ছোট গল্প

  • নিশি

    মাহবুব আজীজ   শচীনবাবু স্যার তিন-চারদিন আগে আমাদের একজনের কাছে টেলিফোন করেন; আমরা, বছর দশেক আগে কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অস্থায়ী ভিত্তিতে এক বেসরকারি সংস্থার হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজে দেশের নানান অঞ্চলে যাই – প্রকৃতপক্ষে যা ছিল আমাদের পার্টটাইম চাকরি; আর ওই কাজে আমরা তিন বন্ধু যাই বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে, সেখানেই তখন কালীবাড়ি স্কুলের…

  • কলুষ্কাল

    মুর্শিদা জামান   শেষবার চোখ বুজে আসার আগে আয়েত্রির মুখটা ভেসে উঠল জাফরের মানসপটে – এরপর নিটোল অন্ধকার। গাঢ় কালো রঙের ভেতর ডুবতে-ডুবতে তীব্র বেগুনির ঝলকানিতেই যেন-বা মস্তিষ্ক সজাগ হলো ওর। ফের বাস্তবে ফিরে আসার প্রবল আলোড়ন অস্তিত্ব জুড়ে। কানের লতি বেয়ে টপ-টপ করে রক্ত মাটিতে পড়ছে, সেই শব্দটুকুও শুনতে পেল সহসা। এর চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য…

  • মান-সম্মান

    ফারুক মঈনউদ্দীন   লিফটের সামনে অনেক লম্বা সারি। একেকবার লিফট নেমে এলে পিলপিল করে লোক ঢুকে পড়ছে, ঠেলেঠুলে শেষ লোকটি ওঠার পর লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে আবার নাট্যমঞ্চের পর্দার মতো দুপাশে খুলে যায়। তখন ভেতরে টুলে বসা লোকটা বিরক্তিতে উঠে দাঁড়ায়, এই যে লাস্টে কে উঠসেন, নাইমা যান, ওয়েট বেশি। সবশেষে ওঠা লোকটি তার আশপাশের…

  • খনন 

    নাসিমা আনিস   ভ্যানের সামনে পা ঝুলিয়ে বসে বাঁয়ের অপূর্ব দৃশ্যাবলি দেখতে-দেখতে মোবাইলে ছবি তোলে আরোহী দুই নারী। শহুরে তারা। রিজার্ভে যাচ্ছে! ভ্যানচালক তাদের প্রফুলস্নতায় খানেক ধুমো দিয়ে ভ্যান থামায়, – তোলেন, নেইমে শামিত্ম কইরে ছবি তোলেন আপা! সালোয়ার-কামিজের মহিলারা লাফিয়ে নামে। বসন্তমেদুর আকাশের নিচে কী অপূর্ব দেশ, তাই দেখে। সবুজ আর সবুজ। পিচঢালা রাস্তার…

  • বর্ণিল ক্যানভাস

    ওয়াহিদা নূর আফজা   বারিধারা তখনো থরে-থরে দালানকোঠা, বিপণিবিতান, রেস্টুরেন্ট আর বিদেশি দূতাবাসে ভরে ওঠেনি। বিকেল হলেই আমরা বান্ধবীরা, মূলত তালাত আর আমি, শোঁ-শোঁ করে সাইকেল ছুটিয়ে আমেরিকান দূতাবাস পর্যন্ত ছুটে যেতে পারতাম অনায়াসে। তারপর হঠাৎ করে জানি কী হয়ে গেল। খালি জায়গাগুলোর গর্ভ চিরে দুমদুম করে এক-একটা প্যালেস তৈরি হলো। নিরিবিলি শান্ত-স্নিগ্ধ এলাকাটি ভরে…

  • অবিশ্বাসের পিনিস

    সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম বৃষ্টিতে গোছানোর কাজ আগাতে চায় না। পায়ের তলায় প্যাচপেচে কাদায় গোড়ালি বসে, মাটির চুলার নিচ থেকে পানি উঠে। গত কদিনে প্রায় মাইল দশ ভেঙে একেবারে ধানক্ষেতের শেষে বসতভিটের শুরুতে এসেছে নদী, থেকে-থেকেই নামছে নয়নশ্রীর জমি। বর্ষার শুরুতে এবার নাই হয়ে গেল পাশের আলাদী গ্রামটা। আর একটা বানে নামবে এখানকার ভিটেমাটি, ঠিক এমন…

