স্মৃতি ও বিস্মৃতির স্থপতি প্যাত্রিক মোদিয়ানো

আন্দালিব রাশদী

‘হুদ্য হেল ইজ প্যাত্রিক মোদিয়ানো?’ ইংরেজি-ভাষী দেশগুলোর পত্রপত্রিকায় তাচ্ছিল্যভরা এ-প্রশ্নটি বেশ পুরু হরফেই ছাপা হয়েছে। প্যাত্রিক মোদিয়ানো ২০১৪ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। নোবেল কমিটি তাঁকে মনে করেছে স্মৃতি ও বিস্তৃতির কারিগর। সুইডিশ অ্যাকাডেমির স্থায়ী সচিব বলেছেন, ‘বলতে পারেন তিনি আমাদের কালের মার্শেল প্রুস্ত।’ সুতরাং আর সব প্রতিযোগীকে পাশ কাটিয়ে তিনি নোবেল পুরস্কার পেতেই পারেন।

কিন্তু কেন নোবেল পুরস্কার পেলেন, প্যাত্রিক মোদিয়ানো নিজেও জানতে চান। ‘ওরা আমাকে কেন বেছে নিয়েছে কারণটা জানতে আমিও আগ্রহী। কেউ তো আর সত্যি-সত্যি নিজের পাঠক হতে পারেন না। তাছাড়া আমার তো ধারণা ৪৫ বছর ধরে আমি একই বই লিখে আসছি।’ তিনি আরো বললেন, এটা তাঁর জন্য অপ্রত্যাশিত; কখনো নোবেল পুরস্কার পাবেন ভাবেননি। পুরস্কার তাঁকে স্পর্শ করেছে, আবেগপ্রবণ করে তুলেছে। তবে পুরস্কারের ভারটি তাঁর কাছে দুর্ভার মনে হয়নি, কারণ তিনি গোঁকুরসহ ইউরোপের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারগুলো আগেই পেয়েছেন; বয়স যখন সত্তর ছুঁই ছুঁই আতিশয্য বেমানানও।

প্যাত্রিক মোদিয়ানো কেবলই লেখক। যেদিন তাঁর প্রথম উপন্যাসটি লিখে শেষ করলেন, সেদিন থেকেই তিনি পুরোদস্ত্তর লেখক; লেখালেখিই হয়ে ওঠে তাঁর একমাত্র পেশা। বললেন, ‘অন্য কোনোকিছু করার কথা কখনো ভাবিনি।’

সে-কালের মার্শেল প্রুস্ত আর ‘আমাদের কালের মার্শেল প্রুস্ত মোদিয়ানো’ দুজনেই যুদ্ধকালের সন্তান, দুজনেই কম বয়সে লিখতে শুরু করেছেন। লেখাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন যৌবনের শুরুতেই। দুজনেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের পুনর্নির্মাণ করেছেন। প্রুস্তের ইন সার্চ অব লস্ট টাইম ১৯১৩ থেকে ১৯২৭-এর মধ্যে সাতখন্ডে প্রকাশিত হয়। সুইডিশ অ্যাকাডেমি এখন তাঁর নাম নিলেও জীবদ্দশায় প্রুস্তকে উপেক্ষাই করেছে। এদিক দিয়ে প্যাত্রিক মোদিয়ানো ভাগ্যবান।

তারপরও প্রশ্ন, মোদিয়ানো কে? এ-প্রশ্নের জবাবে উঠে এসেছে, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে উইলিয়াম ফকনারও তেমন কেউ ছিলেন না।

রয়াল হলোওয়ের ফরাসি ভাষার অধ্যাপক কলিন ডেভিস বললেন, এটা তো তাক লাগানো ব্যাপার। ফরাসি ভাষার কোনো লেখককে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করতে হলে তিনি বরং আলজেরিয়ান ঔপন্যাসিক আসিয়া জেবারকে নিয়ে বাজি ধরতে তৈরি ছিলেন। কলিন ডেভিস একবার মোদিয়ানো সম্পর্কে লিখেছিলেন, লেখক হিসেবে পরিগণিত হতে হলে তাঁকে আরো অনেক দূর যেতে হবে। মোদিয়ানোকে অনেক সমালোচকই সমকালীন ফরাসি কথাসাহিত্যের একটি কেন্দ্রীয় সত্তা বলে বিবেচনা করেননি।

ফরাসি উপন্যাসের স্বনামধন্য সমালোচক জন স্টারক বলেছেন, আমার কোনো সন্দেহ নেই (যে মোদিয়ানোর পুরস্কারপ্রাপ্তিতে) ফরাসিরাও বিস্মিত হয়েছে।

কোনো সন্দেহ নেই ইংরেজি বইয়ের বাজারে যেখানে গোয়েন্দা কাহিনির বিক্রি মিলিয়নের হিসাবে, সেখানে মোদিয়ানোর বুদ্ধিবৃত্তিক গোয়েন্দাবৃত্তি ঠাঁই পায়নি, পেয়েছে ল্যাটিন আমেরিকায়, জার্মানিতে এবং এমনকি সুইডেনে। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগে স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে মোদিয়ানোর ২৮টি গ্রন্থ, জার্মান ভাষায় ২১টি এবং সুইডিশে ১২টি। ব্রিটেনে ইংরেজিতে অনূদিত মাত্র পাঁচটি, প্রকাশকও সংস্করণ ফুরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনর্মুদ্রণ প্রকাশে উদ্যোগী হননি।

মাইকেল উড লিখেছেন : মোদিয়ানো বলেন, ‘অন্য ঔপন্যাসিকের মতো তিনিও সবসময় একই বই লিখে চলেছেন।’ একই বই লেখার প্রশ্নে মোদিয়ানো সম্ভবত সবার চেয়ে বেশি এগিয়ে। তাঁর চরিত্রগুলো পুরনো সাক্ষ্যের চিহ্ন সংগ্রহ করে; হস্তাক্ষর, ফটোগ্রাফ, পুলিশ ফাইল, সংবাদপত্রের ক্লিপিং জমিয়ে রাখে। তারা হারিয়ে যাওয়া মানুষের পদচিহ্ন অনুসরণ করে, যাদের করার কিছু নেই এমন বেকার প্রাইভেট ডিটেকটিভের মতো অন্যের ব্যক্তিগত জগতে উঁকি দেয়। মোদিয়ানোর ব্যক্তিগত আগ্রহের ভার কাঁধে নিয়ে তারা বিশেষ করে প্যারিসের উপকণ্ঠের রাস্তাঘাট সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে, অবিরাম ঠিকানা টুকে যায়, পুরনো ডিরেক্টরি ঘাঁটে, অকেজো টেলিফোন নম্বরে আঙুল চালায়। তাদের চরিত্র কখনো পেয়ে যায় মোদিয়ানোর নিজের পরিচিতি, তাঁর বয়স, তাঁর পিতামাতা, তাঁর অসমাপ্ত স্কুলপাঠ, কখনো তাঁর পেশাজীবন; যেমন দোরা ব্রুদের বর্ণনাকারী মোদিয়ানোর উপন্যাসটি লিখে দিয়েছেন। তারপরও মোদিয়ানো-পরিচিতির অনেকটাই বাকি রয়ে যায়। তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন নাৎসি-অবরুদ্ধ প্যারিস। তাঁর প্রধান হাতিয়ার অসাধারণ ‘স্মৃতির শৈলী’। তিনি যখন মিসিং পারসন উপন্যাসের জন্য গোঁকুর পুরস্কার পেলেন, বললেন, গোঁকুর হচ্ছে মিস ফ্রান্স। নোবেলকে হয়তো বলবেন, মিস ইউনিভার্স।

মোদিয়ানো প্রতিদিনই লেখেন; বলেছেনও, ‘প্রতিদিন না লিখলে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়।’

