সাদত হাসান মান্টো মানব হৃদয়ের ভবিষ্যদ্বক্তা

ইংরেজি থেকে অনুবাদ : দিলওয়ার হাসান

[কৃষণ চন্দর ও সাদত হাসান মান্টো ছিলেন একজন আরেকজনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁরা একসঙ্গে বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন ভারতের ‘আকাশবাণী’ রেডিওতে। তারপর দুজন কর্মক্ষেত্রে ভিন্ন পথে হাঁটলেও তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল অটুট।

সাদত হাসান মান্টো ১৯১২ সালের ১১ই মে পাঞ্জাব প্রদেশের লুধিয়ানার পাপরউদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন কাশ্মিরী বংশোদ্ভূত। তিনি ছিলেন উর্দু সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ-লেখক। সমসাময়িক সমাজের ক্লেদ, অন্ধকারময়তা, নীচতা হাস্য-পরিহাসের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের আলোতে অকপটে তুলে ধরেছেন মান্টো। তাঁর লেখায় যৌনতার অবাধ বয়ানের জন্য তাঁকে ‘অশ্লীলতা’র অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু সেসব বাধা নিরস্ত করতে পারেনি সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এই সাহিত্যিককে।

ছোটগল্প লেখায় সিদ্ধহস্ত মান্টো চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, নাটক, অনুবাদসহ সাহিত্য-সংস্কৃতির বিচিত্র শাখায় বিচরণ করেছেন স্বচ্ছন্দে। তবে এত লেখালেখি করেও তিনি তাঁর যোগ্য সম্মানী পাননি বলে জানা যায় বিভিন্নজনের ও তাঁর নিজের লেখা থেকে। তাই শেষ পর্যন্ত অভাব-অনটনেই কেটেছে মান্টোর জীবন।

উপমহাদেশের এই প্রতিভাবান ও পাঠকনন্দিত লেখক সাদত হাসান মান্টো লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে ১৯৫৫ সালের ১৮ই জানুয়ারি লাহোরে মারা যান।]

দীর্ঘদেহী, একটুখানি ঝুঁকে হাঁটে। ফর্সা গায়ের রং। হাতের উল্টোদিকের রগগুলি স্পষ্ট। কণ্ঠমণি বেশ উঁচু। ল্যাগবেগে দুটি পা, তবে বিদ্ঘুটে নয়। বিরক্তিতে সব সময় কপাল কুঁচকে থাকে। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। কণ্ঠস্বরে উদ্বেগের আভাস। লেখালেখির ব্যাপারে ছটফটে। আচার-আচরণে তিক্ততা লক্ষ করা যায়। চলাফেরায় চটপটে। প্রথম যখন তার সঙ্গে দেখা, তার

আচার-আচরণে এসবই খুব স্পষ্ট। তবে শিগগিরই প্রথম দেখার ধারণাটা কেটে যায়। তার কপালটা ছিল ভারি সুন্দর, তার বুদ্ধিমত্তার মতোই। আমরা সাধারণত পশ্চিমা শিল্পীদের আঁকা শয়তানের চেহারার সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত কোনো মানুষের কপালের সাদৃশ্য খুঁজে পাই। শারীরিক গঠনের এই মিল সত্যিই কৌতূহলোদ্দীপক।* তবে মান্টোর কপালখানা কিন্তু দেখতে শয়তানদের কপালের মতো নয়। ওটা আয়তাকার। সিনেমার পর্দার মতো এর নিম্নভাগ সরু আর ওপরের দিক প্রশস্ত। তার চুল লম্বা, সোজা ও ঘন। তার চোখে আছে অদ্ভুত ও সূক্ষ্ম একটি ঝলক। তার প্রজ্ঞার রয়েছে বিশেষ গুণ, যার জন্ম-মৃত্যুর নিকট স্পর্শে। তার জীবনের এই বিশেষ দিকটির ব্যাপারে তাকে কখনো আমি জিজ্ঞেস করিনি। তবে অন্যদের কাছে শুনেছি, সে যক্ষ্মা বা এ-ধরনের কোনো প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়েছিল।… যাই হোক, তার আয়ত, আবেগমথিত আর হকচকিত চোখের তীব্র বেদনা এই সাক্ষ্য দেয় যে, জীবনের চূড়ান্ত অভিজ্ঞতার অনেক বাইরে ছিল তার পথচলা। এই দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চে ফিরে আসার আগে সে মৃত্যুর মতো একটা রাজ্যের ভেতরে বসবাস করেছিল। এটা অসম্ভব নয় যে, তার ওই দুর্ভোগ কোনো প্রেমের ঘটনা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল; কোনো অসুখ-বিসুখের ব্যাপার সেখানে ছিল না। তবেধ প্রেমের বিষয়টাকেও প্রায়শ একটা অসুস্থতা বলে গণ্য করা হয়। ঘটনা যা-ই হোক না কেন, ওই অভিজ্ঞতা মান্টোর জন্যে নিশ্চিতভাবেই কোনো ক্ষতিকর বিষয় ছিল না। সে হয়তো শেষাবধি পুড়ে পুড়ে নিখাদ সোনা বা খাঁটি একজন মানুষে পরিণত হয়েছিল।

জওয়াহেরলাল নেহরু বা ইকবালের মতো মান্টোও ছিল একজন কাশ্মিরি। বহুদিন আগে তাদের পরিবার অমৃতসরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। তার বড় দুই ভাই ভারত ছেড়ে বিদেশে অভিবাসন গ্রহণ করেন। তাঁদের একজন কেনিয়ায় ব্যারিস্টারি করতেন। তিনি কেনিয়ার আইন পরিষদের একজন সদস্যও ছিলেন। মান্টোর ভাইয়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তাঁকে আমার মনে হয়েছিল একজন ধার্মিক ও আদর্শবান মানুষ। তিনি একজন পরহেজগার মুসলমানও ছিলেন। মান্টোর সবকিছু ছিল তার ভাইদের থেকে আলাদা। তার পূর্বপুরুষের কথা যদি ওঠে, তাহলে বলতে হয় – তাঁদের জন্যে মান্টোর ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকলেও ভালোবাসা ছিল না। আচার-ব্যবহার, আচরণ,  দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি বিবেচনায় ভাইদের সঙ্গে তার এমন এক অনতিক্রমণীয় মতানৈক্য ছিল যে, খুব কম বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মান্টো নিজের জন্যে একটা ভিন্ন জীবন বেছে নিয়েছিল। আলিগড়, লাহোর, অমৃতসর, বোম্বে আর দিল্লি কত রূপেই না মান্টোকে দেখেছে : রুশ সাহিত্যের ভক্ত; চীনা সাহিত্যের সমঝদার; বিদ্বেষ আর বেদনার শিকার মান্টো; প্রশংসা না-পাওয়া মান্টো; কুৎসা আর বদনামের ভাগীদার মান্টো; কুখ্যাত এস্টাবলিস্টমেন্টদের ভীতি মান্টো; মদাসক্ত আর বেশ্যালয়ে গমনকারী মান্টো; গৃহবাসী মান্টো; বন্ধুদের সদা সাহায্যে প্রস্তুত মান্টো; উর্দু সাহিত্যের সবচেয়ে খ্যাতিমান লেখক মান্টো। এই তার প্রজ্ঞার রয়েছে সেই বিশেষ গুণ, যার জন্য মৃত্যুর নিকট স্পর্শে। এই শহরগুলো মান্টোর জীবনের নানান ছায়া দেখেছে। এগুলির সঙ্গে সে নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে ছিল। জীবনকে খুব কাছে থেকে দেখার জন্যে নিজেকে মোমের বাতির মতো জ¦ালিয়ে-পুড়িয়ে নিঃশেষ করেছিল সে।

মান্টো উর্দু সাহিত্যের শিবের মতো, যে নিজ হাতে জীবনের হলাহল প্রস্তুত করে আকণ্ঠ পান করেছিল। তার মানে, মান্টো এই হলাহলের নানা স্তর ছেনে তাঁর লেখায় প্রকাশ করেছিল। মানুষ প্রায়শই ভয়ে এসব থেকে দূরে সরে থাকত। মান্টোর লেখা তারা গ্রহণ করতে পারত না। কিন্তু কখনোই তারা তাঁর লেখা ও পর্যবেক্ষণে ফুটে ওঠা বিচক্ষণতা ও অন্তর্দৃষ্টি অস্বীকার করতে পারত না। বিষের তীব্রতায় নীল হয়ে উঠত শিবের গলা, আর মান্টো এই বিষের কারণে হারিয়েছিলেন সুস্বাস্থ্য। তার জীবন এখন সম্পূর্ণরূপে ওষুধ আর ইনজেকশন নির্ভর হয়ে উঠেছে। তবে এ-কথাও ঠিক যে, মান্টোর মতো আর কারো পক্ষে এই হলাহল পান ও তা হজম করে ফেলা সম্ভব ছিল না। এই অবস্থায় অন্য যে কেউ পাগল হয়ে যেত। মান্টোর তেজ, সহ্য ক্ষমতা আর মেজাজ এমনই ছিল যে, সবকিছু অনায়াসে শুষে নিতে পেরেছে, ঠিক যেন সেই কঠোর সংযমী যোগী যারা ভাংয়ের নেশা দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে মারাত্মক মাদকের প্রতি আসক্ত হয়। একসময় জিভে বিষাক্ত সাপের ছোবল গ্রহণের মাধ্যমে নেশা করে।

