে দেখানো হয়েছে জীবিত মানুষ যারা প্রাতরাশে ব্যস্ত, তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন হাত। এই সব হাত শুধু সুবিন্যস্ত নয়, তাদের নির্বিকার এবং বেশ পরিতৃপ্ত মনে হয়। নিচেই রয়েছে আততায়ীর হাতে নিহতদের মৃতদেহ, যাদের খবর জীবিতরা পেয়েও নির্বিকার হয়ে দৈনন্দিন জীবন যাপনে ব্যস্ত। ছবির দুটি অংশের মধ্যে যোগসূত্র মিনারেল ওয়াটারের একটি বোতল, যেটি জীবিতদের জন্য ভর্ৎসনার মতো স্থির হয়ে আছে। সমকালে দৈনন্দিন জীবনের নৈরাজ্যের প্রতি মানুষের নির্বিকার ঔদাসীন্য এর চেয়ে মোক্ষমভাবে দেখানো যায় না। এটা করতে গিয়ে আতিয়া ইসলাম ব্যবহার করেছেন ফর্ম আর কম্পোজিশনের শিল্পিত সমন্বয়। একই শিরোনামের দ্বিতীয় ছবিতে তিনি ফর্মের ভূমিকা অপরিবর্তিত রেখে তাদের অবস্থান উল্টে দিয়েছেন একই সুচারু সামঞ্জস্যময়তায়। ছবি দুটির ভূমিকা একই সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন এবং প্রচ্ছন্ন বিদ্রƒপ, যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়েছে পটভূমিতে নীল আর লাল ফ্ল্যাট রঙের ব্যবহারে। জীবিতদের হাত সাদা আর মৃতদের রক্তাক্ত দেখিয়ে যে-বৈপরীত্য আনা হয়েছে সেখানে মুনশিয়ানা আছে। সমকালের একটি পৌনঃপুনিক অভিজ্ঞতার নিরাবেগ পরিবেশনায় যে মৌলিকতা এবং শিল্পিত দক্ষতা তার জন্য শিল্পী প্রশংসার দাবিদার। দ্বিতীয় সিরিজের (খ) ছবির শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘বঞ্চিতের কথা’ যেখানে দুটি ছবিতে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির পাশেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তির খাদ্যের অপচয় দেখানো হয়েছে ফলের অভুক্ত অংশ ইতস্তত পড়ে থাকার দৃশ্যে। মুণ্ডুহীন ফিগার এবং অর্ধভুক্ত কলা ও আপেলের ফর্মগুলির কম্পোজিশন বক্তব্যের পরিবেশনায় এর চেয়ে ভালো হতে পারতো না। এই দুটি ছবির কালার স্কিম আগের দুটির মতোই ফ্ল্যাট যার জন্য গ্রাফিক্স অথবা বিজ্ঞাপনের সরলতা এবং প্রত্যক্ষতা সৃষ্টি হয়েছে। এই অভিব্যক্তি আরো দৃঢ় হয়েছে কম্পোজিশনের
দ্বি-মাত্রিকতায়। তৃতীয় সিরিজের (এই লেখায়) ছবির শিরোনাম (শিল্পীর) দেওয়া হয়েছে Hindrance – অন্তরায়। এখানে শিল্পী মনে হয় বলতে চেয়েছেন আধুনিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা মেয়েদের নাগালের ভেতর এসে গিয়েছে, কিন্তু অন্তরায় রক্ষণশীলতা এবং পুরুষতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ, যার বিশ্বজনীন প্রতীক হয়ে গিয়েছে বোরখা, তা সে ঘরেই হোক অথবা বাইরে। কেউ এই প্রতীকের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলে তা অন্যের কাছে বোধগম্য হবে না, কেননা সর্বদাই ব্যতিক্রম দিয়েই নিয়মের প্রমাণ দেওয়া হয়ে থাকে। আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে একটি ছবিতে বার্গার এবং অন্যটিতে ড্রেস করা চিকেন। এখানেও আতিয়া তাঁর বয়ান প্রকাশের জন্য ফর্মের বিন্যাসে এবং সার্বিক কম্পোজিশন নির্ধারণে নির্ভুলভাবে