দেশ বিভাগোত্তর সময়ে ঢাকায় চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা হলে গত শতকের পঞ্চাশ দশকে একদল স্বপ্নবান শিল্পশিক্ষার্থী গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে শিল্পের অনুশীলন শুরু করেন। শিল্পী কাজী আবদুল বাসেত (১৯৩৫-২০০২) তাঁদের অন্যতম। বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রকলায় নিভৃতচারী ও শিল্পে নিমগ্ন শুদ্ধাচারি এক চিত্রকর হিসেবে শিল্পানুরাগী সুধীমহলে তিনি সুপরিচিত। ছাত্রবান্ধব অসাধারণ নিষ্ঠাবান একজন শিক্ষক হিসেবে চারুবিদ্যায় দীক্ষাদানে তাঁর অবদান ভুলবার নয়।
আজ যাঁরা দেশের বড় ও গুণী চিত্রকর, তাঁদের অনেকের মানস গঠনে তাঁর বিশেষ ভূমিকার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। আমি নিজেও তাঁর সরাসরি ছাত্র, আজিমপুরে তাঁর সরকারি আবাসনেও গেছি বারদুয়েক। সেখানেও স্যারের অতুলনীয় আন্তরিকতার স্পর্শ পেয়েছি।
তেলরং মাধ্যমে ফিগার পেইন্টিং ক্লাসে তিনি নিজের হাতে আমার ক্যানভাসে কাজ করে আমাকে ও অন্যান্য শিক্ষার্থীকে শিখিয়েছেন কীভাবে তেলরং প্যালেটে মিশিয়ে পটে প্রয়োগ করলে বর্ণের ঐশ্বর্য থেকে যায়। আমরা দেখেছি বর্ণের জাজ্জ্বল্যমান আভাকে তিনি নমিত করে কেমন নন্দিতভাবে মেলে ধরেছেন। আমাদের মতো শিল্পশিক্ষার্থীদের তাঁর সযত্ন দীক্ষা দেওয়ার এইসব প্রয়াস আমাদের ছাত্রজীবনের অমূল্য স্মৃতি হয়ে মনের গভীরে আজো গেঁথে আছে।
প্রয়াণের বাইশ বছর পর তাঁর চিত্রকর্মের একক প্রদর্শনীর গুরুত্বপূর্ণ এই আয়োজন করল বেঙ্গল শিল্পালয়।
সেখানে এখন চলছে বরেণ্য এই শিক্ষক-শিল্পী কাজী আবদুল বাসেতের চিত্রকর্ম নিয়ে একটি বিশেষ প্রদর্শনী। মূলত দেশের স্বনামধন্য শিল্পসংগ্রাহক আবুল খায়ের, আবুল হাসনাত, মতিউর রহমান, নাসিমুন আরা হক, লুভা নাহিদ চৌধুরী ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সংগ্রহে থাকা তাঁর চিত্রকর্ম নিয়ে এই আয়োজনের শিরোনাম – ‘বৃষ্টিতে রোদের কণা’।
গত ৯ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে অতিথি ছিলেন আবদুল বাসেতের দুই ছাত্র শিল্পী রফিকুন নবী ও সাংবাদিক-শিল্পসংগ্রাহক মতিউর রহমান। তাঁরা প্রিয় শিক্ষকের স্মৃতিচারণ করলেন, বললেন – অসামান্য এই গুণীর প্রকৃত মর্যাদা তাঁর জীবদ্দশায় আমরা দিতে পারিনি। যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রফিকুন নবী তাঁর শিক্ষক ও পরে সহকর্মী বাসেতের সেখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালে আঁকা চিত্রকর্ম দেখে আসার আনন্দস্পর্শী অভিজ্ঞতার বয়ান দিলেন।
এ-প্রসঙ্গে শিল্পী ও শিল্পতাত্ত্বিক মোস্তফা জামান কবি ও শিল্পসমালোচক মাহমুদ আল জামানের উদ্ধৃতি যুক্ত করে বলেন – ‘যে পরিমিতিবোধ দ্বারা তিনি চালিত হয়েছেন’ (মাহমুদ, ২০০৪), তা তিনি ১৯৬৩ সালে ফুলব্রাইট ফেলোশিপ পাওয়ার পর মার্কিন মুলুকের শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউটে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে অর্জন করেছিলেন। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি খ্যাতনামা তিনজন শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁদের শিল্পাদর্শ দ্বারা আলোড়িত হন। শিক্ষক হিসেবে পান নামী শিল্পী পল উইগার্ড, হ্যান্স হফম্যান ও বাবভিক্টকে। আমেরিকায় তখন বিমূর্ত প্রকাশবাদ, কন্সট্রাক্টিভিজম ও পপ আর্ট বহুল চর্চিত। বাসেত এই আবহে শিক্ষা নিলেও এসব শিল্প-আন্দোলনকে অনুসন্ধিৎসু মন দিয়ে কাছ থেকে দেখেছেন। ১৯৬৩ সালে শিকাগোতে এক প্রদর্শনীতে ফিগারেটিভ ও নন-ফিগারেটিভ – দুই ধরনের কাজ করেছেন। অনুমিত হয় যে, এ-পর্বে বাসেত চিত্রচর্চা শুরু করেন – আধুনিকতায় দীক্ষিত হওয়ার সূত্রেই। শিল্পে তাঁর এই বৈশ্বিক শিক্ষা দেশীয় শিল্পের কাজে লেগেছে।