মান্টোর তীক্ষè ও ধারাল লেখা আর তার কঠিন সত্য প্রকাশের জিহ্বা এটাই প্রমাণ করে যে, সে তার কঠোর সাধনার চূড়ায় আরোহণ করেছিল। তার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই মান্টোর গল্প আমি পড়েছি। তার গল্পের ভাষা, প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়ন এত অদ্ভুত আর চোখা যে, অনায়াসে সবার মন জয় করে নেয়। আমি সম্ভবত তখন মুসাব্বির পত্রিকায় প্রকাশিত তার গল্প ‘শু-শু’, ‘খুশিয়া’ আর ‘দিওয়ালি কি দিয়ে’ পড়েছিলাম। গল্পগুলি যে আমার ভালো লেগেছে, তা জানিয়ে একটা চিঠিও লিখেছিলাম তাকে। সে-সময় মান্টো বোম্বেতে থাকত। তখন সে সাপ্তাহিক মুসাব্বির-এর সম্পাদক এবং কীচাদ নামে একটা চলচ্চিত্রের গল্প ও সংলাপ লেখার কাজে ব্যস্ত ছিল। প্রেমচাঁদের পরেই মান্টো সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ করেছিল। তবে এটা বলা হয়তো সঠিক হবে না যে, চলচ্চিত্রজগতে প্রথমে কিছুটা বিচরণ করে সে সাহিত্যে খ্যাতি অর্জন করেছে। মান্টোই সম্ভবত একমাত্র লেখক যে চলচ্চিত্র থেকে সাহিত্যের পথে এসেছিল। খ্যাতির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে আবার চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ করেছিল। বস্তুত তার সবকিছুই ছিল পরম বিস্ময়ের।

ওপরে যে-গল্পগুলির কথা বলেছি সেগুলি পড়া শেষ করে আমি তার ‘লালতেন’ গল্পটা পড়ি। কাশ্মিরের বাতোতে নামের একটা জায়গার পটভূমিতে লেখা গল্পটি। পুরনো একটি অসুখের চিকিৎসা করাতে মান্টো সেখানে গিয়েছিল। গল্পটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, এর বড় অংশই আত্মজৈবনিক।  ছোটখাটো বর্ণনার ভেতরে আকুল উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ফুটে উঠেছে আর গল্পটির পরিণতিতে মান্টোর রোমান্টিক মনের সত্যিকার পরিচয় বিধৃত হয়েছে। এ-গল্পের পরে সে যে-গল্পগুলি লিখেছে তা পড়ে মনে হয়েছে, মান্টোর গল্প থেকে ভদ্রতা ও নম্রতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, হয়তো মান্টো নিজেই তার এই মেজাজ ছেঁটে ফেলেছে। অনুভব করতে পারি, নিজের জীবনের কিছু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর ঝুট-ঝামেলার অভিঘাতে মান্টো ক্রমাগত এরকম করছিল। যেন বলছিল, ‘যাও, ছাড়ো আমাকে। – এ-ধরনের আবেগ বাঁচিয়ে রাখার জন্যে জীবন খুব বেশি নিষ্ঠুর। সবচেয়ে ভালো এসব ছেড়ে চলে যাওয়া।’ তার গল্পগুলি সবসময় এই অনুভবই দিতে চেয়েছে যে, এই ধরনের আবেগ স্পষ্ট ও স্বতঃস্ফূর্ত তীব্রতায় বিতাড়িত হয়েছে। কখনো কখনো সে শিশুদের মতো তাদের টিটকারি দিয়েছে, কখনো এমন নোংরাভাবে ঠাট্টা-মশকরা করেছে যে, লোকেরা তার লেখার তিক্ততা, বিষবাষ্প ও পরিহাসের আকালে থাকা কোমলতা আর চিরন্তন কামনাকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তীব্র আকাক্সক্ষা, তীব্র তিয়াস কখনো মিটবার নয়। জীবনের গোড়া থেকেই মান্টো এক ক্ষুধা নিয়ে বসে আছে। তার প্রতিটি গল্পই নিবেদন আর মিনতিতে পরিপূর্ণ। প্রতিটি গল্পই মানুষের প্রতি ভালোবাসার ঘোষণাপত্র। তার বাহ্যিক আচার-আচরণ দিয়ে বিভ্রান্ত হলে চলবে না। উচিতও হবে না।  জোর দিয়েই সে বলেছিল – ‘মানুষের জন্য কোনো ভালোবাসা আমার নেই। একটা অসুস্থ কুকুরের জন্যে আমার ভালোবাসা থাকলেও কোনো মানুষের জন্যে তা নেই।’

বারবার সে দাবি করেছে : ‘বন্ধুত্বে আমার আস্থা নেই। আস্থা নেই বদান্যে বা কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে এবং স্নেহ-ভালোবাসায়। একটা জিনিসেই শুধু আমার প্রবল আস্থা – তা হচ্ছে মদ। প্রগতি-আন্দোলনের সব কার্যকলাপ সম্পূর্ণ জঞ্জাল। আমি নিশ্চিতভাবেই একজন প্রগতিশীল লেখক নই। আমি শুধুই মান্টো, হয়তো তা-ও নই।’

এসব সে বলেছে কখনো ঠাট্টা করে, কখনো আঘাত দেওয়ার জন্যে, কখনো অন্যদের উত্ত্যক্ত করতে। হয়তো আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে; কিন্তু তাঁর চোখদুটো বলেছে একেবারে ভিন্ন কথা –  দিয়েছে এক ভিন্ন বার্তা। তার কলম থেকেও বেরিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন গল্প। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে, নিজের কলমের ওপর খানিকটা নিয়ন্ত্রণ তার ছিল, যেমন ছিল তার কথাবার্তার ওপর। অন্যের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া, তাদের প্রতি তার অপার ভালোবাসা বা তার প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি সব সময় সযত্নে লুকিয়ে রাখত মান্টো। নিজের গল্প লেখার জন্যে যে তুলি সে ব্যবহার করত, সেখানে থাকত বিস্তর ঠাট্টা-মশকরা। কিন্তু তার কলম তার টেনে ধরা লাগাম মানতে চাইত না। ফলে আমরা তার গল্পে মানবতার প্রতি ভালোবাসাই দেখতে পাই।

একবার নায়ে জাওয়ে নামে একটা ছোটগল্পের সংকলন সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। মান্টোর কাছে গল্প চাইলে সে দ্রুত পাঠিয়ে দেয়। আমার মনে হয়েছে, এই গল্প সমকালীন উর্দু গল্পের মধ্যে এখনো সেরা বলে পরিগণিত। সাহিত্যের বিশাল পটভূমি বিবেচনায় আনলে ওই গল্প রাজিন্দার সিং বেদীর ‘কৃষ্ণ’ ও হায়াতুল্লা আনসারির ‘আখরি কোশিশ’-এর মানের। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, উর্দু সাহিত্যে এরকম গল্প আর লেখা হবে না। একই বিষয় নিয়ে লেখা মাস্টারপিস ‘ইয়ামা’ বা বেশকিছু ফরাসি গল্প পড়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে। উমরাও জান-এর চরিত্রগুলি নিয়ে আমি গভীরভাবে পড়াশোনা করেছি। তবে এসব গল্প-উপন্যাসে এমন কোনো চরিত্রের দেখা পাইনি, যারা তার ‘হাতাক’-এর নায়িকার মতো দৃঢ় পদভারে দাঁড়াতে পারে। সমকালীন সামাজিক কাঠামোতে প্রোথিত একজন বারবনিতার জীবনের নানা স্তর মান্টো ধীরে ধীরে উন্মোচিত করেছে। সে এমন পারঙ্গমতায় চরিত্রটি অঙ্কন করেছে যে, শুধু ওই বারবনিতার শরীরখানাই উন্মোচিত হয়নি – তার আত্মাটা পর্যন্ত সব খোলস ভেঙে একেবারে নগ্ন অবস্থায় সবার সামনে দাঁড়িয়েছে। মান্টো তাকে এমন নির্মম ও নৃশংসভাবে উলঙ্গ করেছে যে, তার দিকে তাকালে মনে হবে, আমরা একটা স্বচ্ছ কাচের টুকরো প্রত্যক্ষ করছি। মান্টো চরিত্রটি বিদ্রোহের রঙে কুৎসিত ও জঘন্যভাবে আঁকলেও সেখানে যে-সৌন্দর্যটি প্রকাশ পেয়েছে তা এককথায় অনবদ্য। তার মানে এই নয় যে, ওটা বেশ্যাবৃত্তিকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। আবার তা সুগন্ধী ও তার যাপিত জীবনের প্রতি মমতা বা দয়ামায়াও জাগায় না। এটাই হচ্ছে একমাত্র গুণ যা কোনো লেখাকে সাহিত্যে রূপান্তরিত করে।