কার্যকর। দ্বিমাত্রিকতা এই ছবি দুটিতে আগের ছবির মতো গ্রাফিক্সের প্রত্যক্ষতা প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফিগারগুলির অবস্থানে এবং তাদের চাউনির যে ভিন্নতা তার জন্য কিছুটা প্রাণবন্ত মনে হয় পর্দানশীন নারীদের। এমনও মনে হতে পারে যে, তারা যেন অভ্যস্ত এই বাধা পেয়ে নিয়ন্ত্রিত জীবনে এবং এর জন্য তাদের মনে ক্ষোভ বা অসন্তুষ্টি নেই। মুক্তমনের এই পরাজয় বা স্বয়ংক্রিয়তাকে সামাজিক মন্তব্যের বিষয় করেছেন শিল্পী – এমন উপসংহারে আসা যেতে পারে। এই ছবি দুটিতেও পটভূমির রঙে (ফিকে সবুজ আর হালকা নীল) ঘনত্বের বৈচিত্র্য নেই, যা ছবিতে গ্রাফিক্সের প্রত্যক্ষতা আরোপ করেছে। নারীদের পোশাকে অবশ্য একই রঙের গভীরতায় হেরফের বাস্তবতার মাত্রা যোগ করেছে।

‘ঘ’ সিরিজের ছবি দুটির ভিন্ন শিরোনাম দিয়েছেন আতিয়া; কিন্তু এক ক্ষেত্রে মিলের জন্য তাদের ‘মুক্তি’ শিরোনামই যেন অধিক প্রযোজ্য। প্রথম ছবিতে মুক্তি এসেছে নারীর আত্মনির্ভরশীলতায়, দ্বিতীয়টিতে ভালবাসার মধুর বন্ধনে। প্রথমটিতে মুক্তির মোটিফ হিসেবে ধরা যায় মেয়েটির মাথার মোটরসাইকেল হেলমেট, দ্বিতীয়টিতে এই প্রতীকের কাজ করছে প্রেমের লাল গোলাপ। দুটি ছবিতেই ফ্রেমে বাঁধাই করা ক্যানভাসের উল্টো দিক দেখিয়ে শিল্পী যেন বলতে চাইছেন – যা দেখা যায় তাই বাস্তবতার সব নয়। আপাতদুরূহ বলে যা মনে হয় সেখানেও আছে সমাধান। আগের ছবিগুলির মতো একই ফলশ্রুতি নিয়ে এখানে কম্পোজিশন দ্বি-মাত্রিক। তবে আগের ছবিগুলির মতো এই ছবি দুটিতে স্পেস ছেড়ে দেওয়া হয়নি, ফর্মগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত অথবা ওপর প্রতিস্থাপিত। এর ফলে দ্বি-মাত্রিক হয়েও কম্পোজিশনে
ত্রি-মাত্রিকতার দ্যোতনা সৃষ্টি হয়েছে। রঙের ব্যবহারে শিল্পী এই ছবি দুটিতে সরলতা (ফ্ল্যাট) থেকে একটু বেরিয়ে এসে চতুরতার (প্রথম ছবিতে হেলমেটের নিচে মুখে, ওড়নায় এবং দ্বিতীয়টিতে ওপরে পুরুষের দেহে) আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশে মুক্তির সম্ভাবনার ইঙ্গিত এভাবে দিয়েছেন আতিয়া ছবি দুটিতে।

সমকালে পরিবেশে যা দেখছেন সবই নিরানন্দ, হতাশা অথবা বিভীষিকার সঞ্চার করে না শিল্পীর মনে। সর্বব্যাপী অন্ধকারেও তাঁর জন্য রয়েছে আনন্দময় অনুভূতির আলোর ছটা। পাখির চোখে তিনি দেখতে পান প্রকৃতির ফুল, লতা-পাতা, যা তাঁকে নিয়ে যায় জীবনানন্দের অপাপবিদ্ধ ভুবনে (Inspiration of Jibonanondo) অথবা ভালোবাসার হালকা পরিহাস ক্রিয়ায় (wings of love)। প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয় ছবিতে কম্পোজিশন জটিল কিন্তু দ্বি-মাত্রিকতা এবং পটভূমির রঙের সরলতার জন্য বক্তব্য এই ছবি দুটিতেও প্রত্যক্ষ এবং জোরালো। প্যালেস্টাইনের গাজায় সংঘটিত অমানবিকতা এবং কনজিউমার কালচারের প্রভুত্ব (‘চ’ সিরিজ) আতিয়ার মনে সৃষ্টি করেছে যথাক্রমে প্রতিবাদ এবং ঘৃণা। দুটি ছবিতেই পিস্তলের মোটিফ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থেকে বি-মানবীকরণের প্রক্রিয়ার প্রতীক। গ্রেনেড আর ফাস্ট ফুড মোটিফ হিসেবে দুটি স্থানেই কার্যকর। প্রথম ছবিতে রঙের বিন্যাসে জটিলতার পাশাপাশি দ্বিতীয়টিতে রঙের কুশলী ব্যবহার ছবির বক্তব্য স্পষ্ট করে তুলেছে।