শিক্ষালব্ধ জ্ঞান আর শৈশব থেকে যা দেখে দেখে বড় হয়ে ওঠা সেই জীবনসংস্কৃতি আর গ্রামীণ মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক মানুষের যাপন এই দুটিই বাসেতকে আলোড়িত করেছে। ফলে, আমরা দেখতে পাচ্ছি একদিকে তিনি বিশ্বশিল্পের বিংশ শতকের আধুনিকতায় নিমগ্ন হয়ে প্রকাশবাদী বিমূর্তরীতিতে মজে ছবি এঁকেছেন এবং নিজের চারপাশের গ্রামীণ জীবনকে সহজ সমীকরণে তুলে ধরেছেন। এখানে তাঁর পাশ্চাত্য আধুনিকতার শুদ্ধতাবাদী মানসের সঙ্গে দেশীয় চরিত্রলাভের আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করি। প্রসঙ্গত বলতে পারি, ১৯৮৩ সালে আঁকা তাঁর বিমূর্ত প্রকাশবাদী চিত্রকর্মের পাশাপাশি একই বছরে আঁকা সাদা শাড়ি পরিহিত নারীর ছবি – ‘অপেক্ষা-২’ চিত্রকর্ম আমরা দেখতে পাই।
১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগ আয়োজিত ওই প্রদর্শনী আমি দেখেছি। সে-সময় আমি ঢাকা চারুকলায় চিত্রবিদ্যায় নিয়োজিত, আবদুল বাসেতের ছাত্র। শিল্পকলা একাডেমির গোল গ্যালারিটি সৌকর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছিল তাঁর অসামান্য সব চিত্রকর্মশোভিত হয়ে! সেসব কাজ প্রকাশবাদী বিমূর্ত ঘরানার। চিত্রপটে নানাবর্ণের নমিত প্রয়োগ আর টেক্সচারের বৈচিত্র্য মিলিয়ে তাঁর কাজগুলো যেন শান্ত-স্নিগ্ধ জীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। যদ্দূর মনে পড়ে, শিল্পীর সেই কাজগুলোর অধিকাংশই লালচে আভা এবং হলুদাভ। বর্ণের এ-বিশেষ ধারার প্রতি তাঁর পক্ষপাত বা আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল স্বভাবজাত সহজ-সরল সৌন্দর্য চেতনার প্রতীক। বাসেত এখানে অনেকটাই তাঁর অগ্রজশিল্পী ও সহকর্মী মোহাম্মদ কিবরিয়া দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও তাঁর নিজস্বতার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। এই ঘরানার বেশ কতক চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে সগর্বে স্থান নিয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে এসে দেখতে পাই আবদুল বাসেতের চিত্রপট শোভিত হয়েছে প্রধানত ফিগারেটিভ গঠনের অংকন প্রয়োগে। এখানে আমরা দেখছি, তিনি গ্রামীণ মধ্যবিত্ত কর্মিষ্ঠ নারী-পুরুষ ও শিশুদের চিত্রিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। সংবাদ পত্রিকার সাহিত্যপাতার সম্পাদক, পরে কালি ও কলমের সম্পাদক কবি ও শিল্পসমালোচক আবুল হাসনাতের অনুরোধে তিনি সংবাদ সাময়িকীর পাতায় এ-ধরনের জীবনমুখী ছবি আঁকতে শুরু করেন। সেসব সযত্নে আগলে রেখেছিলেন হাসনাত ও নাসিমুন। এ-প্রদর্শনীতে সেসব অংকনপ্রধান কাজ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। কাগজে সফট প্যাস্টেলে আঁকার পাশাপাশি ক্যানভাসেও বেশ কিছু ফিগারেটিভ কাজ করেছেন শিল্পী তেলরঙে। এই সিরিজের ছবিও প্রদর্শনীতে দেখা গেল। এই কাজগুলোর ক্ষেত্রে শিল্পীর বর্ণলেপনে সুবিদিত দক্ষতার প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করা যায়।
শিল্পী বাসেতের আঁকা অনেক চিত্রকর্মের হদিস আমরা পাই না, দেশে-বিদেশে নানা জায়গায় বিভিন্ন মানুষের কাছে সেগুলো হয়তো আছে। তবে বেঙ্গল শিল্পালয়ের এই আয়োজনে যেসব কাজ আমরা দেখতে পেলাম তাতে প্রায় পঞ্চাশ বছরের শিল্পীজীবনে তাঁর কাজের একটা ধারাবাহিক চিত্র আমাদের দর্শকদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে বলে আমার মনে হয়। যাঁরা বাংলাদেশের চিত্রকলা পড়েন বা পড়বেন, গবেষণা করবেন তাঁদের জন্য এই প্রদর্শনী অবশ্য দর্শনীয়। বিশেষ একটা গৌরবময় পঞ্চাশের দশক থেকে নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ এ-সময় ও এ-সময়ের চিত্রকলা উপলব্ধি করার এ এক অনন্য সুযোগ।
বেঙ্গল শিল্পালয়ে এই প্রদর্শনী চলবে আগামী ১১ জানুয়ারি, ২০২৫ পর্যন্ত, রোববার ব্যতীত অন্যান্য দিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.