‘হাতাক’-এর পর মান্টোর অনেক লেখাই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং একজন ভালো লেখক হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে – সে জয় করেছে পাঠকহৃদয়। এই সময়টাতেই আমি আকাশবাণীতে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়ে লাহোর থেকে দিল্লি চলে যাই। এক মাসও যায়নি মান্টো আমাকে একটা চিঠিতে জানায় সেও দিল্লিতে আসছে, আর আমার সঙ্গে থাকবে। আমি তিজ হাজারি এলাকার কাছে ছোট একটা বাসা ও আমাদের গৃহস্থালির কাজ দেখাশোনা করার মতো একটা কাজের লোকও পেয়ে যাই। ফলে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলাম। একদিন সন্ধ্যায় বাসার বাইরে পায়চারি করার সময় একজন লম্বা, খানিকটা ঝুঁকে চলা, ফর্সা ভদ্রলোককে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখি। তার হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ। আমাকে দেখে মুচকি হাসছিল সে। মুহূর্তের মধ্যে আমরা একে অপরকে চিনে ফেলি।

নবাগত লোকটি বলল, ‘কৃষণ চন্দর না?’ আমি উত্তর দিই ‘মান্টো?’ আমরা বুকে বুক মেলাই।

তার পরণে ছিল একটা লংকোট। ঘরে ঢুকে মান্টো লংকোটটা ও হাতের চামড়ার ব্যাগ সোফার ওপর রেখে সিনেমায় পকেটমারের অভিনয় করতে গিয়ে কানহাইয়ালাল যেভাবে পা মুড়িয়ে চেয়ারে বসে সেইভাবে বসল। ওভাবে তাকে বসতে দেখে আমি হাসি সংবরণ করতে পারলাম না।

সিগারেটের প্যাকেট তার দিকে এগিয়ে বললাম, ‘নাও।’ এক সস্তা ব্র্যান্ডের।’

মান্টো অবাক হয়ে বলল, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা। তুমি এসব সিগারেট খাও? এসব সিগারেট টেনে এতো ভালো ভালো গল্প তুমি লেখো কী করে! কেরানি ছাড়া অন্য কিছু হওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। ওহে, কৃষণ চন্দর এম. এ, কি বলছি বুঝতে পারছো? এই নাও ৫৫৫। টানো, ওইসব বাজে সিগারেটের কথা ভুলে যাও।’

এই সময় আমার বাসার কাজের ছেলে একটা প্লেটে করে গরম ফুলকি নিয়ে এলো। আমি বললাম, এগুলো পাঞ্জাব থেকে আনা খাঁটি ঘিয়ে ভাজা।

‘ফুলকি! তা-ও ঘিয়ে ভাজা’ মান্টো প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা! দেখো ভাই, তুমি একটা বুদ্ধু। কোন বোকা ঘি দিয়ে ফুলকি ভাজতে যায়? ফুলকি ভাজতে হয় ডালডা দিয়ে, ঘি দিয়ে নয়। দাঁড়াও, আমার বউয়ের আসার অপেক্ষা করো। সে এলে ফুলকি খাওয়াব তোমাকে। মচমচে মশলাদার ফুলকি। বোম্বের ‘ঘাতানের’*। বোম্বে গিয়েছ কখনো?’

‘জীবনে এই প্রথম দিল্লি এসেছি। এর বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।’

‘রেডিওর এইসব চাকরির ধান্দা ছেড়ে বোম্বে আসো। এসো পান করা যাক।’

অতঃপর মান্টো কোটের পকেট থেকে ‘সোলান নাম্বার ওয়ান’ ব্র্যান্ডের হুইস্কির বোতল বের করে বলল, ‘জলদি করো। তোমার কাজের ছেলেটাকে গ্লাস আনতে বলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

আমি জীবনে এক ফোঁটা মদও ছুঁয়ে দেখিনি; কিন্তু মান্টোর হাবভাব এমন মারমুখী ও আগ্রাসী যে, মনে হলো, এখন যদি মদ খেতে রাজি না হই, নির্ঘাত সে আমাকে খুন করে ফেলবে।

আমি খুব শান্ত থেকে দুটো গ্লাস আনতে বললাম কাজের ছেলেটাকে।

হুইস্কি ঢালতে ঢালতে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি সাধারণত কোন ব্র্যান্ডের হুইস্কি খাও?’ বললাম, ‘ব্র্যান্ডি আর যে-কোনো ভালো মানের ইংলিশ হুইস্কি।’ ‘কোন ইংলিশ হুইস্কি? ইংল্যান্ডে হুইস্কি নেই। হুইস্কি হয় স্কচ্ স্কটিশ। কী করে মদ তৈরি করতে হয় সে-সম্পর্কে ওই শালা ইংরেজদের কোনো ধারণাই নেই। কেমন করে তারা গোটা ভারতবর্ষ শাসন করার স্বপ্ন দেখে?’

আমার মাথায় তখন আমদানি করা একটা হুইস্কির বিজ্ঞাপন ঝলক দিয়ে উঠল। চট করে বলে ফেললাম, ‘ডোন্ট বি ভেগ, আস্ক ফর হেইগ।’

মান্টো বলল, ‘ননসেন্স। সোলান নাম্বার ওয়ানই সর্বোত্তম। এর প্রথম ভালো দিক – দামে সস্তা, আর হেইগের চেয়ে বেশি আনন্দদায়ক। নেশাও হয় প্রচুর। এখন থেকে আর কখনো হেইগ স্পর্শ করবে না।’

‘ঠিক আছে। আর নয়।’

আমার গ্লাস এখনো প্রায় চার ভাগের এক ভাগ পূর্ণ দেখে মান্টো বলল, ‘আর একটু দেবো?’

বললাম, ‘আর না হলেও চলবে। আচ্ছা, তুমি যখন চাইছ দাও একটুখানি …’

আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে মান্টো বলল, ‘তুমি কি ‘পাতিয়ালা পেগ’ চাইছ?’

আমি চট করে বললাম, ‘হ্যাঁ।’

সত্যি কথা বলতে কী, পাতিয়ালা পেগ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। আমি শুধু বড়শিটা গিলতে চাইছিলাম না।

‘তুমি দেখছি দারুণ মদারু।’ এ-কথা বলে মান্টো সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতে লাগল।

পয়লা চোটেই আমি ধরাশায়ী হয়ে পড়েছিলাম। এরপর আর আমি পান করিনি। আমাকে কুপোকাত হতে দেখে মান্টো আরো খানিকটা পান করার অনুরোধ করা থেকে বিরত থাকে। আমি তো প্রথমেই কবুল করেছি, জীবনে ওটাই ছিল আমার প্রথম মদ্যপান। এ-কথা জানার পর মান্টো মদপানের উপকারিতা বিষয়ে ম্যালা বক্তৃতা ঝাড়তে লাগল।

‘মদে রয়েছে পাপের আনন্দ। মেয়েমানুষ যে-আনন্দ তোমাকে দিতে পারে – মদও তা পারে। মদে আছে সাহিত্যের মধু। মদে তুমি পার্থিব জগতের নিত্যদিনের কাজকর্মের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পাবে। কতদিন তুমি নিজের গায়ে কলঙ্কের কালিমা লাগতে দেবে না? তোমাকে তো সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, স্কুলের বাচ্চাদের পড়াতে হবে না। জীবন সম্পর্কে তোমার যদি কোনো অভিজ্ঞতা না-থাকে, কোনো অপরাধ যদি না-করো, মৃত্যুর খুব কাছাকাছি না-যাও, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার স্বাদ যদি
না-গ্রহণ করো তাহলে সোলান নাম্বার ওয়ান পান করার দরকার নেই। তাহলে আমাকে দয়া করে বলো কোন জিনিস পান করলে তুমি লিখতে পারবে?’

বোতল শেষ হওয়ার পর মান্টো নিজেও তার হুঁশ  হারিয়েছিল। তারপরই তার প্রধান সমস্যা ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কেন আমি কৃষণ চন্দর এম. এ, কেন আমি শুধু কৃষণ চন্দর নই। তারপর সে ক্রমাগত মশকরা করে বলতে লাগল – কৃষণ চন্দর এম.এ, কৃষণ চন্দর এম.এ।

আমিও তার সঙ্গে মশকরা করে বলতে লাগলাম, ‘তুমি প্রথমে আমাকে বলো তোমার নাম আসলে কী, মিন্টু, মিন্টো না মান্টো। ভগবানের দোহাই – মিন্টো, না মান্টো?’