কনজিউমার কালচারে অভ্যস্ত দুই নারীর পোশাক বিদেশিদের মতো করে দেখিয়ে আতিয়া এর মাধ্যমে নব্য-উপনবেশবাদের আগ্রাসনের কথা বলেছেন (‘জ’ সিরিজ)। তিনি insects.com শিরোনামে দুটি এবং contemporary life শিরোনামে একটি ছবিতে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী সংস্কৃতির প্রভাবে কীভাবে জীবনযাপন বদলে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে, তা দেখানোর পর সেই ভোগবাদী জীবনের অন্তঃসারশূন্যতার ওপর আলোকপাত করেছেন। ক্যানভাসের উল্টো দিকে তেলাপোকা এবং পিঁপড়ার মোটিফ যে নিছক ডিজাইন নয়, অসুস্থতা সংক্রমণের বাস্তবতা, তা দেখানোর জন্য একটি তেলাপোকা এবং একটি পিঁপড়াকে তিনি জীবন্ত করে দেখিয়েছেন। ফর্মগুলি নিয়ে কম্পোজিশন এই ছবিতে বক্তব্য প্রকাশে বেশ সফল। রঙের ব্যবহার একই সঙ্গে বৈপরীত্য এবং পরিপূরক হওয়ার দাবি মিটিয়েছে। Looking back (‘ছ’ সিরিজ) শিরোনামে শিল্পী রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন করেছেন দাবার ছকে ঘুঁটি হিসেবে মানুষের ব্যবহার দেখিয়ে এবং আক্ষরিকভাবেই মুখোশ এঁকে। ছবি দুটির ফর্মে জটিলতা নেই, কম্পোজিশন খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে বক্তব্যের পরিবেশনে সফল। রঙের ব্যবহার সরল এবং মিতব্যয়ী। ‘ঝ’ সিরিজের ছবিটিতে (know thyself) চারটি ফর্ম এবং দুটি মোটিফ শনাক্ত করা যায়। কম্পোজিশনের সার্বিক অবয়বের সঙ্গে ফর্মগুলির সংগতি খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন, যেমন সহজ নয় তাদের একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক, যার জন্য সঙ্গে সঙ্গে শিরোনামের বিষয়ের যথার্থতার উপলব্ধি হয় না। মনে হয়, এই ছবির কম্পোজিশনে শিল্পীর কয়েকটি বক্তব্য একাকার হয়ে গিয়েছে, যার উপলব্ধি সহজসাধ্য নয়।

আতিয়া ইসলামের ছবি বর্ণনাপ্রধান নয়, বক্তব্যপ্রধান। ‘সমকালের বয়ান’ বিষয়ক চিত্র-প্রদর্শনীতে তিনি যে মন্তব্য করেছেন এবং যে বক্তব্য রেখেছেন তা একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব। এই বয়ানের জন্য নির্বাচিত বিষয়গুলি প্রাত্যহিকের অভিজ্ঞতা হওয়ার জন্য তাদের প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত। তার চেয়েও যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হলো, তাঁর প্রকাশভঙ্গির অনন্যতা। বিশেষ ফর্ম আর মোটিফ দিয়ে তৈরি হয়েছে যে কম্পোজিশন, সেই সার্বিক রূপাভাসে ব্যক্ত হয়েছে সমকালের ওপর তাঁর নিজস্ব বয়ান। বিষয় নয়, বয়ানই এখানে উদ্দীষ্ট। বিষয় এসেছে বয়ানের (আধেয়ের) পরিপূরক বা আধার হয়ে, যদিও একটি ছাড়া অন্যটির কথা ভাবা যায় না। সমকালের ঘটনা এবং দৃশ্য দেখে অনেকেই প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে; কিন্তু কীভাবে, কোন রূপে বা