‘মেয়েটি ছিলো হাতের পাঁচ/মেয়েটি ছিলো ভালো।
মেয়েটি ছিলো টাকার গাছ / অন্ধকারে আলো।
মেয়েটি ছিলো জলের হাওয়া / মেয়েটি ছিলো নারী
পাতাল তলায় কুড়িয়ে পাওয়া / সোনার তরবারি।’
কবি নারীকে যেভাবে কল্পনা করেন, সে-কল্পনা তার নয়, বরং নারীর প্রতি পুরুষশাসিত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিই উঠে আসে তার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। নারী যেন মানুষ নয়, সে শুধুই নারী। পুরুষের ইচ্ছের যন্ত্র। যখনই সে-যন্ত্র পুরুষের ইচ্ছেগুলোকে বাস্তবায়ন করে না তখনই সে হয়ে ওঠে যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণা থেকে উপশম পেতে পুরুষ নারীর প্রতি যুগ যুগ ধরে চালিয়েছে নির্যাতন, বঞ্চনা।
তিনটি ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন সময়ে তিন নারীর কথা নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘ফুলরানী- আমি টিয়া’ নাটকটি। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের রচনা ও নির্দেশনায় নাট্যজন নিয়মিত প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে এনেছে ‘ফুলরানী- আমি টিয়া’ নাটকটি। আর এ নাটকের একক অভিনয় শিল্পী হলেন মুনীরা ইউসুফ মেমী। নাটকটির আলোক-পরিকল্পনা করেছেন জীবন্ত কিংবদন্তি আলোকপ্রাণপুরুষ তাপস সেন। মঞ্চ পরিকল্পনায় আছেন উত্তম গুহ। পোশাক-পরিকল্পনা বিবি রাসেলের। আবহ সংগীত পরিকল্পনা করেছেন আমানুল হক। আঙ্গিক অভিনয় ও কোরিওগ্রাফিতে সহযোগিতা করেছেন জিল্লুর রহমান জন ও শিবলী মহম্মদ।
অসংখ্য গুণী মানুষের প্রচেষ্টার ফসল ‘ফুলরানী- আমি টিয়া’। ‘ফুলরানী- আমি টিয়া’ নাটকের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে টিয়া। বর্তমানের নারী। ‘উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’, ‘উইমেন রাইট ইজ হিউম্যান রাইট’-এর বর্তমান যুগের এক আধুনিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারী টিয়া। মধ্যবিত্তের আদর্শিক ভাবনার ধারক-বাহক এক নারী। মূল্যবোধ তাকে প্রতিবাদী করে। আর তার প্রতিবাদী চেতনাকে জিইয়ে রাখতে গিয়ে সে হয়ে ওঠে স্বামীহীন, স্বামী-গৃহহীন এক নারী। টিয়া ফুলরানীকে আবিষ্কার করতে গিয়ে আবিষ্কার করে নিজেকে। আবিষ্কার করে ময়নাকেও। ফুলরানী একশ বছর আগের নারী। শ্বশুরবাড়িতে তার প্রতি অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে উন্মাদ আখ্যা পেয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে আসতে হয় তাকে। বাপের বাড়িও তার জন্য নিরাপদ স্থান নয়। কাকাতো, পিসেতো বোনদের বিয়ে আটকে যেতে পারে এই আশঙ্কায় উন্মাদ সেজে অন্দরমহলের অন্ধকুঠুরিতে অবস্থান নিতে হয় তাকে। মাত্র ২৪ বছর বয়সে ফুলরানীর জীবনাবসান ঘটে। সামাজিক ইতিহাসে উল্লিখিত অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটলেও কাহিনী কিন্তু থেমে থাকেনি। নতুনভাবে সংযোজন ঘটেছে টিয়া, ময়না এসব অধ্যায়ের। ফুলরানী থেকে ময়না পর্যন্ত শুধু সময় এগিয়েছে, এদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। প্রায় একশ বছর আগে বেগম রোকেয়া যে-অবস্থা দেখে গেছেন, সুফিয়া কামালও তাঁর অন্তিমযাত্রার সময় তার থেকে উন্নততর কিছু দেখে যেতে পারেননি। সময়-সমাজ-অর্থনীতি-পরিবার আজো নারীকে পুরুষের হাতের ক্রীড়ানক বানাতে চায়। সেখানে ফুলরানী, টিয়া, ময়না আলাদা কোনো অস্তিত্ব নয়। তাদের পরিণতিও এক। শুধু প্রেক্ষাপট ভিন্ন, নাম ভিন্ন, নিগ্রহের ধরন ভিন্ন।