এতেও থামল না সে। বলতেই লাগল কৃষণ চন্দর এম.এ, কৃষণ চন্দর এম.এ।

আমরা বেশ কিছুক্ষণ এসব করে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমি ঘুমালাম সোফায়, মান্টো যে চেয়ারটাতে বসেছিল সেখানে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি রাতে তাকে যে-অবস্থায় দেখেছিলাম সে-অবস্থায় দেখতে পেলাম। টেবিলে পড়ে আছে খালি বোতল, গ্লাস আর কিছু বাসি হয়ে যাওয়া রুটি।

আমি বললাম, ‘এ্যাই মান্টো ওঠো।’

সে চোখ না খুলেই বলল, ‘একটুখানি হুইস্কি দেবে আমাকে, যাতে মুখ থেকে হুইস্কির স্বাদটা তাড়াতে পারি। ওই স্বাদ দূর করার একমাত্র উপায় হচ্ছে খানিকটা হুইস্কি গলাধঃকরণ করা। বুঝেছ? শিগগির একটুখানি হুইস্কি নিয়ে এসো। তারপর অল ইন্ডিয়া রেডিওতে যাব।’

‘ওখানে আবার কী?’

‘নাটক লেখার জন্যে ওরা আমাকে ডেকেছে।’

‘কিন্তু তুমি তো আমাকে সিনেমায় কাজ করার জন্যে বোম্বে যেতে বলছ।’

‘আরে ধুর। বাদ দাও তো ওসব, গুল্লি মারো তোমার সিনেমার। হুইস্কি আনাও জলদি করে।’

সে তার ব্যাগ থেকে তার গল্পের স্ক্রিপ্ট বের করল। আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘পড়ো। আমি আমার গল্প কাউকে পড়তে দিই না। কাউকে না, এমনকি আমার বাপকেও না। আমি শুধু তোমাকে দেখাচ্ছি গল্পটা, যদিও তুমি খুব ভালো লেখক নও। তবে তোমার গল্পে বিশেষ কিছু গুণ আছে, খুব দারুণ কিছু! আমাকে স্বীকার করতেই হবে। বুঝলে জনাব কৃষণ চন্দর এম. এ?’

রেডিও স্টেশনে আমরা দুজন একসঙ্গে দু-বছর কাজ করেছি। পরে উপেন্দ্রনাথ আশ্ক আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। আমি নাটক বিভাগের প্রযোজক ছিলাম, মান্টো আর আশ্ক নাটক লিখত। প্রতিনিয়ত এই দুজনের সঙ্গে আমাকে ভারসাম্য বজায় রাখার কাজটা করতে হতো। দুজনেই ভালো লিখত ও সমপরিমাণ অহংকারী ছিল। ফলে সেই সময় রেডিওর জন্যে বেশকিছু ভালো নাটক রচিত হয়েছিল। ওই নাটকগুলি ছিল মূল ভাষায় রচিত, অন্য কোনো ভাষা থেকে অনূদিত নয়। ওই লেখাগুলিতে ছিল বৈদগ্ধ্য ও প্রাণের স্পর্শ। অসংযত বুদ্ধিবৃত্তির কোনো প্রকাশ সেখানে ছিল না। উর্দু সাহিত্যে নাটককে আধুনিক ও জনপ্রিয় করার পেছনে এই নাটকগুলি ছিল। সত্যি কথা বলতে কী, এইসব নাটক লেখা হয়ে গেলে উপেন্দ্রনাথ আশ্ক তার সকল শক্তি ও মেধা নাটকের জগতে ঢেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

ওইদিনগুলি ছিল বড়ই সুখের। আমরা তিনজনে প্রায়ই সাহিত্যের নানান বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতাম। কখনো কখনো তর্কেও মেতে উঠতাম। আমরা গল্প লিখতাম, নাটক লিখতাম; একে অপরের লেখা পাঠ করতাম। কিছুদিন পরে বেদীও আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। এর পরপরই এসেছিল আহমেদ নাদিম কাশমি ও নুন মিম রশীদ। আমাদের এই সম্মিলন উর্দু সাহিত্যের জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। নাদিম তার বড় অপেরা লিখেছিল। রশিদের মাভারা* কাব্যগ্রন্থ তখনই প্রকাশিত হয়। দেবেন্দ্র সত্যার্থীও তখন আমাদের পথে এসে নিজেকে প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। সে আর মান্টো প্রথম কিছুদিন বেশ মিলেমিশে থাকলেও মান্টোর তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচার-ব্যবহারের সঙ্গে সত্যার্থীর মিষ্টি হাবভাবের একেবারেই মিল খায়নি। খুব বেশিদিন একসঙ্গে থাকতে পারেনি তারা।

পরে একটা গল্প লিখে মান্টো তীব্র ভাষায় সত্যার্থীকে আক্রমণ করেছিল।* ‘নায়ে দেবতা’ নামে একটা গল্প লিখে সত্যার্থী এর জবাব দিয়েছিল। এই গল্প মান্টোকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল, যা প্রায় দুই থেকে তিন বছর স্থায়ী হয়েছিল। পরে মান্টো ব্যাপারটা নিজেই সুরাহা করে ফেলে, এই বলে যে, “নায়ে দেবতা? বেশ, এ ব্যাপারে আর কোনো কথাই বলব না!”

আমি নিজেও এই ব্যাপারটা নিয়ে আর কোনো কথা বলিনি। মান্টো প্রায়ই বলত, ‘তোমার এই বিষয়টি আমার ভালো লাগে না। আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে চাই, আর তুমি কিনা তার আগেই আমাকে কুপোকাত করে ফেলো। তোমার এই বেয়াদবি একদম পছন্দ হয় না আমার।’

উত্তরে আমি বলি, ‘কেন, ঝগড়া করার জন্যে আশ্কই তো যথেষ্ট। আমাকে কী প্রয়োজন?’

আশ্ক আর মান্টোর মধ্যেকার ঝগড়া-ফ্যাসাদ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। দুনিয়ার যে-কোনো বিষয় নিয়ে ওই দুজনের মধ্যে কথাকাটাকাটি হতো। তবে প্রায়ই তারা এমন চমৎকার সব বিষয়ে তর্ক করত যে, কারো পক্ষে বিরক্ত হওয়া অসম্ভব ছিল।

মান্টোর একটা উর্দু টাইপরাইটার ছিল। ওটা দিয়েই সে তার নাটকাদি লিখত। সে ওই মেশিনটাতে কাগজ লাগাত, স্থির হয়ে বসত, তারপর খটখট করে টাইপ করে যেত।

মান্টো বিশ্বাস করত, ওই টাইপরাইটারের মতো এত সংবেদনশীল মেশিন দ্বিতীয়টি নেই। প্রায়ই বলত, ‘গোটা-গোটা অক্ষর, মুক্তোর দানার মতো ঝকঝকে লেখা, দূষণ ও ধুলোমুক্ত দারুণ একখানা টাইপরাইটার। এটা দিয়ে লেখা আর কলম দিয়ে লেখার মধ্যে বিস্তর ফারাক। ঝরনা কলমের নিব কখনো ভেঙে যায়, কালি ফুরিয়ে গেলে আবার ভরতে হয়। আবার কখনোবা পাতলা কাগজের কারণে লেখা জাবড়ে যায়। এ-কারণে একজন লেখকের একটা টাইপরাইটার থাকা খুব জরুরি। যেমন জরুরি একজন স্ত্রীর স্বামী থাকা। এর বেশি আর কী বলব – এখানে উপেন্দ্রনাথ আশ্ক ও কৃষণ চন্দর হাজির আছেন। এখনো তারা কাগজের ওপর কলম আঁচড়ে যাচ্ছেন। ওই দেখুন না ভদ্রমহোদয়গণ! আচ্ছা আপনারাই বলুন, আট আনা দামের একখানা কলম দিয়ে কি মহৎ কোনো সাহিত্য রচনা করা যায়? যত্তোসব নির্বোধের দল!’