এখন তাঁকে মনে করা হচ্ছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি করা দ্বিতীয় প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথক। তিনি ঐতিহাসিক নন, কথাশিল্পী – তিনি ঘটনার বিবরণ দিতে পারেন না, উপস্থাপন করতে পারেন এর ছায়া।

যুদ্ধোত্তর ফ্রান্স তার অগৌরবের যুদ্ধকালীন ইতিহাস বলতে চায়নি, কিন্তু সময়ের সঙ্গে ইতিহাসের ধারাও বদলেছে। এখন মোদিয়ানোর মতো লেখক খুলে ফেলছেন অগৌরবের আবরণ। তিনি স্মৃতি খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে তুলছেন। অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন – ওই তো আমাদের পাপ, আমাদের গ্লানি।

মাইকেল উড লিখেছেন, মোদিয়ানো টুকরো টুকরো অতীতকে স্মরণ করেন, কিন্তু যা ভোলেন না তা হচ্ছে খা-খা করা বর্তমান। ক্যালেন্ডারের বছর, মাস ও দিন। মোদিয়ানোর সময় ফিরে আসে না; সেই সময় খন্ড খন্ড করে সাজানো হয়, সময়ের ক্যাটালগ তৈরি হয়, হারিয়ে গেছে মনে করেই সময়কে স্মরণ করা হয়।

মোদিয়ানো নিজেই বলেছেন, যাদের পায়ের তলায় মাটি নেই, শেকড় নেই, আমি তাদের মতোই আমার প্রাক-ইতিহাসের প্রতি বাতিকগ্রস্ত। আর আমার প্রাক-ইতিহাস (নাৎসি) অবরোধে সংকটপূর্ণ এবং লজ্জাজনক। ইহুদি পরিবারের ছন্নছাড়া ব্যথিত সন্তান হলোকস্টের খুঁটিনাটি থেকে একটি একটি করে উপন্যাস টেনে এনেছেন এবং বলছেন, সব মিলিয়ে তিনি একটি বই-ই লিখে চলেছেন।

বুদ্ধিজীবী সমালোচকদের কেউ কেউ জোর গলায় বলেছেন, প্যাত্রিক মোদিয়ানোর নামই শোনেননি।

কেউ বলেছেন, হোয়াট অ্যা জোক? এ কেমন ঠাট্টা?

কেউ কেউ বলেছেন, ‘এ কী; মাঝারি গোছের একজন ডিটেকটিভ কাহিনি লিখিয়েকে সর্বোচ্চ শৃঙ্গে তোলা হয়েছে। সুইডিশ অ্যাকাডেমি আগেও কাউকে কাউকে অন্ধকার থেকে তুলে এনে পুরস্কৃত করেছে, তাঁরা আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেছেন। প্যাত্রিক মোদিয়ানোর বেলাতেও কী তা-ই ঘটবে?’

 

পরিচিতি

প্যাত্রিক মোদিয়ানোর জন্ম ৩০ জুলাই ১৯৪৫, ফ্রান্সের প্যারিস নগরীর উপকণ্ঠে ইহুদি বাবা আলবার্তো মোদিয়ানো ও বেলজীয় অভিনেত্রী মা লুইসা কলপাঁর সংসারে। বাবা-মায়ের দাম্পত্য সম্পর্ক মোটেই শান্তিপূর্ণ ছিল না, একসময়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল আরো খারাপ। তিনি স্কুল পালিয়েছেন, আবার ফিরে এসেছেন। মায়ের বন্ধু র‌্যায়মঁ কোনোর কাছ থেকে জ্যামিতির পাঠ নিয়েছেন, সাহিত্যের প্রেরণা পেয়েছেন। প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। ১৯৭০-এ বিয়ে করেন। দুই কন্যাসন্তান জিনা (১৯৭৪) ও ম্যারি (১৯৭৮)। তাঁর বইয়ের সংখ্যা তিরিশ। সিনেমার জন্য লাকোম লুসিয়েন নামের একটি চিত্রনাট্যেরও তিনি সহ-রচয়িতা। ইউরোপের প্রধান সাহিত্য পুরস্কারগুলো তিনি পেয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় নোবেল সাহিত্য পুরস্কার হয়তো অবিশ্বাস্য নয়। ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে মিসিং পারসন, আউট অব দ্য ডার্ক, দোরা ব্রুদে, হানিমুন, নাইট রাউন্ডস, অ্যা ট্রেস অব ম্যালাইস, ক্যাথেরিন সার্টিচিউড।

কেবল উপন্যাস রচনা নয়, সিনেমা ও টেলিভিশনের জন্য যেমন চিত্রনাট্য লিখেছেন; ক্যাথেরিন দানিয়ুবের মতো একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন।

 

কেন মোদিয়ানো?

সুইডিশ অ্যাকাডেমির স্থায়ী সচিব পিটার ইঙ্গলুন্ড বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে যা বলেছেন, তা এরকম।

প্রশ্ন : এ-বছরও কোনো আমেরিকান নয় কেন? কারণটা কী?

উত্তর : (অ্যালিস) মুনরো (১৯১৩ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী) কানাডিয়ান। আমার বিশ্বাস কানাডা উত্তর আমেরিকা মহাদেশই; কাজেই আমেরিকা আছে, অ্যাকাডেমিতে আমাদের তো আর কোনো কোটার হিসাব নেই; সাহিত্যমানের ওপর ভিত্তি করেই এ-পুরস্কার। বহু লেখক আছেন যাঁরা নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন। এ নিয়ে কখনো পুরোপুরি সুবিচার করা যাবে না। এর গাণিতিক হিসাব একটি অসম্ভব ব্যাপার। বছরে দেওয়ার মতো আমাদের একটিমাত্র পুরস্কার; কিন্তু যোগ্য লেখকের সংখ্যা অনেক। নির্মম সত্যটি হচ্ছে, যোগ্য সকলকে আমরা কখনো পুরস্কৃত করতে সমর্থ হবো না।

প্রশ্ন : এ-বছরের বিজয়ী মিস্টার মোদিয়ানোর ব্যাপারে আপনারা কখন সিদ্ধান্ত নিলেন?

উত্তর : এক সপ্তাহ আগে অ্যাকাডেমি একটি ট্রায়াল ভোটের মাধ্যমে তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত করে। আনুষ্ঠানিক ভোট হয়েছে আজই (৯ অক্টোবর ২০১৪)। তারপর এবারের প্রক্রিয়ার সমাপ্তি।

প্রশ্ন : যদি মিস্টার মোদিয়ানোকে পড়তে হয়, তাহলে তার কোন বইটি দিয়ে আপনি শুরু করতে বলবেন? এবং কেন?

উত্তর : মিসিং পারসন দিয়ে শুরু করছেন না কেন – মিস্টার মোদিয়ানো গোয়েন্দা ধারার লেখা নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন – এর একটা ফিল্মি প্রেক্ষাপট রয়েছে। তিনি বহুলচর্চিত গোয়েন্দা উপন্যাস ধাতের লেখা নিয়ে খেলেছেন – কিন্তু এখানে একজন গোয়েন্দা নিজেকেই আবিষ্কার করতে মাঠে নেমেছেন – তিনি কে? আমি সুইডিশ, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজিতে বইটি পড়েছি। তারপর বেছে নিতে পারেন দোরা ব্রুদে – এটি ১৯৪১-এ হারিয়ে যাওয়া ১৫ বছর বয়সী একটি ফরাসি-ইহুদি মেয়েকে নিয়ে লেখা।

প্রশ্ন : আপনি তো নিজে ঐতিহাসিক। মোদিয়ানোর ঐতিহাসিক বিবরণী নিশ্চয়ই আপনার মনোপুত?