নাটকের মুখবন্ধে বলা হয়েছে, এই নাট্যের কাহিনী দুই নারীকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। বাস্তবে কি তাই? ফুলরানী ও টিয়ার উপস্থিতি মঞ্চে দেখতে পাই সত্যি; কিন্তু টিয়ার অভিজ্ঞতায় যে-ময়নার মঞ্চে ইলেকট্রনিক উপস্থিতি তাওতো কোনো অংশে কম নয়। তবে তাকে অস্বীকার করা কেন? টিয়া যদি ফুলরানীর ‘আত্মকথন’ ধরনের ডায়েরি থেকে তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিতে পারে, তাহলে ভিডিও ফুটেজের ময়নাকে অস্বীকার করা কেন? নাট্যকার ও নির্দেশক কুন্তল মুখোপাধ্যায় এর প্রকৃত জবাব দিতে পারবেন বলে মনে হয়! তবে আমরা দর্শকরা তাঁর জবাবে কতটা সন্তুষ্ট হতে পারব জানি না। কারণ মঞ্চে একটি বালিশ কিংবা ওড়না দিয়ে একটি চরিত্রের উপস্থিতিকে যখন গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়, তখন ভিডিওচিত্রের উপস্থিতি দোষ করল কোথায়? নাকি অন্য (ইলেকট্রনিক) মাধ্যম বলে ধর্তব্যে আনেননি নির্দেশক। নির্দেশক যদি তাঁর ডিজাইনে ভিডিওগ্রাফি সংযোজন না করতেন, তাহলে কি খুব অসুবিধা হতো? বরং মঞ্চের শক্তিটা সঠিকভাবে যাচাই করবার সুযোগও পেতেন তিনি। সেক্ষেত্রে যন্ত্রের যন্ত্রণা (মার্চ মাসের ১৭ তারিখের প্রদর্শনীতে ভিডিও অপারেটিং সমস্যার কারণে ভিডিওচিত্র প্রদর্শনে সাংঘাতিক রকম সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল) থেকেও মুক্তি পেতেন দর্শকরা।
এ-নাটকের কাহিনী এবং সংলাপবিন্যাস খুব উঁচুমানের বলে মনে হয়নি। বরং তাড়াহুড়ো করে সবকথা বলে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। কাহিনী, উপকাহিনী, শাখা কাহিনী হয়ে অনেক অনেক ঘটনা চলে এসেছে দর্শকের সামনে। কোনো একটি ঘটনা বিস্তারলাভে পরিপূর্ণতা অর্জনের আগেই শেষ হয়ে গেছে। এক কাহিনীর থেকে অন্য কাহিনীতে যাওয়ার বিষয়টি খুব মসৃণ নয়। ‘ফুলরানী- আমি টিয়া’ দেখতে দেখতে মনে পড়ে সেলিম আল দীনের ‘যৈবতী কন্যার মন’ নাটকের কথা। দুটি ভিন্ন সময়ের দুই নারীর কথা কী সুন্দর-সার্থক করে বলা হয়েছে সে-নাটকে। কী চমৎকার তার সংলাপ!
কুন্তল মুখোপাধ্যায় নাটকের পণ্ডিত মানুষ। নিজে লেখেন, নিজেই নির্দেশনা দেন। একটি রচনা মঞ্চে কত সুন্দর, নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা যায় সেই ব্যাকরণ তাঁর জানা। ‘ফুলরানী- আমি টিয়া’ নাটকের অনেককিছু আরোপিত মনে হয়। কেন জানি তিনি তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন বা তাড়াহুড়ো করে নির্দেশনার কাজটি সমাপ্ত করেছেন বলে মনে হয়।
শুরু থেকেই নাট্যজন নাটক-নির্বাচনে বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। ‘ঘৃতং পিবেৎ’, ‘একজন পিরামিড’, ‘তেভাগার পালা’ ‘শুধু একাকী’ হয়ে ‘ফুলরানী- আমি টিয়া’। ‘ফুলরানী- আমি টিয়া’র বিষয়বস্তু অসাধারণ।
তারপরেও নাটকটি দর্শকের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছাতে পারেনি। দর্শকের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তবে নাটকের তিনটি চরিত্রের নাম অসাধারণ লেগেছে। সাংঘাতিকভাবে রূপক মনে হয়েছে। ফুলরানী, টিয়া এবং ময়না। ফুল চমৎকার একটি জিনিস। যে-কেউ তাকে নিজের হাতে পেতে চাইবে। নারীর অবস্থাও কি তাই নয়? টিয়া এবং ময়না। সুন্দর পাখি। মুখে বুলিও ফোটে। মানুষ যে বুলি শেখায়, তাই শেখে এই পাখি। নারীকেও পুরুষ তার নিজের ভাষায় বুলি শেখাতে চায়। টিয়া আর ময়না সেই বুলি আওড়াতে চায় না। কারণ তাদের মাঝে আছে আলাদা নারীসত্তা। আছে মানুষ হিসেবে নিজের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ।