এসব কথায় আমি কান দিইনি। কদিন পরে দেখলাম একটা উর্দু টাইপরাইটার বগলদাবা করে আশ্ক সাহেব অফিসে ঢুকছে। ভদ্রলোক টাইপরাইটারখানা মান্টোর টেবিলে রেখে কি-বোর্ড হাতাতে লাগল।

এসব দেখে মান্টো বলল, ‘দেখো ভাই, শুধু একখানা উর্দু টাইপরাইটার থাকাই যথেষ্ট নয়। একখানা ইংরেজি টাইপরাইটার রাখাও দরকার। কৃষণ, তুমি কি ইংরেজি টাইপরাইটার দেখেছ কখনো? আমার একখানা আছে। সারা দিল্লি ঘুরে ওরকম একটা টাইপরাইটার তুমি খুঁজে পাবে না। একদিন অফিসে এনে দেখাব তোমাদের।’

আশ্ক শুধু একটা ইংরেজি টাইপরাইটারই কিনল না, একখানা হিন্দিও কিনল। আমাদের দফতরের অ্যাটেনডেন্টও দুটি বগলদাবা করে এমনভাবে মান্টোর টেবিলের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল যে, সবাই বুঝল আশ্কের তিনটে টাইপরাইটার আছে; আর মান্টোর আছে মাত্র দুখানা। এসব দেখে মান্টো এত বিরক্ত হলো যে, ইংরেজি টাইপরাইটারখানা তড়িঘড়ি করে বিক্রি করে দিলো। সত্যি কথা বলতে কী, উর্দু টাইপরাইটারখানাও সে বেচে দিতে চাইছিল, কিন্তু কাজের ক্ষতি হবে বলে ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিলো। কিন্তু তিনখানা টাইপরাইটারের মালিকের দ্বারা আর কতদিন নাজেহাল হওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত সে উর্দু টাইপরাইটারও বিক্রি করে দিলো। এর পেছনে তার যুক্তি ছিল : ‘যত যাই বলো, মেশিন কখনো কলমের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। কলমের সঙ্গে কাগজের আর মনের যে-সম্পর্ক টাইপরাইটার তা কখনো অর্জন করতে পারে না। টাইপরাইটার যখন অবিরাম খটাখট শব্দ তুলতে থাকে …, কলমের প্রবাহে এক জাদু আছে। মনে হয় যেন মনের গহন থেকে কালি বেরিয়ে কাগজের শরীরের ওপর ছড়িয়ে পড়ছে। আহা! ওই শেফার কলমটা যে কী সুন্দর বলে বোঝানো যাবে না! এরকম সুস্পষ্ট চিকন চেহারা আর দ্যুতিময় অবয়ব আপনাদের মধ্যে কে দেখেছে? যেন বান্দ্রার কোনো খ্রিষ্টান যুবতী!’

এসব দেখেশুনে আশ্ক দিলে বড় চোট পেল। একদিন বলেই ফেলল, ‘আচ্ছা মান্টো, ন্যায়নীতি বোধ বলে কি তোমার কিছুই নেই? এই গতকাল পর্যন্তও তুমি টাইপরাইটারের ব্যাপারে অত্যুৎসাহী ও সমঝদার ছিলে। কতই না প্রশংসাবাক্য ঝেড়েছ ওই ব্যাপারে। আজ যখন আমি তিন-তিনটে টাইপরাইটারের মালিক হয়েছি, তুমি কলমের প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছ। এটা কি ঠিক হচ্ছে? এর মধ্যেই আমার নগদ এক হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে!’

একথা শুনে মান্টো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

একদিন তাকে বেশ হাসিখুশি মনে হলো। আমার কাছে এসে বলল, ‘এই চিঠিখানা পড়ো ভাই। আহমেদ নাদিম কাশমির লেখা। তোমাকেও সালাম জানিয়েছে সে।’

চিঠিটা পড়ে দেখলাম বেশ আনন্দদায়ক। তবে তখনই বুঝে ফেললাম মান্টো কেন ওই চিঠি আমাকে দেখাচ্ছে। গল্পলেখক হিসেবে মান্টোর বিস্তর প্রশংসা ও তার প্রতি পত্রদাতার অনুরাগ প্রকাশিত হয়েছে। চিঠির শেষ লাইনে ছিল : ‘আপনি হচ্ছেন গল্পের সম্রাট।’

চিঠিটা পড়া শেষ হলে আমি ড্রয়ার খুলে একটা চিঠি বের করে পড়তে লাগলাম। ওটিও আহমেদ নাদিম কাশমির লেখা। সেদিনের ডাকেই এসেছে। চিঠিটা আমি মান্টোর হাতে দিয়ে বললাম, ‘পড়ে দেখো, একই ভদ্রলোকের লেখা। আমাকে লিখেছেন।’

গল্পলেখক হিসেবে আমার বিস্তর প্রশংসা ছিল ওখানে। শেষ লাইন ছিল : ‘আপনি উর্দু গল্পের সার্বভৌম সম্রাট।’

আমি বললাম, ‘মান্টো তুমি হচ্ছো সম্রাট আর আমি সার্বভৌম সম্রাট। তার মানে তোমার চেয়ে এক কাঠি ওপরে। এ ব্যাপারে তোমার কী মত?’

আমরা দুজনই হো-হো করে হেসে উঠলাম। নাদিম আমাদের উভয়ের সঙ্গেই জালিয়াতি করেছেন। মান্টো তখন বলল, ‘চলো, আমরা দুজনে মিলে ওকে এখানে আমন্ত্রণ জানাই।’

সে-সময় ভদ্রঘরের মেয়েরা রেডিও-নাটকে অভিনয় করতে চাইত না। আমি যখন দিল্লিতে আসি, তখন মাত্র তিনজন মেয়ে নাটকে অংশগ্রহণ করতে রাজি ছিল। অবশ্য সেই সময়টাতেই এমন সব নাটক লেখা হচ্ছিল, যেখানে সমসাময়িক উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চশ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার ওপর আলোকপাত করা হচ্ছিল। তখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে, আমাদের দলটা ছিল বেশ ছোট, যাকে আরো প্রসারিত করার প্রয়োজন ছিল। আমি অনেক চেষ্টা-তদবির করে দশ-বারোজন মেয়েকে আমাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলাম।

একদিন মান্টো আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘শোনো ভাই, কতজন মেয়েকে তুমি বেতারজগতে অভিনয়ের জন্যে আনতে পারবে?’

‘কতজন বলতে কী বোঝাচ্ছ তুমি? যতজন দরকার পড়বে ততজন।’

‘এত বড়াই করার সময় এটা নয় ভায়া। আমি সঠিক জানতে চাইছি।’

‘কেন জানতে চাইছ? যতজন নারী চরিত্র দরকার ততজনকে অন্তর্ভুক্ত করে নাটক লেখো তুমি। আমি অভিনেত্রী জোগাড় করব। দায়িত্ব আমার।’

‘আচ্ছা মানলাম তোমার কথা। আমি এমন একখানা নাটক লিখব যেখানে শুধু নারী চরিত্র থাকবে। এই ধরো ছাব্বিশ থেকে সাতাশজন।’

আমি বললাম, ‘তাহলে নাটকের নাম হবে ‘এক মর্দ’।’

ওই নাটক সত্যি সত্যিই লেখা হয়েছিল আর মহাসমারোহে প্রচারিত হয়েছিল। প্রতিটি নারী চরিত্রের জন্যে আমরা অভিনেত্রী খুঁজে বের করেছিলাম।

এরকমের প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছিলাম। আমি একটা ভালো গল্প লিখি, মান্টো ও আশ্কও তা-ই করে। আর রশীদ লেখে চমৎকার একটা কবিতা। মান্টো একটা নাটক লিখলে আশোকের জন্যে আর একটা লেখা ফরজ হয়ে দাঁড়ায়। তখন আমিও একটা লেখার চেষ্টা চালাই। সারাই কি বাহার* নামে আমার নাটক ওই সময় রচিত।

সেই সময়গুলিতে মান্টোর সঙ্গে আমার প্রবল সখ্য ছিল। আর্থিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমরা আনন্দময় সময় কাটিয়েছি। আমরা প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও মৌলিকতা নিয়ে বিস্তর লিখেছি। এসব করতে গিয়ে কখনো আমরা আমাদের সজীবতা হারাইনি বা অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়িনি।

সেই সময়টাতেই মান্টো তার শ্রেষ্ঠ নাটক ও গল্পগুলি লিখেছিল। মান্টোর কলম থেকে অসাধারণ ও বিস্ময়কর সব  লেখা বেরুছিল। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাটি বা তর্কাতর্কির বিষয়টা বাদ দিলে আমি আর মান্টো একটা টিমে বেশ ভালোই কাজ করে যাচ্ছিলাম। রাত-দিন আমরা একসঙ্গে কাটাতাম আর সারাক্ষণ ভাবতাম আমাদের অনুষ্ঠানগুলি কী করে আরো ভালো করা যায়। রেডিওশিল্পীরা বিশেষভাবে মান্টোর ভক্ত ছিল। সে রিহার্সালে খুব বেশি একটা থাকত না; তবে যখন থাকত
ঠাট্টা-মশকরা আর আনন্দ-উল্লাসে আসর এমনভাবে মাতিয়ে রাখত যে, সে চলে যাওয়ার পরও তার রেশ থাকত। মান্টোর নাটকে যেসব শিল্পী কাজ করত তারা এতটা নিষ্ঠা ও পরিশ্রম ঢেলে কাজ করত যে, নাটকটি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে যেত। শিল্পীদের কাজের নিষ্ঠা থেকেই প্রমাণিত হতো যে, মান্টোর বেতার-নাটকগুলি কতখানি আন্তরিকতা দিয়ে রচিত।