উত্তর : হ্যাঁ, অবশ্যই, কিন্তু মিস্টার মোদিয়ানো তো উপন্যাস রচনা করেন। স্মৃতি নিয়ে কাজ করে ঔপন্যাসিক হওয়া আর স্মৃতি নিয়ে কাজ করে ঐতিহাসিক হওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। তাঁর রচনা আপনাকে থামিয়ে দেয়, এককদম পিছিয়ে নিয়ে যায় এবং আপনাকে বুঝিয়ে দেয় ইতিহাসে যা ঘটেছে তা ধারণ করা খুব কঠিন – এর অনেক ভয়ংকর বিপজ্জনক উপাখ্যান। ঐতিহাসিক হিসেবে তাঁর উপন্যাস পড়া আপনার ভেতর বিনয়ের অনুপ্রবেশ ঘটায় – আপনার এতো বেশি স্বাধীনতা নেওয়া অসমীচীন। তাঁর অতীত অনুসন্ধান সবসময় শূন্যতায় গিয়ে শেষ হয়। তিনি যা চান, তা পান না – এটা একসময় মিলিয়ে যায় সচল ও সত্যান্বেষী পথে। ঐতিহাসিক হিসেবে কেউ এটা ভাবতে প্রলুব্ধ হতে পারেন যে, অতীতের সবকিছুই তার করতলে – কিন্তু এটা তো অবশ্যই সত্য নয়।

ফরাসি রাজনীতিবিদরাও পড়াশোনা করেন। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ বলেছেন, মোদিয়ানো তাঁর পাঠককে নাৎসি দখলদারিত্বের অন্ধকার যুগের গভীর সংকটে পৌঁছে দেন আর তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেন ঘটনাপ্রবাহে ব্যক্তি কেমন করে হারিয়ে যায়, আবার খুঁজেও পায় নিজেদের।

 

এ-কালের মার্শেল প্রুস্ত?

নোবেলবিজয়ী মোদিয়ানোর বন্দনায় সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁকে এ-কালের মার্শেল প্রুস্ত আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু প্রুস্তবিশেষজ্ঞ এডমুন্ড হোয়াইট তা মানতে রাজি নন। মার্শেল প্রুস্ত যেখানে দীর্ঘ ও ব্যাকরণগতভাবে জটিল বাক্য রচনা করে থাকেন মোদিয়ানো সেখানে নিরাভরণ সরল বাক্যে লিখে থাকেন। প্রুস্ত স্পষ্টই মহাযুদ্ধের সামাজিক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন, মোদিয়ানো সেখানে রাজনীতি এড়িয়ে চলেন; ব্যতিক্রম কেবল নাৎসি অবরোধকাল। প্রুস্তের চরিত্রগুলো বর্ণিল ও অমোচনীয়, মোদিয়ানোর চরিত্র সাধারণত অনেকটা পেনসিল স্কেচের মতো।

এডমুন্ড হোয়াইট বলেছেন, বরং মোদিয়ানো এ-কালের একজন আদর্শ ফরাসি লেখক। যিনি বছরে একটি বই লেখেন; যাঁর কাজগুলো সহজ ভাষায় ছোট ছোট বাক্যে তৈরি; যিনি জনপ্রিয় ধারার যেমন ধরা যাক অপরাধ উপন্যাসে মোচড় দেন, যিনি কৌতুকপ্রবণ নন, যার এক একটি উপন্যাস হতে পারে দীর্ঘ উপন্যাসের এক একটি অধ্যায়ের মতো। মোদিয়ানো তাঁর ব্যক্তিগত ইতিহাসকে বিস্তৃত সামাজিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেন।

মোদিয়ানোর চরিত্র অতীতের সঙ্গে সমঝোতা করে বর্তমানে শান্তি খোঁজে; অতীত ও বর্তমান তাঁর কাছে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

প্রুস্তের সঙ্গে তুলনার যথার্থতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন থাকতেই পারে। বিশ্বসাহিত্যের অন্তরঙ্গ পাঠকরা দেখেছেন, মোদিয়ানো অনুসরণ করছেন সঁতাদাল, প্রুস্ত, বোরহেস ও ভার্জিনিয়া উলফের পদক্ষেপ।

মাইকেল উড লিখেছেন, প্যাত্রিক মোদিয়ানোর কাহিনি সবসময়েই খুব নিবিড়ভাবে সময়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সময়ই তার প্রধান চরিত্র। ব্যক্তি মুখ্য, সময় গৌণ হলেও তা মোদিয়ানোর নির্মাণ-মাধ্যম, তাঁর কাঠামোর অভিভাজ্য স্তম্ভ।

 

অন্তরালের লেখক

যে-কোনো আলোচনায়, যে-কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিতি তিনজন ছাড়িয়ে গেলে তিনি অস্বস্তিবোধ করতে শুরু করেন। ১৯৭০-এ যখন দোমিনিককে বিয়ে করেন, ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা নিয়ে আসামাত্র একজনও ফিল্ম আনতে ভুলে যান। তাঁদের বিয়ের টিকে থাকা একমাত্র ছবিটি পেছন দিক থেকে নেওয়া এবং নবদম্পতি তখন একটি ছাতার নিচে। মোদিয়ানো কদাচিৎ সাক্ষাৎকারে মুখোমুখি হয়েছেন; নিভৃতে রেখেছেন তাঁর প্রকাশ্য জীবন। তিনি বর্তমানের চেয়ে বেশি উৎসুক রহস্যময় অতীতে ফিরে যাওয়া নিয়ে, কোলাহল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন নির্জনতায়; হারিয়ে যাওয়া মানুষ ও তাদের স্মৃতি-বিস্তৃতির দৃশ্যপট উদ্ধার করতে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। ফ্রান্স টুডে লিখেছে : প্যারিসবাসী মোদিয়ানো জানেন কেমন করে মিডিয়ার আলো থেকে দূরে থাকতে হয়। সাহিত্যের ককটেল পার্টিতে যে তাঁর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বেন তার উপায় নেই; তিনি টকশোতে যান না, সাক্ষাৎকারও দেন না। নোবেলের শক্তি তাঁকে কিছুটা বাইরে টেনে এনেছে।

যত অন্তরালের লেখকই হোন না কেন তাঁকে কি নীরব স্ট্র্যাটেজিস্ট বলা যায় না? ইংরেজিতে তেমন অনূদিত না হোন, নোবেল পাওয়ার আগেই সুইডিশ ভাষায় তাঁর একডজন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার মানে তিনি সুইডিশ অ্যাকাডেমির নজরের বাইরে ছিলেন না। তিনি অন্তরালে থেকেও সফল। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে বছরের পর বছর ধরে ফিলিপ রথকে নিয়ে মাতামাতি করছে, ন্যাডব্রোক হইচই করছে হারুকি মুরাকামি নিয়ে, বুদ্ধিজীবীরা আফসোস করছেন মিলান কুন্ডেরার জন্য, মোদিয়ানো তো ভালোই দেখালেন।

 