আগেই বলা হয়েছে ‘ফুলরানী- আমি টিয়া’ নাটকের একক অভিনয় শিল্পী মুনীরা ইউসুফ মেমী। মেমী মঞ্চে অত্যন্ত উঁচুমানের অভিনয় শিল্পী। আমি তার অভিনয়ের সাংঘাতিক ভক্ত। তার স্বরপ্রক্ষেপণ, বাচনিক অভিনয় রীতিমতো ঈর্ষণীয়। একজন মেধাবী শিল্পীর যেসব গুণ থাকা দরকার তার সমস্ত কিছুই আছে মেমীর মাঝে। মেমীর কাছে আমাদের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। ‘ফুলরানী- আমি টিয়া’ নাটকটি তার জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয়। একক অভিনয় বলেই বিষয়টিকে তিনি নিজেও গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন। না নিয়ে উপায়ও নেই। কারণ বাংলা নাটকে একক অভিনয়ের (নারী চরিত্র) ক্ষেত্রে দর্শকদের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে তৃপ্তি মিত্রের ‘অপরাজিতা’, শাঁওলী মিত্রের ‘কথা অমৃতসমান’, ‘নাথবতি অনাথবৎ,’ বিজয়লক্ষ্মী বর্মনের ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিলো’, ফেরদৌসী মজুমদারের ‘কোকিলারা’ – এসব উজ্জ্বল নাট্যমালা। অভিনেত্রী হিসেবে মেমী উল্লিখিতদের অনুবর্তী হওয়ার চেষ্টা করেছেন নিঃসন্দেহে। একটি নাট্যে প্রধান দুটি বিষয় পাণ্ডুলিপি ও নির্দেশনা। এ দুটি বিষয় অভিনয় শিল্পীকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সেদিক থেকে একটা ঘাটতি তো ছিলই। এবং এই কারণেই মেমীর বাচিক অভিনয় যতটা উজ্জ্বল ছিল, সেই তুলনায় আঙ্গিক অভিনয় অতটা সমুজ্জ্বল ছিল না। তিনি যেন অভিনয় থেকেও দর্শকের অবস্থানটি বেশি করে মাথায় রেখেছেন। একজন মেধাবী শিল্পীর জন্য এটি অবশ্যই একটি ত্রুটি। সংগত কারণে দর্শকের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। যে-উজ্জ্বলতায় মেমীর জ্বলে উঠবার প্রত্যাশা আমরা করেছিলাম, তা পূরণ হয়নি।
ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নাট্যজনের প্রধান সম্পাদক শ্রদ্ধেয় তবিবুল ইসলাম বাবুর একটি বিশেষ আগ্রহের কথা জানা ছিল। মেমীকে দিয়ে একক অভিনয়ের একটি চমৎকার নাটক তাঁর দলের পক্ষ থেকে দর্শকদের উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা, আগ্রহ ও আন্তরিকতার কথা অনেক আগেই জানতে পেরেছিলাম। বিষয়বস্তু নির্বাচন সঠিক হলেও পাণ্ডুলিপিতে অনেক ঝামেলা রয়ে গেছে। তবিবুল ইসলাম বাবুর আন্তরিক প্রচেষ্টাটি সার্থক করে তুলবার জন্য নাটকের পাণ্ডুলিপি ও নির্দেশনার ক্ষেত্রে আরো পরিশ্রম দাবি করে।
‘ফুলরানী- আমি টিয়া’ নাটকের আলোক পরিকল্পনার কাজটি করেছেন তাপস সেন। পুরো নাটকে আলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংযম লক্ষ করি আমরা। কোথাও কোনো বাহুল্য নেই। কোথাও বাড়তি আলোর ব্যবহার নেই। আলোর উৎসও কম। অথচ তাতেই তিনি কী অসামান্য পারঙ্গমতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন ফুলরানী আর টিয়ার মানসলোক। আলোর এমন ব্যবহার দেখবার অভিজ্ঞতা আমাদের খুব একটা হয় না। বিরল অভিজ্ঞতায় আমাদেরকে সমৃদ্ধ করায় শ্রী তাপস সেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। উত্তম গুহের সেটও বাহুল্যবর্জিত, নান্দনিক। তবে মুখোশগুলোর, এমনকি ইজেলের স্ট্যাটিক অবস্থান অনেক সময় চোখে লাগে। মুখোশ ব্যবহারে ভিন্নমাত্রা নিয়ে আসা গেলে ওই সামান্য সমস্যাটুকু কেটে যাবে নিশ্চয়ই। আবহসংগীত, পোশাক পরিকল্পনা নাটকের মেজাজের সাথে মাননসই। তবে অঙ্গবিন্যাস ও কোরিওগ্রাফিতে তেমন কিছু চোখে পড়েনি, যদিও দুজন বিখ্যাত মানুষের নাম সংযোজন করা হয়েছে ফোল্ডারে।
‘ফুলরানী- আমি টিয়া’ নাটকটি নিয়ে নাট্যজন এবং মুনীরা ইউসুফ মেমীকে অনেকদূর যেতে হলে পাণ্ডুলিপি এবং প্লে-ডিজাইন নিয়ে অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.