ঠিক ওই সময়টাতেই আমি আর মান্টো বানজারার জন্যে একত্রে একটা গল্প লিখেছিলাম। চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ওটাই ছিল আমার প্রথম কাজ। দিল্লির এক ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে আমরা গল্পটা বিক্রি করে দিয়েছিলাম যাতে ওই টাকা দিয়ে আমরা দুজনে নতুন একখানা করে স্যুট বানাতে পারি। জানতাম, অদূর ভবিষ্যতে কোনো প্রকাশকের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই ঘটনার মজার দিক হচ্ছে এই যে, ব্যাপারটা তখন আর নতুন স্যুট সেলাইয়ে না-থেকে আমাদের জন্য একটা অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়।

যে-শেঠাজির কাছে আমরা গল্পটা বিক্রি করেছিলাম সে কোনোভাবে আমাদের মতলব বুঝে ফেলে জানায়, ‘আপনাদের গল্পটা নিঃসন্দেহে চমৎকার। তবে মান্টো সাহেব, গল্পে আপনি মিল মালিককে একজন সত্যিকার শয়তান রূপে সৃষ্টি করেছেন। ওই লোকটাকে ভালো মানুষ হিসেবে দেখান, তা না হলে শ্রমিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে।’

মান্টো বলল, ‘অতি উত্তম কথা। আমরা তাকে ভালো মানুষে পরিণত করব।’

ব্যাপারটাতে আমি এমন হতবাক হয়ে পড়ি যে, ব্যথিতচিত্তে মান্টোর দিকে তাকাই। আমি ওই শেঠকে মুখের ওপর বলতে চেয়েছিলাম – এ-কাজ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মান্টো আমাকে ইশারা দিয়ে নিরস্ত করেছিল।

শেঠজির আরো কথা ছিল, ‘ওই ম্যানেজারের স্ত্রী থাকবে। আর তার একজন অবিবাহিত বোন থাকবে যে নায়কের প্রেমে পড়বে। তাকে একজন ছিনালি হিসেবে দেখালেও ক্ষতি নেই। ব্যাপারটা কেমন হবে মান্টো সাহেব?’

মান্টো বলল, ‘অতি উত্তম, অতি উত্তম।’

আমি একটুখানি হকচকিয়ে অতীতে ফিরে গেলাম। ভাবলাম, আমি কি সেই মান্টোকে দেখছি যে একজনের কথায় তার লেখার একটা অক্ষরও পরিবর্তন করতে রাজি হয়নি। বলেছে – ‘যেমন আছে তেমনভাবে ছাপতে হবে। না হলে লেখা ফেরত নেব।’

আমি অবাক হয়ে বারবার তার দিকে তাকাচ্ছিলাম। শেঠের সঙ্গে বৈঠক শেষ করে ফেরার পর মান্টো বলল, ‘দেখো ভাই, এগুলি সাহিত্য নয় – সিনেমা। শিক্ষিত, সভ্য মানুষ বা সাহিত্যবোদ্ধাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ এর ওপর নেই। আমাদের গল্প যারা মূল্যায়ন করবে তারা মাওলানা সালাহউদ্দিন, কালেমুল্লাহ আর হামিদ আলি খানের মতো মানুষ – সারু ভাই, তোকারজি প্যাটেল, কিংবা মাঙ্গু ভাঙ্গু-জাঙ্গু বা তাদের ভাইদের মতো মানুষ নয়। চলচ্চিত্রে মাকে বোন, বোনকে প্রেমিকা আর প্রেমিকাকে ছিনালিতে পরিণত করা বাচ্চাদের খেলার মতো একটা ব্যাপার। বুঝলে? সাহিত্যের সেবা করো আর সিনেমা থেকে টাকা কামাও। এখন বলো, স্যুটের দরকার নেই তোমার?’

‘আছে।’

‘তাহলে অবশ্যই গল্পটা বদলাতে হবে।’

আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই ভাই, নিশ্চয়ই।’  

মেজাজ-মর্জি, শরীর-স্বাস্থ্য আর নিষ্ঠার কথা বিবেচনায় নিলে মান্টো এখনো কাশ্মিরি পণ্ডিত। নানাভাবে সেও আশোকের মতো। আমি জানি ব্যাপারটাতে মান্টো দুঃখ পাবে, কিন্তু এটাই সত্যি। আশ্কও একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। দুজনেই তারা লম্বা ও হালকা-পাতলা। দুজনেই ভাবে তাদের স্বাস্থ্য গুরুতর হুমকির মুখে। ভোগা মানুষ। ইনজেকশন নেওয়ার ব্যাপারে তাদের প্রবল আগ্রহ। ব্রাহ্মণের ব্যাপারে দুজনেই অনমনীয়। তাদের মেধা, ধৈর্য আর বিরক্তি একই ধরনের। দুজনেই বাচাল। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মান্টোর কথাবার্তায় প্রবল রসবোধ আছে। তার সঙ্গে যে-কোনো বিষয়ে আলাপ করা যায় আর ওই বিষয়ে একটা নতুন পরিপ্রেক্ষিত প্রদানে সে ভালো রকমের সক্ষম। সাধারণভাবে যে বিষয়গুলি এড়িয়ে যাওয়া যায় মান্টোর ব্যক্তিত্বের সেটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য। কোনো অবস্থাতেই তা ত্যাগ করতে পারে না সে। আপনি যদি দস্তয়েভস্কির প্রশংসা করেন, সে সমারসেট মমের গুণকীর্তন শুরু করবে। আপনি যদি বোম্বের কোনো ব্যাপার নিয়ে নিন্দামন্দ করেন, সে অমৃতসর নিয়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠবে। আপনি যদি জিন্নাহ বা গান্ধীজির বিষয়ে আপনার পছন্দের কোনো কিছু নিয়ে প্রশংসা করেন, তাহলে সে তার এলাকার কোনো পার্টির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে। আপনি মাংস কিংবা পালংপনির খেতে চাইলে সে আপনাকে ডাল খাওয়ার পরামর্শ দেবে। আপনি বিয়ে করার বাসনা প্রকাশ করলে সে আপনাকে চিরকুমার থাকতে বলবে। তার কাছে কোনো আনুকূল্য চাইলে সে আপনাকে নাজেহাল করে ছাড়বে। আপনি যদি তাকে নাজেহাল করেন, দেখবেন সে আপনার জন্যে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে। মান্টোর বন্ধুত্ব, শত্রুতা আর প্রতিহিংসা তার ব্যক্তিত্বের মতোই অদ্ভুত।

আলো-আঁধারির নানান ছায়ায় প্রত্যক্ষ করা যায় তার যথার্থ মানবতা।

তার অনমনীয়তা, সোজাসাপটা বা কাঠখোট্টা

কথাবার্তা আসলে রক্ষাকারী অস্ত্রের মতো, যা দিয়ে সে নিজের ভেতরকার দরদি ও সহানুভূতিশীল মনটাকে সংরক্ষণ করে। নিজে সে অন্যদের থেকে আলাদা, এটা দেখানোর তার চেষ্টা থেকে আমরা এমন প্রমাণই পাই, সে আমাদের সবার মতো। বাস্তবে সে গভীর পোড়খাওয়া এক মানুষ। অসহায়-দুর্বল, আঘাত দেওয়া যায় এমন এক নমনীয় মানুষ। প্রচণ্ড সহানুভূতিশীল, পরদুঃখে কাতর এক মানবাত্মা! জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে অবজ্ঞা করে মান্টো হাসছে, মদ খাচ্ছে, বন্ধুদের সঙ্গে

ঠাট্টা-মশকরা করছে – লোকে এটাই দেখেছে, দেখছে তার বিদ্রূপাত্মক মনোভাব; কিন্তু আমি মান্টোকে কাঁদতেও দেখেছি। প্রেমের বেদনা বা মারাত্মক কোনো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে কাতর হয়নি সে। কাঁদেনি জাগতিক দুঃখে, নিজের কষ্টে – কেঁদেছিল তার দেড় বছর বয়সী ছেলের মৃত্যুতে।

ওই খবর শোনামাত্র তার বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলাম। রক্তলাল চোখে আমার দিকে সে তাকিয়েছিল। যেন বলতে চাইছিল, ‘এতক্ষণে এলে? সে তো চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। দাফন করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছি তাকে। এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি, একটু আগে এলে হয়তো ছেলেটাকে বাঁচানো যেত …’

গলা ধরে এসেছিল তার। চোখের পাতা ভারী। বলেছিল, ‘কৃষণ, মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। কারো মৃত্যু আমার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করে না। কিন্তু এই শিশুটিকে দেখো। আমার ছেলে বলে বলছি না। … তার দিকে একবার তাকাও … কী নিষ্পাপ! মরে গেছে তারপরও দেখ কত তরতাজা, কত মিষ্টি! কোনো নতুন ও বিশুদ্ধ উপলব্ধি অকালমৃত্যুর মুখোমুখি হলে বড় ধরনের ট্র্যাজেডি ঘটে। প্রতিটি শিশুই আসলে একটি নতুন উপলব্ধির মতো। কেন তা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে? আমি জীবনের ঝলককে দেহ ছেড়ে চলে যেতে দেখেছি। আমি মারা যেতে পারি, তুমি মারা যেতে পারো, একজন বৃদ্ধ, জোয়ান আর মাঝ বয়সের কোনো লোক মারা যেতে পারে। … মরণশীল মানুষ তো মরবেই, কিন্তু এই শিশু? প্রকৃতি একটি নতুন অনুভূতিকে এত তাড়াহুড়ো করে দ্রুত মেরে ফেলতে পারে না …’