নোবেল এফেক্ট

নোবেল পুরস্কারের সরাসরি প্রভাব বইয়ের কাটতির ওপর। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের বইয়ের দোকানগুলোর শেলফে বলতে গেলে প্যাত্রিক মোদিয়ানোর কোনো বই ছিল না। যখন চাপ পড়েছে, বাজারে অনূদিত মোদিয়ানো আসছেন; তড়িঘড়ি করে অনূদিত গ্রন্থ প্রকাশের আয়োজন চলছে। ফ্রান্সে মোদিয়ানো বিক্রি বাড়লেও নোবেল বিজয়ের প্রথম সপ্তাহে তাঁর উপন্যাস বেস্ট সেলারস লিস্টে ঠাঁই পায়নি। কোরিয়া হেরাল্ড জানিয়েছে, নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর চারদিনে মিসিং পারসনের অনলাইন বিক্রি ৩০০ কপি ছুঁয়েছে। ২০১০ সালে মিসিং পারসন দক্ষিণ কোরিয়ায় বিক্রি হয়েছে ১২০ কপি। প্রকাশনা সংস্থা মানহ্যাকডঙ্গ-প্রকাশিত মোদিয়ানোর বই মাসে গড়ে ১০ কপি বিক্রি হতো। কিন্তু পুরস্কার ঘোষণার পর ১৩ হাজার কপি ছেপেছে; চাহিদা বুঝে আরো দশ হাজার ছাপার প্রস্ত্ততি নিয়েছে। তাক লাগানো ব্যাপার ঘটেছে তেহরানে। সেখানে মোদিয়ানো বেস্ট সেলারস লিস্ট দখল করেছেন। ইরানে মোদিয়ানোর ছয়টি উপন্যাস অনূদিত হয়েছে। মোদিয়ানোর উপন্যাস মূল ফরাসি থেকেই হোক কিংবা ইংরেজি থেকেই হোক, অনুবাদের ধুম পড়েছে। বাংলাদেশেও অন্তত তিনজন একই সঙ্গে মোদিয়ানোর উপন্যাস অনুবাদ করে চলেছেন। বাংলাদেশে মোদিয়ানো-আগ্রহ বাড়ছে।

 

লেখালেখি নিয়ে

* আমার স্বীকারোক্তি দেওয়ার মতো কিছু নেই, পরিষ্কার করে বলার মতো কিছু নেই, আর আমার আত্মপরীক্ষারও কোনো প্রয়োজন নেই। বরং যা কিছু অাঁধারে এবং রহস্যময় তা-ই আমাকে বেশি আগ্রহী করে তোলে।

* (আমি যখন লিখতে শুরু করি) তখনো আমার বয়স কুড়ি হয়নি, কিন্তু আমার স্মৃতির শুরু জন্মেরও আগে থেকে।

* আপনি জানেন না আপনি কোথায় যাচ্ছেন। কিন্তু আপনি জানেন এভাবে আপনাকে চলতে হবে।

* যাতে কোনো রহস্য নেই, আমি তার মধ্যেও রহস্য খুঁজতে চেষ্টা করি।

* আমার গোয়েন্দা উপন্যাসের মূল থিমগুলো আমি যেসব বিষয়ে বাতিকগ্রস্ত যেমন অন্তর্হিত হওয়া, পরিচিতির সংকট, স্মৃতিভ্রষ্টতা এবং রহস্যময় অতীতে ফিরে যাওয়া – গভীর অন্তরঙ্গে এসবের খুব কাছাকাছি।

* আমি সবসময়েই ইচ্ছে ও নস্টালজিয়া লালন করেছি – আমি গোয়েন্দা উপন্যাস লিখতে সমর্থ হবো।

* আমি ইংরেজি ভালোই পড়তে পারি, কিন্তু বলতে পারি না। এটা আমার জন্য খুব কঠিন কাজ।

* আমার স্মৃতি আমার জন্মেরও আগেকার। আমি নিজেকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছি – যেমন (নাৎসি) অবরোধকালীন প্যারিস সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে –  সে-সময়কার কিছু চরিত্রের কথা আমি মনে করতে পারি, সঙ্গে মনে পড়ে অন্তরঙ্গ ও বিচলিত করা কিছু বিবরণ –  যা ইতিহাসের বইতে অনুল্লিখিত রয়ে গেছে।

* পেছন ফিরে তাকানোর বাতিক আমার বরাবরই ছিল, কিছু একটা যে হারিয়ে গেছে, সেই অনুভূতি জেগে উঠত; এটা ঠিক প্যারাডাইস লস্টের মতো নয়। কিন্তু অবশ্যই কিছু একটা হারিয়ে গেছে।

 

সাক্ষাৎকারের টুকরো টুকরো কথা

* আমি লিখতে শুরু করেছি অনেক আগে, আমার বয়স তখন কুড়ির ঘরে। এখন থেকে বহু বছর আগে। লেখালেখির ব্যাপারটা আমার জন্য প্রকৃতিগত, অনেকটা আমার জীবনের অংশ।

* আসলে আমি অন্যকিছু করার কথা ভাবিনি। আমার কোনো ডিপ্লোমা ছিল না, অর্জন করার মতো কোনো লক্ষ্যও না। এত কম বয়সে শুরু করাটা একজন তরুণ লেখকের জন্য বেশ কঠিন কাজ। আমার আগের বইগুলো আমি বরং পড়তে চাই না। তার মানে এই নয় যে আমি এগুলো পছন্দ করি না। আসলে সেখানে আমি আর নিজেকে চিনতে পারি না। ব্যাপারটা একজন বৃদ্ধ অভিনেতার তারুণ্যে প্রধান চরিত্রে নিজেকে দেখার মতো।

* (নোবেল পুরস্কার নিয়ে) মনে হয়েছে আমি দ্বিতীয় কাউকে দেখছি, আমার নামে তাঁর নাম –  যেন এমন কাউকে উদযাপন করছি। আমি মোটেও প্রত্যাশা করিনি।

* দীর্ঘসময় ধরে আমি একই স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি – আমি স্বপ্ন দেখছি আমাকে আর লিখতে হবে না; আমি মুক্ত। কিন্তু হায়! আমি মুক্ত হইনি। আমি এখনো একই চড়াই-উতরাই সাফ-সুতরো করে চলেছি – মনে হচ্ছে এর কোনো শেষ নেই।

* ২০১১-তে বার্লিন সফরের সময়ে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেছেন :  শহরের দীর্ঘ জ্যামিতিক সড়কগুলো ইতিহাসের চিহ্ন বহন করে। কিন্তু যদি সরাসরি এগুলোর দিকে তাকান, আপনি এখনো কংক্রিটের নিচে প্রাচীন পতিত জমিনের চিহ্ন খুঁজে পাবেন। এগুলোই আমার প্রজন্মের ভিত্তিমূল।

* প্রতিটি উপন্যাস লিখে শেষ করার পর ভাবি, যাক সব শেষ করেছি। কিন্তু আমি জানি, বারবার আমি ফিরে আসবো খুঁটিনাটি বিবরণ নিয়ে, এসব ছোট ছোট বিষয় আমার জীবনেরই অংশ।

 

সুসান রবিন সুলাইমানের লেখার অনুসৃতি :