ভাষায় সেই প্রতিক্রিয়া জানানো যায় সেখানে ভিন্নতা আছে বিস্তর। আতিয়া যেভাবে নিজের মতো করে সমকালকে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে দেখে অনুভূতির প্রকাশ করেছেন সেটি তাঁর একান্ত নিজস্ব, অনন্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাঁর এই প্রকাশের ভাষা হয়েছে ফর্ম, মোটিফ, রঙের বিন্যাস নিয়ে তৈরি প্রতিটি ছবির কম্পোজিশন। সমকালের বয়ানের ভাষা নির্মাণে তিনি সফল, একথা বলা যায় একটি ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ছাড়া, যার উল্লেখ করা হয়েছে। সমকালের যে চালচিত্র আতিয়া তুলে ধরেছেন দৃষ্টান্ত হিসেবে সেসব ন্যারেটিভে পুরুষের তুলনায় নারী চরিত্রই বেশি, যার কারণ হয়তো এই নয় যে, শিল্পী একজন নারী। মনে হয়, আতিয়ার উপলব্ধিতে সমকালে যাদের বিসদৃশ, অসামাজিক এবং মনোবিকারজনিত আচরণে অভ্যস্ত হতে হয়েছে আর্থ-সামাজিক কারণে তাদের অধিকাংশ নারী। এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য শিল্পীকে নারীবাদী হতে হবে, এমন বক্তব্যে পক্ষপাত থাকতে পারে।

তিন

বর্তমানের শিল্পকর্ম কেবল শিল্পকলার নিজস্ব এস্থেটিক্স দিয়ে বোঝা যায় না। এর সম্যক উপলব্ধির জন্য ব্যবহার করতে হয় কালচারাল স্টাডিজের বিভিন্ন বিষয় – ফেমিনিজম, বর্ণবাদ, মার্কসবাদ, নব্য ইতিহাসবাদ, রাজনীতি ইত্যাদি। শুধু এর একটি দিয়ে কোনো শিল্পকর্ম ব্যাখ্যা করার চেষ্টা অনেকটা অন্ধের হাতি দেখার মতো। আতিয়া যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এবং আঙ্গিক ব্যবহার করে ছবি আঁকেন, সেসব তাঁকে উত্তর-আধুনিক শিল্পচর্চায় নিয়ে গিয়েছে প্রথম থেকেই। তাঁর ছবি বুঝতে হলে দর্শককে শিল্পকলার যে বৃহত্তর প্রেক্ষাপট কালচারাল স্টাডিজ, সে-সম্বন্ধে অবহিত হতে হবে। এই শর্ত শতকরা কতভাগ দর্শক পূরণ করতে পারবে, সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মনে হয় না তাদের সংখ্যা এমন যার ভিত্তিতে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, তারা আতিয়া ইসলামের ছবি দেখেই বুঝতে পারবে। তা হলে কি আতিয়ার মতো শিল্পীদের সময়ের চেয়ে অগ্রগামী না হয়ে স্থির হয়ে থাকতে হবে, অথবা পিছিয়ে আসতে হবে দর্শকের রুচি এবং উপলব্ধির সঙ্গে সংগতি রেখে? অবশ্যই না। আধুনিক থেকে উত্তর-আধুনিক শিল্পীরা সামনের দিকেই রেখেছেন তাঁদের চোখ, যেজন্য শিল্পকলার চর্চা এমন বেগবান এবং প্রাণবন্ত। তাঁদের এবং দর্শকদের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে হবে সমালোচকদের। এই দায়িত্ব তাঁদের ওপরই বর্তায়। প্রশ্ন হলো : তারা এই প্রসঙ্গে কতটা সচেতন এবং এ পর্যন্ত কী করতে পেরেছেন? এরই অনুষঙ্গে যে-প্রশ্ন এসে যায় তা হলো, সমালোচকরা কি শিল্পীর মতো একই বোধ ও মননের অধিকারী? যদি তা না হয় অগ্রগামী শিল্পীর কাছে তিনি কি বলতে চেয়েছেন তা জেনে নিয়ে তাঁর শিল্পবিচার করা হলে বিব্রতকর বা অশোভন কিছু নেই। অতীতে যত নতুন ধারার শিল্পচর্চা হয়েছে তার পুরোধায় শিল্পীরাই ছিলেন, সমালোচকরা নন।