কথাগুলি বলার পর তীব্র কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। নিজের চারপাশে উন্নাসিকতার যে-অস্ত্র সে তৈরি করেছিল তা মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে খান খান হয়ে যায়।  এরপরে আর কোনোদিন তাকে কাঁদতে দেখিনি। কিন্তু তার ওই চোখের জল আমাকে কূলকিনারাহীন সমুদ্রের কাছে নিয়ে যায়, যেখানে জন্ম লাভ করে সাহিত্য। মান্টো নামের ওই সমুদ্রের জলের রং গাঢ় সবুজ ও সোনালি। ওই জল লবণাক্ত। ওই সমুদ্রে বাস করে হাঙর ও অক্টোপাসের মতো ভয়ংকর প্রাণী। ওগুলি ছাড়াও সমুদ্রে থাকে বহুবর্ণিল, চমৎকার সব পাথরের গায়ে সবুজের প্রলেপ, মখমলের মতো শৈবাল, খাঁটি আর চকচকে মুক্তো। জীবনে একবার মাত্র ওই দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। নিজেকে হৃদয় মন্থন করে মান্টো যে বিপুল মণিমুক্তা আহরণ করেছিল তা আপনারা দেখেছেন। এগুলি সবই মান্টোর জমে যাওয়া রক্তের ফোঁটা। আপনাদের কাছে উপস্থাপন করার আগে সে তার রঙ্গরস আর অসূয়া নিয়ে তা ঘষামাজা করত। মান্টোর স্টাইল সবসময় গ্রহণ করাও আপনাদের পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ ওগুলি বরাবরই খাঁটি ও ভেজালমুক্ত। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য, এই সম্পদ কোনোদিনও স্বীকৃতি লাভ করেনি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার ভাণ্ডার বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু আমরা আমাদের মহান সব শিল্পীর ব্যাপারে বরাবরই চরম মূর্খ রয়ে গেছি। উদাহরণ হিসেবে শেহগালের কথা মনে পড়ছে আমার। তার মৃত্যুর পর আমাদের তথাকথিত খ্যাতনামা ব্যক্তিদের একটি কথাও বলতে দেখিনি। অথচ তাঁরাই আবার দেশের শিল্প-সাহিত্য নিয়ে হাহাকার করেন। খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন, তাঁরা যদি আমার দেশের প্রধান প্রধান শিল্পীদের নাম, পরিচয় আর অবস্থা সম্পর্কে জানতেন, তাঁরা তাঁদের নিয়ে কোনো কথাই বলতেন না। নিজেদের অজ্ঞতা চাপা দিতেন ব্যস্ততার অজুহাতে।

পোশাক-আশাকের প্রতি মান্টোর কোনো আসক্তি ছিল না। তার পছন্দ ছিল ভালো একটা বাসা, চমৎকার একটা থাকার জায়গা, ভালো খাবার ও ভালো মদ। তার ঘরবাড়ি সবসময় পরিচ্ছন্ন আর সাজানো-গোছানো থাকত। পরিষ্কার ও ধুলোবালিমুক্ত পরিবেশে কাজ করতে ভালোবাসত সে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শুদ্ধতা আর পরিশীলিত আচরণ ছিল তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। লেখকদের বাড়িতে যে বিশৃঙ্খল ও নোংরা পরিবেশ দেখা যেত মান্টোর বাড়িতে তা একেবারেই ছিল না। আপনি এমন কিছু পাবেন না, যা এলোমেলো করে রাখা। সবকিছুই খুব গোছাল। একটা জিনিসই শুধু ছিল আঁকাবাঁকা – তা হচ্ছে গৃহকর্তার মন। কিন্তু এখানেও আপনি এমন নকশা-নমুনা খুঁজে পাবেন, যা কেবল গল্পের শেষে আছে। মান্টোর গল্পগুলিতে তার মেজাজ-মর্জি ও তার চারপাশের পরিবেশেরই প্রতিফলন আছে। প্রচণ্ড সতর্কতার সঙ্গে সে তার গল্পের পোশাক-আশাক সেলাই করত। একটা ভাঁজও সেখানে খুঁজে পাওয়া যেত না। একটা অসতর্ক ফোঁড়ও সেখানে থাকত না। মুড়ি-সেলাই ছিল নিখুঁত। শেষে অতিযত্নে ইস্ত্রি করা হতো। মান্টোর গল্প সাবলীল, বিশৃঙ্খলামুক্ত। ভাষা চাকচিক্যপূর্ণ হলেও সরল। তার গল্পে অদ্ভুত এক আলোছায়া আছে। স্বচ্ছ শিল্পকুশলতায় পূর্ণ। মান্টো-ব্যবহৃত মেটাফোরগুলি চমৎকার। রসময়তা, ছন্দলয়, সুরপ্রবাহ ও সংশয়বর্জিত সাহিত্যে সৌন্দর্যের পূজারী সে নয়। বরং জ্যামিতি তার আরাধ্য। সবকিছু তার চাই সঠিক অনুপাতে। শব্দের অর্থ ও সেইসঙ্গে মেটাফোরের সীমা সম্পর্কে সে সচেতন। সৌন্দর্যের অসচেতন ধারণা দিয়ে পাঠককে মুগ্ধ না-করে সে সুগঠিত ও সুষম জ্যামিতিক ডায়াগ্রামের মাধ্যমে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়।

মাটির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত তার শেকড়। সত্যি কথা বলতে কী, তার শেকড় এত শক্তভাবে পোঁতা যে, ঘাসের নিচ দিয়ে হেঁটে বেড়ায় যেসব কীটপতঙ্গ তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি তার চোখ এড়ায় না। সীমাবদ্ধতার জালে ঢাকা যাদের দৃষ্টি তারা মান্টোর সূক্ষ্ম দেখার চোখ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণক্ষমতা অনুধাবনে ব্যর্থ হবেন। তবে সন্দেহ নেই যে, তার বাড়াবাড়ি রকমের প্রচণ্ড অহংবোধ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার জন্যে প্রতারণাপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। কখনো আবার এমনও ঘটেছে যে, সে জীবন ও সাহিত্যের ভারসাম্যের মধ্যে সফলভাবে আঘাত করতে পারেনি। কারণ এসব ছড়িয়ে আছে কীটপতঙ্গ আর আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের মধ্যে। সেই সময়গুলিতে মান্টো তার অদ্ভুত স্বভাব থেকে পিছলে সরে যায় আর একগুঁয়ে স্বভাবের এক মানুষে পরিণত হয়। এরকম অবশ্য কদাচ ঘটে। তার অধিকাংশ সাহিত্যকর্মেই প্রকাশ ঘটেছে মানবিকতার। সরলতা, সত্য আর উন্নাসিকতার আবহে আবিষ্কার করা যায় তার লেখার শক্তি ও উদ্দীপনা, যেখানে অনিবার্যভাবে ফুটে ওঠে সৌন্দর্য, নম্রতা আর স্নিগ্ধতা, যা সর্বযুগের পাঠকের, এমনকি আজকের পাঠকেরও কাম্য। ওই অভিজ্ঞতা গ্রহণে মানবহৃদয় আজো উন্মুখ।

লেখালেখির শুরুতে মান্টো রুশ সাহিত্য দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। একটা বিষয় খুবই বিস্ময়কর, প্রগতিশীল ধারার লেখকরাই শুধু নন, রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন লেখকরাও, রুশ সাহিত্যের উত্তরাধিকার থেকে লাভবান হয়েছেন। তারপরও মান্টো অল্প সময়ের মধ্যে এমন এক শৈলী রপ্ত করে ফেলে যা একান্তভাবেই তার নিজের। লক্ষ করলে দেখবেন, লোকে  আব্বাস, আশ্ক, ইসমত আর কৃষণ চন্দরের স্টাইল নকল করেছে; কিন্তু মান্টো বা কিছু পরিমাণে বেদীর লেখা অনুকরণ করে সফল হতে পারেনি। উর্দু সাহিত্যে মান্টো ও বেদী একজনই জন্ম নিয়েছিল। এই দুজন ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ লেখকের লেখায় মিল দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে যখন আন্তরিকতার কথা ওঠে, যার মাধ্যমে মান্টো যৌনতার বিষয়টি স্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছিল। হিন্দিসহ অনুবাদে আমি মারাঠি, গুজরাটি আর বাংলা ভাষায় যেসব অনুবাদ পড়েছি, সেখানে এ-ধরনের কোনো নজির আমার চোখে পড়েনি। যৌনতাবিষয়ক ধারণাটি আর এই সংক্রান্ত লজ্জার আবরণটি মান্টোই প্রথম ছিন্ন করে। তারপর সে নোংরা স্তরগুলি ঝেঁটিয়ে বিদায় করে ক্রমাগত এমনভাবে তা ঘষামাজা, ধোলাই ও ঝকঝকে করতে থাকে যে, এ-যুগে আমরা সবাই যৌনতার শক্তি, এর জটিলতা ও প্রভাবকে স্বীকৃতি না দিয়ে পারি না।
এ-ধরনের যৌন শিক্ষা প্রদানের জন্যে মান্টোর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। নিজের যৌবন আর স্বাস্থ্যের মূল্য দিয়ে সে আমাদের ওই শিক্ষা প্রদান করেছিল।