উন পেডিগ্রি মোদিয়ানোর সরাসরি আত্মজীবনী হলেও দোরা ব্রুদে উপন্যাসে আত্মজৈবনিক ঘটনাপ্রবাহের সূত্রপাত ঘটেছে। দোরা নামের পনেরো বছর বয়সী মেয়েটির লোকালয়ের সঙ্গে তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বাবা-মায়ের সঙ্গেই ছিল দোরার বসবাস, তিনিও মায়ের সঙ্গে নিত্যই ঘুরে যেতেন এই লোকালয়ে। তাঁর শৈশব, তাঁর মা, তাঁর নৈঃসঙ্গ্য, তাঁর প্রেমিক – সবকিছুর সঙ্গে শনাক্ত হয়ে আছে দোরা-কাহিনি। দোরা অপছন্দের বোর্ডিং স্কুল থেকে পালিয়ে যায়, তার খোঁজে মা-বাবা পত্রিকায় হারানো বিজ্ঞপ্তি ছাপায়। কিশোর মোদিয়ানোকে সংসার থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর বাবাও তাঁকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দেন। মোদিয়ানোও একসময় ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে যান। অবশ্য তা ছিল স্বল্পকালীন। বাবা তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করেন, পুলিশ তাঁকে একটি শস্যের ওয়াগনে নিয়ে যায়। দোরার মাধ্যমে তিনি তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে বিশেষ করে বাবার সঙ্গে অসুখী সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরতে থাকেন। ২০০৫-এ প্রকাশিত উর পেডিগ্রিতে বাবার কথা লিখেছেন। মহাযুদ্ধের সময়ে তিনি প্যারিসের কালোবাজারিদের আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন হয়ে ওঠেন। গেস্টাপো-সংযোগ থাকায় তিনি নাৎসি নিপীড়ন এড়াতে সমর্থ হন। ১৯৪২-এ বেলজিয়ামে নায়িকা হওয়ার প্রত্যাশী যে যুবতীর সঙ্গে তাঁর দেখা, তাঁকেই বিয়ে করেন দুবছর পর। ১৯৪৫-এ মোদিয়ানোর জন্ম, দুবছর পর তাঁর ভাই রুডির। তাঁর যে-বর্ণনা তাতে মনে হয়, তিনি মায়ে খেদানো বাপে তাড়ানো অবাঞ্ছিত সন্তান। ১৯৫৭তে রুডির যখন মৃত্যু হয়, মোদিয়ানো মাত্র ১২ বছরের কিশোর। এই বেদনা তিনি বহন করেছেন বছরের পর বছর। তাঁর মতো দোরাও বয়ঃসন্ধিতে ‘বিদ্রোহী’ হয়ে ওঠে। যে সড়ক ধরে মোদিয়ানো পালাচ্ছিলেন, সে-পথেই দোরা নিরুদ্দেশে পাড়ি জমায়। আরো একটি মিল – দুজনই বেছে নেয় একটি শীতার্ত দিন। আপাতত একজন তরুণীর নিরুদ্দিষ্ট হওয়া নিয়ে দোরা ব্রুদে লিখলেও অবরোধকালে নিরুদ্দিষ্ট সকলের জন্যই বইটি মোদিয়ানোর বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য।

 

দোরা ব্রুদে : মাদিয়ানোর লেখা থেকে

আট বছর আগে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪১ তারিখের প্যারিস সয়া পত্রিকার একটি পুরনো কপির তৃতীয় পৃষ্ঠার একটি শিরোনামে আমার চোখ আটকে যায়।

প্যারিস।

হারিয়ে গেছে, একটি তরুণী, দোরা ব্রুদে, বয়স ১৫ বছর, উচ্চতা ১.৫৫ মিটার, ডিম্বাকৃতির মুখাবয়ব, ধূসর-বাদামি চোখ, পরনে ধূসর স্পোর্টস জ্যাকেট, মেরুন রঙের পুলওভার, নেভি-ব্লু স্কার্ট আর হ্যাট, বাদামি জিমনেশিয়াম জুতো। সকল তথ্য জানাবার ঠিকানা মশিও ও মাদাম ব্রুদে, ৪১ বুলভা অরনানো, প্যারিস।

বুলভা অরনানোর চারপাশের জায়গাটার সঙ্গে আমি অনেকদিন ধরে পরিচিত। ছোটবেলায় সাঁ-ওয়ের সস্তা দামের বাজারে আমার মায়ের সঙ্গে যাওয়া-আসা করতাম। বাস থেকে নামতাম ক্লিনাকুয়ে স্টপেজে, কখনো কখনো ১৮ আরোদিসমে টাউন হলের বাইরে – বরাবরই শনিবার আর রোববার বিকেলে।

আমি এই পাতাগুলো লিখছি ১৯৯৬-র নভেম্বরে। বৃষ্টি কদাচিৎ থামে। কাল ডিসেম্বর শুরু হচ্ছে; দোরা পালিয়ে গেছে, ৫৫ বছর এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে। আগেভাগে অন্ধকার নেমে আসে। রাত নামতেই এই বৃষ্টিঝরা দিনগুলোর ধূসরতা ও একঘেয়েমি কেটে যায় – তখন অবাক লাগে এটা কি আসলে দিনের বেলা – নাকি আমরা একটি অন্তর্বর্তী পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি – বিষণ্ণ অাঁধার সাঁঝবেলা পর্যন্ত দিনটাকে ঢেকে রাখছে। তখন রাস্তার বাতি দোকানের জানালা আর ক্যাফের আলো জ্বলে ওঠে। সন্ধেবেলার বাতাস সতেজ করে তোলে, সবকিছুর প্রান্তদেশ শানিত হয়ে উঠছে, চৌরাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম, রাস্তায় দ্রুতগামী জনতা। এতো আলোর ঝলক ও হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে আমি বিশ্বাস করতেই পারি না। এই শহরে দোরা তার মা-বাবার সঙ্গে বসবাস করতো। আমার এখন যে বয়স আমার বাবা যখন তার চেয়েও কুড়ি বছরের ছোট এই শহরেই থাকত। আমার মনে হয়, যা কিছু খুঁটিনাটি সব মনে করে একমাত্র আমিই সেই প্যারিস আর এখনকার প্যারিসের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এমন কিছু মুহূর্ত এসে যায় যখন এই যোগসূত্রটি এগোতে এগোতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; অন্যান্য সন্ধ্যায় গতকালের শহর আজকের পেছনে পলাতক প্রদ্যোত নিয়ে হাজির হয়।

 

ক্যাথেরিন সার্টিচিউড : মাদিয়ানোর লেখা থেকে

এখানে নিউইয়র্কে তুষারপাত হচ্ছে, ৫৯ নম্বর সড়কের ভবনটিতে আমার অ্যাপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি, রাস্তার ওপারে আমি একটি নাচের স্কুল চালাই। কাচের দেয়ালের পেছনে নৃত্য-শিক্ষার্থীরা ব্যালে নাচের পোশাকে ছোট্ট লাফে আয়ের আঙুলের ডগায় ঠেস দিয়ে তাদের চর্চা থামিয়েছে – নাচের স্টেপ পরিবর্তনের এ পর্যায়ে আমার মেয়ে, সেও আমার সহকারী, তাদের জাজ নাচের স্টেপ দেখিয়ে দিচ্ছে।

কমিনিট বাদে আমি তাদের সঙ্গে যোগ দেব।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে চশমাপরা একটি ছোট্ট মেয়ে। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে মেয়েটি তার চোখের চশমা চেয়ারের ওপর রাখে, ওই বয়সে আমিও একইভাবে চশমা রাখতাম, ক্লাস নিতেন মাদাম দিসমেইলোভা। নাচের সময়ে তো কেউ আর চশমা পরে না। আমার মনে আছে, যখন আমি মাদাম দিসমেইলোভার সঙ্গে, দিনের বেলা চশমা না পরেই নাচের চর্চা করতাম, তখন মানুষ আর সকল কিছুর আকৃতির তীক্ষ্ণতা লোপ পেতে থাকত, সবই তখন ঝাপসা মনে হতো। এমনকি শব্দগুলোও মনে হতো গলা চেপে ধরা কথা। চশমা ছাড়া পৃথিবীটা রুক্ষতা হারিয়ে ফেলে; শোয়ার আগে যে বড় বালিশটাতে আমি গাল ঠেকিয়ে রাখতাম, পৃথিবীটা তেমন কোমল ও মোলায়েম হয়ে যায়।

বাবা জিজ্ঞেস করতো, ‘ক্যাথেরিন, তুমি কীসের দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছ? তোমার তো চশমা পরা উচিত।’

বাবার কথামতো আমি চশমা চোখে দিতেই সবকিছু আবার নিজকার তীক্ষ্ণতা ও যথার্থতা ফিরে পেয়ে বদলে যেতো।

আমি যখন চশমা পরি পৃথিবীটা যেমন, তেমন হয়ে যায়।

আমি আর দিবাস্বপ্ন দেখতে পারি না।

 

মোদিয়ানো কি লেখালেখির ভক্ত?