  • এক চিলতে আকাশ

    মাহবুব রেজা   অনেকক্ষণ ধরে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে মিলন বুঝল অহেতুক দাঁড়িয়ে কোনো লাভ নেই। পনেরো মিনিটের মতো হয়ে গেছে। বাসের দেখা নেই। বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছু দূরে ট্রামের লাইন। এক নম্বর ট্রামটা যেখানে এসে থামে বাসস্ট্যান্ডটা তার খুব কাছেই। রাস্তার ওপর দিয়ে ট্রামলাইন। কাইয়াতসো থেকে মিলনকে বাসার কাছে গিয়ে নামতে হলে তাকে বাস অথবা…

  • শিবানি ও সাপ

    রাশেদ রহমান   আমি শিবানি। শিবরামের বউ…। সেদিন আষাঢ়ের তিন, গোদার তিন নম্বর বউ সারাদিন কেঁদে-কেটে অস্থির। কী জল যে সারাদিন ঢালল চোখের! ওরা সহোদর সাত বোন গোদার সাত বউ। সবাই বুড়ো হয়েছে। চুল পেকে হয়েছে শনপাটের মতো সাদা। দাঁত পড়ে গেছে। হাসলে খয়েরি মাড়ি বেরিয়ে আসে। তো, এই বুড়ো বয়সেও ওরা শ্বশুরবাড়ি যেতে কাঁদে।…

  • খসড়া উপন্যাসের সম্ভাব্য প্রথম পরিচ্ছদ…

    মালেকা পারভীন   (এখন শুধু মনে পড়ে, তোমার কথা মনে পড়ে; তোমার কথা মনে পড়ে অনেক কথা মনে পড়ে, এখন শুধু মনে পড়ে, এখন শুধু মনে পড়ে; …মনে পড়ে – মহাদেব সাহা) আমার মনে হয়েছিল, আমি একটা প্রায় ডুবন্ত মানুষকে ভেসে উঠতে সাহায্য করছিলাম। সে-বছরের জানুয়ারির ৩১ তারিখ বা এর কাছাকাছি সময় যেদিন তার সঙ্গে…

  • সুখস্বপ্নের দিন

    চন্দন আনোয়ার   ভরা বসমেত্মর দুপুরের ঘুমে স্বসিত্মকর কিছু স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে অথবা স্বপ্নঘোর শেষ না হতেই কোমর ভাঁজ করে উঠে বসতে-বসতে প্রফেসর হোসেন সিদ্ধান্ত নিলেন, এখনি বেরিয়ে পড়বেন। বাথরুমে এক মিনিট, জামা-প্যান্টে এক মিনিট, ৩০ সেকেন্ডে অ্যাপেক্সের ফিতাওয়ালা স্যান্ডেলে দুই পা ঢুকিয়ে আড়াই মিনিটের নিশ্বাসরুদ্ধ ব্যস্ততা শেষে প্রায় লাফিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে…

  • লজ্জিত ঘাস

    শাহ্নাজ মুন্নী   হেমমেত্মর মধ্যরাত। মৃদুমন্দ ঠান্ডা হাওয়া বইছে। রংপুর শহরের সব মানুষ সারাদিনের কাজকর্ম সেরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাস্তাঘাটে সুনসান নীরবতা। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরের সামনে এসে থামল একটা অ্যাম্বুলেন্স আর চারটা সরকারি গাড়ি। গাড়িবহরের সামনের সাদা জিপ থেকে দ্রুত নেমে এলেন রংপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রিয়সিন্ধু তালুকদার। অন্য গাড়িগুলোর একটিতে পুলিশের দুজন…

  • তিমিরের তীরে

    মনি হায়দার   আপনারা আসমান আলীকে চিনতে পারবেন না। না, আসমান আলী কোনো আশ্চর্য প্রদীপ পায়নি। কিংবা হয়নি কোনো মন্ত্রী-টন্ত্রী। মানুষ হিসেবে ঠিকই আছে। রক্ত, মাংস, কাম, ক্রোধ-রিপু মিলিয়ে আগের মতোই আসমান আলী আছে আসমান আলীর মতোই। প্রশ্ন হচ্ছে – কী এমন ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটল যে আমরা, পরিচিতজনেরা আজ আসমান আলীকে চিনতে পারছি না?…