মান্টো বোম্বের অপরাধজগতের দিকে গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল, সেখানে গড়ে ওঠা বসতি, মদের আখড়া আর পতিতালয় সমেত। কালিমা-কলুষে আর নোংরার ভেতর ডুবে গিয়েই সত্যের সন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছিল সে। তার পোশাকে নোংরা লেগে ছিল; কিন্তু তার বিবেক সব ধরনের কলুষ থেকে মুক্ত ছিল, আর তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সবটুকু পরিস্ফুটিত হয়েছিল তার গল্পে। নারীদের মর্যাদা, পারিবারিক জীবন ও শালীনতার বিষয়টি মান্টো যেভাবে সমর্থন করেছে তা আর কারো মধ্যে খুঁজে পাওয়া কঠিন। যখন কোনো নারী তার সম্মান হারাতো, পরিবারের ভেতর যথাযথ স্থান পেত না কিংবা তার মর্যাদা হারাতো, মান্টো প্রচণ্ড অস্থির হয়ে এর কারণ খুঁজে বের করার জন্যে প্রবল গুরুত্বসহকারে অনুসন্ধান চালাত। গভীর পর্যবেক্ষণের পর সে যখন দেখত একই রীতি-আদর্শ, একই সমাজব্যবস্থা এর জন্যে দায়ী – তখন তার মাথা খারাপ হয়ে যেত আর সে প্রবলভাবে ওসবের ওপর আক্রমণ হানতে মরিয়া হয়ে উঠত। আবেদন-নিবেদনে আস্থা ছিল না মান্টোর। তার আস্থা ছিল আক্রমণ আর চপেটাঘাতে। তার সব গল্প শেষ হতো পাঠকের গালে প্রচণ্ড এক থাপ্পড়ের মাধ্যমে, যা তাদের দারুণভাবে অস্থির করে তুলত। আর মান্টো মুখোমুখি হতো তীব্র ভর্ৎসনার। এখানে থেমে যেত না মান্টো, যাকে সমালোচকগণ মর্ষকাম বলে অভিহিত করতেন। ওটা আসলে ছিল মান্টোর আহত মানবতার একটা পরিবর্তিত রূপ। আর এর সবটাই আপনি খুঁজে পাবেন তার আচার-আচরণ, কথাবার্তা, লেখা ও নিত্যদিনের জীবনযাপনে।

মান্টোর জীবনের অনেক ঘটনাই আছে যা তার জীবদ্দশায় লেখা বা বলা যাবে না। তবে একটা ঘটনা না বলে পারছি না। ঘটনাটা সেই সময়কার যখন আমি পুনার শালিমার পিকচার্সের একজন কর্মচারী আর প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে যোগ দিতে আমাকে বোম্বে যেতে হয়েছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে ট্রেনে মান্টোর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিল। মিনিট দশেক এটা-সেটা নিয়ে কথাবার্তা বলার পর মান্টো আমাকে বলেছিল, ‘শোন ভাই, একটা মেয়েকে আমি পুনা পাঠিয়েছিলাম ‘শ’র কাছে। অভিনেত্রী হওয়ার সাধ ছিল তার। তার কপালে কী ঘটেছিল জানো?’

আমি তাকে বলেছিলাম, ‘মেয়েটি এখন ‘প’-এর সঙ্গে থাকে। তার বিষয়ে তোমার নিজেরও কিছু অভিজ্ঞতা আছে।’

মান্টো মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হয়ে বলেছিল, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা। আমার অভিজ্ঞতা শুধু পতিতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ ধরনের সম্মানিত নারীদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আমি কখনো যাই না।’

এটাই ছিল মান্টোর অতি ভিন্ন এবং স্পষ্ট এক স্টাইল। খানিকক্ষণ চুপ থেকে সে বলেছিল, ‘তাকে আমার সত্যি খুব ভদ্র ও শালীন মেয়ে বলে মনে হয়েছিল। তারপরও বলতে হয় – পেটের দায় যে-কোনো মানুষকে ধ্বংস করে ফেলে ও সর্বনাশের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারে।’

এরপর সে চুপ হয়ে গেলে আমি তার ভেতরকার বিবেকের দংশন, লজ্জা আর অন্তরের শুদ্ধতা ও পবিত্রতা উপলব্ধি করতে পারি। সে সব সময় নারীদের সম্পূর্ণ কলুষহীন, সচ্চরিত্র ও পবিত্র দেখতে চাইত। যাকে সে সৃষ্টির উৎস, সৃষ্টি আর সৌন্দর্য বলে বিবেচনা করত, চাইত না সেখানে কোনো কালিমা ও নোংরা থাকুক। এসব সে ধুয়েমুছে ফেলতে চাইত। তার এই মনোভাবকে কেউ কি স্বাস্থ্যকর, সুস্থ, সুন্দর ও পবিত্র ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে? মান্টোর সাহিত্যিক সততা আর আন্তরিকতার সমর্থক হওয়া ছাড়া আমাদের হাতে তখন অন্য কোনো পছন্দ সামান্যই থাকে। আমার তো পূর্ণ আস্থা আছে এতে। তবে এটা নিশ্চয়ই ভিন্ন বিষয় যে, কেবল আমার বিরোধিতা করার জন্য মান্টোকে বেশ কিছু গল্প লিখতে হয়েছিল। এটা করার ক্ষমতা তার ছিল। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়া তার বহুমুখী প্রতিভা ও সাহিত্যিক সক্ষমতার নজির নয়। তার মেধার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মানবজাতির দুঃখ-কষ্ট লাঘবে মানব অস্তিত্ব ও তার প্রতি সহায়ক হওয়ার ইচ্ছের প্রতিফলন। এসবই হচ্ছে তার লেখার সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য, যা কখনোই মুছে ফেলা বা ভোলার নয়।

লেখক-পরিচিতি

[উপমহাদেশের খ্যাতনামা লেখক কৃষণ চন্দরের (২৩শে নভেম্বর ১৯১৪-৮ই মার্চ ১৯৭৭) জন্ম রাজস্থানের ভরতপুরে। তিনি উর্দু, হিন্দি ও ইংরেজিতে লেখালেখি করেছেন। ২০টিরও বেশি উপন্যাস ও ৩০টি ছোটগল্প ও বেশকিছু চলচ্চিত্রের কাহিনি লিখেছেন। ১৬টি ভাষায় তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে। বাংলায় অনূদিত তাঁর উপন্যাস আমি গাধা বলছি, গাদ্দার, অন্নদাতা, ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ ও এক লায়লা হাজার মজনু জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ১৯৭৪ সালে পদ্মভূষণ লাভ করেন।

তাঁকে বলা হয় গণমানুষের লেখক। ভাগ্যহত, বঞ্চিত ও প্রান্তিক মানুষ তাঁর লেখায় গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলার দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, দারিদ্র্য ছিল তাঁর লেখার প্রধান বিষয়। প্রগতিশীল চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ কৃষণ চন্দর ছিলেন একজন মানবতাবাদী, যাঁর লেখার আবেদন বিশ্বজনীন।]

১.  লেখাটি মান্টোকে নিয়ে কৃষণ চন্দরের লেখা একটি বই থেকে নেওয়া, যা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন বিভা. এস. চৌহান এবং খালিদ আলভি।

২. মাওলানা সালাউদ্দিন, কালেমুল্লাহ ও হামিদ আলি খান বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ৎ

* চওড়া কপাল, জুলফি আর চুলের রেখা কানের পেছনে এসে ক্ষীণ হয়ে যায়।

* মান্টো যখন লিখছিলেন, তখন ঘাতান নামটি দেওয়া হয় এক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্যদের, যারা ছিলেন বিশাল এক অভিবাসী শ্রমিক শ্রেণি। এক নামহীন আদিবাসী ঘাতান মেয়ে মান্টোর গল্প ‘বু’-এর প্রধান চরিত্র।

* গ্রন্থটি ছিল কবিতা সংকলন, যার ভূমিকা লিখেছিলেন কৃষণ চন্দর

* গল্পটির নাম ছিল ‘তরক্কি পছন্দ্’

* সারাই কি বাহার কৃষণ চন্দরের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটক। পরে এটি চিত্রায়িত হয়েছিল। তার ভাই মহেন্দ্রনাথ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।