লেখালেখি ছাড়া অন্য কোনো পেশার তিনি ধার ধারেননি। কিন্তু পরিণত বয়সে পৌঁছে তিনি কি এই লেখালেখির খুব ভক্ত? লা ফিগারো পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, লেখালেখি যত না আনন্দের, বরং তার চেয়ে বেশি বোঝা। ‘দীর্ঘ সময় ধরে বারবার আমি একাই স্বপ্ন দেখে আসছি আমাকে আর লিখতে হবে না, আমি মুক্ত। কিন্তু হায়! আমি মুক্ত হইনি। আমি এখনো একই চড়াই-উতরাই সাফ-সুতরো করে চলেছি –  মনে হচ্ছে এর কোনো শেষ নেই।’ শেষ না হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে মোদিয়ানো নিজেকে গুটিয়েও নেননি। লেখালেখিকে কুয়াশার মধ্যে গাড়ি চালানোর সঙ্গে তুলনা করেছেন : ‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি জানেন না, কিন্তু আপনি জানেন এই যাওয়া অব্যাহত রাখতে হবে।’

 

নোবেল-দৌড়ে ফরাসি সাহিত্য

১৯০১ সালের প্রথম নোবেল সাহিত্য পুরস্কারটি রুশ ঔপন্যাসিক লেভ তলস্তয় পাবেন – সুইডিশ বুদ্ধিজীবীদের অনেকে বিশ্বাস করতেন, তলস্তয় নিজেও এতোটা নিশ্চিত ছিলেন যে, নোবেল পুরস্কারের সমুদয় অর্থ দুখোবোর সম্প্রদায়ের কল্যাণে ব্যয় করার জন্য পত্রও লিখেছিলেন। কিন্তু সুইডিশ অ্যাকাডেমি প্রথম পুরস্কারের জন্য মনোনীত করল ফরাসি কবি সুলি প্রুধোঁকে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি নিতান্তই অপরিচিত ছিলেন। নোবেল-দৌড়ে ইংরেজির পর ফরাসির অবস্থান। এ পর্যন্ত ফরাসি ভাষায় ১৭ জন লেখক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন :

 

১৯০১        সুলি প্রুধোঁ                   কবি

১৯০৪        ফেদেরিখ মিস্ত্রাল          কবি

১৯১১        মরিস মাতেরলিঙ্ক         নাট্যকার, বেলজিয়াম

১৯১৫        রোমা রোলাঁ                 ঔপন্যাসিক

১৯২১        আনাতোল ফ্রাঁস             উপন্যাস

১৯২৭        অঁরি বার্গসো                দর্শন

১৯৩৭       রোজার মার্টিন দ্যু গার্ধ     উপন্যাস

১৯৪৭        আঁদ্রে জিদ                  উপন্যাস

১৯৫২       ফ্রাঁসোয়া মরিয়াক          উপন্যাস

১৯৫৭       আলবেয়ার কামু            উপন্যাস

১৯৬০       সা-জন পার্স                 কবি

১৯৬৪       জ্যঁ পল সার্ত্রে               দার্শনিক

১৯৬৯       স্যামুয়েল বেকেট           নাট্যকার

১৯৮৫       ক্লদ সিমো                   উপন্যাস

২০০৮       লে ক্লেজিও                  উপন্যাস

২০১৪        প্যাত্রিক মোদিয়ানো        উপন্যাস

 

১৯৩৩-এর নোবেল বিজয়ী রুশ সাহিত্যিক ইভান বুনিন এবং ২০০০ সালের চীন দেশীয় ঔপন্যাসিক গাও জিনজিয়ান ফরাসি নাগরিক। ১৯৮৪-এর নোবেল বিজয়ী জ্যঁ পল সার্ত্রে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৯৬৯-এর বিজয়ী স্যামুয়েল বেকেট ইংরেজি ও ফরাসি উভয় ভাষায় লিখেছেন।

 

পরিসংখ্যানের খোরাক

সাহিত্যবিচারে কোন লেখক কোন ধর্মানুসারী, কিংবা আদৌ ধার্মিক কি না কিংবা আস্তিক না নাস্তিক – এর গুরুত্ব অতিসামান্য। তবে তার পরিসংখ্যানগত কিছু মূল্য জানতে পারে। প্যাত্রিক মোদিয়ানোর নোবেল সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তি বাড়িয়ে দিলো আরো একজন ইহুদি নোবেল লরিয়েট। এ পর্যন্ত নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ১১১ জন, তাঁদের মধ্যে ১৪ জন ইহুদি। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক দুই ভাগ ইহুদি; সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ১২.৬১ ভাগই ইহুদি বংশোদ্ভূত লেখকরা পেয়েছেন; আর তাঁদের সকলেই মূলত গদ্যশিল্পী। তাঁদের মধ্যে কেবল একজন ইসরায়েলের নাগরিক। কৌতূহলী পাঠকের জন্য তালিকাটি দেওয়া হলো :

 

১৯১০           পল ফন হেইসে         জার্মান

১৯২৭           অঁরি বার্গসঁ              ফরাসি

১৯৫৮          বরিস পাস্তেরনাক      রুশ

১৯৬৬          স্যামুয়েল ইউসেফ অ্যাগনন                                                 ইসরায়েলি

১৯৬৬          ন্যালি স্যাকস           জার্মান

১৯৭৬          সল বেলো               মার্কিন

১৯৭৮          আই বি সিঙ্গার         মার্কিন

১৯৮১           ইলিয়াস কানেত্তি       জার্মান

১৯৮৭          জোসেফ ব্রডস্কি         মার্কিন

১৯৯১           নাদিন গর্দিমার          সাউথ আফ্রিকান

২০০২          ইমার কার্তেজ          হাঙ্গেরিয়ান

২০০৪          এলফ্রিদে এলিনেক     অস্ট্রিয়ান

২০০৫          হ্যারল্ড পিন্টার          ব্রিটিশ

২০১৪           প্যাত্রিক মোদিয়ানো    ফরাসি

 

যতোটা না সাহিত্যমানে, ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে নোবেল-দৌড়ে ইহুদি লেখককরা বেশ এগিয়ে রয়েছেন।

 

‘হারুকিস্ট’ প্রতীক্ষা

লুইস টেমপ্ল্যাডো নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘিরে হালে বাজার পাওয়া একটি শব্দ ব্যবহার করেছেন : হারুকিস্ট।

হারুকিস্ট মানে হারুকি মুরাকামির ভক্ত এবং তাঁর জন্য নোবেল পুরস্কার প্রত্যাশী। ল্যাডব্রোকের বাজিতে কয়েক বছর ধরে শীর্ষস্থানে থাকার পরও হারুকি মুরাকামি এবার যখন আবার বাদ পড়লেন, হারুকিস্টরা ভেঙে পড়েননি, তাঁরা আশায় বুক বেঁধেছেন। দেখা যাক সামনের বছর। ফিলিপ রথ, আদুনিস, কো উন, মিলান কুন্ডেরা, থিয়োঙ্গো বুড়ো হয়ে গেছেন, সামনে তেমন সময় নেই। হারুকি মুরাকামির সামনে এখনো অনেক সময়। সুতরাং প্যাত্রিক মোদিয়ানোতে তাঁদের আপত্তি নেই। খুব চটে আছেন মার্কিন ঔপন্যাসিক ফিলিপ রথের ভক্তরা। বছরের পর বছর ধরে তাঁদের প্রত্যাশা ফিলিপ পুরস্কার পাচ্ছেন। এদিকে লেখক নিজেকে লেখালেখির জগৎ থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। মোদিয়ানো নিয়ে তাঁর কোনো মন্তব্য নেই।

না পাওয়া নিয়ে অ্যান্থনি বার্জেস একবার গ্রাহাম গ্রিনকে নোবেল পুরস্কার পাওয়া প্রশ্ন করেন। বহুবার প্রস্তাবিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে তাঁর নাম। তিনি বললেন, আমি নোবেলের চেয়েও বড় পুরস্কারের প্রতীক্ষায় আছি – আমার মৃত্যু।

গ্রাহাম গ্রিন শেষ পর্যন্ত পুরস্কার পাননি। পাননি এমনকি তলস্তয়।

প্যাত্রিক মোদিয়ানোকে বেছে নিয়ে সুইডিশ অ্যাকাডেমি ভুল করেছে, না ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখনই তার মূল্যায়ন করা যথার্থ হবে না। সময়ের পরীক্ষায় মোদিয়ানো কতোটা উত্তীর্ণ হবেন তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে। নোবেল লরিয়েট অনেক লেখক বিস্মৃত হয়ে গেছেন, নোবেল পাননি এমন অনেকে দাপটে শাসন করে যাচ্ছেন। ফরাসি সাহিত্য থেকে উদাহরণ টানলে মার্শেল প্রুস্তের কথা বলতে হয়। সুইডিশ অ্যাকাডেমি এখন তাঁকে স্মরণ করলেও তখন কিন্তু উপেক্ষাই করেছে।

প্যাত্রিক মোদিয়ানোর মিসিং পারসন

প্যাত্রিক মোদিয়ানোর উপন্যাস মিসিং পারসনের হারিয়ে যাওয়া মানুষটি গোয়েন্দা গি রোঁলা নিজেই। কিন্তু এই মানুষটি স্মৃতিভ্রষ্ট। গোয়েন্দার কাজ হাতে নেওয়ার আগেকার যে-জীবন, স্মৃতি থেকে তার প্রায় পুরোটাই মুছে গেছে। এমনকি তার নাম ও জাতীয়তার সূত্রও হারিয়ে ফেলেছে। অন্যসব মানুষের জীবনের সমস্যা মিটিয়ে রহস্য উদ্ঘাটন করে রোঁলা এবার ফিরে এসেছে নিজের জীবনের কাছে।

তার অতীত বিছিয়ে আছে ১৯৪০ দশকে নাৎসি অধিকৃত প্যারিসে। এটা এমন এক কাল, যে-কালের কর্মকান্ড, নিজের কীর্তি, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক স্মৃতি মানুষ ভুলতেই চেয়েছে। আর কাহিনির নায়ক রোঁলা আক্ষরিকভাবেই স্মৃতির শ্লেট মুছে ফেলেছে – এর প্রতীকী অনুরণন গভীর থেকে উঠে এসেছে। এতোদিন পর সে স্মৃতির টুকরো উদ্ধার করতে চাইছে – একটি থেকে আরেকটি তারপর আরেকটি – প্রলুব্ধকর অনুসন্ধান সিরিজ নির্মিত হয়েছে; একটি তথ্য তাকে নিয়ে গেছে সংগুপ্ত আরেকটি তথ্যের কাছে, প্রতিটি ধাপে ধাপে হেঁয়ালির জালে তাকে বাঁধা পড়তে হয়েছে।

কিন্তু টুকরোগুলো জড়ো করে জিগসো পাজলের ঘর মেলাতে পারে না। একসময়ে গি রোঁলার মনে হয়, রাশিয়া ছেড়ে আসা কোনো ইমিগ্র্যান্টের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। একসময়ে মনে হয়, হলিউডের অভিনেতা জন গিলবার্টের সঙ্গে সে কাজ করেছে। অন্য একটি উৎস তাকে মনে করিয়ে দেয়, সে ল্যাটিন আমেরিকান কূটনৈতিক দলের কোনো একজন। একবার মনে হয়, তার নামের শেষাংশ হচ্ছে ম্যাকইভয়, যুদ্ধের আগেই সে ফ্রান্স ছেড়ে এসেছে। অথবা সে স্টার্ন নামের একজন গ্রিক দালাল, তার নিবাস কখনো রোম, কখনো প্যারিস। সে ছবি, ম্যাগাজিন, বর্ষপঞ্জি, ডিরেক্টরি, চিঠি সব ঘেঁটেছে – কিন্তু কোনো উপসংহারে পৌঁছতে পারে না। ডিটেকটিভ গি রোঁলা যতোই তার জীবনের গল্পের কাছাকাছি আসে ততোই মনে হয় সে এক বিস্মৃত ষড়যন্ত্রের বলি। উপন্যাসটির প্রথম অধ্যায় ইংরেজিতে অনূদিত হলো।

 

মিসিং পারসন

আমি কিছু নই। সেদিন সন্ধ্যায় বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থাকার সময় ক্যাফের টেরাসে সৃষ্ট আবছা ছায়ার আকৃতি ছাড়া আর কিছু নই। উটে উমাকে যখন ছেড়ে গেল, তখনই বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

কয়েক ঘণ্টা আগে এজেন্সির চত্বরে আরো একবার শেষবারের মতো আমাদের দেখা হয়েছিল। বরাবরের মতোই উটে তার বিশাল ডেস্কে, তবে গায়ে কোট চাপানো – কাজেই সত্যিই বিদায়ের একটি আবহ ছিল। তার উলটোদিকে চামড়ার হাতলওয়ালা চেয়ারে যেখানে আমাদের মক্কেলরা বসত, আমি তাতেই বসি। ঝলমলে উজ্জ্বল সাদা বাতি আমার চোখ ঝলসে দেয়।

দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে উটে বলল, ‘তাহলে গি, এই হচ্ছে অবস্থা।’ ডেস্কের ওপর একটি বিচ্ছিন্ন নথি। এটা সম্ভবত কালো মানুষটির  যার চোখেমুখে আতঙ্কের অভিব্যক্তি আর মুখমন্ডল ফোলা ফোলা; তার স্ত্রীকে অনুসরণ করার জন্য আমাদের ভাড়া করেছে। বিকেলে মহিলাটি নিজেও পল ডুমার এভিনিউর কাছে ভিটাল রোডের একটি আবাসিক হোটেলে অন্য একজন ছোটখাটো, ফোলা-মুখ একজন কালো মানুষের সঙ্গে দেখা করল।

চিন্তামগ্ন উটে দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিল; ছোট করে কাটা ধূসরবরণ গালঠাসা দাড়ি। তার বড় স্বচ্ছ স্বপ্নাবিষ্ট চোখজোড়া সামনের দিকে তাকিয়ে। টেবিলের বাম দিকে বেতের চেয়ার, কাজের সময় এটাতেই বসি। উটের পেছনে কালো কাঠের শেলফ দেয়ালের অর্ধেকটা ঢেকে রেখেছে : তাতে সারি সারি রাস্তা ও বাণিজ্যিক ডিরেক্টরি, গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময়ের হরেকরকমের ইয়ার-বুক। উটে আমাকে প্রায়ই বলত, আমাদের পেশায় এগুলোই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এগুলো সে কখনো হাতছাড়া করতে পারবে না। এই ডিরেক্টরি আর ইয়ার-বুকগুলো সবচেয়ে মূল্যবান একটি চলমান লাইব্রেরি তৈরি করেছে – এটা ভাবতে পারো। এগুলোর পাতায় পাতায় মানুষ জিনিসপত্র আর হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর কথা – এই বইগুলোই একমাত্র সাক্ষী।

আমি বইগুলোতে একঝলক চোখ বুলিয়ে উটেকে জিজ্ঞেস করি, ‘এসব ডিরেক্টরি দিয়ে তুমি কী করবে?’ উটে বলল, ‘গি আমি সব এখানেই রেখে যাচ্ছি। আমি এই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে দিচ্ছি না, লিজ চলতে থাকবে।’

দ্রুত চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিল। পাশের সংলগ্ন ছোট  রুমটিতে যাওয়ার দুই কপাটের খোলা দরজা দিয়ে ভেতরের জীর্ণ মখমল-ঢাকা সোফা, ফায়ারপ্লেস আর আয়নাটা দেখা যাচ্ছে – আয়নায় ইয়ারবুক আর ডিরেক্টরির সারি এবং উটের চেহারা প্রতিফলিত হচ্ছে। আমাদের মক্কেলরা প্রায়ই এই রুমটিতে অপেক্ষা করে। একটি পার্শিয়ান কার্পেট কাঠের কারুকাজ করা মেঝে ঢেকে রেখেছে। জানালার কাছে দেয়ালে ঝোলানো একটি প্রতীকী মূর্তি।

‘গি, তুমি কী ভাবছো?’

‘কিছু না। তুমি ভাড়া চালিয়ে যাচ্ছো?’

‘হ্যাঁ, আমি সময়ে সময়ে প্যারিসে ফিরে আসব, আর এই এজেন্সি হবে আমার তখনকার বাড়ি।’

সে একটা সিগারেট কেস বের করে।

বলে, ‘জায়গাটা যেমন আছে তেমন রেখে দিই, তাহলে কষ্ট কম হবে।’

আমরা একসঙ্গে আট বছরের বেশি কাজ করেছি। ১৯৪৭-এ উটে নিজেই এই প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খোলে আর আমার আগে আরো অনেকের সঙ্গে সে কাজ করেছে। উটের ভাষায় আমাদের ব্যবসা হচ্ছে মক্কেলদের ‘সামাজিক তথ্যাবলি’ সরবরাহ করা। কথাটা উটে বারবার বলতে পছন্দ করত – এটা হচ্ছে ‘সমাজের লোকজনের’ সঙ্গে লেনদেনের ব্যাপার।

‘তুমি নিকোতে বসবাস করতে পারবে?’

‘অবশ্যই।’

‘একঘেয়ে লাগবে না?’

সে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে।

‘গি, মানুষকে শেষ পর্যন্ত অবসর নিতে হয়।’

উটে বিশাল দেহটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছ-ফুটেরও বেশি লম্বা, ওজন ২০০ পাউন্ডেরও বেশি।

‘আমার ট্রেন ১০টা ৫৫তে। একদফা ড্রিংক করার মতো সময় আছে।’ আমার আগে আগে হেঁটে করিডোর ধরে এন্ট্রাস হলের দিকে এগিয়ে গেল –  বেমানান ডিম্বাকৃতি রুম, ঝাপসা বাদামি রঙের দেয়াল। কাগজপত্রে ঠাসা একটি পোর্টফোলিও ব্যাগ মেঝেতে পড়ে আছে – ব্যাগটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। উটে এটা তুলে নিল। নিচে একটা হাত দিয়ে ব্যাগটা বয়ে নিয়ে চললো।

‘তোমার কোনো লাগেজ নেই?’

‘আমি আগেই সবকিছু পাঠিয়ে দিয়েছি।’

উটে সামনের দরজা খুলল, আমি হলের আলো সুইচ অফ করলাম। দরজা বন্ধ করার আগে সিঁড়িটিতে একটুখানি থামল। দরজার ধাতব শব্দে আমি ভীষণ অাঁতকে উঠি। এর মধ্য দিয়েই আমার জীবনের একটি দীর্ঘ অংশের সমাপ্তি ঘটল।

‘এটা খুবই লজ্জার তাই না, গি’ বলে উটে তার পকেট থেকে খুব বড় একটি রুমাল বের করে ভ্রু মুছল।

কালো আয়তাকার মার্বেলের ওপর গিল্ট করা অক্ষরের লেখাটি তখনো আছে :

সি.এম. উটে

প্রাইভেট এনকোয়ারিজ

উটে বলল, ‘আমি এটা ছেড়ে যাচ্ছি।’

তারপর চাবি ঘুরিয়ে তালা লাগাল।

আমরা নিয়েল অ্যাভিনিউ ধরে পেরেইরি প্লেস পর্যন্ত হেঁটে এগোলাম। যদিও শীত তেমন দূরে নয়, বাতাস তখনো কোমল, অন্ধকার নেমে এসেছে। পেরেইরি প্লেসে অর্তেনসিয়ার টেরাসে গিয়ে বসলাম। এই ক্যাফেটা উটের খুব পছন্দ। কারণ চেয়ারগুলো বেতের, আগেকার দিনের মতন :

‘আর তোমার কী হবে, গি? মানে, তুমি কী করতে যাচ্ছো?’

‘আমি কিছু একটা খুঁজে ফিরছি।’

‘কিছু একটা খুঁজছো?

‘হ্যাঁ, আমার অতীত।’

আমি বেশ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে কথাটা বলেছি আর এতে উটে হেসে ফেলেছে।

‘আমি সবসময়ে ভাবতাম একদিন তুমি তোমার অতীত খুঁজে বের করবে।’

উটে সিরিয়াস হয়ে চলেছে, তা আমাকে স্পর্শ করেছে।

‘কিন্তু শোনো গি, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না এতে কী লাভ হবে?’

উটে নীরব হয়ে গেল। এখন সে কী ভাবছে? নিজের অতীত?

‘আমি তোমাকে এজেন্সির চাবিটা দিয়ে যাচ্ছি। সময়ে সময়ে তুমি ওখানে যেতে পারবে, আমার তাতে ভালোই লাগবে।’

সে চাবি তুলে ধরলো, আমি ট্রাউজারের পকেটে রেখে দিলাম। ‘নিসেতে আমাকে ফোন করো : কী হচ্ছে, তোমার অতীতের খোঁজে তুমি কেমন করছো, আমাকে জানিয়ো।’

সে উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত চেপে ধরল।

‘আমি কি তোমার সঙ্গে স্টেশনে যাবো?’

‘না, না… এতে আরো কষ্ট লাগবে।’

একটি দীর্ঘ পদক্ষেপে সে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল, আমি হঠাৎ এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করলাম। আমার কাছে এই মানুষটির গুরুত্ব অনেক বেশি। দশ বছর আগে থেকে তাকে ছাড়া তার সাহায্য ছাড়া আমার যে কী হতো – আমি তখন স্মৃতিভ্রষ্ট অবস্থায় কুয়াশায় হাতড়ে বেড়াচ্ছি। আমার নিজের  কেসটা তাকে নাড়া দেয়, তার সঙ্গে যাদের যোগাযোগ তাদের কারো মাধ্যমে আমার জন্য একটি বৈধ আইডেন্টিটি কার্ডও জোগাড় করে।

‘এই নাও’ – সে আমার হাতে একটি বড় খাম তুলে দেয়, এতে একটি আইডেন্টিটি কার্ড এবং একটি পাসপোর্ট। ‘এখন থেকে তোমার নাম গি রোঁলা।’

এই প্রাইভেট ডিটেকটিভ যার পেশাগত সাহায্য আমার অতীতের সাক্ষ্য ও চিন্তাবলি খুঁজতে বারবার আমাকে নিতে হয়েছে, আরো বলল : ‘প্রিয় গি রোঁলা, এখন থেকে আর পেছনের দিকে তাকাবে না – তাকাবে শুধু বর্তমান আর ভবিষ্যতের দিকে। আমার সঙ্গে কাজ করবে?’ আমার জন্য যদি তার কোনো টান জন্মে থাকে, এটা তার কারণেই – পরে আমি জেনেছি সে নিজেও তার অতীত হারিয়ে ফেলেছে; তার জীবনের একটি পুরো অংশ হারিয়ে গেছে, তাকে যে অতীতের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দেবে এমন সামান্যতম চিহ্ন, সামান্যতম যোগসূত্র কোথাও নেই। রাতের বেলা বহুল ব্যবহৃত জীর্ণ কোট গায়ে কালো পোর্টফোলিও ব্যাগ হাতে যে ক্লান্ত বুড়োকে চলে যেতে দেখেছি তার সঙ্গে পুরনো দিনের হ্যান্ডসাম টেনিস খেলোয়াড় হলদে চুলের বাল্টিক ব্যারন কনস্ট্যানটিন ফন উটের মিল কোথায়?